
১.
নিউ অরলিন্স, লুইজিয়ানা। সেপ্টেম্বর, ১৮৯২ সাল…
নিউ অরলিন্সের সেপ্টেম্বরের রাত। আকাশের গায়ে তখন জ্যোৎস্নার আলো গলে গলে পড়ছে। মাংকি পাহাড়টাকে আড়াল করে রুপালি থালার মতো বিশাল এক চাঁদ উঠেছে। সেই মিষ্টি চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে মেপল বনের পাতায় পাতায়। সত্যি, মাংকি পাহাড়ের ঢালটা রাতের বেলায় তখন অন্যরকম লাগে। মনে হয় আকাশ ভেঙে যেন জ্যোৎস্নার ঢল নেমে এসেছে। যতদূর চোখ যায় দেখা যায় পাহাড়ের ঢালে অজস্র জোনাকী পোকার ইতিউতি উড়াউড়ি। পৃথিবীটাকে মনে হয় যেন এক চিলতে স্বর্গ। আকাশে অগণিত নক্ষত্র ফুটছে আবার নিভছে। সেই মেপল পাতার ফাঁক দিয়ে খানিক আলো তেরছা করে পড়ছে পাহাড়ের ঢালের নিচে বসে থাকা দুই আদম সন্তানের ওপর। একজনের বয়স চল্লিশ, আরেকজনের ছয়। একজনের চোখে হতাশা, ক্ষোভ, দৃঢ়তা আর অন্যজনের চোখে বিস্ময়, স্বপ্ন। একজনের নাম ডারনেল আর অন্যজনের নাম লায়ালা। ঈশ্বর দুজনকেই গায়ের রং কালো করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। না, কাজটা একান্তই ঈশ্বরের অতএব অপরাধটা তাঁরই। এত রং থাকতে কালো রং দিয়েই কেন তাদের বানাতে হলো ? তাঁর ভান্ডারে অন্য কোন রং কি ছিল না ? কথাগুলো ভাবতে থাকে ডারনেল। ভাবতেই সে চকিতে নিজের শরীরের দিকে তাকায়। তারপর মেয়ের দিকে গভীর মমতায় তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। জ্যোৎস্নার আলোয় লায়ালা মুক্তার মতো দাঁত বের করে ডারনেলকে বলে,
‘বাবা, দেখো কত সুন্দর আকাশ!’
‘হুম!’ ডারনেলের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘কত সুন্দর এই পাহাড়! আর বাবা দেখ চাঁদের কত আলো! কিন্তু সে বড্ড দুষ্ট।’
‘কেন দুষ্ট বলছিস ? কেনরে ?’ ডারনেল তার পুচকে মেয়ের দিকে বিস্ময়ের চোখ নিয়ে তাকায়।
‘দেখো না, সে মাংকি পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আমরা কি চাঁদের আলো চুরি করে নিয়ে যাব ?’
‘তুই তো! খুব বোকা এই চাঁদ। কিন্তু কী আর করা। চাঁদ দেখতে পাস না তো কী হয়েছে ? দেখবি, চাঁদের সব আলো পকেটে নিয়েই আমরা ঘরে ফিরব। এখন চুপচাপ জ্যোৎস্নাটা উপভোগ কর মা। প্রকৃতির কত রহস্য।’ ডারনেল লায়ালার বাম কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে।
‘কী এত রহস্য বাবা ?’
‘তুই এখন বুঝবি না মা। একটু বড় হয়ে উঠ আগে, তারপর সব বুঝবি।’
‘না, এখনই বলো। আমি এখনই শুনবো।’ জ্যোৎস্নার সবুজ অন্ধকারে লায়ালা তার বাপের দিকে তাকায়।
‘এই ধর এই পৃথিবীতে কিছু মানুষের গায়ের রং সাদা আর কিছু মানুষ আমাদের মতো কালো। এটাও প্রকৃতির বিরাট রহস্য।’ কথাগুলো বলতে বলতে ডারনেলের হলুদ চোখ শক্ত হয়ে উঠে।
‘বাবা, কালো রং কি খারাপ ?’
‘নারে মা, কালো রং খারাপ না। কিন্তু এই পৃথিবীর কিছু মানুষ খারাপ।’
‘বাবা, ঈশ্বরই তো আমাদের এই রং দিয়েছে। তাহলে ঈশ্বরও খারাপ ?’
