আর্কাইভগল্প

গল্প : আঁধারে হারানো রাত : পিওনা আফরোজ

আজও হয়তো পুরাটা রাতই নির্ঘুম কাটাতে হবে, সকালের অপেক্ষায়। ৬ আগস্ট ২০২৪ রাত ১১.২৯ ঘড়িতে, এই মুহূর্তে। তবু ঘুমাতে যাবার কোনও আয়োজন নাই আমাদের পরিবারের কারও। সেই ১৫ জুলাই থেকে রাত আর দিনের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নাই বললেই চলে। কাক্সিক্ষত সকালের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকাল এলেও চিন্তার শেষ থাকে না। ফুরিয়ে যাওয়া গতরাতে কাকে বা কতজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, কতজন মারা গেছে, কতজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কোথাও গুলির আওয়াজ হচ্ছে কি না, সমন্বয়কদের দিক থেকে নতুন কি কর্মসূচি দেয়া হয়েছে এইসব নিয়ে সারাক্ষণ মানসিক অস্থিরতায় দিন কাটাতে হয়। তাই নতুন সকাল এলেও, স্বস্তি আর মেলে না।

আজ আবার কিছুক্ষণ আগেই খবর পেলাম, রাতে না কি এই এলাকায় ডাকাতি হতে পারে। উত্তরায় বসবাসকারী এবং স্থানীয়দের ধারণাও তাই। মসজিদের মাইকেও এই নিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমার প্রতিবেশী মিমি ফোন করে এমনটাই জানিয়েছেন। তার সঙ্গে কথা শেষ করে মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে যায় ট্রাফিক অ্যালার্ট নামে একটি  গ্রুপের পোস্টে। সেখানে এই নিয়ে একাধিক পোস্ট দেখলাম। গ্রুপটিতে উৎকণ্ঠা মেশানো সাবধানবাণীতে বেশ কিছু পোস্ট দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। তবে কি আজ রাতে উত্তরায় ডাকাতি হতে পারে… ? এই নিয়ে ভাবতে গিয়ে বুকের ভেতরটায় কেমন ভার অনুভব করছিলাম।

মানসিক অস্থিরতার পাশাপাশি হাত-পাসহ পুরো শরীর তখন অবশ লাগছিল। পেটেও কেমন মোচড় দিল। কোনও কিছুতে ভয় পেলে বা কিছু নিয়ে খুব টেনশন করলে এরকম হয়। ঠিক তখনি ছেলে সাদাত এসে বলল, ‘মা ঘরের দরজায় ভারী কিছু দেওয়া দরকার।’

‘কি দিবি ?’

‘জুতা রাখার আলমারিটা টেনে এনে দরজার সামনে রেখে দিই ?’

‘যা ভালো মনে হয় কর।’

সাদাত ঘরের মেইন দরজার সঙ্গে লাগিয়ে জুতার আলমারিটা রেখে দিল। যাতে বাইরে থেকে খুব সহজেই দরজা খুলে ঘরের ভিতরে ঢোকা না যায়। গায়ের মেক্সিটা বদলে সালোয়ার-কামিজ পরলাম। মেয়েকেও বললাম, গেঞ্জি ট্রাউজার বদলে সালোয়ার-কামিজ পরতে। যে কোনও প্রয়োজনে যেন ঘর থেকে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যেতে পারি। ঘরে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল, সেগুলোও অনেকক্ষণ ধরে ভেবে ভেবে আর ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। যেন ডাকাত ঘরে ঢুকতে পারলেও সহজে সেগুলো খুঁজে না পায়। হঠাৎ মনে হলো, আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের উপরতলা থেকে শব্দ আসছে। কেউ জোরে জোরে অনবরত হেঁটে যাচ্ছে। একজন বা কয়েকজনও হতে পারে। আবার মনে হলো ঠিক হাঁটা নয় কিংবা দৌড়ানোর শব্দও নয়। হাঁটা আর দৌড়ানোর মাঝামাঝি কিছু মনে হলো। বাচ্চারাও খুব মনোযোগ দিয়ে সেই শব্দ শুনে বুঝতে চাইছে উপরতলায় ঠিক কী হচ্ছে। ভাবছি―ডাকাত অ্যাটাক করেনি তো! বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়েও কেবল সেই শব্দ শুনে আমাদের দ্বারা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হলো না। রূপা বলল, ‘মা, দারোয়ানকে ফোন করে জানার চেষ্টা করো, দেখো, সে কী বলে ?’

