আর্কাইভগল্প

গল্প : প্রেসক্রিপশন : মোস্তাফিজ কারিগর

ট্রেনের জানালা থেকে দৃশ্য একবারই; কেননা ট্রেন সম্মুখগামী, দৃশ্য থেকে দৃশ্যে ময়নুলের চোখও ছুটছে―যদিও নাবালক রাত্রির, এই সন্ধে অতিক্রান্ত কেবলই তার অন্ধকার আর লোকাল ট্রেন যেহেতু সত্য চিরকালের যে গতি তারও কিছু কম, তারপরও মাত্রই স্টেশন ছেড়ে দেওয়ার পরে স্বাভাবিক গতি প্রাপ্তির আগেই কিছুটা গ্রামের ভেতরে, ঘন, নিঝুম, ভূতের ভাস্কর্যপ্রচুর বৃক্ষদের পেছনে ফেলে যেতে যেতে দৃশ্য, সেই―রেললাইন লাগোয়া খুপড়ি ঘরের উঠোনে প্রায় নিভু নিভু হেরিকেনের আলোয় লোবানের ধোঁয়া, তার ভেতরে অধিকতর আবছা এক নারী, বৃদ্ধা, খাটিয়ার দিকে মাথা নামিয়ে বসে আছে, খাটিয়াতে কালো চাদরের সীমানা অতিক্রম করে কাফনে মোড়া জোড়া পা, লাশের, সাদা; বেরিয়ে আছে। পলকের দৃশ্য, অথচ ময়নুলের মস্তিষ্কের লক্ষ লক্ষ নিউরনে সবিশেষ দখল নিয়েছে স্বমহিমায়। ট্রেন পোড়াদহে পৌঁছালে, নেমে ইস্টিশনে ইতিউতি মিনিট কিছু হাঁটবার পরে ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরে আবার জগতি, কুষ্টিয়া কোর্ট হয়ে গোয়ালন্দগামী হওয়ার অন্তবর্তীকালে পোড়াদহ স্টেশনের ক্যান্টিনে সেই কোন সকালে পোড়া পামওয়েলে ভাজা শীতল চুপসানো দুটো পুরির অর্ডার করে কতকালের তেল চিটচিটে অথচ বেশ শক্তসবল কাঠের বেঞ্চে বসা ময়নুলের চোখে কাউন্টারে বসা পান চিবানোরত বয়স্ক ও শ্মশ্রুমণ্ডিত ক্যাশিয়ারের কানের পাশ দিয়ে খোলা দরজাটা বায়োস্কোপের ফ্রেম হয়ে উঠল। প্লাটফর্ম থেকে কিছুটা নিচু টিকিট কাউন্টারের পাশের জনশূন্য নিঝুম বইয়ের দোকানটিতে ঝুলতে থাকা ‘হাদীসের আলোকে স্বামী-স্ত্রীর গোপন জীবন’ বা ‘মকসেদুল মমেনীন’ বা ‘সাত দিনে কোরান শিখুন’ জাতীয় অনেকানেক বই বায়োস্কোপসদৃশ দরজার ফ্রেমে চোখ গলিয়ে দেখতে দেখতে ময়নুলকে কৈশোরোত্তীর্ণ কালের কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনসংক্রান্ত অজস্র স্মৃতির আক্রমণে পর্যুদস্ত হতেই হলো―স্টেশনসংলগ্ন প্রাচীন দালানের স্কুল, যেহেতু শ্রেণিকক্ষের শিক বা গ্রিলহীন অবারিত উন্মুক্ত জানালা আকাশকে কাছে ডেকে আনত, হুড়মুড় করে ঢুকিয়ে নিত অমনোযোগী বাতাসদের, যা কেবলই পালিয়ে যেতে উস্কানি দিত আর টিফিন পিরিয়ডে নিত্যদিনই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়ত বলে পানু স্যার পান চিবাতে চিবাতে, যার মুজিবর মওলা নাম বিলুপ্ত হয়েছিল প্রায়, অন্তত ছাত্রদের কাছে; পানু স্যারকে ফাঁকি দিয়ে সেই অবারিত আকাশপ্রতিম জানালা টপকে সমবেত ব্যাক বেঞ্চারদের সাথে হইহুল্লোড় করতে করতে স্কুলের বিশাল মাঠ পেরিয়ে পুকুর পাড় টপকে রেললাইন ধরে কুষ্টিয়া স্টেশন, টিফিনের টাকা দিয়ে বিস্কুট বা একটা শিঙাড়ার পরিবর্তে স্টেশনের পাশে সারি সারি ঝুপরি ভিউকার্ড বা বইয়ের দোকানে ঘণ্টাচুক্তিতে ভাড়া নেওয়া রসময় গুপ্তের সচিত্র কামের আগুন মার্কা চটি বইয়ের অক্ষর আর নীলছবি ঝুপরি দোকানের পেছনের জঙ্গলে বসে গব গব করে খাওয়ার কথা তার মনে পড়ল। সেই-ই সমবেত পাঠচক্র ও সমবেত হস্তশিল্প, সেই প্রথম পাঠাভ্যাস ও পাঠাগারই একদিন মুরাকামির ‘ম্যাজিক লাইব্রেরি’র বালকটি হতে স্বপ্ন দেখিয়েছে হয়তো অথবা রুই জিংকের ‘এক সমুদ্র বই’য়ের জাহাজের অন্ধকার ডেকে একা বালকটির মতো হারিয়ে যেতে চেয়েছে সারা জীবন। অথচ জীবন থেকে হারিয়ে কিংবা পালিয়ে যেতে চেয়েও ময়নুল দেখেছে―স্কুলের প্রাচীন দালানঘরের জানালার মতো সেই সব উদাত্ত জানালারা আর কোথাও নেই। চারিদিকে জানালারা ভারি ছোট হয়ে গেছে, আবদ্ধ গ্রিলে, নানাবিধ জঞ্জালে। তবু পুরোটা না পালাতে বা হারিয়ে যেতে পারলেও ছুটির দিনগুলোতে কিছুটা ট্রায়াল অথবা দুধের স¦াদ ঘোলে; শুক্রবারগুলো অন্তত নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস বা শাটলে কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন থেকে পোড়াদহ, ট্রেনের জানালা থেকে সন্ধ্যার অন্ধকারে চুপসে থাকা জীর্ণ জগতি স্টেশনটাকে একটু দেখার জন্যে বা পোড়াদহ স্টেশনের সন্ধ্যার নির্জন প্লাটফর্মের পাশে এক মৃত বৃক্ষ অলক্ষ্যে কেমন প্রাণময় হয়, তাকে বিভোর দেখা এবং সেই বৃক্ষের সাথে হৃদয়মথিত গূঢ় অনেক কথা ময়নুলের বলবার থাকে; যদিও তার জানা নেই প্রায় পরিত্যক্ত পূর্ববঙ্গের প্রথম এই রেলস্টেশনটা তাকে কেন এভাবে টানে, স্টেশনের অন্ধকার ও নৈঃশব্দ্য বা গ্রীষ্মদুপুর হুহু করা নির্জনতা তাকে বারবার হাতছানি দেয়; নাকি দাদি গেদুজান্নেসা ডাকে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে ময়নুলের বাবা-মার সাথে সাংসারিক কলহ পরে অভিমান করে জগতি স্টেশন ছাড়িয়ে কিছুটা দূরেই কোনও এক শীতল স্লিপারের উপর গেদুজান্নেসা প্রাণ থেকে শরীরকে আলাদা করে শুইয়ে রেখে দুরন্ত ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। দিনের পর দিন, মোবাইল ও সহজ যোগাযোগাতীত সেই সব দিনে খুঁজে খুঁজে ছাইগোষ্ঠী ব্যর্থ হওয়ার পরে অবশেষে পোড়াদহ রেলওয়ে পুলিশফাঁড়িতে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগসম্বলিত শাড়িটি আবিষ্কার করে পাশের বাড়ির মুশেম রাজমিস্ত্রী এনে দিলে ময়নুলের বাবা মাটিতে গড়াগড়ি করে গলাকাটা বলদের মতো গুঙরে গুঙরে কেঁদেছিল। দাদির চেহারা ময়নুলের আবছা মনে পড়ে, মুখের বলিরেখা, হাতের রূপালি বালাটার রঙ আজও উজ্জ্বল। কতদিন একা একা জগতি স্টেশন ছেড়ে রেললাইন ধরে খাঁ খাঁ দুপুরের ভেতরে একটা ডানাভাঙা লাল ফড়িঙের মতো একটার পর একটা স্লিপার মাড়িয়ে দাদির হাতের রুপোর বালাটা খুঁজেছে ময়নুল, খুঁজতে খুঁজতে কতদিন গজরাতে গজরাতে ট্রেন কাছে চলে এলেও সম্বিৎ হারানো ময়নুল হয়তো অচিন কোনও পথচারীর চিৎকারে দ্রুত সরে বেঁচে গেলেও বাঁচার অর্থ সে দাদির রুপালি বালাটির মতো হারিয়ে ফেললেও, বালাটির উজ্জ্বল রুপালি রঙের মতোই জীবন সপ্রতিভ ও দুরন্ত, ক্ষিপ্ত বাইসনের মতো তাড়া করে একবার সংসারে ঢোকায় আবার প্রবল শিং উচিয়ে দূর তেপান্তরে রুক্ষ বিরানে ফেলে দেয়।

