
ল্যাপটপের ঢাকনা বন্ধ করে দিয়ে দোতালার হলকামরায় পায়চারি করেন এহতেশাম। আড়চোখে টাইমপিসে সময়ও দেখে নেন। ছয়টা বাজতে এখনও মিনিট পনেরো বাকি আছে। বুঝতে পারেন, বাইরের আঙিনায় রোদ মিহি হয়ে এসেছে, অপরাহ্ণ গড়িয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। সতেরো মিনিট আগে তিনি কড়া ডোজের আরেকটি পিল নিয়েছেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠেনি স্নায়ু, মস্তিষ্কের ভেতর কিছু একটা ঘাসফড়িং-এর কায়দায় লাফিয়ে উঠছে থেকে থেকে।
সপ্তা-দুয়েক আগে এহতেশাম ডেট্রোয়েট নগরীর বাড়িটি পুরো বছরের জন্য ভাড়া দিয়ে ফিরে এসেছেন স্বদেশে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী ছিলেন তিনি দীর্ঘ একুশ বছর। দ্বিতীয়বার ফাইনান্সে মাস্টার্স করে থিতু হয়েছিলেন ওখানে। শেষ দিকে দশ বছরের মতো কাজ করেছেন অটো ইন্ডাস্ট্রির একাধিক সেকশনে। ব্রেস্ট ক্যান্সারে স্ত্রী-বিয়োগের বছরখানেক পর থেকে তার দেহ-মনে মানসিক ব্যাধির আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভুগছিলেন প্রবল অনিদ্রায়, কাড়ি কাড়ি সিডেটিভ গিলেও ফায়দা কিছু হচ্ছিলো না। এমন কী মাঝেমধ্যে শিকার হতে শুরু করেন প্যানিক অ্যাটাকেরও।
তো পরামর্শ নেন সাইকিয়াট্রিস্টের, মেনে নেন আর্লি রিটায়ারমেন্টের অপশন। তারপর থেকে হাজিরা দিচ্ছেন থেরাপি সেশনে, ভেষজ ওষুধপত্র সেবন করেছেন বিস্তর, সেরেও উঠেছেন বেশ খানিকটা, কিন্তু ওই যে―করোটিতে কারণে অকারণে মৌমাছির গুঞ্জন, মনে হতো পুরো মাথাটি বিবর্তিত হয়েছে আস্ত এক মৌচাকে, মগজের কোষে কোষে সক্রিয় হয়ে আছে অজস্র শ্রমিক মৌমাছি, কিছুতেই তাদের ক্রমাগত কর্মতৎপরতা থেকে রেহাই পাচ্ছিলেন না এহতেশাম।
ট্র্যাংকুইলাইজারের কল্যাণে ঝিমিয়ে পড়লেও, রাতবিরাতে দেখা দিত স্বপ্নের উপসর্গ। সাইকিয়াট্রিস্ট তখন তাকে নোটবুকে ড্রিমগুলো ডিটেইলসসহ টুকে রাখতে পরামর্শ দেন। পরবর্তীকালে ওগুলো বিশ্লেষণ করে ডাক্তার দেখান যে, দুঃস্বপ্নে বারংবার ফিরে আসছে তার শৈশবের চেনা চরিত্ররাজি ও স্বদেশের দৃশ্যপট। সাইকিয়াট্রিস্টের ধারনা, অবচেতনের কিছু আনফিনিশড বিজনেস তাকে পীড়া দিচ্ছে অহরহ। সুতরাং স্বদেশে ফিরে গিয়ে চেনা পরিসরে বিষয়টার মোকাবিলা করতে পারলে হয়তো চাপমুক্ত হবে স্নায়ুতন্ত্রী, এবং প্রয়োজনও পড়বে না দিন-কে-দিন কড়া-ডোজের ওষুধপত্র গেলার।
মোড়ার ওপর পা তুলে, সোফায় একাকী চুপচাপ বসে থেকে এহতেশাম সচেতন হন কিছু না করে বেশিক্ষণ এক-জায়গায় ঝিম ধরে থাকার ঝুঁকি সম্পর্কে। কারণ নিঃসঙ্গতা প্রবল হলেই অদৃশ্য মৌমাছিগুলো ফিরে আসে করোটিতে, ফলে শিকার হন তিনি প্যানিক অ্যাটাকের। কিন্তু অনেক বছর পর এসেছেন স্বদেশে, গ্রামের বাড়িতে জীবিত আত্মীয়স্বজনদের প্রায় সকলে পরবাসী। সুতরাং এ মুহূর্তে তিনি বসবাস করছেন তার ফুফুআম্মার দোতালা বাড়িতে। স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকরি থেকে বছর দশেক আগে অবসর নেওয়া ফুফা এখনও বেঁচেবর্তে আছেন বটে, তবে চলাফেরা তেমন করতে পারেন না, স্বরনালিতে অপারেশনের পর কথাবার্তাও বলেন না তেমন, এবং অস্পষ্ট-স্বরে একটু-আধটু যাও বলেন―তা বুঝে ওঠাও কঠিন হয়ে উঠেছে।
কৈশোরে ফুফুআম্মার এই বাসায় থেকে তিনি বছর দুয়েক হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এ শহরের একটি ব্যাংকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করার সময় মাঝেমধ্যে এখানে এসে দু-চার রাত কাটাতেনও। তখন অবশ্য ঠিক এই জায়গায় ছিল টিনের ঘরওয়ালা বাসাবাড়ি। দিন কয়েক ধরে এহতেশামের কেবলই এক-পাক শহরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। এখানে চেনাজানা বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন যে জীবিত নেই, তা নয়, তবে কোনও কোনও সুহৃদের বিত্ত এমন বিপুল হয়েছে, তারা সমাজের এত উচ্চমার্গে বিচরণ করছেন, তাদের সঙ্গে তিনি ঠিক খাপ খাওয়াতে পারেন না। আবার কেউ কেউ রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে এমন আদ্যোপান্ত জড়িয়ে আছেন যে, এদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে অযথা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
