
এক
দড়ি গাছা হাতে নিয়ে হাঁটতে থাকে শেফালি।
শ্রাবণ মাস। গত দুই দিন তেমন বৃষ্টি হয়নি। বেশ গুমোট। আর কিছুটা পথ পেরুলেই মোড়লদের কলম বাগান। গড়াগাছি পুকুরের পাড় ধরে হাঁটছে সে। বড় বড় কেশি ঘাস আর লতাপাতায় আচ্ছন্ন পথ। পায়ে হাঁটা পথরেখাটি এখন আর দেখা যায় না। জৈষ্ঠ্যের শেষাশেষি বাগানের আম শেষ হয়েছে। তারপর থেকে এ-পথ বোধ হয় আর কেউ মাড়ায়নি।
পথের দু পাশে মদন কটকটির কাঁটা ঝোপ। কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে। ছোট ছোট সাদা আর হালকা গোলাপি ফুল। গোলমরিচের আকারের থোকা থোকা সবুজ, লালচে ফল ধরে আছে। ফুলে ফুলে প্রজাপতি উড়ছে। কেউ স্থির ডানায় বসে মধু পানে ব্যস্ত। বেশ সুন্দর সুগন্ধে জায়গাটা ম ম করছে। মদন কটকটি এমনি সুবাস ছড়ায়। একটা কানাকোয়া এক ঝোপ থেকে ছোট্ট লাফে আরেক ঝোপে চলে গেল। বর্ষার জলে সতেজ তেলাকুচা কেমন যেন অহংকারী। ঝোপের মাথায় মাথায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। টুনটুনি বুলবুলি সা রে গা মা পা-এর আসর বসিয়েছে।
শেফালির পায়ের শব্দে একটা গো-সাপ সড় সড় করে পুকুরের জলে নেমে যায়। গা টা কেমন ছমছম করে ওঠে। একটু থমকে দাঁড়ায় সে। এখন দুপুর। মাথার উপর সাদা সাদা মেঘ মন্থর গতিতে হেঁটে চলেছে। কোথায় যাবে কে জানে। আকাশটা আজ বড় মায়াবী মনে হচ্ছে। গাছপালা লতাপাতা পাখি সব যেন কেমন নতুন ঠেকছে। বড় মায়াময়। আপনজনের মতো। কবছরই বা সে গ্রামে ছিল না–সে তো গ্রামেরই মেয়ে। গ্রামেই মানুষ। বন বাদাড় গাছপালা সব সেই কোন ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। এমন তো কখনও মনে হয়নি। দুটি বুলবুলি পাখি নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কী মিষ্টি স্বর! কী আবেগ ভরা তাদের আলাপ। এমন করে কোনওদিন বুলবুলির কথা শোনা হয়নি। চিরকাল কি পাখিরা এমন করে কথা বলে ? ভালবাসে ? বাসে বুঝি। আর দেখা হবে না।
আকাশে মন্থর মেঘের উদাস হেঁটে যাওয়ার সঙ্গে তার মনটাও কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। আরেকটু গেলেই মোড়লদের বাগান। উদাস মনটা আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনে শেফালি। আতা গাছের ডালে এই নির্জন দুপুরে কণ্ঠি ঘুঘু ডেকে চলেছে। এক বিষণ্ন মায়াময় ডাক। কেমন একটানা সুরে ডাকছে। ডাকছে নাকি কাঁদছে ? কেন কাঁদবে ? কী দুঃখ তার ? প্রাণিমাত্রই বুঝি দুঃখ থাকে, থাকে কান্না। থাকে বুঝি! পাখিরাও তবে কাঁদে! মনটা ভারী হয়ে আসে শেফালির। একটু দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকিয়ে থাকে ঘুঘুটির দিকে। এতক্ষণ গাছপালা লতাপাতা কেমন সব আনন্দমুখর মনে হচ্ছিল। প্রজাপতির ডানায় ডানায়, টুনটুনির পায়ে পায়ে কেমন যেন নৃত্য ছন্দ ছিল। এখন ঘুঘুর ডাকে নির্জন এই নিরালা দুপুর কেমন এক বিষণ্নতায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
পায়ের উপর পাতা পিলপিল করছে। সেদিকে তাকাতে দেখে নরম মাটি ফুঁড়ে একটা কেঁচো তার পায়ের উপর উঠছে। পাটা একটা ঝাড়া দেয় শেফালি। কেমন যেন ঘেন্না লাগে এই প্রাণিটিকে। তবে পা দিয়ে চেপে মারে না। ঘৃণা শব্দটা মনে হতেই চোখ-মুখ কেমন একটু বেঁকে যায়। একটা তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা ফুটে ওঠে সেই হঠাৎ বাঁকা চোখে-মুখে। মুখে উচ্চারণ করে হু, ঘৃণা, বে-বুশ্যা মাগির আবার ঘৃণা!
