আর্কাইভগল্প

গল্প : খেজুর কাঁদি : নলিনী বেরা

‘April is the cruelest month, breeding/ Lilacs out of the dead land, mixing/ Memory and desire, stirring/ Dull roots with spring rain.’ (THE WEST LAND  : T. S. ELIOT )

না, না এপ্রিল নয়। এ বছর এ দেশের এদিকটায় মে মাসটাই সবচাইতে পৎঁবষবংঃ মাস, খুব গরম পড়ল। তাপমাত্রা যেখানে থাকার কথা ৩৬/৩৭ ডিগ্রি, সেখানে চড় চড় করে পারদ উঠল ৪৭/৪৮ ডিগ্রি। তার মধ্যে কলাইকুণ্ডা আবার এক-কাঠি সরেস, ৪৯/৫০ ডিগ্রি।

মাঠময় আ-কাটা ‘বোরো’। আই আর ছত্রিশ, আটত্রিশ, স্বর্ণ, লাল স্বর্ণ। কাটা হবে কি, গর্ভাধানে থোড় এসেছিল, ধানে দুধ জমেছে কি জমেনি, সব তো শুকিয়ে আগড়া। মাঠই তো জলহীন, শুষ্ক। ফুটিফাটা। সাবমার্শালও আর জল দিতে পারছে না, মাটির নিচে জলস্তর প্রায় শূন্য। কিছুক্ষণ চলার পর জল না, মেশিনে গল গল করে ধোঁয়া উঠছে।

ধান তো ধান, বট-অশ্বত্থের পাতাও রোদ উঠতে না উঠতেই ঝিমিয়ে পড়ছে। পাতা ঝরার সময় নয়, তবু শালের তেল-চকচকে পাতাগুলো শুকনো মড়মড়ে খড়খড়ে হয়ে ঝরে পড়ছে।

সময়টা ভারি দিগদারির, বিশেষত মা-পাখিদের। গাছের  এ-ডালে সে-ডালে বাসা বেঁধে ডিম পেড়েছিল তারা। ডিম ফুটে বাচ্চাও হয়েছে। পালক না-গজানো কাঁড়াল-কোঁড়ল বাচ্চাগুলো হলুদ বর্ডার দেওয়া ঠোঁটে হাঁ করে  কঁহরাচ্ছে, হাঁপাচ্ছে। হয়তো মরেই যাবে। তাদের মা-বাবাও নিশ্চেষ্ট বসে নাই। দুজনেই কা-কা রবে ডানা ফেটিয়ে এসে-পড়া-রোদটুকুকে আড়াল করছে।

গবাদি পশুগুলো আর গোচারণের মাঠে নাই, মাঠ কোথায় ? ‘চব্বিশের খরা আদিগন্ত মাঠে পেতেছে ত্রিপল’। মাঠের ঘাসগুলো রোদে পুড়ে এতদিনে হলুদ তেরপলের রং ধরেছে। যে দু-চাট্টা হালের বলদ নয়, হয়তো বা রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো ধর্মের ষাঁড়, তারা বনঝাড়ে ঢুকে বড়জোর গাছতলে বসে মচর মচর জাবর কাটছে। উঁহু, জাবর কাটা কী আর, ধুঁকছে।

একটাও ছাগল-ভেড়ার দেখা নাই। খৎখানায়, জবরাখানায় যে মুরগিগুলো সারা দিনমান তাদের ছানাপোনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, খুঁটে খুঁটে পোকা বের করে খায়, তাদেরও পাত্তা নাই। হয়তো রোদের ঝাঁজে এতদিনে সাবাড় হয়ে গেছে, আর নয়তো পেটতলে আণ্ডাগাণ্ডা নিয়ে বসে আছে ‘মাঝু’ ঘরে। 

রাস্তায় ঘাটে একটাও লোক দেখা যায় না, ক্বচিৎ কদাচিৎ ছাতামাথায় ওই এক-দুজন। তাও হাঁটছে না, দৌড়াচ্ছে। যেন বা ভয়ে ভয়ে কোথাও পালাচ্ছে।

নদী-ডাঙায় ছাতিনা গাছে দু-চাট্টা দাঁড়কাক তাদের হেঁড়ে গলায় তারস্বরে চিল-চিৎকার করে চলেছে, করেই চলেছে, হয়তো বা ক্ষুধার তাড়নায়।

খাবে কী ? নদী তো শুকনো, ঠা ঠা, মরা সোঁতা। মাছ  তো মাছ, একটা ব্যাঙটুনিও আর বেঁচে নাই। চারদিকে শুধু ধূ ধূ বালি। বালিয়াড়িতে আগে আগে দু-দশটা আকন্দ গাছ, দশ-বিশটা  কাঁটা কুলবুদা যাও বা দেখা যেত, এখন তাও আর নাই। রোদে পুড়ে হেজে মরে যাচ্ছে টাটকাটাটকি।

নাকি এমনটা, এমন তপ্ততা, তাপপ্রবাহ―বিগত এক শো বছরেও দেখা যায়নি। গাঁ-গঞ্জ দেশ-গ্রাম প্রচণ্ড দাবদাহে সুদূর আফ্রিকাকেও এ বছরটায় গো-হারান হারিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে তল্লাটের কলাইকুণ্ডা।

এহেন কলাইকুণ্ডার বিশ-পঁচিশ মাইল দূরবর্তী দক্ষিণে দু-দুটো ছোট-বড় নদী পেরিয়ে যেতে হয় বরেণের দেশবাড়ি কলাইমুড়ি গ্রামে। কলাইকুণ্ডার ফৌজি উড়া-কল রোজদিন সেখানে ট্রেনিং-এর নাম করে ফলস বোমা ফেলে আসে। বোম্বিং-এর ‘গু-ড়ু-ম’ ‘গু-ড়ু- ম’ প্রচণ্ড আওয়াজ হরবখত শোনা যায়।

মে মাসের ২৩ তারিখ সেখান থেকে ‘URGENT’ একটা টেলিগ্রাম এসেছে―‘MOTHER DIED, COME SOON. NRIPEN’। বড়দা নৃপেনই টেলিগ্রামটা পাঠিয়েছে। তবে তার নিজের হাতের লেখা কি আর ? ক অক্ষর গোমাংস―বড়দা ইংরেজি লিখবে ? বাংলায় অ আ ক খ-ই তো জানা নাই তার। নির্ঘাৎ পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টারকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে।

বরেণের স্ত্রী যোগমায়া বলল, যা গরম!

