একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা : মূল : চিমামান্দা নগুজি আদিচি : অনুবাদ : নাহার তৃণা

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : আফ্রিকান গল্প
[চিমামান্দা নগুজি আদিচি (Chimamanda Ngozi Adichie)―নাইজেরিয়ান লেখক। জন্ম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। উপন্যাস থেকে শুরু করে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ। নতুন প্রজন্মের পাঠকদের আফ্রিকান সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করতে তাঁর শক্তিশালী লেখনী বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাঠক মহলের মনোযোগ আকর্ষণের পাশাপাশি বিবিধ পুরস্কার এবং সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য তিনটি উপন্যাস হলো―পার্পল হেবিস্কাস (Purple Hibiscus (২০০৩), হাফ অফ আ ইয়েলো সান (Half of a Yellow Sun (২০০৬) এবং আমেরিকান (Americanah (২০১৩)।উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প সংকলন, দ্য থিঙ অ্যারাউন্ড ইউর নেক (The Thing around Your Neck (২০০৯)। ২০১৭ সালে তাঁর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ গ্রন্থ অ্যা ফেমিনিস্ট মেনিফেস্টো ইন ফিফটিন সাজেশন্স প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালে তিনি ম্যাক আর্থার জিনিয়াস ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হন। প্রায় ত্রিশটি ভাষায় তাঁর সাহিত্য অনূদিত হয়েছে।]
চিকা প্রথমে জানালা বেয়ে দোকানের ভেতর ঢুকে শাটারটা এমনভাবে ধরল যেন তার পেছনে থাকা মহিলাটির ঢুকতে সমস্যা না হয়। দোকানটা দেখে মনে হচ্ছে দাঙ্গা শুরুর অনেক আগে থেকেই খালি পড়ে ছিল। কাঠের খালি তাকগুলো হলদে ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে। এক কোণে জড়ো করা ধাতুর পাত্রগুলোতেও ধুলোর স্তর। দোকানটা বেশ ছোট, চিকার বাড়ির কাপড় রাখার ঘরের চেয়েও ছোট। মহিলাটি ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে চিকা শাটার ছেড়ে দেয়, কর্কশ একটা শব্দ তুলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। চিকার হাত রীতিমতো কাঁপছিল, হিল তোলা জুতো পায়ে কোনও রকমে দৌড়ে বাজার থেকে এতটা পথ আসার কারণে পায়ের গোড়ালি জ্বালা করছে ভীষণ।
আত্মরক্ষার জন্য চিকা মরিয়া হয়ে যেদিকে ছুটছিল, এই মহিলা তখন যদি ‘ওইদিকে যাইও না’ বলে তাকে না থামাত এবং নিরাপত্তার জন্য দোকানটায় না নিয়ে আসত তাহলে হয়তো এতক্ষণে সে মৃতদের সারিতে পৌঁছে যেত; চিকা সেজন্য মহিলাটিকে ধন্যবাদ জানাতে চায়। কিন্তু যে মুহূর্তে সে ধন্যবাদ বলতে যাবে, মহিলাটি তার গলায় হাত রেখে বলে উঠল, ‘আয়হায়! দৌড়াইয়া আসবার কালে আমার গলার হারটা হারাইছে।’
‘আমি সবকিছু ফেলেই পালিয়ে এসেছি।’ চিকা বলল। ‘কিছু কমলা কিনেছিলাম, ওগুলোর সাথে নিজের হাতব্যাগটাও ফেলে এসেছি।’ কমলা আর ব্যাগের উল্লেখ করলেও চিকা সযত্নে চেপে যায় তার হ্যান্ডব্যাগটি বারবেরির ছিল, আসল বারবেরি ব্র্যান্ডের, যা সম্প্রতি লন্ডন ভ্রমণে গিয়ে তার জন্য মা নিয়ে এসেছিলেন।
মহিলাটি গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চিকা আন্দাজ করে সে তার গলার হার নিয়ে চিন্তামগ্ন, যেটি হয়তো প্লাস্টিকের পুথি আর এক টুকরো সুতোয় গাঁথা নিতান্তই সস্তার মালা। মহিলার প্রকট হাউসা উচ্চারণ না শুনেও চিকা বলে দিতে পারে সে উত্তরদিক থেকে আগত, তার মুখের অপ্রশস্ততা, গালে জেগে থাকা হাড়, যা সচরাচর এদিকটায় দেখা যায় না। তার ওড়না দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না সে একজন মুসলাম। ওড়নাটা এখন তার গলায় আলগাভাবে ঝুলে আছে, সেটি দৌড়াবার পূর্বে সম্ভবত তার মাথা এবং কান ঢেকে রেখেছিল।
মহিলার ওড়নাটা কালো আর কটকটে গোলাপি রঙের দীর্ঘ ফিনফিনে সস্তা কাপড়ের। চিকা ভাবে মহিলাও হয়তো তার দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে, তার গায়ের ফর্সা রঙ এবং হাতে থাকা রুপালি জপমালা, যা তার মায়ের পীড়াপীড়িতে নিতে হয়েছে, ইত্যাদি দেখে মনে করছে সে ইগবো ও খ্রিস্টান। পরে চিকা মহিলার সাথে কথা বলে জানবে হাউসা মুসলমানেরা ইগবো খ্রিস্টানদের ম্যাচেট (লম্বা ছুরি) দিয়ে হত্যা করে তাদের আঙুল থেতলে দেয় পাথর দিয়ে। কিন্তু সে এখন বলল, ‘আমাকে এখানে ডেকে আনার জন্য ধন্যবাদ। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেল আর লোকজনও সব পাগলের মতো ছুটোছুটি শুরু করল, হঠাৎ করে ওরকম পরিস্থিতিতে কী করা উচিত সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘এই জায়গা নিরাপদ।’ মহিলাটি এমন আস্তে কথা বলছিল যে ফিসফিসানির মতো শোনাল। ‘শুধু বড় বড় দোকান আর বাজার ছাড়া হেরা এইসব ছোডোমোডো দোকানে হামলা চালায় না।’
‘আচ্ছা’, ছোট্ট করে বলল চিকা। এ বিষয়ে তার সহমত কিংবা দ্বিমতের কোনও কারণ নেই, কারণ দাঙ্গা সম্পর্কে তার কিছুই জানা ছিল না।
কয়েক সপ্তাহ আগে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রের স্বপক্ষে যে সমাবেশ হয়েছিল সেখানে সে উপস্থিত ছিল এবং হাতে তরতাজা সবুজ একটা গাছের ডাল নিয়ে ‘মিলিটারি নিপাত যাক! আবাচা নিপাত যাক! গণতন্ত্র মুক্তি পাক!’ এসব স্লোগানে অন্যদের সাথে গলা মিলিয়েছিল। বোনের কারণেই তার সেখানে যাওয়া। চিকার বোন এন্নেদি সমাবেশ আয়োজকদের একজন, যে কি না হোস্টেলে হোস্টেলে গিয়ে আয়োজনের প্রচারপত্র বিলি করার পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের ‘সবার সম্মিলিত প্রতিবাদ স্বৈরশাসকের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর’ গুরুত্ব বুঝিয়েছে।
চিকার হাতের কাঁপুনি এখনও থামেনি। ঠিক আধঘণ্টা আগে সে এন্নেদির সাথে বাজারে ছিল। সে যখন কমলা কিনছিল এন্নেদি চিনাবাদাম কেনার জন্য বাজারের ঢালু দিকটায় যায় এবং তখনই হঠাৎ ইংরেজিতে, পিডগিনে, হাউসায়, ইগবোতে চিৎকার শোনা যায়। ‘দাঙ্গা লাগছে ! ভয়ানক বিপদ আসছে ! ওরা একজনকে মেরে ফেলেছে !’
চিকার চারপাশে লোকজন ছুটাছুটি শুরু করে, একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগোতে চায়, হুড়োহুড়িতে মিষ্টিআলু ভর্তি ঠেলাগাড়ি উল্টে যায়, একটু আগে যে মহার্ঘ সব্জির দরদামে ব্যস্ত ছিল মানুষ অনায়াসে তা পায়ে দলে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। চিকা যেন বাতাসে ঘাম আর ভয়ের গন্ধ পায়, সেও ছুটতে শুরু করে,বড় রাস্তা পেরিয়ে ভয় আর ত্রাসে দিকবিদিক ছুটতে, ছুটতে, এই গলি পথে এসে পৌঁছায়, তার তখন মনে হয়েছিল এই গলিটা তেমন নিরাপদ নয়, তার জন্য ভয়ানক বিপদ ওৎ পেতে আছে কোথাও, ভয়টা মন আঁকড়ে ছিল যতক্ষণ না অপরিচিত এই মহিলা তাকে দেখে থামায়।
সে আর সঙ্গের মহিলা কিছুক্ষণ চুপচাপ দোকানটার ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে, যে জানালা পথে তারা এখানে ঢোকে সেটা তুলে বাইরের পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করে, জানালার কাঠের পাল্লা বাতাসে কর্কশ শব্দ তোলে। রাস্তাটা প্রথমদিকে একেবারে শুনশান ছিল, কিছু পরে দৌড়ে আসার পদধ্বনি শোনা যায়। অবচেতনেই তারা দুজনই ঝট্ করে জানালার পাশ থেকে সরে আসে, তা সত্ত্বে চিকা একজন পুরুষ এবং একজন মহিলাকে চলে যেতে দেখল, মহিলা তার চাদরটা হাঁটুর উপর ধরেছিল, তার পিঠে একটা বাচ্চা বাঁধা ছিল। চিকা শোনে পুরুষটা ইগবো ভাষায় খুব নরম স্বরে বলছে, ‘সে হয়তো দৌড়ে চাচার বাড়ির দিকে গেছে।’
‘জানালাটা বন্ধ কইরা দাও’, চিকার সঙ্গের মহিলাটা বলল।
চিকা জানালা বন্ধ করে দেয়, আর তাতে জানালা দিয়ে ভেতরে আসা বাতাস হুট করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরের ভেতর ধুলোর পুরু স্তর যা তার চারপাশে ঘূর্ণায়মান ছিল সেটা তার দৃষ্টিগোচর হয়। দোকানের ভেতরটা এমন গুমোট এবং দুর্গন্ধময় যে বাইরের সাথে তার কোনও মিল নেই। মনে হচ্ছে খ্রিস্টমাসের সময় লোকেরা ছাগলের চামড়া ছাড়িয়ে আগুনে ছুঁড়ে দেবার পর পুড়ে যাওয়া লোম থেকে যে গন্ধ বের হয় সেরকম বিটকেলে গন্ধে চারপাশটা ভরপুর। যে রাস্তা থেকে সে অন্ধের মতো দৌড়ে এসেছিল, নিশ্চিতভাবে জানাও নেই এন্নেদি কোন্ দিকে দৌড়ে গেছে, এটাও নিশ্চিত করে জানা নেই তার পাশে ছুটন্ত মানুষটা বন্ধু ছিল না শত্রু, চিকা এটাও নিশ্চিত করে জানেনা এন্নেদি ছুটতে ছুটতে পথে থেমে গিয়ে হুড়োহুড়িতে মায়ের হাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হতভম্ব চেহারার কোনও শিশুকে কোলে তুলে নিলো কি না, এমন কি কে যে কে, আর কে কাকে খুন করছিল সেটাও তার জানা নেই।
পরবর্তীসময়ে সে দেখবে আগুনে দগ্ধ হওয়া সারিবদ্ধ গাড়ি এবং সেগুলোর দরজা-জানালায় অসংখ্য ছিদ্র। তখন তার চোখে ভেসে উঠবে ঘটনার সময় জ্বলন্ত গাড়িগুলো পিকনিকের তন্দুরি চুলার মতো শহরের মাঝে নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে জানতে পারে যে ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল যখন গাড়ি পার্কিংয়ের কাছে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা গ্রন্থের উপর গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিল একজন। যে লোকটা ইগবো ও খ্রিস্টান। রাস্তার পাশে তখন একদল লোক বসে ছিল। বসে বসে দিনভর তাস খেলায় মগ্ন থাকা সেই লোকদের চোখে ধরা পড়ে যায় দৃশ্যটা, যারা ঘটনাচক্রে মুসলমান। তারা দৌড়ে গিয়ে ওই গাড়ির ড্রাইভারকে টেনে নামিয়ে আনল। তারপর হাতের ম্যাচেট দিয়ে এক কোপে মাথাটা কেটে নিলো। কাটামুণ্ডুটা পাশের মার্কেটে নিয়ে গিয়ে অন্যদেরও ডাক দিয়ে বলে এই ব্যাটা অপমান করেছিল। লোকটার বিচ্ছিন্ন মুণ্ডু আর তার মৃত্যুর দৃশ্যটা কল্পনা করে চিকার শরীর গুলিয়ে উঠেছিল এবং সে গলগল করে বমি করতে শুরু করেছিল। তার পেট থেকে সবকিছু খালি না হওয়া পর্যন্ত থামতে পারেনি। কিন্তু এখন সে খুব স্বাভাবিক স্বরে মহিলাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘আপনি কি এখনও ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছেন ?’