কৈশোর ও তারুণ্যে এহতেশামের আউট বই বলে পরিচিত গল্প ও উপন্যাস পাঠের ঝোঁক ছিল প্রচুর। স্থানীয় ব্যাংকে কর্মরত থাকার সময়, পেশাদারি চাপে প্রায়শ তার ক্লেশ হতো তুমুল, তখন সন্ধ্যাবেলা নগরীর দুটি বইয়ের দোকান ঢুঁড়ে খরিদ করতেন, কলকাতা থেকে সদ্য আমদানি করা কোনও উপন্যাস, দেশ কিংবা অমৃতের পুজোসংখ্যা প্রভৃতি। বইয়ের দোকানে কিছু না কিনে স্রেফ আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা কাটাতেও পছন্দ করতেন এহতেশাম। বুকস্টোর দুটিরর অস্তিত্ব এখনও আছে বটে, তবে একটিতে বইয়ের পরিবর্তে হালফিল বিক্রি হচ্ছে―টুপি, তসবি, গিলাফ ও পবিত্র কালাম ক্যালিওগ্রাফ করা পিকচার ফ্রেম প্রভৃতি। অন্যটিতে বসেছে বাহারে পানের দোকান, ছাদে নিওনবাতির রুশনিতে ঝলমলাচ্ছে আগ্রা থেকে আমদানি করা কিমাম, পানপরাগ ও খুশবোদার জর্দার বিজ্ঞাপন।
এহতেশামের ফুফাতো ভাইবোনদের একজন প্রয়াত, বাকিরা প্রবাসী। তাদের আর্থিক অনুদানে তৈরি হয়েছে আধুনিক কেতার পেল্লায় দোতালা বাড়িটি, উপরতলা পুরো খালি পড়ে থাকে বছরের পর বছর। ওখানেই আপাতত থানা গেড়েছেন এহতেশাম। দু বেলার স্নানে গিজারের উষ্ণ পানি থেকে খোলামেলা ঝুলবারান্দা অবধি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এখানে আছে বটে, তবে সারাক্ষণ থম ধরে থাকা এক ধরনের নির্জনতা তাকে তব্দিল করে রাখছে, আর থেকে থেকে তুমুল হয়ে উঠছে নিঃসঙ্গতাও।
এসব ভাবতে ভাবতে এহতেশাম চলে আসেন ডাইনিং স্পেসে। ওভারসাইজ একটি টেবিলের প্রান্তে কামকাজের বুয়া এনে রাখে বিকালের জলখাবার―পায়েস ও কাটাফল। চায়ের পরিবর্তে আজকাল তাকে ইন্সট্যান্ট কফি দেওয়া হচ্ছে। তপ্ত কফির পেয়ালা কাত করে থার্মাল টাম্বলারে ঢালতে ঢালতে এহতেশাম তার অভ্যাস পরিবর্তনের কথা ভাবেন। দেশে ফিরে ফুফুআম্মার বাসায় বসবাসের পয়লা দিকে এক ফোঁটা ড্রিপকফির জন্য প্রাণ হামেশা আইঠাই করত। এখন অবশ্য ইন্সট্যান্ট কফিটা ভালো লাগতে শুরু করেছে।
কফিতে গোটা দুই চুমুক দিয়ে টাম্বলারসহ এহতেশাম চলে আসেন ঝুলবারান্দায়। ঝিরঝিরে বাতাসে চকিতে মন ভালো হয়ে ওঠে। রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে তিনি জারুল গাছের হঠাৎ হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠা পাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। অবাক লাগে―বাগানে ফুফুআম্মাকে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে হাঁটতে দেখে! তাঁর পাশে রীতিমতো পাহারা দিয়ে হাঁটছে বুয়ার কিশোরী মেয়েটি। মরশুমি ফুলের আধলা ইট পুঁতে কেয়ারি করা চৌখুপ্পির ভেতর দিয়ে ফুফুআম্মা গিয়ে দাঁড়ান বাওয়ান্ডারি ওয়ালের কাছে। তারপর সব্জির লতানো ঝাড় থেকে শশা, শিম, চিচিঙ্গা ও কাঁকরুল প্রভৃতি পেড়ে রাখতে শুরু করেন ওয়াকারে লাগানো ঝুড়িতে।
কিছুক্ষণ ধ্যান ধরে এহতেশাম চেয়ে থাকেন, বাতব্যাধিতে মারাত্মকভাবে পঙ্গু ফুফুআম্মার কর্মক্ষম থাকার প্রাণপণ প্রচেষ্টার দিকে। পুষ্করিণীর থির জলে বুজকুড়ি কেটে ভেসে উঠা মাছের মতো তার অবচেতনের অন্ধকার থেকে ঘাই মেরে উঠে গিল্ট ফিলিং। মায়ের মৃত্যুর বছর দুয়েক পরে, পিতার দ্বিতীয় বিবাহের উদ্যোগে কিশোর এহতেশামের মনমেজাজ যখন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল, ফুফুআম্মা তাকে সস্নেহে নিজ বাসায় রেখে স্থানীয় স্কুল থেকে এসএসসি পাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বছর পনের আগে তার বিবাহের আয়োজনও হয়েছিল ফুফুআম্মার তদারকিতে, এ বাড়িতে। স্নায়ুবিক চাপ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এ যাত্রা দেশে এসে এখানে উঠলে―নিজ-হাতে তার পছন্দের পদগুলো রেঁধে তিনি তিনবেলা পরিবেশন করছেন ডাইনিং টেবিলে; আর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত অবসরপ্রাপ্ত সফল প্রফেশনাল এহতেশাম, উপরতলায় বুঁদ হয়ে বসে সারাক্ষণ টিনএজারদের মতো ব্রুড করছেন। আত্মীয়স্বজনরা তাকে দেখতে এলে তাদের সঙ্গে শীতল ব্যবহার করেন, এমন কি খাবার টেবিলে বসেও ফুফুআম্মার প্রশ্নের জবাব দেওয়া ছাড়া বাকি সময়টুকু সম্পূর্ণ নীরব থেকে অসামাজিকতার পরিচয় দিচ্ছেন।