তো কী ?

না, বলছিলাম―

কী যে বলো! মায়ের কাজঘর, মা বলে কথা―আমি তার অধম সন্তান, হোক গরম আমাকে যেতে হবে না ?

গরমের চিন্তা ছেড়ে বউয়ের কথা ঠেলে ফেলে বরেণ ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যেই রামরাজাতলা ইস্টিশনে এসে লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ল। ট্রেনে উঠেই তার অবধারিত মনে হল, মা নিশ্চিত মারা গেছে এ বচ্ছরকার রেকর্ডকরা গরমেই।

কোথায় যেন পড়েছে সে, ‘লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার  মত তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে মাথা ঝিমঝিম করে―যেন নেশা লাগে।’

ট্রেনে উঠেই বরেণের সত্যি সত্যিই মনে হচ্ছিল যেন জ্বলন্ত আগুন থেকে ধোঁয়া উঠছে। ট্রেনের গায়ে হাত বুলাতেই হাতে ছ্যাঁকা লাগছে। তার মধ্যেই হকাররা লাল নীল সবুজ প্লাস্টিকের প্যাকেটে বরফ ভরে ‘কুলফি’ করে বেচছে।

হাতে গরম ‘কুলফি’ চুষে চুষে খেয়ে এই সংহারক গরমে তৃষ্ণাকাতর ট্রেন-যাত্রীরা তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করছে। কুলফি খেয়ে ঝিম ধরা দেহে অতঃপর নেশাগ্রস্তের মতো ঘুমে ঢুলে পড়ছে।

‘পঞ্চাশ টাকায় সাতটা’ ‘পঞ্চাশে সাতটা’ ‘সস্তা সস্তা’ বলে হাঁকতে হাঁকতে এক মুসাম্বিওয়ালা উঠল আবাদা না  বাউড়িয়া ইস্টিশনে। ছুঁচল তার দাড়ি, গোঁফ তার কামানো, ডোরাকাটা লুঙ্গি পরনে, তার উপর কোমরে একটা গামছা জড়ানো। 

উঠেই সে কামরার পাটাতনে কাঁধের ঝুড়িটি ধপাস করে রেখে গেটের দুদিকের দুই রেল কামরার যাত্রীদের চোখের উপর ফেরিওয়ালার অভাবী ও বিক্রয়-পটু চোখের চাহনি ফেলে জরিপ করছে। তারপর―

তারপর বরেণের মনে হল, এই, এ-ই বুঝি এক্ষুনি সে কোনও ফিল্মি গান গেয়ে উঠবে, সেই, সে-ই-টা কী ? ―লে লে বাবু ছ্যায় আনা, নিলামবালা ছ্যায় আনা, যা লিবে তাই ছ্যায় আনা―

না, না। সেসব না। কোমরের গামছাটা একবার খুলে ফের জোরসে এঁটে ৪টে-৩টে লেবু দু-দুটো হাতের তালুতে  অদ্ভুত কায়দায় বন্দি করে কামরার এ মাথা সে মাথা হাঁটতে লাগল। গলায় তার সেই চেনা স্বরই ফুটছে, ‘পঞ্চাশ টাকায় সাতটা’ ‘সাতটা পঞ্চাশে’―

ততক্ষণে মুসাম্বির ঝুড়িতে হামলে পড়েছে কালো কালো ট্রেনযাত্রীদের মাথা, তার মধ্যে বরেণ কি আর নাই ? আছে,  আছে। কোনওমতে সাতটা ম্যানেজ করে মাথা উঁচু করে বলল, একটা কেটে দাও ব্যাপারি!

গরম গরম দিলখুশ, প্যাকেট প্যাকেট শোনপাপড়ি, বাদাম চাট, ঝালমুড়ি, নেলকাটার-চাবির রিং-মানিব্যাগ, আর যা যা―সবই তো ফেল, খালি ওই পানি বোতল, কুলফি বরফ, মিষ্টি মুসাম্বি, ডাবের জল।

মুসাম্বির রস পান করে বাইরে, এমনকি ভিতরেও, ওই যেখানে ট্রেন ও ট্রেনের দু ধারের ‘দিগন্তজোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে। অগ্নিশিখার মত তাহাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির প্রতি চাহিয়া থাকিলে’ সত্যি সত্যিই বরেণেরও মাথা ঝিমঝিম করে, নেশা ধরে যায়, নেশাগ্রস্তের মতো সেও ঘুমে ঢুলে পড়তে চায়।

তন্দ্রায়-ঘুমে আচ্ছন্ন হতে হতে তার মায়ের কথা এখন ভারি মনে পড়ছে বরেণের। এমন ছাতিফাটা ফুটিফাটা রোদের দিনগুলোয় মা যে কী করত অকালে বাপ-হারা তার তিন কাঁড়াল-কোঁড়ল বাচ্চা, নৃপেন-বরেণ-হরেন-কে নিয়ে! একা একাই যেন পাখির মায়ের মতো ডানা মেলে ধরে নাচাতে নাচাতে জ্বলন্ত সূর্যকে আড়াল করে রুখে দাঁড়াত।

বরেণদের মাটির ঘর, খড়ের চাল। তাও গ্রীষ্মের দাপটে খড়ের চাল তেতে উঠলে মা যে বিল-খাল কোত্থেকে জল ছেঁচে এনে বালটিন বালটিন ঢেলে খড়ের চাল ভিজিয়ে রাখত! এমনকি মাটিতে শোওয়ার হাতে বোনা খেজুরপাতার চাটাইটিও জলে ভিজে সপ সপ করত।

আর তাতেই বড় সুখে গড়াগড়ি খেত ‘ন্যাঙটা ভুটুং সাধের কুটুম’ নৃপেন-বরেণ-হরেনরা। দিনে, রাতে ঘুমিয়ে পড়ত। বিজলিবাতি বিজলি হাওয়া তখন আর গ্রামে-ঘরে কোথায় ?