বেশ্যা বলে বুঝি ঘৃণা থাকতে নেই, গ্লানি থাকতে নেই। বেশ্যারা বুঝি মানুষ নয়, তাদের মান-অপমান বোধ থাকতে নেই। এখনও এমনটাই ভাবে অনেকে। গতকাল সন্ধ্যায় কি দাপটের সঙ্গে রামু কাকা বলে দিল বে-বুশ্যা মাগির এই গ্রামে কোনও জায়গা নাই। গ্রামের পরিবেশ নোংরা হতে দেব না আমরা। যেখানকার ঢেউ সেখানেই যাক। আমরা কেউ সেই নরকে ডুবতে যাব না।
চন্দন ছুড়াটারই বা তেজ কত! মাথায় কাকের বাসা নিয়ে হাত পা ছুড়ে ছুড়ে সে কি গালাগাল। এক ইজ্জতের কত খোয়ার। গাধা ঘোড়া পার করে মোবাইলের টাওয়ার নিয়ে ঠেলাঠেলি। মানুষ এমন বজ্জাত হয় ? জিভ দিয়ে এমন নোংরা কথা বলতে পারে ? সোনাগাছির ঘরে বসে আট বছরে সে কত মানুষ দেখেছে। কত রকম তাদের চাহিদা। দেহটা ভোগ করার কত সব কায়দাকানুন, ফন্দিফিকির। তবে কথার এমন ঝাঁজ তাদের ছিল না। তারা এমন গিরগিটি নয়।
এরা গিরগিটিই তো। কাল সন্ধ্যায় সালিশ ডেকে রামু কাকা যে দাপট দেখাল, যে শাসন করল, তা কী করত ? করত না, যদি সে সেদিন দুপুরে রামু কাকার কথা শুনত।
গত কয়েক দিন আগে দুপুরবেলা রামু কাকা বারবাড়ির গোয়ালঘরের মুখে বসে ছিল। বাড়ির পিছনের বাঁশঝাড়ের পথ ধরে শেফালি ফিরছিল ও-পাড়া থেকে। হাতের ইশারায় কাছে ডাকে রামু কাকা। ফিসফিস করে দু-চারটে কথা বলেই হাতটা বাড়িয়ে দেয় শেফালির বুকে। ঝট করে দুপা পিছিয়ে যায় শেফালি। হাতের টানে বুকের এক পাশের কাপড় সরে যায়। সেটা ঠিক করতে করতে আরো দু-পা পিছায় শেফালি। শূন্য বাতাসে খলবল করে রামুর হাত। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় সে। চোখের ইশারায় গোয়ালঘর দেখায়। ওখানে দাঁড়াও কাকা। এরপর এগুলে আমি কিন্তু চেঁচাব। পাড়া জড়ো করব।
থমকে যায় রামু। কামনাহত রামুর ভেতরটা জ্বলে যায়। হাতের শিকার ফস্কে তো গেলই তার উপর বেশ্যা মাগি হয়ে তাকে শাসায়! বলে কিনা চেঁচিয়ে লোক ডাকবে। কামনার আগুনে বেশ্যার শাসানির ঘি পড়ে। জ্বলে উঠে রামু।
রামুর বয়স তো কম হয়নি। পঞ্চাশের কোঠায় বয়স। এত বছরের জীবনে গাঁয়ে ঘরের মেয়ে সে কম ঘাঁটেনি। মেয়েমানুষের মুখ ঝামটা যে খায়নি এমন নয়। কতজনে কত কথা শুনিয়েছে। আবার ধরাও দিয়েছে। তাদের কথা আলাদা। বেশ্যা মাগি কি না তাকে তেজ দেখায়। লোকলজ্জার ভয় দেখায়। থাম মাগি, তোর যদি ইজ্জত নিলামে না তুলি তো…।
