অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প : ক্রিম

মূল : হারুকি মুরাকামি

বাংলা অনুবাদ : কুলদা রায়

আঠারো বছর বয়সে আমার জীবনে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। তাই সেই ঘটনাটা এক অনুজ বন্ধুকে বলছিলাম। এটা কেন মনের মধ্যে পুষে রেখেছি তা ঠিক করে মনে করতে পারছি না। বলা যায় তার সঙ্গে কথা বলার সময়ই ঘটনাটি মনে এসে গেল। মানে―ঘটনাটি বহু আগে ঘটেছিল। পুরনো ইতিহাস। সর্বোপরি ঘটনাটি নিয়ে কখনওই আমি কোনও সিদ্ধান্ত টানতে পারিনি।

‘সে সময় সবে হাই স্কুলের পড়া শেষ করেছি, কিন্তু কলেজে তখনও ঢুকিনি।’ আমি ব্যাখ্যা করলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ধরনের (পুরনো কালের সামুরাই যোদ্ধা) রনিনের মতোই ছিলাম আমি তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করতে পারিনি। তবে আবার পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি। হাওয়ার উপরে ভাসছি। আমি জানতাম, যদি ইচ্ছা করি তবে ভালো কোনও প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হতে পারি। কিন্তু কোনও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল আমার বাবা-মা। আগে থেকেই জানতাম আমি পাস করতে পারব না। তবু বাবা-মার জন্যই পরীক্ষা দিয়েছিলাম। এবং নিশ্চিতভাবেই ফেল করলাম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময় অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে অংক নির্ধারিত ছিল। ক্যালকুলাসে আমার এক ফোঁটা আগ্রহ ছিল না পরিকল্পনা করতে করতে পরের বছর কাটিয়ে দিলাম। মূলত সময় নষ্ট করাই হলো তখন। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য কোনও কোচিং সেন্টারে গেলাম না। তার বদলে স্থানীয় লাইব্রেরিতে সময় কাটালাম। সেখানে মোটা মোটা উপন্যাস পড়ার দিকে নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম। আমার বাবা-মা অবশ্যই ধারণা করল আমি সেখানে ভর্তি পরীক্ষার পড়া পড়ছি। কিন্তু দেখো, সেই জীবনে ক্যালকুলাসের সূত্র পড়ার চেয়ে আমার কাছে বালজাকের সব রচনা পড়াকেই বেশি আনন্দের মনে হলো।

বছরের অক্টোবরের শুরুতে পিয়ানো কনসার্টের জন্য একটি নিমন্ত্রণপত্র পেলাম। পত্রটি পাঠিয়েছে একটি মেয়ে। স্কুলে সে আমার এক ক্লাস নিচে পড়ত। আমি যে শিক্ষকের কাছ থেকে পিয়ানো শিখেছিলাম সেও তাঁর কাছে শিখেছে। একবার এক সঙ্গে চার হাতে বাজানো যায় এরকম একটি পিয়ানোতে মোৎসার্টের একটি সিম্ফোনি বাজিয়েছিলাম আমরা দু’জনে। ষোল বছর বয়স হলে আমি পিয়ানো শেখা বাদ দিলাম। তারপরে মেয়েটিকে আর দেখিনি। তাই সে কেন আমাকে নিমন্ত্রণপত্র পাঠাল বুঝতে পারলাম না। সে কি আমার প্রতি দুর্বল ছিল ? যাই হোক না কেন সে খুব আকর্ষণীয়। আমি নিশ্চিত যে তার চেহারা আমার ধরনের নয়, তবু সে সবসময়ই বাহারি সাজপোশাক পরত। আর একটি ব্যক্তিমালিকাধীন বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ত। বিদ্যালয়ের খরচপাতি অনেক। আমার মতো সাদামাটা নরম-শরম ছেলের প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে সে নয়।

আমরা যখন মোৎসার্টের সেই ধুনটা বাজাতাম, আমি কোনও ভুল সুর বাজিয়ে ফেলতাম, তখন সে বাঁকা চোখের দৃষ্টি হানত। আমার চেয়ে সে ভালো পিয়ানো বাদক ছিল। আমার একটু বেশি উত্তেজনার ধাত। তাই যখনই দু’জনে পাশে বসে বাজাতাম তখন আমার অনেক সুর তালগোল পাকিয়ে যেত। সে সময়ে মাঝে মাঝে আমার কনুইয়ের ধাক্কা লেগে যেত তার গায়ে। ওই ধুনটা খুব একটা জটিল ছিল না। আর তাছাড়া আমার অংশটাই ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। যখনই আমি সেই ধুন থেকে সরে যাই, তখনই তার মুখে রাগের চিহ্ন ফুটে উঠত। আর তার জিহ্বা একটা শব্দ করে উঠত। খুব জোরে নয়। তবে এমন করে শব্দটা করত যে তা আমার কানে চলে আসত। আমি এখনও সেই শব্দটি শুনতে পাই, এমনকি এই সময়েও। এমন কি এই শব্দটি পিয়ানো বাজানোর আশা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে প্ররোচিত করেছে।

যে কোনও ভাবেই হোক না কেন তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মামুলি। পিয়ানো শেখার স্কুলে এরকম হয়েই থাকে। সেখানে দেখা হলেই আমরা পরস্পরকে হ্যালো বলেছি। কিন্তু কখনও বলার মতো একান্ত ব্যক্তিগত কোনও কিছু মনে নেই আমার। তাই হঠাৎ করে তার বাদন অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্র পাওয়াটা ছিল আমার কাছে সম্পুর্ণ বিস্ময়কর ঘটনা। সত্যি বলতে কি আমি প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। পিয়ানো কনসার্টটা তার একার ছিল না―তিনজন পিয়ানোবাদকের সঙ্গে যৌথ অনুষ্ঠান ছিল। সে বছর আমার অঢেল সময় ছিল। তাকে একটা পোস্টকার্ডে উত্তর লিখে পাঠালাম। লিখলাম, আমি অনুষ্ঠানে যাব। আমার যাওয়ার একটা কারণ হলো, আমার বেশ কৌতূহল জেগেছে―কী আছে এই নিমন্ত্রণের পিছনে। যদি কিছু থেকে থাকে তবে কি তার কোনও উদ্দেশ্য আছে ? কেন, এত দিন পরে, সে একটা অনাকাক্সিক্ষত চিঠি পাঠালো ? হয়তো সে এর মধ্যে পিয়ানো বাজানোতে আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। সেটাই আমাকে দেখাতে চায়। অথবা কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার আছে। সেটা হয়তো আমাকে জানাতে চায়। অন্য কথায়, আমি আমার কৌতূহলের সব অনুভূতি দিয়েই চিঠির কারণটি বের করার চেষ্টা করলাম। সব দিকেই মাথা খাটাতে লাগলাম।।