তখনও নাই, এখনও নাই। ওই বড়জোর এসেছে ফৌজি-উড়াকল-ওড়া কলাইকুণ্ডায়। কলাইমুড়ি তখনও যেমন এখনও তেমন, ঘোরতর অন্ধকারময়। অন্ধকার, অন্ধকার।

‘তালিবন তার চারিভিতে’―বরেণদের সারি সারি তালগাছ আর কোথায় ? সে তো আছে যতীন-দশরথদের, আছে অনিল-সুনীল-হীরালালদের। তাও তো প্রখর দাবদাহে বরেণের মা কোত্থেকে তাল কেটে এনে ছেলেদের ‘তালশাঁস’ খাওয়ায়, থলথলে জেলির মতো।

খা বাছারা! খেয়ে এই গরমে দেহ-মন জুড়াক তোদের, শরীরে তাকত আসুক। না হলে মাঠে-ঘাটে খাটবি কী করে ?

বড় আর ছোট এখনও মাঠে-ঘাটেই খাটে, নিজেদের খেতে-খামারে না হোক অন্যের বিলে-বাতানে, দিনমজুরিতে। কেবল বরেণই ঘরছুট হয়ে ‘পাবলিক সার্ভিস কমিশন’-এ একজাম দিয়ে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক।

কাজ করে হাওড়া এসডিও অফিসে, হাওড়াতেই থাকে দু-কামরার এক ভাড়া বাড়িতে।

ওই যে একবার ঘর ছেড়ে এসেছে সে, কেরানিজীবনের হাজার রকম ব্যস্ততায় তার আর ঘরে ফেরাই হয়নি। এর মধ্যেই বিয়েশাদি, সন্তানাদি, তাদের মানুষ করা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ এতদিন বাদে বড়দাপ্রেরিত মায়ের মৃত্যুসংবাদের ‘টেলিগ্রাম’ পেয়ে শতবর্ষের রেকর্ড গরমের মধ্যেও তাকে যেতে হচ্ছে, যেতে তো হবেই নিজের মা বলে কথা, সেই মায়ের ‘কাজঘর’-এ যোগ দিতে।

একটা প্রচণ্ড হাওয়া এল, ধুলা আর আগুনের হলকা নিয়ে, যাকে বলে ঘূর্ণিঝড়, ঘুরঘুরে হাওয়া, ঘুরতে ঘুরতে। কামরার একদিককার দরজা ও জানলা দিয়ে ঢুকে কামরার যাত্রীদের ঝাপটা মেরে আরেক দিকের দরজা ও জানলা দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল মাঠ-ঘাটের দিকে।

অনেকেই দেখেছে হাওয়ার সঙ্গে নাকি আগুনের ‘ফুড়গুনি’ ছিল। ছিল, ছিল। আগুনের ছ্যাঁকা লেগেই তো ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বরেণের! আচমকা ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে সে দেখল―আকাশে উড্ডীয়মান ‘টিট্টিঙ্গে’ পাখিগুলো আগুনে-ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় হুড়ঝুড় করে ঝরে পড়ছে মাটিতে, পড়েই টাটকাটাটকি মরে যাচ্ছে।

রেললাইনের দু ধারের নয়ানজুলির জলে আগে আগে পদ্ম ফুটত, পানিফলের ব্যাপক চাষ হতো। গ্রামের মেয়েরা কোমর বেঁকিয়ে জলে বুক-পেট ভাসিয়ে ডাঁটিসুদ্ধ পদ্ম তুলত, পানিফল তুলত, গেঁড়ি-গুগলি কুড়োত। এখন নয়ানজুলিতে একফোঁটা জল নাই, আলের উপর যে দু-চাট্টা কাঁটাওয়ালা ভাবুর গাছ ছিল, তাও মরে হেজে  বিবর্ণ।

নয়ানজুলির মাটি চৌচির, ফুটিফাটা। তাই দেখে বরেণের আবারও মনে পড়ল―‘অনাবৃষ্টির আকাশ হইতে যেন আগুন ঝরিয়া পড়িতেছে।… সম্মুখের দিগন্ত-জোড়া মাঠখানা জ্বলিয়া পুড়িয়া ফুটিফাটা হইয়া আছে, আর সেই লক্ষ ফাটল দিয়া ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হইয়া উড়িয়া যাইতেছে।…’

ট্রেনটা এইবার এসে দাঁড়াল পাঁশকুড়া ইস্টিশনে। কামরায় বসে থেকেই বরেণ বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনল, কোথায় যেন অঝোরঝরে বৃষ্টি হচ্ছে! হচ্ছে তো হচ্ছেই, এক-টানা, অবিশ্রান্ত। তবে কি এতদিনে, এতক্ষণে বৃষ্টির দেবতা প্রসন্ন হলেন ?

যা দম বন্ধ করা অসহ্য গুমোট গরম, প্রাণটা বুঝি বেরিয়ে যায় যায়! টিট্টিঙ্গা-পাখিগুলো তো চোখের সামনে আকাশে উড়তে উড়তেই জ্বলেপুড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

বরেণ জানলায় মুখ বাড়িয়ে হাতের চেটো মেলে ধরে জলবৃষ্টি ঝরনের, ধুলায় ডেলায় মেঘাম্বুপাতের অনুভূতি পেতে চাইল। ও হরি, কোথায় মেঘ ? কোথায় বৃষ্টি ? ইস্টিশনের জলের ট্যাঙ্ক ভরতি হয়ে ওভার ফ্লো করে অঝোরঝরে ঝরে পড়ছে।

যেন ইচ্ছে করেই কল বন্ধ করছে না, জল অবিশ্রান্ত ধারায় পড়ে যেতে দিচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। আর তাতেই উড়ন্ত কাক-চড়ুই, আর্ত তৃষ্ণার্ত টিট্টিঙ্গা-বুলবুলি কলরব করতে করতে ডানা মেলে এসে আকাশপথেই নাগাড়ে ভিজে চলেছে।

সেই সঙ্গে ট্যাঙ্কের তলদেশে ওই যেখানে অঝোরঝরে জল ঝরে পড়ছে, সেখানে জড়ো হয়েছে বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো প্লাটফর্মের রুণ্ডু উরুণ্ডুর দল। তারা সমানে ভিজছে, নাচছে, ফুর্তিতে কলরব করছে।

মনটা উসখুস করে উঠল বরেণের। আহা, ট্রেনটা কতক্ষণ দাঁড়াবে কে জানে! না হয় একটু নেমে গিয়ে ভিজে এলেই হতো। ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে’। বনধারে ডাহি জমিনে ভুট্টা আর বরবটির বীজ পুঁততে গিয়েছি মায়ের সঙ্গে।

