আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

প্রচ্ছদ রচনা : সংস্কৃতি ও সাহিত্য : সংস্কৃতি-সদাচার-ব্যক্তিত্ব ও আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন : মোহিত কামাল

শুরুতে দুটি শব্দের অর্থ এবং অর্থের গভীরতা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। শব্দ দুটি হলো ‘সংস্কৃতি’ ও ‘সদাচার’। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ‘ব্যক্তি’, ‘ব্যক্তিত্ব’ ও ‘সমাজ’; রয়েছে রাজনীতি ও প্রশাসন, ধর্মীয় অনুশাসনও। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আলোকে বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় : একেকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের বিশেষ যাপিত জীবনের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা, বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর জীবনাচরণেও রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। কিছু কিছু বিষয় একসুতায় গাঁথা থাকলেও যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা বিয়েপ্রথা নিয়েও রয়েছে নানা-রকম আচার-অনুষ্ঠান। উপজাতি কিংবা আদিবাসীদের ভাষা এবং যাপিত জীবনের মধ্যেও রয়েছে নানা পার্থক্য। আর সমকালীন বিশ্বগ্রামের ভিন্নতর যে-প্রতিচিত্র আমরা দেখতে পাই, উন্নত প্রযুক্তির কারণে, তার মধ্যে সমন্বয় তৈরি করতে পারাটাও সদাচারী সংস্কৃতির বিশ্বনির্মাণের জন্য অতীব প্রয়োজন। আকাশ-সংস্কৃতির কারণে এখন বিশ্ববাসী এক বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা হয়ে গেছে। তবু বলা যায়, বাসযোগ্য নিজস্ব স্বতন্ত্র সমাজ-স্বদেশ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

প্রত্যেক সমাজ, দেশ নিজেদের সংস্কৃতির আলোকে সদাচারের চর্চা করতে পারলে ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ আলোকিত থাকবে, বিশ্বাস করি আমরা। তবে পরিবারকে মূল কেন্দ্র ধরে এই পরিচর্যা শুরু করতে হবে শিশুকাল থেকে। ‘সদাচার’ শব্দটাকেও গুরুত্ব দিতে হবে শিশুকাল থেকে। ব্যক্তিত্বের বুনিয়াদ গড়ে ওঠা এবং এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা অর্জন করতে হবে মা-বাবা এবং পরিবারের স্বজনদেরও।

‘সদাচার’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘সদাচরণ’ (সৎ+আচরণ), অর্থাৎ ভালো ব্যবহার, শিষ্টাচার। এটি মহৎ গুণ। কাদামাটির বয়স থেকে আত্মশুদ্ধি বা আত্ম-উন্নয়নের এসব মৌলিক গুণ ব্যক্তিত্বের ভিত্তিমূলে গেড়ে বসলে চারপাশ সুন্দর হতে থাকে। সুন্দর হতে বাধ্য। সদাচারের প্রকৃত চর্চা শুরু হয় তখন থেকেই। সততাচর্চায় নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তখনই  একটি শিশুর মধ্যে মহত্ত্বের বীজ অঙ্কুরিত হবার ভূমি প্রস্তুত হতে শুরু করে। মুখোশধারী সদাচারী ব্যক্তি শিষ্টাচারের আড়ালে প্রতারণাও করতে পারে। আত্মপ্রতারকও হতে পারে। উন্নত সংস্কৃতির বীজ বপন করে আলোকিত বৃহত্তর জাতীয় জীবনের সৌধ নির্মাণ করতে হলে যে কোনও ধরনের প্রতারণা থেকে দূরে থাকতে হবে। এই প্রতারণার শিকড় উপড়ানোর সময় শিশুকালেই।

আর তাই, সংস্কৃতি, সদাচার ও ব্যক্তিত্বের আন্তঃসম্পর্কের নানা বিষয় নিয়ে এই প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিকভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ধাপে ধাপে।

প্রথমে আলোচনা করতে চাই―সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি?

‘সংস্কৃতি’ এসেছে ‘সংস্কার’ থেকে। অভিধানে এর অর্থ : কোনও জিনিসের দোষত্রুটি বা ময়লা-আবর্জনা দূর করে তা ঠিকঠাক করে দেওয়া। আরেক গভীর অর্থ হলো দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনবোধ বিনির্মাণের মাধ্যমে মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। তা ঘটে থাকে কিংবা অর্জিত হয়ে থাকে সদাচারের মাধ্যমে। এজন্য বলা যায় সংস্কৃতি ও সদাচারকে একই সুতায় গেঁথে উন্নত সমাজ, টেকসই প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।

মূলত আমার বা আমাদের যা কিছু আছে তা-ই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মূল কথা নিজেকে সুন্দর করা, সভ্য করা, মন-মানসিকতা উন্নত করা। বড়বেলায় বা বোধসম্পন্ন হয়ে ওঠার বয়স থেকে তার জন্য প্রয়োজন নিজেকে বোঝা। নিজের বাজে আচরণ বা নিজের ঘাটতি শনাক্ত করা এবং তা সংশোধন করে উন্নত সামাজিক-পারিবারিক-রাজনৈতিক পরিবেশ নির্মাণে সহায়তা করা।

এমন একটি ধারণা সাধারণভাবে প্রচলিত যে সংস্কৃতিচর্চা বলতে কেবল শিল্প-সাহিত্য ও সংশ্লিষ্ট নানাবিধ কলার চর্চাই বোঝায়। সংস্কৃতির এ পরিচয় আংশিক। সংস্কৃতির সৃজনশীল ও বিনোদনের দিক হিসেবে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য ও চিত্রকলার মতোই সংস্কৃতির আরও নানামাত্রিক প্রকাশ রয়েছে। এসব কিছুতে সমাজে নিহিত সমস্যা, জীবনযাত্রার নানা সংকট, দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তনের শৈল্পিক রূপ প্রকাশ পায়। ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের বৈচিত্র্যময় রূপও সংস্কৃতির বিশাল ক্যানভাসে ধরা পড়ে। সংস্কৃতির যেমন রয়েছে সামাজিক অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতার দিক, তেমনি রয়েছে বিনোদনের উপভোগ্যতা। এই দুই দিক নিয়ে সংস্কৃতিচর্চার পথ চলা।১

কোনও স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যকলা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তা-ই সংস্কৃতি। উক্ত বিষয়গুলোকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ নিত্যদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।২

সংস্কৃতি হলো টিকে থাকার কৌশল। মানুষের এই কৌশলগুলো ভৌগোলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে।… পূর্বপুরুষদের যেমন এই কৌশলগুলো ছিল তা থেকে উত্তরপুরুষেরা কৌশলগুলো পেয়ে থাকে। অধিকন্তু সময় ও যুগের পরিপ্রেক্ষিতেও তারা কিছু কৌশল সৃষ্টি করে থাকে। তাই বলা যায় সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরোপিত অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তেমনি তা অর্জিতও বটে।৩

