অনুবাদ গল্পআর্কাইভ

অনুবাদ গল্প : ধনী মানুষ, গরিব মানুষ : মূল : ফারাহ আহমেদ

বাংলা অনুবাদ : নূর কামরুন নাহার

[ফারাহ আহমেদ লেখক ও সম্পাদক। জন্ম কেনিয়ায়। বর্তমানে বসবাস করছেন লন্ডনে। তাঁর লেখা Ploughshares, White Review, LA Review of Books, Massachusetts Review, World Literature Today The Markaz Reviewসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে। White Review, Bridport and Commonwealth prizes-এর জন্য তাঁর গল্প মনোনীত হয়েছিল। তাঁর গল্পগুলোর অধিকাংশের প্রধান চরিত্র নারী। তিনি তাঁর ছোটগল্পে দেখিয়েছেন কীভাবে সংস্কৃতি, ধর্ম সমাজ মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে।]

ধনী মানুষরা কখনই বুঝতে পারে না গরিব হয়ে বাঁচার কষ্টটা আসলে কেমন।

গরিব হলে আপনাকে দেখতে হয় মানুষ কীভাবে মাছির মতো মারা যায়, আর প্রতি মাসে আপনার বেতনের অর্ধেকটা খরচ হয় জানাজা ও দাফনে। গরিব হওয়া মানেই হলো কম বয়সে মৃত্যু, কারণ অসুস্থ হলে আপনার হাসপাতালে যাওয়ার মতো গাড়ি থাকবে না। যদি কোনওভাবে বাসে করেও পৌঁছাতে পারেন, আপনাকে হাসপাতালের ঠান্ডা করিডোরের মেঝেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। আর যখন নার্স অবশেষে আপনাকে ডাকবেন, তখন কোনও বিছানা, ওষুধ বা ডাক্তার থাকবে না। যদি কোনওভাবে আপনি বেঁচেও যান, হয়তো আপনার সন্তানটি মারা যাবে। আর আপনি যখন বুক চাপড়ে কাঁদবেন, তখন সবাই বলবে, ‘এটা আল্লাহর ইচ্ছা। যদি তিনি আপনার সন্তান কেড়ে নিয়েছেন, তবে একদিন তিনি হয়তো আপনাকে এমন একটা সুযোগ দেবেন যাতে আপনি আপনার ভাগ্য বদলাতে পারেন এবং ধনী মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারেন।’

ধনী মানুষেরা শোক করার সুযোগ পায়। তারা প্রতিটি মৃত্যুকে এমনভাবে গুরুত্ব দেয় যেন এটি কোনও দৈনন্দিন ঘটনা নয়। যেমন ধরুন, ম্যাডাম ফরিদা আর মিস্টার আবদুল। আমি তাদের বাড়িতে বারো বছর ধরে কাজ করছি। গত মাসে মিস্টার আবদুল হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন, আর এখন ম্যাডাম ফরিদা দুঃখে ভেঙে পড়েছেন। প্রতিদিন সকালে তিনি বারান্দার স্লাইডিং দরজাগুলো খুলে ঠিক সামনের অ্যাপার্টমেন্টটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। যদি আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘পাশের ফ্ল্যাটের প্রতি এত আগ্রহ কেন ?’ তিনি বলবেন, ‘আমি তাদের নিয়ে ভাবি না―বরং আমি চিন্তিত ওরা কাকগুলোকে কী খাওয়াচ্ছে!’ ধনী মানুষের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, তারা গরিবদের নিয়ে মাথা ঘামায় না, বরং বেশি চিন্তিত হয় পাখিরা না খেয়ে মরছে কি না, সেটা নিয়ে।

ফরিদার পছন্দ ওই পাশের বারান্দার কাকগুলোকে দেখা। ওই অ্যাপার্টমেন্টে যারা থাকে তারা নতুন এসেছেন। তাদের কাকদের খাওয়ানোর খুব শখ। আপনি ভাববেন, এ রকম ধনী মানুষদের পাখিদের জন্য ভালো খাবার কেনা উচিত। কিন্তু না, তারা এমন জিনিসে টাকা অপচয় করতে পছন্দ করে না। তারা তাদের বেঁচে যাওয়া খাবারই কাকদের দেয়। আর ফরিদা দেখেন কাকগুলো কীভাবে ফয়েল প্যাকেটের খাবার ঠোকরাচ্ছে, আর এতে তিনি খুব রেগে যান। আজ সকালে তিনি কসম খেলেন যে তিনি একটা কাককে ঠোঁটে একটা হাড় নিয়ে যেতে দেখেছেন, যা পাশের বারান্দার রেলিংয়ে রাখা লাল-সাদা রঙের কেএফসি বক্স থেকে এসেছে।

‘এরা কী করছে ? কাকদের ভাজা মুরগি খাওয়াচ্ছে!’ তিনি আমাকে বললেন।

আমি বলতে পারিনি, ‘ধনী মানুষরা এমনই, উদাসীন।’ তাই শুধু বলি, ‘জি ম্যাডাম।’ আমি তখন রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে মগগুলো মুছতে ব্যস্ত। মগগুলোর গায়ে লেখা আছে ‘অবসর জীবনের জন্য শুভেচ্ছা,’ যা কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিস্টার আবদুল উপহার পেয়েছিলেন। তিনি কখনও ফরিদাকে সেগুলো ব্যবহার করতে দেননি।

 ‘আবদুল নিশ্চয়ই এটা দেখে স্তম্ভিত হতেন,’ ফরিদা বললেন, ‘তুমি কি মনে করো না, তিনি কীভাবে বিশেষ বীজ এনে পাখিদের খাওয়াতেন আর তাদের ভোজের দৃশ্য উপভোগ করতেন ?’

