আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

সাদা শূন্যতা : মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : ভারতের গল্প

মৃদু অথচ প্রখর বারিপতনের শব্দ হচ্ছিল বাইরে। এতক্ষণে বৃষ্টিটা ধরল। হোমস্টের ব্যালকনি থেকে ঘরে এসে শ্রীলগ্না দেখল দিব্যেন্দু তন্ময় হয়ে ইংরেজি পেপারব্যাক পড়ছে। খানিক বিরক্তিও কি মিশে নেই এই ছদ্ম-তন্ময়তার মধ্যে ? দুই আঙুলের ভাঁজে পুড়তে থাকা সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে রয়েছে। স্বামীকে দু-এক মুহূর্ত লক্ষ্য করে শ্রীলগ্না বলল, বেরোবি না আমাদের সঙ্গে ?

দিব্যেন্দু চোখ তুলল বই থেকে। গলায় বিরক্তি মিশিয়ে বলল, কী দেখব বেরিয়ে ? মেঘ আর কুয়াশায় কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। যেকোনও সময় ন্যাগিং বৃষ্টি শুরু হবে। এই ওয়েদারে বাইরে বেরোবার উটকো শখ আমার নেই। যেতে হয় তোরা যা।

দিব্যেন্দুর বয়স চৌত্রিশ হলেও হাবভাব চুয়ান্নর মতো। প্রোমোশন পেয়ে বিমা কোম্পানির অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হয়েছে সম্প্রতি। পদমর্যাদায় উন্নতি হবার পর তার জুলপির কাছটা সাদা হতে শুরু করেছে। হেয়ারলাইন পিছিয়ে গেছে খানিকটা। অ্যান্টি ডিপ্রেশন পিল না খেলে রাতে ঘুম আসে না। শ্রীলগ্না একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, ছেড়ে দে, যেতে হবে না। 

দিব্যেন্দুর উদাসীন বোধ চঞ্চল হলো। মুখ তুলে স্ত্রীকে খুঁটিয়ে দেখে বলল, এত সেজেছিস কেন ? এই রিমোট পাহাড়ে কাকে সাজ দেখাবি ? এখানে আমরা ছাড়া আর তো কেউ নেই।

তুই সারাক্ষণ সাজই দেখিস আমার। আইলাইনারই শুধু দিয়েছি, আর তো কিছু করিনি। আলগা গলায় বলল শ্রীলগ্না।

দিব্যেন্দু সিগারেটের লম্বা হয়ে যাওয়া ছাইটা আলতো টোকা দিয়ে ঝেড়ে বলল, শুধুই আইলাইনার ?

দিব্যেন্দুর মুখ থেকে বেরোনো বিদ্রƒপ ও প্রশ্ন মেশানো শব্দটাকে শ্রীলগ্না থিতিয়ে যেতে দিল। কিছু না বলে এক কোণের বড় আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল চুপচাপ। তুষারনীল ডেনিম জিনস আর কালো লেদার জ্যাকেট পরে আছে সে। মাথায় ফ্যাশনেবল সাদা উলের টুপি। খোলা কালো চুল পিঠ অবধি নেমেছে। সরু করে আইলাইনার দিয়েছে আয়ত চোখ দুটো স্পষ্ট করার জন্য। ঠোঁটে পিচ লিপস্টিক। বাইরে বেড়াতে এসে এটুকু রূপটান করবে না ?

শ্রীলগ্নার গায়ের রং একটু শ্যাম-ঘেঁষা হলেও শরীরী আকর্ষণ প্রবল। নির্মেদ চেহারা দেখে তার বয়স বোঝা যায় না, পঁচিশ-ছাব্বিশ বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। যখন সে মঞ্চে অভিনয় শুরু করেছিল তখন কাগজে লেখা হয়েছিল, এই নবাগতা অভিনেত্রী মঞ্চে থেকে যাওয়ার জন্যই এসেছেন। তখনও শ্রীলগ্না ভাবেনি, কলেজ ফেস্টের স্টেজ থেকে তাকে তুলে যে দিব্যেন্দু মঞ্চে এনেছিল, বিয়ের পর সে-ই আবার তাকে মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠবে। 

এ কি গোপন ঈর্ষা ? নাকি এর মধ্যে অন্য জটিলতা আছে ? জট খুলতে গিয়ে কি আরও পাকিয়ে যাচ্ছে জট ? যখন সে আর দিব্যেন্দু এক ছাদের তলায় থাকতে শুরু করেছিল তখন কে জানত তাদের সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে অন্য এক সম্পর্ক, সঙ্গোপনে জন্ম নেবে এমন এক টানাপোড়েন যা ধ্বস্ত করবে তাকে ? তখন কেউ কি ভেবেছিল, শক্তিশালী অভিনেতা দিব্যেন্দু নিজেকে একদিন সরিয়ে নেবে অন্তরালে এবং নাটক নিয়ে এতটাই উদাসীন হয়ে পড়বে যে, মঞ্চে একসময়ের সঙ্গীসাথীরা কী করছে না করছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতূহলও থাকবে না তার ?

