আর্কাইভগল্প

বড় গল্প : কুম্ভীরাশ্রু : মোজাম্মেল হক নিয়োগী

মাটিয়াকান্দার ইতিবৃত্ত

প্লাবন তো নয়, যেন মহাপ্লাবন।

                কয়েক দিনের লাগাতার মুষলধারে বৃষ্টি, উজানের বাঁধভাঙা পানির তোড় এবং পাহাড়ি ঢল―সব মিলিয়ে জলধারার রহস্যময় প্রকৃতির আনন্দ-মচ্ছবের জেরে সুরানন্দ জনপদের নদী-নালা-খাল-বিলের কয়েক বছরের ঘাটতি পুষিয়ে এবার সুদে-আসলের চেয়ে দ্বিগুণ জল দিল তো দিলই, জনপদকেও ডুবিয়ে দিল। জলের তলে সুরানন্দ জনপদ। হাহাকার করতে করতে মানুষগুলো ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পদ গরু-বাছুর-ছাগল-ভেড়া ফেলে কেবল জান নিয়ে কোনওক্রমে মাটিয়াকান্দার শরণ নেয়। এমন দানবীয় জলের দস্যুতা মেনে নেওয়া সুরানন্দের সর্বহারা নিঃস্ব মানুষদের জন্য ভয়ানক কষ্টকর ব্যাপার। বাঁধভাঙা জলধারা সুরানন্দের জনপদের মানুষের জন্য নিয়ে আসে বাঁধভাঙা দুর্দশা, দুঃখ-কষ্ট আর অন্তর্দহন। বানভাসি কাফেলার জনসংখ্যা একেবারে কম নয়―হাজার বারো হবে। সাত দিনের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত―সব বয়সের মানুষই এই কাফেলায় রয়েছে। এখানে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও তাদের চোখে অপার শূন্যতা, বুকে হাহাকার, নির্বাক ছলছল দৃষ্টি। তারা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সবাই অসাড় শরীর নিয়ে মাটিয়াকান্দির জঙ্গলে পড়ে আছে। কেউ কেউ অসুস্থও। প্রতিবন্ধীও আছে জনা দশেক।

                ‘মাটিয়াকান্দা’ কয়েক একরের একটি উঁচু ভূমি। হাসমত খান একটি কৃত্রিম পাহাড় বানানোর অভিপ্রায়ে তিন বছর আগে নিচু এলাকা থেকে মাটি কেটে এই জায়গা উঁচু করেছিলেন। উঁচু জায়গাটির একটি সুন্দর নামও দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই নাম চাপা পড়ে গেছে, হাসমত খান নিজেও ভুলে গেছেন সেই নামের কথা। যেহেতু মাটি কেটে জায়গাটিকে কান্দার মতো উঁচু করা হয়েছে, সেজন্য মানুষের মুখে মুখে ‘মাটিয়াকান্দা’ নামে পরিচিতি বিস্তৃত হলো। দু-তিন বছরে দেশীয় গাছগাছালি ঝোপঝাড়ের অবাধ বৃদ্ধির কারণে মাটিয়াকান্দা জঙ্গলে পরিণত হলো। তার পরিকল্পনা ছিল, এই কৃত্রিম পাহাড়ে দেশ-বিদেশের গাছগাছালি লাগিয়ে একটি বড় বাগান বানাবেন এবং নিজের অবসর যাপন এবং আনন্দ-ফুর্তির জন্য একটি গ্রামীণ ঘরবাড়ির স্থাপত্যনকশায় গ্রামীণ উপকরণ দিয়ে একটি বাংলো নির্মাণ করবেন। মানুষের কল্পনার বাইরে অর্থপ্রাপ্তি ঘটলে বিলাসিতার জন্য এ রকম পরিকল্পনা ও স্থাপত্য নির্মাণ নতুন কোনও বিষয় নয়―প্রাচীনকাল থেকে এ রকম ইতিহাসের অনেক প্রমাণ রয়েছে। স্বর্ণ চোরাকারবারি হাসমত খান আঙল ফুলে বটবৃক্ষ হওয়ার পর কৃত্রিম পাহাড় বানানোর যাবতীয় ব্যবস্থা পাকা করেছিলেন বটে, কিন্তু হঠাৎ দেশে আদম ব্যবসায় রমরমা ও লাভজনক হওয়ায় তিনি সেদিকে বিনিয়োগ ও মনোযোগ বাড়িয়ে দিলেন সাধ্য অনুসারে। তার কৃত্রিম পাহাড়, যেটির নাম দিয়ে ছিলেন ‘মেঘমালা’―তার কথা কি ভুলে গেলেন ?

                হাসমত খানের মধ্যে মাঝে মাঝে কাব্যিক ভাবও উদয় হতো। বাঙালি যুবকদের মতো হাসমত খানও যৌবনকালে দশটি কবিতা লেখার ক্ষমতার দাপটে প্রিয়তমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পেরেছিলেন, যদিও সেই কাব্যক্ষমতা বাসররাতেই ছিনতাই হয়ে গেল, কিন্তু কাব্যিক ভাবের ছাঁচটি অন্তরে রয়ে গেল―অযত্নে। তখন নামের আগে, বিশেষ করে বিয়ের আগে কবি হাসমত খান লিখতেন, তারপর আর কবিতার দিকে হাত বাড়াননি। টাকার জোয়ারে কবি শব্দটি কোথায় যে ভেসে গেল, তিনি নিজেও টের পেলেন না। তিনি মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, ‘টাকার নেশা আর শিল্পের নেশা এক পথে চলতে পারে না। লক্ষ্মী আর সরস্বতী এক গৃহে থাকে না।’

                হাসমত খানের কাব্যপ্রতিভা নিয়ে এত কথা কেন ? একটি কার্যকারণ সম্পর্ক তো অবশ্য আছেই। তা না হলে এত কথা বলার প্রয়োজন কী ? মেঘের যেমন নিজস্ব কোনও বাড়ি নেই, ঠিকানা নেই, ঠিক তেমনি মানুষেরও। জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী, তাই আসল ঠিকানা হলো ‘সমাধিক্ষেত্র’। তার স্বপ্নের কৃত্রিম পাহাড় ও অবসর যাপনের জন্য ‘মেঘমালা’ নামটি কিন্তু তার কাব্যপ্রতিভার বদৌলতেই দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই ‘মেঘমালা’ ‘মাটিয়াকান্দা’ শব্দের গভীরে চাপা পড়ে গেল; মাটিয়াকান্দার মাটি চাপা থেকে ভবিষ্যতে উত্থিত হয় কি না, তা কেবল হাসমত খানই জানেন। 

                এবার আচম্বিত বন্যায় ঢালের মানুষ এখানে উঠে আসায় তিনি প্রথমে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এবং তাদের লাঠি মেরে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরদার ইরাজকে বলেছিলেন। সরদার ইরাজ তখন গোঁফের নিচে ছোট সাইজের একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটি মহৎ ও সুবর্ণ সুযোগ কি হাতছাড়া করবেন ?’

                মুহূর্তে হাসমত খান উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। তার কপালে ভাঁজ, ভ্রƒকুঞ্চিত করে বললেন, ‘বুঝলাম না।’

                সরদার ইরাজের হাসির সাইজটা আয়তনে কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দিলেন। তখন তার চোখেমুখে দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বললেন, ‘এক ঢিলে কটি পাখি মারবেন, সেই চিন্তা করে দেখুন। হুটহাট ওদের তাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন কী ?’ তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘মানুষের কারবার।’

                হাসমত খানকে চালাক বললে ভুল হবে, তিনি মানুষটা প্রকৃতার্থে ধূর্ত। অগাধ সম্পদের মালিক হওয়ায় জনদরদি সেজে তিনি গত নির্বাচনে চেয়ারম্যানও হলেন। তাই তার চিন্তার রাডারে ইরাজের ইঙ্গিতময় কথা মুহূর্তে ধরা পড়ল।

উদ্ভূত পরিস্থিতি

দুপুরের পর সুরানন্দ গ্রামের হাজারখানেক মানুষ মাটিয়াকান্দায় এসে উঠল। আকাশ মেঘলা; ক্রোধান্বিত শিশু যেমন কখনও ফোঁসে, কখনও বিড়বিড় করে, আবার কখনও শান্ত থাকে, তেমনই বৃষ্টির ভাব। কখনও প্রবল বেগে কখনও টিপটিপ আবার কখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি―চলল চক্রাকারে। মেঘ-বৃষ্টি যে খেলাই খেলুক না কেন, সুরানন্দের মানুষেরা তখন আর এত চিন্তিত ছিল না এই জন্য যে, পানিতে ডুবে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা আর রইল না। তারা ভাবল, হয়তো বৃষ্টির কারণে ছিদ্দত বাড়তে পারে, কিন্তু ডুবে-চুবে মরতে হবে না।

                একটি গাছের নিচে একটি পরিবারের এক নারী, তার পাশে দুই কিশোরী জড়সড় হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল এবং তারা তিনজনই থেকে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কখনও কান্না বেগবান হলেও এর স্থায়িত্ব এক মিনিটও হতো না ক্লান্তির জন্য। অথবা মৃতের প্রতি আবেগের আকুলতা না থাকার কারণে। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ অশ্রুশূন্য। কান্নার জন্য শরীরের বল লাগে, যে বল ওদের শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। তাদের কান্না ছিল মূলত অন্যদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করার জন্য। কারণ, একানব্বই বছরের নারী বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেল গত পরশু। এই বৃদ্ধা ছিল ওই পরিবারের জঞ্জাল। পরিবারের সবাইকে ওই বৃদ্ধা অতিষ্ঠ করে তুলত বলে নিত্যদিনই তার মৃত্যু কামনা করত পরিবারের সবাই। বৃদ্ধার বিধবা মেয়ে ও দুই কিশোরী কন্যা নিয়ে কায়ক্লেশে জীবনযাপন করে করত। গত পরশু যখন তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলো, তখন খুশি হওয়ারই কথা ছিল। হয়তো মনে মনে হয়েছিলও। কিন্তু এরপরও অন্তত লোকলজ্জার কারণে মাঝে মাঝে কেঁদেছিল, যখন বাড়িতে কেউ আসত। ওদের কান্না বস্তুত লোকদেখানো; স্বজন হারানো বিষাদের নয়।

                অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের পুব পাশে আরও দুটি পরিবারের সদস্যরা বিলাপ করছিল। ওই দুই পরিবারের দুটি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেল গতকাল। বন্যার পানিতে খেলতে গিয়েই শিশু দুটির সলিলসমাধি হলো। তাদের মায়েরা আধমরার মতো নেতিয়ে পড়ে রইল ঘাসের ওপর। তাদের গলাও শুকিয়ে কাঠ। হয়তো সন্তানের শোক ও স্মৃতি হানা দিলে তারাও হঠাৎ বিলাপ শুরু করত, কিছুক্ষণ পর আবার আপনিতেই থেমে যেত।

                কারও শোকে কিংবা দুঃখে সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ বলতে গেলে ছিল না ওই কাফেলায়। সবার মধ্যে মৃত্যুর আতঙ্ক আর হাহাকার। সবাই যখন দুর্গতি-দুর্দশার শিকার, তখন কে কাকে সান্ত্বনা দেবে ?