দারোয়ানের নাম্বারে ডায়াল করছি, রিং হয়েই চলেছে। কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন তুলছে না। রিং হতে হতে কেটে গেলে আবারও ডায়াল করলাম। এবারও কেউ ফোন রিসিভ করল না। আমার অস্থিরতা দেখে ছেলে-মেয়ে দুটি তখন বলছিল―‘মা, তুমি বসো। এত টেনশন করলে অসুস্থ হয়ে যাবা তো।’

বাচ্চাদের কথা শুনে ওদের পাশেই সোফায় বসলাম। কিন্তু দুশ্চিন্তা কিছুতেই কাটছে না। অন্যদিকে বাইরে কী হচ্ছে, ফ্যানের শোঁ শোঁ আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছে না। এমনকি আমাদের বাসাটা মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় ইমাম সাহেব অ্যানাউন্স করলেও কিছু শুনতে পাই না। বাইরের শব্দ যেন শোনা যায় তাই ফ্যান বন্ধ করে দিলাম। লাইট বন্ধ করব কি করব না, এই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছি না। একবার মনে হলো, থাকুক, বাতি জ্বললে হয়তো ডাকাতরা ভাববে জেগে আছে। কিন্তু জেগে আছে ভাবলে কী হবে ? ভয় পাবে ? আমার তা মনে হয় না। ওরা তো জানিয়েই আসছে। আর সে কারণে আমাদের আগাম প্রস্তুতি যে কিছুটা হলেও থাকবে সেই বিষয়ে তারা অবশ্যম্ভাবীভাবেই নিশ্চিত থাকার কথা। তাহলে বাতি জ্বালিয়ে রাখা আর নিভিয়ে দেওয়ার মধ্যে কিইবা পার্থক্য থাকতে পারে! তার চেয়ে জ্বালানোই থাকুক। অন্ধকার আর উৎকণ্ঠার মধ্যে বাতিটা একটু আলো দিয়ে যাক। আর এই আলোটুকু না হয় এই সময়ে খানিকটা সাহস হয়েই পাশে থাকুক। কিন্তু ফ্যান বন্ধ রাখায় বেশ গরম লাগছিল। গরমে ঘেমে গেছে বাচ্চাগুলোও। তবু কারও কোনও অভিযোগ নেই। ফ্যান ছাড়ব কি না জানতে চাইলে জবাবে ছেলেমেয়ে দুটো একসঙ্গেই বলে উঠল, ‘না না মা। ফ্যান চললে বাইরের কোনও শব্দ শোনা যাবে না।’

এমন সময় বাঁশির আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোথা থেকে সেই আওয়াজ ভেসে আসছে তা নিশ্চিত হতে জানালার পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে দেখি আমাদের গলিতে এই এলাকারই কল্যাণ সমিতির সিকিউরিটি গার্ড সতর্কতা সংকেত দিয়ে যাচ্ছে হুইশেল বাজিয়ে।