দিব্যেন্দু, কৌশিক আর অভ্রকের সঙ্গে শ্রীলগ্নার সখ্য হয়েছিল কলকাতায় পড়তে এসে। দিব্যেন্দুর বাবা দেবীপ্রসাদ মিত্র নাটকের জগতের নামী মানুষ। সংশপ্তক নামে একটি নাটকের দল আছে তাঁর সেখানে দিব্যেন্দু কৈশোর থেকেই যুক্ত। কলেজ ফেস্টে মূলত দিব্যেন্দুর উদ্যোগেই মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘রক্তকরবী’ যার নির্দেশনা দিয়েছিল মাস কমিউনিকেশনের কৌশিক। ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের দিব্যেন্দু করেছিল রাজার চরিত্র। ফিজিক্সের শ্রীলগ্নাকে কাস্ট করা হয়েছিল নন্দিনী করার জন্য। অভ্রক ছিল রঞ্জনের চরিত্রে। ডিরেকশন দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিশু পাগল সেজেছিল কৌশিক। রিহার্সাল দিতে দিতেই একটা কোর গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাদের। পরে একদিন সংশপ্তকের মহলায় বন্ধুদের নিয়ে এসেছিল দিব্যেন্দু। শ্রীলগ্নাদের শুরু হয়েছিল এক নতুন সফর। ধীরে ধীরে সংশপ্তক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল তারা সকলে।

এক যুগের বেশি হয়ে গেছে দেখতে দেখতে। সংশপ্তক প্রযোজিত নতুন নতুন নাটক একদিকে যেমন দর্শকের প্রশ্রয়ধন্য হয়েছে তেমনই মনান্তর, মতান্তর, অভিমান, অসূয়া, বৈরিতার অশুভ ছায়াও ঘনিয়েছে দলের ওপর। দল ছেড়ে চলে গেছে অনেকে। নতুন ছেলেমেয়েরাও এসেছে। দিব্যেন্দুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে শ্রীলগ্নার। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেবীপ্রসাদ অসময়ে চলে গেছেন। অনেক বদল এসেছে দিব্যেন্দুর মধ্যে। এই সেদিনও যে ছিল দলের প্রাণভোমরা, সে নাটক থেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। রিহার্সাল, স্টেজ শো, অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিং কোথাও আর পাওয়া যায় না তাকে। তবে থমকে যায়নি সংশপ্তক। কৌশিকের ওপর অর্পিত হয়েছে দল চালাবার ভার। সে-ই নাটককার, নির্দেশক, কখনও কখনও নটও। সংশপ্তকের ঐতিহ্যের মধ্যে সে নিয়ে এসেছে এক ভিন্নতর বোধ যা নাট্যরসিকদের সম্ভ্রম আদায় করছে, দর্শকদেরও টেনে আনছে থিয়েটার হলে।

বন্ধুদের মধ্যে প্রথম রোজগেরে হয়েছিল অভ্রক, অকালমৃত বাবার সরকারি চাকরিটা পেয়ে। তার পর দিব্যেন্দু ঢুকল বিমা কোম্পানিতে। কৌশিক জয়েন করল ইংরেজি কাগজের ডেস্কে। কলেজে পার্টটাইম পড়ানর চাকরি খুঁজে নিল শ্রীলগ্না। তার মা চলে গেছেন ছোটবেলায়। বাবা ডাক্তার। তিনি খোলামেলা মানসিকতার মানুষ। মেয়ের নাটক করা নিয়ে, কল শো করতে দূর-দূরান্তে যাওয়া নিয়ে, বাইরে গিয়ে রাতে থাকা নিয়ে, পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা নিয়ে তাঁর ট্যাবু নেই। দিব্যেন্দুকে বিয়ে করার ব্যাপারেও তিনি মেয়ের সিদ্ধান্ত এক কথায় মেনে নিয়েছিলেন।