                বিভিন্ন গাছের তলায় একেকটি পরিবার থাকার জন্য এটা-সেটা দিয়ে পলিথিন মুড়িয়ে নৌকার ছইয়ের মতো ছাপরা বানানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেক মানুষের হাঁটাহাঁটিতে জায়গাটি কিছুক্ষণের মধ্যে কর্দমাক্ত হয়ে পড়ল। তিন মাস আগেও সাম্প্রদায়িক ঘটনায় কয়েকটি পরিবার মারামারি করেছিল; এখন সবাই এক কাতারে। মানুষের জীবন বড় বিচিত্র! ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে চারটি ধর্মের লোকই কমবেশি ছিল।

মানবতার হাত

আদিল হাশিম আর নিতাইয়ের উদ্যোগে আরও কয়েকজন তরুণকে নিয়ে একটি অলিখিত স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে ফেলল। তরুণদের মধ্যে বেশি উৎসাহী পাওয়া গেল জামশেদ অনিল বাবুলকে। ওদের নিজেদের কাছে যে টাকা ছিল, সে টাকা নিয়ে প্রায় দুই মাইল দূরের বাজার থেকে মুড়ি আর গুড় কিনে এনে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করল।

                মোল্লা পুরোহিত পাদ্রি ভিক্ষু চারজন ধর্মগুরু পাশাপাশি বসে ছিলেন। চারটি ধর্মের লোক থাকলেও মুসলমান ও হিন্দুর সংখ্যা বেশি। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ দুটি করে পরিবার।

                পুরোহিত বৃদ্ধ, বৃষ্টির কারণে ঠান্ডায় শ্বাসকষ্টও বেড়ে গেল। অত্যন্ত কাতর দেখাচ্ছে তাকে। তার কণ্ঠ থেকে ফ্যাসফ্যাসিয়ে কথা বের হচ্ছিল। পুরোহিতের কাছে এসে নিতাইকে হাশিম বলল, ‘তুই পুরুত মশাইকে মুড়ি দে। আমাদের হাতের জিনিস খাবেন না।’

                নিতাই বলল, ‘আমিও তো নিচু জাতের মানুষ। ঠাকুর খাবে কি না সন্দেহ আছে। মরবে তবু জাত দিবে না।’

                আদিল বলল, ‘দিয়ে দেখ। না খেয়ে মারা পড়বে যে। বেচারা খুব কাতর হয়ে গেছে, আহা!’

                পুরোহিতের সামনে গিয়ে নিতাই জিজ্ঞেস করল, ‘পুরুত মশাই, চারটে মুড়ি কি দেব ? একটু চিবিয়ে জল পান করুন।’

                পুরোহিত অর্ধমুদিত চোখের পাতা উন্মোচন করে বললেন, ‘আমি যে স্বপাকের খাদ্য ভক্ষণ করি। কিন্তু এখন তো নিশ্বাস নিঃশেষ হওয়ার উপক্রম হইয়াছে। মুষ্টি দুয়েক প্রদান করো নিতাই, ভক্ষণ করে মাটির খাঁচায় প্রাণপাখিটা আটকাইয়া রাখি। নইলে সে যে কোনও সময় উড়াল দিতে পারে। আগে তো জীবন বাঁচানো, তার পরে না ধর্ম।’

                ‘আপনার কি কোনও পাত্র আছে পুরুত মশায় ?’

                ‘না, কোনও পাত্র নাই। সমস্তই মহাপ্লাবনের জলে ভাসিয়া গেল। আমার ধুতির কোঁচরে প্রদান কর।’

 নিতাই ধুতির কোনায় কয়েক মুঠ মুড়ি ও দুটি পাটালি গুড় দিলে পুরুত মশাই বললেন, ‘বুঝলে নিতাই, পাপাচার। চরম পাপাচারে দেশ ডুবিয়া গেছে বলে এমন বন্যা হয়েছে। না হয় আমার জনমে কখনও এই রূপ বন্যা দেখি নাই।’

                তিনি খেতে শুরু করলেন।

                মওলানা সাহেব আদিল মুড়ি দিলে কথা না বলেই একটি গামছায় নিয়ে খেতে শুরু করলেন। তিনিও বিড়বিড় করে বললেন, ‘আল্লাহ পাক তখনই গজব দেয়, যখন মানুষ অত্যধিক পাপে লিপ্ত হয়। দেশের মানুষ পাপে লিপ্ত।’

কয়েকটি চারাগাছ আর ঝোপের আড়ালে একটি পরিবার বসে ছিল ঝিম ধরে। মেয়ে ও মায়ের মুখ নেকাবে ঢাকা। তাদের দীপ্তিময় গভীর কালো চোখ এবং কাঠগোলাপের মতো স্নিগ্ধ কপাল চোখে পড়ল আদিলের। আদিল মেয়েটির দিকে এক পলক তাকিয়ে মুড়ি দিল। ওখানে অন্য পরিবারের দিকে পা বাড়ানোর সময় সে দেখল, মেয়েটি আদিলের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর বুকের ভেতরটা যেন নড়ে গেল। মনে মনে বলল, ‘নার্গিস তাহলে অনেক বড় হয়ে গেছে। সেই পাঁচ-ছয় বছর আগে একবার দেখা হয়েছিল। তখন কি সে হাইস্কুলে পড়ত―নিজেকে প্রশ্ন করে। কিন্তু এখন নার্গিসের কথা ভাবার সময় নেই, পরে ভাবা যাবে।’

                সে মুড়ির পাত্র নিয়ে সামনের দিকে ছুটল।

                ক্লান্ত অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলো কিঞ্চিৎ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ যখন পেল, তখনই দ্রুতগতিতে আকাশের রূপ বদলাতে লাগল―ছাই রঙের আকাশটি চোখের পলকে কালো পাতিলের তলা। মহিষের মতো কালো জলরাশির দোর্দণ্ডপ্রতাপে আর বজ্রনিনাদে আকাশ যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। প্রকৃতি এত ক্রুদ্ধ কেন ? ‘পাপাচার! পাপাচার!’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে অত্যধিক রুষ্ট মোল্লা পুরোহিত পাদ্রি ও ভিক্ষু―‘ভয়ংকর পাপে জড়িয়ে গেছে সুরানন্দের মানুষেরা। তাদের প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চয়ই করতে হবে।’

                গুড়-মুড়ি বিতরণের পর আদিল তরুণদের নিয়ে একটি গাছের নিচে বসে গুড়-মুড়ি খেল। আদিল বলল, ‘সবাই ভাবো, এরপর কী করা যায়। আমাদের কাছে যা ছিল খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষগুলোকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল এবং বলল, ‘আকাশের অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’

                তরুণদের দলে হাশিম বয়সে সবার বড় হলেও, নেতৃত্বের গুণাবলি ও লেখাপড়া জানায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদিলের কাছে নেতৃত্ব চলে গেল। সে বলবান যুবক এবং কথাবার্তায়ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ।

                হাশিম বলল, ‘রাতটা পার হোক। পরে দেখা যাবে। এখন তো সবার পেটে কিছু পড়ছে, রাত পোহালে একটা কিছু করা যাবে।’

                ওই সময় মাটিয়াকান্দার আকাশে ঘন ঘন বজ্রপাত শুরু হলো। হঠাৎ একটি বজ্রপাতে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের পাঁচজনের প্রাণ ঝরে পড়ল।

                শুরু হলো আর্তনাদ। হাহাকার। করুণ বিলাপে বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

                যাচাই-বাছাই করে তাদের ধর্মানুযায়ী সৎকার ও দাফন করা হলো। একসঙ্গে থেকে একই বজ্রপাতে একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে একজন গেল চিতায় বাকিরা কবরে।

                আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় সন্ধ্যা হয়েছে কি হয়নি, তা বোঝা গেল না। ঘড়ি দেখে সন্ধ্যা হয়েছে নির্ণয় করে মওলানা হাবিবুর রহমান মাগরিবের আজান দিলেন। আশপাশ থেকে দু-একজনকে ডেকে নামাজ আদায় করলেন।

                তার প্রার্থনা দেখে পুরোহিত পাদ্রি ভিক্ষুও প্রার্থনার আয়োজন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের প্রার্থনার আয়োজন করা সম্ভব ছিল না বলে চুপচাপ রইলেন। এই দুঃসময়ে প্রার্থনা করেও যদি রক্ষা হয়, তাতে মন্দ তো নয়। 

                জলবেষ্টিত সুরানন্দের মানুষেরা মাটিয়াকান্দায় এসে হাজির হলে খবরটি বাতাসে ছড়ালে এলাকার অনেকেই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ল। তারা অনাহারক্লিষ্ট, রোগে-শোকে মৃত্যুপথযাত্রী―এই খবরও একই সঙ্গে চাউর হলো। মানুষ তো আর অনাহারে রোগে-শোকে মরতে পারে না। তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এলেন মাটিয়াকান্দার চেয়ারম্যান হাসমত খান। হাসমত খান কি আর একা এসেছেন, সঙ্গে এসেছেন সঙ্গীসাথী, ছোট নেতা ও পাতিনেতা অনেকে। হাসমত খানের হুকুমে রাতের মধ্যেই তাঁবু, ত্রিপল আর বাঁশ দিয়ে কোনওক্রমে অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করা হলো। খাবারের ব্যবস্থাও হলো। দুর্গত মানুষদের মনে সাহস দিয়ে তিনি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা করলেন এবং বললেন, ‘তারা যেন কোনও দুশ্চিন্তা না করে। যত দিন বন্যার পানি না শুকায়, তত দিন আপনারা নিশ্চিন্তে থাকবেন।’ অসহায়, ভেঙে পড়া ভগ্নস্বাস্থ্যের কয়েকজনকে জড়িয়ে ধরে তিনি শুকনো চোখে কাঁদলেনও। তখন বন্যাপীড়িত মানুষগুলোর মনও হু হু করে উঠল। তাদের মনে আশার সঞ্চার হলো যে এমন একজন জনদরদি মহান মানুষের আগমন যেহেতু ঘটেছে, সেহেতু তাদের নিরাপত্তা আর জীবনের জন্য কোনও চিন্তা থাকল না।

পর্দার আড়ালে

গ্রিনল্যান্ড শহরে থ্রি স্টার মর্যাদার দুটি হোটেল হয়েছে কয়েক বছর আগে। ধনাঢ্য হাসমত খানের জন্য হোটেল ‘রেড আইল্যান্ড’ থ্রি স্টার হোটেলে বিশেষ ছাড় দিয়ে একটি স্যুট সারা বছর রিজার্ভ থাকত। তিনি যখন খুশি সেখানে থাকেন। কোনও বোর্ডার এই স্যুটে থাকার সুযোগ পেতেন না, এমনকি দেশের ভিআইপি হলেও না। খানাপিনাসহ আমোদফুর্তিও করতেন এই স্যুটে।

                মাটিয়াকান্দা থেকে ফেরার পর হাসমত খানের মগজে রহস্যজনক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘপুঞ্জের মেজাজ বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। মেঘপুঞ্জ অশান্ত হলে ভালো হতো। সরদার ইরাজকে নিজের স্যুটে ডেকে পাঠালেন। তার ব্যক্তিগত একান্ত বিশ্বস্ত সহচর ও সহচরীরা কেবল এই স্যুটে প্রবেশাধিকার পেত। মানুষের কাছে এরা ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত ছিল। সরদার ইরাজ ছোটখাটো মানুষ হলেও মাথায় রয়েছে অসাধারণ সব জটিল বুদ্ধি। হাসমত খানের কাছে তার সুকীর্তির সময় কর্মচারীর মর্যাদা পান এবং কুকীর্তি ও আমোদফুর্তির সময় বন্ধুর। একান্ত বিশ্বস্ত বলে তার জীবনের সকল ঘটনার সাক্ষী একমাত্র সরদার ইরাজই।

                রুমে ভ্যাট সিক্সটি নাইনের ব্যবস্থা করা হলো। আনুষঙ্গিক যা প্রয়োজন, তা-ও আনানো হলো। সিগারেট জ¦ালিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে গেলাসে চুমুক দিয়ে টেবিলের ওপর পা ছড়িয়ে ট্যারা চোখে সরদার ইরাজের দিকে তাকালেন হাসমত খান। টেবিলের অপর পাশে চিন্তাচ্ছন্ন সরদার ইরাজের হাতেও জ¦লন্ত সিগারেট। হাসমত খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরিস্থিতি ক্যামন মনে হচ্ছে ?’