কোবে পাহাড়ের ওপরের মিলনায়তনে পিয়ানো কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল। হ্যাঙ্কিউ ট্রেন লাইন ধরলাম আমি। এটাই ছিল কাছের স্টেশন। তারপর একটি বাসে উঠলাম। বাসটি ঘুরে ঘুরে খাড়াপথে চলল। শীর্ষদেশের খুব কাছের একটি স্টেশনে নামলাম। সামান্য হেঁটে কনসার্ট হলে পৌঁছালাম। খুব সুন্দর হলটি। এর মালিক বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। এরাই হলটিকে পরিচালনা করে। পথঘাট ঝামেলাপূর্ণ হলেও পাহাড়ের ওপরে খুব শান্ত সুন্দর পরিবেশে এরকম উচ্চবিত্ত মানুষের একটা পাড়া গড়ে উঠেছে সেটা আমার জানা ছিল না। যেমন এ পৃথিবীতে অনেক জিনিসের কল্পনাই করো তোমরা―কিন্তু তার সব খবর আমি জানি না।

এই নিমন্ত্রণ করায় তাদেরকে প্রশংসা করা দরকার বলে আমার মনে হয়েছিল। সেজন্য স্টেশনের কাছের একটি ফুলের দোকান থেকে অনুষ্ঠানের সঙ্গে মানানসই এক তোড়া ফুল কিনলাম। সেগুলোকে পলিথিনে মুড়িয়ে নিলাম। সেটা ছিল রোববারের এক বিকেল। একটু ঠাণ্ডা পড়েছে। আকাশে ঘন সাদা মেঘ। দেখে মনে হয় যেকোনও সময়ে ঠান্ডা বৃষ্টি নেমে পড়তে পারে। যদিও কোনও জোরালো হাওয়া বইছিল না। আমি একটা হালকা সোয়েটার পরেছিলাম। তার নিচে পরেছিলাম একটা জ্যাকেট। সেটা ছিল সাদার উপরে নীলচে রঙের চোখুপি। কাঁধে ঝোলানো ছিল একটি মোটা কাপড়ের ব্যাগ। জ্যাকেটটা ছিল একেবারে নতুন। আর ব্যাগটা ছিল বেশ পুরনো। রংচটা। আমার হাতে পলিথিনে মোড়ানো সেই জাঁকালো লাল ফুলের তোড়া। যখন বাসে এই সাজে উঠলাম অন্য যাত্রীরা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অথবা তারা এরকম করেছিল বলে মনে হলো। মনে হলো আমার চিবুক লাল হয়ে গেছে। এরপরেও সামান্য উত্তেজনায় ক্ষণে ক্ষণে চিবুক লাল হয়ে উঠছিল। এবং সারা যাত্রাপথেই এই লালচে আভা মুখ জুড়ে ছিল।

‘কেন আমি এই পৃথিবীতে―কেন এখানে এসেছি ?’ এ প্রশ্নটি নিজে করলাম। আমি বসেছি আমার সিটে। হাত দিয়ে আমার লালচে চিবুকের ঠান্ডা দূর করছিলাম। ঠিক এই মেয়েটিকে আমি দেখতে চাইনি। তার পিয়ানো কনসার্ট শোনার ইচ্ছে আমার নেই। তাহলে কেন বেতনের টাকা দিয়ে এই ফুলের তোড়া কিনলাম ? নভেম্বরের রোববারে বিষণ্ন বিকেলে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলাম ? ডাকবাক্সে জবাবি চিঠি ফেলার পর থেকে আমার মধ্যে কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে।

পাহাড়ের চূড়ার দিকে যেতে যেতে বাসের যাত্রীসংখ্যা কমে এল। আমার স্টেশনে পৌঁছানোর সময় বাসে ছিলাম আমি আর চালক। বাস থেকে নেমে পড়লাম। নিমন্ত্রণপত্রে যেভাবে পথের নির্দেশনা দেওয়া ছিল সেটা অনুসরণ করে একটা স্বাভাবিক ঢালু পথে হেঁটে গেলাম। প্রতিবার একটা কর্নারে ঘুরে যেতে হলো। পোতাশ্রয়টি চোখে পড়ল। আবার তা অদৃশ্য হয়ে গেল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তখন ফ্যাকাসে রঙ ধরেছে। সেটাকে সিসায় তৈরি কম্বলের মতো লাগছে। পোতাশ্রয়ে অসংখ্য ক্রেন নিচু হয়ে রয়েছে। সমুদ্র থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসা কুশ্রী প্রাণিদের এন্টেনার মতো দেখাচ্ছে।

ঢালের শীর্ষে অবস্থিত বাড়িটি বেশ বড় আর জাঁকালো। বাড়ির দেওয়াল বড় বড় পাথর বসিয়ে বানানো। খুব আকর্ষণীর তার প্রবেশদরোজা। সেখানে রয়েছে দুটো গাড়ি রাখার মতো গ্যারেজ। আজেলিয়া ফুলের ঝাড়গুলো সুন্দর করে ছাটা। কাছাকাছি কোথাও থেকে বড় কোনও কুকুরের ডাক আমার কানে এল। তিনবার খুব উঁচু স্বরে কুকুরটি ডাকল। তারপর কেউ একজন তাকে ধমক দিল। সে সহসা থেমে গেল। তারপর সব কিছু চুপচাপ হয়ে গেল।

নিমন্ত্রণপত্রে আঁকা মানচিত্রটি অনুসরণ করতে করতে আমার মধ্যে একটি অস্পষ্ট অস্বস্তিকর ভয় ভর করল। অস্বাভাবিক লাগছিল। প্রথমত, রাস্তায় লোকজন ছিল না। বাস থেকে নামার পর কোনও একজন পথচারীও চোখে পড়েনি। দুটো গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তবে তারা উপরে নয়―গেল ঢালের নিচের দিকে। যদি সেখানে সত্যি সত্যি কোনও কনসার্ট হতো তবে সেখানে অনেক লোক দেখতে পেতাম। কিন্তু পুরো এলাকাটি ছিল নিথর আর শব্দহীন। মনে হয় যেন ঘন মেঘ সব শব্দকেই গিলে খেয়েছে।

আমি কি ভুল বুঝেছি ?