নৃবিজ্ঞানী ই.বি. টেইলারের মতে৪ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হলো সংস্কৃতি।

স্যামুয়েল পুফেনডর্ফের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সংস্কৃতি বলতে সেই সকল পন্থাকে বুঝায় যার মধ্য দিয়ে মানব জাতি তাদের প্রকৃত বর্বরতাকে কাটিয়ে ওঠে এবং উদ্ভাবনী কৌশলের মাধ্যমে পূর্ণরূপে মানুষে পরিণত হয়।৫

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতে৬: …মার্জ্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কালচারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। বাইরের আদেশ নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক। … আর সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা।

…কালচার্ড লোকেরা সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না―এই তাদের ভেতরের দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেননা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম্ম সৃষ্টি করা কালচারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক কালচার নেই। কালচার একটি  ব্যক্তিগত ধর্ম্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ।

… কালচারের আদেশ: দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোল। তাতেই হবে তোমার দ্বারা সমাজের শ্রেষ্ঠ সেবা, যদিও সমাজের বিরক্তি-ভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য।

… কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ, পতন বা পাপ থেকে রক্ষা নয়। গোলাপের সঙ্গে যদি দু-একটা কাঁটা এসেই যায় তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কিনা―এ-ই কালচারের অভিমত।

… ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনসাধনারই অপর নাম কালচার। মন ও আত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত করে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের নবজন্মদানই কালচারের উদ্দেশ্য। অবশ্য এই ইন্দ্রিয়নিচয়ের সবকটিই যে সমমূল্য তা নয়। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে চক্ষু আর কানই সেরা। তাই তাদের স্থান সকলের আগে দেওয়া হয়েছে।

…সংক্ষেপে সুন্দর করে, কবিতার মতো করে বলতে গেলে সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে, মহৎ ভাবে বাঁচা; প্রকৃতি-সংসার ও মানব-সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা; কাব্যপাঠের মারফতে ফুলের ফোটায়, নদীর ধাওয়ায়, চাঁদের চাওয়ায় বাঁচা; আকাশের নীলিমায়, তৃণগুল্মের শ্যামলিমায় বাঁচা, বিরহীর নয়নজলে, মহতের জীবনদানে বাঁচা; গল্পকাহিনি মারফতে, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা; ভ্রমণ কাহিনির মারফতে, বিচিত্র-দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা; ইতিহাসের মারফতে মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশে বাঁচা; জীবন-কাহিনির মারফতে দুঃখীজনের দুঃখ নিবারণের অঙ্গীকারে বাঁচা। বাঁচা, বাঁচা, বাঁচা। প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা। বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।

উল্লিখিত ব্যক্তিমত, কাব্যিক কথা ও বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সংস্কৃতির অপরিহার্য উপাদান হলো ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য, বসতি ও নৃতত্ত্ব, সামাজিক গঠন, জাতিভেদ প্রথা, ভাষা, সাহিত্য-সংগীত-নাটক ও থিয়েটার, গণমাধ্যম, রন্ধন, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, খেলাধুলা-ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, শরীরচর্চা এবং সামাজিক জীবনযাত্রা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি ইত্যাদি। এসব কিছু বিবেচনায় রেখে স্পষ্ট করে বলা যায়, সংস্কৃতির প্রাণই হচ্ছে ব্যক্তির আচরণ। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বই শোভন আচরণের মাধ্যমে সুন্দর পরিবেশ উপহার দেয়, সফলতা বয়ে আনে উপরোক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’ সুন্দর হবে, না অসুন্দর, তা-ই ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। কালচার বা কৃষ্টি তাকে আপন ঢংগে আদল দেয়; গভীরভাবে বাঁচতে শেখায় পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কর্মক্ষেত্রে সর্বোপরি রাজনৈতিক অঙ্গনেও।

দুই

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিশুর বেড়ে ওঠা ও সদাচারের সম্পর্ক:৭ দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত অতি পরিচিত একটি শব্দ হলো ‘ব্যক্তিত্ব’। কথাবার্তায়, আলোচনা, সমালোচনায় আমরা প্রায়ই শব্দটা ব্যবহার করি। এর পুরো অর্থ কি ভালোভাবে বুঝি? এর বৈজ্ঞানিক অর্থ ও গূঢ়ত্ব অনেক সময় আমরা বুঝি না। অথচ ‘সদাচার’ বা ‘অসদাচার’ বিষয়ে বুঝতে হলে, আগেই বলা হয়েছে, শিশুকাল থেকে গড়ে উঠতে থাকা ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের প্রতি নজর দিতে হবে।

শিশুর বিকাশের কথা যখন আমরা আলোচনা করি, সহজে বুঝতে পারি কী ধরনের বৈশিষ্ট্য (ঞৎধরঃং) নিয়ে বড় হচ্ছে তারা। বৈশিষ্ট্যের এই গড়ন সহজেই একটি শিশু থেকে অন্যটিকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করে তোলে। এটাই ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষদ। অন্যের সঙ্গে মেলামেশার মাধ্যমে শিশুর সামাজিক অবস্থানও আলাদা হয়ে ওঠে একই কারণে।

মূলকথা, ভালো ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আচরণ, যা চারপাশের অন্যরা ভালো দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে পারে। ওই আচরণের মোড়কে লুকিয়ে থাকে অনন্যসাধারণ মানসিক প্রক্রিয়া: আবেগ, চিন্তন, পারসেপশন বা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা ও অন্তর্গত প্রেষণা বা মোটিভেশন যা মানুষের বাইরের আচরণও করে তোলে অনন্য।

আমরা বিশেষ কাউকে দেখিয়ে বলি, লোকটির বা ছেলেটির ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় (অঃঃৎধপঃরাব চবৎংড়হধষরঃু)। অর্থ হলো লোকটির আচরণ ভালো, অন্যের কাছে অনুরণীয়, অন্যদের তা মোহিত করে। সবাই তাকে পছন্দ করে।

আবার বলা যায়, আমাদের চারপাশে এমন অনেকে আছে, যাদের আচরণ বিরক্তিকর; অন্যকে প্রায়ই বিব্রত করে কিংবা তারা ঝামেলায় জড়িয়ে যায়―অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, অন্যরা তাকে পছন্দ করে না।

অপছন্দীয়, এ ধরনের লোক দেখলে আমরা বলি, টহধঃঃৎধপঃরাব চবৎংড়হধষরঃু, যা উন্নত সংস্কৃতির জন্য কেবল অশোভন নয়, ক্ষতিকরও। এই ক্ষতির আড়ালে লুকিয়ে আছে অসদাচার, সদাচারের ঘাটতি।