মিস্টার আবদুল পাখিদের ব্যাপারে ভীষণ যত্নশীল ছিলেন, আর এর পেছনে তার যুক্তিও ছিল। প্রতি সকালে, নাশতার সময় তিনি ফরিদাকে ডেকে বলতেন, ‘দেখো, কাকগুলো কীভাবে পরিবারকেন্দ্রিক। দেখো, তাদের আচরণ কতটা সভ্য। তোমার শেখার মতো অনেক কিছুই আছে, ফরিদা।’

‘তুমি কী বোঝাতে চাইছ  ?’ তিনি জিজ্ঞেস করতেন। ‘কাক তো নিষ্ঠুর আর দুর্ব্যবহারী। এদের থেকে শেখার মতো কিছুই নেই।’

আপনার জানা দরকার, মিস্টার আবদুল কখনই চ্যালেঞ্জ সহ্য করতে পারতেন না। এত বছরে আমি দেখেছি, কীভাবে তিনি ফরিদাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন।

‘তোমার সমস্যাটা কী জানো, ফরিদা, তুমি কখনও ভালো করে তাকাও না।’

‘এই পাখিগুলো তো কেবল একটা ঝামেলা,’ তিনি বলতেন।

‘আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, তবে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতাম যদি ওরা তোমার কথা শুনে, তাহলে প্রতিশোধ নিতে আসবে।’

ধনী মানুষেরা কী অর্থহীন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে, তা ভেবে আমার হাসি পায়। গরিব হলে তুমি ঝগড়া করো বিল নিয়ে, কিংবা তোমার স্বামী কীভাবে জুয়া আর মদে টাকা নষ্ট করছে সেটা নিয়ে। তখন সবসময় একে অপরের ঘাড়ে ঘাড় রেখে ঝগড়া চলতে থাকে, কারণ অন্য কিছু করার মতো সময় থাকে না। কেবল কাজ করো আর বাঁচো, তোমার এক কাপ চা খাবার বিলাসী হবার সময়ও নেই। কিন্তু এখানে দেখো, ফরিদা আর মিস্টার আবদুল কাকদের আচার-আচরণ নিয়ে ঝগড়া করছে।

প্রতিদিন একই ঘটনা। প্রথমে বিষয়টা মজাই লাগত, কিন্তু যখন মিস্টার আবদুল পাখি দেখায় আসক্ত হয়ে পড়লেন, তখন তাদের ঝগড়া আরও তীব্র হতে লাগল। যা ফরিদাকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করত, তা হলো, আবদুলের তাকে কাকদের সাথে তুলনা করা।

‘কাক তোমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, ফরিদা, তারা মুখ চিনতে পারে।’

‘একেবারেই অসত্য, আমাদের কাছে যেমন সব কাক দেখতে একই রকম, তাদের কাছে তেমনই সব মানুষই একই।’

‘তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তুমি সত্যি মেনে নিতে চাও না।’

তিনি পাখিদের আরও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতেন তারপর বলতেন ‘আমাকে বিশ্বাস করো ফরিদা, একবার যদি কোনও কাক তোমার মুখ চিনে নেয়, তবে কখনও ভুলবে না।’

অবশেষে ফরিদা বললেন, ‘দয়া করে থামো। তারা আমাকে চিনুক বা না-চিনুক, আমার তাতে কিছুই যায় আসে না।’

আর যেহেতু মিস্টার আবদুল সবসময় শেষ কথাটা বলতে চাইতেন, তিনি বললেন, ‘তোমার অবশ্যই বোঝা উচিত, কারণ কাকরা প্রতিশোধপরায়ণ।’

এখন, যখন মিস্টার আবদুল আর নেই, হয়তো ফরিদা নিজে নিজেই ভাবছেন আবদুলের কথা আসলেই সত্যি কি না। কাকরা সত্যিই তার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কি না ? তিনি বারান্দায়, একেবারে একা দাঁড়িয়ে ভাবছেন আর কাঁদছেন এই কাকগুলোকেই কি তার একমাত্র সঙ্গী কি না ?

আমি তাকে ডাকি ‘আসুন, আসুন’। তাকে বসার ঘরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করি। তার জন্য ট্রেতে নাশতা রেখেছিলাম।

‘এক কাপ চা খান। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

কিন্তু তিনি তার হাত সরিয়ে নিলেন।

‘না এখন খাবো না। দেখতে পাচ্ছ না আমি ব্যস্ত ?’ তিনি তার দৃষ্টি স্থির রেখেছেন কালো কাকগুলোর দিকে, যেগুলো কেএফসি বাক্সের ওপর ঠোকর দিচ্ছে। একটি কাক তার দিকে মাথা কাত করে জোরে ‘কা’ করে ডেকে ওঠে। ফরিদা হালকা কেঁপে উঠেন

 ‘পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা কি জানে না যে কাকগুলো ভাজা মুরগি খেয়ে বদহজমে ভুগতে পারে ?’