সংশপ্তক শ্রীলগ্নার দ্বিতীয় সংসার। এত বছর পর আজও মঞ্চে দাঁড়াবার আগে ঢিপঢিপ করে তার বুক। কিন্তু স্পটলাইটের আলো মুখে পড়ার পর কেটে যেতে থাকে আড়ষ্টতা। নার্ভাসনেস কাটিয়ে চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়তে থাকে সে। দর্শকদের উচ্ছ্বাস তাকে দেয় ব্যাখ্যাতীত রোমাঞ্চ। তার রক্তের মধ্যে নেশার মতো মিশে গেছে এই উন্মাদনা। এখন আর এই আলোর বৃত্তের বাইরে থাকার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারে না সে। কিন্তু পরিস্থিতি যে সেদিকেই যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারছে সে।

দিব্যেন্দুর সংশপ্তক থেকে সরে যাওয়ার পেছনে সকলে দুটো কারণকে দায়ী করে। এক, দেবীপ্রসাদের কোভিডে আকস্মিক চলে যাওয়া আর দুই, তার পেশাগত কর্মব্যস্ততা। কিন্তু এত সহজে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছন যাবে না। শূন্যতার ভেতরেও থাকে ঢেউ। শ্রীলগ্না জানে তার অভিনয়ের খ্যাতি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। কাগজে ফলাও করে প্রশংসা বেরোচ্ছে তার। দিব্যেন্দুর সঙ্গে তুলনা হত প্রথম প্রথম, এখন আর হয় না। বরং আলোচনা হয় দেবীপ্রসাদ কিংবা তাঁর হাতে গড়া সংশপ্তককেও সে হয়তো ছাপিয়ে যেতে পারে একদিন। সে কারণেই কি দিব্যেন্দু তাকে সরিয়ে দিতে চায় মঞ্চ থেকে ? নাকি এখনও ব্যাচেলর থেকে যাওয়া কৌশিক বা অভ্রকের সঙ্গে শ্রীলগ্নার বন্ধুতার মধ্যে আঁশটে গন্ধ খোঁজে সে ?

পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার জন্য ইদানীং ব্যাকুল হয়ে পড়েছে দিব্যেন্দু। শ্রীলগ্না চাইছিল অপেক্ষা করতে। কিন্তু তার প্রতিরোধ টেঁকেনি।  শ্রীলগ্না এই নির্জন পাহাড়ে এসেছে শরীরের অবসন্ন কোষগুলো সতেজ করবে বলে। কিন্তু তার মনের গায়ে ভেজা তুলোর মতো সেঁটে আছে একটা অস্বস্তি। পিরিয়ডের ডেট স্কিপ করছে এক সপ্তাহ হতে চলল। সে জানে না শিশিরপাতের মতো নিঃশব্দে তার গর্ভে কেউ এসে পড়েছে কি না। মা হলে সে বেশ কিছুদিনের জন্য আটকে পড়ে যাবে ঘরের ঘেরাটোপে। দিব্যেন্দু হয়তো সেটাই চায়।

বর্ষা এসেছে। নতুন নাটক আপাতত নামাচ্ছে না সংশপ্তক। যে যার নিজস্ব বৃত্তে দিনযাপন করছিল। তাল তুলল অভ্রক। শ্রীলগ্নাকে ফোন করে বলল, কোভিডের পর বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে লাইফটা। একটা আউটিং করে এলে কেমন হয়! কনফারেন্স কলে নিয়ে নেওয়া হলো কৌশিককে। চারখোল যাবার প্রস্তাব দিল কৌশিক। অভ্র বলল, উঁহু তার চেয়ে কাফের ভালো। পাহাড় তো আছেই জঙ্গলও পাওয়া যাবে। কৌশিক বলেছিল, কী রে শ্রীলগ্না, তোর কর্তা যেতে রাজি হবে তো ? হালছাড়া ধরনের মাথা নেড়েছিল শ্রীলগ্না। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটাকে বেরিয়ে যেতে দিয়ে বলেছিল, জানি না, তোরা ফোন করে দ্যাখ। কৌশিক ফোন করেছিল তখনই। কাজের চাপের বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল দিব্যেন্দু। কৌশিকও ছাড়ার পাত্র নয়। আধঘণ্টা ভ্যাজর ভ্যাজর করে ঠিক জপিয়ে ফেলল। দিব্যেন্দু নিমরাজি হয়ে বলেছিল, কিন্তু থাকব কোথায় ? কৌশিক বলেছিল, ভানুভক্ত ছেত্রীর হোমস্টে। ওই পাহাড়ে টুরিস্টদের ওটাই থাকার একমাত্র জায়গা। আমি গিয়ে থেকেছি একবার।