মা মাদা করে করে ভুট্টা আর বরবটির বীজ পুঁতছে, তার সঙ্গে আমিও হাত লাগিয়েছি। হঠাৎ কী ভেবে খানিক গাছের মতো মাথার উপর দু হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছি।

ভাবনাটা এই আর কি, উড়তে উড়তে বিচরণের পাখপাখালি গাছ ভেবে আমার হাতে এসে বসুক, বসে তার গজাল ঠোঁট দিয়ে নিজেরই পা খুঁটুক, ডানার পালকে ঠোঁট গুঁজে দিক।

পাখপাখালি নয়, একটা ‘ঝিঞ্ঝিরি বাগাডুলু’―যার অর্থ ফড়িং―উড়াকলের মতো ড্রাইভ মেরে উড়ে এসে বসি বসি করেও বসল না মাথার উপর। কান্নিক মেরে উড়ে গেল একটুর জন্য।

উড়ে যেতেই ধ্যান ভঙ্গ হল আমার। চোখ তুলে দেখি―পশ্চিম আকাশে মেঘের সমারোহ, কালো কালো মোষের পারা উঠে আসছে পশ্চিমের মূলাধার থেকে। ভয়ে ভয়ে রৌদ্রের তেজ কখন গুটিয়ে নিয়েছে তার দাপটটুকু!

চিড়বিড়িয়ে দু-এক ফোঁটা এসে যেতে না যেতেই মাকে সজাগ করলাম। মা বোধকরি প্রথমটায় গ্রাহ্য করল না। 

তারপর তো হুড়ঝুড়িয়ে এসে গেল বড় ফোঁটার বৃষ্টি। ঘোরতর তার আকার-প্রকার। গদগদিয়ে ঢালছে তো ঢালছেই। মা ততক্ষণে একদৌড়ে ঝাঁকড়া কষাফল গাছের তলায়।

আমি ঠায় দাঁড়িয়ে যারপরনাই ভিজছি। মা আমার চিল-চিৎকার করে হাঁক পাড়ছে―‘উঠে আয় মেজ, গাছতলে উঠে আয়! অকারণে ভিজিস না বাপ! ভিজলে জ্বর সর্দিকাশি হবে, সন্নিপাত।’

কে শোনে কার কথা, ভিজছি তো ভিজছি। আর বৃষ্টি দেখছি―ঘষা কাচের আবছায়া। মাকে, এমনকি অত বড় ঝাঁকড়া কষাফল গাছটাকেও আর দেখা যাচ্ছে না।

দেখতে দেখতে আরও ঘোর করে এসে গেল বৃষ্টিটা। বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। ঢালতে ঢালতে আসা, ঢালতে ঢালতে যাওয়া। আগম-নিগম তার এক আধারেই। বাও কি! বাতাস কি!

যেন তাড়িয়ে ফুঁসলিয়ে নিয়ে চলেছে ঢলঢলে মেঘগুলোকে। ঘন করে আরওই ঢালবে মনে হয়। আজ ধরা বুঝি টলটলায়মান। ডুববে, ডুববেই। এতক্ষণে ভয়ে ত্রাসে দৌড়ালাম মায়ের কাছে।

মা! মাগো!!

২.

ট্রেনটা এবার জকপুর পেরিয়ে খড়গপুর জংশন ইস্টিশনে এসে একেবারে থেমে গেল। সামনে আর যাবে না, কেননা ট্রেনটা ছিল―‘হাওড়া-খড়গপুর লোকাল, এম. ইউ. কোচ’।

এখন সূর্যটা কোথায়, মাথার উপর তাকিয়ে তাও ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না, তার কারণ মাথার উপর তাকানোও অসম্ভব বোধ হচ্ছিল।

যেন উপরে নিচে চারধারে বরফ পড়ার মতো অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। ধুলা, ধোঁয়া, তার উপর ইঞ্জিন শান্টিংয়ের একঘেয়ে ধ্বক ধ্বক ধ্বক ধ্বক একটানা আওয়াজ।

তারমধ্যেই ২অ প্লাটফর্মে নেমে কিছুটা হেঁটে ওভারব্রিজে উঠে তরতরিয়ে নেমে গেল বরেণ। কলাইমুড়ির বাস ধরতে হলে তাকে আরও কিছুটা হেঁটে পৌঁছাতে হবে খড়গপুর জেনারেল বাসস্ট্যান্ড-এ।

সেদিকেই হাঁটছে বরেণ। সংখ্যায় কম হলেও কতিপয় মানুষ যাচ্ছে আসছে তার আশপাশ দিয়েই। তবে তাদের চোখ বাদ দিয়ে সারা মুখ-মাথা গামছা বা তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। 

কেউ কেউ তার উপর হেলমেট চড়িয়ে হুস করে বাইকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু পাশে অপেক্ষমাণ যাত্রীবাহী চার চাকার গাড়িগুলো যাত্রীহীনতায় রৌদ্রে ভাজা ভাজা হচ্ছে।

মনে তো হয় আর দু-এক ডিগ্রি পারদ চড়লে গলতে শুরু করবে। বাতাসে আগুনের ফুড়গুনি উড়ছে। কাগজের ব্যানার-ফেস্টুনগুলো খড়মড়ে হয়ে পুড়ে ছিনছাতুর, ফালা ফালা হচ্ছে।

রাস্তার পিচ তো গলছেই। খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার কোনও উপায় নাই। গলগলে গরম পিচে পায়ে ফোস্কা পড়ে যাওয়ার জোগাড়। রাস্তায় একটাও কুকুর নাই, তারা বেরুচ্ছে না, পাছে গলন্ত গরম পিচে তাদের পা আঠার মতো আটকে যায়!

হঠাৎ একটা অধপতনের আওয়াজে বরেণ পিছন ফিরে দেখল, জনৈকা বৃদ্ধা পুঁটলি বগলে গলন্ত পিচে বোধকরি পা পিছলেই পড়ে গেলেন। আশপাশের লোক তাঁকে ধরাধরি করে তুলে দিল, বরেণও কিছুটা পিছিয়ে এসেছিল।

মহিলাকে একঝলক দেখামাত্রই তার আচমকা মনে পড়ে গেল―আরে, অনেক অনেক দিন আগে এক বর্ষণশ্রান্ত দিনে পি. এস. সি পরীক্ষার জন্য ‘কমপিটিশন মাস্টার’ কিনতে খড়গপুর ইস্টিশনে ‘হুইলার বুকস্টল’-এ এসে এখানেই, এই রাস্তার ধারেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এই মহিলাকেই ফুল ও ফুলের মালা বেচতে দেখেছিল না সে ?

