অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ নভেলা : নাসিকা

মূল : নিকোলাই গোগল

বাংলা অনুবাদ : নাহার তৃণা

[নিকোলাই গোগল (১৮০৯-১৮৫২): রুশ জাতীয় সাহিত্যে, বিশেষত রুশীয় সাহিত্যের স্বর্ণযুগের ইতিহাসে লেখক-নাট্যকার গোগলের নাম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। জন্মের পর আয়ানোভস্কি ((Ianovskii)) নামকরণ করা হলেও তাঁর দাদাজান নিজের বংশগৌরবের অংশ হিসেবে পৌত্রের নামকরণ করেন গোগল। কালক্রমে এ নামেই তিনি বিশ্ববাসীর কাছে অধিক মাত্রায় পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর পুরো নাম নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগল। জন্মসূত্রে ইউক্রেনীয় হলেও তিনি মূলত রুশ ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন, যেখানে ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। গোগলের বয়স যখন দশ, তখন তাঁর ছোট ভাই আইভানের আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে ঘটনায় গোগল শুধু তাঁর ভাইটিকেই হারাননি, একই সঙ্গে সবচে প্রিয় বন্ধু হারানোর যন্ত্রণাও পেয়েছিলেন। আজীবন সে শূন্যতা যেন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি স্কুল-কলেজের ম্যাগাজিনে লেখালেখি শুরু করেন। লেখালেখির শুরুটা তিনি সম্ভবত কবিতা দিয়ে করতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে নিজ খরচে তিনি তাঁর প্রথম মহাকাব্যিক কাব্যগ্রন্থ হান্স ক্যুকলগার্টেন (Hanz Kuechelgarten) প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যা তাঁর জার্মান রোমান্স পড়ার ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে তাঁর কবিতাগ্রন্থটি পাঠকের সমাদর পেতে ব্যর্থ হয়। সে কারণে গোগল অতিমাত্রায় হতাশ হয়ে কাব্যগ্রন্থটি নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন জীবনে আর কোনওদিন কবিতা লিখবেন না। কবি হিসেবে সমাদৃত না হবার দুঃখটা হয়তো তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে পারলে ভুলে যেতেন। বিশ্বসাহিত্যের কপাল ভালো সেটাতেও তিনি সফলতা পাননি। যে কারণে লেখালেখিকেই গোগল একমাত্র ধ্যানজ্ঞান এবং জীবিকা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। যার ফলাফল আজও সাহিত্যপ্রেমী মানুষ উপভোগ করছেন।

মাত্র তেতাল্লিশ বছরের জীবনে নিকোলাই গোগল বিশ্বসাহিত্য ভাণ্ডারকে যে লেখনী উপহার দিয়ে গেছেন তাঁর বুঝি তুলনা চলে না। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ডেড সোলসকে আধুনিক রুশ উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া তাঁর আরেক বিখ্যাত সৃষ্টি দ্য ওভারকোট নিয়ে ফিওদর দস্তোয়ভস্কি ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই গোগলের ওভারকোট থেকেই বের হয়ে এসেছি।’ স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনেক বিশ্বমানের সাহিত্যকর্ম। তাঁর রচিত নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাসগুলোতে সে স্বাক্ষর পাওয়া যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে : ইভেনিংস অন এ ফার্ম নিয়ার ডিকাঙ্কা (১৮৩১-১৮৩২), মিরগোরোদ (১৮৩৫), দ্য ওভারকোট (১৮৪২), দ্য ইন্সপেক্টর জেনারেল (১৮৩৬), ডেড সোলস (১৮৪২)। দ্য নোজ (১৮৩৫) যা অপেরা হিসেবেও বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।] 

মার্চের ২৫ তারিখে সেন্ট পিটার্সবার্গে ইয়াকভলেভিচের বাড়িতে অদ্ভুতুড়ে একটা কাণ্ড ঘটল। নাপিত আইভান ইয়াকভলেভিচ অ্যাসেনশন অ্যাভিনিউয়ের বহুদিনের পুরোনো বাসিন্দা। (ইয়াকভলেভিচের পিতৃপ্রদত্ত নামটি হারিয়ে গেছে, এমনকি  তার দোকানের সাইনবোর্ডেও তার নামগন্ধ নেই―সেখানে গালে সাবানের ফেনা মাখা এক লোকের ছবির সঙ্গে লেখা আছে : এখানে শিরা কেটে রক্ত বের করার চিকিৎসাও দেওয়া হয়)। ওই বিশেষ সকালটিতে আইভান ইয়াকভলেভিচের ঘুম অন্য দিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়িই ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই বাতাসে ভেসে বেড়ানো রুটি সেঁকার টাটকা গন্ধটা তার নাকে ঝাপটা দিল। শোয়া অবস্থা থেকে বিছানায় উঠে বসতেই সে দেখতে পেলো তার কফি অন্তঃপ্রাণ স্ত্রী চুলা থেকে তৈরি হওয়া গরম রুটি তুলতে ব্যস্ত।

‘ও সোনা বউ, আজ আর সকালে কফি চাই না, তার চেয়ে খানিক পেয়াঁজ দিও রুটির সঙ্গে জমিয়ে খাওয়া যাবে।’ স্ত্রীর উদ্দেশ্যে গলায় যতটা সম্ভব আহ্লাদ ঢেলে কথাগুলো বলে আইভান ইয়াকভলেভিচ। আসল কথা হচ্ছে রুটি কফি দুটোই খাওয়ার ষোলো আনা ইচ্ছে তার, কিন্তু বউয়ের ঝামার ভয়ে কোনও ঝুঁকি নিল না।

‘মাথামোটাটা কফি খাবে না বলছে, ভালোই হলো, বাড়তি আরেক কাপ কফি জমিয়ে খাওয়া যাবে’ ভাবতে ভাবতে আইভানের স্ত্রী এক টুকরো রুটি স্বামীর উদ্দেশ্যে টেবিলের উপর ছুড়ে দিল।

আইভান ইয়াকভলেভিচ জামার উপর একটি কোট চাপিয়ে ভদ্রস্থ হয়ে টেবিলে এসে বসে, তারপর দুটি পেঁয়াজ কেটে, তাতে লবণ ছড়িয়ে, বেশ একটু গম্ভীর মুখে, ছুরি হাতে রুটি কাটায় মন দিল। রুটিটা দুভাগ করার পর সেটার মাঝখানের অংশে সাদাটে মতো কিছু একটা লেগে থাকতে দেখে সে বেশ অবাক হলো। বউ তার শুধু পাকা রাঁধুনিই নয়, কিলিয়ে কাঁচা কাঁঠাল পর্যন্ত পাকাতে ওস্তাদ। সেই মানুষের সেঁকা রুটির ভেতরটা কাঁচা থাকার প্রশ্নই আসে না। খুব সতর্কতার সঙ্গে ছুরি দিয়ে জিনিসটাকে সামান্য খোঁচা দিল সে, নিজের আঙ্গুল ছুঁয়ে বুঝতে চেষ্টা করল ওটা কী হতে পারে। ‘বেশ শক্তভাবে গেঁথে আছে দেখছি।’ মনে মনে বলল আইভান, ‘কী হতে পারে এটা ?’

কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে নিজের আঙ্গুল ভরে জিনিসটা টেনে বের করে দেখল সেটা একটা―নাক! বিস্ময়ে হতবাক আইভান ইয়াকভলেভিচের হাত দুটো শিথিল হয়ে পড়ল, বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে সে তার দু চোখ আচ্ছামতো রগড়ে নিয়ে জিনিসটাকে আবারও ভালো করে দেখল। হ্যাঁ তো, এটা একটা সত্যিকারের নাকই বটে! শুধু তাই না নাকটা তার পরিচিত কারও বলেই মনে হলো। ইয়াকভলেভিচের চোখে মুখে আতঙ্কিত ভাব ফুটে উঠল। নিজের শরীরে রীতিমতো থরহরি কম্প অনুভব করল সে। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা লক্ষ করে স্ত্রী প্রাসকোভিয়া যে নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখাল তার কাছে আইভানের আতঙ্ক নস্যিতুল্য।

‘ওরে জানোয়ার কার নাক কাটলি আবার ?’ রাগে লাল হয়ে চেঁচালো আইভানের স্ত্রী। নেশাখোর খচ্চর! মাতাল কোথাকার! দেখাচ্ছি মজা। এক্ষুনি গিয়ে পুলিশে খবর না দিই তো তোর একদিন, কি আমারই একদিন। মিচকে শয়তান! বহুদিন থেকে কিছু খদ্দেরের অভিযোগ কানে আসছে, চুল দাড়ি কামাতে গিয়ে তুই লোকজনের নাক ধরে এমন টানাটানি করিস যে তাদের পক্ষে চুপচাপ বসে থাকাই মুশকিল।

এদিকে আইভান ইয়াকভলেভিচের অবস্থা শোচনীয়, সে যেন তখন জীবন্মৃত। কারণ নাকটা যে মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য জনাব কোভালিয়েভের, তা বুঝতে বাকি নেই আর। প্রতি রবিবার ও বুধবার নিয়ম করে লোকটা তার কাছে দাড়ি কামায়। অগ্নিশর্মা স্ত্রীকে সামাল দিতে আইভান ইয়াকভলেভিচ বলে ওঠে, ‘দাঁড়াও, ময়না! একটা ন্যাকড়াতে মুড়িয়ে ওটাকে বরং কিছু সময়ের জন্য ওই কোণটাতে রাখি, পরে বাইরে কোথাও ফেলে আসব।’

‘ওসব চলবে না। কী ভেবেছিস, এই ঘরে দিব্যি একটা নাক পড়ে থাকবে আর আমি সেটা মেনে নেব ? কোনও ধানাই পানাইয়ের চেষ্টা করবি না বলে দিচ্ছি। জানিস তো শুধু চামড়ায় ক্ষুর ঘষাঘষি করতে। সে কাজটাও যদি ঠিকঠাক মতো করতে পারিস! তোর জন্য এখন একজন সম্মানী মানুষের ভোগান্তি। ছন্নছাড়া, আমড়াকাঠের ঢেঁকি একটা! কী ভেবেছিস, তোর এসব সৃষ্টিছাড়া কাজের সাফাই গাইবো আমি পুলিশের কাছে ? ওহ্ শখ কত হতভাগা মেনিমুখোর! এটাকে নিয়ে জাহান্নামে যাবি না কোথায় যাবি আমি জানিনা, কিন্তু এখনই সরিয়ে নিবি, আমার চৌহদ্দির মধ্যে যেন আর এটাকে দেখা না যায়।’

আইভান ইয়াকভলেভিচ পাথরের মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ পাতাল ভেবেও সে কোনও কূল কিনারা পেলো না। ‘এমন অদ্ভুতুড়ে একটা কাণ্ড কীভাবে ঘটলো কে জানে!’ ডান হাতটা তুলে কানের পেছনটা চুলকে শেষমেশ কথা বলে উঠল সে। ‘গতকাল রাতে মাতাল অবস্থায় ঘরে ফিরেছি কি না সেটাও তো ছাতার ঠিক মনে নেই। এদিকে সব দিক খতিয়ে পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব, আষাঢ়ে মনে হচ্ছে। রুটি গরম চুলায় সেঁকা একটা তৈরি জিনিস, আর নাকটা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। ঘটনার আগামাথা কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না বাপ।’

আইভান ইয়াকভলেভিচ চিন্তা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে একদম চুপ মেরে গেল। আইনবিরুদ্ধভাবে তার জিম্মায় একটা আস্ত নাক আছে, সে খোঁজটা পেলে পুলিশ নিশ্চয়ই জামাই আদর করবে না, বরং তাকেই অপরাধী ভেবে গ্রেফতার করা হবে। এমন ভাবনায় ইয়াকভলেভিচের মনের শান্তি উবে গেল। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো, ‘রুপালি জরির কারুকাজ করা গাঢ় লাল কলারের তলোয়ার…’ উরি বাবা! পুলিশি উপস্থিতির ভাবনা তার শরীরে তীব্র কাঁপন ধরালো। কালবিলম্ব না করে সে কাপড়-চোপড় পরে তৈরি হয়ে নিল, তারপর স্ত্রীর কঠোর নির্দেশ মানার উদ্দেশ্যে নাকটা একটা ন্যাকড়ায় মুড়িয়ে পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়ল। 

যে কোনও এক জায়গায়, হতে পারে সেটা কারও বাড়ির দরজা, পাবলিক স্কয়ার কিংবা চিপা কোনও গলিতে জিনিসটা ফেলে কোনও রকমে সরে পড়তে চেয়েছিল সে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হওয়ার মতো আইভান পরিচিত কারও না কারও মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছিল। স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে তারা তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, কী হে আইভান সক্কাল সক্কাল চললে কোথায় ? কিংবা এই সাত সকালেই বুঝি কারও ক্ষৌরকর্ম করতে চললে আইভান ? ইত্যাদি প্রশ্নে অতিষ্ঠ আইভান কিছুতেই জিনিসটা ফেলার সুযোগ পাচ্ছিল না। একবার তো কাজটা সে প্রায় করেই ফেলেছিল, কিন্তু পাহারায় থাকা কনস্টেবলটি তার হাতের লাঠি উঁচিয়ে তাকে ডেকে জানায়, ‘ও মশাই, বেখেয়ালে আপনার হাত থেকে কিছু একটা পড়ে গেছে।’ অগত্যা আইভান ইয়াকভলেভিচ বাধ্য হয়ে জিনিসটা আবার পকেটে পুরে নেয়।

গভীর এক হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। ইতোমধ্যে দোকানপাটের ঝাঁপ খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় লোক চলাচল বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত আইভান ইয়াকভলেভিচ আইজাক ব্রিজের ওদিকটা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, সেখান থেকে নেভা নদীর জলে জিনিসটা ছুঁড়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবার ব্যাপক সম্ভাবনা।

কিন্তু এটুকু লিখে পাঠকের কাছে একটা ত্রুটি স্বীকার করতে হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত স্বনামখ্যাত আইভান ইয়াকভলেভিচের বিস্তারিত পরিচয়টা দেওয়া হয়নি। এ বেলা বরং তার পরিচয় পর্বটি সেরে ফেলা যাক।

অধিকাংশ রুশ কারবারির মতো আইভান ইয়াকভলেভিচও ছিল একজন পাঁড় মাতাল। যদিও সে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের গালে নিষ্ঠার সঙ্গে ক্ষৌরকর্ম করত, কিন্তু তার নিজের গাল ছিল ক্ষুর বিবর্জিত। আইভান ইয়াকভলেভিচ কখনও লম্বা ঝুলের কোট গায়ে দিতো না। সে সচরাচর যে কোটটা গায়ে দিত এক সময় সেটার রং কালো হলেও অতি ব্যবহারে তাতে রঙের বেশ বৈচিত্র্য চলে এসেছে। কালো রংটা ক্ষয়ে গিয়ে কেমন বাদামি হলদেটে ভাব ধরছে, তবে কলারটা বেশ চকমকে, আর কোটের বোতাম তিনটে হারিয়ে যাওয়ায় শুধু সুতোগুলো প্যাকাটে মুখে ঝুলে আছে।

আইভান ইয়াকভলেভিচ ছিল ভয়ানক বাতিকগ্রস্থ মানুষ। মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়েভ তার রুটিন মাফিক দাড়ি কাটার সময় প্রায় বলতেন, ‘তোর হাতে সব সময় এ কিসের দুর্গন্ধ পাই রে ইয়াকভলেভিচ ?’