‘না, ম্যাডাম,’ তারপর নিজেকে থামাতে ব্যর্থ হয়ে বলেই ফেলি, ‘ধনী মানুষরা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।’

তিনি আমার মন্তব্য উপেক্ষা করেন। ‘আবদুল মারাত্মক বুক জ্বালায় ভুগতেন, তিনি খুব সংবেদনশীল ছিলেন।’

‘জি, ম্যাডাম।’

তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমার স্নায়ু আর পেট পরস্পর সংযুক্ত, তারপর ফ্রিজের ঠান্ডা করা এনাই খেয়ে ফেলতেন।’

তাকে দেখে মনে হয় তিনি আবার কাঁদতে শুরু করবেন। আমি তাই বলি, ‘প্লিজ, ম্যাডাম, মিস্টার আবদুল নিশ্চয়ই চাইতেন আপনি আপনার নাশতা খান।’

‘তুমি কীভাবে জানো তিনি কী চাইতেন ?’ তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন।

‘বারো বছর ধরে আপনার সঙ্গেই তো আছি, ম্যাডাম।’

তিনি টুলের দিকে তাকালেন, আর আমি লক্ষ করি তিনি ট্রে-র ওপর ছড়িয়ে পড়া চা, পোড়া অমলেট আর অতিরিক্ত ভাজা টোস্টটি লক্ষ করছেন। মিস্টার আবদুল কখনই এমন অবিন্যস্ত নাশতা সহ্য করতেন না। কিন্তু তিনি আর বেঁচে নেই, তাই আমি আর বেশি পরিশ্রম করার প্রয়োজন বোধ করি না।

‘ট্রে-টা রেখে যাও,’ তিনি আবার কাকগুলোর দিকে মনোযোগ দেন।

ধনী মানুষের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তারা খাবার নষ্ট করতে পছন্দ করে। মিস্টার আবদুল সবসময় দুপুরের খাবারের জন্য গরম রুটি চাইতেন। আমি যখন রান্নাঘর থেকে গরম রুটি এনে দিতাম, তিনি তখন এক বা দুই কামড় দেওয়া রুটিটি ফেলে রেখে দিতেন এবং বলতেন, ‘এটা ঠান্ডা হয়ে গেছে।’

আমি তার অর্ধেক খাওয়া রুটিগুলো জমিয়ে রাখতাম। এর চারপাশটা কেটে ছোট টুকরো করতাম এবং একটি বাক্সে রেখে দিতাম। সপ্তাহ শেষে এগুলো দিয়ে টমেটো আর পেঁয়াজ দিয়ে শুকনো কারি রান্না করতাম। এভাবেই গরিবেরা টিকে থাকে।

 বেশির ভাগ মানুষ ঘুমের মধ্যে মারা যায়―এটাই বাস্তব। গরিব হলে আপনি সেটা মেনে নেন এবং জীবন চালিয়ে যান। কিন্তু ধনী মানুষেরা এসব নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করে। এটা ঠিক যে মিস্টার আবদুল হঠাৎই মারা গিয়েছিলেন। এক মুহূর্ত আগেও তিনি ফরিদার পাশে গভীর ঘুমে ছিলেন, আর পরের মুহূর্তেই যখন তাকে জাগানোর চেষ্টা করেন, তখন দেখেন, তিনি আর নেই। তার দাফন কাফনের পর তার মেয়েরা চাইছিল ফরিদা তাদের সবার বাড়িতে পালা করে থাকুন। তারা রোস্টারের একটি সময়সূচিও প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ফরিদা রাজি হননি।

‘আমি কোনও পুরোনো স্যুটকেস নই, যেখানে-সেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে, যতক্ষণ না আমার চাকা খুলে যায়। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি মেরির সাথেই এখানে থাকব।’

তাই মেয়েরা তাদের রুটিন জীবনে ফিরে গেলেন, আর ফরিদা আমার সাথে এখানে রয়ে গেলেন।

মিস্টার আবদুল প্রায়ই ফরিদাকে বলতেন, ‘তুমি কখনই একা থাকতে পারবে না।’ তিনি বলতেন, ‘তুমি স্বনির্ভর মানুষ নও, ফরিদা। কোথা থেকে শুরু করতে হয় সেটাই তুমি জানো না।’

ফরিদা প্রতিবাদ করে দ্বন্দ্বে জড়ানোর প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ তিনি হয়তো আবদুলকে ছাড়া তার জীবন কল্পনাই করতে পারেননি।

কখন দুপুর হচ্ছে তা আমি বলে দিতে পারি, এক নির্দিষ্ট কোণে মেঝের ওপর রোদের আলো দেখে। মিস্টার আবদুল খুব নিঁখুত আর খুঁতখুঁতে ছিলেন, সপ্তাহে একবার মেঝে বিশেষ গ্লস দিয়ে পলিশ দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করার বিষয়ে তিনি জোর দিতেন। কিন্তু এখন, যেহেতু তিনি আর নেই এবং এটি অনেক পরিশ্রমের কাজ তাই আমি আর করি না।

আমি দেখি ফরিদা দোলচেয়ারটি আলো পড়া জায়গায় টেনে নিয়ে গেলেন, আর সেখানে বসে চোখ বন্ধ করলেন। আমি ধারণা করছি, তিনি হয়তো সূর্যের উষ্ণতাটা উপভোগ করছেন। গরিব হলে, আপনি কিছু উপভোগ করার সময়ই খুঁজে পান না।

মিস্টার আবদুল আর ফরিদা এই ক্যাম্পাস ফ্ল্যাটে গত তিরিশ বছর ধরে বসবাস করছেন। তারা লাহোরে চলে এসেছিলেন, যখন মিস্টার আবদুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন। ছয়টি একই রকম স্থাপত্যের তৈরি ভবনের মধ্যবর্তী ব্লকের চতুর্থ তলায় তাদের ফ্ল্যাটটির অবস্থান। ভবনগুলো একে অপর থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে অবস্থিত। রঙিন কাচের জানালাগুলো কিছুটা প্রাইভেসি প্রদান করে, তবে ক্যাম্পাসের অন্য সব জায়গার মতোই এখানের ভবনগুলো খুব কাছাকাছি। সরাসরি বিপরীত বারান্দাগুলোর দিকে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন ভাঙা স্যুটকেস, পুরোনো গদি, মরা গাছপালা আর বিবর্ণ কাপড়ে ভরা দড়ি।