শান্টিং শেষে ট্রেনের ইঞ্জিন কুষ্টিয়া শহরের দিকে মুখ করে থাকা বগিটার সাথে সংযোগ ফিরে পেয়ে যেন বা মহানন্দে সাইরেন বাজালে স্টেশনের ক্যান্টিনের তেলচিটে বেঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে উঠে ক্যাশকাউন্টারে পুরির দাম মেটানোর সময় পানচিবানোরত বয়স্ক ক্যাশিয়ারের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখটার দিকে নিবিড় তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ ময়নুল―পান চিবানোর ছন্দে লোকটার মুখের সাদা শ্মশ্রুগুলো তুলোর পাহাড়ের মতো নাচছে; ময়নুলের মনে হলো লোকটার শ্মশ্রুর মোলায়েম নাচ দেখে দেখে একটা জীবন নির্বিকার কেটে যেত যদি অথবা নিজের মুখের মধ্যে একখিলি পান গুঁজে চিবিয়ে চিবিয়ে সারা জীবন পার করা যেত যদি! তখন আবারও সাইরেন, এবার একটু পা চালিয়ে পছন্দমতো একটা বগিতে দ্রুত উঠে পড়ার মুহূর্ত কয়েক পরেই পোড়াদহ স্টেশন ছেড়ে ট্রেন কুষ্টিয়া শহরের দিকে ক্রমেই গতিচঞ্চল হলে, ট্রেনের জানালায় দ্রুত সরে সরে যাওয়া থোক থোক অন্ধকারে ময়নুল চোখদুটো চালিত করে, আর খোঁজে রেললাইন লাগোয়া খুপড়িঘরের উঠোনে প্রায় নিভু নিভু হেরিকেনের আলো; এখনও কি সেই বৃদ্ধা নারী খাটিয়ার পাশে হেরিকেনের গরিব আলোয় বসে আছে আর উদভ্রান্ত লোবানের ধোয়া তাকে ঘিরে বিরাট কুণ্ডলী গড়ে তুলেছে। দৃশ্যটা কী কলাবাড়ির লালব্রিজের আগে না পরে দেখেছিল, ত্বরিত মনে করবার চেষ্টা করতে করতেই ট্রেনটা ব্রিজ পেরোনোর শব্দ তুলে ছুটতে থাকে। লালব্রিজ পেরিয়েই ট্রেনের গতি কমে কমে প্রায় মন্থর হতে থাকে, যেন সময় থেমে যাচ্ছে। ট্রেনের জানালায় ঘুটঘুটে অন্ধকার; এখানে একটিই লাইন, ক্রসিংয়ের কথা নয়। তবু সিনেমার স্লো মোশনের মতো গড়াতে থাকলে ট্রেন, ময়নুলের চোখে ট্রেনের জানালার ফ্রেমটা একটা সিনেমাহলের বিরাট পর্দা হয়ে ওঠে―ময়নুল একা দর্শক, বিরাট এই সিনেমা হলে; পর্দায় ক্ষীণ আলো, হেরিকেনের; লোবানের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যাচ্ছে মহাশূন্যের দিকে, তার ভেতরে সেই বৃদ্ধা আর খাটিয়া; খাটিয়াতে কালো চাদরের সীমানাকে ফাঁকি দিয়ে কাফনে জড়ানো লাশের পায়ের অংশ ধব ধব করছে―যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতরে বৃদ্ধা আর খাটিয়াটা ভাসছে। যাবার সময়ও কি ট্রেনটা এইখানে এমন গতি কমিয়েছিল ? মন তাকে অতটা ধোঁকা দিতে পারল না―না তো, ট্রেনটা যাওয়ার সময় মোটামুটি গতিতেই চলেছিল আর সেই গতির ভেতরেই পলকের দৃশ্য। কিন্তু এখন ফেরার সময় ট্রেনটা কেমন গলে গলে মন্থর হয়ে গহিন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে অথবা সময় গলে গলে তরল আঠালো অন্ধকার হয়ে ট্রেনের বগিতে ঢুকে সমস্ত কিছু স্থবির করে দিতে চাইছে।