প্রশ্নের জবাবে আইভান উল্টো জানতে চাইতো, ‘দুর্গন্ধ আসবে কোত্থেকে মশাই ?’

‘তা জানি না বাপু, তবে গন্ধটা বেশ জোরালো, নিয়মিতই নাকে লাগে’ উত্তরে বলতেন কোভালিয়েভ। পরের কথাটুকু চুপচাপ শুনে তারপর এক চিমটি নস্যি টেনে নিয়ে কোভালিয়েভের গালে, নাকে, ঠোঁটের উপর, কানের পেছনে, যত্রতত্র ইচ্ছামাফিক বেশ খর হাতে সাবান ঘষে দিত।

জিনিসটা পকেটে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুশ সন্তান ইয়াকভলেভিচ একসময় আইজাক ব্রিজের কাছে পৌঁছে গেল। সেখানে পৌঁছে প্রথমে সে আশপাশে তাকিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল। তারপর ব্রিজের রেলিংটায় ঝুঁকে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়ালো যেন নদীতে মাছ কেমন সেটা দেখে নেওয়াই তার উদ্দেশ্য। এরপর চট করে খুব সাবধানে পকেট থেকে ন্যাকড়ায় জড়ানো নাকটা বের করে ছুড়ে দিল জলে। নাকটা ফেলে দেবার পর তার খুব হালকা বোধ হলো, যেন বুকে চেপে বসা কয়েক মণের বোঝাটা সরে গেল। এবার তার ঠোঁটে স্বস্তির হাসি ফুটল।

যদিও এ সময়ে তার সরকারি কর্মচারীদের দাড়ি কামানোর কথা, কিন্তু তার পরিবর্তে সে এককাপ চায়ে গলাটা ভিজিয়ে নেবার তাগিদে, ‘চায়ের দোকান’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলানো দালানটার দিকে হাঁটা দিল। এমন সময় ব্রিজের শেষ প্রান্তে গালজোড়া জুলফিওয়ালা, তিন কোনা টুপি মাথায়, কোমরে তালোয়ার ঝোলানো জবরদস্ত এক পুলিশ ইন্সেপেক্টরের দিকে তার চোখ পড়ল। আতঙ্কে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি টপাং করে আইভান ইয়াকভলেভিচের পাঁজর খুলে পালিয়ে বাঁচতে চাইলো। ভয়ে তার জ্ঞান হারাবার অবস্থা হলো যখন দেখতে পেলো পুলিশটি তার দিকেই আঙ্গুল ইশারায় ডেকে বলছে, ‘এদিকে আয় দেখি।’

ভয়ে কাঁটা হলেও বুকটান করে, কায়দামাফিক আইভান ইয়াকভলেভিচ পুরোদস্তুর ভদ্রলোকের মতোই ইন্সপেক্টরের উদ্দেশ্যে টুপি খুলে চটপট তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘হুজুরের শরীর মন ভালো তো!’

‘আমার মনের আলাপ পরে হবে, এখন বল দেখি ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে কী করা হচ্ছিল ?’

‘কিরে কেটে বলছি হুজুর, খদ্দেরের দাড়ি কামাতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল নদীটা কেমন কুলকুল করে বয়ে চলেছে, একটু থেমে সেটাই দেখছিলাম।’

‘এমন ডাহা মিথ্যা বলে পার পাবি না রে ব্যাটা, বরং সত্যিটা ভালোয় ভালোয় বলে ফেল দেখি।’

‘দয়া করেন হজুর, ভাতে মারবেন না। টুঁ শব্দটি না করে সপ্তাহে দু দিন এমন কি যদি বলেন তিন দিন আমি বিনে পয়সায় আপনার দাড়ি কামাতে রাজি আছি।’ মিনতি ঝরে পড়ল ইয়াকভলেভিচের গলা থেকে।

‘ওটি তো হবার নয় চান্দু! তিনজন নাপিত আমার ক্ষৌরকর্মে নিযুক্ত, আর তারা কাজটাকে তাদের জন্য দারুণ সম্মানের বলে মানে, আমিও তাদের কাজটা উপভোগের সুযোগ দিই। এখন ভালোয় ভালোয় বলে ফেল দেখি কী করছিলি ব্রিজের উপর ?’

আইভান ইয়াকভলেভিচের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু এই সম্পূর্ণ ঘটনাটি হুট করে যেন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়, যে কারণে তারপর কী ঘটেছিল আমাদের পক্ষে আর জানা সম্ভব হয়নি।

দুই

মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়ভের ঘুমটাও সেদিন (মার্চের ২৫ তারিখ) খুব সকালের দিকেই ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে অভ্যেসবশত তিনি বরাবরের মতো ঠোঁট নেড়ে বিচিত্র শব্দটা করলেন ‘ব্রবরর…’ যদিও তার ঠিক জানা নেই কেন এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডটা তিনি করেন। আড়মোড়া ভেঙে কোভালিয়ভ তার খানসামাটিকে টেবিলের উপর থেকে ছোট্ট আয়নাখানা দিতে বললেন। আগের দিন সন্ধ্যায় নাকের উপর উদয় হওয়া ব্রণটা পেকে কী অবস্থা হয়েছে একবার যাচাইয়ের ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে কোভালিয়ভ বিস্ময়ে থ বনে গেলেন। তিনি দেখলেন মুখের যেখানে নাক থাকবার কথা সে জায়গাটা এক্কেবারে লেপাপোছা―সমান! ব্যাপক ঘাবড়ে গিয়ে কিছুটা দিশাহীন অবস্থায় খানসামার কাছে জল চাইলেন কোভালিয়ভ। মুখে চোখে জল ছিটিয়ে, তারপর তোয়ালেতে বেশ করে চোখ দুটো রগড়ে আরেকবার নিজেকে পরখ করলেন; নাহ্ সত্যিই, তার মুখের উপর থেকে নাক উধাও! তিনি যে ঘুমিয়ে নেই সেটা পরীক্ষার জন্য জায়গাটিতে চিমটি কেটে দেখলেন। উফ! ব্যথা জানান দিল, নাহ্ তিনি মোটেও ঘুমোচ্ছেন না। এবার তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত, তার নাক সত্যিই লাপাত্তা হয়েছে। এমন কথা কস্মিনকালে শুনেছে কেউ! কোভালিয়ভ  লাফিয়ে বিছানা ছাড়লেন, মাটিতে দাঁড়িয়ে শরীরে তীব্র একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন, নাক গেছে তার সকল শূন্য করে! তাতে খুব কাজ হলো বলে মনে হয় না। কারণ তার কিছু পরেই তিনি ভদ্রস্থ হয়ে বিষয়টা ফয়সালা করতে পুলিশ সুপারের কাছে অস্থির হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন।

এখানে কাহিনি গড়ানোর এক ফাঁকে কোভালিয়ভ সম্পর্কে কিছু বলে নেওয়া প্রয়োজন, যাতে পাঠকের পক্ষে বুঝতে সুবিধা হয়  মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়ভ মশাই মানুষ হিসেবে ঠিক কেমন ধারার ছিলেন। যে সব মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য তাদের অধীত বিদ্যার সার্টিফিকেট ও ডিগ্রির জোরে এই পদবির  অধিকারী হন, তাদের সঙ্গে ককেশাস অঞ্চলের নিযুক্তদের তুলনা টানা মোটেও উচিত হবে না। এই দুটি গোত্র একেবারেই বিপরীতমুখী। এ সকল সদস্য সবাই বিশিষ্ট বিদ্বান… কিন্তু রাশিয়া এমন বিচিত্র এক দেশ যে এখানে কোনও সরকারি কমিটির সদস্যদের নিয়ে কিছু বলেই দেখুন না মশাই! অমনি রিগা থেকে কামচাটকা পর্যন্ত সব মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য একাট্টা হয়ে বিষয়টাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ভেবে নেবেন। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।

কোভালিয়ভ মাত্র দু বছরের জন্য ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য’ ছিলেন। কিন্তু সেটা তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকতে পারেন না। শুধু তাই না, ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য’ পদবি ছাড়াও তিনি নিজেকে ‘মেজর’ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি তৃপ্তি বোধ করেন। (রাশিয়ান সরকারি পদবির ক্ষেত্রে ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য’ এবং মিলিটারির ‘মেজর’ পদটি সমপর্যায়ের)। পথে ফেরিওয়ালি কোনও বয়স্ক মহিলার সঙ্গে দেখা হলে গায়ে পড়ে প্রায়শ বলতেন, ‘শোনো হে, বাড়িতে চলে এসো, চিনতে কোনও সমস্যাই হবে না। সাদোভায়া স্ট্রিটে আমার বাড়ি, যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে মেজর কোভালিয়ভ কোথায় থাকেন। এমন কি ছোট্ট শিশুটিও জানে আমার বাড়ি কোনটা।’

আবার যখন ফ্যাশনসচেতন কোনও তরুণীর সঙ্গে দেখা হতো তখন অনুরক্ত গলায় বলতে দ্বিধা করতেন না, ‘সুন্দরী, শুধু জিজ্ঞেস করবে মেজর কোভালিয়ভের ফ্ল্যাটটা কোথায়।’

নিজেকে মেজর হিসেবে ভাবতে পছন্দ করা মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়েভকে এখন থেকে তাই  আমরাও গল্পে মেজর বলে উল্লেখ করব।

স্বাস্থ্যসচেতন মেজর কোভালিয়েভ নিয়মিত নেভস্কি অ্যাভিনিউয়ে হাঁটতে বের হতেন। সে সময় তার পরনে থাকতো কড়া করে মাড় দেওয়া ঝকঝকে পরিষ্কার কলারের পোশাক। তার ছিল নিদারুণ এক জুলফির বাহার, যে জুলফি প্রাদেশিক জরিপকারী, স্থপতি, সেনাবাহিনীর চিকিৎসক এবং গোলগাল লালমুখো উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, যারা খুব ভালো তাস খেলতে পারে (বোস্টন তাস জাতীয় খেলা) তাদের সবার মধ্যে এখনও দেখা যায়। সেই জুলফি তাদের রক্তিম গণ্ডদেশের প্রান্তর পেরিয়ে সোজা নাক বরাবর চলে যেত। মেজর কোভালিয়েভ সব সময় বুকে অনেকগুলো সিল ঝোলাতেন। সেগুলোর কিছুতে নানা প্রতীকচিহ্ন খোদাই করা, আবার কয়েকটির উপর ‘বুধবার’ ‘বৃহস্পতিবার’, ‘সোমবার’  ইত্যাদি খোদাই সম্বলিত। সেন্ট পিটার্সবার্গে আসার পেছনে মেজর কোভালিয়েভের বিশেষ একটা মতলব ছিল। খোলাসা করে বলতে গেলে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে বসবাস করতে এসেছিলেন কারণ তিনি তার নতুন উপাধির উপযুক্ত একটি চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলেন। তাতে সফল হলে তার প্রাপ্ত পদটি হবে প্রাদেশিক ভাইস গভর্নরের সমপর্যায়ের। সেখানে যদি ভাগ্যের শিকে না ছিঁড়ে তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিভাগের প্রশাসনিক পদে বহাল হবার ইচ্ছা। কোভালিয়েভ বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন না মোটেও। এক্ষেত্রে তার কেবল চাওয়া ছিল হবু বউয়ের যেন কমপক্ষে লাখ তিনেক পুঁজি থাকে। সুতরাং এরকম একটা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ছককাটা বৃত্তে থেকে মেজর যখন তার অদ্ভুত বাহারি নাকের জায়গাটা একেবারে লেপাপোছা দেখতে পেলেন তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয়েছিল, পাঠকের পক্ষে সেটা সহজেই অনুমেয়।

এমন দুর্ভাগ্য যে সারা রাস্তায় একটা গাড়ির দেখা পাওয়া গেল না, অগত্যা হাঁটতে হবে মনস্থির করেন কোভালিয়েভ। পরনের পোশাকের উপরে ঢিলেঢালা একটা জোব্বা চাপিয়েছেন তিনি, যেন নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে সেরকম ভঙ্গিতে একটা রুমালে বেশ কায়দা করে মুখটা ঢেকে হাঁটতে শুরু করেন মেজর। হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, ‘হয়তো এটা নিছকই কল্পনা ? জ্বলজ্যান্ত একটা নাক বেমক্কা উবে যাবে, এটা হতে পারে নাকি!’ নাকটা দিব্যি মুখের উপর বহাল তবিয়তে আছে; এমন একটা ভাবনায় নিজের মুখটা একবার আয়নায় দেখে নেবার ভীষণ এক তাগিদে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনের রেস্তোরাঁটার দিকে হাঁটা দিলেন। সৌভাগ্যবশত সে সময় রোস্তরাঁয় কোনও খদ্দেরের ভিড় ছিল না। শুধু দোকানের কিছু কর্মচারী ঘর পরিষ্কার আর টেবিল চেয়ারগুলো সাজানোর কাজে ব্যস্ত ছিল। ওদিকটায় গুটিকয়েক কর্মচারী ঘুম ঘুম চোখে ট্রেতে নাস্তা, পেস্ট্রি সাজিয়ে রাখছিল। অবিন্যস্ত টেবিল চেয়ারের উপর তখনও গত রাতের পরিত্যক্ত কফির দাগমাখা খবরের কাগজ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। ‘দারুণস্য দারুণ ব্যাপার, রেস্তোরাঁ এখন ফাঁকা’, খানিকটা গদগদ ভাবে স্বগতোক্তি করলেন কোভালিয়েভ, ‘এই সুযোগে আরেকবার আয়নাতে মুখটা দেখে নেওয়া যাবে।’ দুরুদুরু বুকে আয়নার সামনে গিয়ে উঁকি দিলেন। পোড়া কপাল আমার! আয়না থেকে ঝটতি মুখ সরিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলেন তিনি।

‘কোন পাপে এই দুর্গতি! আর এই জঘন্য অবস্থার মানেটাই বা কী!’ বিড়বিড় করলেন তিনি। ‘নাকটার জায়গায় কিছু একটা তো থাকতে পারতো, তা না,..একদম লেপাপোছা!’