সুন্দর পরিবার-সমাজ বির্নিমাণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য শিশু কিংবা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের কাঠামো বা ব্যক্তিত্বের বিন্যাস নিয়েও ধারণা অর্জন করা প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে চেয়েছি, সাহিত্যের ভাষায় নয়, এই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো রাজনৈতিক অঙ্গন কিংবা প্রশাসনে ভালো ব্যবস্থাপনা রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মনে রাখতে হবে বড় হয়ে চট করে কেউ ভালো আচরণ করতে পারে না। সদাচারের বৈশিষ্ট্য শিশুকাল থেকে গেড়ে বসে। আর তাই শিশুকাল থেকে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পথে নিচের বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে হবে:৭ শিশুর আত্মোপলব্ধি, নিজস্ব ধারণা (ঝবষভ ঈড়হপবঢ়ঃ) এবং বৈশিষ্ট্যে (ঞৎধরঃং) মিলেমিশে অনন্যসাধারণ আচরণ প্রতিফলিত করে, ব্যক্তিত্বের গড়নের পূর্ণাঙ্গ ভিত দাঁড় করিয়ে দেয়।

একটা চাকার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের কাঠামোর তুলনা করা যেতে পারে। চাকার স্পোকসগুলো হলো বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য এবং কেন্দ্রস্থলটি হলো নিজের প্রতি নিজস্ব ধারণা বা উপলব্ধি। নিজস্ব মূল্যবোধ কিংবা নিজের প্রতি নিজের ধারণা শিশুর বিশ্বাস এবং মানসিক প্রক্রিয়াগুলো প্রতিফলিত করে। সমাজের অন্যরা কী দৃষ্টিতে তাকে মূল্যায়ন করবে, শিশুর আত্মোপলব্ধির ভেতর থেকে তা নির্ধারিত হয়ে যায়। শিশুরা যদি এমন ধারণা করে যে অন্যরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে, সেটা স্বাভাবিক। তখন নিজেদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভাববে তারা।

ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যায় কীভাবে একটি শিশু নিজেকে যাপিত জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেবে। এসব বৈশিষ্ট্য বেড়ে ওঠার পথে শিশুর আচরণ প্রভাবিত করে। শিশু বিকাশের এই গতিময় ধারায় যে-আত্মোপলব্ধি অর্জন করে, সেটিই গুণগত বৈশিষ্ট্যকে গভীরভাবে নির্ণয় করে দেয়।

মা-বাবা কিংবা আত্মীয়স্বজনের বিশেষ নজরদারি এবং মূল্যায়নের কারণে শিশুর মধ্যে অনেক সময় এমনতর উপলব্ধি গেড়ে বসে যে, তারাই অন্যদের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের শিশু বড় হতে হতে অতিশয় আত্মগর্বসম্পন্ন, প্রভুত্বব্যঞ্জক, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়। তারা কেবল নিজের জগৎ নিয়ে ডুবে থাকে। এরা অসদাচারণ করবে নিশ্চিত। মনে রাখতে হবে, বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির আগেই শিশুর ব্যক্তিত্বের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়ে যায়। একই ব্যক্তির শৈশব থেকে শুরু করে বয়সকাল পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিত্বের ভিত গড়ে ওঠে জীবনের প্রারম্ভিক শৈশবে। যেসব শিশু ছোটকালে সহিংস বা অ্যাগ্রেসিভ ছিল, পরবর্তী সময়েও তাদের মধ্যে সহিংসতা বেশি দেখা গেছে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাগ্রেশন বহিঃপ্রকাশের ধরনটাই কেবল পালটে যায়।

সামাজিকভাবে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আত্মবিশ্বাসী শিশুদেরই বেশি। এ ধরনের শিশুরা পরবর্তী জীবনে দৃঢ়চিত্তের মানুষ হিসেবে সফলতার চূড়া স্পর্শ করতে পারে। এমন সফলতা আসবে না, যদি শৈশবে শিশুটির নিজস্ব সামর্থ্য বা দক্ষতার ব্যাপারে বিশ্বাস সুদৃঢ় না হয়।

নিজের দক্ষতা, সামর্থ্যরে ব্যাপারে যৌক্তিক বিশ্বাস ও মনোবল শিশুর আত্মমর্যাদাবোধও সুসংহত করে, সৃজনশীল বিকাশের পথ প্রশস্ত করে, সর্বোপরি সার্বিক সফলতার পথে টেনে নিয়ে যায়, উন্নত মানসিকতা নিয়ে সে বড় হয়।

এবার বলব, ব্যক্তিত্ব কীভাবে বিকশিত হয়।৭

খেলাধুলায় শিশুদের আনন্দ সবচেয়ে বেশি। শিশু বড় হয়, ধীরে ধীরে খেলতে শেখে। সুযোগ না পেলে কোনও ধরনের খেলা তারা শিখতে পারে না, দক্ষতা অর্জনের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে, খেলা শেখার প্রারম্ভিক যাত্রা থেকে সামনের দিকে যতই শিশু এগোবে, ততই ব্যক্তিত্বের বিকাশ গতিশীল হবে, সমৃদ্ধ হতে থাকবে। অর্থাৎ খেলা শেখার পর্ব শিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত গড়ে তোলা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটানোর জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে।

অন্যরা শিশুকে নিয়ে কী ভাবছে―এ ধারণার ওপরই গড়ে ওঠে শিশু নিজেকে নিয়ে কী ভাবনার জাল বোনে। শিশুর নিজস্ব ধারণা গড়ে তোলার জন্য খুব কম মা-বাবা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। বেশির ভাগ সময়ে, নিজের প্রতি শিশুর ‘নিজের ধারণাটা’ গড়ে ওঠে অন্যদের অগোচরে।

সামাজিকভাবে মানানসই বেড়ে ওঠার জন্য প্রতিটি শিশুর মনে মা-বাবাকে কিছু ধারণার বীজ রোপণ করে দিতে হবে। এখানে তাদের কৌশলী হতে হবে, মনোযোগী হতে হবে। এভাবে শিশুর ব্যক্তিত্বের অঙ্কুরটি দাঁড়ানোর শক্ত ফ্ল্যাটফর্ম পেয়ে যাবে। যেমন, মা-বাবা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যকে সহযোগিতা করার জন্য শিশুটিকে উৎসাহিত করতে পারেন, খেলায় অংশগ্রহণ ও সুযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা নিতে পারেন। খেলার সুযোগ পেলে শিশুর দেহ-মনে গতিশীলতা বাড়বে, দক্ষতা অর্জনের জন্য নিজের গতিতেই সে উৎসাহী হবে। এবং নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করে সুশীল বা সুবোধ বালক হিসেবে নিজের সৃজনশীলতাকে আলোকিত করতে পারবে, যা বুদ্ধিদীপ্ত সদাচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

শিশু যেন স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক না হয়, বিষয়টা সহজেই মনিটরিং করা যায়। যেকোনও খাবার অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে খাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নিজেরা শিশুর সামনে খাওয়াদাওয়া শেয়ার করে খেলে শিশুটির সেই অভ্যাস গড়ে উঠতে পারে, আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা কমে আসতে পারে। ঘরে অন্য শিশু এলে নিজের খেলনা তার হাতে তুলে দিয়ে খেলায় অংশ নেওয়ার জন্য শিশুকে কৌশলে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হলে, ‘শেয়ারিং’-এর মধ্য দিয়ে আনন্দ পেতে শিখবে সে। ফলে শিশুর মনে স্বার্থপর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য আসন গেড়ে বসতে পারবে না; সে হয়ে উঠবে নিঃস্বার্থ পরোপকারী। স্বার্থপর ব্যক্তিত্ব সদাচারণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি তৈরি করে।

ব্যক্তিত্বের গড়নটা যদি ভালোভাবে অঙ্কুুরিত হয়ে যায়, বিকাশের যাত্রা এগোতে থাকবে। ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গে ‘নিজস্ব ধারণা’টা (ঝবষভ ঈড়হপবঢ়ঃ) শেখানোর জন্যও মনোযোগী হতে হবে মা-বাবাকে। অঙ্কুরিত গড়নটার ভেতর তখন ইতিবাচক ভালো গুণগুলো সহজে আসন গেড়ে বসবে, নিজস্ব ধারণাটাও নিজের মনে স্থায়ী ছাপ বসাতে পারবে।

আগেই বলা হয়েছে, এই ঝবষভ ঈড়হপবঢ়ঃ ব্যক্তিত্বের কেন্দ্রস্থল; মূল অনুষদ। এটি কেবল গুণগত বৈশিষ্ট্যই প্রভাবিত করে না, কীভাবে বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, সে পথও তৈরি করে দেয়।

নিজস্ব ধারণা যাদের ভালো, তারা সৎ ও বাস্তবসম্মত উপায়ে নিঃস্বার্থপর হওয়ার জন্য চারপাশের পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকে। নিজের সম্মানবোধ নিয়ে বড় হতে পারে। সুতরাং সুযোগ পেলেই অন্যদের থেকে তারা কিছু হাতিয়ে নেয় না কিংবা অন্যদেরও সুযোগ নেওয়ার ছাড় দেয় না। এই সচেতনতাও সদাচারের অন্যতম মাপকাঠি।

শিশুর মনে ‘ইতিবাচক নিজস্ব ধারণার’ বীজ রোপণ করতে হলে নিচের তথ্যগুলো মা-বাবাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে :৭ যেসব পরিবেশ-পরিস্থিতি নেতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে পারে, সেসব ক্ষেত্র মা-বাবাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মা-বাবার বেশি প্রয়োজন নিজেদের প্রতি নজর দেওয়া। নিজের ব্যক্তিত্বের আদলটি শিশুকে বেশি প্রভাবিত করে। সমালোচনা, বকাঝকা কিংবা শাস্তি প্রয়োগের প্রতি জোর না দিয়ে শিশুকে প্রশংসা করার গুণ রপ্ত করতে হবে। পুরস্কৃত করার মানসিকতাও থাকতে হবে। ভালো কাজের জন্য কিংবা প্রশংসনীয় কাজের জন্য উৎসাহিত করতে হলে সফল সমাপ্তির পর যে কোনও বিষয়ে শিশুকে ছোটখাটো উপহার দিতে হবে। ভুল করার পর শিশুর সমালোচনা না করে কীভাবে সেটা শুদ্ধভাবে করা যায়, সেই পথ তাকে দেখিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে সফলতার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

মা-বাবা নিজেই শিশুর সামনে সঠিক কাজটি করে দেখাতে পারেন। এতে শিশু সহযোগিতা পাচ্ছে ভেবে সফলভাবে কাজটা শেষ করার জন্য ভেতর থেকে তাগিদ বোধ করবে। এটা শিশুর মনোজগতেও শান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে, নিজের ব্যাপারে ভালো অনুভূতি জাগাবে।

ব্যক্তিত্বের কাঠামো বা গড়নটি দাঁড় করানোর জন্য, কাঠামোটার সব ধরনের উপাদানের দিকে নজর দিতে হবে। ‘নিজস্ব ধারণা’ একবার গড়ে উঠলে বদলানো যেমন কঠিন, ‘স্থায়ী হয়ে যাওয়া’ ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য (ঞৎধরঃং) পালটানোও কঠিন। প্রবাদ আছে ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’। এই প্রবাদটি বিজ্ঞানের সূত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু কিছু শিশু আছে, কোনও কিছু চাইলে তা পেতেই হবে, না পাওয়া পর্যন্ত বেপরোয়া আচরণ করতে থাকবে। একবার এই বৈশিষ্ট্য শিশুর ব্যক্তিত্বের গড়নে গেঁথে গেলে কোনও উপায়ে তার সহযোগিতা পাওয়া যায় না, যতক্ষণ সে তার আরাধ্য বস্তুটা হাতে না পায়।

মনে রাখা জরুরি, প্রাথমিক স্তরের পারিবারিক অভিজ্ঞতা, পরিবারের সদস্যদের সাহচর্য, শিশুর ব্যক্তিত্বের আদল (চবৎংড়হধষরঃু চধঃঃবৎহ) গড়ে দেয়। অন্য শিশুর কাছে সে সাদরে গৃহীত হলে, প্রশংসা ও সহমর্মিতা পেলে সহজে তার ‘ব্যক্তিগত ধারণা’ সমৃদ্ধ হয়। তাই অন্য ভালো শিশুর সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে মা-বাবাকেই।

শিশুর সদাচারণ : ব্যক্তিত্বের কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য৭

শিশু বড় হবে, তার সান্নিধ্যে সবাই আনন্দে ভরে থাকবে―সব পরিবারেরই এটি কাম্য। নিষ্পাপ শিশুর প্রতিটা উচ্ছ্বাস ও উল্লাস প্রকাশের মধ্যে থাকে শান্তির ছোঁয়া। এই শান্তি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বন্ধনের সাঁকো মজবুত করে।

নিচে কয়েকটি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

উচ্চাকাক্সক্ষা : শিশুর মনে উচ্চাকাক্সক্ষার বীজ রোপণ করতে হবে। তবে উচ্চাকাক্সক্ষার নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা থাকতে হবে। তা যেন অর্জন করা অতিমাত্রায় কঠিন না হয়। ছোট ছোট সফলতা থেকে বড় সফলতার দিকে এগোবে সে নিজস্ব গতিতেই। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তার ভেতরগত তাগিদ নাড়া দিয়ে জাগিয়ে রাখতে হবে।

দৃঢ়প্রত্যয় : শিশুর মন হবে দৃঢ়প্রত্যয়ী। এটি অর্জন করবে শিশু। এই অর্জনের জন্য সুযোগ দিতে হবে। পারিবারিক পরিবেশ আলাপ-আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য উৎসাহ জোগাতে হবে। পরিবারে ছোটখাটো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শিশুর মতামত শোনার প্রয়োজন আছে। তাকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বাস্তবসম্মত না হলে অন্তর্নিহিত বাস্তবতা বুঝিয়ে বলতে হবে।

দক্ষ ক্রীড়াবিদ বা খেলোয়াড় হওয়া : বাসা ও স্কুলের গাইডেন্স এ ক্ষেত্রে বেশি প্রয়োজন। খেলাধুলা শিশুকে গতিশীল রাখে। দেহ ও মনের বেড়ে ওঠার জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয়। সক্রিয় একটি শিশু সহজে আত্মবিকাশের চাবি হাতে পেয়ে যায়, দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে পারে।

যে কোনও পরাজয়কে শোভনভাবে নিতে হবে, বিজয়ীর সঙ্গে মার্জিত প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। জয়কে গ্রহণ করতে হবে বিনয় ও সম্মানের সঙ্গে। এই শিক্ষা যেন শিশুরা ছোটবেলা থেকে পেয়ে যায়।

স্থিরতা, প্রশান্তি ও সুবোধ শিশু : এ ধরনের গুণ গড়ে ওঠে পরিবেশ থেকে, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, কালচার থেকে। ঘরে-বাইরে অন্যের উত্তেজিত আচরণ অনুকরণ করেই শিশুরা নিজেদের আচরণে সহিংসতা ও অস্থিরতার বৈশিষ্ট্যে গেঁথে নেয়। এ ধরনের শিশুরাও সদাচারের পথে কাঁটাস্বরূপ।

উৎফুল্লতা : এর জন্য প্রয়োজন সুস্থতা, নীরোগ দেহ আর পুষ্টিহীনতা রোধ করা। চারপাশের সবার দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে আনন্দময়, হাসি-খুশিতে ভরা। অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা চলবে না, হতাশা থেকে দূরে রাখতে হবে শিশুকে।

সহযোগিতা : দৈনন্দিন টুকিটাকি গৃহস্থালি কাজে শিশুকে অংশগ্রহণের সুযোগ দিলে সহযোগিতার মনোভাব শিশুর মনে গড়ে ওঠে। পরিবারের সবাই মিলেমিশে পারিবারিক কাজগুলো আনন্দ-উপযোগী করতে হবে। শিশুকে বোঝার সুযোগ দিতে হবে, তার সহযোগিতাও মূল্যবান। বড় হয়ে ওঠার পথেও তখন সে অন্যদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে। সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করবে।

সাহস : কেবল ভয় নিয়ে সমালোচনা করে সাহস জাগানো যায় না। মনোবল গড়ে তুলতে হলে যে কোনো ধরনের ন্যূনতম সাহস দেখানোর জন্য সহযোগিতা করতে হবে, প্রশংসা করতে হবে প্রচুর।

অত্যুৎসাহ : শিশুর উৎসাহ, উদ্যম থাকার জন্য প্রয়োজন সুস্বাস্থ্য। চারপাশে থাকতে হবে উদ্যমী, উৎসাহী ব্যক্তি। পরিকল্পনা থাকতে হবে। পরিকল্পনা সফল করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রচেষ্টা থাকতে হবে জোরালো। চারপাশে মানুষজনের এ ধরনের তাগিদ শিশুকেও অত্যুৎসাহী করে তোলে। শিশু যে কাজে আনন্দ পায় সেটির প্রতিও নজর রাখতে হবে। তার আনন্দ বাড়িয়ে তোলার জন্য নিজেকেও শরিক করতে হবে।

আত্মবিশ্বাস : শিশুর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা কঠিন নয়। সে যা আশা করছে, এমন কাজ করার প্রচেষ্টা প্রশংসিত করতে হবে। প্রতিটা কাজ শিশুর সামর্থ্যরে আলোকে বিচার করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত করতে পারে, ততক্ষণ তাদের কাজটা করতে দেওয়া উচিত। ফলে মনোবল বাড়বে, আত্মবিশ্বাসও দৃঢ়তর হবে।

কৌতুকপ্রিয়তা : যে কোনো জটিল অবস্থার হালকা দিকটা খুঁজে দেখতে হবে। গুরুগম্ভীর না হয়ে সমস্যার ফাঁক থেকে মজাদার অংশ খুঁজে নেওয়ার গুণ তাদের সামনে দেখানো গেলে তারা তা সহজে রপ্ত করতে পারে।

নিঃস্বার্থপরতা : নিজের খেলনা অন্য শিশুকে দিয়ে একসঙ্গে খেলতে উৎসাহিত করতে হবে। যে কোনও স্বার্থহীন কাজের জন্য পুরস্কৃত করতে হবে। প্রশংসা করতে হবে। এভাবে নিঃস্বার্থপরতার বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিত্বের কাঠামোতে আসন গেড়ে বসতে পারে। মনোবিদদের বিভিন্ন গবেষণায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।

পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক : বলা যায় ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার জন্য জন্মের কয়েক বছরের পারিবারিক সদস্যদের সাহচর্য ও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

এ সময় শিশুর ব্যক্তিগত ধারণা এবং বৈশিষ্ট্য অঙ্কুরিত হয় বলে পারিবারিক আবহও গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ শিশুর জন্য সুখকর কিংবা অসুখকরও হতে পারে। হতে পারে শান্ত, স্বাস্থ্যকর। ঝগড়াঝাঁটি, তর্ক-বিতর্ক, রাগারাগিতে ভরপুরও হতে পারে। হতে পারে ঈর্ষা, হিংসা বা অপছন্দের কিংবা সহযোগিতাপূর্ণ শান্তির পরিবেশ। মনে রাখতে হবে সব সদস্য মিলে পরিবারের আবেগপ্রবণতা ও ভাবপ্রবণতার আবহ গড়ে তোলে। তবে মা-বাবাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে ঘরের পরিবেশ। শিশু বাইরে কেমন আচরণ করছে, ভদ্র-শোভন নাকি সহিংস তা মূলত প্রকাশ করে ঘরের পরিবেশ। যদি প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে মা-বাবার কেউ একজন পুরো ঘরের পরিবেশ বদলে দেয়, ক্লান্তি-অবসাদসহ নানা কারণে তাঁর ভেতর থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটতে থাকে, তাহলে শিশুর ব্যক্তিত্বের কাঠামোতে ত্রুটি ঢুকে যাবে। শিশুটি হয় অসুখী হবে, নয়তো বিষাদগ্রস্ত। তখন সে এমন সব আচরণ করতে পারে, যা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এমন শিশুর সাংস্কৃতিক পরিবেশ টক্সিক হতে বাধ্য।

হাসিখুশি মা-বাবার কারণেও ঘরের পরিবেশ থাকে উৎফুল্ল, হাস্যোজ্জ্বল। মা-বাবাদেরই শিশুর সামনে আদর্শ মডেল হওয়া উচিত।

পরিবারের অন্য সদস্য, যেমন―ভাইবোন, দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, চাচাতো ভাইবোন এমনকি শিশুর অন্য যত্নকারীরাও বেড়ে ওঠা শিশুর ব্যক্তিত্বের গড়ন বিকাশের পথে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। তাঁরা শিশুটির জন্য কতটুকু সময় দিচ্ছেন, কতটুকু মৌলিক আদর, মায়া-মমতা ধারণ করছেন, সেটির ওপরই শিশুর ব্যক্তিত্বের গঠন নির্ভর করে।

সুস্থ, সুখী, আদর্শ পারিবারিক পরিবেশের মূল অনুষদ হচ্ছে পরিবারের সবাইকে হতে হবে সুখী, সহযোগিতাসম্পন্ন ও বন্ধুভাবাপন্ন। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের একের প্রতি অন্যের সম্মানবোধ থাকতে হবে, বয়স অনুযায়ী প্রত্যেককে নিজস্ব অধিকারের প্রতি স্বাধীনতা দিতে হবে। মা-বাবা উভয়কেই কঠিন হাতে শিশুকে পরিচালনা করা চলবে না। বড় শিশুরা যেন ছোটদের ওপর বস সেজে না বসে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। আদর্শ পরিবারের শিশু নিজেকে নিরাপদ ভাবে, নিরাপত্তাবোধ শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব : সদাচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

মানুষ ভালো গুণ পছন্দ করে। একজন অন্যজনকে পছন্দ করার অর্থ হচ্ছে তার ইতিবাচক গুণ প্রথমজনকে মোহিত করেছে। এ ধরনের ভালো গুণের সমাহার যার রয়েছে, তিনি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এর অর্থ এ নয় যে, সব ধরনের বৈশিষ্ট্য সামাজিকভাবে কাক্সিক্ষত ও কাম্য। এমন মানুষ সত্যিই দুর্লভ, যার মধ্যে কেবল ইতিবাচক গুণই রয়েছে।

সব মা-বাবা মনেপ্রাণে কামনা করেন, শিশুটি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হোক। তাঁরা এও জানেন যে, সারা জীবনের জন্য এ ধরনের গ্রহণযোগ্যতার মূল্য অনেক বেশি।

শিশুর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব মূলত মা-বাবার ব্যক্তিত্বেরই প্রতিফলন ঘটায়, এটি মা-বাবা যে জানেন না, তাও নয়। কিন্তু যখন শিশুর আচরণে বদগুণ দেখা যায়, দূষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে, মা-বাবা ভেঙে পড়েন।

বদ অভ্যাসগুলো শিশুরা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সদ্গুণের অধিকারী করে তুলবে, এমনটাই কামনা করেন তারা। অথবা এমনও হয়, এ সময় মা-বাবা আরো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন, শিশুর সঙ্গে ইতিবাচক (পজিটিভ) বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান, চাপাচাপি করেন। এসব ব্যাপারে মা-বাবাকে সংযত মনোভাব দেখাতে হবে। নিচের দুটি তথ্য মনে রাখতে হবে : সামাজিকভাবে আমরা যা চাই, সেই কাক্সিক্ষত পরিবেশ শিশুর মানিয়ে চলার সামর্থ্য বাড়িয়ে না-ও তুলতে পারে। এমনকি তার পরবর্তী জীবনেও নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, নির্ভীকতা অন্য শিশুদের মধ্যে আপনার শিশুটিকে হিরো করে তুলতে পারে। সে নির্ভীক হতে চাইবে, না পারলে ঈর্ষা কিংবা হিংসায় আক্রান্ত হবে। কিন্তু আপনার শিশু যতই বড় হবে, নির্ভীকতা কালক্রমে তাকে শক্ত মনের মানুষ করে তুলতে পারে, দুঃসাহসী ভয়াবহ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এই অতি নির্ভীকতা তাকে হিরো করবে না, বরং অন্যদের কাছে তখন অবজ্ঞা ও অবহেলার পাত্র করে তুলতে পারে। আর তাই অতি কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য সব সময় কাম্য নয়। উচ্চাকাক্সক্ষাকে আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। মানানসই মাত্রার উচ্চাকাক্সক্ষা লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে, দক্ষতা বাড়ায়।

কিন্তু অতি উচ্চাশার কারণে একজন মানুষ অন্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সামনে এগোতে চাইবে। অতি মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে অন্যকে গণ্য নাও করতে পারে সে। এভাবে সে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলতে পারে। অতি উচ্চাশা মানুষকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়, কোনও কিছুতে সে সন্তুষ্টি পায় না, সব সময় অস্থিরতায় ভোগে, বাজে আচরণের ভেতর ডুবিয়ে দেয়।

তাদের মধ্যে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলার প্রয়োজনে মা-বাবাকেও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে হবে।

ব্যক্তিত্ব বনাম শিশুর তৃপ্তি, অতৃপ্তি ও অতিসন্তুষ্টি :৭ ভেতরের স্বস্তিও বাইরে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। নিজের ভেতরের ভালোলাগা বোধ থেকে মুখের অভিব্যক্তিতে প্রতিফলিত হয় আনন্দধারা। সুখী মানুষ এভাবে চেনা যায়। শিশুর মনোজগৎ ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতায় পূর্ণ থাকলে সে হয়ে উঠবে জৌলুসদীপ্ত, সুখী। নিজের ব্যাপারে থাকবে পরিতৃপ্ত। কারণ সে এসেছে একটি সুখী পরিবার থেকে, যেখানে সবার মাঝে সন্তুষ্টি বিরাজ করে। এ কারণে আত্মতুষ্ট শিশুরা ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার ঐশ্বর্যে থাকে টইটম্বুর। এ ধরনের শিশুরা অন্যদের শ্রদ্ধা করতে শেখে। সব সময় ভালো কিছু করার তাগিদ বোধ করে। ফলে তাদের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, সদাচারের বড় উদাহরণ সৃষ্টি করে তারা।

শিশুরা যদি সব সময় বকাঝকার মুখোমুখি হয়, প্রতিনিয়ত সমালোচিত হয়, শাস্তি পায়, কোনো প্রশংসা যদি তাদের ভাগ্যে না জোটে, তাহলে ভাবতে থাকবে তাদের কোনও গুণ নেই। শিশু হিসেবে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির। এ ধরনের শিশুর অন্তর্জগতে অস্বস্তি, অতৃপ্তি ও অপূর্ণতার বাজে ধারণা আসন গেড়ে বসে। এরা অসুখী শিশু হয়ে যায়। এদের আচরণে অন্যরা বিরক্ত হয়। অন্য শিশুরাও তাদের সঙ্গ পছন্দ করে না, খেলার সাথী হিসেবে মেনে নিতে চায় না।

অতৃপ্তির উলটো পিঠে রয়েছে অতিসন্তুষ্টি। অতিতৃপ্ত শিশুরাও অনেক সময় হয়ে পড়ে উচ্চাকাক্সক্ষাহীন, কল্পনাশক্তিবিহীন। গণ্ডিবদ্ধ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য এদের ব্যক্তিত্বের কাঠামোতে আসন গেড়ে বসতে পারে। এরা দাম্ভিক হয়ে যেতে পারে, অহংকারী হতে পারে, অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে। এই অতি আত্মবিশ্বাস অনেক সময় বাস্তবতা থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। নিজের প্রতি ভ্রান্ত ইমেজও গড়ে উঠতে পারে, সামর্থ্যরে বাইরেও কোনও কিছু করার জন্য জড়িত হয়ে যেতে পারে। এতে অবধারিতভাবে আসবে ব্যর্থতা। ব্যর্থতার জন্য নিজেদের দোষ টের পাবে না তারা। অন্যকে দায়ী করবে, ক্রমান্বয়ে অন্যদের কাছে অপছন্দনীয় হয়ে উঠবে।

শিশুর অসন্তোষ প্রকাশের সাধারণ ভঙ্গি : শিশুর মনোজগতে অসন্তোষ নানান ভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়। মা-বাবাকে শিশুর আচরণ দেখে অসন্তোষের তীব্রতা বুঝে নিতে হবে। নিচে কয়েকটি ভঙ্গির উল্লেখ করা হলো।

নিজের ভুলত্রুটি সব সময় নিজের কাছে বড় ভুল মনে হয়। অন্যের সঙ্গে সব সময় ভুলটি নিয়ে কথা বলতে চায়। প্রায়ই অনুযোগ করতে থাকে নিজের ভুলের জন্য। অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাচ্ছে সে―এমনটা মনে হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে নিজের অসন্তোষের কারণে ভেতর থেকে তার এমন ধরনের আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে।

ছোটদের সঙ্গে কিংবা জীবজন্তুর প্রতিও নিমর্মতা দেখিয়ে থাকে তারা।

প্রায়ই অনুযোগ করবে, অন্যদের তুলনায় তারা বেশি শাস্তি পাচ্ছে। সমালোচিত হলে অন্যদের দোষী ভাবে, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইবে।

যখন অশোভন আচরণের জন্য সমালোচিত হয়, নিজের পক্ষে যুক্তি খাড়া করে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইবে। বড়দের মনোযোগ ও স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ছোটদের ওপর মাতব্বরি, বাজে বকবক কিংবা বকাঝকা করবে। নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অতিমাত্রায় লোভী হয়ে উঠতে পারে। নিয়মশৃঙ্খলা কিংবা কর্তৃপক্ষের প্রতি প্রায়ই ক্ষিপ্ত থাকে। বড়দের মনোযোগ পাওয়ার জন্য অনেক সময় অমার্জিত, গেঁয়ো কিংবা ভাঁড়ের মতো আচরণ করে। অন্যের খেলনা কিংবা ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও ভাঙচুর করে। অসংযত কিংবা ভুল কিছু করে ধরা পড়লে সরাসরি অস্বীকার করে, মিথ্যা বলে।

এভাবে অসন্তোষের কারণে শিশুর মনে নানা ধরনের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের শেকড় গজাতে থাকে। শিশুর ব্যক্তিত্বের কাঠামোটি নড়বড়ে করে দেয়। তাদের কাছে সদাচারণ প্রত্যাশা করা নিরর্থক।

তিন

আমরা দেখছি মিডিয়া কালচার, মাদক কালচার, পারিপার্শ্বিক সহিংসতার কালচার, নৈতিকতা বিবর্জিত পরকীয়া কালচার, আকাশসংস্কৃতির পেশাদার নারী-পুরুষের জৈবিক কালচার―শিশুকাল থেকে এসব অপসংস্কৃতির বীজ রোপিত হয়ে যাচ্ছে শিশুদের মননে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যে রঙিন জীবনবোধ তা সকল ধর্মীয় অনুশাসন, দেশীয় জীবনবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। স্যাটেলাইটের ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিশু ও বয়স্ক সবার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, বস্তুবাদিতা আর নগ্নতার হাজারো পাঠ। নৈতিক শক্তি আর মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তে শিশুদের মনস্তত্ত্বে ঢুকে বসে যাচ্ছে ভোগবাদী সত্তা। ফলে নারী-পুরুষের সম্পর্কের শ্রদ্ধা, মমতা-ভালোবাসার সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। পারিপার্শ্বিক সহিংসতা ঘটছে নানা কারণে। মাদকের কারণে সমাজে ঘটছে নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা। কোনও কোনও চলচ্চিত্র, নাটক, শিশুদের জন্য নির্মিত ভিডিও গেমস, অনলাইন গেমস ইত্যাদিতেও আমরা দেখছি সহিংসতা, হিংস্রতা, খুনোখুনির দৃশ্যপট। এসব দৃশ্য শিশুদের মধ্যে সহিংসতার বীজ রোপণ করে দিচ্ছে। এমন বিরূপ অবস্থায় শিল্পবোধ, সাহিত্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, নন্দনতত্ত্ব কীভাবে আসন গেড়ে বসবে তাদের শিশুসত্তায়? সূক্ষ্মভাবে নয়, প্রায় প্রকাশ্যে ব্যাপক বিধ্বংসী ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে সমাজে, পচন ধরে গেছে প্রায় সর্বত্র। একজন মনোবিদ হিসেবে এসব প্রত্যক্ষ করছি আমরা পেশাদারি কর্মক্ষেত্রে। একদিকে ছেলেবেলা থেকে এসব দেখে বড় হচ্ছে শিশুরা। অপরদিকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বইয়ের বোঝা। জিপিএ ফাইভ অর্জনের জন্যে কোচিংয়ের দৌড়ে তারা চাপে থাকছে প্রতিনিয়ত। এর থেকে পরিত্রাণের জন্যে তারা বিকল্প বিনোদন খুঁজছে। ল্যাপটপ, ট্যাব, স্মার্টফোনে ডুবে থেকে বিনোদন খুঁজছে, খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের অজান্তেই তারা ছুটছে মোহময় জৈবিক জগৎপানে, বিপদসংকুল ভুবনের দিকে। এসব শিশু কি শিশুসংগঠনমুখী হবে? আকাক্সিক্ষত সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করবে?

সুবিধাভোগী শিশুরা তো নিজেদের শোবার ঘরেই পেয়ে যাচ্ছে প্রেষণাকে তৃপ্ত করার সব উপাদান। দৈনন্দিন চাহিদাও পূরণ হয়ে যাচ্ছে তাদের ঘরে। তাই তাদের সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা শাণিত হওয়ার সুযোগ পায় না। তারা আত্মকেন্দ্রিক, পরনির্ভরশীল, স্বার্থপর বৈশিষ্ট্য ঢুকিয়ে নিচ্ছে নিজেদের ব্যক্তিত্বে। নৈতিক শক্তি হারিয়ে এরা ভোগবাদী সত্তা নিয়ে বড় হতে থাকে। এসব কিছু সদাচারণের পথে বড় বাধা এবং হুমকিস্বরূপ। হিংসা-বিদ্বেষ, গর্ব-অহংকার, অশ্লীল কথাবার্তা, ঈর্ষাকাতরতা, কঠোর হৃদয়ের কর্কশভাষা, কলহবিবাদও সদাচারের প্রধান শত্রু। অন্যদিকে ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক কোমলচিত্ত, ক্ষমা করার বৈশিষ্ট্য, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, সৎকাজে লেগে থাকা, উত্তম কথা বলা, সহনশীলতা, দয়াবান হওয়া সদাচারের ভালো উদাহরণ। এসব বৈশিষ্ট্য নিজেদের সংস্কৃতিকে উন্নত করবে, সন্দেহ নেই।

সবশেষে বলা যায়, সোশাল মিডিয়া ও মুঠেফোনের সংস্কৃতির বেপরোয়া জোয়ার, কিংবা বহুমুখী বৈশ্বিক সংস্কৃতির আগ্রাসনে উপড়ে যাচ্ছে আমাদের মূল সংস্কৃতির শেকড়-বাকল, সাহিত্যেরও। তাই বলব, বিশ্বের বর্তমান সংস্কৃতির ওপর প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতির প্রভাবে সদাচারী সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। এই অশুভ রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে হলে প্রতিটি দেশের আকাশসীমার নেট-গেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, ফিল্টার করতে হবে আজেবাজে ওয়েবসাইটের ঢালাও স্রোত। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নব প্রযুক্তিও আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, মনে হচ্ছে। এসব থেকে বাঁচতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার। পরিবারিক মূল্যবোধ উন্নত করার দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার সুযোগ থাকতে হবে। কিন্তু ঢালাওভাবে সব কিছু তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না। সাহিত্যেও তার চর্চা দেখতে চাই। উপসংহারে আরও বলতে চাই, কেবল অতিমাত্রায় উচ্চাকাক্সক্ষী হতে উদ্বুদ্ধ করা নয়, উন্নত চরিত্র গঠনের ভিত্তি দান করতে হবে শিশুদের। প্রয়োজন প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘ফলিত চর্চা’র (ড়িৎশংযড়ঢ়) সাপ্তাহিক কর্মসূচি/কর্মশালা (পষধংং) আয়োজন করা। বিষয়সূচিতে থাকবে : ভালো ও মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে বিবেচনা। হাতে কলমে শেখা, শরীরচর্চা। ঘরে-বাইরে নিজের কাজ নিজে করা, খাদ্যাভ্যাস ও সংযম বোধ; পোশাক-পরিচ্ছদের প্রশ্নে ‘গড্ডলিকা প্রবাহে’ ভেসে না যাওয়া, বাগানচর্চা, কৃষি খামারে শ্রম দেওয়া।

ভার্চুয়াল জীবন নয়―বাস্তব জীবনই চর্চার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি।

নৈতিক চরিত্রগঠন সম্পর্কে বলতে হবে। পঞ্চাশ বছর আগেও সকল পাঠশালায় ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শরীর ভালো না থাকিলে মন ভালো থাকে না’―এ ধরনের অনেক উপদেশ ছিল।

মদনমোহনকে মনে পড়ে : ‘কটুবাক্য নাহি কবে। কুকাজে অখ্যাতি হবে। অসত্য পাপের চর। কুপথ্য রোগের ঘর। কুনটের নাট্য কিছু নয়। অনিয়মে রাজ্য নাহি রয়। বিদ্যাধন আছে যার। সকলি সুসাধ্য তার। সুশীল শিশুকে সকলে ভালবাসে। দুরন্ত বালককে কেহ দেখিতে পারে না। পরের দ্রব্যে লোভ করিও না। অন্ধজনে দয়া কর।…’

এখনকার শিশুদের জানতেই হবে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, টমাস আলভা এডিসন, আব্রাহাম লিংকন, এপিজে আবুল কালাম, স্টিভ জবস কত দরিদ্র ছিলেন। সহজে বিত্তশালী হবার প্রলোভন নয়। জ্ঞানসাধনায় পথ দেখিয়ে দিতে হবে শিশুদের। নিজেদের ঐশ্বর্য এবং আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে তারা তখন। এভাবে সমাজ-সংস্কৃতিতে সদাচারের অন্য আলো ছড়াতে থাকবে, সন্দেহ নেই।

তথ্যসূত্র :

১.         রফিক, আহমদ (২০১৮), সংস্কৃতিকথা/ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা, অনিন্দ্য প্রকাশ। পৃষ্ঠা: ১১

২.         উমর, বদরুদ্দীন (১৯৮৪), সংস্কৃতির সংকট, মুক্তধারা। পৃষ্ঠা: ২৭

৩.        খান, একে এম আলী (২০১৪), স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, গ্রন্থকুটির। পৃষ্ঠা: ৪৭ 

৪.         টেইলর, নৃবিজ্ঞানী (১৯৭৪), ইন্টারনেট।

৫.         স্যামুয়েল পুফেনডর্ফ, ইন্টারনেট।

৬.        চৌধুরী, মোতাহের হোসেন, সম্পাদনা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বাংলা একাডেমি (২০১৬)। পৃষ্ঠা: ০১-১৫

৭.         কামাল, মোহিত (২০০২), শিশুর মনোজগৎ/শিশুর সৃজনশীল বেড়ে ওঠা, বিদ্যাপ্রকাশ; পৃষ্ঠা: ৮৯ (প্রথম প্রকাশ)

লেখক : কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button