‘বাসার গার্ডরা কেউ ঘুমাবেন না। সবাই জেগে থাকুন। বাড়ির মেইন গেইটের আলোগুলো জ্বালিয়ে রাখুন।’ সিকিউরিটির কণ্ঠে জোরালো নিরাপত্তার কথা শুনে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম। বাচ্চাদের চোখে মুখেও ভয়। ভাবছি―ঢাকায় থাকি এতগুলো বছর, কই, কখনও তো এমন আয়োজন করে ডাকাতি হতে শুনিনি। আর শুধু ডাকাতিই-বা বলছি কেন, যা কিছু এই কয়েক দিনে একের পর এক ঘটে চলেছে সবকিছুই বিস্মিত করছে। জানালার পর্দাটা টানটান করে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে কী যেন কী ভেবে পুনরায় তা সরিয়ে দিই। গ্রিল ধরে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। এই শহর কি আমার সেই চেনা শহর, ঠিক বুঝতে পারি না। মনে হয় আমার এই চেনা শহর ছেড়ে সবাই পালিয়ে গেছে অন্য কোনও শহরে। আমরাই কেবল ভুল করে রয়ে গেছি এখানে। থকথকে আঁধার আর থমথমে স্তব্ধতা বুকে নিয়ে যেন বেঁচে আছি। মনে হয়, এখনই মহাপ্রলয়ে কোনও একটা শব্দে কেঁপে উঠবে পুরা শহর, কেঁপে উঠবে এই অচেনা শহরের বুকে জমাটবাঁধা গাঢ় অন্ধকার। আচ্ছা, সেই অন্ধকারটাই কি আমার ভিতরে আসন পেতেছে, গত কয়েকদিনের ঘটনাপুঞ্জে ? বাসা থেকে একটু দূরের বড় পুকুর আর পার্কটাতেও আঁধার যেন আঁধারেরই সঙ্গে ফিসফিস করছে। নিস্তব্ধ এই রাতের ভেতর কি আঁধার লুকিয়েছে, না কি আঁধারের ভেতরে রাত ? কতক্ষণ এভাবে বাইরে তাকিয়ে আছি, মনে নেই। ঠিক তখনি আবার মচমচ শব্দ তুলে উপরতলায় কারা যেন হাঁটছে বলে মনে হলো। সম্বিৎ ফিরে এলে পুনরায় এসে বসি বাচ্চাদের কাছে। সেন্টার টেবিলের উপরে পড়ে থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি―কোনও শুভাকাক্সক্ষীর ফোন অথবা ম্যাসেজ মিস করেছি কি না!