চারজন ট্রেন থেকে নেমেছিল নিউ মাল জংশনে। একে বৃষ্টির জন্য পাহাড়ের রাস্তার হাল খারাপ তার মধ্যে রাস্তা সারাই হচ্ছে। আগে থেকে বলে রাখা গাড়ি ছিল অপেক্ষায়। তাতে চড়ে বসল চারজন। পথে কুয়াপানিতে দাঁড়ানো হলো। সয়াবিনের মোমো আর চা খেয়ে আবার পথ চলা। অরণ্যের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে গভীর নির্জন পথ। মেঘ আর কুয়াশায় কিছুই দৃশ্যমান নয়। তার মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে গুঁড়িগুঁড়ি। রাস্তা ভিজে। ফলে গাড়ি চলছে ধীর গতিতে। কিছুক্ষণ পর একটা বাঁক ঘুরতেই জঙ্গল পাতলা হয়ে এল। আরও এগিয়ে পাহাড়ের ব্যাকড্রপে সবুজ চালওয়ালা একটা ছোট্ট একতলা বাড়ি। সাইনবোর্ডে লেখা সাংগ্রিলা। গাড়ি হর্ন দিল গেটের সামনে এসে। এগিয়ে এলেন এক মঙ্গলোয়েড মুখের বৃদ্ধ। জানা গেল ইনিই ভানুভক্ত ছেত্রী। হোমস্টে চালান, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও করেন। তাঁর স্ত্রী এসে খাদা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন সকলকে। দুটো ঘরে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। উন্মুক্ত ব্যালকনি। সেখান থেকে মেঘ সরলে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো রেঞ্জ দেখা যাবে। কৌশিক আর অভ্রক সিগারেট ধরিয়ে একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। অন্যটার দখল নিল শ্রীলগ্নারা।

ভাড়া করা গাড়িটা ফিরে গেছে তাদের ছেড়ে। এই নির্জন পাহাড়ে মানুষ বলতে ভানুভক্ত, তাঁর স্ত্রী এবং তারা চারজন। বৃদ্ধার রান্নার হাত বেশ ভাল। ডাল আর ডিমের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খাওয়া হলো। অভ্রকরা হাত আঁচিয়ে চলে গেল নিজেদের ঘরে। দিব্যেন্দু এসে ব্যাগ থেকে একটা ইংরেজি পেপারব্যাক বের করে তাতে সেঁটে গেল। এতক্ষণ পর এবার বৃষ্টিটা ধরেছে। শ্রীলগ্না ব্যালকনিতে এসে দেখল মোষের পিঠের মত আকাশের কালচে রং ধূসর হয়েছে। কৌশিক আর অভ্রক চলে এল খানিক বাদে। কৌশিক বলল, তোরা কি ঘরে বসে থাকার জন্য এসেছিস ? ঝটপট তৈরি হয়ে নে। চল, এক চক্কর হেঁটে আসি।

দিব্যেন্দু বই থেকে মুখ তুলে তার ভারী মুখের তুলনায় ছোট চোখ দুটো ঠাণ্ডা ও অনুভূতিহীন করে বিরস গলায় বলল, আমি এখন আরাম করে বই পড়ব। তারপর এক ঘণ্টা ঘুমোব। সঙ্গে করে একটা স্কচের বটল নিয়ে এসেছি। বিকেল থেকে নেশা করব। তোরা কোন জাহান্নমে যাবি যা, শ্রী যেতে চাইলে ওকে সঙ্গে নিয়ে যা, আমাকে ছেড়ে দে। লিভ মি অ্যালোন। দিব্যেন্দুর কথাটার মধ্যে সূক্ষ্ম ঝাঁঝ ছিল। সে যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে এসেছে সেটা কাল রাতে শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেনে চাপার পর থেকেই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে আসছে সে। কৌশিক আর অভ্রক নিজেদের মধ্যে মুখ তাকাতাকি করে নিল একবার। কৌশিক মজার ছলে ‘অ্যাজ ইউ প্লিজ, স্যার’ বলে চলে গেল নিজেদের ঘরে।

একটুক্ষণ বাদে শ্রীলগ্না তৈরি হয়ে নেমে এল কটেজের সামনে। পাহাড়ের উচ্চতা ও বৃষ্টির কারণে শীত শীত লাগছে। সামনে ঘন কুয়াশা। দুহাত দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বাগানে প্রচুর ফুল ফুটেছে। কয়েকটা গাছ সাদা অর্কিডে ছেয়ে আছে। সেসবই দেখছিল শ্রীলগ্না। এমন সময় কুয়াশার আড়াল সরিয়ে পাগলের মতো দৌড়তে দৌড়তে জনাছয়েক পাহাড়ি লোক এল। বছর সাতাশ আঠাশের একটা ছেলেকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এসেছে তারা। ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এলেন ভানুভক্ত। ছেলেটা অদ্ভুতভাবে গোঙাচ্ছে। এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে নেপালি ভাষায় যা বলল তার মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধে হলো না। বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে তার ছেলে বিষ খেয়েছে। এখন মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোতে শুরু করেছে বলে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ভানুভক্তের কাছে নিয়ে এসেছে ছেলেটাকে।

ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে কৌশিক আর অভ্রক। নেপালিতে উঁচু গলায় কিছু বললেন ভানুভক্ত। তাঁর স্ত্রী ঘর থেকে কী নিয়ে এলেন হাতে করে। শ্রীলগ্না দেখল, কাঁচা ডিম আর তেঁতুল। ভানুভক্ত মহিলার উদ্দেশে বললেন, বমি করিয়ে পেট ওয়াশ করার চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। তাই করা হলো। ছেলেটা অনেক বমি করল। তবু অত বড় চেহারাটা ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে থেকে থেকে। ভানুভক্ত পালস ধরে বসে আছেন গম্ভীর মুখে। ছেলের মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার একটাই ছেলে। ওকে বাঁচান ডাগদারসাব। ভানুভক্ত দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, আমি ভালো বুঝছি না। এখনই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাও। দেরি হলে বিপদ হতে পারে। অনেক আশা নিয়ে এসেছিল সকলে। হতাশ হয়ে আবার ছেলেটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে দলটা ছুট দিল জঙ্গুলে পথের দিকে। ছেলেটা কাঁদছিল আর গোঙাতে গোঙাতে বলছিল, আমি আর কখনও বিষ খাব না। আমি মরতে চাই না, আমাকে বাঁচিয়ে দিন ডাগদারসাব, এবারের মতো বাঁচিয়ে দিন। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবার পরও পাহাড়ে কিছুক্ষণ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল মুমূর্ষু ছেলেটার হাহাকার।

শ্রীলগ্নার বুকের ভেতরটা ছমছম করছিল। সে অস্ফুট স্বরে বলল, ছেলেটা বাঁচবে তো ? ভানুভক্ত মাথা নাড়লেন দুদিকে। ছেলেটার মুখটা হন্ট করছে শ্রীলগ্নাকে। একটা বড় নিঃশ্বাস সংবরণ করল সে। দিব্যেন্দুও তো এমনই এক কাণ্ড ঘটিয়েছিল একবার। এখন সন্দেহ হয়, পুরো স্ট্রিপ না খেয়ে পাঁচ-ছটা ঘুমের বড়ি খেয়েছিল কেন সেদিন দিব্যেন্দু ? যদিও বা খেল, শ্রীলগ্নাকে ফোন করে সেটা জানাল কেন ? তবে কি হিসেব করে কোনও জটিল অংক কষেছিল সে ?

একই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল তারা চারজন। ততদিনে তাদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে এক ধরনের পারস্পরিকতা, যার ভেতর শ্রীলগ্না নিজেও খুঁজে পেত নির্ভরতা। ক্লাস বাংক করে ক্যাম্পাসে আড্ডা হত জোর। ফি সন্ধেবেলা সংশপ্তক দলের মহড়া হতো। নাটক দেখতে যাওয়া হতো থিয়েটার হলে। আইনক্সেও তারা ঢুঁ মারত ভালো সিনেমা এলে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় গেছে তখনই। সে সময় শ্রীলগ্না তার ইচ্ছের বশে বশ করে রাখতে পারত বন্ধুদের। সেবার যেমন হলো। শীতকাল। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এসেছে। টিকিটের ক্রাইসিস। তার মধ্যেও কোত্থেকে চারটে টিকিট জোগাড় করে এনেছে কৌশিক। ফোন করা হলো শ্রীলগ্নাকে। সেদিন তার মায়ের মৃত্যুতিথি। তার ইচ্ছে করছে দক্ষিণেশ্বর যেতে। তিনজন টিকিট ছিঁড়ে ফেলে ছুটেছিল শ্রীলগ্নার বাড়ি। সেখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে দক্ষিণেশ্বরে, মায়ের মন্দিরে। চারজন বসেছিল গঙ্গার তীরে, চুপচাপ। গঙ্গার জলজ হাওয়া সান্ত্বনার প্রলেপ বুলিয়ে গিয়েছিল শ্রীলগ্নার সন্তপ্ত প্রাণে।

না, কেউই মুখ ফুটে শ্রীলগ্নাকে কোনও দিন কিছু বলেনি। কিন্তু মেয়েদের জন্মগত ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে শ্রীলগ্না বুঝতে পারছিল যা বোঝার। তিনজনের মধ্যে কৌশিকই এগোল প্রথম। মহলা শেষে সেদিন দুজন হেঁটে বাড়ি ফিরছিল একসঙ্গে। সেদিনই মনের কথা বলেছিল সে। সে অপেক্ষা করেছে অনেক। কিন্তু একান্ত চাওয়াকে সে অপেক্ষা দিয়ে আর পিছিয়ে রাখতে রাজি নয়। শ্রীলগ্না প্রথমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল বোধশূন্যতায়। নিজের ভেতর ডুবুরি নামিয়েছিল সে। চিনে নিতে চাইছিল নিজস্ব সংরাগের রং। দ্বিধা থরথর এক অনুভূতির ভেতর ক্রমশ ইচ্ছেয় ভরে উঠছিল শ্রীলগ্না। গোটা শরীর জুড়ে অনুভব করছিল এক রোমাঞ্চ। এই অলৌকিক অনুভূতি আগে কখনও সে পায়নি।

মাস্টার্স করা হলো না অভ্রকের। ফাইনাল ইয়ারে মারা গেলেন তার বাবা। ছমাসের মাথায় বাবার চাকরি পেল সে। পোস্টিং কলকাতাতেই। চাকরির প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে শ্রীলগ্নার সঙ্গে একদিন একান্তে দেখা করেছিল অভ্রক। নিঃশব্দে তার হাতে তুলে দিয়েছিল একটা দামি পেনড্যান্ট আর গোলাপগুচ্ছ। অস্পষ্ট হলেও তার অভিব্যক্তির মধ্যে আড়ষ্টতা ছিল। ছিল সঙ্কোচের আভা যা দৃষ্টি এড়ায়নি শ্রীলগ্নার। অভ্রকের উপহার ফিরিয়ে দিয়ে তার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে শ্রীলগ্না প্রগাঢ় স্বরে বলেছিল, আমরা বন্ধু। আজীবন বন্ধুই থাকব। থাকতে পারি না, বল ? অভ্রকের চোখের সাদা জমিটা অস্বচ্ছ দেখাচ্ছিল সেদিন। মুখের রেখায় অব্যক্ত ভাঙচুর। হাসার চেষ্টা করে বলেছিল, পারি।

সেই ঘটনার কিছুদিন পরের কথা। গ্রীষ্মের ক্লান্ত দুপুর। রাস্তায় গলে যাচ্ছিল পিচ। সেদিন কৌশিক ইউনিভার্সিটি আসেনি। জলপাইগুড়ি গেছে অসুস্থ ছোটমাসিকে দেখতে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছিল দিব্যেন্দু আর শ্রীলগ্না। অপ্রত্যাশিতভাবে দিব্যেন্দু তার একটা হাত আঁকড়ে ধরেছিল। অস্ফুট উচ্চারণে বলেছিল, শ্রী, আমি মানুষটা একটু অন্যরকম। আমার ভাবনায় যা আসে তার সবটা আমি বলতে পারি না। প্রয়োজনে ভাষাও পাই না ঠিকঠাক। কী করব, আমি যে এমনই। কিন্তু তুই ? এতদিন তুই কি কিছু বুঝিসনি আমাকে দেখে ?

স্তম্ভিত চোখে দিব্যেন্দুকে দেখছিল শ্রীলগ্না। বিশেষ মুহূর্তে কণ্ঠস্বর খুঁজে পেতে তার দেরি হয়ে যায়। কিন্তু দিব্যেন্দুকে যেন সেদিন ভূতে পেয়েছিল। জনহীন রাস্তায় আচমকা তার ডান হাত শ্রীলগ্নার কাঁধের ওপর রেখেছিল দিব্যেন্দু। সরে যাবার কোনও সুযোগ না দিয়ে তার শরীরটাকে নিজের শরীরে টেনে এনে শ্রীলগ্নার মুখের ওপর নিজের উত্তপ্ত ঠোঁট দুটো চেপে ধরেই ছেড়ে দিয়েছিল। দু-এক মুহূর্তের জন্য নিজের পুরুষালি গন্ধের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিল শ্রীলগ্নাকে। তারপর নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করতে করতে ভেঙে পড়েছিল দিব্যেন্দু। অস্ফুট স্বরে গোঙাতে গোঙাতে বলেছিল, তোকে না পেলে আমি মরে যাব। জাস্ট মরে যাব। মুখের ওপর আড়াআড়ি হাত ঘষতে ঘষতে, পায়ে পা জড়িয়ে, শ্রীলগ্নাকে একা রেখে হুড়মুড় করে চলে গিয়েছিল দিব্যেন্দু।

পরদিন দিব্যেন্দু ফোন করেছিল শ্রীলগ্নাকে। কান্নার মতো হেসে বলেছিল, আমি অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়েছি। চলে যাচ্ছি সব ছেড়েছুড়ে। আমাকে ক্ষমা করিস। এটুকু বলেই কেটে দিয়েছিল ফোন। সঙ্গে সঙ্গে কৌশিক আর অভ্রককে ফোন করেছিল শ্রীলগ্না। ওরা ছুটে গিয়েছিল দিব্যেন্দুর বাড়িতে। সেখান থেকে নার্সিং হোম। যেমন ছিল সেই পোশাকেই ট্যাক্সি ধরে চলে এসেছিল শ্রীলগ্না। তাকে দেখে বেডে শোয়া দিব্যেন্দু আচ্ছন্নের মতো বলেছিল, আমি কি মরে যাচ্ছি শ্রী ? কৌশিক আর অভ্রকের দিকে এক পলক তাকিয়ে এক ধরনের সুন্দর অথচ মনখারাপ করা হাসি হেসে শ্রীলগ্না বলেছিল, তোকে মরতে দিচ্ছে কে !

শ্রীলগ্না এতক্ষণ স্মৃতিতে আটকে ছিল। নিজের মধ্যে ফিরে এল অভ্রকের গলা পেয়ে। অভ্রক ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে, পকেট থেকে বের করে আনা দেশলাই বাক্সের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে মুখটা অসহায় করল। কৌশিকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, পাহাড়ি বৃষ্টি কিন্তু ডেঞ্জারাস। একবার ভিজলে আর দেখতে হবে না, ডবল নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। হোমস্টেতে ফিরে যাই চল। কৌশিক তার গ্যাস লাইটারটা অভ্রকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, সেটাই ভালো। তার মধ্যে অন্ধকারও হয়ে আসছে। এই জঙ্গলে বুনো জন্তু-টন্তু, সাপখোপ আছে নির্ঘাত। এখন বাইরে থাকাটা আনসেফ। শ্রীলগ্না বলল, হোক আনসেফ, আমি বেরোব। তারপর পাশে দাঁড়ানো ভানুভক্ত ছেত্রীর উদ্দেশে বলল, এদিকে দেখার মতো কী আছে দাদুভাই ?

ভানুভক্ত বললেন, ওই খাড়া পথ দিয়ে আধ মাইল উঠলে একটা ইশকুল পাবেন। হাতে গোনা কিছু বাচ্চা পড়ে। ওখান থেকে অনেকটা দেখা যায়। পাহাড়ি বৃষ্টির ধাত কিন্তু অন্যরকম। যেকোনও সময় বৃষ্টির তোড় বাড়তে পারে। তখন ছাতাতে কাজ হবে না। শুধু তাই নয়, পায়ে চলা পথ কাদা কাদা হয়ে যাবে। জুতায় গ্রিপ না থাকলে অসুবিধে হবে হাঁটতে।

অভ্রক বলল, এর পরও তুই যাবি ? হেসে ঘাড় কাত করল শ্রীলগ্না। কৌশিক হতাশ গলায় বলল, আস্ত পাগল একটা!

এখানেই থাকবি স্ট্যাচু হয়ে। আমি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে যাচ্ছি। আধঘণ্টা সময় নেব। কেউ জ্বালাতে আসবি না আমাকে। মনে থাকবে ?

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে হাঁটতে শুরু করল শ্রীলগ্না। কয়েক পা গিয়ে ঘাড় ঘোরাল। মাটিতে পা গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক আর অভ্রক। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল দুর্বোধ্য একটা হাসি। এখনও তাহলে সে তার ইচ্ছের আঠা দিয়ে আটকে রাখতে পারে এই দুই বন্ধুকে ! কৌশিক চেঁচিয়ে বলল, বৃষ্টি এলে ছাতাটা খুলিস দয়া করে।

সি অফের ভঙ্গিতে একটা হাত ওয়েভ করে হাঁটতে শুরু করল শ্রীলগ্না। জলভরা মেঘেরা তাকে দেখে রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। পাহাড়ি অরণ্য ছুঁয়ে আসা ভেজা বাতাস ফুসফুসে নিতে নিতে পাহাড় চড়ছে সে। এবড়োখেবড়ো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দুপাশে গভীর জঙ্গল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। এত নিচ দিয়ে মেঘ যাচ্ছে যে, তাদের গায়ে আঙুল বুলিয়ে আদর করা যায়। সেই সঙ্গে রয়েছে জলজ কুয়াশা। ধূসর পর্দার আড়ালে চলে গেছে রাস্তা। বড় বড় ওক, পাইন গাছের গায়ে ঝুলছে সবুজ শ্যাওলার স্তর। স্যাঁতসেতে নির্জন রাস্তায় সঙ্গী বলতে শুধু পাখি আর ঝিঁঝির ডাক। এমন সময় শুরু হলো বৃষ্টি। প্রথমে মিহি রেণুর মতো, পরে মুষলধারে।

প্রচুর পাখি এই জঙ্গলে। কিন্তু ঘন পাতার আড়ালে কোথায় যে বসে তারা ডাকছে তা খুঁজে পাওয়া ভার। এক ঝাঁক স্কারলেট মিনিভেট একটা গাছে বসে ছিল। মনে হচ্ছিল গাছের ডালটা লাল ফুলে ভরে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই পুরো ঝাঁকটা  নিরাপদ জায়গার সন্ধানে উড়ে গেল। সামনে আদার খেত। এখানে খেত-খামারগুলো পাহাড়ের ঢালে। সমতলের মানুষদের পক্ষে হাঁটা সহজ নয়। মেঘের প্রাচীরের মতো কুয়াশারা শ্রীলগ্নাকে ঘিরে দাঁড়াল। এক জায়গায় সুগন্ধি অর্কিড ফুটেছে। দাঁড়াল শ্রীলগ্না। জঙ্গলের গভীরে জোঁকের উপদ্রব খুব। অবশ্য যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে জোঁক বেরোবেই। একে পাহাড়ি এলাকা তার ওপর মাটির রাস্তা। এতটাই কাদা আর পিছল, বার বার হড়কে যাচ্ছে পা।

শীত তীব্রতর হচ্ছে। অনেকটা খাড়াই উঠে এসেছে শ্রীলগ্না। গভীর থেকে গভীরতর কুয়াশার মধ্যে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সে। এই উঁচু ফাঁকা জায়গাটা থেকে হোমস্টের সবুজ চাল অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। তার সামনের হাতায় দুটো স্থির বিন্দু। মাথায় ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক আর অভ্রক। বৃষ্টির তেজ বাড়ল আরও। দুটো নয়, এবার তিনটে বিন্দু। দিব্যেন্দুও কি বেরিয়ে এসেছে বাইরে ? তিনটে বিন্দু এবার নড়ছে-চড়ছে। শ্রীলগ্না স্থির দাঁড়ানো। তার দেরি হচ্ছে দেখে দিব্যেন্দুরা কি তার খোঁজে উঠে আসছে খাড়াই বেয়ে ? হাতের ছাতাটা খুলছে না শ্রীলগ্না। ভিজছে। চোখ দুটো লাল। কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

কটকট শব্দে ডাকছে অচেনা কীটপতঙ্গ। ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাক। একটানা শব্দটাই একচ্ছত্র হয়ে স্মৃতিশূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে শ্রীলগ্নাকে। নিরাসক্তির এক ধূসর দূরত্ব থেকে, জীবন থেকে বহুদূরে, নিজেকে সরিয়ে এক সুদূর প্রান্তে এখন রাখতে শিখেছে শ্রীলগ্না। সেই প্রান্তসীমা থেকে জীবনের উত্থান, পতন, হাসিকান্না, আনন্দ, জয়, পরাজয় সবকিছুই সে দেখতে শিখেছে শান্ত বেদনার মতো। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো অননুভূত এক ধরনের অনুভূতি হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে তার দেহমন জুড়ে। তৃষিতের মতো সে শুষে নিচ্ছে জলের ফোঁটাগুলো। না এখনই নয়, শ্রীলগ্না হোমস্টেতে ফিরবে না এখনই। আরও কিছুক্ষণ থাকবে এই আদিম নির্জনতার মধ্যে, তার শরীর ও মনসিজ অস্তিত্বের ব্যথাতুর সমষ্টি নিয়ে, এই বিষণ্ন সাদা শূন্যতায়।

জলপাইগুড়ি, ভারত থেকে

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button