ট্রেনটা সময়ের তরল মগজে জলোচ্ছ্বাস তুলে দুরন্ত গতিতে কখন যে স্বাভাবিক হয়েছে, লোবানের গন্ধের ভেতরে স্নায়ুলুপ্ত ময়নুল তা বুঝে ওঠার আগেই ট্রেনের জানালায় তার প্রিয়-কাক্সিক্ষত নস্টালজিক ফ্রেমে বিপুল অন্ধকারের ভেতরে তলিয়ে থাকা জগতি স্টেশনের ছবি আবিষ্কার করতে না করতেই ট্রেনটা কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে এসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে, গন্তব্যস্থলে নামতে ব্যস্ত মানুষের কোলাহল তার সম্বিৎ ফেরায়। দীর্ঘ মানুষের সারির পেছনে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে ট্রেন থেকে নেমে প্লাটর্ফম ছেড়ে রামচন্দ্র রায় চৌধুরী রোড ধরে হেঁটে কলেজমোড়ে সারি সারি ঔষধের দোকানের সামনে ভিড় করে ঔষধ ক্রয়রত অসুস্থ বা মুমূর্ষুদের বিষাদবিধ্বস্ত স্বজনদের কাতারে শামিল হয়ে পকেট থেকে ভাঁজ করা বাবার ঔষধের প্রেসক্রিপশন বের করে। চিরকালের ভিড়ের তকমা পাওয়া মাছের বাজার এখন ঔষধের বাজারের কাছে ম্লান; এখানে এলে ময়নুলের মনে হয়―ভাত-মাছের চেয়ে মানুষ যেন ঔষধই বেশি খাচ্ছে আজকাল। বাবারও তাই; গত চব্বিশ বছরের ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসারের সাথে সদ্য হার্টঅ্যাটাকের পরে প্রেসক্রিপশনে ঔষধের তালিকা ক্রমশই বাড়ছে। তাতে বাবা এখন ভাতের চেয়ে ঔষধপ্রধান প্রাণি। ভিড়ে স্থৈর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ঔষধগুলো কিনে বাড়ির দরজায় পা রাখতেই বুঝতে পারে, হ্যাঁ আজও ক্ষেপেছে বাবা; আর অকারণে থাইরয়েডাক্রান্ত, ডায়াবেটিস-হাইপ্রেসারে আক্রান্ত আরেকজন রোগী, ক্লান্ত-অবসন্ন মইনুলের মা হাফিজা বেগমের উপর অকারণে চড়াও হচ্ছে বাবা। দরজার কড়া নাড়তেই মা দরজা খুলে দিলে মইনুল প্রত্যক্ষ করে―বাবা একটা পুরোনো দাঁতপড়া করাত দিয়ে ঘরের টেবিলের পায়া কাটার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিরত, আর মুখে তিক্ত বিষোদগার―শালার পোকাটা টেবিলের এই পায়ার মধ্যেই আছে। সন্ধেবেলা থেকে আমার কান মাথা খেয়ে ফেলল, আমি ঘুমাতে পারছি না। মা নির্বিকার পাশে দাঁড়িয়ে। হার্ট অ্যাটাকের পরে পনেরো দিন হসপিটালে কাটিয়ে বাসায় আসার পর থেকে বাবা কোনও রকম শব্দ শুনলে ভীষণ রেগে যাচ্ছে―বাবার ঘুমানোর ঘরের জানালার পাশে পেয়ারা গাছে অনেক দিন ধরে দুটো টুনটুনি থাকে, পেয়ারা পাতা জড়িয়ে তাদের ছোট্ট বাসা-সংসার, খুনসুটি; সেই টুনটুনি পাখিদুটোর ডাকেও অতিষ্ট হয়ে উঠছে বাবা। দেয়ালে ভ্রাম্যমাণ পোকাশিকারি টিকটিকির ডাক, পাশের বাড়ির বাচ্চাদের হইহুল্লোড়ের শব্দ, এমনকি বাথরুম রান্নাঘর ডাইনিংয়ে বেসিনের ট্যাপের জলের শব্দে সে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে, রেগে মারাত্মক উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। তার ধারণা―তার হার্ট অ্যাটাক হয়নি, শুধু মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তায়, তারপর পথচারীরা কর্তব্যপরায়ণ,  দ্রুত হসপিটালে; হসপিটালে ডাক্তাররা ভুল ঔষধ দিয়েছে তাকে। ভুল চিকিৎসায় তার ব্রেনে সমস্যা হয়ে গেছে। তো ঠিক আছে, ব্রেনের ডাক্তারের কাছে চলো―ডাক্তার দেখলেন, সিটিস্ক্যানে কোনও ত্রুটি লক্ষিত নয়। মা নিজেও তো রোগাক্রান্ত, আরেকজন রোগীর সেবা করতে করতে আরও বিধ্বস্ত, বলে―তোমার বাবার মনে হয় মানসিক সমস্যা হয়ে যাচ্ছে, তাই আবোল তাবোল করছে। শুধু দুঃশ্চিন্তা করছে, সামান্য দু-দশ হাজার যা এখনও ঐ ছাপোষা চাকরিটা থেকে পায়, তাতে মোশতাকের পড়াশোনার খরচটা চলে যাচ্ছে। তুমি সংসারে বাজার, ঔষধপত্র, আনুষঙ্গিক সামলাচ্ছো। তোমার উপরে অনেক চাপ।  অফিসে এতোদিন গ্যাপ পড়ে গেলে মালিক যদি চাকরিতে না রাখে। এমনিতেই এখন আগের মতো কাজ করতে পারে না তোমার বাবা, হিসাব-পত্তরে ভুল করে, দুটো চোখেই সমস্যা। অল্প টাকা বেতনে মালিক কম্পিউটারে দক্ষ নতুন ছেলেদের চাকরি দিচ্ছে, এখন তো সব হিসাব-নিকাশ কম্পিউটারে, তোমার বাবা এখনও সেই কাগজ কলমে। দুশ্চিন্তা করছে চাকরিটা যদি না থাকে। মোশতাক এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারল না। আর কটা দিন পরে ভর্তিপরীক্ষা, যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর একটা গতি হলে টিউশনি করে চলতে পারবে। তোমার বাবার আবোল তাবোল আমি আর সহ্য করতে পারছি না। সারা রাত আমাকে ঘুমাতে দেয় না; এটা করো সেটা করো…বলতেই থাকে, আমারও অসুস্থ শরীর। তুমি এক কাজ করো ময়নুল―তোমার বাবাকে মানসিক রোগের ডাক্তার দেখাও। বাবা তা শুনে আরও উত্তেজিত―তোমার মাকে নিয়ে যাও পাগলের ডাক্তারের কাছে। ময়নুল বিধ্বস্ত কোমড়ভাঙা গাছের মতো দাঁড়িয়ে তার স্থৈর্যের ঝিরি ঝিরি পত্রপল্লব নাড়িয়ে শান্ত বাতাস তোলার চেষ্টা করে। শীতলতা এলে, বেজার বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে নিজের ঘরের দিকে চলে― যেন গৃহস্থের হেঁশেলে খাবার না পেয়ে একটা মন খারাপ করা কালো বেড়াল সে, আরও কালোর ভেতরে গড়াতে গড়াতে স্ত্রী ও সন্তানের ঘুমের গভীর কুয়োর পাশে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার মতো নিঃশব্দে পতিত হয়।