‘না, ঈশ্বর খারাপ হতে যাবে কেন ?’ ডারনেল উদাস দৃষ্টিতে তার মেয়ের দিকে তাকায়।
‘বাবা, আমাদের সাদা কোনও বন্ধু নেই। আমাদের গায়ের রং কালো বলে সবাই আমাদের সাথে কত খারাপ ব্যবহার করে। আচ্ছা বাবা, আমরাও কি মানুষ ?’ লায়ালা বিস্মিত চোখে বাবার দিকে তাকায়।
‘আমরা অবশ্যই মানুষ। তবে ঈশ্বর কেন কালো করে বানাল সেটা আমারও প্রশ্ন। একদিন নিশ্চয়ই সেই উত্তর আমরা জানতে পারব।’
‘বাবা!’ লায়ালার চোখে-মুখে কত শত-প্রশ্ন যেন আকাশে তারার মতই ফুটে উঠতে থাকে।
‘বল মা।’
‘ঈশ্বরের গায়ের রং বুঝি সাদা ?’
‘হ্যাঁ মা, আমাদের শ্বেতাঙ্গ মনিবরা তাই মনে করেন। তারা নিজেদের ঈশ্বর মনে করেন। তবে আমরা সেই ঈশ্বরকে মানি না।’ ডারনেলের কণ্ঠে দৃঢ়তা।
‘তাহলে আমাদের ঈশ্বর কে ? লায়ালার সহজ-সরল প্রশ্ন।
‘এই যে চাঁদ দেখছিস, পাহাড়, নদী, জঙ্গল, প্রজাপতি তাদের যে ঈশ্বর, আমাদেরও সেই একই ঈশ্বর। বুঝলি কিছু ?’
লায়ালা এত শক্ত কথা বুঝতে পারে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে সে তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘তুই যখন আরও বড় হবি তখন সব বুঝবি। এখন এত কিছু বুঝতে হবে না তোকে।’ এই বলে ডারনেল তার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়।
‘বাবা, দেখো দেখো! আরেকটা উল্কা মাটিতে পড়ে যেতে দেখেছি। আমি এই পর্যন্ত ১৩টা দেখলাম। আর তুমি কিনা মাত্র ২টা! আজ কিন্তু আমার জিত হলো।’ এই বলে লায়ালা হাত তালি দিয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠে।
‘ঠিক আছে মা। আজ তোরই জিত হলো। এভাবেই তুই যেন জিতে যাস সব সময়। তোর জীবনে মেলা সময় সামনে পড়ে আছে। পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সুন্দর চাঁদটাকে আমি হয়তো কখনই দেখতে পাব না। কিন্তু তুই ঠিক দেখতে পাবি। তুই পাহাড়টাকে একদিন উপড়ে ফেলবি। পাহাড়কে জয় করে চাঁদের সাথে তখন তোর হবে সরাসরি আলাপ। আমি বসে আছি সেই সময়ের অপেক্ষায়।’
লায়ালা তার বাবার এই কঠিন ভাষণের কিছু বুঝল আর কিছু বুঝল না। তার নিষ্পাপ চেহারায় সে কথা ফুটে উঠে।
মাংকি পাহাড়কে পেছনে ফেলে ডারনেল আর লায়ালা এবার চললো তাদের ছোট কুটিরের দিকে। ছোট মেপল গাছের কাঠ দিয়ে বানানো দোচালা একটা বাড়ি। অন্ধকারে ছোট বাড়িটা দার্শনিকের মতো গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে ঝুলিয়ে রাখা হারিকেনের আলোটা তখনও মিটিমিটি করে জ্বলছে। ‘যাক, আলোটা এখনো জ্বলছে, তাও রক্ষে! এই আলোটা যতক্ষণ জ্বলবে ততক্ষণই তো প্রাণ। এই আলোটা যাতে নিভে না যায় সে কারণেই এত যুদ্ধ।’ ডারনেল মাথা নেড়ে ফিসফিস করে নিজেই নিজের সঙ্গে কথাগুলো বলে। হঠাৎ বাতাসের দমকা হাওয়ায় বড় মেপল গাছটা শব্দ করে নড়ে উঠে। লায়ালা তাতে ভয় পেয়ে যায়। ডারনেল শক্ত করে ওর হাতটা ধরে রাখে। ডারনেলের চোখে মুখে তখন অন্য এক ভাবনা পেয়ে বসে। সামনে তার বিশাল এক যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তাকে জিততে হবেই। ডারনেল আগামীকালকের জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২.