                ‘উদ্বেগহীন। সুখকর।’

                ‘সব কি ঠিকঠাক আছে ?’

                ‘একদম’, বলেই গেলাসে চুমুক দিল সরদার ইরাজ। হাসমত খানের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদু হাসলেন।

                ‘সুরানন্দের সার্বিক পরিস্থিতির খবর নে।’

                ‘নেওয়া সারা। আপনার গোমস্তা সরদার ইরাজকে এখনও চিনে সারতে পারেন নাই, দুঃখ তো এখানেই।’

                হাসমত খান অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন এবং হাসি থামলে বললেন, ‘গোমস্তা বলছিস কেন রে ইরাজ, বল দোস্ত। বৃষ্টিটা আর কয়েক দিন থাকলে বেশি ভালো হতো। কী বলিস ?’

                ‘সুরানন্দে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তার পানি নামতে কমপক্ষে ছয় মাস। যা করার ছয় মাসের মধ্যে করে ফেলতে পারেন।’

                ‘দেখা যাবে। দারোয়ানকে বলে হোটেল থেকে খাবারের আয়োজন কর। রাত এখানেই থেকে একটা ছক আঁকতে হবে।’

                পরদিন দেশের পত্রপত্রিকায় হাসমত খানের ছবিসহ ফলাও করে খবর ছাপা হলো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং দু-একটি পত্রিকার ভাষা এমন, যাতে মনে হলো হাসমত খান একজন মহামানব। তিনি এই এলাকায় না থাকলে এক হাজার মানুষের সলিলসমাধি হতো।

                খবরটি প্রচারিত হওয়ার পরই বিদেশ থেকে মানবতাবাদী অনেক মানুষ দুর্গম মানুষদের সহায়তা করার জন্য আসতে লাগলেন। তারা এসে হাসমত খানের সঙ্গে দেখা করে মাটিয়াকান্দায় আশ্রিত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের জন্য সাহায্য করতে চাইলেন। হাসমত খান উদার চিত্তে তাদের সমস্ত দান-অনুদান গ্রহণ করলেন।

ঈশ্বরের দূতের আগমন

‘রেড আইল্যান্ড’ হোটেলের লবিতে হোয়াইট এলানের মুখোমুখি বসলেন হাসমত খান। হাসমত খান ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলতে পারতেন আর হোয়াইট এলান ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে পারতেন। তাদের দুজনের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি ও বাংলার মিশেল কথোপকথনে একটি অদ্ভুত ধরনের ভাষার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হলো। সরদার ইরাজ কিছুটা গুছিয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করলেন। কারণ, ওখানকার সকল তথ্য-উপাত্ত তার নখদর্পণে। হোয়াইট এলান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানলেন এবং প্রয়োজনীয় নোট নিলেন। তারপর কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিরুত্তাপ চোখে হাসমত খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফান্ড ইজ নো প্রোবলেম। আপনেরা কী করতে চান আমাকে বলবেন।’

                তিনি বানভাসিদের স্বচক্ষে দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে তাকে নিয়ে হাসমত খান নিজেই গেলেন। সঙ্গে সরদার ইরাজকেও নিলেন। এই কয়েক দিনে তাঁবুগুলো সরিয়ে ত্রিপল ও বাঁশ দিয়ে অপেক্ষাকৃত মজবুত থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন হাসমত খান। অবশ্যই এ জন্য সরকারি অনুদানসহ অনেকের অনুদান পেয়ে গেলেন। সরদার ইরাজের ভাষার দক্ষতা হাসমত খানের চেয়ে তুলনামূলক ভালো হওয়াতে হোয়াইট এলানের সঙ্গে তার কথাবার্তা বেশি হলো। তিনি আবারও বললেন, ‘ফান্ড ইজ নো প্রবলেম।’

                বানভাসিদের মধ্যে কয়েকজনকে ডেকে কথা বললেন হোয়াইট এলান। দোভাষী সরদার ইরাজ।

                সমস্ত কিছু দেখার পর তিনি বললেন, ‘আপনারা এখানে থাকবেন। আপনাদের থাকা-খাওয়া ও শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। যত দিন সুরানন্দের পানি না সরে, তত দিন এখানে থাকবেন।’

                হোয়াইট এলান টিনের ঘর ও শিশুদের অস্থায়ী স্কুল করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। প্রত্যেক পরিবারের জন্য রিলিফ কী পরিমাণ দেওয়া হবে, তার একটি ছক তৈরি করলেন মনে মনে। অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে মানুষদের সঙ্গে কথা বলে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

                ‘কী ভাবছেন হোয়াইট ?’ হাসিমুখে হাসমত খান জিজ্ঞেস করলেন।

                ‘ভাবছি এরা কত অসহায়! মনে হচ্ছে এই অসহায় মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তন করা দরকার।’

                ‘কী করা যায় ?’

                ‘ভাবছি। দেখা যাক কী করা যায়। অপেক্ষা করুন।’

                এই সময় সামনে দিয়ে দুটি জীর্ণশীর্ণ পাঁচ ছয়-বছরের শিশু ওদের সামনে এসে দাঁড়ালে ওদের জড়িয়ে ধরলে সঙ্গে সঙ্গে সরদার ইরাজ ছবি তুললেন। হোয়াইট এলানকে দেখে হাসমত খান একটু আগ বাড়িয়ে এলেন। তিনি ওদের দুই কোলে নিয়ে ছবি তুললেন। এরপর হোয়াইট এলান নিজের ক্যামেরায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত ও রুগ্ণ মানুষদের অনেকগুলো ছবি ফ্রেমবন্দি করলেন।

                দু-তিন ধরে কোনও বৃষ্টি নেই। তবে সূর্য তার পূর্ণ মাত্রায় কিরণ পৌঁছাতে পারছে না, কোথায় যেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আকাশে হঠাৎ হঠাৎ দলছুট ভ্রষ্ট মেঘ দেখা হলেও দল বাঁধার সুযোগ পাচ্ছিল না। হয়তো মেঘখণ্ডগুলো সঙ্গী খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

                দুপুরের দিকে হাসমত খান হোয়াইট এলান ও সরদার ইরাজকে নিয়ে শহরে ফিরে ‘রেড আইল্যান্ডে’ হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করলেন। খাওয়ার সময়ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সুযোগ হলো। অনেক অফিসে তো টি-মিটিংয়ের নামে চা বিরতিতে মিটিং করে। কোনও অফিসে আবার চা খেতে খেতে স্ট্যান্ডিং মিটিং করে। হোয়াইট এলান খাওয়ার সময়টা বেছে নিলেন মিটিংয়ের জন্য।

                হোয়াইট এলান বললেন, ‘এখানে থাকার চেয়ে বিভাগীয় শহরে থাকলে ভালো হবে।’

                হাসমত খান বললেন, ‘অবশ্যই। সেখানে ফাইভ স্টার হোটেল আছে। নিরাপত্তার খাতিরে সেখানেই আপনার থাকা উচিত।’

                ‘হ্যাঁ। নিরাপত্তা…’ তিনি কথাটি শেষ করলেন না। তারপর তিনি নিজের পাশ থেকে একটি হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটি প্রিন্টেড কাগজ বের করে হাসমত খানের হাতে দিয়ে বললেন, ‘একটি পরিবার কী পরিমাণ রিলিফ পাবে, তার একটি চার্ট আমি আগেই করে রেখেছিলাম। এই দুর্গত মানুষগুলোকে নিজ এলাকায় এখনই যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। তাদের বাড়িঘর ঠিক করতে বছরখানেক লাগবে। আর ওয়াটার লগিং হলে তো বছর দুয়েকের আগে সুরানন্দে যাওয়া সম্ভব নয়। আপনারা দুই বছরের একটি পরিকল্পনা ও বাজেট করে আমাকে দেবেন। আমি সে অনুযায়ী ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেব।’

                ‘কিন্তু এত দিন কি ধরে রাখা যাবে ? ওরা তো এখনই চলে যেতে চাইছে।’ হাসমত খান শুধালেন।

                ‘ওদের বোঝাতে হবে। আসলে তোমাদের দেশের গরিব মানুষেরা নিজেদের সমস্যা কী, তা-ই বোঝে না। তাদের সমস্যা সম্পর্কে তোমাদের ধারণা দিতে হবে। আর এখানে তো ওরা সবই পাচ্ছে। খাবার পাচ্ছে। শিক্ষা পাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। ওরা নিজ এলাকায় গেলে কি এসব পাবে ? কেন যাবে ?

                ‘মনে হচ্ছে, সবই ঠিক ছিল কিন্তু আদিল নামের যুবকটি এখানে থাকতে চাচ্ছে না।’ শুধালেন সরদার ইরাজ।

                হোয়াইট এলান বলনে, ‘ওকে একটা চাকরি দিয়ে দেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

                ‘কিন্তু ওর সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে।’ বললেন সরদার ইরাজ।

                হোয়াইট এলান বললেন, ‘তাহলে বাছাই করে তিন-চারজনকে চাকরি দিয়ে দেন। ওদের ভবিষ্যতের জন্য একটি অনুন্নত জায়গায় গিয়ে কী করবে ? এখানে থাকার ব্যবস্থা করেন।’

                হাসমত খানের মনে হলো, বুদ্ধিটা খারাপ দেয়নি। যেখানে ওদের পনেরো দিন থাকতে দিলেই চলত সেখানে দু বছর! পনেরো দিনের জন্যই হাতে কম টাকা আসেনি। সিকি ভাগও তো খরচ হয়নি। দুই বছরের পরিকল্পনা ও বাজেটের কথা শুনে তার মনে আনন্দে ঢেউ খেলতে শুরু করল।

                হোয়াইট এলান ভাবলেন, মানুষগুলোকে দুই বছরের আগে এখান থেকে সরতে দেওয়া ঠিক হবে না। এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে থাকা মানে আমার স্বচ্ছন্দের দিন যাপন। ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা-খাওয়া। এই মানুষগুলো আমার লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে কি আর পায়ে ঠেলে দেওয়া যায়!