বৃষ্টির অতিরিক্ত ধারাবর্ষণে ও ক্ষিপ্রতায় তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো কেমন যেন ফ্যাকাশে ও পাংশুটে হয়ে গিয়েছিল। ফুল কেনার একটাও লোক নাই, কে কিনবে ওই কটা কুচো ফুল আর বেলফুলের মালা ওই রেকর্ড বর্ষায় ?

কী মনে করে মালাসহ সবকটা ফুলই সেদিন কিনে নিয়েছিল বরেণ। আজ যেন তাকেই আবার দেখল ঠিক সেই জায়গাটার আশপাশেই শতবর্ষের রেকর্ড গরমে গলন্ত পিচে পা পিছলে পড়ে যেতে।

গলন্ত পিচে পা পিছলে পড়ে যাওয়া না ‘হিট স্ট্রোক’ ? আর আর পথযাত্রীদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে বরেণ বৃদ্ধাকে তো নিয়ে তুলল খড়গপুর বাসস্ট্যাডের মুখে এক মিষ্টির দোকানে!

মিষ্টির দোকানি খরিদ্দারবিহীন এহেন জ্বলন্ত অগ্নি উদগিরণকারী মধ্যাহ্ন-সময়ে দোকানের টাটে বসে ঘুমে ঢলে পড়েছিল। অকস্মাৎ একসঙ্গে এত লোকের সমুজ্জ্বল উপস্থিতি দেখে চমকে জেগে উঠল।

ঠান্ডা এক বোতল জল দিন তো!

কী হয়েছে ফুলওয়ালির ? জল দিতে দিতে দোকানি।

ফুলওয়ালি ? তবে তো ঠিকই চিনেছে বরেণ।

গরমে বোধকরি মূর্ছা গেছেন।

চোখে-মুখে জল দিতে না দিতেই বুড়ি তো জাগ্রত হয়ে বলে উঠল, না না, এই তো আমি ঠিক আছি। দোকানির কাছেই তো আসছিলাম দুপহরের খাবার খেতে। হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গেনু বাছা, তাই।

বরেণ ভাবল, কী অসাধারণ প্রাণশক্তি! সেই কবে আমার ছাত্রাবস্থায় দেখেছি ফুলওয়ালিকে! আজ এখনও সে এই প্রচণ্ড দাবদাহে ঠা ঠা রৌদ্রে বসে ফুল বেচছে। আর আমার মা কি না এই গরমেই টাটকাটাটকি মরে গেল ?

বুড়িমা, কী খাবে বল ? আজ আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি। বরেণ যেচে বলল। বলতে না বলতেই ধুলো উড়িয়ে একটা বাস এল, ‘রগড়া-মেদিনীপুর’-এর। বাসটা থামামাত্রই এক ঝাঁক পায়রা হয়তো কিছু দানাশস্য দেখে বাসের ছাদের উপর উড়ে এসে বসে গেল।

দু-এক চঁচরা খেয়েছে কি খায়নি, তাপের তাড়সে কবুতরগুলো ছটফটিয়ে চোখের সামনেই মরে গেল। কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল বরেণ।

তাকে দেখে মিষ্টির দোকানি এতক্ষণে জানতে চাইল, বাবুর কোন দিগরে যাওয়া হবে শুনি ?

বরেণ বলল, কলাইমুড়ি।

বলেন কী আইজ্ঞা ? কলাইমুড়ি ?

হ্যাঁ, কলাইমুড়ি।

না গেলেই ভালো করতেন। এখানে কলাইকুণ্ডাতেই ৫১-৫২, না জানি কলাইমুড়িতে আরও কত!

কিন্তু যেতে তো হবেই দোকানি। মায়ের ‘কাজঘর’ বলে কথা। বাস আসার আগে তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দিন তো ?

শুনতে পেয়ে ফুলওয়ালি বৃদ্ধা শোকপ্রকাশ করে খেতে খেতেই বলল, আহা রে! ছাতি-ফাটা খরার তাড়সে কাক-চিল মরে মরুক বাছা, তথাপি তুমি যাও, মা বলে কথা, একবার বৈ দুবার না।

চকিতে চোখ তুলে বরেণ যেন তার নিজের মাকেই চোখের সামনে দেখতে পেল। খেতে খেতে হাণ্ডুল-মাণ্ডুল হয়ে অর্ধেক খাবার অভুক্ত রেখেই সে উঠে দাঁড়াল। ওদিকে কলাইমুড়ি যাবার বাসটাও এতক্ষণে এসে গেছে।

হাঁ হাঁ করে উঠল দোকানদার, করেন কী আইজ্ঞা! এই ত এল বাসটা, এখনও দাঁড়াবে অনেকটা। খেয়ে যান খাবারটা।

আর খেলই না বরেণ। দুড়দাড় দৌড়ে একেবারে বাসেই উঠে পড়ল সে। ‘রোহিণী মেদিনীপুর’ বাস। বাস থেকে নেমে দু-দুটো নদী পেরিয়ে আরও কিছুটা হেঁটে তবেই না কলাইমুড়ি গ্রাম।

বাসে উঠে বরেণ দেখল, লোকজন আছে বটে। খুব বেশি না হলেও খুব কম না। তবে তারা সবাই নিদ্রিত, ঘর্মাক্ত। দর দর করে ঘামছে, তার মধ্যেও বেমালুম ঘুমাচ্ছে। মেদিনীপুর থেকে খড়গপুর―এইটুকু পথ তো মাত্র আসা! কে জানে কে কোথায় নামবে!