মাঝরাতে স্ত্রী ও সন্তানের পাশে ঘুমিয়ে থাকা ময়নুল তিড়িং করে বিছানায় উঠে বসে―স্বপ্নের ভেতরে না বাস্তবে, কী একটা শব্দে তার কান ফেটে যেতে চাইছে। কাঠকাটা কোনও পোকার দাঁতাল শব্দ, নাকি দাঁতপড়া করাতের ব্যর্থ আস্ফালনের। বাবা কি আবার রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে টেবিলের পায়াটা করাতে কাঁটছে। মশারির সীমানা থেকে বেড়িয়ে অন্ধকারে অনেকক্ষণ পায়চারী করে, বাবা-মার ঘরের দরজায় দাঁড়ায়―নিঝুম, বিভোর ঘুমে বাবা-মা। ফিরে আসে মশারিতে, স্ত্রী ও সন্তানের ঘুমের পাশে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আর তাকে পায় না, তাকে পায় বিচিত্র দুশ্চিন্তায়। অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসা আত্মীয়েরা নানাজন নানা পরামর্শ দিচ্ছে―তোমার বাবাকে ঢাকা নিয়ে যাও, রাজশাহী নিয়ে যাও, তোমার বাবাকে ভেলর নিয়ে যাও, চেন্নাই যাও, তোমার বাবাকে ব্যাঙ্গালুরে নিয়ে যাও―এখানে তোমার বাবার ভালো চিকিৎসা হচ্ছে না, দ্রুত এনজিওগ্রামটা করাও―সমস্ত ঘটনা ঘটবার সাথে সাথে মায়ের চিরকালীন সেই দুঃখী স্বর, ময়নুলের কানে কর্ফা ধরে গর গর করে সব কথা-খবরাখবর ত্বরিত গতিতে গড়িয়ে দিচ্ছে। তার মনে পড়ে না, সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, মা কখনও ফোন করে কোনওদিন কোনও আনন্দের সংবাদ দিয়েছে তাকে―চাকরির পাশাপাশি চাউলের ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যবসায়ে বাবার নিদারুন অসফলতা, বিচিত্র ঋণের লতায় জড়িয়ে পড়া, মাইক্রোক্রেডিটের বিপুল জালে আটকে শেষতক পৈতৃক ভিটেটা বিক্রি হয়ে যাওয়া, আবার জমি কিনে বাবা বাড়ি করতে গিয়ে আবার ব্যাংকে লোন থেকে সংসারের হাঁড়িতে চাউলের শূন্যতা, খুটিনাটি; কখনও বা বিষয় আনন্দের হলেও উপস্থাপনার বিষণ্নতায় মায়ের কণ্ঠ চিরকাল ভেজা। এটা কি মায়ের প্রকৃতি, না মা দিনের পর দিন তাকে ব্লাকমেইল করে যাচ্ছে―ভেবে ভেবে ময়নুল নিজেকে অপরাধী করেছে অনেক। তার মনে হতো―সমস্ত সংকটই তো সে জানে, আপ্রাণ চেষ্টাও করছে অর্থ জোগানের, কিন্তু মা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এতো কান্না তার কানে ঢেলে নাও দিতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় থেকেই মায়ের এই প্রকৃতি কিংবা আবেগাক্রান্ত প্রতারণা তাকে দ্বান্দ্বিক ভাবনার ভেতরে চুবিয়ে রেখেছে। বন্ধুরা যখন আড্ডা দিয়ে হুল্লোড় করে প্রেম করে নিয়মিত ক্লাস করে যাচ্ছে ভাল রেজাল্ট করছে; মায়ের কান্নাভেজা ফোন তাকে ছুটিয়ে বেড়ায় টিউশনিতে, জুতোর কোম্পানিতে পার্টটাইম কিংবা পথশিশুদের শিক্ষক হয়ে জার্মান ডোনারের এনজিওতে; কোনও কোনও দিন ক্লান্ত বিষণ্ন বিধ্বস্ত হয়ে মেসের ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে চেয়ারের উপরে উঠে পৃথিবীর মাধুর্যকে শেষবারের মতো ভুলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নেমে, বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে গুমরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্নাতক হতে পারলেও, স্নাতকোত্তরে নন-কলেজিয়েট, পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হলো না তার। একটা ভালো চাকরি খোঁজার আগেই দলছুট উল্কার মতো ছিটকে পড়তে হলো বিচিত্র পেশায়―সাংবাদিকতা, প্রেসের ব্যবসা, খাবারের রেস্তোরাঁ, শেষে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সার; ফ্রিল্যান্সে বেশ সফলতা ময়নুলকে একে একে পারিবারিক সমস্ত ঋণের গর্ত থেকে টেনে তুললেও মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরাট অধ্যায় হয়ে আসা করোনা মহামারীতে ঢাকার জীবন-সংসার বিপর্যস্ত হলে তল্পি-তল্পা গুটিয়ে বৌ-সন্তান নিয়ে কুষ্টিয়ার বাড়িতে, আকস্মিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি; ব্যাংকে জমানো কিছু টাকা আর করোনাপরবর্তী মুখথুবড়ে পড়া বৈশ্বিক মন্দা অর্থনীতির বাজারে অন্তর্জালনির্ভর পেশায় কিছু কাজ কুড়িয়ে মফস্বলে বসেও জীবিকার চাকা ঘুরাতে থাকে। কিন্তু সংসার যৌথ, নিকটাত্মীয়ের নানা বিপদ-আপদে অনিচ্ছায় সহযোগিতা, আজ মামা পাঁচ হাজার ধার চায় তো কাল মেজো খালা বিশ হাজার, পরশু ফুফাতো ভাই এক লাখ, চাচাতো ভাই পাঁচ লাখ―ময়নুলের জীবনকে পর্যুদস্ত করে তোলে। ময়নুল না করতে পারে না, হ্যাঁ করলেও তার যা ভোগান্তি, তাতে দিন দিন সে আরও বিপন্ন হতে থাকে।