কোভালিয়েভ বিরক্তির সঙ্গে ঠোঁট কামড়ে দ্রুত রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলেন। নিজেকে তিনি পইপই করে বোঝালেন, আজ আর স্বভাব মতো কারও দিকেই মুখ তুলে তাকাবেন না, সেরকম কাউকে দেখে হাত কচলে হাসতেও যাবেন না।

চলতি পথে হঠাৎই তাকে সুবিশাল এক বাড়ির সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো; কেননা তিনি তার চোখের সামনে এমন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে যেতে দেখলেন যার সহজ ব্যাখ্যা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি দেখলেন সেই বাড়িটার সামনে একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির দরজা খুলে মাথাটা একটু কাত করে লাফিয়ে নামলেন ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোক। ভদ্রলোকটি দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। লোকটিকে দেখে কোভালিয়েভের মধ্যে বিস্ময় আর আতঙ্কের মিশ্র একটা অনুভূতি খেলে গেল। কারণ লোকটির মুখের উপর বসে থাকা নাকটি তার বড্ড চেনা, ওটা যে তার নিজেরই নাক! এমন অভাবনীয় ব্যাপার দেখে কোভালিয়েভের চোখের সামনে দৃশ্যমান সবকিছুই কেমন ঘুরতে লাগল, তার মনে হলো যে কোনও মুহূর্তে তিনি বুঝি মাথা ঘুরে পপাত ধরণীতল হবেন।

কিন্তু শারীরিক অস্বস্তির তোয়াক্কা না করে, বুক ঠুকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যতক্ষণ না তার নাক আবার গাড়িতে ফিরে আসে, ততক্ষণ তিনি সেখানেই অপেক্ষায় থাকবেন। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় তার গোটা শরীর তখন জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁপতে শুরু করেছে। মিনিট দুই পরে সত্যিই নাক গাড়িতে ফিরে এলেন।  ভদ্রলোকের পরনে জরির কাজ করা, উঁচু কলারের ইউনিফর্মটা বেশ চটকদার, হরিণের নরম চামড়ার তৈরি প্যান্ট, কোমরে ঝুলন্ত তলোয়ার। মাথায় থাকা পালকওয়ালা টুপি দেখে বলে দেওয়া যায় ইনি একজন স্টেট কাউন্সিলর। তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল কারও সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে তিনি কোথাও রওনা দিচ্ছেন। আশপাশটা দেখে নিয়ে তিনি কোচোয়ানের উদ্দেশে হাঁক দিলেন, ‘জলদি গাড়ি ছাড়ো!’ বলেই তিনি তাতে উঠে বসলেন এবং গাড়ি চলতে শুরু করল।

বেচারা কোভালিয়েভের তখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা। এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছিল না। গতকাল পর্যন্ত যে নাক তার মুখের উপর বহাল তবিয়তে জাঁকিয়ে বসেছিল, যার পক্ষে গাড়িতে চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরেফিরে বেড়ানো কোনওভাবেই সম্ভব না, সে কীভাবে ইউনিফর্মে সাজতে পারে!  ভাবতে ভাবতে কোভালিয়েভ ছুটলেন গাড়ির পিছু ধাওয়া করতে, কপাল ভালো খুব বেশিদূর যায়নি গাড়িটা তখনও, নেভস্কি অ্যাভিনিউয়ের উপর বিশাল দালানের যে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা তার সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছে।

কোভালিয়েভ খুব তাড়াহুড়া করে দালানের সামনে অপেক্ষমাণ সরু চোখের কুৎসিত চেহারার ভিখিরি বুড়িগুলো, যাদের দেখলে তার খুব বিরক্ত লাগে―তাদের ভিড় ঠেলে দালানের ভেতরে ঢুকে পড়লেন। সেখানে গুটিকয় খদ্দের ছিল মাত্র, কিন্তু কোভালিয়েভ এতই মর্মাহত ছিলেন যে প্রথম কয়েক মুহূর্ত তিনি কীভাবে লোকটার খোঁজ করবেন সেটা মনস্থির করতে পারছিলেন না। অবশেষে কোভালিয়েভ লোকটিকে একটা কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন, ইউনিফর্মের উঁচু কলারের আড়ালে মুখের পুরোটাই ঢাকা পড়েছে, সে অবস্থায় ভদ্রলোক খুব মনোযোগ দিয়ে দোকানের পণ্যসামগ্রী দেখায় ব্যস্ত।

‘কী করে ওর কাছে যাওয়া যায় ?’ কোভালিয়েভ ভাবলেন। ‘ইউনিফর্মের বাহার, টুপি এসব কিছু দেখেশুনে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এই লোক বিরাট তালেবর। ছাতার মাথা! কোনও বুদ্ধিও মাথায় আসছে না। এ সময়ে কী করণীয় সেটা একমাত্র মুখপোড়া শয়তানের পক্ষেই জানা সম্ভব।’

কোভালিয়েভ তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য খানিকটা কাছাকাছি গিয়ে কাশতে শুরু করেন, কিন্তু তাতে এক মুহূর্তের জন্যও নাক মহাশয়ের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির কোনও পরিবর্তন ঘটলো না।

‘জনাব…’ অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে গলায় স্বর ফোটালেন কোভালিয়েভ, ‘শুনছেন জনাব, আমি মানে ইয়ে…’

‘কী চাই আপনার ?’ ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন নাক।

‘কঠিন অবস্থায় পড়ে গেছি জনাব। আমি মনে করি… আমি মনে করি যে…নিজের জায়গাতেই আপনার থাকা উচিত, সেটাই উপযুক্ত হতো আমার মতে। হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি শেষে হঠাৎ আপনার দেখা পাওয়া গেল, কোথায় ? প্রশ্নটা বরং নিজেকেই করুন…’

‘ক্ষমা করবেন, আপনি কীসব বলছেন তার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বলার স্পষ্ট করে বলুন।’

‘আমার অবস্থাটা কী করে বুঝিয়ে বলি…’ স্বগতোক্তি করলেন কোভালিয়েভ, তারপর আবার সাহস সঞ্চয় করে বলতে শুরু করলেন, ‘দেখুন ইয়ে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি মানে…আমি একজন সম্মানিত মেজর। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নাক ছাড়া চলাফেরা করা কেমন একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। অবশ্য ভজক্রেসেনস্কি ব্রিজের উপর বসে থাকা ফেরিওয়ালারা হয়তো নাক ছাড়াও বেচাকেনা করতে পারে, কিন্তু আমার পক্ষে কি তা সম্ভব ? কদিন পরই আমি আরও উচ্চপদ অধিকার করতে যাচ্ছি,… তাছাড়া শহরের অনেক সম্মানিত মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয়, যেমন সরকারি উপদেষ্টা চেখতারিওভের স্ত্রী প্রমুখ আরও অনেকের সঙ্গে পরিচিতি থাকায়….আপনি নিজেই ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখুন না বরং…আমার আর কী বলার আছে জানিনা জনাব….’ কথাগুলো বলে মেজর কোভালিয়েভ অসহায় একটা ভঙ্গি করে কাঁধ ঝাঁকালেন। ‘ক্ষমা করবেন, আপনি নিজেই  এ ধরনের আচরণকে দায়িত্ব ও সম্মানের বিধি অনুসারে বিবেচনা করবেন কি না তা আমি জানি না, তবে কমপক্ষে আপনি এটা বুঝতে পারবেন—’

‘আপনার কথার এক বর্ণও বুঝিনি আমি।’  নীরবতা ভেঙে নাক মহাশয় বলে উঠলেন। ‘বুঝতে পারি সেরকম সহজ করে বলুন।’

‘বলছি ভায়া’ কণ্ঠস্বরে বেশ খানিক গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললেন কোভালিয়েভ, ‘যে জিনিসটি হারিয়েছে বলে বোঝাতে চাইছি সেটি আসলে আমার। অন্তত প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটা আপনার বোঝা উচিত, যদি জিনিসটি আপনি জোর করে রেখে দিতে না চান।’

নাক মহাশয় একটু ভ্রƒকুটি করে মেজরের দিকে তাকালেন। তারপর উত্তর দিলেন,

‘আপনি ভুল করছেন ভায়া। আমি আমিই―নিজের কর্মদক্ষতায় আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাছাড়া আমাদের মধ্যে এমন কোনও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে বলেও তো জানা নেই, যার সূত্রে এমন আলটপকা মশকরা শুরু করবেন! আপনার ইউনিফর্মের বোতামগুলো বলছে আপনি কোনওভাবেই আমার দপ্তরের নন, অন্য দপ্তরে কাজ করেন।’

এই বলে নাক মশাই মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন।

কোভালিয়েভ মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী করণীয়, কিছুই তার ভাবনাতে আসছিল না। ঠিক সে মুহূর্তে কোভালিয়েভ কোনও মহিলার কাপড়ের মৃদু খসখস আওয়াজ শুনতে পেলেন, শব্দের উৎস এক সুবেশি বর্ষীয়ান ভদ্রমহিলা তার দিকে এগিয়ে এলেন, তাঁর পরনে কারুকার্যময় লেসের পোশাক, তাঁর সঙ্গে আছে এক ছিপছিপে গড়নের তরুণী যার পরনে সাদা ফ্রক এবং মাথার উপর চমৎকারভাবে শোভা ছড়াচ্ছে একখানা খড়ের টুপি। তাদের পেছনে এক ডজন কলার আঁটা পোশাক পরিহিত, ইয়া জুলফিধারী সুবেশি দীর্ঘকায় এক ভৃত্য এসে দাঁড়ালো এবং হাতের নস্যিদানিটা খুলে ধরলো।

কোভালিয়েভ নিজের জায়গা ছেড়ে খানিকটা এগিয়ে গেলেন, শার্টের কলারটা টেনে বের করে ঘড়ির সোনার চেনটার সঙ্গে ঝুলতে থাকা সিলগুলো ঠিকঠাক করে নিয়ে বিগলিত হাসি ছড়িয়ে বর্ষীয়ানের সঙ্গে থাকা তরুণীটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিলেন, যে তখন বসন্তের সদ্য ফোঁটা ফুলটির মতো দুলছিল এবং তার চম্পাকলির মতো আকর্ষণীয় হাতের আঙ্গুল তুলে বারংবার নিজের ভ্রƒর কাছে নিয়ে নাচাচ্ছিল। কোভালিয়েভ যখন তরুণীর টুপির আড়াল থেকে তার  সুডৌল, উজ্জ্বল, সুন্দর ছোট্ট চিবুক আর ফুটে থাকা গোলাপের মতো গালের একাংশ দেখতে পেলেন তখন তার হাসি এ কান ও কান ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আচমকা কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি কেমন কুঁকড়ে গেলেন। তার মনে পড়ে গেল যে মুখের উপর তার নাকটি নেই, জায়গাটা একদম লেপাপোছা। বাড়া ভাতে কেউ বুঝি অদৃশ্য হাতে ছাই ছড়ালো। কোভালিয়েভ খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন, তার চোখে পানি এসে গেল।

তিনি যখন গোলাপি গালের শুভ্র তরুণীর দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন সেই অবকাশে নাক মহাশয় কোথাও উধাও হয়ে গেছেন। সম্ভবত অন্য কোনও কাজে কিংবা কারও সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছায় সেখান থেকে সটকে পড়েছেন।

আশেপাশে নাক মশাইয়ের চিহ্ন না দেখে কোভালিয়েভ ভীষণভাবে মুষড়ে পড়লেন। তিনি দ্রুত বড় দালানটায় ফিরে গিয়ে বারান্দার সারিবদ্ধ থামের আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন, এবং আরেকবার নাকের  দেখা পাওয়ার আশায় চারপাশে তীক্ষè নজর বোলাতে লাগলেন। নাকের পালকওয়ালা টুপি আর সোনালি জরির কাজ করা ইউনিফর্মের কথা কোভালিয়েভ দিব্যি মনে করতে পারলেও তার ওভারকোট, ঘোড়া বা গাড়ির রং, কোনওটাই খেয়াল করে না দেখায় সেসবের কিছুই মনে করতে পারলেন না। এমনকি গাড়ির পেছনের সিটে আরও কোনও আরোহী ছিল কি না, তাদের পরনের পোশাকই বা কেমন ছিল, সেসব এখন মনে করাটাও ঝকমারি। তাছাড়া অসংখ্য গাড়ি রাস্তার উপর আসা-যাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, আর সেগুলোর গতি এত দ্রুত ছিল যে আলাদা করে কাঙ্খিত গাড়িটা চিনে নেওয়াও ছিল দুঃসাধ্য; অবশ্য অত গাড়ির ভেতর থেকে আলাদা করে চেনা গেলেই বা কী আসতো যেত―তিনি তো আর গাড়িটা থামাতে পারতেন না।