                সরদার ইরাজ ভাবলেন, হাসমত খানের সুদিন মানেই আমার সুদিন। সুরানন্দের মানুষগুলোকে দুই বছর কি পাঁচ বছর আটকে রাখার পথ বের করতে হবে। হোয়াইট এলান যখন দুই বছরের কথা স্বেচ্ছায় বললেন, তখন আমরা অনুরোধ করলে হয়তো পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়াতে পারব। আর আদিল, হাসিম, নিতাইকে বাঘবন্দির ছকে আটকে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওরা যদি চাকরি পেয়েও ঘাড় ত্যাড়ামি করে, তাহলে বিদেশে পাঠিয়ে দেব। নাকি সেখানেও যাবে না ? বিদেশের নাম শুনলে এই দেশে কার মাথা ঠিক থাকে ? এমন দেশপ্রেমিক কয়জন আছে দেশে ? তা-ও যদি ঘাড় ত্যাড়ামি করে, তাহলে মাটির নিচে পাঠিয়ে দেব।

                হাসমত খানের মাথা ঝিমঝিম করছে। হাসমত খান ভাবলেন, আদম ব্যবসা করে তার এখন টাকা রাখার জায়গা নেই। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখতে হবে। এগুলোও তো আদম। এই আদমগুলো দিয়ে ভিন্নধারার ব্যবসায়। মূল ব্যবসা তো একই। আদমের বাণিজ্য। শুধু বুদ্ধিটাই একটু খাটানো। বুদ্ধিমানরাই তো এগিয়ে থাকে। বুদ্ধিটা ঠিকমতো খাটাতে পারলে টাকা দেয় গৌরী সেন। তিন বছর আগে হজে লোক পাঠিয়ে পাঁচ কোটি টাকা কামাইলাম। শুধু বুদ্ধিটা খাটাতে হবে। হাজিদের ধোঁকা দেওয়ার কত রকমের ফাঁকফোকর আছে, যা বুঝতেই পারে না। পৃথিবীটা তো চলছেই মানুষের ওপর বাণিজ্য দিয়ে। পণ্য একটা নিমিত্তমাত্র। যুদ্ধ লাগাও, মানুষ মারো―অস্ত্র বিক্রি করো। এ-ও কি মানুষের জান নিয়ে ব্যবসায় নয় ? রক্তমাংসের মানুষই তো অর্থোপার্জনের মোক্ষম অস্ত্র। 

                হোয়াইট এলান বললেন, ‘আমি তাহলে এখন বিভাগীয় শহরে চলে যাচ্ছি। ওখানে ‘হোটেল খলিফা’-তে থাকব। রুম বুকিং দেওয়া আছে।’

                হাসমত বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। আপনি এখানে কী করে থাকবেন ? এখানে কি কোনও মানুষ থাকতে পারে ? এই শহর হলো গরুছাগলের শহর। দুটি থ্রি স্টার হোটেল আছে, তা-ও সুবিধার নয়। আপনার দেশের ওয়ান স্টারের সমতুল্যই নয়।’

                প্রাডো জিপে চড়ে হোয়াইট এলান চলে গেলেন।

                হাসমত ও সরদার ইরাজ কফি খেলেন। হাসমত ইরাজকে বললেন, ‘তোর কি মনে হয়, সত্যি সত্যি দুই বছরের বাজেট পাওয়া যাবে ?’

                ‘কেন পাওয়া যাবে না ?’

                ‘ওর কি ঠেকা পড়ছে আমাদের এসব আবালের জন্য টাকা দেওয়ার ?’

                ‘ঠেকা কি আমাদের আবালদের ? ঠেকা তো ওর নিজেরই।’

                ‘বুঝলাম না ?’

                ‘বুঝলেন না, না ?’

                ‘হ্যাঁ।’

                ‘এই দেশে এসে ফাইভ স্টার হোটেলে থাকে কার টাকায় ? হোটেল খলিফার স্যুটের এক রাতের ভাড়া কত ? ডিনার খরচ কত ? এখন বোঝেন কার ঠেকা ?’

                ‘হুম।’

                ‘আমি ভাবছি, দুই বছরের বাজেট পেলে পরে পাঁচ বছরের বাজেট দেব। তখন আপনারও একটা সুবিধা হবে।’

                ‘কী সুবিধা ?’

                ‘সুইস ব্যাংকে টাকা রাখতে পারবেন। বুঝলেন হাসমত ভাই, শেকসপিয়ার বলেছিলেন, বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খায়। আসলে বিষয়টা হলো বুদ্ধিমান মানুষেরাই নির্বোধদের পুঁজি করে তাদের জীবনকে ভোগ করে। এই জগতে মানুষই মানুষের আসল পুঁজি। ভৌত সম্পদ প্রকৃতার্থে সম্পদ নয়, প্রকৃত সম্পদ হলো মানুষ। প্রকৃত পুঁজি হলো মানুষ। যদি সম্পদকে ম্যাটেরিয়েলাইজ না করা যায়, তাহলে সম্পদের কোনও মূল্য কি আছে ? নাই। আর ম্যাটেরিয়েলাইজ কে বা কারা করে ? মানুষই করে। খনির আকর থেকে কে বা কারা ধনরত্ন খুঁজে বের করে ? মানুষ। কে তোলায় ? ক্ষমতাশালীরা। বুদ্ধিমানরা। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল ? আসল পুঁজি কি মানুষ, নাকি খনি ? মানুষ যতক্ষণ খনির আকর থেকে সম্পদকে তুলে আনতে না পারবে, ততক্ষণ তা ইটপাথর ছাড়া কিছু নয়। লোহাকে যখন মেশিনগান কামান বানাবেন, তখন ওটার মূল্য হলো। না হয় লোহা দিয়ে কী করবে ? আপনার কৃষিজমি যদি শ্রমিকেরা চাষ না করে ফসল না ফলায়, তাহলে জমির কী মূল্য আছে ? জমি কেবলই পতিত মাটি। যখনই জমিনে ফসল ফলছে, তখনই জমির মূল্য হলো। শহরের বাড়ি করলেন, এই বাড়ি কে বানাল ? শ্রমিকেরা। অর্থাৎ মানুষেরা। তাহলে আসল পুঁজি জমি, নাকি মানুষ ? ভোগ করে কে ? বুদ্ধিমানরা। ক্ষমতাশালীরা। বোঝাতে পারলাম ?’

                ‘হুম।’

                সিগারেটে দম দিয়ে সরদার ইরাজ আস্তে আস্তে বললেন, ‘আপনি হলেন আদম ব্যাপারি। তার মানে মানুষের কারবারি। মানুষ বিদেশে পাঠিয়ে কোটি কোটি টাকা কামালেন। হাজিদের কাছ থেকে পাঁচ কোটি কামালেন। আর এই আদমদের শ্রম-ঘাম দিয়ে তৈরি হবে ভোগবিলাসের যাবতীয় সরঞ্জাম। এগুলো কে ভোগ করবে ? বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাচ্ছে। তারা স্বাস্থ্যবান হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষের মধ্যেও যারা বুদ্ধিতে বড়, চিন্তায় বড়, মেধায় বড়, তারাই মূলত পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করে, পুঁজির মালিক হয়। তারাই পৃথিবীকে উলটপালট করে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে বা করছে।’

                হাসমত খান রহস্যজনক ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলেন। তিনি মনে মনে বললেন, ‘সরদার ইরাজের কথাই সত্য। আমি কীভাবে আদম ব্যাপারি হলাম ? একটা ভিসা ওদের কাছে পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। অথচ আমার খরচ বলতে তেমন কিছুই না। কেবল বুদ্ধি খাটিয়েছি। আর ওরা বিদেশে গিয়ে শ্রমিকগিরি করছে। ওরা শরীরের রক্ত পানি করে সামান্য টাকা রোজগার করছে আর আমি বসে বসে স্বপ্ন দেখছি সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার। সরদার ইরাজ সত্যি একটা চিজ বটে। কিন্তু ওর বুদ্ধি তো অনেক, তাহলে আমার চামচামি করে চলে কেন ? সে কেন আমার মতো হতে পারে না ? হয়তো দার্শনিক টাইপের মানুষগুলোর সম্পদের প্রতি লোভ নাই। নাকি ভোগের লোভ নাই সে জন্য। তাহলে সরদার ইরাজ কি আসলে দার্শনিক টাইপের মানুষ, নাকি মস্ত শয়তান ?’

                হাসমত খান মনের চিন্তার এই দ্বন্দ্বের সরল সমীকরণ করতে পারলেন না। ধন্দের মধ্যে পড়ে গেলেন। তার চিন্তাশক্তি হঠাৎ কেমন যেন স্থবির মনে হলো। তিনি কিছু ভাবতে পারলেন না। ক্লান্তি নয়, তবু চিন্তার অবসন্নতায় তার শরীর ক্রমশ অবশ হয়ে আসছিল। ঘুম ঘুম লাগছিল। তিনি বললেন, ‘ইরাজ বিশ্রাম দরকার। যা করার তুই কর। তুই শুধু আমাকে জানিয়ে রাখিস। এই জটিল চিন্তায় আমার মাথা ভোঁতা হয়ে গেছে।’

                সরদার ইরাজ আরেকটা সিগারেট জ¦ালিয়ে ওপরের দিকে ধোঁয়া ছেড়ে হাসমত খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুব অবাক লাগছে, তাই না ? আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনার টাকা আছে বলে কৃত্রিম পাহাড় বানালেন, যদিও আপনি তা সম্পূর্ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী করতে পারেননি। হয়তো হবে। যদি এই কৃত্রিম পাহাড়টি না বানাতেন, তাহলে কিন্তু সুরানন্দতে এমন বন্যা হতো না। আপনি নিচু এলাকা থেকে এমনভাবে মাটি কেটে পাহাড় বানালেন যে কয়েকটি গ্রামের মানুষের কথা ভাবলেন না। যদিও আপনি জানতেন যে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা হতে পারে। সেটা ছিল আপনার ভাবনা কেবল। কিন্তু এখন বাস্তবে ফল পেলেন। আপনার ক্ষমতা ও সম্পদের কাছে ওরা নতজানু হয়ে থাকে বলে আপনার শখের কাজে ওরা বাধার সৃষ্টি করেনি। কিন্তু তখনও ওই জনপদে কানাঘুষা হয়েছিল যে আপনি তাদের ক্ষতি করছেন। ভূমির উপরিতল নষ্ট করছেন। এখন এক ঢিলে কটি পাখি মারা যায়, তা ভাবতে থাকেন। এক ঢিলে এখন অনেক পাখি মরবে।’

                ‘তুই ঢিলগুলো ঠিকমতো মারিস। যতটুকু সহযোগিতা লাগে পাবি। এই মুহূর্তে আমার মাথা কাজ করছে না।’ কথা শেষ করে তিনিও একটা সিগারেট জ¦ালালেন। উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন, সুইস ব্যাংকে কত টাকা রাখা যাবে।

                অমাবস্যার গাঢ় ও রহস্যময় অন্ধকার আকাশ যেন কালো চাদরে ঢাকা। অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র শিউলি ফুলের মতো ফুটে আছে নিঃসীম আকাশে। ভীষণ শান্ত ও ঠান্ডা। কোথাও কোনও শব্দ নেই। চারপাশ বড্ড নিঝুম। দূরে শহরের আলোর পেছনে কালো পাহাড়ের ছায়ার দিকে চোখ রাখলেন হাসমত খান। ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নিসর্গের অপরূপ রূপের দিকে। এক প্রকার জটিল চিন্তায় তিনি আচ্ছন্ন হলেন। তার মনোজগতে পারত্রিক জীবনের নানা বিষয় পানকৌড়ির মতো ডুবে আর ভাসে। কেন অনন্ত শূন্যতায় বুদ্বুদের ভাসমান তারার মতো নিজেকে ভাসমান মনে হচ্ছে, তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, জীবন কি এমন বুদ্বুদের মতো ? এমনই অনন্ত শূন্যতায় ভাসমান ? এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তার কতক্ষণ কেটে ছিল বলতে পারবেন না। চিন্তারও ক্লান্তি আছে। আচ্ছন্নতারও ক্লান্তি আছে। আসলে পৃথিবীর সমস্ত গতিশীল বিষয়েরই ক্লান্তি আছে, আছে অবসাদ। তিনি রুমের ভেতরে প্রবেশ করে সমস্ত রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। একজন মানুষের জন্য এত বড় রুম! হালকা ক্রিম কালারের জানালার পর্দাগুলোও যেন শরতের স্নিগ্ধতা ঢেলে দিল। কিং খাটের পাশে ছোট্ট টেবিল। ফ্রিজে মদের বোতল সাজানো। রুমের বাইরে ড্রয়িংরুমে দুবাই থেকে আমদানি করা সোফা সেট। তিনি এক বোতল মদ, গেলাস আর বরফের কিউব নিয়ে বসলেন। একা একা ধীরে ধীরে যখন মদের বোতল খালি করলেন, তখন ফজরের আজান পড়ল। হাসমত খান উঠে কিং সাইজের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