নিউ অরলিন্স, লুইজিয়ানা। সেপ্টেম্বর সকাল। ১৮৯২ সাল
খুব সকাল সকাল ডারনেলের ঘুম ভাঙে। কাঠের দরজাটা খুলে সে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। তারপর বারান্দায় খয়েরি রঙের জং পড়া পেরেকে ঝুলিয়ে রাখা টুপিটা মাথায় পড়ে বারান্দার টুলে এসে বসে। বাড়ির সামনেই খুব ছোট একটা বাগান। লায়ালার ফুলের বাগানের শখ। ছোট কুঁচকানো কাগজের মতো কুড়েঘরের সামনে ফুলের বাগান খুব বেমানান। বাগানে কয়েকটা হলুদ রং-এর টিউলিপ ফুটেছে। লায়ালা ফুলগাছগুলো দেখভাল করে। কোন গাছে কয়টা ফুলের কলি এসেছে সব খবর তার মুখস্ত। কিন্তু ডারনেলের চোখে-মুখে তখন চাপা এক উত্তেজনা। এক বিশাল কাজ তার হাতে। আকাশের দিকে তাকায় সে। বর্ণবাদের মোড়কে ঢাকা আকাশটাও ফেটে চৌচির হয়ে আছে। উদাস চোখে বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকা মেপল গাছের পাতার উপর চোখ রাখে ডারনেল। মেপল পাতাগুলো উড়তে উড়তে আকাশের কোন ভুল ঠিকানায় ভেসে বেড়ায় কে জানে ? বাতাসটা এত ভুসভুসে গরম যে মনে হয় যেন কেতলির পানি থেকে ধোঁয়া উঠছে। অসহ্য একটা দম বন্ধ করা অবস্থা। প্রকৃতির এই চেহারাটাকে দেখলে মনে হয় যেন আস্ত একটা শ্বেতাঙ্গ জংলি সাপ। কখন যে ফণা তুলে ছোবল দিবে তা কেউ জানে না। ডারনেল কাজ করে একটা মুচির দোকানে। সেখান থেকে আজ সে ছুটি নিয়েছে। কারণ আজ সে একটা ট্রেনের টিকিট কিনেছে। সাধারণ কোনও টিকিট না। ইস্ট লুইজিয়ানা রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির টিকিট। সাহসের ব্যাপার বটে। এই প্রথম শ্রেণির টিকিট কিনে সে শ্বেতাঙ্গদের পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করবে। ডারনেল আগেই হিসেবটা করে রেখেছিল। মুখটাকে মৃত শামুকের মতো আর কতকাল বন্ধ রাখা যায় ? এবার হোক প্রতিবাদ।
সূর্যটা মধ্যগগনে থকতে থাকতেই ডারনেল তার ছোট টিনের সুটকেসটা গুছিয়ে ফেলল। ডারনেলের সঙ্গে আছে তার মেয়ে লায়ালা এবং স্ত্রী ডায়ানা। তারা দুজনই ডারনেলকে রেল স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। বাড়ি থেকে রেল স্টেশন মাত্র মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। ডারনেল হাঁটছে। তার একহাতে রং চটচটে পুরোনো কালো একটা সুটকেস, অন্য হাতে মেয়ে লায়ালার ছোট নরম তুলতুলে হাত। তাদের বাপ-বেটির লম্বা তেড়ছা ছায়া পড়ছে নিও অরলিন্সের কাঁচা রাস্তার উপর। হাঁটার পথে লায়ালার বকবকানি যেন শেষ হয় না। কত কথা তার জমে আছে! রাস্তার দু পাশ থেকে মাঝে মাঝেই নাম না জানা কিছু জংলি ফুল তুলে তার ছোট্ট জামাটায় তুলে রাখছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দূরে লাল রঙের রেল স্টেশনটা দেখা গেল। দূর থেকে বর্ণবাদী এই লাল দালানটাকে দেখলে মনের মধ্যেও কেমন যেন একটা ঘৃণা দলা পাকিয়ে উঠে। ডারনেল পকেট থেকে বের করে ট্রেনের টিকিটটা আবার দেখে নেয়। সব ঠিক আছে। কোরভিংটন এক্সপ্রেস। প্লাটফর্ম ৩। ছাড়বে দুপুর ২.৩০ মিনিট।