চমৎকার রোদ ঝলমলে ছিল দিনটা। নেভস্কি অ্যাভিনিউ দিয়ে অসংখ্য মানুষের ঢল নেমেছে। নানা বয়সী নারীরা ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পুলিশের সদর দপ্তর থেকে মানুষের বর্ণিল স্রোত শুরু হয়ে অ্যানিচকভ ব্রিজ পর্যন্ত ফুটপাথ বরাবর বয়ে চলেছে। অগণিত মানুষের ভিড়ে কোভালিয়েভ তার পরিচিত উচ্চ আদালতের এক উপদেষ্টাকে দেখতে পান, যাকে তিনি অন্যদের সামনে সচরাচর লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলে সম্বোধন করে থাকেন।  সংসদের প্রধান মুহুরি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়ারাইজকিন যে কিনা বোস্টন খেলায় (তাসজাতীয় খেলা) আটের বাজিতে প্রায়শ হেরে যায়, তার মুখটাও ভেসে উঠতে দেখেন এক ঝলক। তার পরে দেখলেন ভিড় ঠেলে আঙুলের ইশারায় কোভালিয়েভকে কাছে ডাকছে তারই মতো ককেশাসের ‘মেজর’ পরিচয় দিতে ইচ্ছুক পরিচিত একজন।

‘দূরে গিয়া মর!’ নিজের মনে বিড়বিড় করেন কোভালিয়েভ। ‘ওহে গাড়োয়ান, আমাকে সোজা পুলিশ কমিশনারের কাছে নিয়ে চলো দেখি। বলতে বলতে একটা ছ্যাকরা গাড়িতে চেপে বসে চালকের উদ্দেশ্যে বলেন, “জোরসে ছুটো।” চালক তার পছন্দসই পথে রওনার উদ্যোগ নিতেই তিনি বলে ওঠেন, ‘ও পথে না বাপু, তুমি বরং আইভানভস্কাইয়া স্ট্রিট দিয়ে চলো।’

‘পুলিশ কমিশনার কি ভেতরে আছেন ?’ দোরগোড়া পেরোতে পেরোতে তিনি জানতে চাইলেন।

‘নাহ্, তিনি তো নেই।’ দারোয়ান জবাব দিল। ‘মাত্রই বেরিয়ে গেলেন।’

‘আহ্! ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম।’

‘হ্যাঁ তাই’ দারোয়ানটা যোগ করল, ‘এই কিছুক্ষণ আগেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। আর মিনিট কয়েক আগে যদি আসতেন, তবে তাঁকে বাড়িতেই পেয়ে যেতেন।’

তখনও কোভালিয়েভ মুখের উপর রুমালটা ধরে রেখেছিলেন, সেভাবেই তিনি অপেক্ষারত গাড়িতে ওঠে রুষ্ট গলায় চেঁচালেন, ‘চালাও।’

‘কোন দিকে ?’ গাড়িচালক জানতে চাইলো।

‘আরে ধ্যাৎ! নাক বরাবর চলো বাপু।’

‘সোজা যাবো ? কিন্তু সেটা তো সম্ভব না জনাব, কিছুদূর গিয়ে রাস্তা ডান আর বাম দুটো দিকে মোড় নিয়েছে, কোনদিকে যাবো ঠিক করে বলুন ?’

ছ্যাকরা গাড়ি চালকের এমন প্রশ্নে থমকে গেলেন যেন কোভালিয়েভ, খানিক কী যেন ভাবলেন  তিনি। তার এখন যা অবস্থা, তাতে বুদ্ধিমানের কাজ হবে যদি তিনি সরাসরি আইন শৃঙ্খলা বিভাগে গিয়ে একটা আর্জি পেশ করেন, যদিও এ বিভাগের সঙ্গে পুলিশ বিভাগের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই, তবু ওদিক থেকে একটা চাপ এলে তাতে পুলিশের হুকুম অন্যান্য দপ্তরের তুলনায় দ্রুত কার্যকরী হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। সরাসরি নাকের দপ্তরে গিয়ে নালিশ জানানোও বোকামির কাজ হবে, কেননা লোকটার কথাবার্তায় এটা তো স্পষ্ট, যে সে একদমই ন্যায়নীতির ধার ধারে না। আর এ ক্ষেত্রে সে মিথ্যেও বলতে পারে, যেমন আগেও বলেছে সপাটে, সেই মুখোমুখি সাক্ষাতের সময় যেমন বলল, তার সঙ্গে নাকি কোভালিয়েভের কস্মিনকালেও দেখা হয়নি! ভেবেচিন্তে কোভালিয়েভ আইন শৃঙ্খলা দপ্তরের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্তই নিলেন। সেদিকেই গাড়ি চালানোর হুকুম দেবার আগের মুহূর্তে তার মনে দুম করে আরেকটা চিন্তা খেলে গেল, নাক বাটপার প্রথম আলাপের সময় তার সঙ্গে যেরকম নির্লজ্জ অভব্য আচরণ করেছে, দাগাবাজটার পক্ষে হয়তো কিছুই অসম্ভব নয়। যদি সে ক্ষমতা আর সময়ের সুযোগ নিয়ে শহর ছেড়ে পগারপার হয়ে যায়, তাহলে তো অনুসন্ধানের সমস্ত তোড়জোড়ই বিফল হবে। ভাগ্য সহায়  না হলে ভোগান্তিটা পুরো একমাস ব্যাপী চলবে হয়তো।

শেষমেষ মেজর কোভালিয়েভ তার দূরদর্শিতার প্রয়োগ ঘটিয়ে ঠিক করলেন তিনি এখন সরাসরি পত্রিকা অফিসে যাবেন এবং নাক বাটপারটার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন  প্রকাশ করবেন। যাতে যে কেউ পলাতকটাকে দেখা মাত্র শনাক্ত করে তার কাছে হাজির করতে পারে, কিংবা অন্তত তার একটা হদিশ দিতে সক্ষম হয়।

সুতরাং সরাসরি পত্রিকা অফিসে যাওয়ার জন্য ছ্যাকরা চালককে হুকুম দিলেন কোভালিয়েভ, কিন্তু গোটা পথ জুড়ে বন্য এক অস্থিরতায় তিনি চালকের পিঠে ক্রমাগত আঘাত করতে করতে বলতেই থাকলেন, ‘জলদি চালা নচ্ছার! আরও জোড়ে চালা খচ্চর কোথাকার!’ তার খোঁচানির যন্ত্রণায় ত্যক্ত বেচারা চালক মাঝে মধ্যে ‘জি হুজুর’ বলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোড়ার লাগামটা ধরে এমনভাবে দাবড়ানি দিতে থাকলো যেন সে একটা শিকারি কুকুর।

ছ্যাকরা গাড়ি পত্রিকা অফিসের সামনে থামা মাত্রই কোভালিয়েভ নেমেই রুদ্ধশ্বাসে ছুটে স্বল্পায়তনের একটা অভ্যর্থনা কক্ষে প্রবেশ করেন। সেখানে পাকা চুলের এক কেরানি, অতি ব্যবহারে জীর্ণ একটা কোট গায়ে, নাকের উপর চশমা এঁটে, দুই ঠোঁটের ভাঁজে কলমটা ধরে তার সামনে রাখা গাদাগুচ্ছের পয়সা গোনায় ব্যস্ত ছিল।

‘এখানে বিজ্ঞাপনের দায়িত্বে কে আছেন ?’ ঢুকেই প্রায় চিৎকার করলেন মেজর। ‘এই যে ভাই শুনছেন ?’

‘জি ভায়া, আপনার জন্য কী করতে পারি ?’ পক্ককেশি কেরানিটা চোখ তুলে আগতকে সম্ভাষণ জানানোর পরমুহূর্তে আবার চোখ নামিয়ে ছড়ানো পয়সার গাদায় মন দেয়।

‘আমি একটা বিজ্ঞাপন ছাপাতে চাই―’

‘একটু অপেক্ষা করেন মশাই’, একহাতে কাগজের উপর কিছু সংখ্যা লিখতে লিখতে অন্য হাতে গণনাহিসাব যন্ত্রের দুটো ঘর সরাতে সরাতে বলল পক্ককেশি।

টেবিলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা, লেসের পোশাক পরনে ভৃত্যগোছের একজন, যার চেহারা আর হাবেভাবে এটা স্পষ্ট সে কোনও অভিজাত বাড়িতে কাজ করে; লোকটার হাতে ধরা একটা কাগজ, সম্ভবত কোনও বিজ্ঞাপনই হবে। সে বেশ প্রাণবন্ত গলায় আলাপ জুড়েছে পক্ককেশি কেরানিটার সঙ্গে, বিশ্বাস করেন ভাই, ওই হতচ্ছাড়া কুকুরটার দাম আট আনাও হবে না এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমি হলে পঞ্চাশ টাকার বেশি একটা পয়সা দিতাম না। কিন্তু বেগম সাহেবা যে ওটাকে ভালোবাসেন, সত্যিই খুব ভালোবাসেন। সেজন্যই তো যে ওটার খোঁজ দিতে পারবে, পুরস্কার হিসেবে তাকে পাঁচশ টাকা দেওয়া হবে। ভদ্রতার খাতিরে যদি বলতে হয়, এই যেমন এখন আপনার আমার মধ্যে কথা হচ্ছে; তাহলে বলবো, আজকাল মানুষের রুচি বোঝা দায়! শিকারি কুকুরের কথাই ধরেন, যেসব সৌখিন লোক তাদের পোষে, তাদের পেছনে পাঁচশো কেন, হাজার টাকাও খরচ করতে রাজি আছে যদি কুকুরটা সেরকম চালাক চতুর হয়। 

কেরানি মশাই যথেষ্ট গাম্ভীর্য নিয়ে ছোকরা কাজের লোকটার কথা শুনছিলেন আর তার বয়ে আনা কাগজে কতগুলো শব্দ আছে তা গুনে যাচ্ছিলেন। তার দু পাশে বহুসংখ্যক অপেক্ষমাণ বাড়ির ঠিকা ঝি, দোকানকর্মী আর পাহারাদার এবং আরও অন্যরা বিজ্ঞাপনের কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল।

সবার হাতে যেসব বিজ্ঞাপন ধরা ছিল, তার কোনওটাতে ভালো স্বভাব-চরিত্রের কোচম্যান নিয়োগ ইচ্ছুক প্রার্থী, কোনওটায় আবার লেখা ছিল ১৮১৪ সালে প্যারিস থেকে আমদানিকৃত অল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করা গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন, আরেকটিতে ধোপার কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উনিশ বছরের বুয়ার কাজে নিয়োগ পেতে ইচ্ছুক, যে  ঘরের অন্যান্য কাজেও পারদর্শী।

এছাড়া বিজ্ঞাপন হিসেবে আরও ছিল, স্প্রিংহীন টেকসই ছ্যাকরা গাড়ি, ধুসর রঙের সতেরো বছরের তেজস্বী এক ঘোড়া, লন্ডন থেকে আনা শালগম আর মূলার বীজ, দুটো আস্তাবল আর একই সঙ্গে চমৎকার বার্চ বা ফারগাছের বাগানের উপযোগী অনেকটা জমিসহ সমস্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বাগানবাড়ি, ইত্যাদির বিজ্ঞাপন, তার মধ্যে আবার একটা ছিল, পুরোনো জুতা ক্রয়েচ্ছুকদের প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে তিনটা পর্যন্ত দৈনিক নিলাম-বিক্রির ঘরে উপস্থিতির আমন্ত্রণ জানিয়ে বিজ্ঞাপন। যে ঘরটাতে বিজ্ঞাপনসমেত এত কিসিমের মানুষ জড়ো হয়েছিল, সেটা আয়তনে ছিল বেশ ছোট, ঘরে বাতাস চলাচলও ছিল সীমিত, স্বভাবতই পরিবেশটা ছিল গুমোট, কিন্তু মেজর কোভালিয়েভের নাক না থাকায় কোনও গুমোট গন্ধ তার পক্ষে টের পাওয়া  সম্ভব ছিল না, আর তাছাড়া সঙ্গত কারণেই তিনি নাকের উপর রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। নাকের কথা মনে পড়ে গেল তার; হায় তার লাপাত্তা নাকটা এখন কোথায় আছে, একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন তার বর্তমান হদিশ।

‘একটু শোনেন ভাই,’ অবশেষে অধৈর্য কোভালিয়েভ মুখ খুললেন, ‘আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হোক, ব্যাপারটা জরুরি।’

‘একটু পরে, একটু পরে! ওহে তোমার এত টাকা, আর তোমার হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি, তোমার এত টাকা এত পয়সা’ বলতে বলতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক ঠিকা ঝি আর দারোয়ানদের মুখের ওপর বিজ্ঞাপনের কাগজগুলো ছুড়ে দিতে দিতে পক্ককেশি কেরানিটা কোভালিয়েভের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।

‘আচ্ছা বেশ’ লম্বা একটা শ্বাস টেনে কেরানিটা বলল, ‘আপনার কী চাই মশাই ?’