‘হ’ মহিলাটি বলে। সে তার গায়ের চাদরটা খুলে ধুলোময় মেঝেতে বিছিয়ে দেয়। তার গায়ে শুধু ব্লাউজ যা বেশ চকমকে আর প্রান্তটা ছেঁড়া। সে চিকাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, ‘আসো, এইদিকে আইস্যা বসো।’
চিকা মেঝের উপর বিছানো মামুলি চাদরটা তাকিয়ে দেখে, এটা সম্ভবত মহিলার দুটো সম্বলের একটা।
আড়চোখে নিজের পরনের দামি ডেনিম স্কার্ট আর স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ছবিওয়ালা লাল রঙের টি-শার্টটা একবার দেখে নেয়; সে আর এন্নেদি এক আত্মীয়ের সাথে গরমের কয়েক সপ্তাহ নিউইর্য়কে কাটিয়েছিল সে সময় টি-শার্ট দুটো কিনেছিল। ‘না থাক আপনার চাদরটা খামোখাই নোংরা হবে’, চিকা বলে।
‘আরে কোনও অসুবিধা নাই, তুমি বসো তো। কতক্ষণ খাড়ায়া থাকবা ? এইখানে আমাগো অনেকক্ষণ আটকাইয়া থাকতে হইব’ মহিলাটি যেন চিকাকে চিন্তামুক্ত করতে চায়। অল্প সময়ে কেমন আপন স্বরে কথাগুলো বলে।
‘আপনার কি ধারণা আছে কতক্ষণ ?’
‘আইজ পুরা রাতটা হইতে পারে আবার আগামীকাল সকালও গড়াইতে পারে’।
চিকা তার হাতটি তুলে এমনভাবে কপালে রাখল যেন ম্যালেরিয়া জ্বর পরীক্ষা করছে। সচরাচর তার হাতের শীতল তালুটা তাকে এক ধরনের প্রশান্তি দেয়, কিন্তু এই মুহূর্তে তার হাতের তালু চ্যাটচেটে, ঘামে ভেজা।
‘আমার বোনটা চিনাবাদাম কিনতে গিয়েছিল, তাকে রেখেই পালিয়ে এসেছি। সে এখন কোথায় আমি জানি না।’
‘চিন্তাইও না, বইনে নিরাপদে আছে।’
‘এন্নেদি।’
‘অ্যাঁ ?’
‘আমার বোনের নাম এন্নেদি।’
‘এ-ন্ন-দি’, মহিলা নামটা পুনরাবৃত্তি করে। তার হাউসা উচ্চারণে ইগবো নামের উচ্চারণটা কেমন মোলায়েম শোনাল।
এখান থেকে চলে যাবার পর চিকাকে দেখা যাবে হাসপাতালের মর্গগুলোতের তন্ন তন্ন করে এন্নেদির খোঁজ করছে। মাত্র গত সপ্তাহেই এক বিয়েতে তোলা তার এবং এন্নেদির একটা ছবি নিয়ে সে পত্রিকা অফিসগুলোতে যাবে; যে ছবিতে তার মুখে একটা বোকাটে হাসি লেপ্টে আছে কারণ ছবিটা তোলার ঠিক আগের মুহূর্তে এন্নেদি দুম করে তাকে চিমটি কেটে বসেছিল, তারা দুবোন একই ধরনের কাঁধখোলা আঙ্কারা গাউন পরেছিল। চিকা বাজারের দেওয়ালগুলোসহ আশেপাশের দোকানে তাদের ছবিটার ফটোকপি টেপ দিয়ে সেঁটে দেবে। কিন্তু এন্নেদিকে কোথাও খুঁজে পাবে না চিকা। আর কখনও সে এন্নেদির খোঁজ পাবে না। কিন্তু এখন সে মহিলারটিকে জানায়, ‘এন্নেদি ও আমি খালাকে দেখতে গত সপ্তাহে এখানে এসেছি। এখন আমাদের স্কুল ছুটি।’
‘তোমরা কোন্ স্কুলে পড় ?’