ময়নুল হাঁপিয়ে যাচ্ছে; ময়নুল হাঁপাচ্ছে। তার দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দে স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেলে কিছুটা তিরিক্ষি মেজাজ স্বাভাবিক―অনেক তো চাপ তুমি জীবনে নিলে, কিছু করতে পেরেছো, এবার নিজের সংসার-সন্তানের দিকে ফেরো। যে দায়িত্ব নিলে তুমি ভালো থাকো না, অতো দায়িত্ব নিয়ে কেন গলা কাটা মোরগের মতো তড়পাও। ময়নুল আরও হাঁপাতে হাঁপাতে ভাবে―কবে কবে সত্যিই সে এতো দায়িত্ববান সন্তান, স্বামী এবং পিতা হয়ে উঠেছে; একে কি দায়িত্ব বলা যায় নাকি সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে গিয়ে সংসারের নানা জনের আবেগের বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার সে; সে কি সত্যিই দায়িত্ববান! না কি সংসারের মানুষেরা স্পষ্ট টের পেয়ে গেছে ময়নুল একটা হা-মুখ চুল্লি, তার ভেতরে সমস্ত আগুন সেধিয়ে দিলে জ¦লে জ¦লে শান্ত ছাই হয়ে যাবে। স্ত্রীর কথাতে নয়, সে নিজেই অযুতবার ভেবেছে নিজেকে এই ঘোরের মধ্যে থেকে বের করতে, ততই দায়িত্বের ঘুলঘুলিতে তার অতল নিমজ্জন। সে ভেবে অকূলে পতিত―দায়িত্ববান হওয়া কি অপরাধ ? দায়িত্ববান হওয়া মানে কি জগৎ-সংসারের সমস্ত দায় তার!―না এটা অপরাধ নয়, কিন্তু তুমি কৌশলী নও―স্ত্রীর কথা তাকে আরও বিষণ্ন করে; এই সব বিষণ্নতা থেকে বেরিয়ে পড়ার কৌশল তার কিছুতেই জানা নেই। সে কেবল আরও বিষণ্ন হতে জানে, বিমূঢ়, ভয় পেতে জানে, সমস্ত কিছুতে, নিজের ভেতরে কুকরে গ্রীষ্মের শুকনো পাতাদের মতো সময়ের পদতলে চূর্ণ হয়ে ধুলো হয়ে যেতে জানে―আর কোনও জানা তার নেই…নিজের ভেতরে নিজে আটকে গেছে ক্রমশ। ভুলে যেতে থাকে পাঠাভ্যাস, মুখস্ত কবিতার অসংখ্য লাইন বা প্রিয় উপন্যাসের চরিত্রদের। নিভৃতে সেও কি লেখক হতে চেয়েছিল কোনওদিন, কবি―কোনও গোপন গূঢ় কথা লিখে দিতে চেয়েছিল পৃথিবীর প্রথম নির্জন প্যাপিরাসে―আজ তার সেটুকুও ভাবতে ইচ্ছে করে না যেন!