‘ভীষণ একটা প্রতারণা আর জালিয়াতির ঘটনা ঘটে গেছে ভায়া, যা আমি নিজেই এখনও ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারছি না। তবে আপনার কাছে আমার এটুকুই আর্জি আপনি শুধু বিজ্ঞাপনে ছাপিয়ে দিন যে ওই জোচ্চোরটাকে কেউ ধরে আনতে পারলে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।’ উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলে থামলেন কোভালিয়েভ।

‘আপনার নামধাম জানতে পারি ?’ নির্লিপ্ত পক্ককেশি বলল।

‘না না নামটাম দিয়ে কী হবে ? কী মুশকিলের কথা। এই শহরে অনেক মান্যগণ্য ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার ওঠাবসা আছে, সবাই আমাকে এক নামে চেনে, স্টেট কাউন্সেলরের স্ত্রী ম্যাডাম চেখতারিয়েভা থেকে স্টাফ অফিসারের স্ত্রী পালেগইয়া গ্রিগরিয়েভনা পদেতোচিনা পর্যন্ত সবাই আমার ঘনিষ্ঠ। পত্রিকায় দেখামাত্র তারা আমাকে চিনে ফেলবে, তারপর কেলেংকারীর সীমা থাকবে না। তার চেয়ে আপনি লিখে দেন “কোনও এক সরকারি কর্মকর্তা” কিংবা “জনৈক মেজর”। শেষেরটাই আমার পছন্দ।’

‘যে লাপাত্তা হয়েছে সে কি আপনার বাড়ির চাকরবাকর  ?’

‘আরে বলে কী! না, না, আমার চাকরবাকর কেউ না, সেরকম কেউ হলে তো ব্যাপারটা নিয়ে এত ঝামেলার কিছু ছিল না। আসলে আমার কাছ থেকে পালিয়েছে…আমার মানে ইয়ে… আমার “নাসিকা”।’

‘বড়ই বিচিত্র নাম দেখছি! তার মানে এই নাসিকা নামধারী আপনার বিপুল অর্থ বগলদাবা করে পালিয়েছে, তাই তো ?’

‘কী মুসিবত! আপনি যা ভাবছেন ব্যাপার আদৌ তা নয়। নাসিকা মানে বোঝাতে চাইছি…আমার এক্কেবারে নিজের নাক রে বাবা… আমার নাক, নাক দ্য নোজ! সেটা বেমক্কা উবে গিয়ে আমাকে ঘোল খাওয়াচ্ছে, কোথায় গেছে জানি না। এক্কেবারে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা!’

‘কিন্তু কীভাবে সেটা হাওয়া হয়ে গেল ? ব্যাপারটায় কোথাও একটা ভজঘট আছে যেটা আমি ঠিক মতো ঠাওর করতে পারছি না বাপু।’

‘পুরো বিষয়টা ভেঙে যে আপনাকে বলবো, সেটাও পারছি না। তবে আসল কথা হলো যে, সে এখন এই শহরেই এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নিজেকে দিব্যি স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে জাহির করছে। সেজন্যই আপনাকে বিশেষ অনুরোধ করছি, অতি সত্বর এই লিখে একখানা বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিন যে, তাকে দেখামাত্র পাকড়াও করে যেন আমার জিনিস আমার কাছে সটান নিয়ে আসা হয়।’

‘আপনিই বিবেচনা করে বলেন না মশাই, শরীরের এমন একটা দৃষ্টিগোচর এবং অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ ছাড়া আমার পক্ষে কীভাবে চলা সম্ভব ? এটা তো আর পায়ের কড়ে আঙ্গুলটি নয়, যে সেটা খোয়া গেলেও তেমন যায় আসে না, বুট জুতার ভেতর পা চালান করা মাত্র মুশকিল আসান। কারও পক্ষে জানাই সম্ভব না কড়ে আঙ্গুল আছে কি নেই। তাছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার স্টেট কাউন্সেলরের স্ত্রী ম্যাডাম চেখতারিয়েভার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে যাই, স্টাফ অফিসারের স্ত্রী পালেগইয়া গ্রিগরিয়েভনা পদেতোচিনার সঙ্গেও দেখা করি।  তার আবার নিদারুণ সুন্দরী এক মেয়ে আছে―মা মেয়ে দুজনের সঙ্গেই আমার বেশ মাখোমাখো সম্পর্ক; সুতরাং সব দিক বিচার করে আপনিই বলেন, সেই সকল সুদর্শনাদের সান্নিধ্যে আমার পক্ষে এখন কীভাবে যাওয়া সম্ভব ?’

শক্ত করে ঠোঁট কামড়ানোর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল বেচারা পক্ককেশি কেরানিটি গভীর চিন্তার আবর্তে পড়ে গেছে।

‘না হে বাপু, এ ধরনের বিজ্ঞাপন আমার পক্ষে পত্রিকায় ছাপানো সম্ভব না।’ বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পক্ককেশি বলে উঠল।

‘কেন সম্ভব নয় ?’

‘সম্ভব না, কারণ এ জাতীয় বিজ্ঞাপন ছাপা হলে পত্রিকার সুনাম নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শহরের সবাই যদি তাদের নাক খোয়ানোর খবর ছাপতে শুরু করে তবে তো… আর পত্রিকায় এমন বিজ্ঞাপন ছাপানো হলে লোকজন বলতে শুরু করবে আমরা ভুয়া খবর ছাপি, আষাঢ়ে গালগপ্পো ছাপানোর ঝোঁক আমাদের।’

‘কিন্তু আমার খবরটা ভুয়া বা আষাঢ়ে মনে হলো কেন বলেন দেখি ভায়া ? সেরকম কিস্যু এতে নেইও।’

‘সেটা আপনার মনে হচ্ছে মশাই। গত সপ্তাহের ঘটনাটাই ধরেন না, আপনি যেরকম এসেছেন, একই ভাবে সেদিন একজন সরকারি কর্মচারী এক বিজ্ঞাপন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল; হিসাবনিকাশ করে তার বিজ্ঞাপনের জন্য খরচ ধার্য করা হলো। তার বিজ্ঞাপনের ভাষ্যটা ছিল এমন, কালো লোমওয়ালা একটা পুডল (ছোট্ট কুকুরছানা) হারানো গেছে। নিতান্তই সাদামাটা এই বিজ্ঞাপনে কিইবা থাকা সম্ভব, এমন মনে হচ্ছে না ? কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত মানহানির মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কারণ এই পুডল আদতে ছিল কোনও এক প্রতিষ্ঠানের ক্যাশিয়ার―যদিও প্রতিষ্ঠানের নামটা আমার এখন মনে নেই।’

‘আচ্ছা… আপনার ভোগান্তিটা অনুমান করতে পারছি, কিন্তু আমি তো ভায়া কোনও পুডলবিষয়ক বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না, বিজ্ঞাপনটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত সমস্যা সংক্রান্ত। এককথায় খোদ নিজের সম্পর্কে এই বিজ্ঞাপন, সেটা ভুয়া খবর হয় কীভাবে!’

‘তা না হোক, তবু ঘুরেফিরে সেই একই ভেজাল, এই ধাঁচের বিজ্ঞাপন ছাপানো আমার পক্ষে সম্ভব না।’

‘আজব তো! আমি যে আমার নিজের নাকটি খুইয়ে বসলাম সেটা কোনও ব্যাপার না!’ 

‘দেখুন মশাই বিষয়টা পুরোপুরি ডাক্তারিবিদ্যার আওতাভুক্ত। শুনেছি এমন কামেল চিকিৎসকও আছেন যিনি পছন্দসই যে কোনও আকারের নাক দিব্যি বসিয়ে দিতে ওস্তাদ। তবে কী জানেন, আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে আপনি একজন রসিক লোক, এই নাক ব্যাপারটি নিয়ে আপনি নিছক মজা করছেন।’

‘কসম কেটে বলছি! যা ভাবছেন তা নয় মোটেও। বিষয়টা এতদূর যখন গড়ালোই তখন আসল ব্যাপারটা আপনার কাছে খোলাসা করতেই হচ্ছে।’

‘ঝামেলা পাকিয়ে কাজ কী ?’ খানিকটা নস্যি টেনে নেবার আগে নিজের কৌতূহলটুকুও চাপতে না পেরে কিরানিটা বলল, ‘তবে সেরকম সমস্যা মনে না করলে ব্যাপারটা একবার দেখালে মন্দ হতো না।’

মুখের উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলেন মেজর কোভালিয়েভ।

বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! সত্যিই খুব অদ্ভুত ব্যাপার! বুড়া কেরানি বিস্ময় না লুকিয়ে চিৎকার করল, ‘জায়গাটা এক্কেবারে লেপাপোছা, দেখে মনে হচ্ছে তৈরি একটা প্যানকেক; কী অবিশ্বাস্য রকমের সমান জায়গাটা!’

‘তা এবার কি বুঝতে পারছেন আমি এতক্ষণ কী বোঝাতে চাইছি ? এবার নিশ্চয়ই আপনার কোনও আপত্তি থাকবে না বিজ্ঞাপনটি সটান ছাপাতে। এই বিজ্ঞাপনের সুবাদে আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।’ কথা বলতে বলতে মেজর যেন একটু অতিরিক্ত তৈলাক্ত শব্দ প্রয়োগে কেরানির মন ভেজাতে চেষ্টা করলেন।

‘সে তো ছাপানোই যায়, ওটা তেমন কঠিন কোনও কাজও নয়’। কেরানি বলল, ‘তবে বাস্তবতা হলো ভায়া, এই বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে আপনার খুব একটা উপকার হবে বলে আমার মনে হয় না। সত্যি যদি ব্যাপারটার সুষ্ঠু ফয়সালা করতে চান, তাহলে বরং আপনি এমন একজন কব্জির জোরওয়ালা লেখকের শরণাপন্ন হোন যিনি বিষয়টাকে অসাধারণ প্রকৃতির ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে সরস প্রবন্ধ লিখে দেবেন। তারপর সেটা মৌচাকে ঢিল পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করুন, (এই বলে কেরানি একটিপ নস্যি নিল), কাজটা তরুণ সমাজের যেমন উপকার করবে (বলতে বলতে পক্ককেশি হাত উল্টে নাক মুছলো), তেমনি সাধারণ মানুষের কাছেও হয়তো আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে।’

কেরানির বেহুদা ভ্যাজর ভ্যাজর শোনার পর মেজর সাহেব পুরোপুরি হতাশায় ডুবে গেলেন। তিনি চোখের সামনে থাকা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেন, সেখানে কোনও থিয়েটারের একটা বিজ্ঞাপন, এক স্বনামধন্য সুন্দরী অভিনেত্রীর নামটা চোখে পড়া মাত্র কোভালিয়েভের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা দিল, নিজের অজান্তেই যেন হাতটা পকেট হাতড়ে নোটের খোঁজে সক্রিয় হলো, (তিনি ভাবছিলেন যে কেবল স্টলগুলিতে মেজরদের পছন্দসই আসন এবং তারপরেই…) সবই ঠিক চলছিল, কিন্তু হুট করে আবারও নাকের চিন্তাটা উড়ে এসে তার সব উৎসাহে পানি ঢেলে দিল বুঝি।

পক্ককেশি কেরানিটা পর্যন্ত কোভালিয়েভের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ল। সহানুভূতির সঙ্গে এই পরিস্থিতিতে সামান্য হলেও কোভালিয়েভের দুঃখ কমানোর আন্তরিকতা নিয়ে সে সমবেদনা জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে মুখ খুললো,

‘আপনার পরিণতির জন্য সত্যিই বড় দুঃখ হচ্ছে। এক চিমটি নস্যি নিয়ে দেখবেন নাকি ভায়া ? এতে মাথাধরা আর বিষণ্নতা কেটে যায়―দেখবেন একটু নিয়ে ? এমনকি পাইলসের সমস্যা থাকলেও এতে ভালো কাজ দেয়।’

বলেই পক্ককেশি কেরানি টুপি পরা এক মহিলার ছবি আঁকা নস্যিদানির ঢাকাটা বেশ কায়দা করে সরিয়ে কোভালিয়েভের সামনে ধরলো।

কেরানিটির এহেন হঠকারী ব্যবহারে কোভালিয়েভের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো।

তিনি বেশ উষ্মার সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘মশকরা করছেন মশাই ? আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না নস্যি টানার মতো কোনও উপায় নেই আমার ? এমন বিষয় নিয়ে তামাশা করার রুচি আপনার হচ্ছে কীভাবে! আপনি আর আপনার নস্যির নিকুচি করি।’

বলেই তিনি রাগে জ্বলতে জ্বলতে ব্যস্তসমস্তভাবে পত্রিকা অফিস থেকে বেরিয়ে ওয়ার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দুর্ভাগ্যবশত কোভালিয়েভ এমন সময় গিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন যখন পুলিশ বাবুটি হাই তুলে শরীরে মোচড়ামুচড়ি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন এখন তার অন্তত দুই ঘণ্টার ঘুম বিরতিতে যাওয়ার সময়। কাজেই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, মেজর কোভালিয়েভ পুলিশ বাবুর দর্শন লাভের জন্য বড্ড অসময়ে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো পুলিশ পরিদর্শক ভদ্রলোকটি ছিলেন শিল্পকলা এবং বাণিজ্যের এক মহান পৃষ্ঠপোষক, তবে ব্যাংক নোটের প্রতি ছিল তার জন্মের দুর্বলতা।

‘ওহ্ জিনিস বটে একটা!’ পুলিশ বাবুটি ব্যাংক নোট সম্পর্কে প্রায়শ তার মুগ্ধতা ঝরাতেন ওভাবে, ‘এমন দারুণ জিনিস আর হয় না, কোত্থাও এর তেমন মার খাওয়ার ভয় থাকে না, খাওয়া পরারও দরকার হয় না এর, জায়গাও লাগে অল্প,  সুট করে পকেটে এঁটে যায় দিব্যি, পড়ে গেলেও আস্তই থাকে।’

নিস্পৃহ গলায় পুলিশ পরিদর্শক কোভালিয়েভকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, বিকেলটা কোনও ভাবেই তদন্তের জন্য সুবিধাজনক নয় ভায়া, স্বয়ং প্রকৃতিও চায় খাওয়াদাওয়ার পর লোকজন খানিক বিশ্রাম নিক (এই বক্তব্য শুনে কোভালিয়েভের বুঝতে দেরি হলো না প্রাচীন জ্ঞানীগুণীদের বাণী সম্পর্কে পুলিশটির ভালোই জ্ঞান আছে), তাছাড়া বললেও বিশ্বাস করব না, কোনও বিশিষ্ট ভদ্রলোকের নাক কেউ খামোখাই ছিনিয়ে নিতে পারে।