জারুল গাছে আচমকা উড়ে এসে বসা ফটিকজল পাখিটির মতো এহতেশামের মনে হঠাৎ করে উদয় হয় একটি জরুরি প্রশ্ন। ভাবেন, বিষয়টি ভুলে যাওয়ার আগে এখনই ফুফুআম্মাকে জিজ্ঞেস করে ফেললে হয় না ? ঝুলবারান্দা থেকে কামরায় ঢুকে, কফির টাম্বলারটি ডাইনিং টেবিলে রেখে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসেন গ্রাউন্ড ফ্লোরে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ সুপরিসর ড্রয়িংরুমে। তার চোখ দুটি অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়ায় অকেজো দেয়াল ঘড়ির কারুকাজে। ফ্রেমে বাঁধানো দুটি সুচিকর্মের নমুনা মলিন হয়েও এখনও ঝুলছে দেয়ালে। মনে পড়ে, যখন বেঁচে ছিলেন তার মা, এহতেশাম বোধ করি অজ পাড়াগাঁয়ের স্কুলে ক্লাস টু কিংবা থ্রি’তে পড়েন, তখন এ বাড়িতে, আজকালকার দোতালা দালান নয় টিনের সাতচালা বাসায় নাইওর এলে, মায়ের তদারকিতে ফুফুআম্মা হরেক রঙের রেশম দিয়ে সুইসুতোয় তৈরি করেছিলেন দুটি বর্ণাঢ্য ট্যাপেস্ট্রি।
ফটিকজল পাখিটির উড্ডয়ন রেখার মতো করোটির কোষে কোষে অলীক এক বিজুরি ঝলসে ওঠে। স্মৃতিবিধুর এহতেশাম চকিতে ফিরে আসেন বর্তমানের রূঢ় বাস্তবে। ফুফুআম্মাকে জিজ্ঞেস করে কিছু একটা জেনে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু আদতে তিনি কী জানতে চেয়েছিলেন ঠিক মনে করতে পারেন না। প্রশ্নটি যেন ঘাটলায় গোসল করতে এসে জলে পড়ে যাওয়া সাবানটির মতো তলিয়ে গেছে অবচেতন অন্ধকারে। চোখে-মুখে বিভ্রান্তি ফুটিয়ে কিছুক্ষণ তব্দিল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এহতেশাম।
চোখ চলে যায় বুককেসের তিনটি তাকে সযত্নে সাজিয়ে রাখা বইপত্রের দিকে। হঠাৎ করে যেন এহতেশামের দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করেন কয়েকটি বইয়ের এর শিরদাঁড়ায় মুদ্রিত শিরোনামগুলো। তারাশঙ্করের জঙ্গলগড় ও গন্না বেগম-এর পাশে রাখা সমরেশ বসু’র গঙ্গা, শ্রীমতি ক্যাফে, ও বাঘিনী, এবং অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড় শ্রীখণ্ড প্রভৃতি। ব্যাংকে চাকুরি পাওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি-সপ্তাহে এহতেশাম কিনতেন একটি-দুটি করে উপন্যাস। স্পষ্ট মনে পড়ে, স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যাপারটা পাকাপাকি হয়ে উঠলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, বাসা ছেড়ে সপ্তা তিনেকের জন্য এসে উঠেছিলেন ফুফুআম্মার বাড়িতে। বিদেশবিভুঁইয়ে স্যুটকেসভর্তি বইপত্র ক্যারি করে নিয়ে যাওয়াটা ছিল দুরূহ, উপরন্তু তিনি রাত জেগে বাংলা উপন্যাস পড়ার অভ্যাসের বিকল্প হিসাবে কিছুদিন ধরে পাঠ করছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের বইপুস্তক, উদ্দেশ্য ছিলÑযুক্তরাষ্ট্রে ল্যান্ড করার আগে ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করে ফেলা। সুতরাং, বেশ কিছু ব্যক্তিগত আইটেমের সাথে বাক্সভর্তি বইপত্রও রেখে গিয়েছিলেন ফুফুআম্মার বাসায়।
কী এক প্রেষণায় তড়িতে বুককেসের পাল্লা খুলে―অনেক অনেক বছর আগে কেনা নিজের বইপুস্তকগুলো বিচরাতে শুরু করেন। হাতড়ানোতে বেরিয়ে আসে অসীম রায়ের রচিত আবহমানকাল নামক গ্রন্থটি। বইটি বেজায় জীর্ণ হয়ে পড়লেও এখনও প্রায়-নতুনই আছে। পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বই কেনার রশিদটিও। এটি কেনার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার বিষয়টা পাকাপাকি হয়ে উঠেছিল, ভেবেছিলেন সুদীর্ঘ বিমানযাত্রায় পড়ে নেবেন…।
একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন, তখনই চোখে পড়ে, বইগুলোর পেছনে ঠেসে রাখা বাঁধানো এক ফটোগ্রাফ। হাতে নিতেই দেখতে পান, তার বিয়ের পরদিন তোলা যুগল ছবিটি থেকে লাজুকমুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে সদ্য পরিণিতা কনে রেজওয়ানা চৌধুরী উরফে রূম্পা। নির্লিপ্তভাবে ছবিটি যথাস্থানে রেখে দিয়ে তিনি বেতের সোফায় এসে বসেন। নিজের নিরাসক্তিতে নিজেরই অবাক লাগে। বিবাহোত্তর যুগল ছবির মোকাবিলায় তার দেহ মনে যে দেখা দিচ্ছে না প্যানিক অ্যাটাকের কোনও আলামত, তাতে বিস্মিত হন আরও!
যুক্তরাষ্ট্রে এহতেশামের পেশাদারি জীবনে সফলতা হাসিল হলেও ফ্যামিলি লাইফ বলে তার তেমন কিছু ছিল না। মূলত অবাঙালি যেসব নারীর সঙ্গে তিনি ডেট করেছেন, কিংবা কখনও-সখনও লিভ টুগেদারে কাটিয়েছেন মাস কয়েকের যুগল জীবন, এদের কারও সঙ্গেই থিতু হতে পারেননি তিনি। বছর কয়েক ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, তখন সচেতন হয়ে উঠেছিলেন নিজের অন্তর্গত ডিপ্রেশন সম্পর্কে। ফুফুআম্মার পীড়াপীড়িতে অতঃপর মাসখানেকের ছুটিতে এসেছিলেন স্বদেশে। বিবাহের ব্যাপারটা তখনই ঘটে। সম্পর্কে ফুফার ভাগনি রূম্পা বছর তিনেক আগে স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে এসে বসবাস করছে পিত্রালয়ে, বড় ভাইয়ের সংসারে। এ বিবাহে এহতেশাম যে খুব আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তা নয়, তবে জোরালোভাবে আপত্তিও তুলেননি।