সকালে বিকট শব্দে ময়নুলের ঘুম ছত্রখান; বিছানা ছেড়ে ছুটে বাবা-মার ঘরের সামনে যেতেই শুনতে পায় দ্রুম দ্রাম। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে ময়নুলের চোখ বিস্ময়ের চূড়া―বাবা তাদের এতদিনের পুরোনো খাটের পায়াটা হাতুড়ি দিয়ে ভাঙছে আর মা দুই হাতে দুটো কান ধরে শীতার্ত মৃগশাবকের মতো কাঁপছে। বাবা হাতুড়ি পেটাচ্ছে আর বলছে―আজ পোকার বংশ শেষ করে দেব। পোকাটা খাটের পায়ার ভেতরেই আছে। ময়নুল এগিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ায়, বাবা তখনও হাতুড়িতে খাটের পায়া ভেঙে চলেছে। মা বলছে―সকালে তোমার বাবার কলিগ নিজামুল ভাই ফোন করেছিল; তোমার বাবা ভালই তো কথা বলছিল তার সাথে, বেশ গল্পগুজব করল। শেষে নিজামুল ভাই বলেছে না কি―তোমার বাবা তো গত এক মাস হতে চললো অফিসে যেতে পারে না, অফিসের কাজ আটকে থাকছে, মালিক তাই একটা তরুণ ছেলেকে বসিয়েছে তোমার বাবার চেয়ারে।

বাবা ক্লান্ত। ঘেমে স্নাত। মেঝেতে এলিয়ে বসে পড়েছে। খাটের ভাঙা পায়াটা নিয়ে ময়নুল ছাদে উঠে পায়াটাতে কেরোসিনের তেল ঢেলে সকালের টকটকে রোদে বিছিয়ে রাখে, পোকা থাকলে বেরিয়ে যাবে। বিকেলে একজন কাঠমিস্ত্রি ডেকে পায়াটা লাগিয়ে দেবে, ভাবল। কেরোসিনে ভেজা খাটের পায়ার দিকে অনেকক্ষণ নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে―বাবার চাকরিটা সত্যিই না থাকলে সংসারের পুরো চাপটা তার উপড়ে পড়ে যাবে; অনেকটা সময় ধরে তার ভাবনাযান আরও বিষাদগতি পেল তবু কোনও পোকা বের হলো না। ময়নুলের মাথা ঝিম ঝিম করে ওঠে। কী যেন একটা শব্দ তার মাথার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে, শব্দটা প্রবল থেকে ক্রমশ প্রবলতর হতে থাকে। ময়নুল ছাদ থেকে নামে, সবার অলক্ষ্যে বাড়ির দরজা টপকে দৌড়াতে থাকে। একটু আধটু জগিংয়ের অভ্যেস থাকলেও, আজকের জগিং ভারী করুণ; কেননা ভেতরে তার প্রদাহ পরিব্যাপ্ত হচ্ছে আর মুখে সার্কাসের ভাঁড়ের মতো হাসি―কেননা পাড়ার লোকেরা এবং পরিচিত পথচারীরা যেন বুঝতে পারে, এ তার নিরেট স্বাস্থ্যসতেনতা; ঐ হাসি বলে দেবে ময়নুল ভারী সুস্থ ও সুখী। শরীর সুস্থ যার, সুখও তার―তাই শাস্ত্রজ্ঞরা বলেছেন―নিয়মিত শরীরচর্চা বিধেয়। কিন্তু শব্দটা তার পিছু পিছু অধিকতর সরব, ফলে দৌড়ের গতি বেড়ে যায় ময়নুলের। কখন যে বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরের পরিত্যক্ত জগতি রেল স্টেশনের শূন্যতার ভেতরে এসে ডুবে গিয়েছিল সে―টের পেলো, যখন একটা লোকাল ট্রেন এসে প্রাচীন নির্জনতাকে কিছুটা ছত্রখান করে বগিগুলো থেকে আরও আরও ঘন-শীতল নির্জনতা ঢেলে দিয়ে পরিত্যক্ত জগতি স্টেশনকে আরও নিঝুমপুরি বানিয়ে দিল। পুরো ট্রেনটাতে কোনও যাত্রী নেই। যাত্রীর ওঠা-নামা নেই, কুলির ব্যস্ততা নেই। এই পরিত্যক্ত স্টেশনে মাঝে মধ্যে দুটি একটি লোকাল ট্রেন দাঁড়ায়, কিছু মালগাড়ি এসে বিশ্রাম নেয় বা নেহায়েৎ কোনও ক্রসিংয়ে আটকে পড়ে কোনও কোনও ট্রেন যাত্রীদের উষ্মাতে মুখর হয়। কিন্তু আজ এই যাত্রীহীন একাকী ট্রেন অনেকানেক সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও কোনও ক্রসিং হয় না। এই পরিত্যক্ত স্টেশনের নিঝুম-নির্জনতা ছেড়ে ট্রেনটা কি আর কোথাও যাবে না কোনওদিন, সময় কি এখানে বিমূঢ়, থেমে যাচ্ছে। থেমে থাকা ট্রেনের একটি বগির ভেতরে উঠে বসে ময়নুল, অনন্ত স্তব্ধতার ভেতরে। ময়নুলের মনে হয় হাজার হাজার বছর সে এখানেই বসে আছে, এই পরিত্যক্ত স্টেশনের নির্জনে যাত্রীশূন্য অসীম বগির ভেতরে। তার মনে হয় এখানে রাত নেই দিন নেই; কেবল নিরেট একটা আবরণ; কুহেলিকা-কুয়াশা কিংবা ধোঁয়ার ভেতরে ক্লান্ত ময়নুল ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন, ইয়াত্তা নেই। হঠাৎ মাঘের শীতল বাতাসের মতো ট্রেনের জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে লোবানের গন্ধ ঢুকে এসে ময়নুলের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে কম্পিত করে। ট্রেনের জানালা গলিয়ে বাইরে ডানে বামে তাকিয়ে দেখে―চারিদিকে যেন প্রবল কুয়াশা। মনে হয় অসীম শূন্যে ট্রেনটা ভাসছে আর লোবানের গন্ধ আরও তীব্রতর হয়ে সমভিব্যহারে তাকে ঘিরে ধরছে। আবিষ্কার করে, ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতরে নিভু নিভু হেরিকেনের আলোয় চেয়ারে বসে আছে সেই বৃদ্ধা, পাশে খাটিয়াতে কাফনে জড়ানো লাশ। তার মনে হলো মহাশূন্যের ভেতরে ট্রেনটা, চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধা আর লাশের খাটিয়াটি ভরহীন ফেনার মতো ভাসছে। এক সময় সে দেখে―কুয়াশা, মেঘ কিংবা লোবানের ধোঁয়ার ভেতরে ধবধবে সাদা শাড়িতে বৃদ্ধাটি হাঁটতে হাঁটতে ট্রেনের জানালার দিকে এগিয়ে আসছে আর শূন্যে ভাসমান খাটিয়া থেকে কালো চাদর সরিয়ে ধীরে ধীরে শরীর থেকে সফেদ কাফন খুলে লাশটা উঠে বৃদ্ধার পেছনে পেছনে আসছে। লাশ বৃদ্ধাকে হাত নেড়ে ডাকছে কিন্তু বৃদ্ধা বড় অভিমানী, পিছু ফিরেও তাকাচ্ছে না। বৃদ্ধা ক্রমশ ট্রেনের জানালার কাছে এলে ময়নুল স্পষ্ট দেখতে পায়―এতো দাদি, গেদুজান্নেসা আর ঐ তো পেছনে তার বাবা, দাদিকে ডেকে ডেকেও পিছু ফেরাতে পারছে না। ময়নুল ট্রেনের সিট থেকে ছুটে দরজার কাছে যায়―উন্মুক্ত, অসীম; এ যেন কুষ্টিয়া হাই স্কুলের সেই জানালা, উদাত্ত সেই সব জানালা, কেবল ক্লাস পালাতে উস্কানি দেওয়া সেই সব জানালা। ক্লাস পালিয়ে কুষ্টিয়া স্টেশনে জাদুখেলা দেখতে যাবে―পান চিবোতে চিবোতে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়া পানু স্যারের অলক্ষ্যে উদাত্ত জানালা টপকে লাফিয়ে পড়ার মতো মেঘ, কুয়াশা কিংবা লোবানের ধোঁয়ার ভেতরে দুরন্ত লাফ দেয় ময়নুল।

কতগুলো লোক খোলা ভ্যানের উপরে ময়নুলকে শুইয়ে বাড়ির দরজায় এসে হাঁকডাক করে। ময়নুলের মা দরজা খুলে ভ্যানে শুইয়ে রাখা সারা গায়ে কাদা জড়ানো ময়নুলকে দেখে হাইমাউ করে কেঁদে ওঠে। ময়নুলের স্ত্রী ছুটে আসে―কী হয়েছে ময়নুলের ? তেমন কিছু হয়নি, এই একটু কপালে আর হাত-পায়ের কনুইতে কিছুটা কেটে গেছে। খুব রক্ত বের হয়নি। আমরা পাশের ফার্মেসি থেকে স্যাভলনে মুছে ন্যাবানল পাউডার লাগিয়ে দিয়েছি। ভাবী আপনি একটু এদিকে আসেন―লোকগুলো ময়নুলের স্ত্রীকে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে বলে―ভাগ্যিস ট্রেনের গতিটা কম ছিল আর লাফটা যেখানে দিয়েছে সেখানে ডোবা, কাদা।

বাড়িতে ভীষণ বিষণ্নতা নেমে আসে। ময়নুল ইদানীং দিনের বেশি সময় শুয়ে থাকে। বইপত্র নেড়ে চেড়ে রেখে দেয়, পড়তে ইচ্ছে করে না আর, কোনও একটা অদ্ভুত লাইব্রেরিতে অজস্র বইয়ের উপরে পরিযায়ী পাখিদের রেখে যাওয়া পালক তাকে হাতছানি দেয় না। বাবা জানালার ধারে বসে সারাদিন টুনটুনি পাখিদুটো তাড়ায়, কিন্তু যথেষ্ট নাছোড় টুনটুনি তারা। বাবার খাটের পায়াটা সারানো হয়নি, ওখানে কতগুলো ইট দিয়ে ভর রাখা হয়েছে। এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলো না ছোট ভাইটার। পচাত্তর ভাগ সিট কোটাতে পূর্ণ, সাধারণ ছাত্ররা প্রায় আশি পেয়েও ভর্তি হতে পারল না, সেখানে কোটাঅলারা সাঁইত্রিশ পেয়েও বর্তে গেছে। একদিন সকালে আবার বিকট শব্দে ময়নুলের ঘুম ভেঙে যায়। ছুটে বাবা-মার ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই দেখে―মা একটা হাতুড়ি দিয়ে তাদের ঘুমানোর খাটের পায়াটা ভাঙছে আর বাবা বিভোর ঘুমাচ্ছে খাটের উপরে আর মা বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছে―সারা রাত পোকাটা ঘুমাতে দেয়নি আমাকে। এই খাটের পায়াতেই আছে পোকাটা। আজ আমি পোকার বংশ শেষ করে দেব।― মাও কি তবে বিপন্ন, লুপ্ত হতে চলেছে সুস্থ মানসিকতা ? তাকেও কি মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার।

