আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : মুশাররাত

সময়ের নাট্যশালায়

মাঝরাত! ক্লান্ত চাঁদ ডুবে গেছে

কলঙ্কিনী মেঘের বুকে

হিমেল বাতাস আর বৃষ্টির সঙ্গম

হায়!

না জানি কে সহযাত্রী হলো সময়ের সাথে!

না জানি কার শেষ ইচ্ছে

সমাহিত হলো এ সময়

প্রহসন! প্রহসন! খেলো না শিশু আর

যৌবন ভিখ চায় বাঁচবার, আরও কিছুকাল।

আরও কিছুকাল সময় যদি পায়

সময়ের নাট্যশালায়

আকণ্ঠ পান করে যাবে প্রেম

প্রেমিকার হিংস্র থাবায়।

অপরিচিতা

সঙ্কুচিত হয়ে আসে পৃথিবী

কুঞ্চিত কপাল, বঞ্চিত প্রাণ―আঁধার

ভিড়ের মাঝেও একাকী হৃদয়

               বিষাদের মৌন পাহাড়

এতদিন কি এখানেই ছিলাম

এই কি সেই আপন আঙিনা,

সেই সব প্রিয় মানুষেরা!

না, না, না―সমস্বরে, কোরাসে

              মহাকালের আর্তচিৎকার।


স্বাধীনতা

তার কোনও নিজস্ব ভিটেমাটি নেই

নেই এক টুকরো বাগান যেখানে

সকাল হয় পর্তুলিকার রঙিন হাসিতে

অথবা কামিনীর মোহিনী গন্ধ ব্যর্থ যামিনী

সাজিয়ে রাখে ক্রন্দসীর জন্য

তার নিজস্ব কোনও পেয়ালাও নাই

কমলাষ্ঠ ছুঁয়ে যাতে উঠে আসে এক ফোঁটা

সবুজ চা বা ব্ল্যাক কফি, শব্দহীন

যেখানে তৃপ্তির চেয়ে ভদ্রতাই বেশি

তার কোনও সীমারেখা আদৌ নেই

নেই কোনও নো ম্যানস ল্যান্ড বা ভূমধ্যসোপান

সে পতঙ্গ বা প্রজাপতির মতো কিংবা

ধানক্ষেতের পাশে শহুরে আধুনিকার

মেদহীন দেহে সরু আলের মতো

যেখানে লাল ফ্রক পরে ঘাসফড়িং হয়ে

ছুটে চলে বালিকা

আদিগন্ত সবুজ শস্যক্ষেত বানিয়ে ফেলে

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পতাকা আর লাল সবুজের আবডালে

আমরণ বেজে চলে বাংলাদেশের আবহসংগীত

‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’…

এই তো আমার আনত নয়নে উদ্ধত স্বাধীনতা।


ভেসে থাকে একা

আর কতটা পথ পেরোলে পৌঁছানো যাবে গন্তব্যে

কোথায় বা আসল ঠিকানাটা তার

কে জানে তা কোন ভবে!

বাড়ি নাকি ঘর ঘরের ভিতর

ছড়িয়ে যা থাকে একান্ত খুব

আবার যখন বাইরে আসা

প্রয়োজনে বা পরিচিত মুখ

শৈশব থেকে কৈশোর

নাকি কৈশোর ছেড়ে যৌবন

প্রৌঢ়ত্বের নীরবতা নিয়ে

খুঁজে ফিরে যাওয়া অভিযোজন

সঠিক মাপে কোথায় আসন

বৃদ্ধ বটের হারিয়েছে সুর

ঝুড়িগুলো সব নেমেছে যখন

শিকড় থেকে অনেকটা দূর

এরপরও তো থেমে থাকে না

জীবন্ত সব চাওয়া পাওয়া

গন্তব্য কি এটাই তবে

মাটির সাথে মিলিয়ে যাওয়া!

