ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, আমেরিকা : মূল : জন ও কিলেনস : অনুবাদ : বিপ্লব বিশ্বাস

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : আফ্রিকান গল্প
[জন ও কিলেনস―জন্ম জানুয়ারি ১৮, ১৯১৬। মৃত্যু অক্টোবর ২৭, ১৯৮৭। আফ্রিকান-আমেরিকানদের নিয়েই তিনি লেখালেখি করেছেন। তস্র বাবা তাকে ল্যাংস্টন হিউজেসের লেখা পড়িয়েছেন। মা পড়িয়েছেন কবিতা। আর ঠাকুরমা তাকে শুনিয়েছেন আফ্রিকানদের পুরাণ, গ্রামীণ রূপকথা। তাঁর প্রথম উপন্যাস―Youngblood, দ্বিতীয় উপন্যাস And then we heard the thunder। এছাড়া লিখেছেন গল্প, নাটক, চিত্রনাট্য, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ।]অন্যসব নিগ্রো সৈনিকের সঙ্গে লম্বা মাঝপথ ধরে মার্চ করতে করতে এগোনোর সময় জো’র গভীর চোখ দুটি পাগলের মতো ক্লিয়োকে খুঁজতে লাগল। সারিবদ্ধ সেনাদের দিকে ছুটে এসে আপনজন মহিলারা কেঁদে, হেসে নিজ নিজ পরিজনদের চুমু খেয়ে বিদায় জানাতে থাকল। কিন্তু ক্লিয়ো কোন চুলোয় ?
তার পাশেই হাঁটছে বিশালবপু লিউক রবিনসন যার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে বেবি রুথ ক্যান্ডির কার্টনের বিজ্ঞাপন থেকে তাকে খুঁটে আনা হয়েছে। কিন্তু জো’র প্রত্যাশী চোখ দুটি রাস্তার দুপাশের সিভিলিয়ানদের মধ্যে ওপর―নিচ করে চলেছে। সে এখানেই কোথাও না কোথাও আছে; যে কোনও মুহূর্তে ভিড় ঠেলে শান্তভাবে বেরিয়ে জো নৌকায় পৌঁছনো অবধি তার পাশাপাশি হাঁটবে। ওর মনে ক্লিয়োর একটি তাৎক্ষণিক ছবি আঁকা হয়ে গেল, ঠিক যেমনটি গতরাতে ছেড়ে আসার সময় তাকে দেখাচ্ছিল। সে যখন বাইরে এল রাতের ক্যালিফোর্নিয়ার জোর হাওয়া তার গরম শরীরে বিঁধছিল আর তখনই সে ঘুরে তাকাল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ক্লিয়োর একটি ছোট্ট বিদায়ী হাসমুখ দৃকপাতের আশায়।
গতরাতে দুই-বাই-চারের ছোট্ট ঘরটিতে বসে তারা কাটিয়েছিল যেখানে গত তিন মাস ছিল আর যেখানে নড়াচড়ার জায়গা ছিল খুবই কম। জো ঘরটি ভাড়া নিয়ে ক্লিয়োকে আসার জন্য বলেছিল যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় এসে সে জানল, তাদের দলটাকে দ্রুত জাহাজে করে কোরিয়ায় পাঠানো হবে আর তাই তারা বেপরোয়া ঢঙে একাত্ম প্রাণবন্ততায় সেখানে বাস করেছিল যেন জীবনভর সেখানেই কাটানোর চেষ্টায় অবিচল থাকবে। কিন্তু গতরাতে বিশাল লোহা―খাটটির পাশে বসে, সারারাত কথা বলে, পোর্টেবল রেডিয়োটি অমনোযোগী অবস্থায় শুনতে শুনতে অন্য যে কোনও রাতের মতোই ভেবে কাটিয়ে দিলো―সিনেমার অভিনয় যেন।
সন্ধ্যা খানিক গড়ালে ক্লিয়োকে জিজ্ঞেস করল জো, ‘আজকাল ছোট্ট জো কেমন করছে ?’
নিজের তলপেটের দিকে তাকাল ক্লিয়ো। ‘ওহো, পল জো একটা বল পেয়েছে যেন।’ এই বলে মৃদু হেসে সে জো’র হাতটি নিয়ে তার পেটে রাখে; জো সন্তানের নড়াচড়া বুঝতে পারে, অনুভব করে তার প্রাণ―স্পন্দন। তাদের দুজনের জীবন―তার আর ক্লিয়োর … আর সে চলে যাচ্ছে দূরে―সন্তানের কাছ থেকে আর ক্লিয়োর থেকেও, হয়তো চিরকালের জন্য।
ক্লিয়ো বলল, ‘ডার্লিং, সে তোমাকে বিদায় জানাতে চেষ্টা করছিল।’ এই বলে নিশ্চল বসে সে তার বলা কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল এবং তারপর হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়ল।
সে জো’র বাহুবদ্ধ আর তার কাঁধে ঝাঁকানি হতে লাগল। ‘এটা ঠিক নয়! ওরা কেন তাদের নিয়ে যাচ্ছে না যাদের বিয়ে―থা হয়নি ?’