‘আমরা লাগোস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমি মেডিসিন নিয়ে পড়ছি। এন্নেদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে।’
কথাটা বলে চিকা ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কী জিনিস সে সম্পর্কে মহিলার আদৌ কোনও ধারণা আছে কি না। সে আরও ভাবে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারটা তোলার উদ্দেশ্য কী নিজেকে ভোলানোর চেষ্টা কি না। নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করা যে এন্নেদি দাঙ্গায় নিখোঁজ হয়নি, সে কোথাও নিরাপদে আছে, হয়তো কোনও রাজনৈতিক বির্তকের সূত্র ধরে তার সহজাত প্রাণখোলা ভঙ্গিতে হেসে উঠছে। যেমন কীভাবে জেনারেল আবাচা তার পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যবহার করে আফ্রিকার দেশগুলোর কাছে নিজের বৈধতাকে জাহির করছে কিংবা সোনালি চুলের এত জনপ্রিয়তার পেছনে প্রত্যক্ষ বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব আছে কিনা ইত্যাদি।
‘এখানে খালার সাথে আমরা মাত্র একটা সপ্তাহ কাটিয়েছি; এর আগে কখনও কানোতে আসা হয়নি আমাদের, ‘কথাটা বলে পরিস্থিতি নিয়ে তার অনুভূতিটা উপলব্ধি করল চিকা। সে আর তার বোনের তো এসব দাঙ্গায় আক্রান্ত হবার কথা না। এসব দাঙ্গা হলো সংবাদপত্রের বিষয় যা তারা দূর থেকে পড়েই অভ্যস্ত। এরকম দাঙ্গা নিজেদের উপর কখনও আসেনি, এসব কেবল অন্য লোকদের মধ্যেই ঘটে থাকে।’
‘তোমার খালাও কি বাজারে আসছিল ?’ মহিলাটি জানতে চায়।
‘না, তিনি কাজে ছিলেন। তিনি সচিবালয়ের পরিচালকের পদে আছেন।’ চিকা আবারও তার হাতটা কপালে রাখে। সে নিচু হয়ে মাটিতে বসে পড়ে, স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো ওভাবে বসত না, এখন মহিলার বেশ কাছ ঘেঁষে চাদরের উপর বসে, যেন নিজের শরীরটা চাদরের উপর রেখে বিশ্রাম নিতে পারে। মহিলার গায়ে সে কেমন একটা গন্ধ পায়, যা বেশ ঝাঁজাল এবং পরিষ্কারক বার সাবানের মতো তাদের গৃহপরিচারিকা যা বিছানার চাদর ধোয়ার কাজে ব্যবহার করে।
‘তোমার খালাও নিচ্চয়ই নিরাপদে আছে, চিন্তাইও না।’
‘হ্যাঁ’ চিকা মৃদু গলায় উত্তর দেয়। তাদের এ সমস্ত কথোপকথন তার কাছে কেমন পরাবাস্তব মনে হয়, তার মনে হয় এই দৃশ্যকল্পে যেন সে নিজেকেও দেখতে পাচ্ছে। ‘আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না এমনটা বাস্তবে ঘটছে, এমন দাঙ্গা হচ্ছে।’
মহিলাটি পলকহীনভাবে সোজাসুজি সামনে তাকিয়ে আছে। তার দেহকাঠামোর সমস্তটাই লম্বাটে আর লিকলিকে, তার মেলে রাখা লম্বা পা জোড়া বেরিয়ে আছে চিকার চোখের সামনে, পায়ের আঙুলের নখে মেহেদির ছোপ।
‘এইগুলান সব শয়তানের কাজ।’ অবশেষে মহিলা তার অভিমত ব্যক্ত করল।
চিকা ভাবল দাঙ্গা সম্পর্কে এই যদি হয় মহিলাটির চিন্তাধারা, তবে তো সে তাদেরও শয়তানের দলভুক্ত ভাবছে। তার মনে হলো আহা এন্নেদি যদি এখানে উপস্থিত থাকত; সে কল্পনা করল, মহিলার এই কথা শুনে এন্নেদির পিঙ্গল চোখ জোড়া কি এক কৌতুকে জ্বলে উঠত, ঠোঁট জোড়া দ্রুত নড়ে উঠত, সে ব্যাখ্যা দিত যে দাঙ্গা শূন্যে জন্ম নেয় না, ধর্ম, জাতিসত্তা ইত্যাদি নিয়ে প্রায়শই রাজনীতি করা হয়, কেননা তখন ক্ষুর্ধাতরা একে অন্যকে হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এবং শাসক নিজে নিরাপদে থাকে। চিকার মনটা একটু খচখচ করতে থাকে মহিলা এমন ভাবনাগুলো তার মগজে ধারণ করতে পারবে কি না ভেবে।
‘তুমি কি ইশকুলে অসুখ্যা রোগীগো চিকিৎসা করো ?’ মহিলাটি জিজ্ঞেস করে। শোনামাত্র চিকা তার বিস্মিত দৃষ্টিটা এত দ্রুত সামলে নিল যে মহিলা টেরই পেল না।
‘চিকিৎসা মানে রোগী দেখার কথা বলছেন ? হ্যাঁ, গত বছর থেকে আমরা এটা শুরু করেছি। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমরা রোগী দেখি।’ কিন্তু চিকা এটা বলল না যে তারা ছয়-সাতজন মিলে রোগীর কাছে যায় বটে, কিন্তু সেটা সিনিয়র রেজিস্ট্রারের চোখ এড়িয়ে। যাতে তিনি তাকে কোনও রোগীকে পরীক্ষা করে তার রোগ নির্ণয়ের কাজ না দেয়।
‘আমি বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করি,’ মহিলাটি বলে। চিকা মহিলার গলায় বিদ্রƒপ বা অপমানের রেশ আছে কি না বুঝতে চেয়েও ব্যর্থ হলো। মহিলার কণ্ঠ ছিল যথেষ্ট শান্ত ও ঋজু, একজন মহিলা কি করে সেটা সে কেবল সপাটে জানাচ্ছে।
‘আশা করি দাঙ্গাকারীরা বাজারের ঝুপরিগুলোর কোনও ক্ষতি করবে না।’ চিকা উত্তর দিলো। সে আসলে বুঝে উঠতে পারেনি এছাড়া আর কী বলা যেত।
‘প্রত্যেকবার দাঙ্গায় হারামিরা বাজার ভাঙচুর করে।’ মহিলাটি বলল।
চিকার খুব জানতে ইচ্ছে করে মহিলা এ পর্যন্ত কতগুলো দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু সে তা করল না। চিকা এর আগের দাঙ্গা সম্পর্কে কিছু পড়েছিল কোথাও: হাউসা মুসলিম উগ্রপন্থীরা ইগবো খ্রিস্টানদের আক্রমণ করে এবং অন্যদিকে ইগবো খ্রিস্টানেরা বদলা নিতে হাউসাদের উপর সহিংস আক্রমণ চালায়। নাম ধরে দোষারোপপূর্ণ কথাবার্তায় সে যেতে চায় না।
‘মা গো! আমার বুক দুইটা মরিচের মতো জ্বলতাছে।’ মহিলাটি হঠাৎ বলে ওঠে।
‘কি ?’