তারপরও আছে অন্য শহর

বিশ্বাসে শুধু, কেউ চেনে না

যে দেখে সে ফেরে না বলে

জাদুর গল্প শোনা হয় না

তারপরও সব ছুটতেই থাকে

কোনও এক ঘরে ফেরা তার চাই

নির্জন ঘাটে তরী পড়ে থাকে

শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নাই।


মুখশ্রী তোমার

রোদের আরশিতে দেখতে

চেয়েছি সেদিন তোমার মুখ

খরতাপ দহন চৈত্রের কালেও

দিয়েছিল সুখ তাই

ফেলে আসা পথে তাকাইনি ফিরে

বা চিন্তিত আগামীকাল

বর্তমানেই হাত পেতে নেই নগদ

যা দেয় সকাল।

কাফকানন্দ

এমন কেউ কি আছো

বা এমন কিছু

যে লক্ষ যোজন দূরে থেকেও আমার মতোই ভাবছো

ঠিক এই মুহূর্তে আমার মতোই আকাশ দেখছে চোখ

আরেকটা চোখ আরেকজনের হোক না একটু হোক

অনেক ভিড়েও খুঁজছে কি কেউ

ধরার মতো হাত

কথার ঝাঁপি উথলে উঠে বুকেই কাটায় রাত

কথারাও চায় কথার পিঠে

ঢেউয়ের মতো কথা উঠুক

একলা মানুষ যেমনটা চায়

তার চাঁদটাও অন্যে দেখুক

যেমন দেখছে কাফকা আর ভাবছে জীবনানন্দ

একজন গাঁথে কথার মালা গদ্যেই কারও ছন্দ

তবু থাকুক এমনই কেউ, কিংবা ভাবুক এমন করে

একটা পাশের আসন ফাঁকা সেই কতটা যুগ ধরে

শোভনা নাই, ডোরাও নাই, নাই মিলেনা বা লাবণ্য

আমি দেখি গহিন চর আর ওরা জনারণ্য

পুড়ুক সকল ডায়েরি দাশের

কাফকার সব চরিত্র

তবু কত মিল ভাবনায় বিষাদ জীবন যত্রতত্র।


প্রহসন

একদিন যারা ছিল মানুষের সন্তান

আজ তারা মিশে গেছে প্রকৃতির সাথে

প্রেমিকের সাথে ভাগ করে নিয়েছে

গোলাপি চাঁদের আলো

জঠরের স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটার মুহূর্তগুলো

মুছে ফেলা হয়েছে প্রগাঢ় অনুভূতি থেকে

যে হাত একদিন শক্ত করে ধরা হয়েছিল

হারিয়ে যাবার ভয়ে

আজ স্বেচ্ছায় হারাবার লোভে

ছাড়িয়ে নিয়েছে সে হাত

স্বচ্ছন্দে কাটা হয়েছে সব বাঁধন

আলাদা জগতে পৃথক সংসার

রোমান্টিক সাহচর্যে

তারা ধারণ করবে আরেকটি প্রাণ,

আষ্টেপৃষ্ঠে তারা উপলব্ধি করবে

মায়াময় পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসা

কতটা প্রহসন

অতঃপর, খবরের শিরোনাম

বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের গলিত লাশ উদ্ধার।


রঙিন অসুখ

আহা! এতো রঙ! রঙের ঢল

তবু কেন বল

অন্ধকারে যাই তলিয়ে

যাই তলিয়ে, যাই হারিয়ে

প্রস্ফুরণে তুলে ধর

কোথায় প্রশান্তি

কমল কান্তি

প্রসন্ন চিত্ত খুঁজে ফিরি,

খুঁজে ফিরি অনন্তকাল

সাজানো সুখ

নিঃসাড় আনন্দের মতন

বাহিরে আলোর খেলা

ভিতরে ক্রন্দন

ভিতরে অস্থিরতা

অস্তিত্ব উন্মুখ

মুখিয়ে থাকে দুঃখ,

কষ্টের উৎসমুখ।


আছি আলোতেই

তুমি চলে গিয়ে ভাবো

গেছো চিরদিনের জন্য

খুব বিপরীতভাবে

হয়ে আছো কী অনন্য!

কী অদম্য তুমি

কী উচ্ছ্বাসে হাসো

কী সুন্দর তুমি

শুধু প্রেম হয়েই আসো

কী নিদারুণ সুখে

কী জ্যোতির্ময় মুখে

কী নিষ্পেষিত প্রাণে

আছো সুললিত গানে

তুমি যাও ক্ষতি নেই

আমি আছি আলোতেই।


কষ্ট পাওয়া মানুষগুলো

খুব বেশি কষ্ট জমা হলে বুকে

মানুষ কেমন নিস্পৃহ হয়ে যায়

চোখ হয় ভাষাহীন

হৃদয়টা আশাহীন

স্বপ্নহীন কেটে যায় অসহায় রাত

আঙুল কেটে রক্ত ঝরলেও একটুখানি

উহ বলে না।

খুব কষ্টে থাকা মানুষগুলোর

চারপাশে থাকে রঙের বাহার,

আলোর নাচন, ফুলের কাঁপন, কোটি

নক্ষত্রের হাতছানি

সে থাকে গাঢ় অন্ধকারে, গুটিসুটি

মেরে থাকা শুঁয়োপোকার মতো

খুব কষ্ট পাওয়া মানুষগুলো ফসিলের রূপ পায়

ভালোবাসা পেলে চুপি চুপি বুঝি

জেগে উঠতে চায়

চোখের জলে ধুয়ে দেয় তারা

মধ্যরাতের নির্জনতা

তারাদের সাথে মিতালি পাতে

শোনাতে তাদের দুঃখগাথা

খুব কষ্ট পাওয়া মানুষগুলো শূন্য হয়ে যায়

শূন্য থেকে জন্ম দেয় নতুন পৃথিবীর

সে পৃথিবীতে মানুষগুলো নিজে থাকে না আর

থাকে কষ্ট শুষে পুষ্ট হওয়া উত্তরাধিকার।

একমাত্র

আমার ব্যর্থতা―আমি কোনও কিছুতেই

অভ্যস্ত হতে পারি না

না তেল-জল রং না কবিতা

না ধূপকাঠি না শরাব

আমি কেবল তোমাতেই সুমগ্ন

আর তোমাতেই অভ্যস্ত

যেহেতু তুমিই আমার ঘোর লাগানো

অসময়ের প্রলাপ।

————–

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button