অভিবাসন প্রক্রিয়ার পর রূম্পা যুক্তরাষ্ট্রে সেটেল্ড হতে সময় নেয়নি তেমন। দ্রুত ইংরেজি ভাষা ও কম্পিউটারের কলাকৌশল শেখার ক্ষেত্রে সে পরিচয় দিয়েছিল দক্ষতার। চটজলদি শিখেও নিয়েছিল ড্রাইভিং। উৎসাহভরে এহতেশাম তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন কমিউনিটি কলেজে, কিনে দিয়েছিলেন গাড়ি, এমন কী জোগাড়ও করে দিয়েছিলেন একটি চাকুরি। তাদের সংসারে কেইপ কড কেতার নতুন বাড়িটি কেনা, হালফ্যাশনের ফার্নিচারাদি জোগাড় করে ঘরদোর সাজানো, বেলকনির টবে ফুলের গাছ লাগানো থেকে রান্নাবান্না প্রভৃতিতে রূম্পা শুধু প্রচুর মনোযোগ দেয়নি, স্বকীয়তারও পরিচয় দিয়েছিল। তার ওপর এহতেশাম ভরসা করতে শুরু করেছিলেন। তাদের অন্তরঙ্গতায় খানিকটা খামতি যে ছিল না, তা নয়। কখনও তারা ঝগড়াঝাটি যেমন করেনি, তেমনি পারস্পরিক সহমর্মিতার ভিত্তিতে বন্ধুও হয়ে ওঠেনি। তবে দৈহিকভাবে অন্তরঙ্গতার সময় রূম্পা নিষ্ক্রিয়ভাবে এহতেশামকে গ্রহণ করত, এবং প্রথম প্রথম সে যে নিঃশব্দে তার অভ্যন্তরে এহতেশামের উপস্থিতিকে উপভোগ করছে, তাও তিনি অনুভব করতেন। পরে ব্যাপারটা ফিকে হয়ে এলে তাদের ভেতর নীরবে দূরত্ব বেড়েছিল দ্রুত।
কিন্তু আপাতত কোনও কারণ ছাড়াই তাদের ব্রেকাপ হলো। তাকে ছেড়ে, সম্প্রতি অভিবাসন নেওয়া সাবেক স্বামীর এক কাজিনের সঙ্গে ঘর বাঁধার সংবাদটি তিনি জানলেন, ইউরোপের এক শহরে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত থাকার সময়, ইমেইল মারফত। তাদের দাম্পত্যজীবনে দ্বন্দ্ব-বিসংবাদের অস্তিত্ব না থাকলেও অন্তরঙ্গতার অভাব ছিল গোড়া থেকেই, সুতরাং এহতেশাম চেষ্টা করেন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে। বেশ ভেবে-চিন্তে, তাদের বয়সের ব্যবধান, দীর্ঘদিন প্রবাসী থাকার কারণে তার চরিত্রে খানিকটা হলেও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অভিযোজন ইত্যাদি আমলে নিয়ে, এহতেশাম অতঃপর ইমেইলে প্রস্তাব দেন ডিভোর্সের। এমন কি ম্যারেজ কাউন্সিলরের মারফত কথাবার্তা বলে, সমঝোতার ভিত্তিতে রূম্পার পাওনা খোরপোষ, দেনমোহর প্রভৃতি মিটিয়ে বিষয়টা চুকিয়ে ফেলাতে তার আগ্রহের কথা জানান। টেলিফোনে বার দুই ফলোআপ করারও চেষ্টা করেন, কিন্তু জবাব পান না।
ব্রেকাপের বিষয়টা ভাবতে ভাবতে এহতেশাম তন্ময় হয়ে বসেছিলেন ড্রয়িংরুমে। করিডোরে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে ফুফুআম্মার এদিকে আসার সাড়াশব্দ পেয়ে তিড়িক করে উঠে দাঁড়ান। না, এ মুহূর্তে তিনি ফুফুআম্মাকে ফেস করতে চান না। তো পর্দা ঠেলে দ্রুত বেরিয়ে আসেন পর্টিকোয়। দেয়ালে ঝুলন্ত আদ্যিকালের হরিণের শিং-এর তলায় ইজিচেয়ারে শুয়ে ঝিমাচ্ছেন তার ফুফা। কোনও অসুখবিসুখে ফুলে ওঠা তাঁর পা-জোড়া ছুঁয়ে আছে ফ্লোরে মোজাইকের নকশা। দাঁড়িয়ে চকিতে এক আমলের স্যুট-টাই পরে আপিস-করা মানুষটিকে অবলোকন করেন এহতেশাম। তাঁর ঠোঁটের ফাঁক গলে লালা ঝরে আর্দ্র হয়ে আছে ফতুয়ার বুক-পকেট। ফুফা বোধ করি শুয়ে শুয়ে দোয়াদরুদ পড়ছিলেন, তসবিটি মুঠো গলে পড়ে আছে মেঝেতে।
দীর্ঘশ্বাস চেপে, গাড়িবারান্দা ধরে বাগানে নেমে আসেন এহতেশাম। গন্ধরাজের শ্বেতশুভ্র ফুলে ফুলে সমাচ্ছন্ন ঝোপের কাছে দাঁড়িয়ে অনুভব করেন সৌরভের উপস্থিতি। পরাগায়ন প্রয়াসী পতঙ্গের মতো মনে ফিরে আসে ব্রেকাপের সময়কার দ্বন্দ্ব-বিধুর ঘটনাক্রম।