একরাতে, আমি যখন রাতের খাবারের পর টেবিল পরিষ্কার করছিলাম, তখন মিস্টার আবদুল তার অভ্যাসমতো জানালাগুলো পরীক্ষা করছিলেন। সেই সময় তিনি দেখতে পেলেন, প্রতিবেশীদের একজন তার পার্কিং এলাকায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন করে গাড়িটি সরানোর অনুরোধ করলেন।

প্রতিবেশী বললেন, ‘আপনি যুক্তিহীন কথা বলছেন, আপনার তো গাড়ি নেই, আর জায়গাটাও ফাঁকা। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ?’

‘এটা আমার জায়গা, তাই সিদ্ধান্ত আমিই নেব―আর এখন আমি এটা খালি চাই,’ মিস্টার আবদুল বললেন, এবং তারপর ফোন রেখে দিলেন।

ফরিদা বললেন, তিনি আর একটু ধৈর্য ধরতে পারতেন।

‘কখনই নয়,’ মিস্টার আবদুল বললেন। ‘যদি তুমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া না দেখাও, তারা তোমাকে বোকা ভাববে এবং আবারও এমনটা করবে।’

মিস্টার আবদুল বিষয়টি হাউজিং ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছে নিয়ে গেলেন এবং প্রতিবেশীর কাছ থেকে লিখিত ক্ষমা চাইলেন। কমিটির চেয়ারম্যান বললেন, এতে কোনও ক্ষতি হয়নি, আর মিস্টার আবদুলকে একটু নমনীয় হতে হবে। কিন্তু মিস্টার আবদুল সেটা মানতে রাজি নন।

ফরিদা যখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, তিনি বললেন, ‘তুমি যা বুঝো না, তাতে নাক গলিও না, এটা নীতির ব্যাপার।’

ধনী মানুষরা ভাবে তারা মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে, আর মিস্টার আবদুল এ বিষয়ে বিশেষভাবে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। আহা! হতভাগী ফরিদা, আবদুল একবারও ফরিদার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখেননি। ফরিদা যতটুকু পেরেছেন লড়াই করেছেন, কিন্তু তিনি কখনই মেনে নেননি। হয়তো তার মৃত্যুর পরে এই পরাজয়ের চরম অনুভূতিটাই ফরিদার দুঃখের কারণ।

সেই বিকেলে, আমি ফরিদাকে সোফায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে বাগানে নেমে যাই। হারুন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা আমগাছের ঠান্ডা ছায়ায় বসি। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই শুনি, ফরিদা আমার নাম ধরে ডাকছেন।

হারুনকে বলি, ‘তিনি একজন বিরক্তিকর মহিলা, দেখো, বারান্দা থেকে আমাদের দেখছেন।’

ফরিদা চিৎকার করে বলে, ‘মেরি, এক্ষুনি আসো, তুমি কী করছো ?’

আমি হাত তুলে ইশারা করি এবং যেখানে ছিলাম সেখানেই বসে থাকি। আমি হারুনকে টাপারওয়্যার কনটেইনারটি দিই, যা আমি রান্নাঘর থেকে অ্যাপ্রনের ভাঁজে লুকিয়ে এনেছি। সে আমার গালে হাত বুলিয়ে দেয়, চকোলেট কোটেড বরফি বের করে আমার মুখে তুলে দেয়। এই চকোলেট বরফি ফরিদার খুব প্রিয়।

হারুন আর আমি পাঁচ বছর ধরে একসঙ্গে আছি। সে ক্যাম্পাসে একজন মালি হিসেবে কাজ করে। গত বছর আমরা একটি সন্তান হারিয়েছি। আমরা বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছি। হারুনকে দেখলে মনে হবে না সে সুদর্শন, কিন্তু তার হৃদয়টা ভালো। সে পাতলা গড়নের কালো বর্ণের, আর সবসময় মাথায় পুরোনো একটা লাল স্কার্ফ জড়িয়ে রাখে, যেটি সূর্যের তাপ থেকে তাকে রক্ষা করে। তাকে মরুভূমিতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকা ক্লান্ত পথিকের মতো দেখায়। মাঝে মাঝে সে অতিরিক্ত মদ খায়, আর তখন আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়।

ফরিদা তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিলেন। ‘তুমি শুনতে পাচ্ছ, মেরি ? এখনই ফিরে আসো,’ তিনি চিৎকার করে বলেন।

আমি মাথাটা হারুনের কাঁধে রেখে দেই; তার গা থেকে সদ্য কাটা ঘাস আর ঘামের গন্ধ আসছিল। ‘শুভ জন্মদিন, প্রিয়তম,’ সে বলে।

‘ওই!’ ফরিদা ডাকেন।

‘আসছি, আসছি,’ আমি বলি কিন্তু উঠার কোনও চেষ্টাই করি না। আমি জানি আমার এই উত্তর তাকে আরও রাগিয়ে দেবে, আর তিনি ভাববেন আমি ইচ্ছে করে ব্যঙ্গ করছি। এ কয়েক বছরে প্রায়ই মিস্টার আবদুলকে বলতে শুনেছি, ‘কখনই কাজের লোকদের বিশ্বাস করো না। তাদের কোনও আনুগত্য নেই। সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখো, না হলে তারা তোমার মাথায় চড়ে বসবে।’