জো তাকে নিজ শরীরের সঙ্গে লেপ্টে ধরল, তার গলাজুড়ে এখন একান্ত পূর্ণতা। ‘এই, কী হচ্ছে কী ? কাঁদে না সোনা। এইসব কথা বোলো না। তুমি কী চাও… ? দেখ, আমাদের ছোট্ট জো জন্মানোর আগেই আমি ফিরে আসব।’
‘তুমি আর ফিরে নাও আসতে পার। ওরা সেখানে আমাদের বহু ছেলেকে হত্যা করে চলেছে। ও, জো, জো, ওরা কেন আবার একটা যুদ্ধ বাধাতে যাচ্ছে ?’
এসব শুনে কর্কশ গলায় জো বলল, ‘তুমি কি বড় জো’র চিন্তা না করে থাকতে পারছ না ? সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। তুমি বরং নিজের আর ছোট্ট জো’র দেখভাল করো। এটাই এখন তোমার কাজ।’
‘তুমি ওখানে কোনও ঝুঁকি নিতে যেয়ো না। হিরো সাজতে যাবে না একদম।’
জো জোর করে ক্লিয়োকে হাসানোর চেষ্টা করে; তাকে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে। এসব সাতপাঁচ আজগুবি ভাবনা মন থেকে মুছে ফেলো।’
সে জোর করে কান্না থামিয়ে চোখমুখ মুছে নিল। বলল, ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না জো, এসব নিগ্রো (আফ্রো―আমেরিকি) সেনাদের যুদ্ধে কী লাভ―বিশেষ করে অন্যান্য নিগ্রো মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ?’
‘সোনামণি’, নরম স্বরে বলল জো, ‘অন্য যে কোনও সেনাদের মতোই যুদ্ধ আমাদের করতেই হবে। আমরা বাইরের দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারি না।’
এ কথায় ক্লিয়ো একদৃষ্টে তাকিয়ে মাথা নাড়ল শুধু। ‘দেখো’, জো বলল, ‘যুদ্ধ থেকে ফিরে আমি কলেজের পড়া শেষ করব। আমি আইনজীবী হব। সেই কারণেই আমি লড়াই করছি।’
ক্লিয়ো যেন তার কথা শোনেইনি এমনভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। ‘আমি জানি না জো। হয়তো তুমি আমি আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠেছি বলে। আমার যখন চার, বাবা মারা গেল। মা জীবনভর শ্বেতকায়দের বাড়ির রাঁধুনি হয়েই কাটিয়ে দিলো। আমি কোনওমতে হাইস্কুলের পড়া শেষ করলাম। তুমি বেশির ভাগ নিগ্রো ছেলেদের চাইতে ভালো অবস্থায় বেড়ে উঠেছ।’ এই বলে ক্লিয়ো ক্লিনেক্স টিস্যুর বাক্সের কাছে গিয়ে নাক ঝাড়ল।
‘আমি বুঝতে পারছি না, ওসবের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক ?’ এমনতরো একগুঁয়ে হবার কারণে জো ক্লিয়োর দিকে রাগতভাবে তাকাল। সে কি কোনও ফারাকই দেখতে পাচ্ছে না ? জ্যাকি রবিনসনকে দেখো, র্যাল্ফ বানশকে দেখো। ধুত্তোর! তারা সবাই এসব পেরিয়ে গেছে। ক্লিয়ো তার কাছে কী চায়! সে কি চায়, জো যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাক ?