ময়নুলের একজন প্রিয় গল্পকার খুব বড় সাইক্রিয়াটিস্ট, রাজশাহীতে রোগী দেখেন। বাবা-মা দুজনকেই নিয়ে একদিন সেই সাইক্রিয়াটিস্টের চেম্বারে। সাইক্রিয়াটিস্ট প্রথমে বাবাকেই চেম্বারে ডেকে নিলেন। আধা ঘন্টা পরে মাকে। ঘন্টাখানেক পরে বাবা-মা দুজনই চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলে সাইক্রিয়াটিস্ট এবার ময়নুলকে ডাকলেন ভেতরে। তারপর ঘণ্টার পরে ঘণ্টা ময়নুল থাকল সাইক্রিয়াটিস্টের চেম্বারে। ময়নুল তার সমস্তটা সাইক্রিয়াটিস্টকে বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে―আমিও কি পাগল হয়ে যাচ্ছি ? চেম্বারের বাইরে বসে থাকা তার বাবা-মা সেই কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল কি! পেয়েছিল অথবা পায়নি। সাইক্রিয়াটিস্ট বললেন―ময়নুল, শরীর যেমন অসুস্থ হয় নানা অনিয়ম, রোগ-শোকে; মনটাও সেভাবেই জগৎ-সংসারে ঘটে চলা ঘটনায় যেমনটি আহ্লাদিত হয়, তেমনটি আক্রান্তও হয়। শরীর অসুস্থ হলে, স্বাভাবিক, আমরা যেমন ঔষধ খাচ্ছি, অসুস্থতাকে যাপন করছি; মনও তো অসুস্থ হবে, তার ঔষধ আছে। মস্তিষ্কে কেমিক্যাল ইমব্যালেন্স হতেই পারে আমাদের। আর তুমি সুস্থ না থাকলে তোমার বাবা-মাকে কীভাবে সুস্থ রাখবে।

বাড়ি ফিরে পরদিন ঔষধ কিনতে যাবে বলে সাইক্রিয়াটিস্টের ফাইলের ভেতর থেকে প্রেসক্রিপশটা নিয়ে ভাঁজ করে বুকপকেটে ঢুকিয়ে এলোমেলো অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে ঔষধের দোকানগুলোর সামনে যায়। ঔষধখেকো রোগীদের ও রোগীর স্বজনদের ভিড় ঠেলে একটা ফার্মেসির বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে বুকপকেট থেকে প্রেসক্রিপশনটা বের করে―দেখে, প্রেসক্রিপশনে রোগীর নাম লেখা―ময়নুল ইসলাম। বয়স ৩৭। প্রেসক্রিপশনটা আবার একটা গোপন প্রেমপত্রের মতো ভাঁজ করে বুকপকেটে লুকিয়ে ঔষধের দোকানগুলোর ভিড় থেকে নিজেকে দাগী কয়েদির কারামুক্ত হওয়ার মতো নিজেকে মুক্ত করে আরও এলোমেলো হেঁটে হেঁটে কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে গিয়ে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে হাঁপাতে থাকে। স্টেশনটা কতো বদলে গেছে। স্কুলপালানো দিনগুলোর সেই স্টেশনটা আর নেই। স্টেশনে রেললাইনের ধারের চটি বই, ভিউকার্ডের দোকানগুলো আর নেই। পুরোনো স্টেশন দালান ভেঙে নতুন দালান উঠেছে। প্লাটফর্মে মোজাইক, টাইলসে বাঁধানো বসার জায়গা। অনেকক্ষণ পরে একটা লোকাল ট্রেন আসে সন্ধ্যা নিয়ে, পোড়াদহগামী। ময়নুল চড়ে বসে ট্রেনটাতে।

স্টেশন ছেড়ে, শহরের কোলাহল রেখে, গ্রামের ঘন অন্ধকার কেটে, একলা জগতি স্টেশনটাকে রেখে লালব্রিজের দিকে পৌঁছানোর আগেই ট্রেনের গতি কমে যায়। ময়নুল ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখতে পায়―রেললাইন লাগোয়া খুপড়ি ঘরের উঠোনে প্রায় নিভু নিভু হেরিকেনের আলোয় লোবানের ধোঁয়া, তার ভেতরে অধিকতর আবছা এক নারী, বৃদ্ধা, খাটিয়ার দিকে মাথা নামিয়ে বসে আছে, খাটিয়াতে কালো চাদরের সীমানা অতিক্রম করে কাফনে মোড়া জোড়া পা, লাশের, সাদা; বেরিয়ে আছে। ট্রেনটা ধীরে ধীরে থেমে যায়। ময়নুল টুক করে নেমে পড়ে লোবানের গন্ধের ভেতরে। সাথে সাথেই ট্রেনটা আবার দুরন্ত হয়, গতিতে ছুটে চলে। অনন্ত অসীম লোবানের গন্ধের অতলে ময়নুলকে নামিয়ে দেওয়ার জন্যেই ট্রেনটা যেন ক্ষণিক দাঁড়িয়েছিল!

ময়নুল ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় রেললাইন লাগোয়া খুপড়ি ঘরের উঠোনে। চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধা আর খাটিয়ার লাশের পাশে ক্রমশ। হেরিকেনের মৃদু আলোয় বৃদ্ধার মুখটা একদম তার দাদি গেদুজান্নেসার মতো, তা নিশ্চিত হলেও কালো চাদর সরিয়ে কাফনের বাঁধন খুলে দেখা মুখের ছবিটা তাকে ধন্দে ফেলে দেয়―মুখটা কি তার বাবার, নাকি তার নিজেরই। ধপ করে বৃদ্ধার হাতের কেরোসিনের মৃদু আলোটুকুও নিভে যায় হঠাৎ। কিন্তু তখন লোবানের ধোঁয়া আরও বিস্তৃত হয়, আরও প্রবল হয় গন্ধ।

প্রতিপদের জ্যোৎস্না আজ। তার পরাক্রমী আলো এসে লাগছে লোবানের ব্যাপ্ত ধোঁয়ার গায়ে। ধোঁয়ার কুণ্ডলীরা আলোতে দৃশ্যসম্ভব হলে ময়নুল দেখে―সেই ধোঁয়ার ভেতরে অনেক সাদা কাগজ ভাসছে। লাফিয়ে লাফিয়ে ভাসতে থাকা কাগজগুলো ধরে ময়নুল দেখে, এগুলো কতক প্রেসক্রিপশন, কোনওটাতে রোগীর নামের জায়গায় তার বাবা―সাদেকুল ইসলাম, কোনওটাতে মা―হাফিজা বেগম, কোনওটাতে তার নিজের নাম ও বয়স লেখা।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button