গ্রামে আসার পর থেকে মাঝে মাঝে শেফালিদের বাড়িতে আনাগোনা শুরু হয় চন্দনের। ঠারেঠুরে মনের কথা বলে। শেফালি পরিষ্কার করে বলে দেয়, দেখ চন্দন তোরা গাঁয়ের ছেলে, ভালো ছেলে। আমার মতো পাঁকে কেন ডুব দিবি ? আমার এই শরীর বড় নোংরা রে। এ নর্দমায় নামিস না। তাছাড়া গাঁয়ে ঘরে আমি ওসব করব না। বাড়িতে একটা মুদির দোকান দেব আর সন্ধ্যা বেলায় চপ-বেগুনি-পেঁয়াজি ভাজব। তোরা পাশে থাকিস।
সেদিন চলে যায় চন্দন। পরে আবার আসে। তবে একা নয়, তিনজন। জোর দেখায়। জোর করে শরীরের দখল নিতে চায়। শেফালি হাতে একটা ক্ষুর বাগিয়ে ধরে বলে, ভাগ কুত্তার দল, ভাগ। বেশি এগুলে গোড়া থেকে কেটে নেব।
চন্দনদের সেদিন কুকুর তাড়া করেছিল শেফালি। আশ্বিন মাসের কুকুরের রোখ চেপে থাকে চন্দনের মাথায়।
দুই
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে দেশে। চারিদিকে দাউ দাউ জ্বলছে চিতা। নদীতে ভেসে আসছে লাশ। কবর খোঁড়ার বিরাম নেই। হাসপাতালগুলি সব রোগীতে ভর্তি। তিল ধারণের জায়গা নেই। ঔষধ, অক্সিজেন বাড়ন্ত। মানুষ বড় বিপাকে পড়ে গেছে। প্রাণের দায়ে বাঁচার পথ খুঁজছে। করোনার সুনামি আটকাতে সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছে। তার সঙ্গে নাইট কারফিউ। নিশ্চল জনজীবন। দোকান বাজার বন্ধ। বন্ধ ট্রেন বাস। স্তব্ধ চারপাশ। গরিব মানুষদের ঘরে থাকলেও মরণ, বাইরে বের হলেও মরণ। কী এক যাঁতাকলে পড়ে গেছে মানুষ। মানুষের জীবন নিয়েই তো টানাটানি। এর উপর আমোদ ফুর্তি করবে কী করে। তাই সোনাগাছির হাজার হাজার ঘর আজ বন্ধ। কোনও কাজ নেই। সকাল থেকে সন্ধে দরজার সামনে, রাস্তার পাশে ভয়ে ভয়ে রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকে শেফালির মতো মেয়েরা। কিন্তু কাস্টমার কই ? বরাত জোরে কেউ একটা দুটো পেয়ে যায়। পেলে কি হবে পয়সা পায় না আগের মতো। বড় ক্যাঁচাল করে। বলে দেখছিস না লকডাউন, হাতে পয়সা নাই। যা আছে তাই নে। লকডাউন উঠে গেলে পুষিয়ে দেব। শেফালিরা বোঝাতে চায় সেই একই অবস্থা তাদেরও। তাদের হাতেও তো পয়সা নাই। কীভাবে চলবে তাদের ? এই ঘর ভাড়া, মাসি চার্জ, দালাল চার্জ, দাদা চার্জ, কোথায় পাবে তারা ? বলাই হয়, কাস্টমারদের পকেটও গড়ের মাঠ। তাই যা দেয় নিতে হয়।
দাদারা, দালালরা এখন পয়সা পায় কম। তাই মাঝে মাঝে এসে পিষাই করে চলে যায়। গরম নামিয়ে যাবার সময় চোখ গরম করে কথা কয়। সপ্তাহে দুই একটা খদ্দের যা দিয়ে গেছে তার পাই পয়সা বুঝে নেয়।
বড় আতান্তরে পড়ে এই মেয়েরা। দেখার কেউ নেই। না সরকারি ব্যবস্থা, না মানুষের সাহায্য। কিছুই পায় না তারা। শহরতলী থেকে আসা মেয়েরা এখন আর আসে না। আসবে কিসে ? তারপর এসেই বা লাভ কী ? রোজগার পাতি হয় না। উপরন্তু পুলিশের লাঠির গুঁতো খেতে হয়।
