আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : আফরোজা সোমা

দুই পক্ষ

তোমার মাথার ভেতর পল্লীগীতির সুরের মতন হাহাকার

তোমার বুকের ভেতর স্বর্গের একাকী আদমের বিষণ্নতা।

তুমি বুনো ঘোটক, ক্ষেপা পবনের সাথে যার কেশরের সখ্য,

তুমি পৃথিবীর দূর কোণে সাগরতীরের বিদ্যুৎহীন এক গ্রাম

তোমার বালুতটে নিকষ অন্ধকারে মিলিত হন মানুষ ও ঈশ্বর।

তোমার মন আর তুমি ধরো না বাজি হয়ে দুই পক্ষ;

তোমার মন স্বয়ং শিব, তারে তুমি বাঁধবে যদি

আগে বলো ‘ওম নমঃ শিবায়’!


জাদুর বাক্সে লুকিয়ে থাকা গান

তোমারে কে দেবে শুশ্রুষা ?

কপালে হাত রেখে কে তোমার মাপবে জ্বরের তাপ ?

তুমি ছাড়া কার কাছে আর রাখবে জমা অভিমান, আহ্লাদ ?

দারুণ কোমল শরৎ বাড়ির দাওয়ায়, ঘাসে

যেভাবে আসে একপেশে গরিব প্রেমিকের মতন নিশ্চুপে

সেইভাবে তুমি নিজেরই কপালে খেয়ো চুমু,

ঝকমকে উজ্জ্বল রোদেলা দিন দেখে

আহ্লাদী প্রণয়ীর মতন নিজেকে বলো,

চলো আজ অফিস কামাই করি

ঘুরতে যাই নদীর ধারে;

তারপর ফিরতি পথে নিজেকে দিও কিনে

এক তোড়া দোলনচাঁপা উপহার।

তোমার পায়ের পাতায় খাবে চুমু

কল্লোলবতী দারুণ সিন্ধুতট,

তোমারে পাঠাবে চিঠি মাঠের পরে নামতে থাকা রোদ,

তোমারে শোনাবে গান

বুকের ভেতর জাদুর বাক্সে লুকিয়ে থাকা

ভরসন্ধ্যার অকৃত্রিম গ্রাম।

তুমি নিজেরে রেখো নিজের কাছাকাছি

দিও তোমার কোমল পরশখানি নিজেরে আগে;

তুমি আর ব্রহ্মাণ্ড একই সুরে বাঁধা গান

তোমারে একলা করে, কোথায় আছে তেমন সংসার!


আয়না

লোহা পিটিয়ে পাত বানাচ্ছেন কামার

মাটি পুড়িয়ে ফুলদানি বানাচ্ছেন কুমোর

রেশম বুনবেন বলে তুঁতপাতাদের

গুটিপোকার আহার বানাচ্ছেন চাষি;

ব্রহ্মাণ্ডের কামারশালায় অকরুণ হাতুড়ি দিয়ে

জীবন তোমাকে পেটাচ্ছে বলে

কেন এতো মনোক্ষুণ্ন তুমি ?

শূককীটের ডানা মেলে উড়বার সাধও

একদিন পূর্ণ হয়, যদি সে কোকুনের ভেতর

স্থৈর্য নিয়ে সাধনায় রত হয়ে থাকে।

অগ্নিতে বিহ্বল হইয়ো না তুমি,

তোমাকে নিজ হাতে পোড়াচ্ছেন ধরিত্রী মাতা

পরিপক্ক ধানের মতন মাড়াইয়ের যথার্থ ক্ষণ এলেই

মুকুরসমুখে তোমায় তিনি তুলে ধরবেন;

নিজের চেহারা যদি দেখবে তুমি

কলবের আরশিখানি সযতনে রেখো।


উত্তর

তোমার থাকা আর না থাকার মধ্যে

যদি না ফারাক কিছু থাকে

তবে এই মাহফিলে কী তোমার কাজ ?

নিজেকে কখনও করেছো জিজ্ঞেস ?

তুমি আর তোমার থাকা

তুমি আর তোমার না থাকা

দুইই যদি হয় বরাবর

তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করো

কেন তুমি এই সুধী সমাবেশে ?

বৃক্ষ প্রশ্ন ব্যতিরেকেই বাড়ে

তটিনীও ধায় কোনো জিজ্ঞাসা ছাড়াই

কিন্তু তাদের নেই ভান, ভনিতা কোনও।

বন্ধুর ডাক ভেবে যাচ্ছো তুমি যে মাহফিলে

হৃদয়ের তন্ত্রীতে সে তোমার তুলেছে টংকার ?

নাকি করছো তুমি নিজেরই সন্ধান ?

বৃক্ষ ও তটিনীর মতন

ভান ও ভনিতাবিহীন

আছে তোমার উত্তর ?