বৈচিত্র্য

এই জগতে বৈচিত্র্য ছাড়া কী আছে ? পৃথিবীর সৌন্দর্যই হলো মূলত বৈচিত্র্য। আকাশ বলো, পাতাল বলো, সমুদ্র বলো, পাহাড় বলো, রং বলো, মানুষ বলো, প্রাণি বলো―বৈচিত্র্য ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অর্থহীন। জীবন অর্থহীন।

                মাটিয়াকান্দার মানুষগুলো পারত কয়েকটি দিন চুপ করে পড়ে থাকতে। না তারা চুপ করে পড়ে থাকেনি। কানাই সুরানন্দ থেকে আসার সময় দোতরাটা নিয়ে এসেছিল। বশির কোমরে গুঁজে এনেছিল বাঁশি। বিকেল হলে কানাই আশ্রয়ের এক কোণে বসে দোতরা বাজিয়ে গান করত। তার সঙ্গে বশিরও বাঁশি বাজাত। তাদের ঘিরে থাকত শিশু-কিশোরসহ বয়স্করাও। কখনও দু-একজন বয়স্কও গান গাইতেন।

                একদিন গান গাওয়ার সময় নার্গিস এসে হাজির হলো। আদিলও ওখানে ছিল। নার্গিস আদিলের চোখে চোখ রাখলে আদিল রোমাঞ্চিত ও হতভম্ব হয়ে পড়ল। তখন মুখে নেকাব না থাকাতে শরীরের সমস্ত সৌষ্ঠব ও মাধুর্য যেন লুটিয়ে পড়ল আদিলের চোখে। ছিমছাম শারীরিক গড়ন, মুখের ডৌল অপূর্ব, নিটোল বুক, কোমর অবধি ঘন কালো কেশরাশি সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। মায়াবী ও চুম্বকীয় আকর্ষণে যেন আদিলকে কাছে টানতে লাগল নার্গিস। সে ভাবতে লাগল, মাটিকান্দায় কেন এই পরির মতো মেয়ের আবির্ভাব হলো ? এতগুলো মানুষের সামনে নার্গিসের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কুৎসা রটতে পারে ভেবে সে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

                কানাইয়ের দোতরা বাজতে শুরু করল। সে-ও গানে টান দিল। কানাইয়ের বাম চোখটি নষ্ট। ছোটবেলায় শিম পাড়তে গিয়ে শিমের ডগার আঁচড়ে চোখটি নষ্ট হয়েছিল আর ঠিক হয়নি। গানের গুণপনায় সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিছুক্ষণের মধ্যে সমবেত মানুষগুলোকে সুরের জালে আটকে ফেলল, আর ওরা কেউ নড়তে পারল না। তারপর বশির তো আছেই। বাঁশির সুরে যেন নার্গিসের বুকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। ওর মনে হলো, আদিলের সঙ্গে দুটি কথা বলে তোলপাড়কে শান্ত করি। সে স্বস্থান ত্যাগ করে আদিলের পাশে গিয়ে বসল ঘাসের চাতালে। কথা তো আগেই তৈরি ছিল ? ‘এখানে কিন্তু ভালো লাগছে। ঠিক না আদিল ভাই ?’

                ‘কী বলছ ? ভালো লাগার মতো কী আছে এখানে ? এত কষ্ট সবার।’

                ‘এমন সুন্দর গানের আসর কি গ্রামে কোনওদিন দেখেছেন ?’ 

                ‘সেই পরিবেশ সৃষ্টি কখনও হয়নি বলে আসর বসত না। কিন্তু ওরা তো গ্রামেও গান করত।’

                ‘আমরা তো কখনও শোনার বা দেখার সুযোগ পাইনি।’

                ‘তোমার গান ভালো লাগে ?’

                ‘হুম। খুব ভালো লাগে।’

                ‘এবার গ্রামে ফিরে আসরের ব্যবস্থা করব। তোমরাও শুনতে পারবে।’

                ‘সত্যি ?’

                ‘হুম, সত্যি।’

                দুজনের মুখে দুষ্ট হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এই হাসির দীপ্তি যেন মাটিয়াকান্দার অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ছাপিয়ে আরও অনেক দূর ছড়িয়ে গেল।

                এই সময় মওলানা হাবিবুর রহমান মাগরিবের আজান দিলে আসর ভেঙ্গে গেল।

ফেরা না-ফেরা

হাসমতের ত্বরিত সিদ্ধান্তে তারই অর্থায়নে মাটিয়াকান্দায় তাঁবু দিয়ে একটি অস্থায়ী ত্রাণকেন্দ্র গুদাম খোলা হলো। এই ত্রাণকেন্দ্রে যে পরিমাণ পণ্যসামগ্রী রাখা হয়েছে, তাতে দুই মাস আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষদের চালানো যাবে। এত মালপত্র মূলত এই মানুষগুলোর জন্য টোপ, যাতে ওরা সুরানন্দে চলে যেতে না চায়। 

                আদিল, হাশিম, নিতাই ও রাহিমা―এই চারজনকে দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে প্রতিটি পরিবারকে রিলিফ দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলো। আদিল নার্গিসকে খুব বুঝিয়েছিল তাদের দলে আসার জন্য, কিন্তু সে রাজি হয়নি। নার্গিস মেয়েটি যে বুদ্ধিমতী, তার প্রমাণও সে দিতে পারল। সে বলেছিল, ‘আমার লেখাপড়া আছে। এই কাজে যুক্ত হয়ে সামান্য টাকার মায়ায় আটকে যেতে চাই না।’

                আদিল হতাশ হয়ে বলল, ‘এখানে টাকাকে কি মুখ্য বিষয় মনে হলো ? মানুষের সেবাটা দেখবে না ?’

                ‘আমার কাছে তাই মনে হয়। সেবা মনে হতো যদি বহিরাগত কোনও সাহায্য না আসত। আপনাদের টাকা না দিলে আপনারাও এক কাজ সবাই করবেন না, বেশি দিন করবেন না। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেন, আমার কথার সত্যতা পাবেন।’

                আদিলের মনে হয়েছিল, নার্গিস তার কথা ফেলতে পারবে না। কারণ, দু-তিন চোখের ভাষায় যে কথা হয়েছে, তাতে আদিলের হৃদয় টাল খেল বটে এবং সে মনে করেছিল, নার্গিসের হৃদয়েও টাল খেয়েছে। একসঙ্গে থাকার সময় দুজনের মনের কথার বলার মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগে প্রেমটা আরও গভীর করা যাবে। শরীর ও মনের রসায়ন বলে একটা কথা তো আছে। তারপর সুরানন্দে ফিরেই বিয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু তার সমস্ত কল্পনা আর চিন্তা নার্গিস নস্যাৎ করে দিলে দারুণভাবে মর্মাহত হলো সে। তার আনন্দের গতিটাই যেন থেমে গেল। সে এতটাই অসাড় ভাবতে লাগল যে, তার দেহে প্রাণ আছে কি নেই, ভাবতে হিমশিম খেতে লাগল।

                নার্গিসকে স্বেচ্ছাসেবক দলে আদিল যেমন চেয়েছিল, ঠিক তেমনই হাশিমও চেয়েছিল। নার্গিসের প্রতি হাশিমের মনের টান সৃষ্টি না হলেও নার্গিসকে ভালো লাগে, এর চেয়ে বড় কথা আর নেই। যদি একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হতো, তাহলে হয়তো টান সৃষ্টিও হতে পারত। আরও বড় কথা হলো, একটা সুন্দরী মেয়ে দলে থাকলে দলটার মর্যাদা বেড়ে যায়। তবে রাহিমা নার্গিসের চেয়ে কম সুন্দরী, সে কথা বলা যাবে না; বরং বেশি সুন্দরীই বলা যায়। তবে নার্গিসের লেখাপড়া বেশি থাকায় তার প্রতি আকর্ষণটা সবারই বেশি ছিল।

                সরদার ইরাজ আদিল আর হাশিম যা-ই ভাবুক না কেন, হাসমত খান কোনও মেয়েকে স্বেচ্ছাসেবক দলে নিতে চাননি। পরে যখন হোয়াইট এলান বললেন, ‘নারীদের ক্ষমতায়ন দরকার। জেন্ডার বৈষম্য চলবে না।’

                তখন হাসমত খান নর-নারীকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করলেন এবং রাহিমা ও রাজিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। তাদের একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে ভাতা প্রদান করা হলো।

                হোয়াইট এলান হোটেল খলিফা থেকে পারতপক্ষে বের হতেন না। তিনি সেখান থেকে দিকনির্দেশনা যা দেওয়ার তা দিতেন। তবে হাসমত খানের কাজে যে বেশি হস্তক্ষেপ করতেন, তা-ও কিন্তু নয়।

                একইভাবে হাসমত খানও বেশি হস্তক্ষেপ করতেন না সরদার ইরাজের কাজে। তিনি হোয়াইট এলানের দিকনির্দেশনা সরদার ইরাজকে ফরোয়ার্ড করেই খালাস। 

                সরদার ইরাজ সার্বিকভাবে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ দেখভাল করতেন। হাসমত খান রেডল্যান্ড হোটেলের স্যুটে থাকতেন। খুব জরুরি কাজ না থাকলে তিনি রাজধানীতে সচরাচর যেতেন না। যেখানে লাভ বেশি সেখানেই থাকা সমীচীন।

                একদিন দুপুরের পর সরদার ইরাজ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে মিটিং করলেন অস্থায়ী গুদামে। সরদার ইরাজ জানতে চাইলেন, ‘এখানে কি কারও কষ্ট হচ্ছে ?’

                আদিল বলল, ‘না, কষ্ট হচ্ছে না। তবে আমার মনে হয়, আর সপ্তাহখানেক পরেই চলে যেতে পারব। এখানে আর থাকা লাগবে না। বন্যার পানি অনেক কমে গেছে।’

                ‘কী বলো তুমি ? এই দুর্যোগের সময় ওখানে কি মরতে যাবে ?’