সোনাগাছি, বউবাজারের মতো পাড়ার মেয়েরা অনেকেই পালিয়েছে। যাদের যাওয়ার জায়গা আছে তারা গেছে। আবার যাদের যাওয়ার জায়গা আছে তাদের অনেকজনকে মাসি যেতে দেয়নি। কারণ মাসির মোটা দামে কেনা মাল। একবার হাতছাড়া হলে পায়রা আর খোপে ফিরবে না। তাই তাদের আটকে রাখে। অনেকের যাবার কোনও জায়গায়ই নেই। তাদের পড়ে থাকতে হয়। এ পাড়া তাদের কাছে স্বর্গ, এ পাড়াই নরক।
গত বছর প্রথম লকডাউন পুরোটাই সোনাগাছিতে কাটিয়েছিল শেফালি। এ বছরও ছিল। কিন্তু আর থাকা গেল না। খদ্দেরপাতি তো এমনিতেই কম তার উপর নানা নিয়মনীতি চালু হয়েছে। নিয়মগুলো ভালই। কিন্তু খদ্দেররা মানলে তো। নিয়মের কথা বললে উল্টো কথা শুনতে হয়। সেদিন এক খদ্দেরকে শেফালি বলে, দাদা, যা করবেন মাস্ক পরেই করুন। মাস্ক খুলবেন না। খদ্দের তো চটে লাল। বলে মাগি তোর গায়ে গতরেই তো কাপড় রাখব না, মুখে টুড়ি তো দূরের কথা। বলতে বলতে গা থেকে খুলে নেয় শাড়ি ব্লাউজ। এক টানে মুখ থেকে ছিঁড়ে নেয় মাস্ক। নিজের মুখের মাস্কও টান দিয়ে খুলে ফেলে দেয় ঘরের কোণে। তবে সব খদ্দের সমান নয়। অনেকেই মুখে মাস্ক রেখে কাজ শুরু করে। কিন্তু তা থাকলে তো। কখন মুখ থেকে নেমে যায় থুতনিতে। কারো বা আবেগের তোড়ে পট করে একদিকের সুতো ছিঁড়ে ঝুলতে থাকে এক কানে।
সেদিন হাতে স্যানিটাইজার লাগাতে বলে ফেঁসে যায় শেফালি। এক খদ্দের বেশ করে হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে তার বুকে ঘষতে থাকে। কেমন চিড়বিড়িয়ে ওঠে বুকটা। তারপর আস্তে আস্তে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব হয়।
হাতে স্যানিটাইজার দাও, মুখে মাস্ক পরো, এত সব নিয়ম মেনে কি এ কাজ হয় ? বিরক্ত হয় খদ্দের। নেমে আসে নির্যাতন। খদ্দেরের নির্যাতন তো আছেই, মাসিদের চোটপাটও কম হয় না। সেদিন শেফালির সামনের খুপরির কমলাকে যা নয় তাই বলে গেল পদ্মা মাসি। বলে, মাগিদের ইয়েতে হুঁশ হচ্ছে না। এমনিতেই খদ্দের পাতি নাই, তার উপর খদ্দের চটানো। কেন রে কেন ? সরকার কি তোদের খেতে দিচ্ছে ? নিয়ম করেই তো খালাস। তারপর যা একটু সাহায্য আসছে তা দাদা আর পার্টি বাবুদের ভোগে চলে যাচ্ছে। তু মাগিরা কী পাচ্ছিস ? তাই মাস্ক পরো, স্যানিটাইজার লাগাও করে হেদিয়ে মরছিস। ফের যদি কাস্টমার চটাবি তো মেরে পুঁতে দেব এখানে।
খদ্দের নাই কিন্তু ঘর ভাড়া আছে। পার্টি বাবুদের, দাদাদের আবদার আছে। তার সাথে মাসিদের চোটপাট। কতদিন আর এভাবে থাকা যায়। গ্রামে ফিরে আসে শেফালি।