শেষের ইঙ্গিতটা এক্কেবারে সরাসরি কোভালিয়েভের উদ্দেশ্যেই ছুড়ে দেওয়া। বলে নেওয়া ভালো যে, কোভালিয়েভ ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। তাকে উদ্দেশ করে কেউ কিছু বললে তিনি সেটা ক্ষমার চোখে দেখতে সক্ষম, কিন্তু তার পদ বা খেতাব নিয়ে কারও কোনও রকমের ঠাট্টা বা তাচ্ছিল্য তিনি সহ্য করতে পারেন না। তিনি এটাও মনে করেন যে, কোনও কৌতুকনাটকে নিম্ন পদমর্যাদার সৈন্যদের নিয়ে যা খুশি দেখানো যেতে পারে, কিন্তু উচ্চপদস্থের সম্মান নিয়ে কোনও আক্রমণই বরদাস্তযোগ্য নয়। পুলিশ বাবুটির অভ্যর্থনায় স্বভাবতই তিনি যারপরনাই মর্মাহত হলেন, মাথা ঝাঁকিয়ে গাঢ়স্বরে, হাতদুটো সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার এমন ন্যাক্কারজনক ব্যবহার আর মন্তব্যের পর আমার আর কিছু বলার নেই।’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন।

শেষমেষ কোভালিয়েভ যখন বাড়িতে ফিরে এলেন তখন তার পা দুটো অসাড় প্রায়। বাইরে ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। সারাদিনের পণ্ডশ্রম শেষে বাড়ি ফিরে নিজের ফ্ল্যাটটাকে তার বিষাদে ভরপুর আর শ্রীহীন বলে মনে হলো। সামনের ঘরটাতে ঢুকতেই তিনি দেখতে পেলেন তার খানসামা ছোকরা আইভান বেশ চমৎকৃত হবার মতো এক বিনোদনে মশগুল। দাগে ভরপুর চামড়ার ডিভানটিতে হতভাগা চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ছাদ বরাবর থুতু ছিটাচ্ছে, এবং বেশ দক্ষতার সঙ্গে বার বার নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য ভেদ করছে। ব্যাটার এহেন অনাসৃষ্টি দেখে কোভালিয়েভ রাগে ফেটে পড়লেন, তিনি তার হাতের টুপিটা দিয়েই ছোকরার মাথায় আঘাত করে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘হতচ্ছাড়া আমড়া কাঠের ঁেঢকি একটা। কাজকম্মে মন নেই খালি বেহুদা বাঁদরামি।’

হতচ্ছাড়া আইভান তড়াক করে উঠে একছুটে সাহেবের গা থেকে ঢিলে পোশাকটা খুলে নেবার জন্য গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। ক্লান্ত আর হতাশ মেজর নিজের ঘরে ঢুকে একটা আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন, এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করলেন―

‘পোড়া কপাল আমার! এই দুর্ভোগ কোথা থেকে এসে হাজির হলো ? যদি হাত কিংবা পা হারাতো সেটাও না হয় মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু নাক ছাড়া একজন মানুষ―তাকে কী বলা যায় ? এমন তো না যে সেটা একটা পাখি, না পাখিও নয়, কোনও মানুষ ? না সেও নয়, কেবলি যেন একটা কিছু যাকে চাইলেই জানলা গলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায়! আর যদি এমন হতো যুদ্ধের মাঠে কিংবা কারও সঙ্গে ডুয়েল লড়তে গিয়ে অথবা আমার নিজেরই কোনও দোষে, কিন্তু নাহ্, একদম বিনা কারণে খুইয়ে ফেললাম, খামোখাই, ফুটো পয়সার ফায়দা ছাড়াই… না এটা মেনে নেওয়া যায় না,’ খানিক কীসব ভেবেটেবে তিনি আবার বিড়বিড় শুরু করলেন, ‘এটা পুরোপুরি অবিশ্বাস্য, জ্বলজ্যান্ত একটা নাক লাপাত্তা হয়ে গেল, একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। খুব সম্ভবত আমি স্বপ্ন দেখছি, অথবা গত রাতে বেহেড মাতাল অবস্থায় বাড়ি ফেরার পর এখনও আমি পুরোপুরি ধাতস্থ হইনি। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, মনের ভুলে পানির বদলে ব্র্যান্ডি খেয়ে ফেলেছি, যে ব্র্যান্ডি আমি রোজ দাড়ি কামানোর পর চিবুকে ঘষি। হতচ্ছাড়া আইভানটা সেসব জায়গা মতো সরিয়ে রাখেনি, যা সম্ভবত আমি খেয়ে ফেলেছি।’

তিনি যে মাতাল নন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মেজর নিজেকে এত জোরে চিমটি কাটা শুরু করলেন যে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলেন। ব্যথা পাওয়াতে তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তিনি সম্পূর্ণ ধাতস্থ এবং জেগেই আছেন। এরপর তিনি ধীর পায়ে হেঁটে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, প্রথমে মনে একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে চোখ বুজলেন যে, চোখ খুলেই তিনি আগের মতো সব ঠিকঠাক অবস্থায় দেখতে পাবেন। কিন্তু চোখ খুলেই তিনি পিছু হটলেন, ‘উফ্ কী জঘন্য দৃশ্য!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।

যা ঘটেছে সেটা সত্যিই দুর্বোধ্য। কারও হয়তো বোতাম, রুপার চামচ, ঘড়ি অথবা ওরকম কিছু জিনিস হারাতেই পারে, সেরকম কিছু খোয়া গেলেও না হয় একটা মানে দাঁড় করানো যেত। কিন্তু খোয়া গেল তো গেল এমন জিনিস ? তাও আবার খোদ নিজের বাড়ি থেকেই!

মেজর কোভালিয়েভ গোটা পরিস্থিতিটা মনে মনে পর্যালোচনা করে এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে এই গোটা পরিণতির জন্য স্টাফ অফিসারের স্ত্রী ম্যাডাম পদতোচিনা ছাড়া আর কেউ  দায়ী নন। মহিলা ভীষণভাবে চাইতেন মেজর যেন তার মেয়েটাকে বিয়ে করেন। যদিও মেয়েটার সঙ্গে দহরম মহরমে মেজরের আগ্রহের কোনও কমতি ছিল না। তবে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়টা তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলতে চাইতেন। কিন্তু একদিন যখন মহিলা তাকে পাকড়াও করে বসলেন এবং সপাটে জানালেন তিনি চান তার মেয়েটিকে মেজর বিয়ে করুন, তখন বেশ কায়দা করেই মেজর পিছলে যান। বিনয়ের অবতার হয়ে মেজর তখন জানান যে বিয়ের জন্য তার বয়স এখনও তেমন পাকেনি, আর তার মেয়ের বয়সও যথেষ্ট কম, তাছাড়া বয়সটা বিয়াল্লিশ হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্যারিয়ারের পেছনে তাকে এখনও আরও পাঁচ বছর সময় দেওয়া লাগবে।

তার উপর খাপ্পা হওয়ার কারণ হিসেবে ম্যাডাম পদতোচিনার জন্য এটাই যথেষ্ট, আর সে কারণেই তিনি প্রতিহিংসাবশত তার উপর প্রতিশোধ নেবার আঁটঘাট বেঁধেছেন, যেন সামাজিকভাবে মেজরকে যথেষ্ট অপদস্থ করা যায়। হয়তো এ জন্য তিনি জাদুটোনায় দক্ষ এমন কারও সাহায্যও নিয়েছেন। এটা তো নিশ্চিত যে তার নাকটা কেউ খচাৎ করে কেটে নিয়ে পালায়নি, কেননা তার খাস কামরায় কারও ঢোকার কথা নয়। যদিও ব্যাটা নাপিত আইভান ইয়াকভলেভিচ তার দাড়ি কামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেও তো গত বুধবারে। আর বৃহস্পতিবারের গোটা দিনটাতে যে তার নাকটা দিব্যি আস্তই ছিল এটা তার স্পষ্ট মনে আছে এবং এ ব্যাপারে তিনি সুনিশ্চিত, তাছাড়া যদি সেরকম কিছু অঘটন ঘটত তিনি তো অন্তত ব্যথাট্যাথা অনুভব করতেন! তাছাড়া ভোজবাজির মতো কোনও ক্ষত এত দ্রুত শুকিয়ে গিয়ে জায়গাটার দিব্যি নিখুঁত লেপাপোছা একখানা প্যানকেকের আকার নেওয়া সম্ভব নাকি!

কোভালিয়েভ নানা চিন্তায় আচ্ছন্ন হলেন। একবার ভাবলেন দেবো নাকি স্টাফ অফিসারের স্ত্রীর নামে আনুষ্ঠানিকভাবে একখানা মামলা ঠুকে ? নাকি নিজেই সরাসরি তার বাড়ি গিয়ে মহিলার নামে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ জানিয়ে আসবেন ? ঘরের দরজার ফাঁক-ফোঁকর ভেদ করে খুচরো আলোর ঝলকে হঠাৎ মেজরের ভাবনা বাধা পেল। তিনি বুঝে নিলেন ইতোমধ্যেই ঘরে ঘরে খানসামা আইভান মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছে। একখানা মোমবাতি হাতে তার ঘরেও আইভান এসে হাজির হলো। আইভানের আনা মোমবাতির আলোতে গোটা ঘর ভরে ওঠার আগেই কোভালিয়েভ ক্ষিপ্র হাতে রুমালটা মুখের সেখানটা চাপা দিলেন, যেখানে গত সন্ধ্যাতেও একখানা আস্ত নাকের উপস্থিতি ছিল। কারণ তিনি মোটেও চান না তার চেহারার এমন বদখত অবস্থা দেখে বুদ্ধিনাশা আইভানটার মুখ হা হয়ে যায়।

ঘরে বাতিটা রেখেই অবশ্য আইভানকে ফিরতে হয়, কারণ বাইরের ঘরের দরজায় অপরিচিত একটা গলা শোনা যায়, ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়েভ কি এখানে থাকেন ?’ প্রশ্ন ভেসে আসে।

‘ভেতরে আসুন।’ প্রায় ছুটে এসে মেজর দরজা খুলতে খুলতে আগন্তুককে আহ্বান জানালেন।

সৌম্যকান্তি এক পুলিশ অফিসার ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালেন। তার সুন্দর চেহারার সঙ্গে বেশ খাসা একজোড়া ধূসর রঙের জুলফি ভরাট গালটা জুড়ে একটা বিশেষত্ব দিয়েছে। ইনি হলেন সেই পুলিশ ভায়া, কাহিনির শুরুতে যাকে আমরা আইজাক ব্রিজের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।

‘আপনারই কি নাক খুইয়েছে জনাব ?’ ঘরে ঢুকেই তিনি প্রশ্নটা করলেন।

‘ঠিক তাই।’

‘মাত্রই ওটার হদিস পাওয়া গেছে।’

‘কী বললেন ?’ আকস্মিক পাওয়া আনন্দ সংবাদটি কয়েক মুহূর্তের জন্য মেজরকে বাকরুদ্ধ করে দিল। তিনি বড় বড় চোখ করে অপলক দৃষ্টিতে অফিসারের দৃঢ়চেতা ঠোঁট আর গালের উপর মোমের আলোর প্রতিফলন দেখতে থাকলেন। তারপর প্রবল উত্তেজনার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিভাবে, কী করে এটা সম্ভব হলো ?’

‘দাঁড়ান বলছি খুলে। নাকটাকে পাওয়া গেছে একটা রাস্তার পাশে। রিগার উদ্দেশ্যে রওনা  দেবে তেমন একটা গাড়িতে উঠে বসেছিল ব্যাটা। সঙ্গে ছিল ভুয়া পাসপোর্ট যেটা ইস্যু করা হয়েছিল কোনও এক সরকারি কর্মকর্তার নামে। আমি নিজেও তো তাকে ভদ্রলোক বলেই ধরে নিয়েছিলাম শুরুতে। আমি আবার চোখে ভালো দেখতে পাই না। এই যে আপনি সামনে আছেন, আপনার মুখটা দেখতে পাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু  আপনার নাক, মুখ, চিবুক কিছুই আলাদা করে বুঝতে পারছি না, আমার শাশুড়িরও একই দশা। ভাগ্যিস তখন চোখে চশমা ছিল। ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম ভদ্রলোকটি একখানা নাক বাদে আর কিছুই নয়। তখনই গ্যাঁক করে চেপে ধরলাম ব্যাটাকে।’ 

‘ওটা এখন কোথায় আছে ? কোথায় ? আমি এক্ষুনি সেখানে যেতে চাই।’ উত্তেজনায় কোভালিয়েভ রীতিমতো চিৎকার করে উঠলেন।

‘এত অস্থির হবেন না জনাব। ওটা আপনার বিশেষ প্রয়োজন জেনে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি। আর অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হচ্ছে এই ঘটনার পেছনে জড়িত পালের গোদাটা হচ্ছে অ্যাসেনশন অ্যাভিনিউয়ের বাটপাড় এক নাপিত আইভান ইয়াকভলেভিচ, ব্যাটা এখন জেলহাজতে বসে বসে কড়িকাঠ গুনছে। অনেক দিন ধরেই মাতলামি আর চুরিধারি নিয়ে ওর প্রতি আমার সন্দেহ হচ্ছিল। গতকালের আগের দিনই এক দোকান থেকে সে বেশ কিছু বোতাম হাতিয়েছে। আপনার নাক একদম অক্ষত অবস্থায় আছে জনাব।’

বলতে বলতে পুলিশ অফিসার পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাগজে মোড়ানো জিনিসটা বের করলেন।

‘হ্যাঁ, নাকটা একদম ঠিক আছে।’ চেঁচিয়ে বললেন কোভালিয়েভ। এটাই তার কাক্সিক্ষত সেই নাক। ‘আচ্ছা, আপনি বসুন না ভায়া, এককাপ চা কিংবা কফি হয়ে যাক এই আনন্দে।’