                স্বেচ্ছাসেবকেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারা সবাই ভাবল, ওদের তাহলে কি কোনও মতলব আছে ? আমাদের এখানে বসে বসে খাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে কেন ? কিন্তু মনের কথা কেউই প্রকাশ করার সাহস পেল না। তারা ভাবল, যারা এত উপকার করছে, তাদের কথার বাইরে কোনও কথা বলা মানেই অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। ‘দেখা যাক সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে।’

                আদিলদের গ্রামে সম্পত্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ধানি জমিসহ বাড়িঘর, রবিশস্যের জন্য অনেক জমিজমা ছিল। আদিলের বাবা বারবার চলে যেতে চাইলে আদিল কয়েকটা দিন দেখার জন্য বলল। আশ্রয়কেন্দ্রে আদিলের নেতৃত্বের বিষয়টি অবশ্যই আদিলের বাবা ও মায়ের কাছে ভালো লাগছিল। ভবিষ্যতে সে নেতা হোক, এমন একটি সুপ্ত বৃক্ষের বীজ আদিল বাবার মনে বপন করে দিল।

                আদিল মনে মনে বলল, ‘এখন তো দেখছি, কথা বললেও বিপদ আর না বললেও বিপদ। আমাদের জমিজমা ঘরবাড়ি কি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে না ? আমরা কেন পরের দানদক্ষিণায় চলব ? কিন্তু জোরালো কিছু বলতে গেলে ওরা অকৃতজ্ঞ ভাববে। নিমকহারাম ভাববে। দেখা যাক কোন ধনুকের তীর কোন দিকে যায় ?’

                ইরাজ বললেন, ‘এখানকার শিশুদের জন্য স্কুল খোলা হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র খোলা হবে। আর খাওয়ার জন্য চাল-ডাল-তেল-নুন তো দেওয়াই হচ্ছে। আগে তোমরা এখান থেকে বাড়িঘর ঠিকঠাক করো, জমির পানি ভালোভাবে সরুক, তারপর যেয়ো। হাসমত খান তোমাদের জন্য যা যা করার দরকার, সবই করবেন। এমন মহান মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই জন্মায়।’

                কৃতজ্ঞতায় ওদের চোখ ছলছল করে উঠল। সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। হাশিম বলল, ‘ঠিকই বলছেন ইরাজ ভাই। মানুষের দুঃসময়ে এভাবে কাজ করতে জীবনে কাউরে দেখি নাই। এত বড় মনের মানুষ পৃথিবীতে খুব কম আসে।’

                ‘তোমরা তো আমার চেয়ে বেশি জানো না। আমি ওনার সঙ্গে বিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। ওনার মন খুব উদার। নিজের সুখের কথা কখনও চিন্তা করেন না। মানুষ জোর করে তারে ইলেকশনে দাঁড় করাইল। ভোট দিল। চেয়ারম্যান বানাইল। মানুষের ভালোবাসা পাওয়া খুব সহজ ব্যাপার না, বুঝলে তো ?’

                ‘জি, ইরাজ ভাই’, রাহিমা বলল, ‘এমন ভালো মানুষ জীবনে দেখি নাই।’

                মেয়েটি লেখাপড়া তেমন জানে না। কিন্তু কথাবার্তায় স্মার্ট, সপ্রতিভ। দৃষ্টিকাড়া চোখ। গায়ের রং যেন হলুদবাটা। মুখে মিষ্টি হাসি লেগেই আছে। সরদার ইরাজ ওদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলে সাধারণত রাহিমার দিকে তাকান না। যদিও মনে খচখচানি থাকে। তখন ওর মনে হতো―‘আমি ওদের দেখছি দুনয়নে আর ওরা আমাকে দেখছে অষ্টনয়নে। রাহিমার দিকে তাকালে সবার চোখই আমার দিকে ঝুঁকে পড়বে। কোনও রসায়ন কোনওভাবে সৃষ্টি হয়ে গেলে কূলহারা হয়ে দরিয়ায় ভাসতে হবে। আমি এত বেয়াকুফ না।’

                সরদার ইরাজ নিতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুম। তোমার কথা সত্য।’

                নিতাই একটু চালাক। সে ভাবছে, ‘এত দরদ কেন উপচে পড়ছে। হেতু কী ? মানুষ কি আর বিনা কারণে দরদ দেখায় ?’ সে কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে বেড়াতে লাগল। তবে কোনও মন্তব্য করল না। তীক্ষè ও গভীর পর্যবেক্ষক।

                আদিল বলল, ‘আমি গতকাল নিতাইকে নিয়ে দেখে এসেছি, পানি প্রায় নেমে গেছে। বাড়িঘরে পানি নাই। কিছু নিচু জমিতে পানি আছে। এই জলাবদ্ধতা থাকলেও আমাদের বাড়িঘরে যাওয়া প্রয়োজন। গরু-ছাগল তো সবই গেল। এখন টুকটাক করে সবই কিনতে হবে, জুততে হবে।’

                ‘ভালো কথা বললে। আমি একটা কাজ করার জন্য হাসমত ভাইকে বলবনে।’

                সবাই ওর দিকে ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে তাকাল। ইরাজ বললেন, ‘গরুছাগল কেনার জন্য দেখি সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না।’

                নিতাই মনে মনে বলল, ‘এইবার অক্টোপাসে ধরবে। আসল জায়গাটা পেয়ে গেছে। ঋণ দেবে। ঋণের জালে আটকাবে। তারপর কই যাবে ? যা কামাও সবই কিস্তি দাও।’ নিতাই আরও ভাবল, ‘এই কৃত্রিম পাহাড়টা যদি না বানানো হতো, তাহলে কি বৃষ্টির জলে বন্যা হতো। একটা এলাকাকে নিচু করে এখানে পাহাড়ের মতো বানিয়ে জলাশয়ের সৃষ্টি করল। তাহলে কি হাসমত খানের আগে থেকেই দুরভিসন্ধি ছিল ?’

                রাহিমা বলল, ‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমাদের গরু কেনার মতো টাকা নেই। বাবা সামান্য কৃষক। এবারের বন্যায় পাকা ধান ভেসে গেল। সারা বছর খোরাকির চিন্তায় আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’

                আদিল আর হাশিম ভাবল, ‘এত দরদের কারণ কী ?’ হাশিম বলল, ‘তাহলে কি হোয়াইট এলান আমাদের খ্রিস্টান বানানোর পাঁয়তারা করছে।’

                আদিল সংশয়ে পড়ে গেল, ‘অনেক দরিদ্র কৃষকের গরু বন্যার পানিতে ভেসে গেছে, মারা গেছে। ওদের যদি সাহায্য করা হয়, তাহলে মন্দ হয় না।’ আবার ভাবল, ‘ওরা কি কাবলিওয়ালার মতো ঋণের জালে আটকায় কি না কে জানে। দেখা যাক কী হয় ?’

                কয়েক দিন রিলিফ দেওয়ার সময় কয়েকটা ফুটবল দিয়েছিল শিশুদের খেলার জন্য। কাউকে খেলতে দেখা গেল না। এই গাছপালা ভর্তি জঙ্গলে ফুটবল কোথায় খেলবে ? খেলার জন্য কমপক্ষে একটা ছোটখাটো মাঠ তো চাই।

                সরদার ইরাজ সন্ধ্যার দিকে চলে গেলেন শহরে। আগামী সপ্তাহে আবার তিনি আসবেন। যে পরিমাণ রিলিফ দেওয়া হলো, তাতে এক সপ্তাহ চলে যাবে।

সরদার ইরাজ মনে নানা প্রশ্ন ও সংশয় নিয়ে যেমন মাটিয়াকান্দা ত্যাগ করলেন এবং ঠিক তেমনই একইভাবে নানা প্রকার সন্দেহ-সংশয় নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে নিজ নিজ অস্থায়ী ত্রিপলের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

                রাতে সরদার ইরাজ রেডল্যান্ড হোটেলের স্যুটে হাসমত খানের সঙ্গে দেখা করলেন। বারো শত স্কয়ার ফুটের স্যুট। বেডরুম ও ড্রয়িংরুমের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন চোখজুড়ানো। দৃষ্টিকাড়া পর্দার রং। ছয়তলার স্যুটের ঝুলবারান্দায় বসলে বিস্তৃত প্রান্তরে মুক্ত বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়।

                রুমের ভেতরে ফ্রিজে রাখা আছে নানা রকম ফলসহ আরও বিভিন্ন খাবার। হাসমত খান বললেন, ‘যা খাইবি নিয়ে বস।’

                সারা দিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার কারণে শরীরটা কাদা কাদা হয়ে গেছে। সরদার ইরাজ হুইস্কি আর কয়েক রকম বাদাম ও চিপস নিয়ে বসল ড্রয়িংরুমে। আইস কিউব আর পেপসির বোতল সঙ্গে নিল। লেবু ফ্রিজে থাকলেও কাটতে ইচ্ছে হলো না।

                হাসমত খান বোতল থেকে ধীরে ধীরে হুইস্কি ঢালেন গেলাসে। সরদার ইরাজ একটা দুটো করে বাদাম মুখের ভেতরে ছুড়ে মারতে লাগলেন। তারপর সিগারেট জ¦ালিয়ে বললেন, ‘খবর বল। তোকে টেন্সড দেখা যাচ্ছে।’

                ‘যা ভাবছিলাম তাই। মনে হচ্ছে আদিলটাই বেশি গণ্ডগোল পাকাবে। ওকে আটকানো কঠিন হয়ে যাবে। সে তো এখনই চলে যেতে যাচ্ছে। তার চলে যাওয়া মানে আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের নিয়ে চলে যাওয়া। কেবল রাহিমাকে মনে হলো পজিটিভ। নিতাইও চুপচাপ। চুপচাপ থাকা মানে আরও ভয়ংকর। সাইলেন্স ইজ ডেঞ্জারাস। সে তলে তলে ঘোঁট পাকাবে। হাশিমও আদিলের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে বলে মনে হলো।’

                ‘কী করা যায় তাহলে ? দুই বছরের জন্য ফান্ড পাওয়া যাবে। বলা যায় অ্যাপ্রোভড। মি. বি আমাকে আজকে জানালেন। দুই বছর তো আটকাতে হবেই।’

                ‘আজকে কিছু ফটো আনছি। এগুলো হোয়াইট এলানকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। খুব টাচি ছবি।’

                ‘আদিলের ব্যাপারে কী করা যায় ?’

                ‘আগে যা ভাবছিলাম, তাই করতে হবে। ওকে মিডলইস্ট পাঠিয়ে দিতে হবে। হাশিমকে বেশি বেতনের চাকরি দিয়ে দেব। তখন নিতাই তো এমনিতেই সংখ্যালঘু, বেশি নড়াচড়া করবে না। সংখ্যালঘু মানুষও এখানে কম। ওরা যদি চলে যায় অসুবিধা নেই। রাহিমা তো আমাদের পক্ষেই আছে। ও স্মার্ট হলেও লেখাপড়া জানে না। বেশি করে টোপ দিয়ে দিলে নড়াচড়া করবে না। রাজিয়াও কিছু বলবে না। ও হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে।’

আদিল রাতে ঘুমাতে পারেনি। সে ভাবল, ‘হাসমত খান কেন সুরানন্দের মানুষগুলোকে এখানে রাখতে চাচ্ছেন। কেন আমরা এখানে বসে বসে খাব। নিজেদের স্বাধীনতা বিকিয়ে ওদের দিকে হাঁ করে খাবারের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে। বসে বসে খেয়ে আমরা হয়ে যাব পঙ্গু। আমাদের ফসলি সব জমিন হয়ে যাবে বন্ধ্যাভূমি।’

                মধ্যরাতে হাশিমকে ডেকে বাইরে আনল আদিল। ওরা দূরে একটি ফাঁকা জায়গায় বসে সিগারেট জ¦ালিয়ে কথা বলতে শুরু করল। আদিল বলল, ‘বুঝতে পারছি না হাশিম, আমাদের কেন এখানে রাখতে চায়। নিশ্চয়ই বদ উদ্দেশ্য আছে। এখন পানি প্রায় নেমে গেছে। বাড়িঘরে পানি নেই। আমরা কেন এখানে থাকব ? তোর কি মনে হয় এখানে থাকা উচিত ?’