এ সময় কাকতালীয়ভাবে কর্মক্ষেত্রে এহতেশামের পদোন্নতি ঘটেছিল, বদলি হয়েছিলেন তিনি অভারসিজ সেলস ও মার্কেটিং বিভাগে। দায়িত্ব ও চাপ বেড়ে ছিল ব্যাপকভাবে। দূর-দূরান্তের নগরগুলোতে, এবং কখনও-সখনও ট্যুরে ইউরোপেও যেতে শুরু করেন ঘন ঘন। এ হেন পরিস্থিতিতে ডিভোর্স-সংক্রান্ত আনফিনিশড বিজনেসটি অসমাপ্তই থেকে যায়, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তার যে মেন্টাল স্পেস―তাও সংকুচিত হয়ে আসে। সময় বয়ে যায়। এক সময়ের আরামদায়ক পুরোনো জুতা-জোড়ায় পা গলানোর মতো এহতেশামের দিনযাপনে ফিরে আসে ব্যাচেলর-সময়ের অভ্যাসাদি। দিনের কাজবাজ সেরে, সানডাউনের পর যেতে শুরু করেন নগরীর চেনা পাবে। পরিমিত পানে উষ্ণ হয়ে অতঃপর ঢোকেন বিলিয়ার্ড পার্লারে। পুল-গেইমে কিছু টাকাপয়সা খোয়া গেলেও তেমন কিছু মনে করেন না। লেবানিজ কিংবা গ্রিক রোস্তারাঁর টেকআউট ডিনার নিয়ে একা একা ফেরেন, রেনট্রিতে ছত্রছায়ায়, রূম্পার পছন্দ-মোতাবেক কেনা কেইপ কড কেতায় নির্মিত নিজস্ব বাড়িটিতে।
এহতেশামের সংসার ছেড়ে যাওয়ার সময় রূম্পা তার নিজস্ব জিনিসপত্র, এমন কি নিজে খুঁটিয়ে পছন্দ করে কেনা মাসটাং গাড়িখানাও নিয়ে যায়নি। ড্রাইভওয়েতে দিন-কে-দিন রোদবৃষ্টিতে ভিজে, ব্যাটারির বিদ্যুৎ ফুরিয়ে, রঙ জ্বলে ক্রমশ মলিন হতে থাকা রূম্পার ফার্স্ট-কার, বনেটে বুনোঘোড়ার ফিগারিন লাগানো তার প্রিয় মাসটাংখানার দিকে আড়চোখে চেয়ে মাঝেমধ্যে এহতেশাম ভাবেন, মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তা বলাটা জরুরি, আরেক দফা ট্রাই করলে কেমন হয় ? ততদিনে রূম্পা শুধু টেলিফোন নাম্বার বদলায়নি, তার ইমেইল আইডি থেকে এহতেশামের মেইলগুলোও বাউন্স করতে শুরু করেছে। যে ফার্মে সে চাকরি করত, ওখানে রিং করে অতঃপর তিনি জেনে নেন নতুন যে জায়গায় সে কাজ করছে তার ঠিকানা। তারপর মাসটাং কার-এর ব্যাটারি বদলিয়ে তাতে তুলেন স্যুটকেস-ভর্তি রূম্পার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যথা শাড়ি, কিছু গহনা, কসমেটিকস, টপস, ট্রাউজার্স ও ড্রেস প্রভৃতি ।
লাঞ্চব্রেকের সময় ক্যাফেটেরিয়ায় রূম্পাকে স্পট করতেও সমস্যা কিছু হয় না। খানিক দূর থেকে―একটি টেবিলে স্যুপের বাটির সামনে একাকী বসে আকাশপাতাল ভাবা রূম্পাকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠেন এহতেশাম! মেয়েটি শুধু শীর্ণকায় হয়নি, শরীর-স্বাস্থ্যরও অবনতি হয়েছে প্রচুর। তার পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপক পরিবর্তন তাকে দারুণভাবে অবাক করে! প্রচুর দ্বিধা নিয়ে অতঃপর সামনে এসে দাঁড়ালে, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রূম্পা হিজাব টেনেটুনে তার পর্দাকে সুদৃঢ় করে এহতেশামকে মোকাবিলা করে। তার মুখ থেকে নিরাসক্ত স্বরে বেরিয়ে আসে, ‘ইউ আর ফলোয়িং মি.. রাইট ?’ চেয়ার টেনে বসতে বসতে জবাব দেন এহতেশাম, ‘নো, অ্যাম নট, তোমার জামা-কাপড়, জিনিসপত্র এসব পৌঁছে দিতে আসলাম, দ্যাটস অল,’ বলে তিনি তার সামনে রাখেন রুম্পার প্রিয় ক্যারামেল চকোলেটের বড়সড় একটি বার। নির্লিপ্তভাবে বারটি ফিরিয়ে দিয়ে সে বলে, ‘লুক, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।’
ডিসয়েপোয়েন্টমেন্টটা নীরবে হজম করে নিয়ে এহতেশাম মিনমিনিয়ে বলেন, ‘তোমার নিজস্ব জিনিসপত্রের স্যুটকেসটা অন্তত রাখো, তারপর আমি… অবকোর্স দূর হব―তোমার চোখের সামনে থেকে।’ প্রতিক্রিয়ায় অসংলগ্নভাবে রূম্পা চার-পাঁচটি বাক্য বলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে মাথা নিচু করে। এহতেশাম বুঝতে পারেন, সাবেক স্বামীর যে কাজিনের সঙ্গে সে বসবাস করছে, তিনি নারীদের জীবনযাপনে পর্দাপ্রথার পুরোপুরি প্রতিফলন দেখতে চান। সুতরাং আগেকার জীবনের অনাবৃতিবহুল জামাকাপড় নিষ্প্রয়োজন। শেষ চেষ্টা হিসাবে এহতেশাম প্রস্তাব করেন, ‘তোমার ফেভারিট মাসটাং গাড়িটি অন্তত রাখো, কাজে লাগবে, আমি না হয় স্যুটকেসসহ উবার ডেকে বাড়ি ফিরি।’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে রূম্পা বলে, ‘ইফ ইউ কনটিনিউ টু হেরাস মি..,’ বলেই ফুঁফিয়ে উঠে কান্না লুকাতে স্কার্ফে মুখ ঢাকে। তার উচ্চগ্রামের প্রতিক্রিয়ায় আশপাশের টেবিলে লাঞ্চরত মানুষজন মুখ তুলে তাকায়।
‘আই অ্যাম স্যরি, সো স্যরি…’, বলতে বলতে বিব্রত ভঙ্গিতে এহতেশাম ক্যাফেটেরিয়া ছাড়েন। পার্কিংলটের দিকে যেতে যেতে মনে পড়ে, রূম্পার সঙ্গে বিবাহের সম্ভাবনা যাচাই করতে গিয়ে তার ফুফুআম্মা এহতেশামকে খোলাখুলি জানিয়েছিলেন যে, মেয়েটির সব কিছুই ভালো, তবে ধর্মকর্মে, পর্দাপুশিদায় আগ্রহ কম। সাবেক স্বামীর সংসারে শাশুড়ি কড়া রকমের পর্দা―এমন কী নিকটাত্মীয়দের সামনে যেতে বোরকা পরার জন্য চাপ দিলে সূত্রপাত হয়েছিল পরিবারের নানাজনের সঙ্গে ঘোরতর দ্বন্দ্বের, পরিণতিতে তালাকপ্রাপ্ত হয় সে। কিন্তু আজ, একটু আগে, রূম্পাকে যে রকম হিজাববৃতা দেখলেন, ফুফুআম্মার দেওয়া তথ্যের সাথে এ অভিজ্ঞতাকে কিছুতেই মেলাতে পারেন না। দাম্পত্যজীবনে রূম্পাকে তিনি কাছ থেকে অবলোকন করেছেন, গড়পড়তা অন্যান্য আধচেনা বাঙালি নারীদের চেয়েও তাকে মনে হতো পোশাকআশাক ও আচরণে অনেক বেশি উত্তরাধুনিক। মাসটাং গাড়িটি স্টার্ট দিতে দিতে এহতেশামের ভারী বিভ্রান্ত লাগে।