জ্যাকেটের পকেট থেকে নিমন্ত্রণপত্রটি বের করে ঠিকানাটি আবার দেখে নিলাম। হতে পারে আমি ভুল পড়েছিলাম। আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে আবার পড়লাম। কিন্তু কোনও ভুল খুঁজে পেলাম না। ঠিক পথেই আমি আছি, ঠিক বাস স্টপেই নেমেছি। তারিখ ও সময়ও ঠিক ঠিক আছে। নিজেকে শান্ত করার জন্য গভীর করে শ্বাস নিলাম। তারপর আবার পা বাড়ালাম। কনসার্ট হল খুঁজে বের করে দেখাই আমার একমাত্র কাজ হয়ে পড়ল।

অবশেষে সেই বিল্ডিংয়ের সামনে পৌঁছালাম। সে সময়ে গেটে শক্ত একটা তালা লাগানো ছিল। একটা মোটা শেকল দিয়ে গেটকে আটকে রাখা হয়েছে। শেকলটা একটা বড় তালার সঙ্গে লাগানো আছে। আশেপাশে কেউই নেই। গেটে একটি ছোট খোলা ছিদ্র আছে। সেখান দিয়ে ভেতরে বড় একটি পার্কিং লট দেখতে পারছি। সেখানে কোনও গাড়ি রাখা নেই। চত্বরের পাথরখণ্ডগুলোর মাঝখানে আগাছা জন্মেছে। দেখে মনে হয় পার্কিং লটটি বেশ কিছুদিন ধরে ব্যবহৃত হয় না। গেটের নামফলকটি বলে দিচ্ছে যে কনসার্ট হলটি আমি খুঁজছি সেটা এটাই।

গেটের পাশে ইন্টারকমের বোতামে চাপ দিলাম। কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বোতাম টিপলাম। তখনও কোনও উত্তর এল না। ঘড়ি দেখে বুঝলাম পনেরো মিনিট পরে কনসার্ট শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু গেট খোলার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। জায়গায় জায়গায় রঙ উঠে গেছে। শুরু হয়েছে জং পড়া। আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তাই আরেকবার ইন্টারকমের বোতাম টিপলাম। টিপে ধরে রাখলাম বেশ কিছুটা সময়। কিন্তু আগের মতোই অবস্থা―গাঢ় নীরবতা।

কী করব বুঝতে পারছিলাম না। গেটে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে রইলাম ঝাড়া দশ মিনিট। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার আগেই কেউ না কেউ এসে দেখা দেবে এ-ধরনের একটি ফিকে আশা মনে জেগেছিল। গেটের ভেতরে অথবা বাইরে কারও আসার কোনও লক্ষণ দেখা দিল না। কোনও হাওয়া নেই। পাখির কিচিরমিচির নেই। নেই কোনও কুকুরের ঘেউ ঘেউ। আগের মতোই মাথার ওপরে অখণ্ড সাদা মেঘ শুয়ে আছে।

শেষ আশা ছেড়ে দিলাম―এ ছাড়া আর কীইবা করার আছে ? আর লম্বা লম্বা পা ফেলে বাসস্টপের রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কী ঘটেছে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারেই থেকে গেলাম। শুধু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল―আজ এখানে কোনও পিয়ানো কনসার্ট বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে না। এরপরে আমি ফুলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করতে পারি। আমার মা হয়তো সন্দেহ ছাড়াই শুধাবেন, ‘কীসের জন্য এই ফুল ?’ আমি তখন তাকে কিছু বানানো কথা বলব। স্টেশনের আবর্জনার ক্যানে ফুলগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলাম। কিন্তু সেগুলো―নিদেনপক্ষে―ছুড়ে ফেলার জন্য ব্যয়বহুল কাজ হবে।

পাহাড় থেকে নামলে অল্প দূরে একটি মনোরম ছোট পার্ক পড়ে। একটি বাড়ির জমির সমান আকারের এই পার্কটি। রাস্তা থেকে একটু দূরে একটি কোণাকার পাথর পার্কের দেওয়াল হিসেবে আছে। এটা শুধুই একটা পার্ক মাত্র―এখানে নেই কোনও ঝরনা বা খেলার উপকরণ। এর বাইরে পার্কের মাঝখানে একটি ছোট পোতাশ্রয় শক্ত করে পোতা রয়েছে। পোতাশ্রয়টির দেওয়াল একটু হেলানো জাফরি কাটা―সেখানে আইভি লতার বাড়তি ঝাড়। তার চারপাশে ঝোপজঙ্গল আর মাটিতে পা ফেলার জন্য চ্যাপ্টা পাথরখণ্ড আছে। পার্কটা কেন এখানে করা হয়েছে তা বলা কঠিন। কিন্তু কেউ নিয়মিত পার্কের যত্ন করে। গাছপালা আর ঝোঁপগুলো সুন্দরভাবে ছাটা আছে। এর চারদিকে কোনও আগাছা বা জঞ্জাল নেই। পাহাড়ে হেঁটে ওঠার সময়ে পার্কটির পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি। কিন্তু আমি সেটা খেয়াল করিনি।

আমার চিন্তাগুলোকে জড়ো করার জন্য পার্কে ঢুকলাম। পোতাশ্রয়ের কাছে একটি বেঞ্চিতে বসলাম। পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয় কিনা তা দেখার জন্য এখানে কিছুক্ষণ বসে যাওয়া উচিত মনে হলো। যতটা জানি হুট করে কেউ এসেও পড়তে পারে। বসে পড়তেই বুঝতে পারলাম খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সেটা ছিল অদ্ভুত ধরনের ক্লান্তি। বেশ কিছু সময় ধরেই এটা আমাকে অবসন্ন করে ফেলেছিল। কিন্তু সেটা টের পাইনি। এখন সেটা আক্রমণ করল। পোতাশ্রয় থেকে পোতাশ্রয়টিকে ছবির মতো দেখাচ্ছিল। জেটিতে অসংখ্য বড় বড় কন্টেইনার রয়েছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে গাদা করে থাকা ধাতব কন্টেইনারগুলোকে ছোট ছোট টিনের কৌটার মতো লাগে। পয়সা বা কাগজের টুকরো রাখা হয় টেবিলের ওপরে থাকা এসব কৌটার মধ্যে।

কিছু সময় পরে দূর থেকে কোনও একটি মানুষের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সেটা ঠিক স্বাভাবিক কণ্ঠ নয়―সে কণ্ঠের জোর বাড়াতে একটি লাউড স্পিকার ব্যবহার করা হয়েছে। কী বলা হচ্ছে সেটা ধরতে পারছি না, কিন্তু প্রতিটি বাক্য বলার পরপরই বেশ কিছুটা থেমে নিচ্ছে। কণ্ঠটি গুছিয়ে কথা বলছে। কোনও আবেগের লেশমাত্র নেই। যেন সে কণ্ঠ কোনও অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে যতটা সম্ভব স্পষ্টভাবে ঘোষণা করার চেষ্টা করছে। এই ঘোষণাটিতে যেন শুধু আমার উদ্দেশ্যেই কোনও ব্যক্তিগত বার্তা  পাঠানো হচ্ছে। শুধু আমারই উদ্দেশ্যে। কোথায় আমার ভুল হচ্ছে সেটা বলার ঝামেলায় যাচ্ছিল কেউ একজন। বলছে―কী আমি এড়িয়ে যাচ্ছি। স্বভাবত এরকম কিছু আমি ভাবিনি। কিন্তু কিছু কারণের জন্য এটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরছে। আমি কান খাড়া করে শুনলাম। কণ্ঠটি খুব ধীর লয়ে জোরালো হয়েছে। সহজে বোঝা যায়। অবশ্যই একটি লাউড স্পিকার থেকে কণ্ঠটি ভেসে আসছে। সেটা একটা গাড়ির ছাদে আছে। গাড়িটি ঢালু পথ দিয়ে ধীরে ধীরে চলছিল। তার মোটেই কোনও তাড়া ছিল না। অবশেষে বুঝতে পারলাম, ওটা একটা খ্রিস্টান মিশনারিদের গাড়ি। যিশুর বাণী শোনাচ্ছে।

‘প্রত্যেকেই মরবে।’ গলাটি শান্ত একঘেয়েভাবে বলল। ‘সবাই অবশেষে মারা যাবে। কেউই মৃত্যুকে এড়াতে পারবে না। এড়াতে পারবে না মৃত্যুর পরের বিচারকে। মৃত্যুর পরে প্রত্যেকেই তার পাপের জন্য কঠিন শাস্তি পাবে।’

সেখানে একটি বেঞ্চে বসে এই বাণী শুনছিলাম। পাহাড়ের চূড়ায় এই জনবিচ্ছিন্ন আবাসিক এলাকায় কেউ সমাচার প্রচার করতে পারে―এটা দেখে অবাক হলাম। এখানকার বাসিন্দাদের অনেকগুলো গাড়ি আছে। তারা বেশ ধনী। পাপ থেকে উদ্ধারের জন্য এদের কোনও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। অথবা তারা কি এরকম ? আয় আর সামাজিক অবস্থার সঙ্গে পাপ আর ত্রাণের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নাই।

‘কিন্তু যারা যিশুর শরণ নেবে পাপ মোচনের জন্য প্রভু অবশ্যই তাদেরকে ক্ষমা করেবেন। তারা নরকের আগুন থেকে রক্ষা পাবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস আনো। যারা তার প্রতি বিশ্বাস আনবে তারা মৃত্যুর পরে উদ্ধার পাবে। আর পাবে স্বর্গীয় জীবন।’

খ্রিস্টান মিশনের গাড়ির অপেক্ষা করছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম গাড়িটি রাস্তার ওপরে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। আর মৃত্যুর পরের বিচার নিয়ে আরও কিছু কথা বলবে। তারা কথা বলবে আশ্বাসের সুরে আর অটল সাহসের সঙ্গে। সে কথা যাই হোক না কেন আমাকে অবশ্যই শুনতে হবে সেই সব কথা। কিন্তু গাড়িটি দেখা গেল না। আর এক সময় সেই কণ্ঠটি কমে আসতে লাগল। তা হয়ে উঠল অস্পষ্ট। বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই আর শোনা যায়নি। গাড়িটি অবশ্যই অন্য দিকে চলে গেছে। চলে গেছে আমার কাছ থেকে বহু দূরে। যখন গাড়িটি মিলিয়ে গেল তখন মনে হলো এ পৃথিবী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

হঠাৎ করে একটা চিন্তা এল, হয়তো পুরো ব্যাপারটাই একটা ধাপ্পা। মেয়েটি আমাকে ধাপ্পা দিয়েছে। এই ধারণা বা তালগোল পাকানো ব্যাপারটা―আমার বলা উচিত―কোথাও থেকে আসেনি। কিছু কারণে ধাপ্পাটা আমি ধরতে পারিনি। সে খুব স্বচ্ছন্দে আমাকে ভুল তথ্য পাঠিয়েছে। আর আমাকে একটি রবিবার বিকেলে একটি পাহাড়ের চূড়ায় টেনে এনেছে। হয়তো কোনও ভুল করেছিলাম মেয়েটির প্রতি―সেজন্য সে মনে ব্যক্তিগত রাগ পুষে রেখেছে। অথবা, কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই সে খুব খারাপভাবে নিয়েছে। সেটা সে সহ্য করতে পারেনি। আর সে তাই কোনও ভুয়া কনসার্টের আমন্ত্রণ আমাকে পাঠিয়েছে। এখন তার উল্লাস হচ্ছে―আমাকে কতটা বোকা বানিয়েছে সেটা হাসতে হাসতে মাথা ঘুরিয়ে দেখছে সে। কতটা বেদনাদায়ক আর হাস্যকর আমাকে দেখাচ্ছে সেটা অবশ্যই দেখছে।

ঠিক আছে। কিন্তু কাউকে হয়রানি করার মতো জটিল ঘটনার সঙ্গে যে ঝামেলাগুলো আসে তা নিয়ে খেলা করা কি উচিত কোনও মানুষের ? এটা কি এক ধরনের জিঘাংসা নয় ? কেউ কি সত্যি সত্যি এরকম খারাপ হতে পারে ? মনে করতে পারি না যে তার সঙ্গে আমি এমন কোনও আচরণ করেছি যার জন্য সে আমাকে ঘৃণা করতে পারে বা করতে পারে তারও বেশি কিছু। কিন্তু কখনও সখনো না বুঝে মানুষের অনুভূতিকে পায়ে দলে যাই, তাদের গর্বকে আঘাত করি, তাদের মান খারাপ করে দিই। মাঝে মাঝে এই অবিশ্বাস্য ঘৃণার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবি। এখানে ঘটে যাওয়া ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু মনে সান্ত্বনা পাওয়ার মতো কিছু পাই না। এরকম আবেগের গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি বলে আমার মন খেই হারিয়ে ফেলছে বলে বোধ হলো। এটা বোঝার আগেই আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।

বছরে দু-একবার এ শ্বাসকষ্টে ভুগতে হয় আমাকে। আমার ধারণা অবশ্যই এটা মানসিক চাপের কারণেই হয়ে থাকে। এটা হাইপারভেন্টিলেশন রোগ। কোনও কিছু আমাকে বিক্ষুব্ধ করলে আমার গলা চেপে আসে। ফুসফুসের জন্য বেশি হাওয়া তখন নিতে পারি না। যেন আমি দ্রুত বাঁকা হয়ে যাচ্ছি বিদ্যুতের নিচে। যেন আমি ডুবে যাচ্ছি। আমার শরীরটা যেন জমে বরফ হয়ে যাচ্ছ। এই আতঙ্ক এলে এ সময়ে আমি শুয়ে পড়ি। চোখ দুুটি বন্ধ করে ফেলি। আমার শরীরের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসার সময় পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে থাকি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের লক্ষণের মুখোমুখি এখন আর হই না। (এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে এত সহজেও আর লাল হয়ে পড়ছি না।) কিন্তু কিশোরবেলায় এইসব ঝামেলায় হলে বিপদে পড়তাম।

পোতাশ্রয়ের বেঞ্চে বসে আমার চোখ দুটোকে খুব শক্ত করে মাতালের মতো বুজিয়ে ফেলি। মনের ঘোর থেকে বেরোনোর জন্য অপেক্ষা করি। এই অপেক্ষার সময় হতে পারে ৫ মিনিট। হতে পারে ১৫ মিনিট। জানি এটা কতটা লম্বা সময়। এ সময় অদ্ভুত অদ্ভুত রঙ দেখতে থাকি। অন্ধকার সরে যায় চোখ থেকে। আমি রঙগুলোকে ধীরে ধীরে গুনতে থাকি। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। একটা ইঁদুর আটকা পড়লে যেরকম হয় ঠিক সেরকমই আমার বুকের খাঁচায় হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে যায়।

এই গোনা কাজটিতে এত বেশি মগ্ন হয়ে পড়ি যে, অন্যের উপিস্থিতি বুঝতে আমার বেশ কিছুটা সময় লাগে। মনে হয় যেন কেউ আমার সামনে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খুব সতর্কভাবে, খুব ধীরে ধীরে আমার চোখ দুটো খুলি, আমার মাথা একটু উঁচু করি। আমার হৃৎপিণ্ড তখনও ধপ ধপ করতে থাকে।

আমার সামনের বেঞ্চে একজন বুড়ো মানুষ আমার অজান্তে বসে ছিলেন। তিনি আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়েছিলেন। বুড়ো মানুষের বয়স যাচাই করা একজন তরুণের পক্ষে সহজ নয়। আমার কাছে, এদের সবাইকে বুড়া মানুষ লাগে। ষাট, সত্তর―কী পার্থক্য আছে ? তারা আর তরুণ নেই―এটাই হলো আসল। এই মানুষটি একটি নীলচে সাদা কার্ডিগান পরে আছেন। বাদামি শক্ত সুতি কাপড়ের প্যান্ট। আর গাড় নীল রঙের স্নিকার জুতা। আমি যদিও এখন সেগুলো দেখছি, কিন্তু যখন ছিল সে সময় বহু আগেই চলে গেছে। এর মানে এই নয় যে, তিনি ছেঁড়া জামাকাপড় বা এ ধরনের কিছু পরেছেন। তার সাদা চুলগুলো বেশ ঘন আর খাড়া দেখতে। স্নানের সময়ে পাখির ডানা দুটো যে রকম দেখায় ঠিক সে সময় কানের ওপরে তার দু গাছা চুল রয়েছে। কোনও চশমা পরেননি তিনি। তিনি কতক্ষণ সেখানে বসে আছেন আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হলো তিনি বেশ কিছু সময় ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নিশ্চিত যে, যখন অবশ্যই আমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল তখন থেকে তিনি বলতে চাইছেন, ‘তুমি ঠিক আছো তো ?’ অথবা এ ধরনের কিছু কথা। আমি তো সত্যি সত্যি চিন্তিত ছিলাম। এই বুড়ো লোকটিকে চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই ভাবনা আমার মনে উঁকি দিল। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। কিছুই জানতে চাইলেন না। শুধু তিনি খুব শক্ত করে একটা কালো রঙের ছাতা মুঠো করে ধরে ছিলেন বুড়োদের লাঠির মতো। ছাতাটির কাঠের হাতল স্ফটিকের মতো চকচকা রঙের। সেটা দেখতে খুবই মজবুত। দরকার হলে সেটাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা যায়। তার কাছে অন্য কিছুই ছিল না। এজন্য কাছাকাছি পাড়ায়ই তিনি থাকেন বলে ধারণা করছি।

আমার শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে তুলতে চেষ্টা করছি এখানে বসে। বুড়ো লোকটি চুপচাপ আমাকে খেয়াল করে চলেছেন। তার চোখের পলক পড়ছে না বলা যায়। এটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলল―যেন আমি কারও বাড়ির পেছনের বাগানে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছি। আর আমি বেঞ্চ থেকে উঠে পড়তে চাইছিলাম। চাইছিলাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাস স্টপের দিকে চলে যেতে। কিন্তু কিছু কারণে আমার পা তুলতে পারলাম না। সময় চলে গেল। আর তখন হঠাৎ করে বুড়ো লোকটি কথা কয়ে উঠলেন―

‘অনেকগুলো কেন্দ্রযুক্ত একটি বৃত্ত।’

তার দিকে তাকালাম। আমার চোখাচোখি হলো। তার চওড়া কপাল। খাড়া নাক। পাখির ঠোঁটের মতোই তা চোখা। আমি একটা কিছু বলতে পারলাম না। তাই বুড়ো মানুষটি আবার বললেন সে কথাগুলো :

‘অনেকগুলো কেন্দ্রযুক্ত একটি বৃত্ত।’

স্বাভাবিকভাবে তিনি কী বলতে চাইছেন সে ব্যাপারে আমার কাছে কোনও ইশারা ইঙ্গিত কিছুই নাই। একটা চিন্তা এল আমার মধ্যে―এই লোকটি লাউড স্পিকার বহনকারী গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। হয়তো কাছাকাছি কোথাও গাড়িটি থামিয়ে রেখেছেন। এখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। না, তিনি সেটা করতে পারেন না। আমি যে কণ্ঠটি শুনেছিলাম তা থেকে তার কণ্ঠটি ভিন্ন। লাউড স্পিকারের কণ্ঠটি ছিল অনেক অল্প বয়েসী মানুষের কণ্ঠ। অথবা সেটা রেকর্ড করা।

‘বৃত্তগুলো, আপনি কি তাই বলছেন ?’ দোনামোনা করে শুধালাম। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। আর তার ভদ্রভাব দেখেই আমি সাড়া দিলাম।

‘কয়েকটি বৃত্ত―না, কখনও কখনও অগণিত। এবং এটা পরিধি ছাড়াই একটি বৃত্ত।’ এই কথাগুলো বলতে বলতে তিনি ভ্রƒ কোঁচকালেন। তার কপালে গভীর করে বলিরেখা জেগে উঠল। ‘এ ধরনের বৃত্ত তোমার মনে আঁকতে পারো ?’

আমার মন তখনও কিছু ধরতে পারেনি। কিন্তু মনে কিছু ভাবনা আনলাম। একটি বৃত্ত―যার আছে অনেকগুলো কেন্দ্র। আর নেই কোনও পরিধি। যতোটা পারলাম ততোটা ভাবলাম। কিন্তু তার কোনও ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারলাম না।

‘আমি পারি না।’ বললাম আমি।

বুড়ো মানুষটি আমার দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে রইলেন। যেন তিনি কোনও ভালো উত্তরের অপেক্ষা করছেন।

‘আমার মনে হয় না যে, অংক ক্লাসে এ ধরনের বৃত্ত নিয়ে কিছু শিখেছি।’ হতাশ গলায় যোগ করলাম।

বুড়ো মানুষটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। ‘অবশ্যই নয়। এটাই ধারণা করা যায়। কারণ তারা স্কুলে তোমাকে এরকম কিছু শেখায়নি। সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো।’

আমি যেন খুব ভালো করে জানি। কেন এই বুড়ো মানুষটি এটা বুঝে নিলেন ?

‘এ ধরনের বৃত্ত সত্যি কি আছে ?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘অবশ্যই এটা আছে।’ বুড়ো লোকটি কিছু সময় ধরে নড়ে চড়ে বললেন। ‘এই বৃত্ত আসলেই আছে। কিন্তু সবাই তা দেখতে পারে না―এটা জেনো।’

তুমি কি দেখতে পারো সেটাকে ?

তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। কিছু সময়ের জন্য আমার প্রশ্নটি হাওয়ায় ঝুলে রইল। শেষে সেটা কুয়াশার মতো হয়ে গেল। তারপরে হয়ে গেল অদৃশ্য।

বুড়ো মানুষটি আবার বললেন, ‘শোনো, একে কল্পনা করার মতো শক্তি তুমি পেয়েছো। তুমি তোমার অভিজ্ঞানকে কাজে লাগাও। আর তাকে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলো―একটি বৃত্ত―যার আছে অনেক অনেক কেন্দ্র, কিন্তু নেই কোনও পরিধি। তোমাকে এমনভাবে শক্তি খাটাতে হবে যেন তোমার রক্ত গলে জল হয়ে যাবে, ঠিক এ সময়েই ক্রমান্বয়ে বৃত্তটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।’

‘শুনতে বেশ কঠিন লাগছে।’ আমি বললাম।

‘অবশ্যই কঠিন।’ তিনি বললেন। এমন করে বললেন যেন তিনি কঠিন কিছু ছুড়ে দিলেন। এ পৃথিবীতে সহজে পাওয়ার মতো কিছ নেই তোমার। তারপর, যেন আরেকটি স্তবক শুরু করার জন্য গলাটা একটি কেশে পরিষ্কার করে নিলেন। ‘কিন্তু, তুমি যখন অনেক সময় ব্যয় করে চেষ্টা করো, যদি তুমি সেই জটিল জিনিসটি পেয়ে যাও তবে তখন তা তোমার জীবনের ক্রিম হয়ে উঠবে।’

‘ক্রিম ?’

‘ফরাসি ভাষায় তারা বলে, ক্রেমে ডে লা ক্রেমে। তুমি কি এটা জানো ?’

‘জানি না আমি।’ উত্তরে বললাম। আমি ফরাসি ভাষা জানি না।।

‘ক্রিমের মধ্যে ক্রিম। এর অর্থ সেরা মধ্যে সেরা। এটা জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সার-পদার্থ―এটা হলো ক্রেমে ডে লা ক্রেমে।―বুঝেছো ? আর বাকি সব বিরক্তিকর আর মূল্যহীন।’

তিনি ক্রেমে ডে লা ক্রেমে বলতে কী বুঝিয়েছেন সেটা কিন্তু আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারছি না ।

‘এটা নিয়ে চিন্তা করো।’ বললেন বুড়ো মানুষটি। তোমার বন্ধু করো চিন্তাকে আবার। তারপর তুমি গভীরভাবে সেটা ভাবো। একটা বৃত্তকে ভাবতে থাকো যার অনেক কেন্দ্র আছে। কিন্তু কোনও পরিধি নেই। জটিল বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করার জন্য তোমার মগজ তৈরি করা হয়েছে। তুমি যেটা বুঝতে পারছ না সেটা কীভাবে বুঝতে কী করতে হবে তার জন্য কিছু ইঙ্গিত তোমাকে দিচ্ছি। এটা থেকে তুমি সাহায্য পাবে। তুমি অলস হতে পারবে না বা তুচ্ছ করতে পারবে না। এখন সময়টা হলো ক্রান্তিকাল। এ সময়টাতেই তোমার মগজ আর হৃদয় সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে শক্তি।’

আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম। চেষ্টা করলাম মনে মনে সেই বৃত্তটির ছবি আঁকতে। অলস হতে বা এড়িয়ে চলতে চাইলাম না। মানুষটি কী বলেছিল সেটা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে যাই ভাবি না কেন সে সময়ে এর অর্থ বের করাটা আমার জন্য ছিল অসম্ভব। যেসব বৃত্তকে আমি জানি তাদের প্রত্যেকের একটি কেন্দ্র। কেন্দ্রের চারিদিকে বাঁকা পরিধি রয়েছে। পরিধির যে কোনও বিন্দু থেকে কেন্দ্রের দূরত্ব সমান।। কম্পাস দিয়ে এ ধরনের বৃত্তের ছবি খুব সহজে আঁকা যায়। বুড়ো মানুষ যে বৃত্তটির কথা বলেছেন সেটা এর ঠিক উলটো নয় ?

আমার মনে হয় না লোকটার মাথা ঠিক নেই। আর তিনি আমার সঙ্গে মস্করা করছেন সেটাও মনে হয়নি। তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় জানাতে চাইছিলেন। তাই আমি আবারও চেষ্টা করি বুঝতে, কিন্তু আমার মন কেবল ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয় না। কীভাবে একটি বৃত্তের অনেক (হয়তো বা অসীম সংখ্যক) কেন্দ্র থাকতে পারে যার কোনও পরিধি নেই ? এটা কি কোনও উন্নত দার্শনিক রূপক ? আমি আশা ছেড়ে দিলাম। চোখ খুললাম। আরও অনেক ইশারা ইঙ্গিত দরকার আমার।

কিন্তু বুড়ো মানুষটিকে আর সেখানে দেখা গেল না। চারিদিকে নজর করলাম।।কিন্তু পার্কে কারও উপস্থিতির চিহ্ন দেখা গেল না। মনে হয় যেন তিনি কখনওই ছিলেন না। আমি কি এরকম কিছু কল্পনা করে নিচ্ছি ? না, এটা কোনও ফ্যান্টাসি নয়। তিনি এখানেই ছিলেন, ঠিক আমার সামনেই ছিলেন। শক্ত হাতে ধরেছিলেন ছাতার বাঁট। কথা বলছিলেন শান্তভাবে। অদ্ভুত একটি প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে ছিলেন। আর তারপর তিনি উবে গেলেন।

আমার শ্বাস প্রশ্বাস, আমার বোধ হলো, আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। হয়েছে শান্ত এবং স্থির। দ্রুত গতির বিদ্যুৎপ্রবাহ চলে গেছে। পোতাশ্রয়ের ওপরের ঘন মেঘের এখানে ওখানে ফাঁকা হতে শুরু করেছে। আলোর একটি রশ্মি ভেঙ্গে গেছে। ক্রেনের ওপরের এলুমিনিয়ামের ছাদটাকে উজ্জ্বল করে দিয়েছে। যেন ঠিক এই একটি জায়গাটিকে লক্ষ করেই রশ্মিটি এখানে এসে পড়েছে। এই প্রায় পৌরাণিক দৃশ্যটি আমাকে স্তম্ভিত করে দিল। অনেকটা সময় আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

সেলোফেন কাগজে মোড়া লাল ফুলের ছোট তোড়াটা আমার পাশেই ছিল। যা কিছু ঘটেছে তার প্রমাণ যেন এই ফুলের তোড়াটা। এটা দিয়ে আমি কী করব―এই প্রশ্ন তুলতেই পারি। আর পোতাশ্রয়ের বেঞ্চিতে ফেলে গেলেই এর সমাপ্তি ঘটে। আমার কাছে এটাই সব চেয়ে ভালো হবে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। যে বাস স্টপে সকালে নেমেছিলাম সেদিকে রওনা করলাম। জোরালো বাতাস আবার বইতে শুরু করেছে। ওপরের থমকে থাকা মেঘগুলোকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে।

এই গল্পটি বলা শেষ করে একটু দম নিলাম। আমার তরুণ বন্ধুটি বলল, ‘গল্পটি কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারিনি। তখন কী ঘটেছিল সত্যি সত্যি ? সেখানে কি কোনও উদ্দেশ্য বা নীতি কাজ করেছিল ?’

হেমন্তের এক রবিবার দুপুরে কোবি পাহাড়ের শীর্ষে খুব বিতিকিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। নিমন্ত্রণপত্রটির দিক নির্দেশনা অনুসারে সেখানে গিয়েছিলাম―সেখানে পিয়ানো কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। আবিষ্কার করেছিলাম সেখানে শুধু আছে একটি নিঝুম বিল্ডিং । ―এসবের মানে কী ? আর কেনই বা এটা ঘটল ? এসব প্রশ্নই বন্ধুটি জানতে চেয়েছিল। এগুলো খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন। বিশেষ করে যে গল্পটি তাকে বলেছিলাম তার কোনও উপসংহার নেই।

‘আমি নিজেও সেটা বুঝতে পারিনি, এমন কি এখন পর্যন্ত না।’ আমি স্বীকার করলাম।

কিছু পুরনো ধাঁধার মতো আমি চূড়ান্তভাবে এর সমাধান করতে পারিনি। সেদিন যা ঘটেছিল তা ছিল দুর্বোধ্য, ব্যাখ্যাতীত। আমার আঠারো বছর বয়সে এটা আমাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। ফেলে দিয়েছিল রহস্যের অন্ধকারে। এটা এত তীব্র ছিল যে সে সময়ে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

‘কিন্তু আমি সেই অনুভূতিটি পেয়েছিলাম,’ আমি বললাম, ‘সেই নীতি বা উদ্দেশ্য কিন্তু কোনও বিষয় ছিল না।’

আমার বন্ধুটি এবার হতভম্ভ হয়ে গেল। শুধাল, ‘সে ঘটনাটি কী ছিল সে বিষয়ে তোমার আর জানার দরকার নেই―তুমি কি তাই আমাকে বলছ ?’

আমি মাথা নাড়লাম।

‘কিন্তু আমি’, সে বলল, ‘এই গল্পের শেষ না থাকার কারণে বিরক্ত হতাম। সে রকম যা কিছু ঘটেছিল তার সত্যিটাকে জানতে চাইতাম। যদি আমি তোমার জায়গায় থাকতাম তাহলে এটাই করতাম।’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই। যদি পিছিয়ে গিয়ে ভাবো তবে সেটা আমাকেই বিরক্ত করেছিল বইকি। অনেক বেশি করেছিল। এটা আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছিল। কিন্তু পরে এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে, দূর থেকে ভাবতে ভাবতে, অনেক দিন কেটে গেছে। সেটা এখন আমার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। আমাকে বিষণ্ন করার মতো তার কোনও মূল্য নেই। জীবনের ক্রিমের কাছে এর কোনও অর্থ নেই―এটাই আমি ভাবি।’

‘জীবনের ক্রিম।’ সে আবার উচ্চারণ করল।

‘মাঝে মাঝে এ ধরনের কিছু ব্যাপার ঘটে।’ তাকে বললাম। ‘এগুলো যদিও খুবই বিরক্তিকর, তবু এসব ব্যাপার বোঝানো যায় না। যুক্তিতে ফেলা যায় না। আমার মত হলো এগুলো নিয়ে আমাদের ভাবনা করার দরকার নেই। শুধু চোখ বন্ধ করো। আর সেগুলোকে ছুড়ে ফেলো। যেন আমরা প্রবল স্রোতের নিচে দিয়ে গিয়েছিলাম।’

আমার তরুণ বন্ধুটি কিছু সময় চুপ হয়ে রইল। বুঝতে চেষ্টা করল সেই প্রবল স্রোতধারাকে। সে যন্ত্রণায় অভিজ্ঞ মানুষ। এই স্রোতে আসতে অনেক অনেক বিষয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে বিবেচনা করতে হয়েছে তাকে। শেষে সে বলল, ‘কোনও কিছু নিয়ে না ভাবার ব্যাপারটি কিন্তু বেশ কঠিন।’

‘তুমি ঠিক ধরেছ। হয়তো এটা বেশ কঠিন হতে পারে বাস্তবে।’

‘এ পৃথিবীতে সহজে পাওয়ার মতো মূল্যবান কিছু নেই তোমার।’ বুড়ো মানুষটি এই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন কম্পনহীন শাস্তি ঘোষণার মতো। যেন পিথাগোরাস তার কোনও তত্ত্ব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

‘যে বৃত্তটির অসংখ্য কেন্দ্র রয়েছে, নেই তার পরিধি,’ বন্ধুটি শুধালো, ‘এর কোনও উত্তর তুমি কি খুঁজে পেয়েছ ?’

‘ভালো প্রশ্ন,’ উত্তর দিলাম মাথাটি খুব ধীরে ধীরে নাড়িয়ে। আমি কি পেয়েছি ?

আমার জীবনে, যখনই কোনও ব্যাখ্যাতীত, যুক্তিহীন ও বিরক্তিকর ঘটনা ঘটেছে (আমি বলছি না যে এটা প্রায়ই ঘটছে, কিন্তু সামান্য কিছু তো ঘটে), আমি সব সময়েই এই বৃত্তের কাছে ফিরে আসি―ফিরে আসি সেই বৃত্তের কাছে যার বহু কেন্দ্র আছে, নেই কোনও পরিধি। আর এরকমই তো আমার আঠারো বছর বয়সে পোতাশ্রয়ের বেঞ্চিতে বসে আমার চোখ বন্ধ করেছিলাম। শুনেছিলাম আমার হৃদস্পন্দন।

মাঝে মাঝে আমি বৃত্তটি কী রকম সেটা অনুভব করতে পারি। কিন্তু গভীর বোধ আমাকে সরিয়ে দেয়। বৃত্তটির অধিকাংশ স্থির বা সত্যিকারের কোনও বৃত্তের আকার তাতে না থাকলেও তার অস্তিত্ব আছে কেবল আমাদের মনের মধ্যে। যখন আমরা কাউকে সত্যিকারে ভালোবাসি, বা গভীরভাবে কাউকে অনুভব করি, কিংবা এই পৃথিবীটা কেমন হওয়া উচিত সে ধরনের আদর্শ অনুভব থাকে আমাদের মনে, অথবা যখন আমরা বিশ্বাসকে আবিষ্কার করে বসি বা আবিষ্কার করি বিশ্বাসের কাছাকাছি কিছু, তখন আমরা প্রদত্ত বৃত্তটিকে বুঝতে পারি, আমাদের হদয়ে তাকে গ্রহণ করি। যদিও স্বীকার করছি, এর কারণ বের করার জন্য আমি যেসব উদ্যোগ নিয়েছি তার কাছে এটা কিছুই নয়।

আমার মগজের সৃষ্টি হয়েছে জটিল বিষয় চিন্তা করার জন্য। তুমি যে কিছু বুঝতে পারছ না এটা বোঝার মতো একটা পয়েন্ট পেতে সাহায্য করে এই মগজ। এটাই তোমার জীবনের সারাংশে পরিণত হয়। বাকিগুলো বিরক্তিকর আর মূল্যহীন। এটাই সেই সাদা চুলওয়ালা বুড়ো মানুষটি আমাকে বলেছিলেন। হেমন্তের শেষে এক রবিবারের মেঘলা দুপুরে মোবি পাহাড়ে শীর্ষে ছোট এক তোড়া লাল ফুল হাতে ধরেছিলাম। আর এখনও কোনও ঝামেলা মতো ব্যাপার ঘটলেই আমি তাই করি। আমি আবার ভাবতে থাকি সেই বিশেষ বৃত্তটিকে। সেটা খুবই বিরক্তিকর আর মূল্যহীন। এবং তার মধ্যেই সেই জীবনের সারাংশ অবশ্যই আছে। আছে তা আমার মনের গভীরে।

অনুবাদক : গল্পকার, প্রবন্ধকার

নিউ ইয়র্ক থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button