                ‘ওদের মনে হয় কোনও স্বার্থ আছে। নইলে এতগুলো মানুষের জন্য ওদের এত দরদ কেন ?’

                ‘কী করা যায় ?’

                ‘চলে যাব। এখানে থাকব কেন ? নিজের অস্তিত্ব ধ্বংস করে এখানে থাকার কোনও মানে নেই। যতই লোভ দেখাক কাজ হবে না। আগামী শনিবারে চলে যাব।’

                ‘বললেই কি চলে যেতে পারবি ?’

                ‘কেন ?’

                ‘এই যে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব নিলি। তার দায়দায়িত্ব কী করব ? কাগজে সাইন করোস নাই ?’

                ‘হ। তা তো ভাবি নাই।’

                ‘গুদামের দায়িত্ব তো আমাদের হাতেই। যদি চলে যাই, ওরা মাল সরিয়ে আমাদের নামে চুরির মামলা দেবে। পরে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে জেলে ভরে রাখবে। বিষয়টা খুব সাধারণ মনে করলেও কিন্তু সাধারণ না। আমাদের কিন্তু একটা গ্যাঁড়াকলে আটকিয়েছে।’

                ‘তাহলে ?’

                ‘এখন আমাদের এলাকার মানুষদের গোপনে গোপনে পাঠিয়ে দে। কারণ, তাদের কোনও দায়িত্ব নেই। তবে গরিব-কাঙ্গালগুলো যাবে বলেও মনে হয় না। আমরা এখন মাইনক্যা চিপায় পড়লাম। আসলাম বাঁচার জন্য, এখন দেখা যায় পড়লাম মরণফাঁদে।’

                ‘তাহলে গোপনে গোপনে আমাদের আত্মীয়স্বজনকে পাঠিয়ে দিই। রাতে ওরা চলে যাবে।’

                ‘তাই কর। তারপর গুদামের জিনিসপত্র শেষ হলে ওদের হাতে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আমরাও চলে যাব।’

                ‘তাই হবে। এখন চল, ঘুম পাচ্ছে খুব।’

ছুটি যাপন

হাসমত খান মাটিয়াকান্দা থেকে ছুটি কাটাতে গেলেন রাজধানীতে। সব বিষয় দেখার জন্য সরদার ইরাজ দায়িত্বে রইলো। সরদার ইরাজ হোটেল রেডল্যান্ডে থেকে গেলেন। তিনি মৃতদার ব্যক্তি হিসেবে নিজের জীবনের জন্য চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু নেই। অর্থকড়িও যে খুব প্রয়োজন, তা-ও নয়। বলতে গেলে অর্থের মোহ বলতে তার কিছুই নেই। তবে ছিল একসময়। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই সরদার ইরাজের লেখাপড়াও অনেক। একসময় কেবল টাকার পেছনে ছুটত। অসদুপায়ে টাকা কম কামায়নি। সেই টাকা খরচ করত দুই ডব্লিউ মানে উইমেন ও ওয়াইনের জন্য। নিজের বন্ধ্যাত্বের কারণেই নিঃসন্তান। একসময় প্রিয়তমা স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত হলে এহেন চেষ্টা নেই যে তিনি করেননি। তার সঞ্চয় ও স্থাবর সম্পত্তি―সব মিলিয়ে দুই কোটি টাকার বেশি খরচ করেও বাঁচাতে পারলেন না। তখন থেকে সরদার ইরাজের টাকার মোহ চিরতরে হারিয়ে গেল। এখন সাধারণভাবে নিজের চলার মতো ব্যবস্থা হলেই তার চলে। বটবৃক্ষ হাসমত খানকে আশ্রয় করেই তার জীবন।

হোয়াইট এলান ছুটি কাটাতে প্রতি সপ্তাহে থাইল্যান্ড যেতেন। অবশ্যই তিনি কোথায় গেলেন, কোথায় খেলেন, কোথায় ঘুমালেন―এই ব্যাপারে হাসমত খান কিংবা সরদার ইরাজের জানার বিষয় নেই। হি ইজ আ মানিমেকিং মেশিন। টাইমলি মানি দিতে পারলেই হলো।

চেতনার ভাঙচুর

স্বার্থের গন্ধ পেলে মানুষ কী করে, তা বলা মুশকিল। আদিল, হাশিম আর নিতাই যা ভেবেছিল, তা কার্যকর করতে পারেনি। তারা বলেছিল, অনেককে রাতের অন্ধকারে এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য। কার্যত কয়েকটি পরিবার ছাড়া আর কেউ যেতে রাজি হলো না। দরিদ্ররা তো একেবারেই না করে দিল যে তারা যাবে না। খাওয়া, চিকিৎসা পাচ্ছিল, তাহলে কেন বাড়িতে যাবে ? কেউ কেউ যুক্তি দেখাল, এখন কেবল আষাঢ় মাস। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসেও বন্যা হতে পারে। তারপর কি আবার এখানে আসতে হবে না ? এ ছাড়া যাওয়ার জায়গা কোথায় ? তাহলে দু-তিন মাস থেকে যাওয়াই কি ভালো নয় ?

                সমস্যাটি দ্বিমুখী রূপে দাঁড়াল। আশ্রিতরা স্বেচ্ছাসেবকদের নামে অভিযোগ করতে পারে। অভিযোগ করার পর তাদের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হতে পারে। তখন এরা সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কেউই এদের সঙ্গে থাকবে না। সুরানন্দতে গিয়েও সামান্য কিছু মানুষ নিয়ে থাকতে হবে। তারপর যদি আবার শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে বন্যা হয়, তখন কোথায় যাবে ? আষাঢ়েই যদি এমন বন্যা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্রে তো আর বড় বন্যাও হতে পারে।

                এত প্রতিকূল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েও আদিল বলল, ‘কেউ যাক আর না যাক, আমি আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে এলাকায় চলে যাব। যদি মরতে হয় ওখানেই পড়ে মরব। কিন্তু তবু হাসমত খানের দয়ায় বাঁচতে চাই না।’

                আদিলের এমন দৃঢ়তা দেখে নিতাই বলল, ‘আমি থাকব না। এখানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমরা সংখ্যালঘুরা চলে যাব।’

                দিনের বেলায় আদিল ও নিতাইয়ের এমন দৃঢ় কথাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াল। এবং সরদার ইরাজের কাছে সব কথাই কীভাবে চলে গেল, আদিল ও নিতাই কিছুই বুঝতে পারল না।

                দিনে কথাবার্তা বলে তাদের সিদ্ধান্ত পাকা করল কিন্তু রাতেই আবার অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। এই বৃষ্টির অবস্থা দেখে আদিল ও নিতাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও রেডল্যান্ড হোটেলের স্যুটে বসে আনন্দে মেতে আছেন হাসমত খান ও সরদার ইরাজ। তারা বৃষ্টিকে সেলিব্রেট করে বিশেষ খাবারের আয়োজন করল। হোটেলের ম্যানেজারকে বলে দিল খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের ভাজা স্যুটে পাঠাতে। মদ তো আছেই।

                যদিও হোয়াইট এলান ওদের সেলিব্রেশনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি, আবার হাসমত খানও নিজেদের আনন্দকে এতটা নগ্নভাবে হোয়াইট এলানকে জানাতে চায়নি, তথাপি হোয়াইট এলানও একা একা হোটেল খলিফা থেকে সেলিব্রেট করে চার প্যাগ অতিরিক্ত মদ্যপান করল।

                বৃষ্টি দু দিন স্থায়ী হলো।

                সুরানন্দ এলাকা আবার নতুন করে ডুবল।

                আদিল, হাশিম আর নিতাই মেনে নিতে পারছিল এই বিপর্যয়। তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ল। ওদের মনে একটিই প্রশ্ন, যদি কৃত্রিম পাহাড় বানানো না হতো, তাহলে সুরানন্দ পানিতে ডুবত না। হাসমত খানের শয়তানির কারণেই এতগুলো মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার পথে। এই জনগোষ্ঠী সত্যিকার অর্থেই অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। একটি জনপদ বিলীন হওয়ার পথে।

                দু দিন পর সরদার ইরাজ আদিল ও নিতাইয়ের সঙ্গে পৃথকভাবে মিটিং করে, তারা কী ভাবছে সব কথা যখন বলতে লাগল, তখন ওরা বিস্ময়াহত হয়ে পড়ল। দুজনই ভাবছে, দলের ভেতরের কথা কে ফাঁস করল ? কে বলে দিল ? কিন্তু এর কোনও সুরাহা করতে না পেরে ওরা মাথায় বাড়ি খাওয়া সাপের মতো নেতিয়ে থাকল এবং সরদার ইরাজের কথামতো সব কাজ করে যেতে লাগল।

                আবার রোদ উঠল। আবার রোদের উজ্জ্বলতার স্বপ্নে বিভোর হলো ওরা কয়েকজন। ওরা সুরানন্দতে চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগল। নিজের জন্মভূমির টানে ওরা মাটিয়াকান্দা ছেড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগল।

                আদিলকে সহজে বাগে আনা যাবে না, তা ইরাজ খুব ভালো করেই বুঝে গেলেন। তিনি হাসমত খানকে বোঝালেন যে ব্রিটিশ পলিসি অ্যাপ্লাই করতে হবে।

                ‘সেটা কেমন ?’

                ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল। আদিলকে সরিয়ে দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, ওরে মিডলইস্ট পাঠিয়ে দেন। এই টোপে অনেকে দিশাহারা হয়ে যাবে। আবার অনেকেই বিনা শর্তে আপনার দাসত্ব মেনে নেবে। কারণ, বিদেশের নাম শুনলে এই দেশের মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়।’

                ‘সে যদি বিদেশ যেতে না চায় ?’

                ‘তাহলে হয়তো ড্রাস্টিক অ্যান্ড ব্রুটাল অ্যাকশনে যেতে হবে। কোনও ইতরকে ময়দানে রাখতে নেই, সরিয়ে দিতে হবে।’

                ‘ওর সঙ্গে কথা বলে দ্যাখ। যদি রাজি হয়, তাহলে দ্রুতই পাঠিয়ে দেব। ওয়ার্ক পারমিটের কাগজপত্র আছে। পাসপোর্ট পেলেই ভিসা করে দেব। মিডলইস্টে পাঠানো ওয়ান টুর ব্যাপার।’

  একদিন মাটিয়াকান্দার আশ্রয়শিবিরের গুদামে দুপুরের দশাসই খাবারের আয়োজন করা হলো। সরদার ইরাজ রেডল্যান্ড হোটেল থেকে আনানো খাবারের হোস্ট। থ্রি স্টার হোটেলে বুফে মেনুর সাবকন্টিনেন্টাল ফুডের সব আইটেম আনানো হলো। এই খাবার ওরা খাবে তো দূরের কথা, চোখেও দেখেনি, নাম জানা তো দূরের কথা। যে যেমন পারে খেল। অর্ধেকের মতো খাবার বেঁচে গেল, সেগুলো নর্দমায় ফেলা হলো। কারণ, এখানে পার্সেল করে নেওয়ারও সিস্টেম ছিল না।

                সরদার ইরাজ মনে মনে বলল, ‘বাছারা, এগুলো মোটিভেশন বেইট। খাও। টোপ খাও।’ দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। সরদার ইরাজ বললেন, ‘দেশে থেকে কী করবে আদিল ?’