পুরোপুরি উষ্ণমণ্ডলের আবহাওয়া, দমবন্ধ করা প্যাচপ্যাচে গরম। বাসের ভিতরটা যেন কারখানার চুল্লির মতোই তেতে আছে। বাস চললে তবু হয়তো জানলা দিয়ে কতকটা হাওয়া আসবে।

একটা পছন্দমতো জানলা বেছে বরেণ বাসের সিটে বসে পড়ল। বসেই জানলার ভিতর দিয়ে বাইরে চোখ রাখল।

দেখতে পেল, বাসস্ট্যাডের চৌহদ্দির ওপারে সাধারণ গৃহস্থের বাড়ির বাগানের কলাগাছগুলির পাতা এই রৌদ্রে ঝলসে গিয়ে একেবারে পুড়ে খড়খড়ে। হাত দিয়ে দোক্তাপাতার মতো মসকালাই হয়তো গুঁড়ো ঝুরঝুরে হয়ে ঝরে পড়বে।

পাতা তো পাতা, তার উপর আসন্তি যাউন্তি বাসের ধুলা-ধোঁয়া, অবিরাম পোঁক পোঁক, রেলের ইঞ্জিন-শান্টিংয়ের অবিশ্রান্ত ধ্বক্ ধ্বক্ ধ্বক ধ্বক ধ্বক ধ্বক আওয়াজ জায়গার মানুষগুলোকেও যেন তাতিয়ে শুষ্ক করে রেখেছে।

তারা ধুঁকছে, হাঁপাচ্ছে। এক জায়গায় বরেণ তো দেখল, দু-দুটো পাশাপাশি বাড়ির মাঝখানের চওড়া গলিরাস্তার মুখে কতক লোকজন সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে শরীরের উপরিভাগের আবরণ খুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী যেন করছে।

শুধু কী মানুষ, এবাড়ি ওবাড়ির কার্নিশ থেকে কতক কবুতরও ভদভদিয়ে উড়ে এ দেয়াল সে দেয়াল করে চলেছে। করেই চলেছে, করেই চলেছে।

ড্রাইভার, কন্ডাক্টর বাসে উঠলে তাদেরও ডেকে দেখাল বরেণ, ওখানে কী হচ্ছে বলুন তো ?

দু জনেই হাসল। বলল, কী আর হবে, পাখপাখালি, মানুষজন হাওয়া খাচ্ছে, স্রেফ হাওয়া। আপনাদেরও হাওয়া খাওয়াব, চলুন না!

আসলে ওই দু বাড়ির মাঝখানের চওড়া গলি বরাবর কোত্থেকে যে সামুদ্রিক হাওয়ার মতো ঠান্ডা ও ঝড়ো হাওয়া আসছে! ঘর্মাক্ত মানুষজন, হা-বাতাস পাখ-পাখালি ঠান্ডা হাওয়া পেয়ে তাই খানিকটা শরীর-মন জুড়িয়ে নিচ্ছে।

সত্যি সত্যিই বাসটা যখন ফেরার পথে ওই গলির সামনাসামনি হল তখন কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে পড়ল। আর সত্যি সত্যিই ধুলমাদুল হাওয়া বাসের জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকল।

আহ, কী হাওয়া! কী হাওয়া!!

এখানেও বাস-কন্ডাক্টর বাসের পাদানিতে দাঁড়িয়ে হেঁকে চলেছে―‘রো-হি-ণী রো-হি-ণী!!’ ভায়া ‘হা-তি-গে-ড়ি-য়া!’ ‘কু-ল-টি-ক-রি!!’ ‘কু-ল-টি-ক-রি!!’

হাওয়া-খাওয়া ভিড় থেকে দু-চারজন উঠেও আসছে বাস-কন্ডাক্টরের গগন-ভেদী হাঁকডাকে। বাস আবার যথারীতি চলতে শুরু করেছে। হাওয়ার তাড়সে এতক্ষণে ঘুমন্ত  লোকগুলোও জেগে উঠেছে।

এদিকটায় রেললাইন। আগে আগে বরেণ দেখেছে লাইন পেরোতে গেলে বাসটাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, রেলগাড়ি অবিরত যাচ্ছে তো যাচ্ছে, আসছে তো আসছে।

এখন সে-হুজ্জুতি নাই। ওভারব্রিজে উঠে আই আই টি ক্যাম্পাসের গা ঘেঁষে বাসটা প্রেমবাজার, সালুয়া, ডিমৌলি হয়ে খাজরা, হাতিগেড়িয়াতে হুড়দুড়িয়ে এসে গেল।

এখানে বাসটা কিছুক্ষণ দাঁড়াবে। বেলদা কেশিয়াড়ি ভসরাঘাটের ওদিক থেকে আসা যাত্রী সংগ্রহ করে আবার ছুটবে গন্তব্যের দিকে, অর্থাৎ রোহিণী বাস-স্টপে।

খুব গরম, প্রচণ্ড দাবদাহের তেজ এখনও এতটুকুও কমেনি, বরঞ্চ এক-আধ ডিগ্রি বেড়েছে। তার মধ্যেও বাসযাত্রীরা আড় ভাঙতে বাস থেকে নেমে পড়েছে। বরেণও নামল।

এদিক-ওদিক হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে হাতিগেড়িয়া মোড়ের ধাপির উপর তেলেভাজার দোকানটায় চোখ পড়ল। আরে, ওখানেই তো ছাত্রাবস্থায় যাতায়াতের পথে কত খেয়েছে চপ-পকৌড়া আর চা।

বেহুঁশের মতো তৎক্ষণাৎ সেখানে দৌড়ে গেল সে। আরে, আরে! সেই বৃদ্ধাই তো এখনও ধাপিতে বসে আছে। এখনও চপ-পকৌড়া ভাজছে! একদৃষ্টিতে পলকহীন বরেণ তাকিয়ে আছে সেদিকে।

অকস্মাৎ একটা চিল আকাশে উড়তে উড়তে মাটিতে ধপাস করে পড়ে মুখ গুঁজড়ে মরে গেল। হতচকিত বরেণ শুনল, কে যেন বলছে, গরম, গরম। গরমে এরকম কত যে মরছে!!

কোনওক্রমে চলন্ত ‘রোহিণী মেদিনীপুর’ বাসটায় দৌড়াতে দৌড়াতে উঠে পড়ল বরেণ।

৩.

বাসটা যখন লাস্ট স্টপে থামল তখন সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর সে নিজে ছাড়া একটা যাত্রীও অবশিষ্ট নাই যে এখন বাস থেকে নামবে।

কে যে কখন কোথায় নেমে পড়েছে! তার মানে তাকে একা একাই যেতে হবে কলাইমুড়ি। বটেই তো। ‘MOTHER DIED, COME SOON. NRIPEN.’