তার বাড়ি ফেরা সম্ভব হতো না যদি না যমুনা মাসি দ্বিতীয় লকডাউনের কয়েক মাস আগে তাকে মুক্তি দিত। সে ছিল যমুনা মাসির মোটা টাকায় কেনা ফুল। সতীশ কাকু তাকে বেচে দিয়ে গিয়েছিল যমুনা মাসির কাছে।
ছোটবেলায় বাপটা মরে যায় শেফালির। দুঃখী মায়ের সংসারে মানুষ হয় সে। ছোট থেকেই চেহারায় একটু আলাদা চটক ছিল। সতীশ কাকু আসত তাদের বাড়ি। পাশের গ্রামের বড় নেতা। বুলেট চালিয়ে এলাকা কাঁপিয়ে বেড়ায়। শেফালির মা তাকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু লোকটার মতলব ছিল অন্য। তখন বোঝেনি। পনেরো বছরের শেফালির পেটে ব্যথা হয়। স্থানীয়ভাবে দেখিয়ে কোনও ফল হয় না। কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায় সতীশ। দুই একবার দেখিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তারপর একদিন কলকাতা নিয়ে এসে যমুনা মাসির কাছে বেচে দেয় শেফালিকে। বাড়ি গিয়ে বলে শিয়ালদা স্টেশনে ভিড়ের মাঝে হাত ফসকে গেছে। অনেক খুঁজে তাকে পাইনি। ফিরে আসবে, ঠিক ফিরে আসবে।
আর ফিরে আসেনি শেফালি। যমুনা মাসির ঘেরাটোপে বন্দি হয়। অন্য মাসিদের চেয়ে যমুনা মাসীর মনটা একটু নরম ছিল। কোথাও যেন একটু স্নেহের চোরা স্রোত বয়ে যেত। তাই যমুনা মাসির বদান্যতায় একসময় মায়ের সাথে যোগাযোগ হয় শেফালির। তবে বেশি ডানা ফরফর করা উচিত নয় তা বুঝেছিল। এ মহল্লায় যারা বেশি উড়তে গেছে তাদের ডানা কেটে দিয়েছে মাসিদের লোক। কোথায় যে তারা হারিয়ে গেছে কেউ জানে না। তাই ভয়ে ভয়ে পোষ মেনে থেকে যায় শেফালি।
তিন
বাড়িতে দুটো ঘর। একটি ঘরে মুদিখানার দোকান করবে শেফালি। বেশ কিছু পুঁজি দরকার। অত টাকা নেই। তাই আপাতত অল্প পুঁজিতে তেলে ভাজার দোকান দেয়। সন্ধ্যাবেলায় চপ, বেগুনি ভাজে। বেচাকেনা মোটামুটি। গ্রামের চ্যাংড়া চুটকোদের ভিড় বেশি। সন্ধ্যায় এসে তারা একটু আড্ডা দেয়। শেফালির ছোঁয়া পেতে চায়। ছোঁড়াদের মনের ভাবগতিক বোঝে শেফালি। সে কাউকে নষ্ট করতে চায় না। তাই কাছে ভিড়তে দেয় না কাউকে। শুধু একটু হেসে হেসে কথা বলে। মরুর বুকে একটুখানি মেঘের ছায়ার শীতলতার মতো ছোঁড়াদের কাছে তাই যেন অনেক। বৃষ্টির আশা বুকে নিয়ে সন্ধ্যার আসর জমিয়ে তোলে তারা।
গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা খুব একটা আসে না তার দোকানে। এড়িয়ে চলে। শুধু এড়িয়েই চলে না, পিছনে নানা কথা বলে। ষড়যন্ত্র করে। কিছু কিছু কথা কানে আসে শেফালির। বেশ্যা মাগির হাতের ছোঁয়া খাবার সে তো বড় অপবিত্র, সে কি খাওয়া যায় ? ছোঁড়াদের আটকাতে চায় তারা। কিন্তু ছোটে কুলায় না। তাই কেউ ফোঁসফাঁস করে, কেউ চুপ থাকে। আবার অনেকেই সন্ধ্যায় আঁধারের আড়াল নিয়ে শেফালির দোকানের এক পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’। সেই মাংস ছিঁড়ে খেতে চায় রামু কাকা, চন্দনরা। তা হতে দেয় না শেফালি। একটু অন্যভাবে বাঁচতে চায়। কিন্তু তা হবার নয়। রামু কাকা, চন্দনের নজর পড়ে। তাদের আবদার পূরণ না করায় সালিশ বসে গ্রামে। পাড়ার ছোঁড়াদের মাথা চিবিয়ে খাবা, চোখের সামনে গতরের ব্যবসা করবা, তা তো হতে দেওয়া যায় না। রামু সালিশ ডাকে, চন্দন লোক জোগাড় করে। মজলিস জমায়। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণেই তো রথী মহারথীরা চুপ থেকে ছিল। এ তো গাঁয়ের ছুঁড়ি পুটা পড়ি শেফালি। নিদান ঘোষণা হয় সাত দিনের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। গ্রামের মধ্যে এসব নোংরামি চলবে না।
রামু ভেবেছিল ছ্যাঁক বুঝে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে শেফালি। তার হাতে ধরা দেবে। কাপড় তোলা মেয়ে। এটুকু চাপই যথেষ্ট। চন্দনের মতলবও তাই ছিল।
চার
মোড়লদের আমবাগানে ঢোকে শেফালি। বড় বড় গাছে ঢাকা বাগান। তলার দিকে গাঢ় ছায়া। বাইরে গুমোট গরম হলেও বাগানের ভেতর বেশ ঠান্ডা। গাছের উপর দিকে তাকায়, ডাল খোঁজে। উঠতে পারবে তো ? ডালের দিকে তাকাতে তাকাতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে যায় সাধন বাবুর ছোট ছেলেটার কথা। কী দ্রুত গাছে উঠতে পারত সে। একেবারে গাছাল। ছোটবেলায় সে আর নিমাই একসাথে স্কুল যেত। টানা টানা চোখ, হালকা পাতলা চেহারা। কেমন মায়া ভরা মুখ। রোজ স্কুল যাওয়ার সময় শেফালিকে কিছু না-কিছু এনে খাওয়াত নিমাই। কুল, তেঁতুল, আমড়া, কতবেল, আতা আরও কত কী। স্কুল থেকে ফেরার পথে বা ছুটির দিনে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত দুজনে। সেবার মাঠের ধারে বড় আমড়া গাছ থেকে এক জৈষ্ঠ্যের দুপুরে পড়ে গিয়েছিল নিমাই। খুব লেগেছিল। অনেকক্ষণ ধরে পা আর ঘাড় টেনে দিয়েছিল শেফালি। তারপর শেফালির কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটেছিল নিমাই। এক একবার পা ছোট বড় হয়ে মাটিতে পড়ে। ব্যথা লাগে। বেশ করে জড়িয়ে ধরে শেফালিকে। শেফালির বয়স তখন দশ এগার হবে। ফ্রকের নিচে বুকের উপর দুটো আমড়া উঁচু হয়ে উঠেছিল। সেখানে নিমাইয়ের হাত পড়ায় কেমন এক ভালোলাগা ছড়িয়ে যায় শরীরে।