আমি এটা স্বীকার করতে ঘৃণা করি, কিন্তু মাঝেমধ্যে ফরিদা আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। একবার তিনি পুরোনো কিছু পোশাক আর জুতো, এমনকি তার প্রিয় কমলা রঙের ব্যাগটি আমাকে দিয়েছিলেন, যদিও সেটার ফিতেটা ছেঁড়া ছিল।

 তিনি বলেছিলেন, ‘যত্ন করে ব্যবহার করো।’

যখনই তিনি আমার হাতে সেটি দেখতে পেতেন (আমি সেটি মেরামত করিয়েছিলাম) তখনই মন্তব্য করতেন, ‘ব্যাগটি কত সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি বুঝতে পারতাম, এটা দিয়ে দেওয়ায় তার একটু অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু আমি সেটি ফিরিয়ে দিইনি, বরং তাকে বলতাম, ‘এটার জন্য আমি কত প্রশংসা পেয়েছি।’

তিনি বলতেন। ‘শুধু আবদুলকে এটা দেখিও না, সে বলবে আমি তোমাকে বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছি।’

আমরা দুজনেই জানতাম, মিস্টার আবদুল পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়াও কখনই আমাদের দুজনকে কাছাকাছি আনতে পারেনি।

গত বছর, আমি যখন গর্ভবতী ছিলাম, চিকিৎসার জন্য মিস্টার আবদুলের কাছে কিছু ঋণ চেয়েছিলাম।

তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার কি মনে হয় আমি কোনও দাতব্য সংস্থা ? চার্চের কাছে চাও না কেন ?’

ফরিদা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে আমি অসুস্থ এবং, আমি সন্তানসম্ভবা এবং তিনি প্রতি মাসে আমার বেতনের সামান্য অংশ কেটে সমন্বয় করে নিতে পারবেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। ‘তুমি কি এখনও শিখতে পারোনি, কাজের লোকদের প্রতি নরম হলে তারা তোমাকে ব্যবহার করবে ?’

ধনী মানুষ ভাবে, তাদের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে।

বাগান থেকে ফিরে সরাসরি বসার ঘরে যাই―‘আপনি আমাকে ডাকছিলেন, ম্যাডাম ?’

‘তুমি ওই লোকটার সঙ্গে কী করছিলে ? সে কে ?’

‘আমার বন্ধু হারুন, ম্যাডাম।’

‘বন্ধু ? তুমি কখন থেকে বন্ধুদের জন্য সময় পেতে শুরু করলে ?’ তিনি চেয়ার থেকে তার ওড়নাটা তুলে কাঁধে জড়িয়ে নিলেন। ‘আবদুল এটা কখনওই মেনে নিত না।’

আমি মাথা উঁচু করে সরাসরি তার দিকে তাকালাম। ‘কিন্তু মিস্টার আবদুল তো এখানে নেই, তাই না ?’

‘তোমার এত সাহস কী করে হয় ? আমি এখনই সেই মালীকে একটা শিক্ষা দেব।’

‘দয়া করুন, ম্যাডাম। আমরা শুধু কথা বলছিলাম।’

‘আমি বিশ্বাস করি না, তোমাকে কিছু দিতে দেখেছি। তুমি কী চুরি করেছ ? আমি এখনই তা বের করব এবং এই বোকামি শেষ করব।’ তিনি দরজার দিকে কুঁজো হয়ে এগিয়ে গেলেন, আর আমি তার পিছু নিলাম।

আমি বললাম। ‘সাবধানে, আমরা চাই না আবার আপনি পড়ে যান, ম্যাডাম।’

সিঁড়ি ধরে একপাশে হয়ে নামতে নামতে তিনি বললেন, ‘আমি তোমার মতামত চাইনি’, তিনি রেলিং শক্ত করে ধরে ছিলেন। আমরা নিচতলায় পৌঁছাই যেখানে দেখি হারুন গাছের নিচে হলুদ ফুলের পাপড়ি জড়ো করছে।

‘এই!’ ফরিদা তার হাত উঁচু করে হারুনকে ডাকলেন। সে কাজ থামিয়ে এগিয়ে আসে।

‘আমি মেরিকে তোমার সঙ্গে গল্প করার জন্য বেতন দিই না, তার সঙ্গে কথা বলো না।’

‘আজ তার জন্মদিন, ম্যাডাম,’ হারুন আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল।

 তিনি বললেন, ‘এসব বাকোয়াস কথা রাখো। আজ তার, কাল হবে তোমার, আর তার পরদিন অন্য কারও। এসব খুবই ফালতু ব্যাপার!’

হারুন তার পকেট থেকে টাপারওয়্যার কনটেইনার বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল―‘দয়া করে একটু চকোলেট বরফি নিন, ম্যাডাম।’

‘কী ধৃষ্টতা,’ তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। ‘এই বরফিগুলো আমার রান্নাঘর থেকে আনা হয়েছে আমি চিনতে পারছি। কীভাবে মেরি আমার অনুমতি ছাড়া এগুলো নিতে সাহস করল ?’

ঠিক তখনই একটা জোরালো বাতাস বয়, আর একটি খালি কেএফসি বাক্স আমাদের দিকে উড়ে আসে। সেটা আমাদের থেকে কয়েক ফুট দূরে মাটিতে পড়ে, আর তার ভেতরের মুরগির টুকরো আর চিপস ছড়িয়ে পড়ে।

ফরিদা বললেন ‘এটা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’ তিনি চোখের ওপর হাত রেখে উপরের বারান্দার দিকে তাকানোর চেষ্টা করলেন। ‘পর্যাপ্ত হয়েছে এবার ওদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’ তিনি ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে বিপরীত ভবনের দিকে এগিয়ে গেলেন আর ঠিক তখনই একটা কাক নিচে নেমে এসে খাবার ঠোকরাতে শুরু করল।

‘আমি ওদের একটা শিক্ষা দেব, ওরা নিজেদের কী ভাবে ? কাকদের কেএফসি মুরগি খাওয়াচ্ছে ?’