‘বোঁটা দুইটা এমন জ্বালা করতাছে মরিচ ঘষা দিছে কেউ এমন লাগে।’
বিস্ময়ে গলা দিয়ে উঠে আসা বুদবুদ গিলে নিয়ে চিকা কিছু বলার আগেই মহিলা তার ব্লাউজ টেনে ধরে মামুলি কাপড়ের কালো অন্তর্বাসটার সামনের হুক খুলে ফেলে এবং স্তনজোড়া পুরোপুরি মুক্ত করার আগে ব্রার ভাঁজে রাখা দশ ও বিশ টাকার নায়রা (নাইজেরিয়ান টাকা) নোটগুলো বের করে আনে।
‘জ্বলে রে, চিড়বিড়াইয়া জ্বলতেছে,’ মহিলা বলে, এরপর নিজের স্তনজোড়া চিকার সামনে এমন ভঙ্গিতে ঝুঁঁকে ধরে যেন নৈবেদ্য পেশ করছে।
চিকা একটু সরে বসে। তার মনে পড়ে গেল এক সপ্তাহ আগের শিশু বিভাগে ডিউটি দেবার কথা। সিনিয়র রেজিস্ট্রার ডাক্তার অলুনলোয়ো সব ছাত্রকে একটা বাচ্চার চতুর্থ ধাপের হৃদস্পন্দন শোনার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে বাচ্চাটা তাদের দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকিয়েছিল। ডাক্তার তাকেই প্রথমে পাঠালেন কাজটা করতে সে রীতিমত ঘামছিল তখন, তার আত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল, সে নিশ্চিত হতে পারছিল না হৃদযন্ত্রটা ঠিক কোথায়। সে অনেক খুঁজে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাচ্চাটার নিপলের বামদিকে রাখার পর ব্ররররর..ব্রররররৃ. শব্দে রক্তের ছোটাছুটি টের পায়, তার আঙুলে পাল্স্টা টের পাওয়া যাচ্ছিল, সে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সরি সরি বলে উঠেছিল যদিও বাচ্চাটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল।
যদিও এই মহিলার স্তনবৃন্তের সাথে ওই ছেলের কোনও মিলই নেই। এটা হলো চিড়খাওয়া, আঁটো ও গাঢ় বাদামি, বৃন্তের নিচের অংশ খানিকটা হালকা রঙের। চিকা গভীর মনোযোগী চোখে সেগুলো ধরে দেখে এবং কিছু বোঝার চেষ্টা করে।
‘আপনার কি কোনও ছোট বাচ্চা আছে ?’ সে জানতে চায়।
‘হ। এক বছর বয়স।’
‘আপনার স্তনবৃন্ত বেশ শুকনো তবে তাতে কোনও সংক্রমণ নেই। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর পর নিয়মিত লোশন ব্যবহার করবেন। এবং যখন খাওয়াবেন তখন খেয়াল রাখবেন যেন স্তনবৃন্ত এবং চারপাশের বাদামি অংশটুকু শিশুর মুখের ভেতর ভালোভাবে প্রবেশ করে।’
মহিলা চিকার দিকে বেশ সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল। ‘এই প্রত্থম এরাম হইছে। আমার পাঁচজন পুলামাইয়া।’
‘আমার মায়েরও ঠিক এমন হইছিল। ছয় নম্বর সন্তান জন্মদানের পর তাঁর স্তনবৃন্তও এমন কর্কশ হয়ে যায়, কেন হয়েছিল, তিনিও তার কারণটা জানতেন না, যতক্ষণ না কোনও বন্ধু তাঁকে জানান যে তাঁর কর্কশভাব কাটাতে লোশন ব্যবহার করতে হবে।’ চিকা গড়গড় করে বানানো কথাগুলো বলে যায়। সে সহজে মিথ্যা বলে না, তবে মাঝেমধ্যে একটা দুটো বলে থাকে, মিথ্যার পেছনে সবসময়ই কোনও না কোনও উদ্দেশ্য থাকে।
সে ভাবে এই মিথ্যার পেছনে উদ্দেশ্যটা কী ? মহিলাকে তার কথা বিশ্বাস করানোর জন্য এমন একটি অতীত কাহিনি ফাঁদতে হবে যাতে সে নিজের সাথে মিল খুঁজে পায়। অথচ সে এবং এন্নেদি ছাড়া তার মায়ের আর কোনো সন্তান নেই। তাছাড়া মা বৃটেন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ঠাঁটবাটপ্রিয় ডাক্তার ইগবোগওয়ের চিকিৎসা নিতেন যাকে একটা ফোন করলেই পাওয়া যেত।
‘তোমার মা বোঁটায় কি ঘষতো ?’ মহিলাটি জানতে চায়।
‘কোকা বাটার। ওতে চিড় খাওয়া ভাব খুব দ্রুত সেরে ওঠে।’
‘অ্যাঁ ?’
মহিলাটি কিছুক্ষণ চিকাকে লক্ষ করে, এই গোপন উন্মোচন তাদের মধ্যে যেন অদৃশ্য একটা বন্ধন তৈরি করেছে। ‘ঠিক আছে আমিও ওইটা লাগামু।’ কিছুক্ষণ সে তার ওড়নাটি নাড়াচাড়া করে তারপর বলে, ‘আমি আমার মাইয়াটারে খুঁজতেছিলাম। আইজ সকালে আমরা একলগেই বাজারে গেছিলাম। বাসস্টপের ধারেই সে চিনাবাদাম বেচাবিক্রি করে, কারণ ওদিকটায় মেলা খদ্দের আসে। তখনই মরার দাঙ্গা শুরু হইল, বাজারের উপর-নিচ সবখানে খুঁইজ্যা কোথাও তারে পাই নাই।’
‘বাচ্চাটা নাকি ?’ চিকা জিজ্ঞেস করে, মহিলা তার মেয়ে সম্পর্কে বলার পরও সে বেকুবের মতো প্রশ্ন করে বসে।
মহিলা মাথা ঝাঁকায়, তার দুচোখে অসহিষ্ণুতা এমনকি খানিক ক্ষোভের ঝলক দেখা গেল।
‘তোমার কানে কী সমস্যা আছে ? শোনো নাই আমি কি বলছি ?’