সেই নিমাইকে আজ বড় দেখতে ইচ্ছে করছে শেফালির। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত একসাথে পড়েছিল তারা। পুজোর সময়, বোলান গানের সময় ভারী মজা হতো তাদের। ও পাড়া থেকে ঠাকুর দেখে একটু রাত করে ফিরত সবাই। ওরা দুজন দলছুট হয়ে পিছিয়ে পড়ত। বড়ো পুকুরের পাড়ের রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় দুটো ছায়া পড়ত জলে। আকাশে নবমীর চাঁদ। কেমন এক ধূসর আলো। মায়া আলো। বাতাসে হাল্কা শীতের পরশ। নিমাইয়ের হাতের মুঠোয় শেফালির হাত। জলে পড়া ছায়া দুটো কেঁপে কেঁপে উঠত। তারপর একটু দ্রুত পায়ে দৌড়ে এসে দলের সাথ ধরত তারা।
তারপর একদিন সাধন বাবু এ গ্রামের পাট চুকিয়ে সপরিবারে উত্তরবঙ্গে চলে যান। সেই থেকে নিমাইয়ের সাথে আর কোনও দিন দেখা হয়নি শেফালির। প্রথম প্রথম অনেক দিন কেমন একটা কষ্ট কষ্ট ভাব বুকের মধ্যে মোচড় দিত। রাতে ঘুম আসত না। এতদিন পর নিমাই-এর কথা মনে পড়তে আষাঢ়ে মেঘের মতো মনের আকাশটা ভারী হয়ে আসে।
হঠাৎ শেফালির পায়ের পাতা থেকে একটু উপরে কিসে যেন কুট করে কামড়ে দেয়। সে অস্ফুটে মাগো বলে ওঠে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা সরু লম্বা সাপ পিঁপড়ে তার পা কামড়ে ধরে আছে। গ্রামঘরে বড়ো মোটা পিঁপড়েকে দুই নামে ডাকে। দুটো পিঁপড়ে দেখতে দুই রকম। একটা মোটা মাথার মিশকালো পিঁপড়ে যাকে বলে কাঠপিঁপড়ে। এতে কামড়ালে খুব বেশিক্ষণ জ্বালা করে না। আর এক প্রকার আছে লম্বা সরু লালচে পিঁপড়ে। এগুলোকে বলে সাপ পিঁপড়ে। এতে কামড়ালে খুব জ্বালা করে। শেফালির পায়ে একটা সাপ পিঁপড়ে কামড়ে ধরে আছে। দুই আঙ্গুলে করে ধরে পা থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর এক টান দেয়। পাতলা শরীর বাতাসে একটু উড়ে গিয়ে পড়ে যায় পিঁপড়েটা। ছোটবেলায় এমন পিঁপড়ে দেখলে সে দু আঙুলে চেপে মচলে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিত। আজ আর মারতে ইচ্ছা করলো না। ছেড়ে দিল।
হাঁটতে হাঁটতে শেফালি বাগানের মাঝখানটা পার হয়ে আসে। আর এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। একটা গাছ দেখে তার মনে হলো ওই গাছটায় সে উঠতে পারবে। হঠাৎ কানে আসে মানুষের গলা ঝাড়ার শব্দ। একটু যেন পরিচিত মানুষের কাশির শব্দ। শেফালি ভাবে তার মনের ভুল। এখানে এখন মা আসতে যাবে কোন দুঃখে। সে দড়ি গাছা হাতে নিয়ে গাছটার দিকে এগিয়ে যায়। আবার কাশির সেই শব্দ কানে আসে।
সচিত্রকরণ : রজত