মধ্যাহ্ন কবেই গড়িয়েছে, এখন অপরাহ্ণ। তবু রৌদ্রের তেজ ‘চিতা বহ্নিমান’। জ্বলছে দাউ দাউ। বরেণ তল্পিতল্পা নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

রাস্তায় ঘাটে একটাও লোক নাই। লু বইছে, কে আর পুড়ে মরতে ঘরের বাইরে বেরোবে ? গোটা রোহিণী গ্রামটাই বিবর্ণ, বেড়ার ধারের বাঁশঝাড়গুলি জ্বলে পুড়ে খাক, হরিদ্রাভ।

‘ঝুরো বাঁশপাতা কান্নিক মেরেছে জলে’―পুকুর, জলাশয়ে জল কোথায় যে শুকনো বাঁশপাতা জলে ঝরে পড়ে উছুক ডুবুক হবে! সেসব উপমা এখন আর চলে না।

ডুলুঙ নদীর পাড়ে যাবার জন্য রোহিণী থেকে দু-দুটো রাস্তা―একটা হাতিবাঁধি গ্রামের ডোমপাড়ার ভিতর দিয়ে নীলকুঠিকে ডাইনে রেখে, আরেকটা রোহিণীগড়ের ‘বাবুঘর’-এর উঠান মাড়িয়ে গড়কাটা খাল পেরিয়ে।

বরেণ ডোমপাড়ার রাস্তাটাই ধরল। দুধারে বট-অশ্বত্থের সারি সারি গাছ, বেশ ছায়ায় ছায়ায় যাওয়া যায়। একসময় এখানেই গড়ের জমিদারদের বড় আদরের হাতি বাঁধা থাকত দু-দুটো।

ছাত্রাবস্থায় পাশ দিয়ে যেতে-আসতে অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে মিলেমিশে হাতি দেখে সুর করে কতবার বলেছে বরেণ―

                ‘হাতি তোর গোদা গোদা পা।

                 হাতি তুই নেদে দিয়ে যা ॥’

মা রোগা টিঙটিঙে বরেণকে সদুপদেশ দিয়েছে, হাতির মাহুতকে বলেকয়ে একবার যদি হাতির পেটতলে গলে যেতে পারিস বাবা, তবে তুই মোটা হয়ে যাবি অচিরাৎ।

আর কেউ কেউ বলেছে, হাতির পেটতলে গলাগলি নয় বরেণ, যদি হাতির নাদিতে একবারটি গড়াগড়ি খেতে পারতিস তবে হাতির মতোই স্বাস্থ্যবান ও বলশালী হতিস।

মা, মাগো! হাতির পেটতলে তিনবার গলেও, হাতির নাদিতে সাত-সাতবার  গড়াগড়ি খেয়েও আমি মোটা হতে পারিনি মা, কিন্তু কেরানির চাকরি করে এই ক-বছরে বেশ মোটা হয়ে গেছি, আর তুমি মরে গেলে, আর তুমি দেখতে পেলে না, মা! মাগো!!    

দু পা এগিয়েই বরেণের ছায়ার মোহ কেটে গেল। হা ছায়া, হা ছায়া! কোথায় সেই চির পরিচিত হাতিবাঁধির রাস্তার দু ধারে সারি সারি বট-অশ্বত্থের ছায়া ? এ তো চিরহরিৎ বট-অশ্বত্থ নয়, এ তো তাদেরই প্রেতাত্মা। সব বাজে পোড়া বট, অশ্বত্থ।

হয়তো রৌদ্রেই পুড়ে গেছে তাদের পাতাপত্র, খোলনলচে। ধারেকাছে দু-চাট্টা পাখপাখালিও নাই, থাকলেও কোথায় বাসা বাঁধবে ? ডালপালাই নাই, কোথায় এনে খড়কুটা জড়ো করে রাখবে ?

নীলকুঠির ভাঙ্গা দেয়ালের আড়ালে কতকটা ছায়া ছায়া, ছায়া কী আর ? ছায়ামরীচিকা। বরেণ তবু দৌড়ুল দু দণ্ড ছায়ায় দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিতে। একসময় স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে নীলকুঠির মাঠে কত খেলেছে―ছো-কিৎ কিৎ, দাঁড়িয়াবাঁধি!

এখন সেখানে পড়ে আছে কটা সাপের খোলস, মরাহাজা শুকনো ফুলসহ চাকুন্দার ঝাড়, কাঁটাওয়ালা কটা জ্যান্ত ফণীমনসার গাছ, তায় আবার ফুটে আছে পাথরকুচির ফুল, ছেঁড়াফাটা ন্যাকড়া জড়ানো।

ইদানীং জায়গাটা পাণ্ডববর্জিত মনে করে বরেণ ত্রস্ত পায়ে ঢালাই রাস্তায় উঠে এল একদৌড়ে। ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্র মাথার উপর, এখনও আগুনের ফুড়গুনি অঝোরঝরে ঝরে পড়ছে।

বরেণ দৌড়াতে দৌড়াতেই একফোঁটা জলহীন গড়কাটা খাল, বাজে পোড়া শিমুলগাছ পেরিয়ে লবকেশরপুরের ডঙাঘাটে এসে গেল। তার সমুখে এখন ‘দুস্তর পারাবার’। এখানেই ডুলুঙ-সুবর্ণরেখা মিলেমিশে একাকার।

জল তো নাই একবিন্দুও। যেন অনন্তকাল বৃষ্টিবিহীন। শুধুই মাইলের পর মাইল বালুকাময়, বালি আর বালি। মরুভূমি আর কাকে বলে ? এটাই তো ঊষর মরু প্রান্তর। না হয় ‘থর’ ‘সাহারা’ মরুভূমির চেয়ে ছোটই হবে।

বালিয়াড়ির মাঝেমাঝে হেথা হোথা কটা ছন্নছাড়া কাঁটাকুলের গাছ, আকন্দ বনঝাড় আর দু-চাট্টা খেজুর গাছ। তাছাড়া সিংহভাগই তো বালি। বালি, বালি। সে বালি এখন ভাজা ভাজা, তাতে জল ঢাললেই হয়তো ধোঁয়া উঠবে!

ভারি চিন্তিত হয়ে বরেণ লবকেশরপুর ডঙাঘাটেই থ্যাবড়ে বসে পড়ল। মনে মন বলল, মা, আমি তোমার অধম সন্তান, আজ বুঝি আর তোমার ‘কাজঘর’-এ যাওয়া হল না। কী করে দুস্তর জ্বলন্ত মরু পেরিয়ে পৌঁছাব ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এ ?