বাড়ি ফিরেন এহতেশাম, কিন্তু স্বস্তি পান না। মনে হয়, অসাবধানে জংলা জায়গায় ঘোরাফেরার সময় সারা শরীরে বিঁধে গেছে কাঁকড়া বিছার সুচালো পশম। উইক-ডের বিকালে সচরাচর যা করেন না, আজ তাকে তাই করতে হয়, পাড়ার পাবে বসে পান করেন অপরিমিত মাত্রায়। সন্ধ্যারাতে ঘরে ফিরে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করেও ফিরিয়ে আনতে পারেন না মেজাজের ভারসাম্য। তো লিখতে বসেন ডায়েরি, কিন্তু কলমের ডগায় ফুটে না কোনও বাক্য, তার স্নায়ুতন্ত্রীগুলো ততক্ষণে ঘাসফড়িংয়ের মতো থেকে থেকে লাফিয়ে উঠছে। ঘাড়-গলা ও সম্প্রতি রুপালি হয়ে আসা জুলফির চুলে কিছুক্ষণ আইসপ্যাক ঘষে অতঃপর কায়ক্লেশে লিখেন একটি বাক্য, ‘ডোন্ট নো হোয়াই ফিলিং সাচ অ্যা টেরিবল সেন্স অব লোনলিনেস।’
বিছানায় শুয়ে পড়ে, অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও রিল্যাক্স হতে পারেন না এহতেশাম। তো মাঝরাতে বাতি জ্বেলে স্টিরিওতে কিছু বাজানোর কথা ভাবেন। মিউজিক সেন্টারের সর্বত্র সুচারুভাবে গুছিয়ে রাখা রবীন্দ্রসংগীতের সিডিগুলো তাকে ক্ষুদ্ধ করে। অভিবাসন পেয়ে এ দেশে আসার সময় এগুলোর বেশ কয়েকটি রূম্পা সাথে করে নিয়ে এসেছিল। বাকিগুলো দূর- দূরান্তের শহরগুলোতে ড্রাইভ করে গিয়ে, বাঙালি-দোকান ঢুঁড়ে সে সংগ্রহ করেছিল। তার নিবিড় সান্নিধ্যে অনেক বছর পর প্রবাসে তিনি শুনতে শুরু করেছিলেন শৈশব-কৈশোরের প্রিয় বাংলা গানগুলো। কেন জানি আজ আর এগুলো স্পর্শ করতেও ইচ্ছা হয় না।
এহতেশাম সিডিগুলো ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে, তন্নতন্ন করে সর্বত্র খুঁজে অতঃপর বের করেন, পরবাসে আসার প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাসের সময় সংগ্রহ করা কিছু গানের সিডি। এগুলো থেকে বেছে ‘ইউক্লিপস অব হার্ট’ নামক একটি অ্যালবাম তিনি প্লেয়ারে ঢুকিয়ে বাটন অন করেন। বনি টেইলারের কণ্ঠস্বরে বেজে ওঠে, ‘এভরি নাউ এন্ড দেন, আই গেট অ্যা লিটিল বিট লোনলি/ অ্যান্ড ইউ আর নেভার কামিং অ্যারাউন্ড…।’ তারপর কিচেনে গিয়ে গ্লাসে কড়া ধাঁচের নির্জলা পানীয় ঢেলে এসে বসেন, বেডরুমের সংলগ্ন বেলকনিতে। তারপর বনি টেইলারের অনবদ্য কণ্ঠস্বরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন ‘এভরি নাউ অ্যান্ড দেন, আই গেট অ্যা লিটল বিট টায়ার্ড/ অব লিসেনিং টু দি সাউন্ড অব মাই টিয়ার্স…।’
কর্মক্ষেত্রে এহতেশামের দায়িত্ব আরও সম্প্রসারিত হয়। মাস কয়েকের জন্য যেতে হয় তাইওয়ানে। ফেরার পথে উড়োজাহাজে পাশের সিটে বসা ভায়োলেতাকে দেখে একটু অবাক হন! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হিস্পানিক এ মেয়েটির সঙ্গে বার কয়েক তিনি ডেটে গিয়েছিলেন। ওই অন্তরঙ্গ ইভেন্টগুলো আহামরি রকমের রোমাঞ্চকর কিছু ছিল না। তবে কখনও-সখনও উইকয়েন্ডে ক্যাম্পাস-সংলগ্ন উপবনে সন্ধ্যাবেলা জোনাকি দেখতে যাওয়া, অল্পবিস্তর মেইক আউটের পর লাইভ মিউজিকে সরগরম কোনও রেস্তোরাঁয় ডিনারে বসে ব্লুগ্রাস মিউজিক শুনতে শুনতে, সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিসরে সম্প্রতি আলোচিত হওয়া কোনও উপন্যাস নিয়ে কথাবার্তার প্রসঙ্গ ফিরে আসে স্মৃতিতে।
পাশের সিটে বসে ভায়োলেতা রিফ্রেশিং টাওয়েলে ঘাড়-গলা মুছতে মুছতে মৃদুস্বরে বলে, ‘আই হ্যাভেন্ট সিন ইউ ফর সাচ অ্যা লং টাইম, লেটস আপডেট আওয়ার লাইভস অ্যা বিট।’ সিঙ্গেল-মাদার ভায়োলেতা তার মা-বাবার বসতবাড়ির নিচের তলার বেইসমেন্টে বাস করছে। পেশায় সে ‘ইংলিশ অ্যাজ অ্যা সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ’ প্রোগ্রামের ইন্সট্রাক্টর। বছর দুয়েক সে ‘পিস কৌর’ নামে একটি সংস্থার হয়ে কাজ করেছে কাঠমান্ডুতে। তখন মাত্র মাস-সাতেকের মেয়াদে দারুণ রকমের রোমান্টিক সম্পর্ক হয়েছিল গোরখা এক ট্যুরগাইডের সঙ্গে। সাংস্কৃতিক ব্যবধানের জন্য এ সম্পর্কটি টেকেনি তবে ফলে জন্ম হয় তাদের শিশুসন্তানের। ছেলেটিকে নিয়ে সে সিঙ্গেল মাদার হিসাবে ফিরেছে যুক্তরাষ্ট্রে, বছর পাঁচেক আগে। এ মুহূর্তে ভায়োলেতার মা-বাবা তার ছয় বছরের ছোট্ট ছেলে এমিলিয়ানোর দেখভাল করছে। তাইওয়ানে সে গিয়েছিলো দু সপ্তাহের জন্য একটি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ প্রোগ্রামে কন্সালটেন্সি করতে। এ পর্যন্ত জানিয়ে ভায়োলেতা অরেঞ্জ জুসের সাথে গোটা দুই নিদ্রাকর্ষক ট্যাবলেট মেলাটোনিন গিলে, হাই তুলে, চোখে আই-প্যাচ লাগিয়ে চেষ্টা করে ঘুমানোর।