আমি বলি, ‘ম্যাডাম, একটু থামুন।’

‘তোমার সাথে আমার এখনও কথা শেষ হয়নি, মেরি, আমি জানতে চাই, ঠিক কখন থেকে তুমি চুরি শুরু করলে।’

তিনি রেলিং ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিলেন, মুখে মৃদু গুঞ্জন করছিলেন, ‘চুরি, মিথ্যা, প্রতারণা, আবদুল সবসময় বলতেন, কাজের লোকদের কখনওই বিশ্বাস করো না…’

আমি তার পেছন পেছন যাই, হারুনও আমাদের অনুসরণ করে।

তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘এখান থেকে চলে যাও, আমাকে একা থাকতে দাও।’

 আমরা কোনও জবাব দেই না, কিন্তু তার ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কায় পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি, দেখতে থাকি তিনি কীভাবে ধীরে ধীরে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলা পার করেন।

তিনি বলতে থাকেন, ‘আবদুল সবসময় বলতেন, যদি তুমি তোমার নীতিকে রক্ষা করতে না পারো, তবে তুমি কিছুই না।’

‘জি, ম্যাডাম। কিন্তু তিনি তো আর বেঁচে নেই, তাই এটা এখন আর কোনও গুরুত্ব রাখে না।’

‘চুপ করো, আমি জানি আমি কী করছি।’

আহা! গরিব ফরিদা। তিনি হয়তো তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। এটা এমন কিছু বড় বিষয় নয়  মানুষ তো প্রায়ই জিনিস হারায়। গরিব হলে, আপনি বাসে জিনিস ফেলে আসেন, কেউ আপনার পকেট মারল, বা আপনার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেল―এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিন ঘটে। কিন্তু ধনী মানুষের জন্য বিষয়টা ভিন্ন; তারা কোনও কিছু হারানো সহ্য করতে পারে না।

কয়েক বছর আগে, মিস্টার আবদুলের ঘড়ি হারিয়ে গিয়েছিল। ‘কেউ এটা চুরি করেছে,’ তিনি ফরিদাকে বললেন।

‘এটা হয়তো তোমার হাত থেকে পড়ে গেছে, ফিতেটা ঢিলা ছিল। অথবা হয়তো তুমি কোথাও রেখে ভুলে গেছ…’

তিনি তীক্ষè সুরে বললেন, ‘এমন হলে আমি জানতাম, আমি তোমার মতো অসাবধান নই। চোরেরা সবসময় নজর রাখে, তারা হাজার চোখ নিয়ে ঘোরে, আর যখন তুমি প্রস্তুত নও, তখনই হামলা করে।’

মিস্টার আবদুল আমাকে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজতে বাধ্য করলেন, কিন্তু ঘড়িটা পাওয়া গেল না। তিনি সেই দিনটির প্রতিটি ঘণ্টা, কোথায় গিয়েছিলেন, কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সবকিছু আবার মনে করার চেষ্টা করলেন। আর এতে তিনি আরও নিশ্চিত হলেন। ‘আমার কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে,’ তিনি বললেন। ‘দিনদুপুরে চুরি করা হয়েছে।’

তিনি দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, কিন্তু আমি কেবল না বোঝার ভান করতাম। 

ফরিদা তার ঘড়ি নিয়ে অভিযোগ ও আহাজারি শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

‘আমার কথা শোনো, একটা নতুন ঘড়ি কিনে নাও,’

‘এই শহর চোরে ভরা। তারা সহজ শিকার দেখলে আক্রমণ করে।’

‘এটা ভুলে যাও, এখন আর কিছু করার নেই।’

‘না, আমি এটা সহজে তাদের করতে দেব না।’ মিস্টার আবদুল আবার চেয়ারে বসলেন এবং সেই দিনের ঘটনাগুলো আরেকবার ভেবে দেখলেন। কিন্তু নতুন কিছু মনে পড়ল না।

ঘটনার কয়েক দিন পর, হারুন দরজায় নক করল, সঙ্গে একজন মানুষ। হারুন বলল, ‘তিনি আপনাকে কিছু দেখাতে চান।’

 সেই মানুষটি একজন নির্মাণশ্রমিক, সে একটি গিঁট বাঁধা রুমাল খুলল, ‘আমি এই ঘড়িটা বিক্রি করতে চাই, আপনার পছন্দ হলে কিনতে পারেন।’

‘তুমি এটা কোথায় পেয়েছো ?’ আবদুল রুমাল থেকে ঘড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের কব্জিতে পরলেন। ‘তোমার সাহস হয় কী করে ? প্রথমে চুরি করো, এখন আবার সেটা আমার কাছে বিক্রি করতে আসো ?’