‘দুঃখিত’ অপরাধী গলায় চিকা বলে।
‘বাচ্চা ঘরে আছে। এই জন আমার বড় মাইয়া। হালিমা।’ মহিলা কাঁদতে শুরু করে। সে প্রায় নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে, কান্নার দমকে তার কাঁধ ওঠানামা করে, যে কান্নায় মানুষ সান্ত্বনা খোঁজে, আমাকে ধরো, আমাকে সান্ত্বনা দাও, আমার একার পক্ষে এ শোক সামলানো কঠিন; তার কান্নাটা সেরকম উচ্চ স্বরের কান্না নয়। মহিলার কান্নাটা একান্ত ব্যক্তিগত শোকের মতো, যেন সে একটা প্রয়োজনীয় আচার পালন করছে যাতে অন্য কারও ভূমিকা নেই।
পরবর্তী সময়ে চিকার মনে হবে এন্নেদি আর তার উচিত হয়নি ট্যাক্সি নিয়ে বাজারের দিকে যাওয়া, উচিত হয়নি খালার বাড়ির এলাকা ছেড়ে প্রাচীন নগরী দেখতে বের হওয়া। তার আরও মনে হবে মহিলার মেয়ে হালিমা যদি অসুস্থ হয়ে কিংবা আলস্য করে বাড়িতে বসে থাকত, তাহলে তাকে বাদাম বিক্রি করার জন্য বাজারে আসতে হতো না।
মহিলাটি তার ব্লাউজের প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছে নেয়। তারপর বলে, ‘আল্লাহ তোমার বইন আর আমার হালিমারে নিরাপদে রাখে য্যান।’
যেহেতু চিকা পুরোপুরি নিশ্চিত নয় যে মুসলমানদের এমন কথার পর ‘আমেন’ বলার রীতি আছে কি না, তাই সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
মহিলাটি দোকানের এক কোনায় ধাতবপাত্রগুলোর কাছে মরচে ধরা একটা কল আবিষ্কার করে। হয়তো দোকানি এখানে হাতমুখ ধুতো, মহিলা জানাল চিকাকে। সেই সাথে আরও জানায় যে সরকার অবৈধ কাঠামো ভেঙে ফেলার ঘোষণা দেবার পর এই রাস্তার দোকানগুলো কয়েক মাস আগে পরিত্যক্ত হয়েছিল। মহিলাটি কলটা খোলার পর তারা দুজনই অবাক হয়ে দেখল সেখান থেকে সরু ধারায় জল বেরিয়ে আসছে। বাদামি রঙের তীব্র ভাবে ধাতুগন্ধী, গন্ধটা ইতোমধ্যে চিকার নাকে লেগেছে। জলের ধারা বয়েই চলেছে
‘আমি হাতপা ধুইয়া নামাজ পড়ব।’ মহিলাটি বলল। এখন তার গলারস্বর বেশ উঁচু এবং এই প্রথমবারের মতো সে হাসে, তার সমান আকারের দাঁতের সারি দেখা যায়, সামনের দাঁতটায় বাদামি ছোপ ধরা। টোল পড়ায় তার গাল দুটো খানিকটা ভেতরে ঢুকে গেছে, টোলের গর্তে দিব্যি অর্ধেক আঙুল ঢুকে যেতে পারে, ওরকম চিমড়ে মুখে যেটা বেশ বেমানান ঠেকে। মহিলা যেনতেনভাবে কলের পানিতে তার হাতমুখ ধুয়ে ফেলে এবং ঘাড় থেকে ওড়নাটা খুলে মেঝেতে রাখে। চিকা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
সে জানে মহিলা এখন তার হাঁটুর উপর বসে মক্কার দিকে ফিরে নামাজ পড়ছে, কিন্তু সে তাকাল না ওদিকে। এটা হলো মহিলার গোপন অশ্রুপাতের মতো, একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়, তার ইচ্ছে করছিল দোকানটা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। অথবা সেও প্রার্থনায় যোগ দিতে পারত, ঈশ্বরে আস্থা রাখতে পারত, একটি সর্বশক্তিমান সত্তার অস্তিত্বকে অনুভব করত পারত দোকানের ভেতর। তার মনে পড়ে না ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাসটা কখনও পরিষ্কার ছিল, এ যেন বাথরুমের আয়নায় জমা বাষ্পের মতো অস্বচ্ছ একটা বিষয়, সে মনে করতে পারে না সে কখনও সেই ধোঁয়াশা পরিষ্কারের চেষ্টা করেছিল কি না।
চিকা তার হাতের জপমালাটা স্পর্শ করে। মাকে খুশি করার জন্য চিকা কখনও এটা তর্জনীতে কখনও বা কড়ে আঙুলে জড়িয়ে রাখে। এন্নেদি তারটা পরে না, একবার চাপা হেসে সে বলেছিল, ‘জপমালা আসলেই জাদুকরি, হরেক রঙের মিশেল, তবে আমার এটির কোনও প্রয়োজন নেই, ধন্যবাদ।’
পরে দেখা যাবে চিকার পরিবার এন্নেদি কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে আছে সে খোঁজ পাওয়ার জন্য একের পর এক প্রার্থনা সভার আয়োজন করবে, তবে সেটা কখনই এন্নেদির আত্মার শান্তি কামনা ধরনের কোনও ব্যাপার হবে না। অন্যদিকে চিকা ধুলো জমা মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনায় মগ্ন মহিলাটির কথা ভাববে এবং সে তার মনোভাব বদলে মাকে বলবে এভাবে প্রার্থনাসভা করা অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়, এতে কেবল চার্চের পকেট ভারী হয়।
মহিলাটি নামাজ শেষ করে উঠলে চিকা নিজের ভেতর অদ্ভুত রকমের উদ্যম অনুভব করে, তিনঘণ্টারও বেশি সময় কেটে গেছে এবং সে কল্পনা করে দাঙ্গা পরিস্থিতি এখন শান্ত, দাঙ্গাকারীরা দূরে সরে গেছে। তাকে চলে যেতে হবে, তার বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার, এন্নেদি আর খালা, তারা যে ভালো আছে সে খবরটাও জানা জরুরি।