আজ রাতে, উত্তরায় রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে জানার পর থেকেই কাছের কিছু বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজন ফোন করে, কখনও বা ম্যাসেজ দিয়ে খোঁজ নিচ্ছে কিছুক্ষণ পর পরই। ওদেরকে বর্তমান অবস্থা জানিয়ে আশ্বস্ত করেছি। ওরাও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে ফোন রাখে। বুঝতে পারি―আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায় মানুষ খুব খারাপ কিছু সময় কাটাচ্ছে। গত কয়েক দিনে আন্দোলন চলার প্রতিটি মুহূর্তে সাদাতকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। ও ১৮ তে পা দিয়েছে এবার। প্রতিদিনই ছেলেটি আন্দোলনে চলে যেত আমার চোখ ফাঁকি দিয়েই। পুরাটা দিন কাটত ওর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থেকে থেকে। অপেক্ষার অবসান শেষে ছেলেটি বাড়ি ফিরলেও দুশ্চিন্তার অবসান হতো না। আরও বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখত আমায়। তখন চারপাশে কেবল শুনেছি রাতের অন্ধকারে পুলিশ দরজায় কড়া নাড়ে ঠকঠক শব্দ তুলে। ছাত্র আছে কি না বলে খোঁজ করত। ছাত্র পেলেই না কি ধরে নিয়ে যেত। এই ভয়ে গত রাতগুলোর কোনও একটি রাতেও চোখ দুটির পাতা এক করতে পারিনি। মনে কেবল একটি শঙ্কাই কাজ করেছিল, এই বুঝি দরজায় পুলিশ এল আর এই বুঝি ছেলেটাকে কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। সারাটা রাত ধরে ঘুম আর জাগরণের মধ্যে বসত করেছিল ভয়। সমস্ত রাত কেটেছে ভোরের আলোর অপেক্ষায়! যদিও ভোর হলেই যে ভয় থেকে মুক্তি মিলবে এমনটা নয়, তবে পুলিশের এই গণগ্রেফতারের আশঙ্কা রাতের চেয়ে দিনে খানিকটা কম ছিল! কিন্তু নিকট অতীতের মতো বর্তমানের সকালকে নির্ভার আর সুন্দর মনে হতো না। সকাল তার স্বভাবসুলভ স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে জেগে উঠত না। শহরটাও কেমন যেন অসহায়ত্ব আর ক্লান্তি নিয়ে কাটায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনের পর দিন। আগের মতো ব্যস্ততা নেই তার। আছে কেবল ভয়, উৎকণ্ঠা, হত্যা আর অসহায় মানুষের আর্তনাদ। এইতো গত তিন-চার দিন আগে ঘুম ভেঙ্গে যায় গাড়ির শব্দে। ভয়ে তখন জড়সড় হয়ে শুয়েছিলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মিনিটখানেক পর ঘুম জড়ানো, কাঁপা কাঁপা, ক্লান্ত চোখ দুটি মেলে খুব সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডার্ক কফি কালারের পর্দাটা খানিকটা সরিয়ে দেখি রাস্তায় কোনও গাড়ি নেই। বাইরে অন্ধকার ধীরে ধীরে সরতে শুরু করেছে। পাঞ্জাবি পরিহিত দু-একজন মানুষ টুপি মাথায় হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো মসজিদের দিকেই যাচ্ছে। আমি বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে সাদা দেওয়ালে আঁটা কালো ঘড়িটির দিকে তাকাই। আধো আলো আধো অন্ধকারেও ঘড়ির সময় স্পষ্ট। সকাল সাড়ে পাঁচটা। ঠিক তখনি মনে হলো বাড়ির লোহার বড় গেইটটি নিচ থেকে কেউ খুলছে। ভেবে চমকে উঠি আমি। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল তখন। ঢোক গিলতে চাইছিলাম কিন্তু বুঝতে পারি ভেতরে একটুও লালা অবশিষ্ট নাই যাতে গলাটা পুনরায় ভিজে উঠবে। খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। আমি জানালার কাছ থেকে ধীরে সরে গিয়ে বারান্দার সঙ্গে লাগোয়া কাচের দরোজার একপাশ খানিকটা ফাঁক করে বাইরে দেখার চেষ্টা করি। বুক কাঁপতে থাকে থরথর। ঘরের ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়ালে, বাড়ির মূল গেইট দিয়ে বাইরে থেকে কেউ বাসায় ঢুকছে বা বেরুচ্ছে কি না, তা স্পষ্ট দেখা যায়।  কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার পর কোনও গাড়ি বা মানুষ দেখতে না পেয়ে নিশ্চিত হলাম, গেইটে কেউই আসেনি, থামেওনি। এমনকি বাসার সামনের গলির রাস্তাতেও কোনও গাড়ি নাই। বুঝতে পারি―মনের ভীতি থেকেই এমনটা হচ্ছে। তবু আমার ভেতরের কাঁপুনিটা স্থির হয় না। মাথার ভেতর সারাক্ষণ হেলিকপ্টার উড়ছে। দরজা, জানালা বন্ধ ঘরেও ফ্যানের শব্দ আর এসির মৃদু গুঞ্জন ছাপিয়ে হঠাৎ ছাত্রদের সম্মিলিত কন্ঠের স্লোগানে চমকে উঠছি। ‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার : কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ‘আমার খায় আমার পরে : আমার বুকেই গুলি করে’ এমন আরও বজ্রকঠিন কিছু সেøাগান একের পর এক কানে বেজেই চলছে। বুকের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন আর মুহুর্মুহু গুলির শব্দ, টিয়ারশেলের ধোঁয়ার আচ্ছন্নতায় এখনও আমার দৃষ্টি আর মন যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ভেবেছিলাম এ সবকিছুরই অবসান হবে সৈ¦রাচারের পতন হলে। ভয় আর উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি পাবে সাধারণ মানুষ। অথচ স্বৈরাচার পতনের পরও ঘটছে দুর্ঘটনা। পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে আছে পুলিশের ড্রেস, বুট, নেইম-প্লেট। তার ওপর এখন শুরু হয়েছে ডাকাতের উৎপাত। না, আর ভালো লাগছে না!