হারুন আর আমি এত কষ্ট করেও কিছুই অর্জন করতে পারলাম না। আমরা একটাও রুপি পেলাম না, কারণ মিস্টার আবদুল তার ঘড়ি কিনে নিতে রাজি হলেন না।

 তিনি ফরিদাকে বললেন, ‘কখনওই না, যদি আমি এটা কিনে নিই, তাহলে প্রতিদিন সকালে এখান থেকে কিছু না কিছু হারাবে, আর প্রতিদিন সন্ধ্যায় চোর সেটা আবার আমাদের কাছে বিক্রি করতে আসবে।’

 ফরিদা বললেন, ‘লোকটা হয়তো কোথাও এটা পেয়েছিল। তাকে একটা ছোট পুরস্কার দেয়া প্রয়োজন ছিল। গরিব মানুষদের নিচু করে দেখো না, তাদের কাছে এটা শুধুই বেঁচে থাকার লড়াই।’

আমরা যখন চতুর্থ তলায় পৌঁছাই, ফরিদা তখন দেয়ালে ভর দিয়ে তার ওড়না দিয়ে মুখে বাতাস করতে লাগলেন। তিনি তিনটা দরজার দিকে তাকালেন―‘অপরাধীরা কোথায় থাকে ?’

আমি মাঝের দরজার দিকে ইঙ্গিত করি। তিনি ল্যাংড়াতে ল্যাংড়াতে সেখানে গিয়ে দরজার কড়া নাড়েন। একজন লোক দরজা খোলে। তার বয়স চল্লিশের মতো হবে। তার পাতলা চুলগুলো টাকের উপরে পাশের দিক থেকে আঁচড়ানো। আমি তাকে চিনতে পারি। কারণ প্রায়ই তাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে জোরে জোরে কথা বলতে দেখি।

‘হ্যালো, বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি ?’

‘আমি ফরিদা, সামনের বিল্ডিং থেকে এসেছি, আপনার প্রতিবেশী, আমি কাকদের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।’

‘কাক ?’ সে বিভ্রান্ত হয়ে তাকায়।

ফরিদা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়―‘মেরি, বুঝিয়ে বলো। তাকে কাকদের ব্যাপারে বলো।’

আমি বলি, ‘আপনার কাকদের যা খাওয়াচ্ছেন ম্যাডাম তা পছন্দ করছেন না, তিনি মনে করেন, কাকদের কেএফসি দেওয়া ঠিক নয়।’

 সে বলে, ‘কেএফসি ? আমি বুঝতে পারছি না।’

ফরিদা জোর গলায় বলেন, ‘মিথ্যা বলবেন না! আজ সকালেই নিজের চোখে দেখেছি কাকগুলো কীভাবে আপনার বারান্দার কেএফসি বাক্স থেকে ফ্রাইড চিকেন আর চিপস খাচ্ছে।’

 লোকটার চোখ সংকুচিত হয়ে গেল, ‘ওই কাকগুলো কি আপনার ?’

 ফরিদা উত্তর করেন, ‘আবদুল বলতেন, কাকদের সম্মানের সঙ্গে আচরণ করতে হয়, যদি তা না করেন, তারা প্রতিশোধ নেবে।’

‘কিন্তু এটা তো আমার সমস্যা, তাই না ?’ লোকটা বলল।

‘এটা ঠিক নয়। এটা তাদের বদহজম করাবে।’

লোকটা হেসে ফেলল। আমি ফরিদার হাত ধরলাম আর বললাম, ‘চলুন, ম্যাডাম।’

কিন্তু তিনি হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কাকরা মুখ চিনতে পারে।’

‘ওই পাখিগুলো কি আপনার পোষা ?’ লোকটি জিজ্ঞেস করল।

ফরিদা তার দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘আমি সেরকম ভাবি না।’

‘তাই আমি তাদের যা খাওয়াতে চাই, তাই খাওয়াব।’

‘আবদুল আপনার নামে ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে অভিযোগ করতেন,’ কিন্তু লোকটি ইতিমধ্যেই দরজা বন্ধ করতে শুরু করেছিল।

‘আরেকটা কথা,’ সে থেমে বলল, ‘যদি আপনার দেখা ভালো না লাগে, তাহলে দেখবেন না।’ সে দরজা আছড়ে বন্ধ করল।

‘কী সাহস,’ ফরিদা বললেন, তার গলা কাঁপছিল, ‘আবদুল থাকলে সে এভাবে সাহস দেখাত না।’

আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার জন্য ঘুরি, ফরিদা যখন হারুনকে অপেক্ষা করতে দেখলেন, তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, ‘তুমি এখনও এখানে কেন ? তুমি কি আমার উপর নজর রাখছ ?’ তিনি এক ধাপ নিচে নামলেন এবং প্রায় পড়ে যাচ্ছিলেন।

হারুন দ্রুত তাকে ধরে ফেলে এবং তার হাত ধরে ভারসাম্য বজায় রাখে, ‘সাবধানে, ম্যাডাম।’

তিনি তাকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘থামো, আবদুল তোমাকে আমাকে স্পর্শ করতে দিত না।’

‘চলুন,’ আমি হারুনকে বলি। আমি ফরিদার বাঁ হাত আমার কাঁধে রাখি, আর হারুন তার কনুই ধরে। এক ধাপ করে আমরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে নেমে আসি।

প্রতিবার ফরিদা দুলে যাচ্ছিলেন আর হারুন বলছিলো, ‘সাবধানে, ম্যাডাম,’ আর এতে তিনি আরও রেগে যেতেন। নীচতলায় পৌঁছানোর পর আমরা তাকে ছেড়ে দিই, তিনি নিজেকে সামলে নেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি এখন কান্না করবেন।

‘শান্ত থাকুন,’ হারুন বলে।

তিনি জবাব দেন, ‘চুপ করো।’

আমি বলি, ‘ম্যাডাম আজ সকালের নাশতা খাননি।’

হারুনকে বলি, মিস্টার আবদুল কীভাবে প্রতিদিন নাশতায় একটি অমলেট এবং দুটি পরোটা খেতেন, আর তার মৃত্যুর পর থেকে ম্যাডাম ফরিদা খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছেন।

তিনি বলেন, ‘তোমার কী সাহস, মেরি, আমাকে নিয়ে গসিপ করছ।’

আমি তাকে উপেক্ষা করে হারুনকে বলি, ‘বেচারা ম্যাডাম ফরিদা―তিনি একেবারে একা, তার মেয়েরা তো অনেক দূরে।’

হারুন বলে, ‘অন্তত আমাদের তো তিনি পেয়েছেন,’ আমি তার সাথে একমত হই।

আমরা যখন অবশেষে ফ্ল্যাটে ফিরে আসি ফরিদা টলতে টলতে বসার ঘরে ঢুকে সোফায় ধপ করে বসে পড়েন। হারুন দরজার কাছে অপেক্ষা করছিল।

‘ওকে যেতে বলো,’ তিনি হাত নেড়ে ইশারা করেন, তার কণ্ঠ ছিল দুর্বল, ‘আমি ওকে এখানে চাই না। আবদুল বলতেন, মালি ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারবে না।’

আমি বলি, ‘ভেতরে আসো, হারুন,’।

 হারুন ঘরের ভেতরে ঢোকে। সে ফরিদার পাশ দিয়ে হেঁটে কনসোলের সামনে দাঁড়ায় যেখানে পুরো পরিবারের ছবিগুলো রাখা ছিল: মিস্টার আবদুল এবং ফরিদা তাদের মেয়েদের সঙ্গে; মিস্টার আবদুল শিক্ষামন্ত্রীর সাথে করমর্দন করছেন; মিস্টার আবদুল একটি বেসবল ক্যাপ এবং কালো চশমা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গলফ টুর্নামেন্টে খেলছেন। হারুন মিস্টার আবদুলের একটি ছবি তুলে নিল।

ফরিদা  জোরে বললেন, ‘না, না, স্পর্শ কোরো না, দয়া করে তুমি শুধু চলে যাও।’

হারুন বলল, ‘আমি মিস্টার আবদুলকে চিনতাম, একবার তিনি আমাকে গাছের নিচে ঘুমাতে দেখে অলসের চূড়া বলেছিলেন। তিনি ম্যানেজমেন্ট কমিটিতেও অভিযোগ করেছিলেন, আর আমাকে পদাবনতি দেওয়া হয়েছিল।’

আমি বললাম, ‘এই রকমই ছিলেন মিস্টার আবদুল, একজন দমনকারী।’

ফরিদাকে এমন দেখাচ্ছে যে তিনি যেন কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু তার মুখ থেকে কোনও শব্দ বের হচ্ছে না। হারুন ছবিটা আরও কয়েক মুহূর্ত ধরে রাখল, তারপর সেটা নামিয়ে রাখল।

 সে বলে, ‘যা গেছে, তা অতীত, আমি মৃতদের প্রতি ক্ষোভ পুষে রাখার মানুষ নই।’

আমি বলি, ‘গরিব মানুষদের সেই বিলাসিতা নেই, চলো হারুন, ম্যাডামকে তার ঘরে নিয়ে যাই। তিনি খুব ক্লান্ত, বিশ্রাম নেওয়া দরকার।’

ফরিদা বললেন―‘না।’

হারুন সোফার কাছে যায় যেখানে ফরিদা বসে আছেন, সে সাহায্য করার জন্য ঝুঁকল।

তিনি বাধা দিতে লাগলেন। ‘না, না, আমাকে স্পর্শ কোরো না।’

আমরা তাকে তুলে নিই।

‘না,’ তিনি বললেন।

‘আপনি খুব ক্লান্ত, ম্যাডাম,’ আমি বলি।

তিনি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার মুখ থেকে কেবল ‘না’ শব্দটাই বের হচ্ছে। তার মুখ ভিজে যায়। আমরা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিই। ‘বিশ্রাম নিন, ম্যাডাম,’ আমি বললাম।

তিনি মৃদু কণ্ঠে গোঙালেন, ‘আবদুল…’

আমি দরজা বন্ধ করি। ‘চলো হারুন, চা বানাই,’ আমি  রান্নাঘরে গিয়ে চা পাতার সঙ্গে পানি চুলায় বসাই।

যখন আমি চায়ের ট্রে নিয়ে বসার ঘরে ফিরে আসি, হারুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৃদু হাসছে। সে পকেট থেকে টাপারওয়্যারের বাক্স থেকে চকোলেট বরফি বের করে বারান্দার রেলিংয়ে ছড়িয়ে দেয়―‘কাকদের জন্য একটু উপহার।’

আমি সোফায় গিয়ে বসি, যেভাবে বার বার ফরিদাকে বসতে দেখি, এবং তার নরম চাদরটা পায়ের উপর টেনে নেই। হারুন মিস্টার আবদুলের চেয়ারে বসে এবং পাগুলো একটি টুলের উপর রাখে, ঠিক যেমনটি মিস্টার আবদুল করতেন।

আমরা বসে থেকে চায়ে চুমুক দিতে থাকি, একটু পরেই একটি কাক নিচে নেমে এসে বরফি ঠোকরাতে শুরু করে।

(ঞযব গধৎশধু জবারবি পত্রিকায় ২ জুলাই, ২০২৩ সালে প্রকাশিত ফারাহ আহমেদ-এর মূল ইংরেজি গল্প ‘জরপয ধহফ চড়ড়ৎ চবড়ঢ়ষব’ থেকে বাংলায় অনূদিত)

  লেখক : কথাসাহিত্যিক

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button