‘আমার যাওয়া দরকার।’ চিকা বলে।
মহিলার মুখে আবারও অসহিষ্ণু গাঢ় ছায়া দেখা দেয়, ‘বাইরের বিপদ কাটে নাই এখনতরি।’
‘আমার মনে হয় তারা চলে গেছে। ধোঁয়ার গন্ধও এখন আর পাচ্ছি না।’
মহিলা কিছু বলে না, মেঝের চাদরের উপর চুপচাপ গিয়ে বসে, চিকা কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ করে,
হতাশাবোধে আক্রান্ত হয় কেন জানা নেই, হয়তো সে মহিলার কাছ থেকে ইতিবাচক কিছু শোনার আশা করেছিল, কিছু একটা।
‘আপনার বাড়ি কত দূরে ?’ চিকা জানতে চায়।
‘মেলা দূর। আমারে দুইটা বাস নিতে হয়।’
‘খালার ড্রাইভারটিকে নিয়ে ফিরে এসে আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।’ চিকা বলে।
মহিলা দৃষ্টি দূরে ছড়িয়ে নিরুত্তর থাকে। চিকা ধীর পায়ে হেঁটে জানালার কাছে যায় এবং সেটা খুলে দেয়। চিকা আশা করেছিল, মহিলা তাকে থামাতে চাইবে, অত হুটাপাটি করে জানালা না খুলে ফিরে আসতে বলবে। কিন্তু মহিলা কিছুই বলল না, চিকা জানালা বেয়ে বেরিয়ে আসার সময় সে কেবল একজোড়া দৃষ্টির শীতলতা তার পিঠে অনুভব করল।
বাইরে এসে চিকা নীরবতায় মোড়া পথের দিকে তাকাল। ঢলে পড়া সূর্যের ম্লান আলো চারপাশটায় কেমন একটা অবসন্নতা লেপ্টে দিয়েছে। চিকা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখল, সে ঠিক কোন দিকে যাবে সেটা ঠাহর করে উঠতে পারল না। মনে মনে সে প্রার্থনা করে জাদুবলে, ভাগ্যগুণে, কিংবা সৃষ্টিকর্তার দয়ায় যেন একটা ট্যাক্সি এসে উপস্থিত হয়। প্রার্থনায় সে আরও চাইল যে, ওই ট্যাক্সির ভেতর যেন এন্নেদিও থাকে, দেখামাত্রই তাকে খুব বকুনি দিয়ে জানতে চাইবে এতক্ষণ সে কোন চুলোয়ও ছিল, তাকে নিয়ে তারা সবাই চিন্তায় অস্থির। বাজারের দিকে যাওয়ার দ্বিতীয় পথটির শেষ পর্যন্তও যাওয়া হয়না চিকার, একটা মৃতদেহ চোখে পড়ে তার। লাশটির অস্তিত্ব সে প্রথমে প্রায় বুঝতেই পারেনি, হেঁটে খুব কাছাকাছি যাওয়ার পর উত্তাপ অনুভব করে বুঝতে পারে ওটা কারও মৃতদেহ, যেটা খুব বেশিক্ষণ হয়নি পোড়ানো হয়েছে। গন্ধটা উৎকট, মাংস পোড়ার এমন গন্ধ সে ইতঃপূর্বে কখনও পায়নি।
পরবর্তী সময়ে যখন চিকা তার খালার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সামনে একজন পুলিশকে নিয়ে সমগ্র কানো এলাকা চষে ফেলবে, তখন সে দেখবে পথে পথে পড়ে থাকা লাশগুলো, অনেকের শরীর পুরোপুরি দগ্ধ হয়েছে, পড়ে আছে রাস্তার ধারে, যেন কেউ তাদের সেখানে ঠেলে দিয়েছে, সোজা করে সারিবদ্ধ করে সাজিয়ে রেখেছে। তার চোখ পড়বে উপুড় হওয়া ফুলেফেঁপে ওঠা একটি নগ্ন লাশের দিকে, লাশটি দেখে বুকে একটা ঘা লাগবে এটা ভেবে যে সে কি ইগবো নাকি হাউসা, খ্রিস্টান নাকি মুসলমান, ওই ঝলসে যাওয়া মাংসপিণ্ড থেকে তা বোঝা কিছুতে সম্ভব নয়। সে বিবিসি রেডিওতে শুনবে কত মানুষ নিহত হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত দাঙ্গাটি―‘ধর্মীয় উত্তেজনার আড়ালে জাতিগত উন্মাদনা চাপা পড়ে যায়।’ নির্মোহ কণ্ঠে সংবাদ পাঠকটি সেটি পড়ে যাবে। ক্রোধে লাল হয়ে রেডিওটা ছুড়ে বাইরে ফেলে দেবে চিকা। কীভাবে এতগুলো লাশ, এতগুলো মানুষের মৃত্যু মাত্র কয়েকটি গৎবাঁধা শব্দ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো! অথচ এই মুহূর্তে তার চোখের সামনে পোড়া লাশগুলোর উত্তাপ এতই কাছাকাছি, এতই স্পষ্ট, এতটাই বাস্তব যে সে আর স্থির থাকতে পারল না। সে তৎক্ষণাৎ ঘুরে সবেগে দোকানের দিকে ছুটতে বাধ্য হলো। দৌড়ানোর সাথে সাথে সে পায়ের নিচের অংশে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। সে দোকানে পৌঁছে জানালায় ধাক্কা দেয়, যতক্ষণ না মহিলা জানালা খুলল ততক্ষণ পর্যন্ত সে জানালা ধাক্কাতেই থাকল।
জানালা বেয়ে ভেতরে ঢুকে চিকা মেঝেতে বসে এবং স্বল্প আলোয় তীক্ষè চোখে তার পা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত দেখে। তার দৃষ্টিটা স্মৃতি-প্রকোষ্ঠে ঘুরপাক খায়। রক্তটা দেখতে কেমন বেমানান, যেন কেউ পিচকারি দিয়ে তার উপর টমেটো পেস্ট ছিটিয়ে দিয়েছে।
‘তোমার পায়ে রক্ত’, মহিলাটি নিস্তেজ গলায় বলে। সে তার ওড়নার শেষ প্রান্তটা ট্যাপের পানিতে ভিজিয়ে চিকার পায়ের ক্ষত মুছে দেয়, তারপর সেটা চিকার পায়ের চারপাশে পেচিয়ে গোড়ালির কাছে গিঁট বেঁধে দেয়।
‘আপনাকে ধন্যবাদ,’ চিকা বলে।
‘তুমি কি টয়লেটে যাইতে চাও ?’