স্টেশনের লোহার গেটের সামনে লায়ালাকে বিদায় জানাতে যেয়ে গোপনে চোখ মুছল ডারনেল। বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ আদর করে নিল মেয়েটাকে। তারপর ডায়ানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ৩ নম্বর প্লাটফর্মের দিকে এগিয়ে গেল। প্লাটফর্মে তখন অজগর সাপের মত বিশাল একটা কালো ট্রেন ভুস ভুস শব্দ করে ফুসছে। বোঝা যাচ্ছে ট্রেনটা হয়তো ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডারনেল তার হাতে টিকিট নিয়ে প্রথম শ্রেণির কামরার দিকে এগিয়ে গেল। সিট নম্বর ১৩। প্রথম শ্রেণির কক্ষের লাইনে দাঁড়াতেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ খেক খেক করে গালি দিতে দিতে ডারনেলকে ঘিরে ধরল।
‘এই ব্যাটা নিগ্রো। তোর সাহস তো কম না। দেখতে পাচ্ছো না এই লাইনটা শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্যে বরাদ্দ ? যারা প্রথম শ্রেণির টিকিট কাটবে শুধু তারাই এখানে দাঁড়াবে।’
ডারনেল তার টুপিটায় ডান হাত দিয়ে মৃদু ছুঁয়ে একটু ঝুঁকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশটাকে তার টিকিটটা দেখাল।
‘এই যে দেখুন, আমার টিকিট প্রথম শ্রেণির। এখানেই তো আমি দাঁড়াব।’
পুলিশটা মুখে শ্লেষের হাসি ফুটিয়ে ঈগলের মতো ছোঁ মেরে টিকিটটা নিয়ে নিল ডারনেলের কাছ থেকে। কপাল কুঁচকে টিকিটটায় কিছুক্ষণ চোখ রাখার পর এবার সে খেকিয়ে উঠল।
“ঐ বেজন্মা কোথাকার। তুই দেখতে পাচ্ছিস না তোর গায়ের রং কালো। শুধু প্রথম শ্রেণির টিকিট কিনলেই কি ব্যাটা তুই সাদা হয়ে গেলি নাকি ? গর্দভ কোথাকার! যা ভাগ এখান থেকে। যা, ঐ যে তোর নিগ্রো জাতভাইগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে যা। ঐ যে লেখা আছে ‘শুধু কালোদের জন্য’ সেই লাইনে গিয়ে দাঁড়া শুয়োরের বাচ্চা।”
ডারনেল তারপরও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সে নড়ছে না তার জায়গা থেকে। কেন নড়বে ? কখনও কি দেখেছেন শ্বেতাঙ্গর ভয়ে রাস্তার পাশের বড় ম্যাপল গাছ একটু নড়ে গিয়ে তার জায়গা করে দিয়েছে ? তো সে কেন সরে যাবে তার পথ থেকে ?
‘কিরে তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না বুঝি ? তুই কি চাস একজন নিগ্রোকে আমি এখানে সবার সামনে জুতাপেটা করি ?’
ডারনেল এইবার পুলিশটার দিকে এগিয়ে এল। দ্যাখো, তুমি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে গালিগালাজ করছ। গালি গালাজ করা ছাড়া তোমার আর কি শক্তি আছে ? আইনগতভাবে আমি প্রথম শ্রেণিতে চড়তে পারি। দেশের আইন কী বলে ? ভেবেছ আমরা কিছুই জানি না ? কিছুই বুঝি না। তুমি জানো আমাদের দেশের চৌদ্দতম আইনি সংশোধনীতে কী লেখা আছে। সেখানে কোথাও লেখা নেই শ্বেতাঙ্গের জন্যে এক কামরা আর কালোদের জন্যে আরেক কামরা। কে বানিয়েছে এই আইন ? তোমরা কি মনে করো না কালোরাও মানুষ ? আমাদের রক্তও তোমাদের মত লাল ?