ক্লিয়ো তার ভাবনা―কথার ওপর সটান খাড়িয়ে বলে, ‘তুমি এটা বুঝতে পারছ না জো, একদমই বুঝতে পারছ না। আমি তোমাকে এখানে চাই জো, এখানেই, আমার সঙ্গে, তোমার নিজের মাটিতে। আমাকে ছেড়ে যেয়ো না জো! প্লিজ, সে এখন কেঁদে চলেছে, ‘জো, জো, আমরা কী করতে চলেছি ? হয়তো ছোট্ট জো থেকে মুক্তি পেলে ভালোই হতো …’। তার বাদামি চোখ দুটিতে ভয়ের আঁকড়া। ‘না, জো, না! আমি তা বোঝাতে চাইনি! আমি এটা বলতে চাইনি ডার্লিং। জানি না, আমি কী বলছি…।’
ক্লিয়ো জো’র পাশে বসে পড়ল। ঝুঁঁকে, হাতের তালুতে মুখ লুকিয়ে। ওর এই চেহারা জো’র কাছে অসহ্য। সে উঠে ছোট্ট ঘরটির এ মুড়ো, ও মুড়ো অস্থির পায়চারি করতে লাগল। হ্যাট্টিসবার্গ , মিসিসিপির শ্বেতাঙ্গ ক্যাপ্টেন যে কথা বলেছিল তা সে ভাবতে লাগল। ‘সেনাগণ, আমরা একটা কাজ করতে বদ্ধপরিকর। ইউএসএ’র যে কোনও সেনাদলের মতোই তুচ্ছ আমাদের এই দল―সে সাদাই হোক বা কালো। আর পূর্ণ সংহতির লক্ষ্যেই আমাদের এই কর্তব্যকর্ম। এটা এক দীর্ঘ, দুরূহ টান কিন্তু আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি, এখানে প্রতিটি সৈনিকের প্রতি পক্ষপাতহীন আচরণ করা হয়। মনে রেখো, আমরা প্রতিটি ব্যক্তির মর্যাদার জন্য লড়াই করি।’ লিউক রবিনসন এই বক্তব্য শুনে ঢ্যাঙা ল্যাকপেকে ক্যাপ্টেনের দিকে উদ্ধত হাসি মুখে তাকিয়েছিল।
জো এবার ক্লিয়োর সামনে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বলল, ‘দেখো সোনা, এটা আদৌ এ রকম কোনও ব্যাপার নয়। কেন তুমি আমার কথা বুঝতে চাইছ না ? ওরা এখন নিগ্রো সেনাদের একত্র করছে এবং যে কোনওভাবেই সবাইকে এ বিষয়ে উত্তেজিত করায় ঘণ্টা লাভটা কী ? আমাকে যেতে হবে। এটাই মোদ্দা কথা।’
এই বলে জো আবার ক্লিয়োর পাশে বসল। সে প্রচণ্ডভাবে এটাই বিশ্বাস করতে চায় যে তাদের মতো মানুষের জন্য প্রকৃতই একটা পরিবর্তন আসছে। এটা তার জন্য সহজতর হোক, সহজতর হোক তার ও ক্লিয়োর জন্য―যদি তারা উভয়েই বিশ্বাস করে যে কোরিয়ায় যুদ্ধে যাওয়া নিগ্রো সেনাদের পক্ষে বাজিস্বরূপ। ক্লিয়ো চোখ মুছল, নাক ঝাড়ল; তারা বিষয়ান্তরে গিয়ে আসন্ন সন্তানকে নিয়ে কথা বলতে লাগল, ধরা যাক মেয়ে হলো, তাহলে তার নাম কী রাখা হবে ? এভাবেই মাঝরাত পেরোলে জো ক্লিয়োকে চুম্বন―বিদায় জানিয়ে সেনা―ব্যারাকে ফিরে গেল।
সেনাদল পুরো যুদ্ধ―পোশাকে সেজে মার্চ করে চলেছে, পিঠে তাদের বোঝা, কাঁধে লোমওয়ালা খসখসে ব্যাগ আর আছে কারবাইন, রাইফেল। বিশাল সাদা জাহাজটির দিকে এগোনোর সময় তারা কথা বলছে, হাসি―মস্করা করছে আর অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেও তা নার্ভাস লাগছে। তারাই কালো সেনাদের সামনের দিকে; শেষ শ্বেত সেনাদের অনুসরণ করছে। তাদের গমন―পথে দুপুরের সূর্যকে মাথায় করে দীর্ঘ বর্তুলাকার মানুষের ঢল, পামগাছ ও ঝোপঝাড়ের পথ বেয়ে তারা যখন পিচপথ মশমশিয়ে এগোচ্ছিল তখন একটা সম্মিলিত ছন্দ ভেসে উঠছিল। কিন্তু জো এখনও ক্লিয়োকে দেখতে পায়নি, সে চিন্তায় অস্থির। কিছু কি ঘটে গেল ?
তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে লিউক রবিনসন বকবক করছে, হাসছে আবার অসন্তোষের সঙ্গে বিড়বিড়ও করছে। ‘আচ্ছা শোনো, আমি বলি কি এইসব ঘ্যানঘেনে পরিজন মেয়েছেলে অত্যন্ত বিরক্তিকর। যেমন ধরো, অফিস উইলি, গতরাতে তোমাদের হার্লেম খবর―কাগজে তার সম্পর্কে কী পড়লাম জান ?’ অফিস উইলি জো’র ডাকনাম কেননা জো ছিল কোম্পানি―কেরানি―হাইস্কুল পাশ, দুবছর কলেজে পড়েছে, বিশেষ ব্যক্তি। ‘আমি পড়লাম তোমাদের জনাকয় নেতা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে দাবি জানিয়েছে যে সেনাদের খাদ্যবস্ত্রের তত্ত্বাবধানে না রেখে নিগ্রো সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হোক। এটা কি দারুণ লজ্জাকর নয় ?’
জো’র চোখ দুটি বিক্ষিপ্তভাবে মানুষের সারি থেকে লিউকের ওপর গিয়ে পড়ল ও পরে আবার সারিবদ্ধ মানুষের দিকে ফিরে এল।
‘পার্সি জনসন যে কোনও দিন আমার যুদ্ধের পোশাক পরে নিতে পারে’, লিউক বলল। ‘সে যুদ্ধ করার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছে। তারপর মহান কোরিয়োরা আমার কোনও ক্ষতি করেনি। একটা জ্যান্ত গাধার সঙ্গে পাগলামি করার লোক আমি নই।’
জো লিউক রবিনসনকে পছন্দ করত শুধু তার বর্ণভেদপ্রথা বিষয়ে একান্ত অনুভূতিপ্রবণ মানসিকতার কারণে। বহুবার সে লিউককে বলেছে, কাঁধের সেনা―পরিচয়ের তকমাটা ছিঁড়ে ফেলে সাধারণ মানুষ হতে। কিন্তু এখন লিউককে দেবার মতো সময় নেই তার। জাহাজের দিকে সোজা তাকিয়ে সে যখন শ্বেত সেনাদের উঠে যেতে দেখল, একটা বেড়ে ওঠা ভয় তাকে চেপে ধরল। হয়তো ক্লিয়োকে ছেড়ে আসার ভয় বা এখনও অব্দি একে অপরকে না দেখতে পাওয়ার ভয়। ভয় হয়তো সেই কারণে যে আর তার সঙ্গে এ জীবনে দেখা নাও হতে পারে―কখনওই নয়। হয়তো সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জোকে জানাতে পারছে না, হয়তো এতটাই অসুস্থ যে হাঁটাচলাই করতে পারছে না―ভয় সে সব কারণেও। ক্লিয়ো গতরাতে ছোট্ট জো সম্পর্কে যা বলেছিল সে কথা ভাবছে জো। হয়তো…!
আর ঠিক তখনই মানুষের পুরোভাগে ক্লিয়োকে দেখতে পেল জো―তার দিকে হাত নাড়ছে আর মুখজুড়ে সেই প্রশস্ত, বিশ্বস্ত আর সুন্দরতম হাসিটি যা যে কেউ দিতে পারে না। জো এতটাই খুশি হলো যে সে প্রত্যুত্তরে ঠোঁট নাড়াতে, হাসতে―জোর বা মুচকি বা অন্য কোনও অভিব্যক্তি দিতেই ভুলে গেল।
ক্লিয়ো ঠিক তাকে লক্ষ্য করে ছুটে এল। ‘এই যে সৈনিক, কোথায় যাচ্ছ বলে ভাবছ ?’