ডেট্রোয়েট নগরী থেকে সামান্য দূরের ছোট্ট এক শহরে বসবাস করছে ভায়োলেতা। তাদের নিয়মিত যোগাযোগে ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার সহায়ক হয়ে ওঠে। কোনও কোনও ফ্রাইডের সন্ধ্যায়, দিনের কাজবাজ সেরে ভায়োলেতা এসে এহতেশামের আপিসের কাছাকাছি মেক্সিকান রেস্তোরাঁয় মার্গারিতার পানপাত্র হাতে অপেক্ষা করে। ডিনারের পর কখনও তারা ডিসকো লাইটের রঙিন আলোয় সুয়িং ড্যান্সেও শরিক হয়। কখনও ভায়োলেতা আগের মতো নিয়ে আসে সদ্য পাঠ করে শেষ করা কোনও উপন্যাস যথা রিডিং লোলিতা ইন তেহরান, বা টিন ড্রাম প্রভৃতি। তাদের মধ্যে বিনিময়ও হয় একটি দুটি সিডি।
একদিন রেস্তোরাঁয় এহতেশামকে দেখতে না পেয়ে, টেলিফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগেও ব্যর্থ হয়ে ভায়োলেতা টেক-আউট খাবারের প্যাকেট নিয়ে, খুঁজেপেতে চলে আসে তার বাড়িতে। লিভিংরুমের বাতিটি নিভিয়ে ঝিম ধরে চুপচাপ বসেছিলেন এহতেশাম। আজ যে তার জন্মদিন তা মনেই ছিল না। ভায়োলেতা ছোট্ট একটি চকোলেট কেকের ওপর কেবল একটি মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে, উপহার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাদের প্রিয় পপ সিংগার বনি টেইলারের সিডি তথা―‘দ্যা ওয়াল্ড স্টার্টস টুনাইট’ শিরোনামের অ্যালবামটি তার হাতে তুলে দিলে, তা স্টিরিওতে পুরে, অন বাটন টেপেন এহতেশাম। কামরাটি ভরে ওঠে বনির দুঃখজাগানিয়া হাস্কি ভয়েসে।
ততক্ষণে ভায়োলেতা কিচেন থেকে ক্রিস্টালের দুটি শটগ্লাস জোগাড় করে তাতে ঢালছে টাকিলা। লবণ মাখানো লেবুর সাথে তা পান করতে করতে তাদের মৃদু মেইক আউট বসনহীনতার পর্যায়ে পৌঁছে, এবং তার মানসমহলে অনেক দিন পর পাপড়ি মেলতে শুরু করে বসন্তের পুষ্পদল। কাউচের কুশনগুলো ধামসে তাদের দৈহিক মিথস্ক্রিয়া পৌঁছায় রীতিমতো বাড়াবাড়ির পর্যায়ে। বনির ঝংকৃত স্বরের সাথে মিশে যেতে থাকে ভায়োলেতার শীৎকারঋদ্ধ অস্ফুট স্বর। ডিনারের অবকাশ আর হয় না, শারীরিক উদ্দীপনার অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন তারা দুজন কার্পেটে, আর স্টিরিওতে কেবলই বাজতে থাকে বনি টেইলারের রাস্পি ভয়েসে ‘টুনাইট আইম গোনা লাভ ইউ/… টু নাইট আই উইল টেইক মাই ফুট অফ দ্যাট ব্রেইক/…হোয়াট ইজ অভার ইজ পাস্ট/অ্যান্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড স্টার্টস্ টুনাইট/ অহ অহ অহ দ্যা ওয়ার্ল্ড স্টার্টস টুনাইট…।’
এত কিছুর পরও এহতেশাম ও ভায়োলেতার সম্পর্কটি আগায় না তেমন, তবে ভেতরে ভেতরে এহতেশাম অনুভব করেন, ইট ইজ টাইম টু সেটেল্ড থিংস উইথ রূম্পা। বিষয়টা নিষ্পত্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠেন তিনি।
তো এক শনিবারের সকালে গুছিয়ে রূম্পার অফিসের ঠিকানায় ফের ডিভোর্সের প্রস্তাব করে চিঠি পাঠান। বিশেষ দ্রষ্টব্যে হাইলাইটারে দাগিয়ে লিখেন, ‘তোমাকে বিরক্ত করা আমার উদ্দেশ্য নয়, তবে ডিভোর্সটা করে রাখলে আখেরে লাভবান হবে তুমি। যাকে ভালোবেসেছো, যার সঙ্গে সংসার করছো, তাকে বৈধভাবে বিবাহও করতে পারবে।’ দিন তিনেক পর জবাব আসে। রূঢ় ভাষায় তাকে শাসিয়ে রূম্পা লিখেছে, ফের তাকে চিঠিপত্র লিখে বিরক্ত করলে সে আইনি ব্যবস্থা নেবে, রেসট্রেইন অর্ডারের জন্য আদালতে দরখাস্ত করবে। বিশেষ দ্রষ্টব্যে সেও হাইলাইটারে দাগিয়ে কমেন্ট করেছে, যার সঙ্গে সে আপাতত লিভ টুগেদার করছে, তিনি যে বিবাহিত, তা সে সম্প্রতি জেনেছে। দেশে ফেলে আসা তার স্ত্রী অভিবাসন প্রক্রিয়া শেষে অলরেডি ভিসা পেয়ে গেছেন। কিছুদিনের মধ্যে শিশুপুত্রকে নিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। সুতরাং ঘোড়ার ডিমের ডিভোর্স নিয়েই বা হবে কী ?