মহামায়া

এই পৃথিবীর গরিবি ধুলোয় তবু কোনও এক মায়া লেগে আছে।

বালিমাখা ওই গাভীটির পায়

রুপার নূপুর চমকায়,

চমকে চমকে ঘুঘু ডাক দিয়ে যায়

রাঙা দুপুর মধু মধু রোদে

গলে গলে যায়,

যে যারে বাসে ভালো

সে তারে পায় না জেনেও

তারা প্রেমে পড়ে কাতরায়,

একলা নিরালায় নিঝুম দুপুর

তার দেহের ভাঁজে-ভাঁজে কান্না উথলায়।

এই পৃথিবীর গরিবি ধুলোয় মহামায়া চুপিসারে

তোমারে জাগাবে বলে লুকিয়ে লুকিয়ে কত

কামনিধি, প্রেম-সরোবর হয়ে দাগ রেখে যায়।


মিলন তিয়াস

সে জাগে তৃষিত একা, সে ঘুমায় ঘোরে

কে ঘুমায় তৃষিত একা, কে জাগে ঘোরে!

আমাদের রক্তের ভেতর কে তুমি নিশিপাখি,

কে খোঁড়ো গোর ?

কে তুমি ঝিলিমিলি আলোর নদী ইন্দ্রিয় জুড়ে

কে তুমি সুখের অসুখ, নাই উপশম!

এ নদী পোয়াতি মাছ, ধীর লয়ে চলে

এ মাটি মহামায়া, বীজ থেকে জাগে।

আমি আছি তুমি আছো, রিরংসা মহান

আমি নেই তুমি নেই, ধরণী কাঁদেন।


মধুফাল্গুনের নির্বাণালাপ

দুপুর লুকিয়ে পড়েছে তোমার চোখের বিষণ্ন তারায়

এই লোক সমাগম, এতো কোলাহল

সবুজ ঘাসের ডগায় হলুদ প্রজাপতির এমন ওড়াওড়ি

সব আজ কাফকার উপন্যাসের মতন লাগছে।

বালিয়াড়িতে ডিম রেখে সাগরে ফিরে যাচ্ছে যে কাছিম,

আকুল গলায় তাকে ডাকছে কেউ, বলছে:

আমাকে বালুকাবেলায় ফেলে যেও না গো মা

ডিম থেকে ফুটতে আমি চাই না তো;

সিসিফাসের এই পাথর গড়ানো খেলা

খেলতে আমি চাই না, মা গো;

যযাতির হাজার বছরের জীবন থেকে মিলেছে দীক্ষা আমার

বাসনার আবর্তন রয়েছে শুধু, আদি-অন্ত নাই;

তুরীয়-আনন্দক্ষণে মাথার ভেতর ময়ূর নাচে,

ঝিলিমিলি আলোর নদী বইতে থাকে চেতনা জুড়ে;

তারপর থাকে শুধু সিসিফাস পাথর গড়াবার;

এ জীবন অপেক্ষারতা রাধিকা মা গো,

কৃষ্ণের দেখা কভু মেলে না কো আর;

অতঃপর আমার ফুরিয়েছে সফর এই ডিমের ভেতর,

যযাতি, সিসিফাস ও রাধিকার জনম শেষে

নির্বাণ পেয়েছি এসে কাছিম মায়ের পেটে

অতএব ডিম থেকে আমি আর ফুটবো না;

পিপীলিকা যেমতে উড়ে অগ্নির দিকে যায়

সেমতে আমি সাগরের দিকে ছুটবো না।

কাফকার উপন্যাসের মতন এই দুপুর সাক্ষী,

না ফোটা সকল ডিম নির্বাণ পাওয়া বুদ্ধ

ব্যথিত সকল মায়ের নাম রানি মায়াদেবী

সাগরমুখো অনাগত কাছিমের ছানারা সব সিসিফাস

রাধিকার মতন তারা কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কাঁদিবে।


পরিচয়

আমার ডাকনাম দিও, লোকগীতি। দিতে পারো, মেঠোসুর। নতুবা ডেকো, রাখালিয়া বাঁশি। ডাকতে পারো, বিজন দুপুর। আমার নাম হতে পারে, রাঙা চুকাই ফুল। এমনকি হতে পারে দুপুরের সঘন রোদে শুয়ে থাকা চীবররঙা খড়-বিচালি। বাঁশঝাড়ে মাঝরাতে ডেকে ওঠে যে প্যাঁচা, তার নাম আমাকে দিও; আমিই হুতোম! সাঁঝবাতি দেওয়ার সময় গোয়াল থেকে আসে যে ধোঁয়ার ঘ্রাণ, তার নামে আমাকে ডেকো, ধুনা! সন্ধ্যারতি নামটাও আমার সঙ্গে যায়। বর্ণনাতীত ব্যথার আখ্যানবাহী নামে ডাকতে যদি চাও, আমার নাম দিও, মেয়েলি গীত। যদি চাও অনেক জীবনের কাহিনি মেশানো নাম, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ বলে ডেকো। খুব ছোট, দুই অক্ষরের নাম যদি খোঁজো, আমাকে ডেকো, ঘুঘু। আর যদি হাতড়ে বেড়াও নাড়ি ধরে টান মারা কোনও নাম, তাহলে রেখো, নরসুন্দা নদীর হাওয়া।

——————–

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button