সুমন একবার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, ‘তোমরা ফ্যান বন্ধ করে রাখছ কেন ? ফ্যানটা চালাও। গরমে ঘেমে গেছ তো!’ বলতে বলতেই ফ্যানের সুইচে হাত দিতে নিলেই সাদাত বলে, ‘না বাবা, ফ্যান ছেড়ো না।’

তখনি আমার ম্যাসেঞ্জারে ছোট বোন বৃষ্টির ফোন আসে। ‘আপু তোমাদের কী অবস্থা ? বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গ্রুপ তো ভরে গেছে পোস্টে পোস্টে।’

‘কিসের পোস্ট ?’

‘উত্তরা না কি ডাকাতরা অ্যাটাক করেছে ?’

‘জানি না রে। এখন তো ফেসবুকে ঢুকতেই ভয় লাগে। একটার পর একটা খারাপ খবরে নিউজফিড ভরে থাকে। এসব দেখতে আর ভালো লাগে না।’

‘শোনো, এইমাত্র দেখলাম ইসিবি চত্বরে একসঙ্গে ৭০টা বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, বেশ কয়েকজন ডাকাত মিলে। সংখ্যায় তারা কতজন তা তো সঠিক বলতে পারব না। একেক জায়গায় এক এক রকম কথা বলছে। কেউ বলছে ৭০-৮০ জন,  আবার কেউ কেউ বলছে আরও বেশিও হতে পারে। সেনাবাহিনী গিয়ে পৌঁছেছে সেখানে। দেখলাম, ডাকাতদল আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে। মহিলাদের আর বাচ্চাদের নাকি জিম্মি করছে ডাকাতরা।’

‘কী বলিস ? এতগুলো বাড়িতে একসঙ্গে অ্যাটাক করছে ?’

‘তাই তো দেখলাম।’

‘গুজব না তো ?’

‘আরে না। লাইভ ভিডিও দেখছি ফেসবুকে। তুমি ফেসবুকে ঢুকে ট্রাফিক অ্যালার্টে যাও, ওই গ্রুপে গেলেই সব দেখবা।’

‘ঠিক আছে। তুই ফোনটা রাখ এখন। আমি দেখছি। আবার পরে ফোন দিব।’

‘আচ্ছা, কোনও দরকার হলে জানাইও।’

‘হুম, জানাব।’

‘কী হইছে মা, বুত্তি (বৃষ্টিকে ভালোবেসে বুত্তি ডাকে) কী বলল ?’ বৃষ্টির সঙ্গে কথা শেষে সাদাত কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল।

পুরো ঘটনা শুনে সাদাত তার মতামত জানায়। ‘এটা কোনওভাবেই ডাকাতি নয় মা। এটা একটা ষড়যন্ত্র। পরিকল্পনা করেই এগুলো করা হচ্ছে, আমার মনে হয়।’

‘জানি না বাবা। কিচ্ছু জানি না।’ আমার চোখে মুখে তখন অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। অস্থির হয়ো না। তুমি অসুস্থ হয়ে যাবা। রিলাক্স থাকো রিলাক্স।’ কথাগুলো বলতে বলতে সাদাত দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে জুতার আলমারিটা একটু পিছনে সরিয়ে দরজা খুলে বলে, ‘মা আমি আসতেছি।’

‘কই যাস তুই এত রাতে ?’

‘বাইরে গিয়ে দেখি, কী অবস্থা ?’ 

‘কোত্থাও যাবি না তুই এখন। ঘরে আয়।’ ধমকের স্বরে বলি আমি।

‘আরে চিন্তা কইরো না। এলাকার অনেকেই তো বাইরে আছে। একটু আগেই উপরতলার সিঁড়ি থেকে শব্দ আসছিল। মনে হলো, কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাইরে যাচ্ছে। তাছাড়া রাস্তায় তো সিকিউরিটিও আছে। সমস্যা হবে না। তুমি ভালো করে দরজাটা লাগায়া দাও।’ পায়ে স্যান্ডেল পরতে পরতে বলে সাদাত।

ও যাবার পর আমার বুকের টিপটিপ শব্দটা রাতের নীরবতার মাঝে যেন আরও সুস্পষ্ট আর গাঢ় হলো। রূপা আমাকে হাত ধরে নিয়ে সোফায় বসাল। কিচেন থেকে এক গ্লাস পানি দিয়ে বলল, ‘খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।’

সুমন ওর রুম থেকে বেরিয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হইছে তোর মায়ের ?’

‘ভাইয়া বাইরে গেছে। তাই চিন্তা করতেছে।’

‘ও। আজাইরা পেনিক হইয়ো না তো। ও চলে আসবে। দেশ এমন একটা সিচুয়েশনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে, এখন যদি দেশের ভালো হয় সেরকম  কিছুতে ও না থাকতে পারে, তাইলে কি ওর ভালো লাগবে ? এমন সুযোগ কি জীবনে আর কখনও পাবে সাদাত ?’

আমি সুমনের কথার কোনও উত্তর দিই না। ওর সবকিছুতেই গা ছাড়া ভাব। কোন বিষয়ে সিরিয়াস আর কোন বিষয়ে সিরিয়াস না তা ২২ বছর সংসার করার পরও বুঝতে পারি না। আমাকে কথাগুলো শুনিয়েই সে আবার চলে গেল তার রুমে। সঙ্গে আমিও যাই। রুমের এক কোনায় রাখা চেয়ারটাতে বসি। টিভির ভলিউম অন করে পুনরায় ফেসবুক স্ক্রল করে চলেছে সে। কোনটা যে দেখছে আর কোনটা শুনছে ঠিক বুঝতে পারি না।

কিছুক্ষণ পর সুমনের রুম থেকে বেরিয়ে আমি ঘরের পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখার বা বোঝার চেষ্টা করি, কোথাও কিছু হচ্ছে কি না!

না, আমাদের বাসার গলিতে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় নিঃসঙ্গ এই পথ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ শুনলাম মাইকে অ্যানাউন্স হচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো অস্পষ্ট। আমি বারান্দায় যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, কী অ্যানাউন্স হচ্ছে মসজিদ থেকে। কিন্তু অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু শুনতে পাইনি। ভয় হচ্ছে ভেবে যে, ডাকাত এই এলাকা অ্যাটাক করেনি তো!

কোনও কিছু বুঝতে না পেরে বারান্দা থেকে ঘরের ভিতর ঢুকব ভেবে উল্টো ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি―ঘরের দরজায় রূপা দাঁড়িয়ে। ‘মা, কী বলতেছে, কিছু শুনতে পাইছ ?’

‘না রে। কিছুই তো বুঝি না।’

‘আচ্ছা। আসো, ঘরে আসো।’

আমি বারান্দা থেকে ঘরে পা দিতেই আবারও ফোন করল বান্ধবী দিশা। ঘড়িতে সময় তখন রাত তিনটা। ‘দোস্ত, কী অবস্থা রে তোদের ?’ তার স্বরে মিশে ছিল উৎকণ্ঠা।

আশ্বস্ত করতে বলি―‘আছি, এই তো।’

‘ফেসবুকে তো দেখলাম, উত্তরা অ্যাটাক হইছে।’

বুকটা ধক করে উঠল। ‘কী বলিস ? কত নাম্বার সেক্টরে ?’ ভয়, আর উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলাম দিশার কাছে।

‘তা তো জানি না রে। সেক্টরের কথা কিছু উল্লেখ করে নাই। শুধু উত্তরা লেখা।’

‘ওহ্, আমি কিছু জানি না।’ নিচুস্বরে বলি।

‘মেয়েটা কোথায় ?’

‘আছে। আমার কাছেই আছে।’

‘সাবধানে রাখিস। মেয়েটাকে সাবধানে রাখিস, বুঝছিস।’

‘হুম। দোয়া করিস আমাদের জন্য।’

‘শুন, সুরা ইউনুস আর আয়াতুল কুরসি পড়তে থাক। ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না।’

‘আচ্ছা, রাখি এখন।’

‘ঠিক আছে।’

ফোন রেখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রূপা চোখ বড় বড় করে জানতে চাইল, ‘কিসের শব্দ হলো মা ?’

‘কই ? শুনি নাই তো।’ অবাক হয়ে কপাল কুঁচকে জানতে চাইলাম।

‘মাত্রই তো হলো। তুমি যখন ফোনে কথা বলতাছিলা। ওই যে আবারও হচ্ছে। শুনছ, একসঙ্গে অনেকগুলা গুলির শব্দ।’ নিশ্চিত হয়ে পুনরায় বলে রূপা, ‘হ্যাঁ মা, গুলির শব্দই তো ওইটা।’

‘হ্যাঁ। গুলিই তো। মনে হচ্ছে সামনের গলি থেকেই শব্দ আসছে।’

‘তাহলে কি ডাকাত এই এলাকাতেই অ্যাটাক করছে ?’

দ্রুত পায়ে সুমনের ঘরের দিকে এগিয়ে যাই আর বলতে থাকি, ‘সাদাত কই ? আমার সাদাত কই ? এই শুনছ, তোমার টিভির সাউন্ডটা কমাও। সাদাতরে ফোন দাও। দেখ, ও কই আছে ?’

‘আরে অস্থির হয়ো না। মাথা ঠান্ডা রাখো। আমি ফোন দিতেছি।’

সুমনের রুমের মৃদু হলুদ আলোর বাতিটা নিভিয়ে উজ্জ্বল সাদা আলোর বাতি জ্বালিয়ে ওর পাশেই বিছানায় বসলাম। রূপা তখন আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ডাকাতের হামলার ভয় তখন আর আমাদের মধ্যে কাজ করছিল না। সবার তখন একটাই চাওয়া, সাদাত কোথায় আছে, কেমন আছে, সেটা জানা। সুমন সাদাতের নাম্বারে বারেবার কল করেই যাচ্ছে, কিন্তু ও ফোন ধরছে না। দুশ্চিন্তায় তখন আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। শরীরে কোনও শক্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছিল শরীরটা শুধু একটা খোলস। যাকে অযথাই কেবল বয়ে বেড়াচ্ছি।

 রূপা ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ স্ক্রল করে দেখার চেষ্টা করছে, উত্তরা নিয়ে কারও কোনও পোস্ট আছে কি না ? স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখে পড়ল, উত্তরায় ডাকাতের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে দুইজন নিহত।

আমি তখন আর স্থির থাকতে পারলাম না―বিড়বিড় করে বলতে থাকি আল্লাহ, আল্লাহ রক্ষা করো। আল্লাহ তুমি রক্ষা করো। আমার নিঃশ্বাস দ্রুত থেকে আরও দ্রুততর হতে লাগল। পুরো শরীর কাঁপছিল। এতক্ষণে ব্লাডপ্রেসারটাও হয়তো বেড়ে গেছে। সুমন ওয়ারড্রবের ভিতর থেকে একটা টি-শার্ট বের করে গায়ে পরে নিলো। লুঙ্গি বদলে জিন্স পরে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আমি বাইরে যাচ্ছি। তোমরা ভালোভাবে দরজা বন্ধ করো আর সাবধানে থাইকো।’

ঠিক তখনি ডোরবেল বেজে উঠলে আমার বুকের ভেতরটায় ধক করে উঠল। সুমন লুকিং গ্লাস দিয়ে কাকে যেন দেখে দরজাটা তাড়াতাড়ি খুলে দেয়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘কই ছিলি ? ফোন ধরিস নাই ক্যান ?’

‘চার্জ শেষ হয়ে গেছে বাবা।’

তখন আকাশ অন্ধকার সরিয়ে ধীরে ধীরে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। ভোরের পাখিরা কিচিরমিচির করছে। হয়তো বাইরে ইটের স্তূপে পতিত শিশিরকণা মুক্তোবিন্দুর মতো টলমল করে হাসছে। আলো ক্রমেই আসছে…।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button