লবকেশরপুরের ওদিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে একটা লোক আসছিল, হয়তো কোনও কাজে, হয়তো গৃহবন্দি গবাদি পশু, ছেড়ি-ছাগলের আহারের সন্ধানে।

বরেণকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, অউ গরমে যাবা নাকি সেপারে ?

যেতে তো হবেই, কিন্তু কী করে ?

রহো, টিকে দাঁড়াও। গড়ধড়ারনু উট আসবে।

উট ? মরুর জাহাজ ? এখানে ?

বিস্ময়ের অবধি নাই বরেণের! লোকটা কী বলে!

আগন্তুক গড় গড় করে বলে চলল, করবার কী আছে, লদী শুকনা, ডঙা-ডুঙি সবু বেকার। মওকা বুঝি মনা বধুক ভাড়া করি খড়পপুরনু উট আনিছেন। অখন, সকাল দুপহর বৈকাল, নোকে পৈসা দি করি উটের পিঠে চড়ি গরমে দিব্যি  এপার-সেপার করেটেন।

তার কথা শেষ হতে না হতেই সত্যিকারের উট এসে গেল। কাঁটা-খেজুরের পাতা চিবোচ্ছিল উটটা, কাঁটাওয়ালা উদ্ভিদ খেতে তারা ভারি ওস্তাদ।

আরবি ভাষায় উটের নাম ‘জামাল’, যার চার-চাট্টে পাকস্থলী, যে একসঙ্গে দুশো লিটার পর্যন্ত জল খেতে পারে, যে গরমকে থোড়াই কেয়ার করে, যার গায়ের মোটা পশম তাকে মরুভূমির প্রচণ্ড তাপ সহ্য করতে সাহায্য করে। এ দেশের এই রেকর্ড গরম তো তার কাছে তুচ্ছ !

উটওয়ালা খুব যত্নসহকারে বরেণকে উটের পিঠে তুলে দিল। এই প্রথম উটে চড়ল বরেণ, উটের পিঠে চড়েই নদী পেরিয়ে সে তার মায়ের ‘কাজঘর’-এ বাড়ি পৌঁছাল।

৪.

বরেণদের গ্রামের বাড়িটা একেবারে গ্রামের মাথায়, একটেরে, একপেশে। তিন দিকেই বাঁশঝাড়, একটা তালগাছ, একটা খেজুরগাছ।

খেজুরগাছ ? খেজুর গাছ কি ছিল ? বরেণের মনে পড়ে না। তবে উঠান পেরোলেই সমুখে দিগন্তজোড়া মাঠ আর সে মাঠের শেষে একটু গড়ানে নামলেই ‘কুমারডুবি’ জলা।

জলায় এখন এক ফোঁটাও জল নাই, তলায় একটা ব্যাঙটুনিও বেঁচে নাই, আছে কেবল জলাভরতি আ-কাটা, পাকা বোরোধান। পাকাধান কী আর, খরায় ঝরায় হলুদ হয়ে যাওয়া খড়। খড়, খড়।

আগড়া।

বাঁশঝাড়গুলোও মরা, বিবর্ণ। পাতাগুলো যেন কোনওমতে আলগা লটকে আছে, একটু নাড়া দিলেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়বে। তবে তালগাছ, খেজুরগাছ এখনও সজীব আছে, টাটকা।

তাল-খেজুর হয়তো ক্যাকটাসের মতো মরুজ উদ্ভিদ। বালির গভীরেও তাদের শিকড় অনেকদূর প্রসারিত করে জল টেনে নিতে পারে। তাই বোধহয় বেঁচে আছে।

আর ঘরের মানুষগুলো ? একজনকেও দেখতে পাচ্ছে না কেন ? সব গেল কোথায় ? দূরে হরিনাম সংকীর্তনের আওয়াজ পাচ্ছে বরেণ, হ্যাঁ, ওই তো ওই  খোল বাজছে, করতাল বাজছে, কারা যেন নামগান করছে।

তবে কি মায়ের ‘তেলখোল’ যাত্রায় যাচ্ছে সব ? ‘MOTHER DIED, COME SOON. NRIPEN’। নিশ্চয়ই যে দিন বা যে রাতে মা মারা গেছে তার পরের দিনই টেলিগ্রাম করেছে বড়দা, তারও পরের দিন কলাইমুড়ি রওনা দিয়েছে সে।

তার মানে সাকুল্যে তিন দিন। তিন দিনের দিন, তার মানে আজই তো ‘তেলখোল’ যাত্রা। পরলোকগতা মানুষটার মৃত্যুর দিন থেকে মৃতের জ্ঞাতিগুষ্টিরা অশৌচ মানে, আমিষ খায় না, গায়ে মাথায় তেল মাখে না।

তিন দিনের দিন শালপাতার দোনায় তেল ভরে কীর্তনীয়ার দল নিয়ে মিছিল করে স্নানের নিমিত্ত নদীতে যায়। নদী না থাকলে খালে যায়। খাল না থাকলে পুকুরে যায়, পুকুর না থাকলে ডোবায় যায়―

খালেবিলে নদীনালায় পুকুরে ডোবায়―কোথাও এক ফোঁটা জল নাই। আজ তবে তারা ‘তেলখোল’ যাত্রায় কোথায় যাচ্ছে ? কোথায় চলেছে ? খোল-কত্তাল, হরিনাম  সংকীর্তনের ধ্বনিও একসময় মিলিয়ে গেল।

বরেণ ঘরে তল্পিতল্পা রেখে ‘তেলখোল’ যাত্রায় সে নিজেও শামিল হবে মনে করে তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাচ্ছিল আর দেখে কি―তার মা খেজুর গাছের ওদিক থেকে একছড়া খেজুর কাঁদি নিয়ে ঘরে ঢুকছে।

মা ?

তুই এসেছিস বাবা ? এই নে একছড়া খেজুর কাঁদি! বড় কষ্ট করে তোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলাম রে!

হাউ হাউ করে বরেণ বলল, তুমি বেঁচে আছো মা ? তবে যে বড়দা ?

তার মা মলিন হাসল।

ততক্ষণে চোখের জলে বরেণের হাতের চেটো ভেসে যাচ্ছে!!

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button