ডারনেলের চিৎকারে ততক্ষণে সেখানে লোক জড়ো হতে থাকল। দূর থেকে কিছু নিজ গোত্রীয় লোক নিরীহ হরিণের মতো অবাক হয়ে তার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল। ডারনেল একাই তার অধিকার আদায়ের চেষ্টায় নেমে পড়ল।
সে বলতে লাগল, ‘এই আকাশ, এই মাটি, এই বাতাস, এই গাছপালা সব আমার। ঠিক তোমাদের মতোই। সবার সমান সুযোগ। গায়ের রং কালো বলে কেন আমি মানুষের মর্যাদা পাব না ?’
আরও অনেক কিছু সে বলতে চাইছিল। কিন্তু বলতে পারল না। হঠাৎ পেছন থেকে এক শ্বেতাঙ্গ তার মাথায় কিছু একটা দিয়ে আঘাত করতেই সে জ্ঞান হারাল। যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে দেখল তার হাত-পা শিকল দিয়ে বাঁধা। তার অপরাধ গুরুতর। সে আইন ভঙ্গ করেছে। শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে। গায়ের রং কালো হওয়া সত্ত্বেও সে শ্বেতাঙ্গদের জন্যে নির্ধারিত ট্রেনের কামরায় বসতে চেয়েছে। ডারনেলকে সেই রাতেই গ্রেফতার করে রেল স্টেশনের অস্থায়ী জেলে অন্ধকার খুপরিতে আটকে রাখা হলো। ডারনেল তখন ভয়ানক ক্লান্ত। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। রাতে তার প্রচণ্ড জ্বর এলো। রাতেই একটা স্বপ্ন দেখল ডারনেল। সে তার নিউ অরলিন্সের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের আলোয় গাছের পাতাগুলো যেন ঝলমল করে উঠেছে। সামনেই খোলা দিগন্ত। সেই দিগন্ত আলোকিত করে মাথার উপর প্রকাণ্ড একটা সোনালি সূর্য। সেই সূর্যের আলোয় লায়ালা তার মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশের গাছগাছালিতে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। পাশের ঝোপেই কয়েকটা বুনো ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের উপর কয়েকটা মৌমাছি ঘুর ঘুর করছে। হঠাৎ করেই কী যেন হল লায়ালার। সে হাত উঁচিয়ে দূরের লোভনীয় সূর্যটাকে ধরার জন্য দৌড় দিল। সে দৌড়াচ্ছে। সূর্যটাকে তার ধরতে হবেই।
সকাল হতেই ডারনেলকে আইন অমান্যের দায়ে ‘সেপারেট কার অ্যাক্ট ১৮৯০’ আইনে নিউ অরলিন্স কোর্টে চালান করে দেওয়া হলো। সেখানে তার সাজা হলো চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
৩.
নিউ অরলিন্স, লুইজিয়ানা। ২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬ সাল।
দীর্ঘ ৪ বছর কারা ভোগের পর ডারনেল যখন তার নিজ বাড়ির সামনে তখন আকাশটা ছিল মেঘলা। গাছের পাতার উপর বৃষ্টির দাগ। ডারনেলের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মনে তার কত কি ভাবনা। লায়ালা নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে। দেখতে না জানি কেমন হয়েছে সে। বাড়ি ফেরার পথে মেয়েটার প্রিয় ওয়ারেন কোম্পানির বাটারফ্লাই বিস্কুট আর একটা পুতুল কিনে নিতে ভোলেনি ডারনেল। কল্পনায় সে দেখতে পেল লায়ালা তার বাবাকে অভ্যর্থনা জানাতে কালো রঙের দরজার কপাট ধরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। লায়ালা! কত বড় হয়ে গেছে আমার মেয়েটা! ডারনেল দৌড়ে লায়ালাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু কোথায় লায়ালা! ডারনেলের চোখে-মুখে তখন বৃষ্টির ঝাপটা লাগে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ভুতুরে বাড়িটার দাওয়ায় উদাস হয়ে বসে আছে তার স্ত্রী ডায়ানা। চোখদুটোতে তার মেঘলা আকাশের বিষন্নতার ছাপ। হঠাৎ অন্ধকার আকাশে বিকট শব্দ করে উড়ন্ত একটা বল্লম মাংকি পাহাড়ের ঢালে মিলিয়ে যায়। তারপর সব কিছু অন্ধকার। ডারনেল সেইদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ



