গুচ্ছকবিতা : রায়হান আহমেদ তামীম

টাইপিং মিসটেক
একদিন তোমার বানান ভুল হলো।
কিংবা ভুলের নাম করে ইচ্ছেকৃত ভুল।
লোকে বলে ‘টাইপিং মিসটেক।’
কথা শেষে আমি বললাম, ‘আচ্ছা যাই ?’
তুমি রিপ্লাইয়ে লিখলে ‘জান!’
আমি জানতাম অভ্র কীবোর্ড ব্যবহারে তুমি অভ্যস্ত নও। তাই ভুল হয়েছে ভেবে কোনও রকম প্রতিক্রিয়া না জানিয়েই বিদায় নিলাম আমি। সেটা যে ইচ্ছেকৃত ভুল ছিল তা জানতে আমার অনেক দিন সময় লেগে গেল।
ব্যস্ততা ছিল ভীষণ। পড়াশোনা। টিউশন। বাবার অসুখ। আরও কত কী! মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল আমাদের। বোঝোই তো কত্ত ব্যস্ততা।
ব্যস্ততায় বেমালুম ভুলে গেলাম তোমার কথা!
ততদিনে তোমার ভীষণ অভিমান জমা হলো আমার উপর। এভাবে মানুষ ভুলে যায়!
হঠাৎ করেই তোমার ভীষণ অসুখ হল।
বাসায় পুরুষ মানুষ বলতে কেউ নেই।
পুরনো প্রতিবেশী হিসেবে আমাকে ফোনে বাসায় ডাকলেন তোমার মা।
যদিও নিতান্ত অনিচ্ছায়। আমি যেতে চেয়েও কী এক ব্যস্ততায় আটকে গেলাম। নীরেন্দ্রনাথ ডাক্তারকে পাঠালাম তোমাদের বাসায়। ডাক্তার গিয়ে তোমাকে দেখে চলে এলেন।
ব্যস্ততা সেরে এসে ডাক্তারকে শুধালাম,
‘কী খবর রোগীর ?’
আজ্ঞে মশাই, ভালো খবর। রোগী বদ্ধ বাসায় থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে। খোলামেলা ভালো বাসায় রাখলেই সুস্থ হয়ে যাবে। ‘ও আচ্ছা’ বলে মুচকি হেসে বাসায় চলে এলাম।
রাতে খাবার পর তোমাকে ক্ষুদেবার্তায় লিখলাম―
‘কী খবর ? এখন শরীর কেমন ?’
তুমি রিপ্লেতে লিখলে―
‘এখন ভালো আছি। ডাক্তার বলেছে আমাদের ভালো বাসা চাই।’
আমি বললাম, জানি তো। ডাক্তারবাবুকে দিয়ে এভাবে না বললেও হতো। আসলে তোমাদের ভালো বাসার প্রয়োজন নেই, বরং তোমার ‘ভালোবাসার প্রয়োজন’।

অ্যানাদার পার্সন
সেদিন দিনের আলো চইলা যাওয়ার পর―
বইয়া যাওয়া হিমেল বাতাস
জ্বলজ্বল করা চান্দের আলোয় ফকফকা পথঘাট। সুনসান নীরবতা, কোথাও কেউ নাই
তোমার হাতে রাখি হাত।
শীতের রাইত, হু-হু শব্দে বওয়া আউলা বাতাসে উইড়া আসা তোমার চুল, ছুঁইয়া যায় আমার মুখ
আমার অন্তর জুইড়া তখন হুলুস্থুল।
তোমার শরীরের ঘ্রাণে কেমন মাতাল মাতাল লাগে আমার, জড়াইয়া আসে চোখ ঘুমে,
আমি মাথা রাখি তোমার কান্ধে,
কনাকনা শীতেও ঘাইমা যাই তোমার ওমে।
তুমি স্বর্গ থিকা নাইমা আসা অপ্সরা
তোমার অন্তরের দরজায় বাধা পাওয়া আমার মন
তবু শেষবার কই, ‘তুমি থাইকা যাও হে প্রিয়া’―
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানাই আকুল আবেদন।
তুমি বরাবরের মতোই ভাবলেশহীন, নির্লিপ্ত
খোদা মালুম কী ভাবনা তোমার,
কোন মহাপুরুষরে নিয়া তোমার কল্পনা, ধ্যান
কোন সে চোরাবালি টানে তোমারে
কার নিকটে গচ্ছিত রাখছো তোমার মন।
আমার ‘ঘ্যান ঘ্যান’ পৌঁছায় না তোমার কানে
আমার আবেদন রেখাপাত করে না তোমার প্রাণে,
আমি হাঁপাইয়া যাই, হাঁসফাঁস লাগে আমার
কান্নায় বুক ভারী হইয়া ওঠে,
বিষাদে ভইরা যায় আমার মন। আমি আমারে সামলাই। চুপচাপ চইলা আসি সেদিন।
তুমি সেদিন আমারে শেষবার ফিরায়া দিছিলা।
যেমন খুচরা না থাকার অজুহাতে ফিরাইয়া দাও ভিখারি।
প্রত্যাখ্যাত হওয়া ভিখারি অন্যত্র হাত পাতে
অথচ তুমি জানলা না,
ফিরায়া দিলে আমার যাওয়ার মতো কোনও ‘অ্যানাদার পার্সন’ নাই।

তুমি সমাচার
তোমাকে নিয়েই লিখছি
ইদানীং অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গ্যাছো
তবু জমাট শোকের মতো বুকের
একপাশে ঠিকই বিঁধে আছো।
আজও রক্তক্ষরণ তোমার নামে।
ফিকে ফানুসে তুমি দৃষ্টি রেখে বহুদূরে
পাড়ি দিয়েছ কবেই।
খুব সস্তায় বিকিয়ে দেয়া আবেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি
আমি আজও―
করুণা করে হলেও শুধু একটিবার চোখ দিয়ে যেও।
কথা দিলাম―চোখ বেয়ে কোনও কষ্টের স্রোত নামবে না মোটেই, তুমি রোদ পড়ে যাবার আগেই, এসে ফিরে যেও, ঝাপটানো পাখির খাঁচার পাশে আরেকটিবার বোসো। তোমাকে নিয়ে ভাবব না, লিখব না বলে এক কোটি বার শপথ করেও সবকিছুতেই আবার তুমি এসে যাচ্ছ কেবলই।
———————
সচিত্রকরণ : রজত