চিঠি পড়ে প্রথমত বিভ্রান্ত হন এহতেশাম। তারপর রেগে গিয়ে ভায়োলেতাকে ক্যারিবিয়ান ক্রুজে বাহামা দ্বীপে তিন-রাত্রি কাটানোর নিমন্ত্রণ জানান। বাহামার সৈকত-সমৃদ্ধ আবহে তাদের দৈহিক মিথস্ক্রিয়ায় যেন দিব্য ফুল ফুটে। নেপালে বছর দুয়েক কাটানো ভায়োলেতা ওই দেশে সৃজিত সূত্র-মোতাবেক হরেক আসনের অনুশীলনে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এহতেশামকে ফের চমৎকৃত করে। ক্যারিবীয় সমুদ্রের উষ্ণণ্ডলীয় আবহাওয়ার জন্য বিখ্যাত দ্বীপদেশ বাহামায় তাদের দারুণ সময় কাটলেও ফেরার পথে, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে মার্গারিতা পান করতে করতে ভায়োলেতা নিরাসক্ত স্বরে তাকে বলে, ‘স্যরি এহতেশাম, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু রেইজ ইয়োর হোপ আপ, আই রিয়েলি লাইক টু বি ট্রুথফুল অ্যান্ড ট্র্যান্সপারেন্ট…।’
এহতেশাম জানতে পারেন, কাঠমান্ডুর গোর্খা ট্যুরগাইডটিকে ভায়োলেতা সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছিল, কিন্তু তরুণটির পরিবারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বাধ্য হয়ে তারা বেছে নিয়েছিল ব্রেকাপ-এর বন্ধুর পথ। কিন্তু নানা ভাবনাচিন্তা করে অতঃপর ভায়োলেতা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, সে চায় না, তাদের ছয় বছরের ছেলেটি পিতৃপরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠুক। তো উকিল-মোক্তার ধরে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে, সম্প্রতি ভায়োলেতা গোর্খা যুবকটিকে ফিঁয়াসে ভিসা পাঠাতে সমর্থ হয়েছে, যাতে সে অভিবাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারে। মাস-পাঁচেকের ভেতর গোর্খা-তরুণটি এসে ল্যান্ড করবে যুক্তরাষ্ট্রে। তথ্যটি শুনে এহতেশাম কিছু বলেন না, প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেন না কিছু, তবে সরে এসে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন হাজার তরঙ্গের অভিঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ অগাধ জলরাশির দিকে। তার মনে হয়, জাহাজে ওঠার ঠিক আগ-মুহূর্তে কে যেন জেটির ঝুলন্ত সেতুটি গুটিয়ে নিল।
ফুফুআম্মাদের বাগানে পায়চারি করতে করতে এহতেশাম ভায়োলেতার সঙ্গে তার হার্দিক সম্পর্ক থিতিয়ে আসার বিষয়টা নিয়ে ভাবছিলেন। একটু ক্লান্ত লাগে। হাস্নাহেনার কলিগুলো মনে হয় ফুটতে শুরু করছে, বাতাসে উড়ছে মন সম্মোহন করা সৌরভ। এহতেশাম রঙ্গনের ঝাড়টির পাশ দিয়ে হেঁটে এসে বসেন দোলনায়। মনে ফিরে আসে তার সান্নিধ্যে রূম্পার শেষের সে দিনগুলোর কথা। ভায়োলেতার আচরণে নিজের নিভৃতে নিবিড়ভাবে আহত হয়েছিলেন এহতেশাম। কিন্তু শপিংমলের চলন্ত সিঁড়ির মতো তার জীবন কিন্তু তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ক্যারিয়ারের খাড়াই-খাতটি ধরে। কেবলই উপরে উঠছিলেন, মাঝেমধ্যে যে রূম্পার সঙ্গে অমীমাংসিত ব্যাপারটি তাকে পীড়া দেয়নি, তা নয়। কিন্তু এ বাবদে কিছু করার উদ্যম হারিয়েছিলেন পুরোপুরি। বছরের পর বছর অতিক্রম করেছেন, রূম্পার সঙ্গে কখনও কাকতালে যেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, তেমনি তার জীবনে কী ঘটছে, তা-ও জানতে পারেননি তিনি।
দিন-চারেকের ট্রিপে লস অ্যাঞ্জেলেস যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এহতেশাম। পাশের শহরের স্যোশাল সার্ভিস থেকে একজন কর্মী ফোনে তাকে রূম্পার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা জানান। ট্রিপ ক্যান্সেল করে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার সময়, পুরো পরিস্থিতি বৈশাখী মেঘের মতো তার মাথায় চক্রাকারে ছড়ায় ঝড়ো অস্থিরতা। দিন-দশেক আগে, শহরের হোমলেস শেল্টার থেকে অসুস্থ রূম্পাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চিকিৎসার অভাবে ততদিনে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সংক্রমণ শরীরের অন্যান্য ভাইটাল অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও ছড়িয়েছে। অনকোলজিস্টের ধারণা, তার জীবনের মেয়াদ বড়জোর মাস-দিন। হাসপাতাল রূম্পার সম্মতিতে নিকটাত্মীয় খুঁজছে।
হাসপাতালে পৌঁছে রিসেপশনে একাধিক কাগজে সই করে তার চিকিৎসা খরচের দায়িত্ব নেন এহতেশাম। স্যোশাল সার্ভিসের মহিলা-কর্মীটি ব্যাখা করেন দুটি অপশন; তথা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রফেশনাল নার্স রেখে সেবা দেওয়া, বিকল্প হিসেবে হসপাস বা মৃত্যুপথযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত ক্লিনিকে তাকে পৌঁছে দেয়া। প্রথম অপশনটি নিয়ে চাপা স্বরে কথা বলতে এহতেশাম গিয়ে পৌঁছান ওয়ার্ডের এক কোণে স্ক্রিন দিয়ে আলাদা করা রূম্পার বেডে।
নার্সের ডাকাডাকিতে সমুদ্রতল থেকে আচমকা ভেসে ওঠা ডুবুরির মতো রূম্পা চোখ মেলে তাকায়। তাকে চিনে উঠতে বোধ করি একটু সময় নেয়, তারপর ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসি ফুটিয়ে প্রশ্ন করে, ‘এতদিন আসোনি কেন ?’ জবাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এহতেশাম, নার্স তাকে চুপ থাকতে ইশারা দেয়। রূম্পা যেন ফের চলে যায় সুপ্তির অগাধ অতলে। বুঝতে পারেন, প্রদাহ প্রবল হওয়ার কারণে কিছুক্ষণ পর পর তাকে দেওয়া হচ্ছে পেইন কিলার। বাড়ি যেতে সে যে অনিচ্ছুক নয়, তার প্রমাণস্বরূপ নার্স তার হাতে তুলে দেন কনসেন্ট পেপার, আজ ভোরে নাকি কিছু সময়ের জন্য ফিরে এসেছিল রূম্পার সংবিৎ, তখন সে স্বেচ্ছায় এহতেশামের ঠিকানা দিয়ে এ কাগজটিতে সই করেছে।
অনকোলজিস্টের হিসাবে মনে হয় কিছু একটা গলদ ছিল। প্রাইভেট নার্সের তদারকিতে বাড়িতে ফিরে তার চেনা বিছানায় শুয়ে, আধোঘুম আধো-জাগরণে রূম্পা বেঁচেছিল পুরো পাঁচ-দিন। একদিন তার সংবিৎও ফিরেছিল মিনিট সাতেকের জন্য, তখন জানতে চেয়েছিল―বারান্দায় যে ফুলের গাছগুলো লাগিয়েছিল, তাতে নিয়মিত জল দেওয়া হচ্ছে কি না ?
মরদেহ ফিউনারেল হোমে পাঠিয়ে, সন্ধ্যার পর রূম্পার পছন্দ-মোতাবেক কেইপ কড কেতায় নির্মিত বাড়িটির বাগানে, আজকে যে রকম ফুফুআম্মাদের বাগিচার দোলনায় বসে আছেন, ঠিক এ রকম ঝিম ধরে লোহার বেঞ্চটিতে বসেছিলেন এহতেশাম, আর পয়লাবার তার করোটিতে সক্রিয় হয়েছিল অজস্র শ্রমিক মৌমাছি। হাস্নাহেনার গন্ধে মথিত হয়ে বসে থাকেন তিনি নিশ্চুপ, আর বসে বসে ভাবেন, মৌমাছিগুলো আজ সক্রিয় হচ্ছে না কেন ? পাড়ায় মসজিদের মাইক্রোফোনে ছড়ায় এশার আজানের প্রলম্বিত ধ্বনি।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ



