
মূলত মন্থন করো তাকে
অনেক জ্বর গেল, ঝড় গেল।
বাদামি পাতার মতো ঝুরঝুর করে ঝরলো কিছু মানুষও।
তাহলে এবার তুমি কোথাও থেকে ঘুরে এসো।
কক্সবাজার যাও―সমুদ্রস্নান করো, মূলত মন্থন করো তাকে।
তুমি তো একা নও, সিন্দাবাদের মতো তোমারও আছে
কত লোক-লস্কর। অন্তত কাউকে নাও―রাতের ট্রেনে
যার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোতে কোনও কুণ্ঠা হবে না।
জিন্সের প্যান্ট আর শাদা শার্ট ? এই বসন্তে
ট্রেন যদি মাতলামি করে, করুক না!
ও যদি নিয়ে যায় কোনও নতুন পথ খুঁড়ে
ক্ষতি কী ?
সমুদ্রে অনেকেই যায়। জল আর ঢেউ দেখে
ফিরে আসে। বলে, কিছুই নেই,
পানি আর পানি!
তুমি যাবে সমুদ্রের কাছে।
তুমি যাবে আদিগন্ত তৃষ্ণার কাছে।
চশমা খুলে জলে নেমো। সাঁতার
জানো না বলে বিভ্রান্ত হয়ো না।
দূর থেকে ধেয়ে আসা প্রতিটি তরঙ্গশীর্ষে
ভেঙে যেয়ো, গলে যেয়ো, মিশে যেয়ো!
সমুদ্র মন্থন শেষে ফিরে এসো
তুমি এক মায়াবি নতুন!

উপার্জিত স্বস্তি
কুয়াশা ও ধোঁয়া মিশে তৈরি করেছে কী যে বিষ
কিছুই যায় না বোঝা, মৃত্যু ঘটে তাই অহর্নিশ।
এখানে ওখানে আর দূরতম ভূগোলের দেশে
একাকার মনে হয়―কোলাহলে হলাহল মেশে।
উপার্জিত স্বস্তিটুকু এমন লুণ্ঠন করে কারা ?
তাদের নিশ^াস পাই ঘাড়ে তবু তাদের চেহারা
স্পষ্ট হওয়ার আগে ধোঁয়াশা আড়াল করে রাখে
এই বাস্তবতা শুধু হেমন্তে না, শীতে ও বৈশাখে।

তবু জানি বেঁচে থাকা ভালো
করিনি যে অপরাধ তার শাস্তি পেয়েছি ব্যাপক
মাথা নিচু করে খুব সয়ে গেছি, ক্ষয়ে গেছি রোজ
অন্ধকার ছিঁড়েখুঁড়ে তবু আসে এক-কণা আলো
নিষ্পেষিত হতে হতে মনে হয়, এ আনন্দভোজ।
তুমি তা-ও কেড়ে নিলে এনে দিলে নিñিদ্র আঁধার
শ^াস রুদ্ধ হয়ে আসে তবু জানি বেঁচে থাকা ভালো
পরমার্থ নেই জেনে আর্তনাদ কখনও করিনি
কখনও কখনও ভাবি, জগদ্দল রজনী পোহালো।
শোণিতের যে প্রবাহ, নিশ্চিত গন্তব্য নেই তার
এঁকবেঁকে চলে যায়, সাপের মতোই ধরে ফণা
হঠাৎ দংশন করে কপালের ঠিক মাঝখানে
পায়ের নিচের মাটি বেছে নেয় অন্য পরগনা।
অনেকেই মরে গিয়ে বেঁচে থাকে খুব তীব্রভাবে
কেউ কেউ বেঁচে থেকে বারংবার মৃত্যুস্বাদ পাবে।

এড়িয়ে গেলে পেরিয়ে যেতে
হয়েছিল মতিভ্রম
তাই করেছি অতিক্রম
দাগ দেয়া সব সীমানা।
করেছিলে কি মানা ?
এখন বলছ সকল দায়
আমার, আমি দখলদার।
না করোনি মানা তো!
করলে কি এ মানাতো ?
যা করি সব অপকার।
বলো তো দোষ ক প্রকার ?
আমার দোষ আর তোমার দোষ―
সবটাতেই অসন্তোষ ?
বিচার তুমি করবে কীসে ?
বিষেও অমৃত মিশে
এই রসায়ন রহস্যময়―
জীবনের এক মহৎ সময়।
এড়িয়ে গেলে পেরিয়ে যেতে
ক্রুশে তোমার জীবন গেঁথে।

আমাকেই দিলে সব
এখনও কি ভোরবেলা সূর্য উদয়ের পাশে
তেলোয়াত করো তুমি কবিতা আমার ?
দিনগুলো সঙ্গে নিয়ে কোন দেশে চলে গেলে তুমি ?
সময় সোনালি নয়, পিতল তামার
রঙের রাঙতা মোড়া―কেমন নিস্তেজ মনে হয়।
কেন তবে বলেছিলে বিজয় নিশ্চিত
গুঞ্জরিত প্রহরের আর কোনও নেই অবসান
সবকিছু কেন হলো হিতে বিপরীত ?
নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলে কোনও ঘূর্ণিপাকে
কী লাভ আত্মায় যদি লেগে থাকে কাদা ?
জটিলতা বাড়িয়েছ তুমি খেলাচ্ছলে। তার দায়
আমাকেই দিলে সব, নিলে না তো আধা!

তোমাকে স্পর্শের স্বাদ
এখন আমি কী করি ?
তোমাকে স্পর্শের স্বাদ আমার আঙুলে লেগে আছে!
মনে হচ্ছে লাফাতে লাফাতে ঝাঁপাতে ঝাঁপাতে
অতলান্তিক সাগরে বেগনি দ্বীপের মাঝখানে বসে
গলা ছেড়ে গান গাই।
মনে হচ্ছে গাঙচিল হয়ে উড়ি দূরগামী জাহাজের
মাথার ওপর। সমুদ্রের তলদেশে যাই,
মুঠো মুঠো রত্ন ছিটাই।
মনে হচ্ছে বর্ণবিশ্ব মাথার ওপরে রেখে
চোরাগর্ভে ডুবে যাই আজ। এতক্ষণে
তুমি কতদূর গেলে ? বড়জোর শ্যামলীতে, কফিশপে ?
স্যান্ডউইচ পার হযে কফিমগে প্রথম চুমুক!
তুমি কি জানবে আর আমার অসুখ ?

এটুকুই, আর-কিছু নয়
মাঝেমধ্যে তুমি দূরত্ব রচনা করো।
আর তা শূন্য করে দ্যায় আমাকে,
অস্তিত্বহীন।
আমি যখন মিলিয়ে যাই
তখন আশি^নেও বসন্তের বাতাস বয়
আমগাছের মাথায় নতুন পাতা
স্বাতী নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে।
মহুয়াগাছে উঁকি দেয় কুঁড়ি
আর লেকগুলো গাছের ছায়া আর
আকাশের প্রতিবিম্ব নিয়ে
টলমল করে।
তবু দুপুরগুলোকে বড় ঔদাস্যপ্রবণ মনে হয়।
এটুকুই। আর-কিছু নয়।

বয়স দিয়েছ, প্রভু
১.
বয়স হয়েছে ঝুলে পড়ে মাংসপেশি
ক্রমে বাড়ে বলিরেখা কথা বলি বেশি।
কথায় বৈদগ্ধ্য নেই শুধু বাচালতা
বিশ্বজুড়ে গ্রাহ্য হয়ে আছে এই প্রথা।
বয়স দিয়েছ, প্রভু, কেড়ে নিয়ে রস
রাত দিন সবই তাই অলস বিবশ।
২.
পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে হীনশক্তি প্রায়
প্রকৃতিই ঢেকে রাখে সব লেফাফায়।
যারা রক্ষাকারী তারা কুক্ষিগত করে
যত্ন করে ভরে রাখে খাঁচার ভেতরে।
ডানা নেই ঝাঁপটাই বুকের পাঁজর
কেউ টের পায় না সে অন্তরের ঝড়।
৩.
বয়স দিয়েছ, প্রভু, দাওনি তো জ্ঞান
কোথাও সঞ্চিত নেই কোনও অনুধ্যান।
কতটুকু পুণ্য হলো, কতটুকু পাপ
কখনও করিনি আমি তার পরিমাপ।
আসা আর না-আসায় নেই তো তফাৎ
মিছিমিছি জুড়ে থাকি সাড়ে তিন হাত।

একা কার জন্য তুমি হলে ?
১.
আষাঢ় শ্রাবণ এলে
জলে ভরে যায় দুই চোখ
স্মৃতি আসে
মেঘের মতন ভেসে ভেসে
জলাবদ্ধ নগরে বা
ডুবে যাওয়া গ্রাম-জনপদে
তুমিও কি আসো তবে
বাজবিজুলির পরিবেশে ?
২.
তুমি এ-ই দিয়েছিলে
মনোমগ্ন ছায়াচ্ছন্ন কাল
চলিষ্ণু মেঘের দেহ
নানাবিধ ভঙ্গিতে মাতাল
একাকার হয়ে ছিলে
একা কার জন্য তুমি হলে ?
আকাশ ভূমি ও নদে
দ্যাখো কতো উথাল-পাথাল!

যদিও তোমার পাশে
পৃথিবীতে আছো তুমি তবু মনে হয় যেন নেই
ভৌগোলিক দূরত্বের, কেউ বলে, অর্থ নেই কোনও
ভার্চুয়াল মহাবিশ্বে তোমাকে তো পায় অনেকেই
পর্বতে অরণ্যে মহাপ্রাকৃতিক গান তুমি শোনো।
আমিও তোমাকে দেখি, মনে হয়―না, এ তুমি নও!
চারিদিকে নানা বর্ণ গুচ্ছ গুচ্ছ ফুটে থাকে ফুল―
দূরের পর্বতশীর্ষে কীভাবে যে গুঞ্জরিত হও
মনে হয়, মেঘপুঞ্জ―আমি দিই ভুলের মাশুল।
তোমার চিকন চোখ কাজল মাখানো যেন রাত
তোমার অপাঙ্গ যেন তার মধ্যে আদিগন্ত আলো
ঘাড় ফেরানোর ভঙ্গি টেনে আনে অনন্ত প্রভাত
এর কোনও চিহ্ন নেই সে-জগতে, অমন ধারালো।
থেকে না-থাকার চেয়ে আত্মনিপীড়ন আর নেই
যথেষ্ট সম্মুখে আসো, দূরত্বের অনুভূতিতেই।
———————-
সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক