আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

প্রচ্ছদ রচনা : সংস্কৃতি ও সাহিত্য : স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতা : প্রকৃতি ও প্রবণতা : আহমেদ মাওলা

বাংলাদেশের কবিতা এখন শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের সম্পত্তি হয়ে পড়েছে। মধ্যবিত্তেরও সবটুকু নয়, নগরের সাহিত্যমনস্ক একটি অংশ, যারা কবিতাকে বেছে নিয়েছে বিলাসী ও বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে। গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ যেভাবে জীবনকে দেখেন, সমাজকে দেখেন―সেভাবে নয়, মধ্যবিত্তের কৃত্রিম দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ভোগ-উপভোগের সমাজটুকুই উঠে আসছে কবিতায়। বলা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতা রোমান্টিক আত্মভুক, উৎকট ব্যক্তিবোধ ও মধ্যবিত্তসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মতা, ব্যক্তিসর্বস্বতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। যদিও আজকের এই অহংবোধে উদ্যত নাগরিক মধ্যবিত্তশ্রেণি পেছনে ফেলে এসেছে ঐতিহ্যবাহী, বিশাল, ব্যাপক কৃষিভিত্তিক এক গ্রামীণ জীবন। সেই লোকজ জীবনের কথা তারা ভুলে গেছে। নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন সংকট, সমস্যার কথা এবং সাধ্যাতীত স্বপ্ন নিয়ে উদ্ধারহীন ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করছে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তাদের উদ্ধারহীন, বিপন্নতার কথাও কবিতায় নেই। অথচ কবিতার ভরকেন্দ্রে অবস্থান করছে তারা। আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে, ধর্মে অবিশ^াস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আস্থা, সমষ্টি চেতনা থেকে উৎকট ব্যক্তিতা, সন্দেহ, জটিলতা, হতাশা, আত্মবিচ্ছিন্ন-আত্মীয়বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি মানুষকে আরও বেশি দ্বন্দ্ব-দীর্ণ, শূন্যতার জটিল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। আধুনিক কবিতার মধ্যে এক গভীর-জটিল- ব্যাপক-সূক্ষ্ম বোধÑঅনুভব-ভাষা-অনুষঙ্গ অর্থ-সৌন্দর্যের সংগঠন রয়েছে, যা আয়ত্ত করার জন্য বারবার পড়তে হয়। তাই আধুনিক কবিতার কোনও ব্যাখ্যায় স্থির বা স্থায়ী নয়, প্রত্যেক পাঠেই এর আপেক্ষিক ভাষ্য তৈরি হয়। বাংলাদেশের সমকালীন কবিতা ওই বিচ্ছিন্নতাবোধকেও দেখছে বেশ উপভোগের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সংশয়, সংঘর্ষ, দ্বন্দ্ব-মিলন ও রোমান্টিক আচ্ছন্নতায় তা পরিপূর্ণ। এসব সীমাবদ্ধতার কথা মেনে নিয়ে বাংলাদেশের কবিতার আলোচনা করতে হয়। নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনা নয়, সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক আলোচনা। স্বাধীনতাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর সবচেয়ে বড় সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনা। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা, উপর্যুপরি সামরিক শাসন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক পালাবাদল, শাসকদলের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, দলীয়করণ, সন্ত্রাস, আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদির চাপে চূড়ান্ত অবক্ষয় ঘটেছে সামাজিক মূল্যবোধের, নীতিবোধের এবং শাশ^ত মানবিকবোধের ভিত্তিগুলোও শিথিল, নড়বড়ে হয়ে গেছে। মোটকথা, স্বাধীনতার স্বাদ আমরা পাইনি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার শিক্ষা, আকাক্সক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ, কোনওটা আমাদের হয়নি। একটি লুম্পেন শ্রেণি দেশের রাজনীতিতে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৃত্তে দ্রুত এসেছে গেছে, সেই সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত শক্তি দ্রুত মার্চ করেছে নানা ছত্রছায়ায়। গ্রাস করেছে আমাদের সমস্ত অর্জন। এইসব বাস্তবতা, দ্রোহ ও সংগ্রাম, সংকট ও সম্ভাবনার চিত্র স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় কতটা রূপায়িত হয়েছে ? এই জিজ্ঞাসাকে সামনে এনে আমরা স্বধীনতা-উত্তর কবিতাকে পাঠ ও বিবেচনা করতে চাই। আমি বলবো, নাগরিক মধ্যবিত্তের গায়ে ইস্তিরি করা শার্টের নিচে লুকিয়ে থাকা একজিমার মতো দগদগে ক্ষত, বুকের দহন, কুৎসিৎ ইচ্ছা, ব্যক্তির ক্ষয় ও বিনাশ, কতটা ধরতে পেরেছে আমাদের কবিতা ? সমাজব্যবস্থা সম্পর্কিত সচেতন ভাবনার কোনও প্রত্যক্ষ সম্পাত ঘটেছে কি কবিতায় ?

আমাদের কবিরা কবিতায় সেই নৈরাশ্যের ছায়া খুব বেশি পড়তে দেননি। নিষ্ঠুর আন্তরিকতা দিয়ে অবলোকন করেছেন শুধু। কবিতায় সমাজভাবনা প্রতিফলিত হতে পারে নানাভাবে। সামাজিক পরিস্থিতিজনিত অসাম্য, শোষণ, নিপীড়ন, সংঘাত, বিপন্নতা, শিক্ষিত তরুণের বেকার থাকার যন্ত্রণা, রাজনৈতিক নেতার দলপরিবর্তন, পতনÑপচন সরাসরি ফুটে উঠতে পারে কবিতায়। কিন্তু না, আমাদের কবিতা প্রবলভাবে হয়ে উঠেছে আবেগময়, উপভোগ্য, স্বপ্নময়, বাস্তব-বিমুখ, ভবিষ্যৎহীন, প্রচণ্ডভাবে ব্যক্তিক।

নাগরিকতার শোভন ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছে আমাদের কবিতা ? কেমন সুশীতল,অভ্যস্ত আরামে বিরাজ করছে কবিতা। অথচ তারই পাশে রুগ্ণ অসুস্থ দেশ, অশ্রুজলে কাতরাচ্ছে! বিস্ফোরণ কোথায় ? সবই প্রথাগত।

সত্তর দশকের প্রবণতা :

প্রত্যেক দশকেই এমন কিছু তরুণ, মননঋদ্ধ এসে দাঁড়ান যাদের কাছে কবিতা হয়ে ওঠে অপরিহার্য, জীবনের গভীর অভাবের বিবরণ, পরমপ্রাপ্তির উল্লাস, ঘনিষ্ঠ বান্ধব, রোদনের মতো প্রিয়তমা, একমাত্র গন্তব্য, লোভনীয় ভবিষ্যৎ, উদ্বেল আকাক্সক্ষা, আত্মমুক্তির একমাত্র বাহন। কবিতাই হয়ে ওঠে একমাত্র উপাস্য দেবতা ও ঈশ্বর। সত্তর দশকে বাংলাদেশের কবিতার যে তরুণ কবিগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল, স্বাভাবিকভাবেই তারা হৃৎপিণ্ডে ধারণ করেছিলেন সমকালীনতার উত্তাপ, জীবানুভূতির ভিন্ন এক ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন তাদের কবিতায়। স্বাধীনতার পরবর্তী সমাজের চেহারা-ছবি সত্তর দশকের কবিতায় অনিবার্যভাবে পড়তে থাকে এবং উপমা, রূপক-চিত্রকল্পে মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গের উপস্থিতি সত্তরের কবিতাকে নতুনভাবে তাৎপর্যবান করেছে। নবজাগ্রত সমাজ, নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের নব উদ্দীপনায় অজস্র কবি জোয়ারের মতো উপস্থিত হন। ‘যেহেতু জোয়ার ছিল প্রবল, জোয়ার নেমে গেলে, দেখা গেল সত্তরের অনেক কবিরই হাত ও চেতনা থেকে কলম খসে গেছে। এই খসে যাওয়ার একটা কারণ রয়েছে কবিতার আত্মস্বভাবে। কবিতা কখনও একেবারে কালজ হতে পারে না―তার একটি পা ঢুকে আছে কালোত্তরে। শুধু পা নয়―চোখও। আজ বলতেই হয়, সত্তরের অনেক কবির মধ্যে ছিলনা এই কালোত্তরের চোখ।’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ/ করতলে মহাদেশ, পৃ: ২০২) সত্তরের কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনা সম্পৃক্তি। কালোত্তরের চোখ ছিল না বলেই সমকালীন প্রয়োজন মিটিয়েছে সত্য। কিন্তু চিরকালীন চেতনায় অভিষিক্ত হতে পারেনি। সত্তরের আত্মচারিত্র্য খচিত কবিরা হলেন―আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, দাউদ হায়দার, নাসির আহমেদ, শিহাব সরকার, কামাল চৌধুরী, সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল, হাসান হাফিজ, ময়ূখ চৌধুরী, আসাদ মান্নান, ত্রিদিব দস্তিদার, মিনার মনসুর, আবিদ আনোয়ার, নাসিমা সুলতানা, মাহমুদ কামাল প্রমুখ।

সত্তরের দশকের কবিতার স্বরূপ শনাক্ত করতে গেলে আমরা দেখতে পাই―তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার দীঘল একটি পটভূমি তারা পেয়েছেন, তার ওপর পেয়েছেন বিশাল একটি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঐতিহাসিক বিজয় পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে সত্তরের কবিদের চেতনালোক, তাই একটা উচ্চকিত কণ্ঠধ্বনি সবার মধ্যে বিদ্যমান। পূর্ববর্তী ষাটের কবিরা যেমন লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে সমবেত, যুক্ত থেকেছেন নানা গোষ্ঠীতে; সত্তরের কবিরা সংখ্যায় প্রচুর হলেও পারস্পর বিচ্ছিন্নতার কারণে কোনও সুনির্দিষ্ট স্রোত তৈরি করতে পারেননি। সত্তরের কাব্যশস্যের যে বৈশিষ্ট্য সহজে চোখে পড়ে, তা হচ্ছে বিষয়-বৈচিত্র্য, মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গে ব্যবহার, সর্বোপরি কাব্য-ভাষা। সত্তরের কাব্যভাষা সহজ-সরল, অজটিল, স্বচ্ছন্দ প্রকাশভঙ্গির কারণে অনেকের কবিতা হয়ে উঠেছে স্লোগানসর্বস্ব, উচ্চকণ্ঠ চিৎকার :

ক. এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় / মিছিলের সব হাত, পা, কণ্ঠ এক নয়/ সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিবাগী থাকে/ কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার/ কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ¦ালাতে সংসার/…কোনও কোনও প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়/ যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান, তাই হয়ে যান/উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।(হেলাল হাফিজ)

খ. আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই/আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি/ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে/এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ? (রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)

গ. কোন পথে যাবো ? সব পথে যাবো, সব পথই গেছে কবিতার দিকে। (আবিদ আজাদ)

মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রতিবিপ্লবের ভ্রষ্ট রাজনীতি, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা, সামরিক ক্যু ইত্যাদি পরিস্থিতির কারণে কাব্যভাষায় ছড়িয়েছে অন্তর্লীন বিষাদ। যুদ্ধাহত, হুইল চেয়ার, স্বপ্নভঙ্গ, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, বিষাদ ইত্যাদি শব্দপ্রতিমা হতে থাকে পুনরাবৃত্ত। কবিতার নান্দনিক, প্রাকরণিক, দার্শনিক চিন্তা গৌণ হয়ে বিষয়সর্বস্বতা ভর করে সত্তরের দশকের কবিতায়।

তাই অনেকের কবিতায় স্বাভাবিক ছন্দও অনুপস্থিত এবং নিরেট গদ্য-সজ্জা অনেকের কবিতার প্রধান ভূষণ হয়ে পড়েছে। ফলে গদ্য-সজ্জার কংক্রিট কবিতা ছন্দহীনতার কারণে গভীরতর জীবনবীক্ষা বা নান্দনিক ভাব-ব্যঞ্জনায় ব্যর্থ হওয়ায় তা পাঠকের মর্মমূলে পৌছতে পারেনি। সত্তর দশকে আগন্তুক ঋতুর মতোই অসংখ্য পত্রপত্রিকার প্রকাশ লক্ষ করা গেলেও উল্লেখ করার মতো কোনও সাহিত্য-আন্দোলন নির্ভর লিটল ম্যাগাজিন বা সাহিত্য পত্রিকা চোখে পড়ে না। সত্তরের কবিরা প্রায় সকলেই হয়ে ওঠেন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য-পাতা নির্ভর। যা তাদের জন্য মোটেই আশীর্বাদ হয়নি। কেননা আর যা-ই হোক দৈনিক পত্রিকার পাতা এই বাণিজ্যের যুগে কখনও সাহিত্যের মুখপত্র হতে পারে না। সত্তরের দশকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সত্তর দশকের কবিরা হলেন―অরুণ দাশগুপ্ত, অরুণ সেন, আইউব সৈয়দ, আওলাদ হোসেন, আতাহার খান, আনন্দ মোহন রক্ষিত, আবিদ আজাদ, আবিদ আনোয়ার, আবু করিম, আবু মাসুম, আবু হাসান শাহরিয়ার, আরিফুল হক কুমার, আলম তালুকদার, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আশরাফ আহমদ, আশরাফ মীর, আশুতোষ ভৈৗমিক, আসাদ মান্নান, আহমদ আজিজ, আহসান হামিদ, ইকবাল আজিজ, ইকবাল হাসান, ওয়াহিদ রেজা, একে শেরাম, কাজী সালাহ্ উদ্দিন, কামাল চৌধুরী, খালিদ আহসান, খুরশিদ আনোয়ার, গোলাম সাবদার সিদ্দিকী, জরিনা আখতার, জাফর ওয়াজেদ, জাফরুল আহসান, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, জাহিদ হায়দার, তপংকর চক্রবর্তী, তিতাশ চৌধুরী, তুষার দাশ, তৌহিদ আহমেদ, ত্রিদিব দস্তিদার, দাউদ হায়দার, দিলারা হাফিজ, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ মুকুল, নাজমুল হাসান, নাসরীন নঈম, নাসিমা সুলতানা, নাসির আহমেদ, নিতাই সেন, পংকজ মনহর, পদ্মনাভ অধিকারী, ফজল মাহমুদ, ফরিদ আহমদ দুলাল, ফাউজুল কবির, ফারুক মাহমুদ, বাবু ফরিদী, বিমল গুহ, মতিন বৈরাগী, মনজুরুর রহমান, ময়ূখ চৌধুরী, মাসুদুজ্জামান, মাহবুব বারী, মাহবুব হাসান, মাহমুদ কামাল, মাহমুদ শফিক, মিনার মনসুর, মুজাহিদ শরীফ, মুজিবুল হক কবীর, মুনীর সিরাজ, মুস্তফা মহিউদ্দিন, মোরশেদ শফিউল হাসান, মোস্তফা মীর, মোহন রায়হান, যুগলপদ সাহা, রবিউল হাসান, রবীন্দ্র গোপ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ্, শফিক আলম মেহেদী, শহীদুজ্জামান ফিরোজ, শামসুল ফয়েজ, শান্তনু কায়সার, শামীম আজাদ, শাহজাদী আঞ্জুমানারা, শাহদাত বুলবুল, শাহাবুদ্দীন নাগরী, শিশির দত্ত, শিহাব সরকার, সরোজ দেব, স্বপন দত্ত, সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল, সাথী দাশ, সুজাউদ্দিন কায়সার, সোহরাব পাশা, সোহরাব হাসান, সৈকত আসগর, সৈকত রহমান, সৈয়দ আল ফারুক, সৈয়দ আহমদ আলী আজিজ, সৈয়দ আহমদ তারেক, সৈয়দ হায়দার, হাফিজুর রহমান, হালিম আজাদ, হারুন রশিদ, হাসান হাফিজ প্রমুখ।

আশির দশকের প্রবণতা :

প্রবহমান সমাজ সংস্কৃতির অন্তর্চাপ ও বহিঃপ্রেরণা থেকে কবি মস্তিষ্কে কবিতার জন্ম হয়। কবিতার শিল্পকর্মে রূপবদ্ধ হওয়ার সময়, অন্যান্য শিল্পাঙ্গিকের মতো কবিতারও ছন্দে-শব্দে-রূপকল্পে সমকালীনতার স্পষ্ট উপাদান লেগে থাকে। বাংলা কবিতার পূর্বাপর গতির দিকে তাকালে, তার এই পরিবর্তিত রূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। সেই জন্যই এক দশকের কবিতার সঙ্গে অন্য দশকের কবিতার কোনও মিল থাকে না। সমাজÑসংস্কৃতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে কবিতার এই রূপ বদলের বিষয়টিও প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। প্রত্যেক দশকের কবিরা তাই দাবি করেছেন স্ব-দশকের কবিতার ‘নতুনত্ব’ ও ‘নিজস্বতা’র। আদালতের রায় ঘোষণার মতো স্বীকৃতি বা প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায়, কবিদের এ দাবি অমূলক নয়। ‘আশির দশকে কবিতায় ঘোষিত দার্শনিকতা ও চিরকালীনতাবিষয়ক প্রসঙ্গটি মন্ময়স্বভাবী ও বোধের অন্তর্দীপনে প্রত্যয়ী হয়েও তা ঐতিহ্যপট, ইতিহাস সময় ও সমাজপ্রতিবেশের দ্বারা অন্তর্দীপ্ত হয় না।…সিচুয়েশন দ্বারা সন্তপ্ত ও তাড়িত কবি এখন যেতে চান সিচুয়েশনের বাইরে, জীবনের বিকল্পে খুঁজে ফেরেন পরাক্ষেত্র―…আশির দশকের কবিতার এক প্রান্তে নগরজীবনের বিবমিষা ও বিমানবিক অন্তর্চাপ রয়েছে, নগর চেতনার সংকটও উচ্চারিত। ব্যক্তি এখানে পূর্বাপর যন্ত্রণাগ্রস্ত।’ (বেগম আকতার কামাল/শতাব্দীসন্ধির কবিতা: দিশা ও বিদিশা, ২৯-৩০, কথাপ্রকাশ, ২০২০, ঢাকা) কয়েকটি উদাহরণ :

ক. অবশেষে আমাকেই আমি খুন করে চলে যাবো/সমস্ত সন্তাপ মেখে চলে যাবো ভীষণ একাকী। (ফরিদ কবির/ ‘আত্মহননের পক্ষে’)

খ. আমি দেখেছিলাম তাদের/ ঈশ^র পাটনীর খেয়া পার হয়ে পাড়ে নামতেই/ তিনটি কলস কাঁখে তিনজন নারী এসে/ সামনে দাঁড়িয়েছিল, তিন প্রাজ্ঞ বৃক্ষের মতোন। (খোন্দকার আশরাফ হোসেন/ তিন রমণীর কসিদা)

গ. বিজনে বিজনে কাজ করো মন ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা/পান খাইয়া যাও/ ভাঙা ঘরখানি কারা ভাঙে, ফের ভাঙে/ভাঙা বাঁশিখানি কারা ভাঙে সকালের গাঢ় কুয়াশায়। (মোহাম্মদ সাদিক/ ‘বসিয়া বিজনে কাজ করো মনে’)

ঘ. ধোবানি গো/ গাঙুড়ের প্রেক্ষাপটে তুমি হও আমার রচনা/ আর আমি নিত্য হই নিত্য বিরচন। (সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ/ ‘লুব্ধক’)

আশির দশকের কবিতারও একটি নিজস্ব চেহারা, স্বতন্ত্র প্রকৃতি উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে রয়েছে। এই চেহারা যতই বিবর্ণ, বিদঘুটে, অসহ্য বাস্তবের দ্বারা বিপর্যস্ত হোক না কেন, আশির দশকের কবিতার শরীরে, দেহ ও ধমনিতে ধারণ করেছে সময়ের উদ্ধারহীন শূন্যতা, কুণ্ডলায়িত বাস্তবতা। দেশ ছিল সামরিক-স্বৈরাচার কবলিত, সমাজ ছিল অবরুদ্ধ। জনগণ ছিল আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তেজিত। পাপী ও পূণ্যবান সকলেই অস্তিত্বের প্রয়োজনে নেমে এসেছিল রাজপথে। সমাজ ও রাষ্ট্রের এই বহির্চাপ আশির দশকের কবিদের কর্ণমূল আরক্ত করেছিল। সন্দেহ নেই, সময়ের এই বাস্তবতাকে কবিতায় চিত্রিত করতে গিয়ে অনেকেই চিৎকার ও চেঁচামেচিকে কবিতায় প্রশ্রয় দিয়েছেন। স্বৈরাচারকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কবিতা হয়ে পড়েছে শিল্পহীন, অগভীর, নিকৃষ্ট। কবিতাকে বহন করতে হয়েছে সময়ের দায়। প্রতিবাদের সহজ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কবিতা। উদভ্রান্ত, দর্শনহীন, মীমাংসাশূন্য, অস্থির বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের মতো কবিরাও ছিলেন চরম উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে।

‘আশির দশকের অধিকাংশ কবি শৈশব-কৈশোরে দেখেছেন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দেখেছেন স্বাধীনতাÑউত্তর এক দশকের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত অনেকগুলো রক্তপাতের ঘটনা। রাজনৈতিক পালাবদল আর মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন। জাতির জনকের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান, সামরিক পোশাকে এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল―এসব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা আশির দশকের কবিতায় অনিবার্যভাবে ছায়াপাত করেছে। কাব্যমনস্তত্ত্বের এসব কথা অবচেতন প্রবাহ, বর্তমান বিরাগী মনের আনুভূমিক বিশ্ববিহার, ঐতিহ্যের চেতনাসাপেক্ষে প্রয়োগ এবং কাব্য অনুষঙ্গের বিপর্যাসের মধ্যে দিয়ে এসব কবির কাব্যবস্তু ও কাব্যভাষায় ভিন্নমাত্রিক আলোড়ন সূচিত হয়।’ (রফিক উল্লাহ্ খান/ বাংলাদেশের কবিতা সমবায়ী স্বতন্ত্র স্বর, পৃ: ১৯৮/৯৯)। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী শহরে ছোট পত্রিক বা লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে আশির দশকের কবিরা মূলত আবির্ভূত, বিকশিত। কাব্যচিন্তার দিক থেকে আশির দশকের কবিরা নিরীক্ষাপ্রবণ, নিজস্বতায় বিশ্বাসী। তাই তাঁরা পূর্বজ কবিদের প্রতি সীমাহীন অনাস্থা নিয়ে মুখ ফিরিয়েছিলেন। নিজস্ব অহংবোধে উজ্জীবিত হয়ে কবিতা লিখেছেন। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কবিতা লিখলেও আশির দশকের কবিদের কণ্ঠস্বর প্রায় অভিন্ন। এর কারণ, আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ, পাপী ও পুণ্যবান, আমলা ও কামলা, মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক একই কাতারে যেমন দাঁড়িয়েছিল, তেমনি কবিদের অনেকেইও রাজপথে সংগ্রামে নেমেছিল। সবার যন্ত্রণাই ছিল এক এবং অভিন্ন। লিটল ম্যাগাজিনের আত্ম-কুণ্ডলায়ন, গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা, অহংবোধ কবিতাকে এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়।

তাই আশির দশকের কবিরা ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে কবিতা লিখলেও তাদের কবিতার বিষয়, ভাষা, উপমা, চিত্রকল্পের মধ্যে প্রায় মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ মিল হয়তো কাকতালীয়। ব্যক্তিগত জীবনবোধ ও শিল্প-এষণার উত্তরকালে অনেকেই স্ব-কণ্ঠ অর্জন করে নিয়েছেন, স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছেন। অনেকে দর্শনচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, উত্তরাধুনিক দৃষ্টিকোণ, উত্তর ঔপনিবেশিক ধারণা দ্বারা পরিপুষ্ট করেছেন কবিতাকে। খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মাসুদ খান, মঈন চৌধুরী, ফরিদ কবির, মোহাম্মদ সাদিক, মারুফ রায়হান, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, সমরেশ দেবনাথ, সরকার মাসুদ, মহীবুল আজিজ,হাফিজ রশীদ খান, জিল্লুর রহমান, ওয়ালি কিরণ, সাজেদুুল হক, আবু মুসা চৌধুরী, অরুণ সেন, আনন্দ মোহন রক্ষিত, সাথী দাস, স্বপন দত্ত, সুহিতা সুলতানা, হাফিজ রশিদ খান, ওমর কায়সার, কাজল শাহনেওয়াজ, দারা মাহমুদ, শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, কামরুল হাসান, খালেদ হোসাইন, আমিনুর রহমান সুলতান, সৈয়দ তারিক, গোলাম কিবরিয়া পিুন, ফেরদৌস নাহার, আবু হেনা আবদুল আউয়াল, বিষ্ণু বিশ্বাস, সাজ্জাদ শরীফ, মৃদুল গুহ, অসীম কুমার দাস, আশিষ সেন, সিদ্ধার্থ হক, এজাজ ইসুফী, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ প্রমুখ যথার্থ শিল্পময় কবিতা লিখে নিজেদের কণ্ঠস্বর স্বতন্ত্র করতে পেরেছেন। একই স্থান থেকে যাত্রা শুরু করেও এরা যে স্বতন্ত্র হতে পেরেছেন, আত্মকণ্ঠ অর্জন করছেন, আবিষ্কার করতে পেরেছেন নিজেদের শিল্পতীর্থ পথ, এটাই আশির দশকের কবিদের অন্যতম প্রাপ্তি ও অহংকার। আপন সময়ের বৈরী অবস্থাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে রেজাউদ্দিন স্টলিন লিখেছেন :

‘আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত

মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মত ফাটা

আমার জন্ম কোনও সময়কে ইঙ্গিত করে না

এমন কি ঘটনাগুলো মুহূর্তের শৃঙ্খলমুক্ত।’ রেজাউদ্দিন স্টালিন/ ‘আমার সময়’)

উদ্ধারহীন, জন্মান্ধ সময়কে উড়িয়ে সাহসী তারুণ্যের দীপ্তবাক উচ্চারণ, স্টালিনের কবিতাকে সজীবতা দান করেছে, যা জীবনমুখিতারই নামান্তর। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতা সময়কে ধারণ করেছে এভাবে :

‘একদিন সে পাঁজরের হাড় দিয়ে গড়েছিল এ পৃথিবী

একদিন মানুষ ধ্বংস করবে তাকে।’

সময়ের এই নষ্টপ্রবণ চেহারা, মানুষের আত্মবিনাশী আয়োজন, তা দেখে শংকিত কবি। অথচ এ কথা তো ঠিক যে, একদিন মানুষই নিজের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছে সুন্দর পৃথিবী। সমাজ, রাষ্ট্র, বিবিধ ব্যবস্থা, সভ্যতা, সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে। অথচ আজ সেই মানুষই পৃথিবীকে ধ্বংসের আয়োজনে মাতাল হয়েছে। ফরিদ কবির আপন সময়ের চেহারা চিহ্নিত করতে গিয়ে লিখেছেন :

‘আমাকে নেয়নি কোনও যুদ্ধ, আমাকে পেছনে ফেলে বারবার চলে গেছে মিছিলের প্রতিধ্বনিগুলো

আমার চৌদিকে আজ অন্যায়ের অন্ধকার এসে

ঢেকে দিচ্ছে যাবতীয় কাক্সিক্ষত দিনের কোলাহল।’

আশির দশকের কবিতায় কবিদের আত্মদর্শনের স্বাতন্ত্রিক পঙ্ক্তিমালা থেকে আমরা সেই সময়ের বাস্তবতা স্পর্শ করতে পারি। অসীম কুমার দাস, মাহমুদ কামাল, ওয়ালী কিরণ এ তিন কবির কাব্যবোধ, শব্দ ব্যবহার, মিথ প্রয়োগ প্রায় অভিন্ন :

সেই গিরিশৃঙ্গতলে

অনশ্বর যন্ত্রণায় অতীন্দ্রিয় সেই পাটাতন

হেরাক্লিস সমুৎকর্ণ হলো

ডিমোগর্গনের নগ্ন অট্টনাদ

শ্রুতির উপান্তে এসে

চিঁহি চিঁহি রৌদ্রের আক্রোশে

আলোর তরঙ্গে ভাষা

সমুদ্র মন্থিত অশ্ব-উচ্চৈঃশ্রবা হলো

যার হংসবলাকার মতো কেশরের ঝঞ্ঝার প্রণোদনা

অকস্মাৎ চেতনার বিস্ময়

হেরাক্লিসের অন্য কোনও স্পৃহায় দিকচক্রবালে’ (অসীম কুমার দাস)

কবির দৃষ্টি বৈশ্বিক, মিথের পুনঃপৌনিক উল্লেখ, কবিতার স্বাভাবিক গতিকে শ্লথ করেছে। বোঝা যায়, সময়ের বহির্চাপ তাকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে। ওয়ালী কিরণের কবিতায়ও সেই পুরাণের ব্যবহারে সময়ের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট :

‘উঠে এসো, জলকুমারী-মৃত্তিকায়

পল্লবৃত্য হোক―জলে ছায়া পড়ুক

আপাত আলৌকিক চোখ তোমার

আসলে নির্বাসিত পোর্ট ব্লেয়ার

কালো জলমুখোশ ছিন্ন করে

চোখের তারায় ধরো সোডার বোতল

অচিরেই দ্রবীভূত হবে

অতএব কিছুক্ষণ জলছবি হও।’

ওয়ালী কিরণের বিজ্ঞানমনস্কতা ও ইতিহাস চেতনা তাঁর কবিতাকে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরে নিয়ে গেছে। হাফিজ রশিদ খান সময়ের অন্তর্মম কবি। প্রতিবাদ, চিৎকার, চেঁচামেচি, কোলাহল তাঁর কবিতায় নেই। তবে গভীর দহন, ক্ষত-বিক্ষত সময়ের বাস্তবতার রূপ অংকনে তিনি স্থির। তাই তার কবিতার শিরোনাম হয় ‘লোহিত ম্যান্ডোলিন’ বা ‘টোটেমের রাতে হত্যাকাণ্ড’। উত্তরকালে হাফিজ রশিদ খান আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতিকে কবিতার বিষয় করেছেন, উন্মোচন করেছেন বাংলা কবিতার নতুন এক দিগন্ত। কিন্তু আশির দশকের সময়কে চিহ্নিত করতে হাফিজ রশিদ খান লিখেছেন :

‘স্নায়ুর আকাশে এখনও তো আসে

একিলিসের ক্রোধ

দিনের ইশারা রাতের অপেরা

বিরক্তিতে কাটে।

শহীদ স্বজনে চেতনায় বুনে

প্রস্তুতিসমূহ

ঝলসাই আলো বিজলি জোরালো

বৈরীসেনা ব্যুহ।’

আশির দশকের কবিতায় বিশ্বমিথের সঙ্গে দেশজ মিথের অন্তর্বয়ন কবিতাকে নতুন এক মাত্রা দান করেছে। বিপর্যস্ত সময়কে চিহ্নিত করার জন্য বা সময়ের অতিক্রমের লক্ষ্যে অসহ্য বাস্তবকে তুলে ধরেছেন মিথের অন্তর্বয়নে।

 মনো-দৈহিক উন্মোচন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়, পলায়নপর সময়কে যাপন করতে গিয়ে আশির দশকের অনেক কবি অগভীর, শিল্পহীন, তাৎক্ষণিক বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এজন্যে অনেক কবিতা স্লোগানের স্তরে নেমে এসেছে। কারও কারও কবিতায় চিৎকার, চেঁচামেচি স্থান পেয়েছে। সামরিক, স্বৈরাচারকে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কবিতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেইসব কবিতা সময়ের দাবি মিটিয়েছে সত্য কিন্তু বুদবুদের মতো হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। আশির দশকের স্লোগানসর্বস্ব এসব ক্ষতি করেছে শিল্পময় কবিতার। বলা যায় আশির দশকের কবিতার দুইটি স্পষ্ট ধারা রয়েছে।

এক. স্লোগানসর্বস্ব কবিতা

দুই. শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্লোগানময় কবিতার গুরুত্বও কম নয়। কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বারবার রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবাদল, সামাজিক সংকট তৈরি করেছে। এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য বার বার আন্দোলন করেছে, সংগ্রাম করেছে, প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ, গণতন্ত্রের সুফল জনগণ এখনও পায়নি। পূর্বাপর সংগ্রামশীল হতে হয়েছে কবিতাকে। আশির দশকের কবিতায় সেই ক্ষতের চিহ্ন একটু বেশি করে লাগলেও শিল্পÑউত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যাও কম নয়। কবিতার শব্দ, ছন্দে, উপমা, চিত্রকল্পে আশির দশকের কবিতায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রয়েছে।

নব্বই দশকের প্রবণতা :

নব্বই দশকের কবিতার ক্ষেত্রে একযোগে এগিয়ে এসেছেন একদল প্রাণময় কবি। সংখ্যায় এরা অনেক। নব্বইয়ের কবিরা শব্দকে অভিজ্ঞান, অভিধান-উত্তর ব্যঞ্জনাদান, ধ্বনিগুণ এবং সঙ্গীতগুণকে কবিতায় সচেতনভাবে প্রয়োগে প্রয়াসী। কবিতার আঙ্গিক ও গঠন-কাঠামোতেও পরিবর্তন, পঙ্ক্তি বিন্যাসে ব্যতিক্রমী হতে চেষ্টা করেছেন। বাংলা কবিতার প্রচলিত ছন্দের বন্ধন থেকে কবিতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন অনেকে। বাংলা কবিতার আবহমান অভ্যস্ত পাঠকের কাছে নব্বইয়ের কবিতা ছন্দ-ছুট মনে হতে পারে। শুধু আঙ্গিক নয়, বিষয় ভাবনার ক্ষেত্রেও নব্বইয়ের কবিরা পূর্বাগত, প্রথাগত নয়। পূর্ববর্তী দশকের কবিদের মতো নব্বইয়ের কবিরা সমাজ- পরিস্থিতিতে আক্রান্ত নন, এরা তাকিয়েছেন আপন চৈতন্যের দিকে, আত্মোক্তির উদ্বোধন ঘটাতে চান কবিতায়। তাই সময়-পরিধি থেকে তাদের কবিতা মুক্ত।

ক. মনোবাসে আছি আমি মনেবাসে আছি, অজানা স্রোতের টানে নাই হয়ে বাঁচি/ দেশছাড়া খেশছাড়া ভিনবাসী মন, হারানো মানুষ আমি করহ যতন/পাঁচবেলা মজে থাকি জপি প্রেমনাম, নিন্দুকেরা দেখে শুধু দেহভরা কাম/ ইবাদতি করি মনে নিত্যানন্দ থাকি, দেখিয়া অনেক ছায়া এই কায়া আঁকি/ কাছে থাকি পাশে তাকি বাওসারা লোক, আমার হয়েছে দেখ মায়ার অসুখ/ তুমিও রাখিও কাছে রাগঅনুরাগে, আমাকে বাঁধিও তুমি মালকোশ রাগে/ ভাবঘোরে ঘিরে রেখো যতো ভুলচুক, ইরম করিছে দাবি এই মায়া হোক।’ ( মুজিব ইরম/ মনোবাস)

খ. আমি রহস্যপুর হাসপাতালে শুয়ে আছি, গল্পের মাঝামাঝি কোনও পৃষ্ঠায়। খুবই জানি, সুস্থ হলেই আবারও সেই ষড়যন্ত্র, প্রজাপতি। হয়তো আমারও খুব ইচ্ছে করবে, তার ডানার খোপের অন্ধকারে রঙ মেখে ঘুমিয়ে থাকি, জাগি। বোঝাই তো যাচ্ছে, এরপর গল্পে একটা খুন এসে যাবে, টিকটিকিরাও জানাচ্ছে, চিরকালই খুনের প্রেরণা নারী। সিরিয়াস পাঠক আমি, হিটলিস্টে আছি। সুতরাং খুন হয়ে যাবো―এই ভয়ে অসুস্থ থাকি। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে নার্স ও নারীর আন্তঃপার্থক্যটুকু ধরার চেষ্টা করছি, পড়ার চেষ্টা করছি আমার পোড়ামন চিকিৎসাধীন। (টোকন ঠাকুর/ বসন্ত দিন)

গ.‘তিনি  সব কিছু অগ্রিম চাইতেন/ বৃক্ষের আগে ফল/ সন্ধ্যার আগে চাঁদ/ নিদ্রার আগে স্বপ্ন/ সূর্যের আগে সকাল/ বিয়ের আগে সন্তান চাইলেন/ তার প্রেমিকা গর্ভবতী হলো/…যেদিন তিনি নিজ গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন/ তার চামড়া মালভূমির মতো ভাঁজ/ মৃত্যুর মিস্ত্রিকে ডেকে তিনি বানালেন/কারুকার্যময় কফিন ও কবর। সেলাই না-করা শাদা পোষাকে শরীর গলিয়ে/ এক লাফে ডিগবাজি খেলেন কফিনে।’ (চঞ্চল আশরাফ/ বিলাসিতা)

আবেগের বদলে বুদ্ধির প্রয়োগ দেখা যায় নব্বইয়ের কবিতার মধ্যে। অনেকে দূরদর্শী, ভবিষ্যৎমুখী, দর্শন-চিন্তায় মগ্ন। লোকজ ফর্ম, লোকজ অনুষঙ্গকে ভেঙ্গে নতুনÑনিরীক্ষায় কবিতায় প্রয়োগ করেছেন নব্বইয়ের কবিরা। মোট কথাÑভাষা, ব্যাকরণ, ছন্দ এবং কবিতার প্রথাগত পূর্বাগত ধারণা থেকে মুক্তি দিতে চান কবিতাকে তারা। নব্বইয়ের কবিতার স্বরূপ উন্মোচনে যাদের কবিতা পাঠ গুরুত্বপূর্ণ―আলফ্রেড খোকন, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ্, আশরাফ রোকন, আয়েশা ঝর্ণা, কামরুজ্জামান কামু, কবির হুমায়ূন, কুমার চক্রবর্তী, ব্রাত্য রাইসু, জাফর আহমদ রাশেদ, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মুজিব মেহেদী, মারজুক রাসেল, মোস্তাক আহমদ দীন, মুজিব ইরম, মিহির মুসাকী, শামীম রেজা, শাহনাজ মুন্নী, সরকার আমিন, শাহেদ কায়েস, হেনরী স্বপন, ওবায়েদ আকাশ, সাখাওয়াত টিপু প্রমুখ। নব্বইয়ের নবো™ূ¢ত কবিদের মানসযাত্রা লোকঐতিহ্যের আদিভূমিক, মিথÑপুরাণ, লোকবিশ্বাস, লোকজীবন, নিসর্গলোক, প্রত্ন-ইতিহাস―এসবে অবগাহন। উত্তরাধুনিক শিল্পতত্ত্ব, উত্তর-উপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ, জ্যাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, এডওয়ার্ড সাঈদ পাঠÑঅভিজ্ঞতা নব্বই প্রবংশের কবিদের একটি ভিত্তিভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। লোক ঐতিহ্য, মিথ-পুরাণ, প্রত্ন-ইতিহাস―এসবের আলোকে তারা নাগরিক বৈদগ্ধ্যকে আঘাত করেন, শাহরিক কৃত্রিম জীবনপ্রণালিকে জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চান নব্বইয়ের কবি ও কবিতা। না, চ্যালেঞ্জ নয়, অনুসন্ধান নয়, বিদীর্ণ, বিচূর্ণ করে দেখতে চান ভেতর ভুবনকে, যেখানে তার নিজের অবস্থান, অস্তিত্ব। এজন্যই নব্বইয়ের কবিতা কিছুটা জটিল, দ্বন্দ্বদীর্ণ, কোমলতাহীন, রুক্ষ, নিষ্করুণ। নব্বই দশকে আবির্ভূত কবিরা হলেন―

অদিতি ফাল্গুনী, অনন্ত জাহিদ, অরূপ রাহী, অলকা নন্দিতা, আদিত্য কবির, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ্, আমিনুল রানা, আমীর আজম খান, আমীর খসরু স্বপন, আয়শা ঝর্না, আলফ্রেড খোকন, আশরাফ রোকন, আশিক আকবর, আশিক সালাম, আহমেদ নকীব, আহমেদ মুজিব, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, ওবায়েদ আকাশ, কবির হুমায়ুন, কামরুজ্জামান কামু, কুমার চক্রবর্তী, খলিল মজিদ, খোকন মাহমুদ, গাজী আলমগীর, গাজী লতিফ, চঞ্চল আশরাফ, জহির হাসান, জাকির আবু জাফর, জাফর আহমদ রাশেদ, জামশেদ ওয়াজেদ, জুনান নাশিত, জেনিস মাহমুদ, জ্যাকি ইসলাম, টোকন ঠাকুর, তপন বাগচী, তাপস গায়েন, তুষার গায়েন, দাউদ আল হাফিজ, নান্নু মাহবুব, পরিতোষ হালদার, পরিমল রায়, পাবলো শাহি, পাঁশু প্রাপণ, প্রত্যয় জসীম, ফাতিমা তামান্না, ফাহিম ফিরোজ, বদরে মুনীর, বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, বায়েজিদ মাহবুব, বিপ্লব ফারুক, বীরেন মুখার্জী, ব্রাত্য রাইসু, মজনু শাহ, মতিন রায়হান, মশিউর রহমান খান, মহিবুর রহিম, মাতিয়ার রাফায়েল, মামুন মিজান, মামুন মোস্তফা, মারজুক রাসেল, মারুফুল আলম, মাসুদার রহমান, মাসুদ মুস্তাফিজ, মাসুম মোকাররকম, মাসুদুল হক, মাহবুব কবির, মাহবুব মোরশেদ, মিজান খন্দকর মিহির, মুসাকী, মুজিব ইরম, মুজিব মেহেদী, মোস্তাক আহমাদ দীন, রওশন ঝুনু, রণক মুহাম্মদ রফিক, রনজু রাইম, রহমান হেনরী, রাজু আলীম, রাসেল আশেকী, রায়হান রাইন, রাশেদ রহমান, রিষিণ পরিমল, রোকসানা আফরিন, লীসা অতন্দ্রীলা, শওকত হোসেন, শাকিল রিয়াজ, শান্তা মারিয়া, শামীম কবির, শামীম রেজা, শামীমা সিদ্দিকী, শামীমুল হক শামীম, শাহনাজ মুন্নী, শাহীন মোমতাজ, শাহেদ শাফায়েত, শিবলী মোকতাদির, শিবলী সাদিক, শোয়াইব জিবরান, সিরাজুল হক সিরাজ, সমর চক্রবর্তী, সরকার আমিন, সাইমন জাকারিয়া, সাখাওয়াত টিপু, সাহেদ কায়েস, সিদ্ধার্থ হক, সিরাজুল এহসান, সুমন সরদার, সৈকত হাবিব, সৈয়দ শাহিন রিজভী, সৌমিত্র দেব, হাদিউল ইসলাম, হামিদ রায়হান, হাসান আল আবদুল্লাহ্, হাসান মাহমুদ, হেনরী স্বপন প্রমুখ।

নব্বই দশকের কবিতায় প্রকরণ-পরিচর্যায় বহুভুজ দৃষ্টিকোণ লক্ষ করা যায়। কবিতার বিষয়ের চেয়ে অধিবিদ্যা, শব্দ-অবয়বে অভিজ্ঞতা, নতুন বোধ ও চেতনাচিত্রণের প্রয়াস রয়েছে। ফোক কালচারের মোটিফ―পুথি, জিকির, রূপকথা, অঞ্চলিক কথনভঙ্গির আশ্রয়ে কাব্যভাষ্যের ডিসকোর্স হাজির করেছেন।

শূন্য দশকের কবিতার প্রবণতা

আবহমান বাংলা কবিতা মূলত লিরিকময়। তবু, মহাকাব্য, আখ্যায়িকা, পাঁচালি, নাটগীতি, গীতিকা ইত্যাদি আঙ্গিকগত স্বাতন্ত্র্য পেরিয়ে বাংলা কবিতা এখন উপনীত হয়েছে খণ্ডকবিতায়। আধুনিক পর্বে এসেও বাংলা কবিতা ক্লাসিসিজম, মিস্টিসিজম, রোমান্টিসিজম, মর্ডানিজম, পোস্টমর্ডানিজম প্রভৃতি প্রাচ্য ও প্রতীচ্য শিল্পরীতির বিচিত্র পথ ধরে এগিয়েছে। শূন্য দশকের কবিরা বাংলা কবিতার ওই দীঘল ধারণা স্মরণে রেখে কবিতা লিখছেন। তাই ভাষায় এনেছেন তারা ভিন্নতা। অগ্রজদের অনুগামী না হয়ে কবিতায় গদ্যভাষাকে গ্রহণ করেছেন কেউ কেউ নির্দ্বিধায়। কাব্যভাষায় চমক সৃষ্টি করে তারা প্রথাগত ছক থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করেছেন। পিয়াস মজিদ, সোহেল হাসান গালিব, মাদল হাসান, পলাশ দত্ত, চন্দন চৌধুরী, জাকির জাফরান প্রমুখের ভাষা ও বোধের নতুনত্ব লক্ষ্য করা যায় :

‘ফুলের দেশে গেলে

আমার পছন্দ তিতকুটে পুষ্প।

কারণ সুঘ্রাণ যত্রতত্র

আর তেতো কুসুমই

পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল আস্বাদ।

 (পিয়াস মজিদ/ ফুলবন থেকে)

নিশিত কিছুই শেখাবেনা বাঁশিঅলা

ইঁদুর তাড়াবে সে একথা ঠিক

শুধু চায় জনে জনে বাঁশি কিনে নিক

তবু ‘চলে যাও’ একথা যাচ্ছে না বলা

(মাদল হাসান/ বাঁশিঅলা।)

আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন

বললেন, ধরো, ডালে বসা দুটি পাখি থেকে

শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল

তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি ?

অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল

বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে

আর মনে এল তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।

(জাকির জাফরান/চিঠি)।

শব্দই কবিতার সত্তা, কেননা শব্দে থাকে অর্থ, ধ্বনিচিত্র, সংকেতদ্যোতনা। প্রাচীন রসশাস্ত্রে শব্দকে কবিতার আত্মা বলে অভিহিত করা হয়েছে। শূন্য দশকের কবিরা শব্দের সেই সার্বভৌমত্ব, সংকেতদ্যোতনাকে কবিতার অবয়ব বিন্যাসে বেশি কাজে লাগিয়েছেন। প্রতীকবাদীদের মতো শূন্য দশকের কবিরা কবিতার আত্মা ও শরীরকে নন্দনচিন্তায় এনে এক বিশেষ প্যাটার্নের কবিতা লিখতে সচেষ্ট। শূন্য দশকের কবিরা হলেন―

আলতাফ শাহনেওয়াজ, অতনু তিয়াস, অদ্বিত্ব শাপলা, অনন্ত সুজন, অনিন্দিতা ইসলাম, অপূর্ব সোহাগ, অবনি অনার্য, অভিজিৎ দাস, অরবিন্দ চক্রবর্তী, অশোক দাশগুপ্ত, অস্ট্রিক মাসুদ, আপন মাহমুদ, আফরোজা সোমা, আবু তাহের, সরফরাজ সুজন, আমির আবদুল্লাহ্, আযাদ কামাল, আরণ্যক টিটো, আসমা বীথি, আহমেদ কিংশুক, আহমেদ ফিরোজ, আহমেদ সায়েম, ইমতিয়াজ মাহমুদ, ইরান মাহফুজ, ইমরান মাঝি, ইসলাম রফিক, ঈশান সামী, এমরান কবির, এমরান হাসান, এহসান হাবীব, কাজী নাসির মামুন, কাফি কামাল, কামাল মহম্মদ, খায়রুল কবির, খালেদ রাহী, গাজী ইমরান, গৌতম কৈরী, চন্দন চৌধুরী, জফির সেতু, জাহানারা পারভীন, জাকির জাফরান, জাহিদ সোহাগ, জিয়াবুল ইবন, জুননু রাইন, জুয়েল মোস্তাফিজ, জাহেদ আহমদ, তানজিম ইসলাম, তানজীর মেহেদী, তানিয়া বখশ, তালাশ তালুকদার, তারিক টুকু, তুষার কবির, তুহিন তৌহিদ, দেবব্রত দাশ, নওশাদ জামিল, নাসরীন রশীদ, নিতুপূর্ণা, নিলয় রফিক, পরাগ রিছিল, পলাশ দত্ত, পিয়াস মজিদ, ফয়সল নোই, ফারুক আহমেদ, ফেরদৌস মাহমুদ, বদরুন নাহার, বিজয় আহমেদ, বিধান সাহা, বিপাশা মণ্ডল, বিলাল হোসেন, বিল্লাল মেহেদী, মনিরুল মনির, মাজুল হাসান, মাদল হাসান, মানস স্যানাল, মামুন খান, মামুন রশীদ, মারজুক রবীন, মাসুদ পথিক, মাসুদ হাসান, মাহমুদ শাওন, মাহমুদ সীমান্ত, মিজানুর রহমান বেলাল, মিঠু রাকসাম, মুজাহিদ আহমদ, মুন্না মানসী, মুয়ীয মাহফুজ, মৃদুল মাহবুব, মোস্তফা তারেক, যুবক অ্যার্য, যুবা রহমান, রনি অধিকারী, রবু শেঠ, রহমান মাসুদ, রাজীব অর্জুনি, রাতুল আহমেদ রাশেদুজ্জামান, রাহেল রাজীব, রিসি দলাই, রুদ্র আরিফ রুদ্র শায়ক, লতিফ জোয়ার্দার, শাবিহ মাহমুদ, শামীম নওরোজ, শামীম হোসেন, শারদুল সজল, শাহানা আকতার মহুয়া, শিশির আজম, শুভাশিস সিনহা, সজল আহমেদ, সজল ছত্রী, সজল সমুদ্র, মনোজ কুণ্ডু, সফেদ ফরাজী, সাকিরা পারভীন, সামন্ত সাবুল, সারফুদ্দিন আহমেদ সিদ্ধার্থ টিপু, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, মুমন সুপান্থ, সুমাত্রা রহমান, সোমেশ্বর অলি, সোহেল হাসান গালিব, স্বপন সৌমিত্র, সৈয়দ শিশির।

উপসংহারের পরিবর্তে

আমাদের সমকালীন কবিতার জনবিচ্ছিন্নতার কারণ কী ? পাঠক কেন আজকালকার কবিতায় বিমুখ! কবিতা পড়ে ভেতরের সুপ্ত,লুপ্ত বোধ-বুদ্ধিতে উজ্জীবিত হতে পারছে না, বিবেকে-সংবেদে জেগে উঠছে না ? কাব্যভাষায় সেই ধারালো ভাষা কোথায় ? মঞ্জুরিত আবেগে কম্পমান, তোলপাড় করা কবিতা কই ? সবই চর্বিত-চর্বণ, অনুকরণের অনুকরণ। পাঠক আপন শুশ্রƒষার জন্য কবিতার কাছে যাবে ? না-কি কবি ও কবিতা পাঠকের কাছে যাবে ? এই এক বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের মীমাংসা নেই হয়তো, কিন্তু বলার কথা হচ্ছে-কবিকে ব্যক্তিক-নিমজ্জন, আত্মভুক গর্ত থেকে বেরিয়ে শাণিত ভাষার ঝলসানি লাগা সর্বজনীন বিষয়-ভাব ও প্রাগ্রসর চৈতন্যের কবিতা লিখতে হবে, তেমনি পাঠককেও সমকালীন দ্বন্দ্ব-জটিল-মনস্তত্ত্বের অভিযাত্রী, অভিনিবেশী পাঠক হতে হবে। তিরিশি  কবিদের রবীন্দ্র-দ্রোহ শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ভাব ও রূপকের একটা সরলরৈখিক কাঠামো পেয়ে গেছে ‘আধুনিক’ শব্দটির মধ্যে, যা ‘মধ্যযুগীয়’ অভিধা থেকে তিরিশি কবিদের মুক্তি দিয়েছিল। উত্তরকালে ‘আধুনিকতা’, ‘আধুনিক কবিতা’ আমাদের সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে গুরুত্ব পেয়ে আসছে এবং ‘আধুনিকতা’, ‘আধুনিক হওয়া’ একটা মোহ তৈরি করেছে বাঙালিদের মধ্যে। তিরিশি আধুনিক কবিতার অর্জন : নাগরিকতা, নগরনির্ভরতা, গ্রামবিচ্ছিন্নতা। চর্যাগীতি, মঙ্গলকাব্য থেকে বৈষ্ণব পদাবলী পর্যন্ত বাংলা কবিতা ছিল মূলত গায়ন-বয়ান-পঠন নির্ভর গণসম্পৃক্ত-বিনোদনের সম্পদ-সামগ্রী। এর বিপরীতে আধুনিক কবিতার সামাজিক ও সাহিত্যিক পরিণতি ভালো কী মন্দ, সেটা তুলনা করে দেখা যেতে পারে। কবিতায় বৈশ্বিক দৃষ্টি, কলাকৌশলের নির্ভরতা, লিবারেল হিউমিনিজম, জাতীয়তাবাদী চেতনা, মার্কসবাদী চেতনা―এই অর্জন খুব কম নয়। ক্ষতি : আমজনতা, মাটিলগ্নতা, নিজস্ব ঐতিহ্য থেকে আধুনিক কবিতা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শিক্ষিত, নাগরিক, উচ্চকোটি মানুষের উৎপাদন এবং উপভোগের সামগ্রী হয়ে গেছে আধুনিক কবিতা। আমাদের সমালোচনা সাহিত্যে গ্রান্ডন্যারেটিভসের গুরু―বুদ্ধদেব বসু, দীপ্তি ত্রিপাঠী, অশ্রুকুমার সিকদার, অরুণ কুমার মখোপাধ্যায়, সৈয়দ আলী আহসান, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের বিশ্লেষণে আধুনিক কবিতার এই জনবিচ্ছিন্নতার কোনও আলাপ নাই। তিরিশি কবিরা বাংলা কবিতার নগরপুত্র, ভূমিপুত্র নয়―এই ডিসকোর্সে, সজাগ ও  বিক্ষোভের ঝড়, ভেতরে ধারণ করতে না পারলে ঔপনিবেশিক চিন্তা থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাব কী ? গ্লোবালাইজেশন ও প্রযুক্তি উৎকর্ষের যুগে বাংলা কবিতার নিজস্ব স্বরায়ন, অর্থাৎ মাটি খুঁড়ে শেকড়ের সন্ধান করতে হবে, বৈদেশিক ঋণের চেয়ে আবহমান মিথ, ইতিহাস-ঐতিহ্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে কবিতার স্বতন্ত্র স্বর, কাব্য-ভাষ্য নির্মাণে যত্নশীল হতে হবে। ভাবীকালের কবিদের কাছে এই আমাদের অন্তহীন আন্তরিক প্রত্যাশা।

 লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,

ডিন, কলা ও মানবিক অনুষদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button