‘ধুত্তোর’, শেষ অবধি যতটা শান্ত থেকে বলা যায়, সেভাবেই বলল সে, ‘কিছুক্ষণের জন্য আমার মনে হয়েছিল তুমি বোধ হয় আজকের দিনটি ভুলেই গেছ। ভেবেছিলাম আমার এই যাত্রা―উৎসবে যোগ দিতে ভুলেই মেরেছে, একদম।’
‘এই যে, তোমার গলা এ রকম শোনাচ্ছে কেন ?’ জো’র ফ্যালফ্যাল তাকানো দেখে ক্লিয়ো হেসে ফেলল এবং বলল, কালো চশমায় তাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে, দাড়িটা কেটে নিলে ভালো হতো, পিঠের বোঝাটিও দেখনসই। ক্লিয়োকে এতটাই উৎফুল্ল লাগছিল যে জো বিশ্বাসই করতে পারছিল না, এই মেয়েই গতরাতে একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সে তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল অনুভব করছিল।
তা যেন না দেখার ভান করে ক্লিয়ো জো’র সঙ্গে শেষ নিষেধ―বাধা অবধি হেঁটে চলল। এরপর আর পরিজন মহিলাদের যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। তার দিকে তাকিয়ে জো চাইল ক্লিয়ো যেন কিছুটা হলেও কাঁদে। কিন্তু সে কাঁদল না। ঝটিতি তার কাছে পৌঁছে চুমু খেল। বলল, ‘বিদায়, ডার্লিং, সাবধানে থেকো। ছোট্ট জো আর আমি রোজ লিখব, হ্যাঁ, আজ বিকেল থেকেই।’
এই বলে সে বিদায় নিল।
শেষ শ্বেত সেনাটি সুন্দর সাদা জাহাজটায় চড়ে গেল আর তারপর ব্যান্ড বেজে উঠল ‘গড ব্লেস আমেরিকা’ গানটির সুরে। ধীরলয়ে। গুরুগম্ভীর।
জো তার কৃশকায় কাঁধে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে যাবার মতো শীতলতা অনুভব করল যদিও সে নিশ্চিত হতে পারল না তা এই গানের সুর শুনে নাকি ক্লিয়োকে ছেড়ে আসার কষ্টে। সে আশা করল ক্লিয়োও এই গান শুনবে; হয়তো এই গানই তাকে বুঝিয়ে দেবে কেন গায়ের চামড়ার রং নির্বিশেষে আমেরিকিদের ঘর ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে যুদ্ধ করতে যেতে হয়।
তারা নিষেধ―বাধার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল আর অপেক্ষা করতে লাগল যতক্ষণ না শ্বেত বাহিনীর জাহাজে ওঠা শেষ হয়। তার ইচ্ছে করছিল শেষবারের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে ক্লিয়োকে দেখে কিন্তু নিজেকে সে কাজে প্রশ্রয় দিল না। এরমধ্যেই তাদের চলা পুনরায় শুরু হয়েছে, জাহাজের দিকে। এবং হঠাৎই ‘গড ব্লেস আমেরিকা’ গানটি থামিয়ে দিয়ে বাদকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অন্য একটি গানের সুরে―দ্য ডার্কটাউন স্ট্রাটার্স বল (ঞযব উধৎশঃড়হি ঝঃৎঁঃঃবৎং’ ইধষষ)… দুরন্ত, উচ্ছল।
সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই ঘাড় উঁচিয়ে জাহাজের দিকে তাকাল, দেখল ডেক থেকে জনাকয় শ্বেত সৈনিক নিচে নিগ্রো সেনাদের দিকে হাত নাড়ছে আর মৃদু হাসছে; চিৎকার করে ডাকছে, ‘এই যে সেনারা!’ আর তুড়ি দিচ্ছে। জো’র পাকস্থলি থেকে যেন পিত্তরসের বিকার মুখ অবধি উঠে এল।
‘ধুত্তোর’, সে শুনল লিউক বলছে, ‘এই গানই তো আমি চাই।’ মোটাকাটা সেনারা আস্তে হাঁটতে লাগল। ‘আমার মনে হয় মি. চার্লি চাইছে আমরা তার সুন্দর সাদা নৌকাটায় ভীরু পায়ে উঠি। সমান ব্যবহার। সম-আচরণ… আমরা কোনও সৈনিক নই, একদল ধুর ভাঁড় মাত্র।’
জো তার টুঁটির ভেতরে এক বীভৎস তাপ বেড়ে উঠছে, অনুভব করল। সে প্রচণ্ড আশা করল, ক্লিয়ো অনেক দূরে, এটা যেন সে শুনতে না পায়।
লিউক ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। ‘ওহে বাচ্চা, ব্যাপারখানা কী ? ধুর, তোমাদের নিগ্রোদের এই বিষয়টাই আমি ঘেন্না করি। এবার তোমার কাঁধের এই সেনা-পরিচয়-চিহ্নটা খুলে ফেলো। ওগুলোই তোমাদের ঘরের আরামের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই যে নিগ্রো জাতীয় সঙ্গীত শুনলে, একে তুমি স্বীকৃতি দাও না ?’
জো কোনও উত্তর করল না। বুঝতে পারল যে তার রাগ চড়চড়িয়ে বেড়ে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল এই সেনাদলের লাইন থেকে বেরিয়ে যায়। সব তছনছ হয়ে যাক। কিন্তু যেহেতু তার কানে বাজছে সেই গানের সুর… দ্য ডার্কটাউন স্ট্রাটার্স বল… তাই সে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াল, কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিল আর দৃপ্ত ঢঙে মার্চ করে এগোতে থাকল বড় সাদা নৌকাটির দিকে।
কলকাতা থেকে
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