                আদিল চমকে ওঠে এবং ইরাজের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘দেখি একটা চাকরি যদি কোথাও হয়। বিএ পাসের চাকরি পাওয়াও কঠিন। আমাদের জমিজমা আছে, সেগুলো কাজে লাগাতে পারলেও হয়।’

                ‘বিদেশে চলে যাও।’

                অধিকতর চমকে ওঠে আদিল। বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, ‘বিদেশে ?’

                ‘হুম।’

                ‘কীভাবে ? আমার তো এই পথ জানা নেই।’

                ‘হাসমত খানকে বলে দেখি, তিনি রাজি হন কি না। তিনি দিলদরিয়া মানুষ, তোমার কথা বললে হয়তো রাজি হতে পারেন। আর রাজি হলে তো এক মাসের ব্যাপারও না। পনেরো দিনেই যেতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে যেতে চাও।’

                আদিল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে, ‘এও কি সম্ভব ? লাখ লাখ টাকা খরচ করে মানুষ বিদেশে যেতে পারে না। আর আমার এই সুযোগ।’ সে চিন্তা করে বলল, ‘কাতার গেলেই মনে হয় ভালো হবে।’

                ‘আমি একটু চেষ্টা করে দেখি। তবে আমার কথাটি অন্য কাউকে বলবে না। কারণ, ওরাও পরে যেতে চাইবে। এত মানুষ তো আর বিদেশে পাঠানো সম্ভব না। খুব গোপনে কাজটি করতে হবে।’

                ‘জি, আচ্ছা।’

                আদিলের মনে হলো ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে দেবতুল্য ইরাজকে।

                কঠোর নীরবতার মধ্য দিয়ে দশ দিনেই সব কাজগপত্র তৈরি হয়ে গেল।

                আদিল বিদেশ যাবে―কথাটি প্রচারিত হলো মাটিয়াকান্দায়, তবে ভিন্নভাবে; যাতে হাসমত খানের মর্যাদার আসন উচ্চতায় ওঠে। জনদরদি ও নিষ্ঠাবান কাজের জন্য আদিলকে হাসমত খান বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রচারের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যেও জান লুটিয়ে কাজ করার প্রবণতা তৈরি হলো। তারাও ভাবল, ভালো কাজ করলে তাদেরও বিদেশে পাঠানো হবে।

                আদিলের কাতার যাওয়ার খবরটি প্রচারিত হলে আশ্রিত মানুষগুলো পারে তো তখনই হাসমত খানের নামে জয়ধ্বনি করতে শুরু করে। এই পাওয়া শুধু আদিলের নয়, পুরো সুরানন্দ জনপদের মানুষের―আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষ সেভাবেই মূল্যায়ন করল।

                নার্গিসকে বলে যেতে চাইল আদিল―মনের আকুতি। দুদিন পরেই ফ্লাইট। সেদিন বিকেলে নার্গিসের সঙ্গে একটি মেহগনি চারা গাছের নিচে দেখা হলে আদিল বলল, ‘কাতার চলে যাচ্ছি নার্গিস।’ আদিল মনে মনে বলল, ‘তুমি আমার স্বপ্ন। এবার হয়তো আমাকে ফেরাবে না। কথাটি সরাসরি বলতে গিয়েও থেমে গেল নার্গিসের অনুচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি এবং রিজার্ভ পার্সোনালিটির কারণে। আদিল নার্গিসের দিকে তাকালে সে বলল, ‘তাহলে হেরে গেলেন ?’

                ‘মানে ? আমি তো ভাবছি জিতে গেলাম। এই প্রাপ্তি কি সাধারণ ?’

                ‘গবেটরা এমনই মনে করে।’

                আদিলের মাথার চাঁদি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। একটা কষে থাপ্পড় লাগাতে ইচ্ছে করে নার্গিসকে, কিন্তু নানা দিক চিন্তা করে পারেনি। দাঁত চেপে হজম করে।

                নার্গিস আবার বলল, ‘আপনাকে বিদেশে পাঠালে এই মানুষগুলোকে এখানে আটকে হাসমত খান ভালো ব্যবসা করতে পারবে। এই চিন্তা থেকে আপনাকে টোপ দিল। আপনি খেলেন। যারপরনাই খুশিও হলেন। তাই না ?’

নার্গিসের দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিল কখনও ভাবেনি। সত্যি কি হেরে গেলাম ? আরে ধেৎ, মেয়েমানুষের বুদ্ধি নিয়ে চললে তো দুনিয়াই শেষ।’ মনে মনে কথাগুলো আওড়িয়ে নার্গিসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখি না কী হয় ? এত অস্থির হওয়ার কী আছে ? তুমি তো আছ।’

                ‘আমি আছি, থাকব। আমি সজ্ঞানে মাথা নত করব না। এক বেলা খেয়ে থাকব, তবু মানুষের সম্মান নিয়ে বাঁচব, বাঁচতে চাই।’

                ‘ওরা কত ভালো কাজ করছেন। তাহলে কীভাবে আমাদের অসম্মান করছে ?’

                ‘আমাদের ইচ্ছেমতো পথচলাকে থামিয়ে দিচ্ছে। আমাদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিচ্ছে না। এর চেয়ে অসম্মান পৃথিবীতে আর কী আছে ? আমি অনুমান করছি, এদের ভালোমানুষির মুখোশটা একদিন উন্মোচিত হবে।’

                নার্গিস আর কথা বলার জন্য উৎসাহ বোধ করল না। সে যখন নিজের ছাপরায় যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, তখন আদিল বলল, ‘নার্গিস, একটা কথা বলতে চাই।’

                ঘাড় কাত করে বলল, ‘বলুন।’

                ‘তোমাকে আমি ভালোবাসি। তুমি যদি রাজি থাকো, তাহলে দু বছর পর কাতার থেকে এসে বিয়ের আয়োজন করব।’

                ‘এই বয়সে ছেলেমেয়ে কিছুক্ষণ এক সঙ্গে থেকে কথাবার্তা বললে ভালোলাগা কাজ করে। তখন তাকে ভালোবাসা বলতে দ্বিধা করে না। আপনারও এই অবস্থা হয়েছে। তবে পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই যে, আমার আশা করে সময় নষ্ট করবেন না―সে প্রত্যাশাই আমি করি।’

                নার্গিস চলে গেল। সে চলে গেল এমনভাবে যেন ওদের মধ্যে কিছুই ঘটেনি। আর আদিল দাঁড়িয়ে রইল। ভাবতে লাগল―‘কিসের দেমাগ ওর ? কিসের দেমাগ… ?’

ভাঙ্গনের সুর  

সরদার ইরাজ আর হাসমত খানের এই স্বপ্ন সহসাই সম্পূর্ণ পূরণ হয়নি। আদিল যেন আকাশের চাঁদ পেল। সুরানন্দর কথা সহসাই ভুলে গেল। ভুলে গেল আত্মীয়স্বজনের কথা। মানুষের কথা। আদিল মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেলে নতুনভাবে সংকট তৈরি হলো মাটিয়াকান্দায়। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিল। এই ভাঙ্গন আদিলের প্রতি ঈর্ষা থেকে নয়, বরং তাদের জীবন ও অধিকারের দাবিতে।

                অর্থ আর প্রাচুর্যের জৌলুশের সামনে রাহিমা নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। তার অবশ্যই বোঝার ক্ষমতাও সীমিত। সে ভাবতে পারত না ভূতভবিষ্যৎ। মোটাবুদ্ধির মানুষের যা হয়। ধরা দিল সর্বস্ব দিয়েই। বড়শির টোপ খেল ভালোভাবে। বড়শির সুতোর টানে সে অফিসের কাজের অজুহাতে রেডল্যান্ড হোটেলে হাসমত খানের স্যুটে মাঝে মাঝে দেখা করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় থাকত। চকচকে টাকার নোট যখন গুনত, তখন সে বুকের ভেতরে যেন শুনতে পেত ইটপ-াথরের ঝনঝনানি। স্বপ্ন দেখতে লাগল প্রাসাদ গড়ার। স্বপ্ন দেখতে লাগল বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর। অবশ্য হাসমত খান তাকে সেভাবে তৈরি করতে লাগলেন। স্বেচ্ছাসেবকদের ভাতার সামান্য টাকার বাইরেও বাড়তি টাকাও তার হাতে আসতে লাগল। সে ভুলে গেল সুরানন্দকে। ভুলে গেল সুরানন্দের মানুষগুলোকে।

                হাশিম ও নিতাই টোপ গেলেনি। বিদেশে যাওয়াসহ তাদের নানা প্রকার প্রলোভন দেখালেও তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে ছিল অনড়, অবিচল। নার্গিসও এদের সঙ্গে যোগ দিল এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে অনেকগুলো পরিবারকে তাদের দলভুক্ত করতে সমর্থ হলো। তাদের একটি কথাই যে, তারা সুরানন্দকে বিরানভূমি বানিয়ে পরান্নে লালিত হবে না। বিবেক ও মস্তিষ্ক বিক্রি করবে না। মস্তক কখনও নত করবে না। না খেয়ে মরলেও সুরানন্দে মরবে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়বে, তবু মাথা বিক্রি করবে না।

                তারা নিজেদের পরিবার-পরিজনসহ দলভুক্ত সমস্ত মানুষকে নিয়ে সুরানন্দে চলে গেল।

                সামান্য কিছু শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল বয়স্ক গরিবগুর্বা পড়ে রইল, যাদের স্বস্থানে করার মতো কিছু নেই। সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলো এমনিতেই অন্যদের দয়াদাক্ষিণ্যে সেখানে চলত। তাদের সেখানে থাকাও যা, এখানেও থাকাও তাই।

                হোয়াইট এলান এলেন না। তিনি ইরাজকে বললেন, ‘কোনও সমস্যা নেই। তুমি কাজ চালিয়ে যাও।’ তিনি নিজেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। লিমা নামের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করলেন। হোটেল খলিফার একটি রুম ভাড়া করে অফিস বানিয়েছে, যে অফিসে তারা দুজন অফিস করতে লাগলেন। প্রতি মাসে একবার তারা থাইল্যান্ড, নেপাল, সিঙ্গাপুর, দুবাই প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করতেন।

                হাসমত খান ভাবলেন, শুধু এই ব্যবসায় পড়ে থাকলে চলবে না। হোয়াইট এলান যখন-তখন ফান্ড উইথড্র করতে পারেন। তাই এখানকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরদার ইরাজকে দিয়ে তিনি রাজধানীর দিকে দৃষ্টি দিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আমার কৃত্রিম পাহাড়ের যে নকশাটি করা আছে, সে কাজগুলো হোয়াইট এলানের টাকা থেকে করে ফেলিস।

                দুই বছরের মধ্যে মাটিয়াকান্দা অপূর্ব নান্দনিক সাজে সজ্জিত হলো। ফুল-ফল ও বনজ গুল্মলতাবৃক্ষরাজি যেন সবুজের প্লাবন। তার মধ্যে বিলাসবহুল রিসোর্ট। সরদার ইরাজ কানাডায় ফ্ল্যাট কিনল। সে কানাডায় চলে যাবে। হাসমত খান তো আগেই আমেরিকায় বাড়ি কিনেছে, কিন্তু ব্যবসায়িক কারণে এবং সংসদ সদস্যের চেয়ারে বসার স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটিকে এ দেশে থাকতে হবে।

                হতদরিদ্র বাস্তুহারা মানুষগুলো মাটিয়াকান্দা ছেড়ে শহরের ফুটপাথ দখল করে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে লাগল।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button