‘টয়লেট ? না।’
‘ওইখানে অনেকগুলান পাত্র আছে, ওইগুলা আমরা টয়লেটের কাজে ব্যবহার করতে পারি,’ মহিলা বলল চিকাকে। সে একটি পাত্র নিয়ে দোকানের পেছনটায় চলে যায় এবং খানিক পরে বিজাতীয় একটা গন্ধ চিকার নাকে এসে ঝাপটা দেয়, গা গুলানো গন্ধটার সাথে ধুলো আর ধাতব জলের গন্ধ মিশে চিকাকে অসুস্থ করে তোলে, তার বমি পায়। দমচাপা একটা অস্বস্তি নিয়ে সে চোখ বন্ধ করে।
‘লজ্জার কথা আর কী বলি, পেটটা খারাপ হওয়ার আর সময় পাইলো না, আইজই সব হইতে হইব,’ চিকার পেছন থেকে মহিলা কথাগুলো বলল। জানালা খুলে সে পাত্রটা বাইরে রাখল। তারপর ট্যাপ খুলে হাত ধুয়ে ফিরে এসে সে আর চিকা পাশাপাশি নিঃশব্দে বসে থাকে।
কিছুক্ষণ পর দূর থেকে ভেসে আসা একটা কর্কশ কণ্ঠের জপ শুনতে পায় তারা, চিকার মুখে কোনও শব্দ যোগায় না। মহিলাটি যখন মেঝেতে শরীরটা ছেড়ে শুয়ে পড়ে দোকানটা তখন পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে গেছে, তার শরীরের উপরের অংশ চাদরের উপর বাকিটুকু ময়লা মেঝেতে পড়ে থাকে।
পরবর্তী সময়ে, চিকা গার্ডিয়ানে পড়বে যে ‘উত্তরের প্রতিক্রিয়াশীল হাউসা-ভাষী মুসলমান কর্তৃক অমুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে।’ দুঃখের মাঝেও চিকা ভাববে যে সে এক মহিলার স্তনবৃন্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল এবং তার নমনীয় আচরণ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল, যে একজন হিউসা এবং মুসলমান।
রাতে তেমন ঘুম হয় না চিকার। জানালা শক্তভাবে বন্ধ থাকায় ঘরের বাতাস কেমন গুমোট, পুরো, দানাদার ধুলো যেন হামা দিয়ে তার নাকে এসে লাগে। সে লাগাতার পুড়ে কয়লা হওয়া মৃতদেহটা জানালার ওধারে আলোর বলয়ের মধ্যে ভাসতে দেখে, যেটা তার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে দেখায়। অবশেষে সে দেখল মহিলাটি ঘুম থেকে উঠে জানালাটা খুলে ঘরের ভেতর ভোরের নিষ্প্রভ নীলচে আভা ঢোকার পথ করে দিচ্ছে। জানালা বেয়ে বাইরে যাওয়ার আগে সে কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। চিকা পায়ের শব্দ শুনতে পায়, কিছু মানুষ হেঁটে চলে যায়। সে শুনতে পায় মহিলা কাউকে ডাকছে, চেনা কারও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য গলার স্বর আরও উঁচুতে তুলে হাউসা ভাষায় দ্রুতলয়ে মহিলা কী বলল, সেটা চিকার বোধগম্য হলো না।
জানালা বেয়ে মহিলাটি দোকানে ফিরে এল। ‘বিপদ কাটছে। ওইটা আবু। অয় খাবার বিক্রি করে। দোকানের কী হাল হইছে দেখতে গেল। সবখানে অহন পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিয়া খাড়ায়া আছে। সেনাবাহিনীও নাকি আসতেছে। সেনাবাহিনীর ব্যাডারা কাউরে হয়রানি করার আগেই আমি এইখানথে যাইগা।’
চিকা ধীরেসুস্থ উঠে দাঁড়িয়ে হাত পায়ের আঁড় ভাঙল; তার গাঁটে ব্যথা হচ্ছে। খালার বাড়ি গেটেড স্টেটে যেতে হলে চিকাকে পুরোটা রাস্তাই হেঁটে যেতে হবে, কেননা পথে এখন কোনও ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, সেখানে শুধু আর্মির জিপ আর যত্রতত্র দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের স্টেশন ওয়াগান। ফিরে গিয়ে হয়তো সে দেখবে তার খালা হাতে পানির গ্লাস নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে পায়চারি করছেন আর ইগবো ভাষায় অনবরত বিড়বিড় করছেন, ‘কেন আমি তোমাকে আর এন্নেদিকে বেড়াতে আসতে বলেছিলাম। কোন দুর্বুদ্ধিতে আমি এমন কাজ করলাম।’ চিকা গিয়ে খালার কাঁধ জাপটে ধরে সোফায় নিয়ে বসাবে।
চিকা পায়ে বাঁধা ওড়নাটা খুলে পাটা বেশ জোরে ঝেড়ে নেয় যেন শুকনো রক্তরেখা ঝরে পরে, ওড়নাটা সে মহিলাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘ধন্যবাদ।‘
‘খুব ভালো কইরা পাও ধুইয়া নাও। তোমার বইনরে আমার দোয়া দিও, পরিবাররে সালাম।’ কোমরে চাদরটা জড়াতে জড়াতে মহিলাটি বলল।
‘আপনার পরিবার-পরিজনকেও আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। ছোট বেবি আর হালিমাকে আদর বলবেন।’ চিকা বলে।
পরে, বাড়ি ফেরার পথে একটা পাথর খণ্ড যাতে রক্তের দাগ শুকিয়ে তামাটে হয়ে গেছে, সেটি ভয়াবহতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বুকে তুলে নেবে। পাথরখণ্ডটা আঁকড়ে ধরার পর অদ্ভূত এক ঝলক অনুভূত হবে এবং তৎক্ষণাৎ চিকা বুঝে যাবে এন্নেদিকে সে আর খুঁজে পাবে না, তার বোন চিরদিনের জন্যই হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখন, সে মহিলার দিকে ফিরে বলল, ওড়নাটা কি আমি নিজের কাছে রাখতে পারি ? আবার হয়তো রক্ত পড়তে পারে।’
মহিলাটি তার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে, যেন চিকা কী বলেছে সে বুঝেনি; তারপর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। হয়তো তার মুখে অনাগত শোকের ছায়া খেলে যায়, কিন্তু সে মৃদু হাসে, চিকার হাতে ওড়নাটা ফিরিয়ে দেবার আগে মুখে বিভ্রান্ত এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে ঘুরে জানালা বেয়ে বেরিয়ে যায়।
পাদটীকা: গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র দুটি দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তাদের সামাজিক অবস্থানও ভিন্ন। সেটি উপস্থাপনের জন্য একটি চরিত্রের মুখে মূলভাব অক্ষুণ্ন রেখে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে।
শিকাগো থেকে
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