‘খেতে পারলে খুশিই হতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে এক্ষুনি একবার সংশোধনাগারে যেতেই হবে জনাব। আজকাল জীবনযাত্রার মান ধাই ধাই করে কেমন আকাশ ছুঁচ্ছে বলুন! এই অগ্নিমূল্যের বাজারে বাড়িতে স্ত্রীর মা মানে শাশুড়িও থাকেন আমাদের সঙ্গে। আমার বেশ কয়েকটা ছেলেপুলে, বড় সংসার। বড় ছেলেটা বেশ কাজের, মাথাটাও ভালো ছিল। কিন্তু ছেলেটার পড়াশোনা করানোর মতো সঙ্গতি আমার নেই…’

পুলিশ অফিসার খুশি হয়ে চলে যাওয়ার পর মেজর কোভালিয়েভ কিছু সময় কেমন এক ভাবালুতায় ডুবে রইলেন। অপ্রত্যাশিত এক আনন্দে তিনি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে বেশ কিছু মুহূর্ত লেগে যায় তার নিজেকে ফিরে পেতে, গোটা পরিস্থিতিটা আত্মস্থ করতে। ফিরে পাওয়া নাকটা তিনি দু হাতের তালুতে সযত্নে রেখে সেটাকে আরও একবার খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন।

‘হ্যাঁ, এটাই তার নাক বটে।’ কোভালিয়েভ মনে মনে বললেন। ‘এই তো বাম পাশে গতকাল সন্ধ্যায় গজিয়ে ওঠা সেই ব্রণটা।’

আনন্দে মেজর গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন।

কিন্তু এই দুনিয়ার কোনও আনন্দই চিরস্থায়ী নয়। ভীষণ আনন্দদায়ক ঘটনার রেশও পরমুহূর্তে ম্লান হয়ে মিশে যায় আর দশটি স্বাভাবিক ঘটনার সঙ্গে। জলের বুকে ঢিল ছুড়ে তৈরি হওয়া আলোড়ন যেমন আবার মিশে যায় সেই জলের সঙ্গে, ঠিক তেমন। কোভালিয়েভ আবারো চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। তার সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান এখনও হয়নি, নাক পাওয়া গেছে এটা ঠিক, কিন্তু সেটাকে যথাস্থানে বসানোর কাজটা এখনও বাকি।

‘কিন্তু যদি ঠিকমতো বসানো না যায় ?’ নিজে নিজেই প্রশ্নটা করে কোভালিয়েভ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।

অসম্ভব এক আতঙ্কে তিনি ছুটে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন, যেন নাকটা কোনও অবস্থাতে বাঁকাভাবে বসানো না হয়, সেটা পরখ করতে চাইলেন। তার হাত রীতিমতো কাঁপছিল। খুব সাবধানে, যত্নের সঙ্গে নাকটাকে তিনি যথাস্থানে বসালেন। সর্বনাশ! এটা তো জায়গা মতো বসছে না! তিনি নাকটাকে মুখের কাছে নিয়ে মুখের ভাপে একটু গরম করে আবার জায়গা মতো বসালেন, কিন্তু সে কিছুতেই জায়গা মতো বসছে না।

‘বসে থাক বলছি, ছাগল! যেখানে থাকার ঠিক সেখানে চুপচাপ বসে থাক বলছি।’ রীতিমতো ক্ষেপে উঠলেন তিনি।

কিন্তু বেয়াদপ নাকটা একগুঁয়ে কাঠের টুকরোর মতো টেবিলের উপর পড়ে এমন বিদঘুটে আওয়াজ করল যেন একটা বোতল ফসকে পড়ে যাওয়া ছিপি। প্রচণ্ড বিরক্তিতে মেজরের চেহারাটা কুঁচকে উঠল।

‘তাহলে কি নাকটা আর জোড়া লাগবে না ?’ অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে ভাবলেন তিনি। নাকটা জোড়া লাগাবার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছিল বারবার।

এই দালানের অন্য একটি ফ্ল্যাটে একজন ডাক্তার থাকেন। তিনি চিৎকার করে আইভানকে বললেন তক্ষুনি তাকে ডেকে আনতে। ডাক্তার ভদ্রলোক দেখতে সুদর্শন, গালের দু পাশে তার কালো জুলফির বাহার, তার স্ত্রীটি বেশ স্বাস্থ্যবতী। ডাক্তার সাহেব খুব  স্বাস্থ্যসচেতন, নিয়ম করে রোজ তরতাজা আপেল খান, রোজ সকালে পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট গার্গল করেন এবং পাঁচ ধরনের ব্রাশ ব্যবহার করে মুখমণ্ডলের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন।

ডাক পাওয়ামাত্র ডাক্তার এসে হাজির হলেন। ঘটনাটি কবেকার তা জিজ্ঞেস করে ডাক্তার সাহেব মেজরের চিবুক ধরে মাথাটা উপরে তুললেন এবং নাকের জায়গাতে নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে এমন করে একটা তুড়ি দিলেন তাতে কোভালিয়েভের মাথাটা পেছনের দিকে সরাতে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে ঠকাশ করে ঠুকে গেল। ডাক্তার বললেন তেমন বড় কোনও ব্যাপার না। এরপর মেজরের মাথা প্রথমে ডান দিকে হেলিয়ে নাকের জায়গাটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বললেন, ‘হুম!’ তারপর আবার মেজরের মাথা বামে হেলিয়েও ‘হুম!’ শব্দে তুড়ি বাজাবার পর কোভালিয়েভকে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলেন যেন এইমাত্র একটি দণ্ডায়মান সুবোধ ঘোটকের দন্ত পরীক্ষা সমাপ্ত হলো।

নিবিড় নিরীক্ষণ শেষ করে ডাক্তার সাহেব মাথা নেড়ে জানান দিলেন, ‘নাহ্ কাজটা ঠিক হবে না। বরং চেহারা যেমন আছে তেমনই থাকুক ভায়া, জোড়াতালির কাজ করতে গেলে আপনার অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা। আপনি চাইলে আমি অবশ্যই তা লাগিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমি নিশ্চিত তাতে অবস্থা খারাপ বৈ ভালো হবে না।’

‘আমি সেটা পরোয়া করি না। আপনি নাকটা লাগিয়েই দেন। নাক ছাড়া আমি চলবো কীভাবে ?’ কোভালিয়েভ উত্তর দিলেন। “তাছাড়া এখনকার চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে ? এমন হতচ্ছিরি চেহারা আমি লোকের সামনে দেখাবোই বা কীভাবে ? মান্যগণ্য লোকসমাজে আমার চলাফেরা, আজ সন্ধ্যাতেই দুটো আসরে আমার দাওয়াত ছিল, সরকারি পরামর্শদাতা চেখতারিওভের স্ত্রী, স্টাফ অফিসারের স্ত্রী পদতোচিনা এবং আরও কতজনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। যদিও ম্যাডাম পদতোচিনা যা করেছেন তার ব্যাপারে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আমার উপায় নেই।… একটা কিছু করুন ভায়া, যে কোনও একটা উপায়ে যদি এটাকে বসানো যায়, ভালোমন্দ যা হয় হোক, ওটা লেগে থাকলেই হবে। তেমন বিপদ দেখলে আমি না হয় হাত দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারব। তাছাড়া কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে আমি নাচিটাচিও না, কাজেই হঠাৎ অসাবধানবশত পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। আপনার ভিজিট আর আনুষঙ্গিক খরচের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করবেন না, নিশ্চিত থাকতে পারেন ওটা বহনের সামর্থ্য আমার আছে।’ মিনতি করে কথাগুলো বললেন মেজর কোভালিয়েভ।

‘বিশ্বাস করুন ভায়া’ ডাক্তার সাহেবের গলা উঁচুতেও গেল না, আবার নিচেও নামল না অদ্ভুত এক সম্মোহনীয় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি টাকার জন্য কখনও চিকিৎসা করি না। এটা আমার নীতি এবং শাস্ত্র বিরোধী। আমি যে ভিজিট নিয়ে থাকি সেটা এই কারণে নেওয়া, যাতে রোগীরা প্রত্যাখ্যানজনিত অপমানবোধ না করেন। আপনার নাক আমি অবশ্যই লাগিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু নিশ্চিত হয়েই বলছি তাতে করে ফল অনেক বেশি খারাপ হবে। ব্যাপারটাকে বরং প্রকৃতির খেয়ালখুশির উপর ছেড়ে দিন। নাকের জায়গাটি আপনি নিয়মিত ঠান্ডা পানি দিয়ে ধোবেন। আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি নাক থাকলে আপনি যেরকম সুস্থ থাকতেন, না থাকলেও ততটাই থাকবেন। আর নাকটা, আমার পরামর্শ যদি রাখেন, স্পিরিটভর্তি একটা বোয়ামে ভরে রেখে দিন, আরও ভালো হয় যদি তার সঙ্গে বড় দুই চামচ ঝাঁঝালো ভদকা ও সামান্য ভালো জাতের ভিনিগার মিশিয়ে নেন। এটার বিনিময়ে আপনি ভালো দাম পেতে পারেন কিন্তু! এমনকি জিনিসটা আমি নিজেও নিতে পারি, যদি আপনি চড়া দাম না হাঁকান।’

‘পাগল নাকি! আমি কিছুতেই বিক্রি করব না এটা।’ মেজর কোভালিয়েভ চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘তারচে বরং জিনিসটার আবার হারিয়ে যাওয়াই ভালো।’

‘দুঃখিত ভায়া, আমি কিন্তু আপনার উপকারই করতে চেয়েছিলাম। আপনি তো দেখলেন আমার চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনও কমতি ছিল না।’ বলে ডাক্তার সাহেব বিষণ্ন মুখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেলেন।

ডাক্তারের চলে যাওয়া নিয়ে কোনও গা করলেন না কোভালিয়েভ, বরং নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে দেখলেন ডাক্তারের ঝুল কোটের হাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে তার ধবধবে শার্টের পরিচ্ছন্ন হাতা।

পরদিন মেজর ঠিক করলেন অভিযোগ ঠোকার জন্য আগে স্টাফ অফিসারের স্ত্রী বরাবর একটা চিঠি লিখে জানতে চাইবেন আপসে তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে রাজি আছেন কিনা। চিঠির বয়ান ছিল এমন, মহাশয়া আলেকজান্দ্রা পদতোচিনা, আপনার অদ্ভু কাণ্ডকারখানার উদ্দেশ্য আমি বুঝতে পারছি না। আপনি যত কায়দাই করুন না কেন, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে কিছুতে আপনার মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমাকে বাধ্য করতে পারবেন না। আমার নাকের ঘটনাটির আসল রহস্য বুঝতে বাকি নেই আর। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি পুরো বিষয়টার পেছনে আপনিই কলকাঠি নেড়েছেন। হ্যাঁ আপনি ছাড়া অন্য কেউ নন। নির্ধারিত জায়গা ছেড়ে আমার নাকটির হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, ছদ্মবেশ নেওয়া, কখনও সরকারি কর্মচারীর বেশ নেওয়া, কখনও স্বমূর্তিতে আসা, এই সবকিছু আপনার কিংবা আপনার মতো যারা এসব কাজে যুক্ত আছেন, তাদের তুকতাকের প্রভাব ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আপনাকে চূড়ান্তভাবে সাবধান করে দিতে চাই যে, নাকটি যদি আজকের মধ্যে তার নিজস্ব ঠিকানায় ফিরে না আসে তবে আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।

আপনার বিনীত,

‘প্লাটন কোভালিয়েভ’

ম্যাডামের তরফ থেকে উত্তর আসতেও খুব একটা দেরি হলো না। তিনি লিখেছেন―‘প্রিয় মহাশয় প্লাটন কোভালিয়েভ, আপনার চিঠি পেয়ে যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি এমন অন্যায় আক্রমণ করতে পারেন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। যে সরকারি কর্মচারীটির প্রতি আপনি ইঙ্গিত করছেন, ছদ্মবেশ কিংবা স্বমূর্তি, কোনও অবস্থাতেই তাকে আমার বাড়িতে আপ্যায়ন করা হয়নি। তবে হ্যাঁ, এ কথা ঠিক ফিলিপ আইভানভিচ পতানচিকভ, প্রায়শই আমার বাড়িতে আসতেন। আর তিনি যথার্থভাবেই আমার মেয়েটিকে বিয়ের আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। যদিও তিনি অতিমাত্রায় একজন সুপাত্র, সংযত আচরণ, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি তাকে সে বিষয়ে কোনও রকম আশায় রাখিনি। আপনি নাক প্রসঙ্গেও কিছু ইঙ্গিত দেবার চেষ্টা করেছেন। এখানে যদি আমার নাক-উঁচু ভাবের ইঙ্গিত করে আমার মেয়ের প্রতি আপনার আগ্রহকে প্রত্যাখ্যানের কথা বুঝিয়ে থাকেন তাহলে অবাক হতেই হয়। কারণ এ ব্যাপারে আপনার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে আছি আমি। তাই আপনি যদি এখনও আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চান, আপনার ইচ্ছার স্বপক্ষে যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে আমার কোনও রকমের ত্রুটি থাকবে না। বহুদিন থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমিও এমন আশাই লালন করে এসেছি।

ইতি-

আপনার গুণগ্রাহী আলেকজান্দ্রা পদতোচিনা’

চিঠিটা পড়বার পর কোভালিয়েভের প্রথম অনুভূতির প্রকাশটা ছিল এমন, ‘নাহ্ যতদূর মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলার কোনও দোষ নেই। তার পক্ষে নাক নিয়ে ঘোঁট পাকানো সম্ভব না বলেই মনে হচ্ছে। একজন অপরাধীর পক্ষে এমন চিঠি লেখাও সম্ভব না। এসব বিষয়ে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। কারণ ককেশাসে থাকাকালীন তাকে প্রায়শই সরকারিভাবে অপরাধ তদন্ত পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করা হতো। কিন্তু কীভাবে কার চক্রান্তে এমন কাণ্ড ঘটলো ? কোন শয়তান যে কলকাঠি নাড়ছে!’ ব্যাপক হতাশায় কোভালিয়েভ বলে উঠলেন।

ইতোমধ্যে শহরময় এই অভাবনীয় ঘটনাটি রাষ্ট্র হয়ে গেছে এবং এসব ক্ষেত্রে যা হয় আসলের গায়ে বেশ কয়েক পরত রং চড়ে বসে। সে কালটাই এমন ছিল যে মানুষ চট করে অদ্ভূতুড়ে―অলৌকিক ঘটনাগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হতো; মাত্র কিছুদিন আগেও জনগণ সম্মোহনশক্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মেতে উঠেছিল। কনিউশেনাইয়া স্ট্রিটের ভাসমান চেয়ারগুলোর গল্পটা এখনও বেশ টাটকাই, তাই শীঘ্রই যখন  চাউর হলো যে মিউনিসিপ্যাল কমিটির সদস্য কোভালিয়েভের নাকটাকে প্রতিদিন ঠিক তিনটায় নেভস্কি অ্যাভিনিউতে হাঁটতে দেখা যায়, তাতে খুব একটা আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু ছিল না। সে ঘটনা দেখার জন্য ঘটনার জায়গাতে এমন লোকের ভিড় জমে গেল যে তাদের হটিয়ে পরিবেশ শান্ত করতে শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হলো।

ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে সুযোগসন্ধানী লোকদের ব্যবসা ফেঁদে বসতেও দেরি হলো না। থিয়েটারের প্রবেশ পথের সামনে নানা ধরনের কেক, মিষ্টির পসরা নিয়ে ভদ্র চেহারার জুলফিধারী জনৈক বিক্রেতাও এ ঘটনা থেকে ফায়দা লুটবার সুযোগ হাতছাড়া করল না। সে শক্তপোক্ত কিছু কাঠের বেঞ্চি বানিয়ে ঘটনার সাক্ষী হতে উৎসুক উপস্থিত অতিকৌতূহলী লোকজনকে সেই বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষের আহ্বানে চটকদার প্রচার শুরু করে, এবং দর্শকপ্রতি তার জন্য সে পয়সাও নিতে লাগল।

এমন মজার ঘটনা থেকে নিজেকে বঞ্চিত না রাখার উদ্দেশ্যে এক প্রবীণ কর্নেল আগেভাবে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন এবং অতি কষ্টে এর কনুইয়ের গুঁতা, ওর ধাক্কা খেয়ে এবং নিজেও সুযোগমতো দিয়ে, ভিড় ঠেলে পথ করে সামনে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি যা দেখার আগ্রহে এতটা কষ্ট হজম করে এতদূর এলেন, তার বদলে তিনি দেখতে পেলেন একখানা ফ্লানেলের ওয়েস্ট কোট এবং একটা রংচঙে ছাপানো ছবি, যাতে দেখা যাচ্ছে এক তরুণী তার পায়ের মোজা খুলে সেটি মেরামতে ব্যস্ত, আর বড় আপেল গাছের আড়াল থেকে এক সুদর্শন যুবক সে দৃশ্যটা উপভোগ করছে। ওই একই জায়গাতে বিগত দশ বছর ধরে ছবিখানা লটকে আছে। স্বভাবতই কর্নেল আশাভঙ্গের ক্ষোভ নিয়ে বিড়বিড় করলেন, ‘আমাকেও বলিহারি! বুদ্ধিনাশা বেহুদা লোকজনের খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই, খামোখাই আজগুবি রটনার পেছনে হেদিয়ে মরছে, মানে হয় কোনও!’

এরপরে আরও একটা গুজব ছড়ালো, কোভালিয়েভের নাক নেভস্কি অ্যাভিনিউয়ে নয় বরং টাউরিস বাগানের লিলুয়া বাতাস সেবন করতে করতে ফড়ফড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। শল্যচিকিৎসা বিভাগের কিছু ছাত্র ঘটনা দেখার জন্য সেখানে গেছে। এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় সজ্জন মহিলা উদ্যান রক্ষকের উদ্দেশে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেন। চিঠিতে তার ছেলেমেয়েদের এই দুর্লভ দৃশ্য দেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ রাখেন এবং সম্ভব হলে এই উপলক্ষে তাদের পক্ষে উপযুক্ত শিক্ষামূলক কিছু উপদেশও দেওয়ার অনুরোধ জানান।

বলাই বাহুল্য এই ঘটনা সমাজে নানাভাবে নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলে। শৌখিন লোকজন সান্ধ্য আসরে নিয়মিত যাদের যাতায়াত, তারা এই ঘটনাকে তাদের হাস্যরসের খোরাক হিসেবে লুফে নিতে দ্বিধা করল না। আসরে আগত লোকদের বিশেষ করে মহিলাদের হাসাতে তারা ভালোবাসত, এদিকে তাদের হাসির উপকরণের বড় অভাব, কাজেই নাক বিষয়ক মজার ঘটনাটি হাতছাড়া করার বোকামিতে তারা গেল না।

অন্যদিকে সংখ্যালঘু একটা অংশ, যারা পরিমার্জিত রুচির, বিচক্ষণ এবং নিজের মতামতটা চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতী, তারা বিষয়টা নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিলেন। এক ভদ্রলোক অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে বললেন, কীভাবে এই আলোকিত সময়ে উদ্ভট রটনার জন্ম হয় কিংবা ছড়াতে পারে এটা তিনি বুঝে উঠতে অক্ষম, আর এ বিষয়ে সরকারের চরম উদাসীনতায় তিনি আরও বেশি অবাক হচ্ছেন। এই ভদ্রলোকটি স্পষ্টত সেই গোত্রের যারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা বিষয়ে, এমনকি দাম্পত্যকলহেও সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

কিন্তু এখানে সমগ্র ঘটনা আবারও কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় এবং কাহিনি শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়ালো তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাতই থেকে যায়।

তিন

পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত কত সব আজগুবি ঘটনাই না ঘটে। কখনও কখনও সেগুলোর কোনও স্পষ্ট কার্যকারণ কিংবা সঙ্গতির হদিশও পাওয়া যায় না। যে নাক স্টেট কাউন্সিলরের ছদ্মবেশে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং শহর জুড়ে বিশাল এক শোরগোল তুলেছিল, সেই নাকই এক সকালে আবার ফিরে এল যথাস্থানে; অর্থাৎ মেজর কোভালিয়েভের দুই গালের ঠিক মাঝখানটায়। ব্যাপারখানা এমন যেন কিচ্ছুটি ঘটেনি।

ঘটনাটা ঘটলো এপ্রিলের সাত তারিখে। সেদিন যথারীতি ঘুম ভাঙার পর নিয়মমাফিক মেজর  আয়নার দিকে তাকালেন, আরেহ্! এটা তিনি কী দেখলেন! তিনি দেখতে পেলেন তার মুখের উপর দিব্যি বসে আছে নাকটা! তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুঁয়ে নিশ্চিত হতে চাইলেন, হ্যাঁ নাকই বটে! আহঃ! খুশি ঝরে পড়ল কোভালিয়েভের গলা থেকে। আনন্দের আতিশয্যে খালি পায়েই ঘরজুড়ে তিনি এক পাক ইউক্রেনীয়ান জনপ্রিয় নৃত্য ‘ত্রোপাক’ নেচেই ফেলছিলেন প্রায়, ব্যাটা আইভান হুট করে এসে পড়ায় তাতে বাধা পড়ল। মেজর তাকে মুখ-হাত ধোয়ার সরঞ্জাম দিতে বললেন। হাত-মুখ ধুয়ে তিনি আরেকবার আয়নার দিকে তাকালেন। ওহ! নাকটা লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপটি করে ঠিকঠাক জায়গায় বসে আছে। এরপর হাতের তোয়ালেটা দিয়ে তিনি বেশ করে নাকটা রগড়ে নিলেন। আহ্! নাকটা নড়েচড়েনি, একদম গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, বিলকুল আগের মতোই আছে।

‘আইভান দেখ তো আমার নাকের উপর ওটা কি ব্রণ উঠল ?’ বলেই মনে মনে ভাবতে লাগলেন,

‘আইভানটা যদি বলে, স্যার নাক থাকলে না ব্রণ ওঠার প্রশ্ন!’ শঙ্কায় কাঁটা হয়ে আইভানের উত্তরের অপেক্ষা করছিলেন মেজর।

‘কই ? ব্রণট্রন কিচ্ছু নেই তো! আপনার নাকটা একদম ফকফকা পরিষ্কার সাহেব।’

‘ভালো, বেশ ভালো!’ চেপে রাখা উচ্ছ্বাসটা মেজর তুড়ি মেরে জানান দিলেন।

ঠিক সে মুহূর্তে দরজায় নাপিত আইভান ইয়াকভলেভিচকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখা গেল, মাংস চুরির দায়ে ধরা পড়ে উত্তম মধ্যম খাওয়া বিড়ালের ভীতসন্ত্রস্ত ছায়া ছড়িয়ে ছিল নাপিতটার চেহারায়।

ইয়াক ভেলভিচকে দেখা মাত্রই কোভালিয়েভ হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘আগে বল ব্যাটা, হাত পরিষ্কার তোর ?’

‘আজ্ঞে হজুর।’

‘মিথ্যে বলিস না কিন্তু।’

‘কিরে কেটে বলছি, হাত একদম পরিষ্কার আছে হুজুর।’

‘থাকলেই ভালো, আয় তবে কাজ শুরু কর।’

কোভালিয়েভ গিয়ে বসলেন। আইভান ইয়াকভলেভিচ মেজরের থুতনির নিচে একটা রুমাল জড়িয়ে দিল, এবং চোখের পলকে ব্রাশ দিয়ে মেজরের দাড়ি এবং গালের খানিকটা অংশ প্রচুর ক্রিমের ফেনায় ঢেকে দিল।

‘এই তো সেটা!’ মেজরের নাকটার দিকে তাকিয়ে নাপিত স্বগতোক্তি করল। তারপর মাথাটা একদিকে সামান্য কাত করে একপাশ থেকে মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখল। ‘হ্যাঁ এটা বাস্তবিকই নাক বটে, সত্যিই, যখন কেউ ভাবে―’ মনে মনে বলতে বলতে একদৃষ্টিতে নাকটা দেখতে লাগল। তারপর খুব সন্তর্পণে নাকটা ছুঁয়ে দেখার উদ্দেশ্যে তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে আলতোভাবে দুটো আঙ্গুল সামান্য উঠাল।

‘ওরে সাবধানে।’ চেঁচিয়ে উঠলেন কোভালিয়েভ।

চেঁচানি শুনে আইভান ইয়াকলেভিচ ব্যাপকভাবে থতমত খেয়ে গেল, বিব্রতভাবে হাত নামিয়ে ফেললো, এতটা বিব্রত বুঝি সে জীবনে কখনও হয়নি। অবশেষে সে খুব সাবধানে ক্ষুর দিয়ে মেজরের চিবুকের দাড়ি কামাতে শুরু করল, নাকের উপরিভাগে হাত না দিয়ে চিবুকের দাড়ি কামানো কঠিন কাজ বলে ইয়াকভলেভিচকে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছিল। তবে তার দাগযুক্ত বুড়ো আঙ্গুলটা মেজরের চোয়াল এবং গণ্ডদেশে রেখে কাজটা সফলভাবে সমাপ্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

দাড়ি কামানোর কাজ শেষ হওয়া মাত্রই কোভালিয়েভ তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড়ে সেজেগুজে একটা ছ্যাকরা গাড়ি নিয়ে সোজা মিষ্টির দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দোকানে ঢুকেই তিনি এক কাপ চকলেট পানীয়ের অর্ডার দিলেন। তারপর সোজা গিয়ে দোকানে ঝোলানো আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘নাক নাকের জায়গাতেই আছে বটে!’ আনন্দচিত্তে তিনি পেছন ফিরলেন এবং বিদ্রƒপাত্মক দৃষ্টিতে সামনের টেবিলে বসে থাকা দুজন সামরিক অফিসারের দিকে তাকালেন, যাদের একজনের নাক ওয়েস্টকোটের বোতামের তুলনায় খুব বড় নয়। মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে তিনি নথিপত্র বিভাগীয় অফিসের দিকে রওনা দিলেন, যেখানে তিনি ইতোমধ্যে প্রাদেশিক ভাইস গভর্নর পদ কিংবা অন্য কোনও প্রশাসনিক পদ পাওয়া যায় তার জন্য চেষ্টাচরিত্র চালাচ্ছিলেন।

রিসেপশন রুমের দিকে যেতে যেতে তিনি ঝট করে আয়নায় নিজেকে দেখে নিলেন, নাহ্ নাক, নাকের জায়গাতেই আছে! এরপর তিনি গেলেন তার এক সহকর্মী  মেজরের কাছে, যিনি ছিলেন ব্যঙ্গবিদ্রƒপে ওস্তাদ লোক, তার নানা খোঁচানিমূলক মন্তব্য গায়ে তেমন না মেখে, কোভালিয়েভ প্রায়শই একটু ঘুরিয়ে বলতেন, ‘জানি হে আপনি সেন্ট পিটার্সবার্গের সবচে মজার মানুষ।’

সহকর্মীর কাছে পৌঁছানোর পথটুকুতে কোভালিয়েভ ভাবলেন, ‘যদি আমাকে দেখে মেজর হাসিতে ফেটে না পড়ে তবে আর কোনও সন্দেহ থাকবে না যে যার যেখানে থাকার কথা সে সেখানেই আছে।’

কিন্তু সাক্ষাৎ করার সময় মেজর কিছুই বলল না।

‘বহুত খুব!’ মনে মনে ভাবলেন কোভালিয়েভ। ফেরার পথে তার সঙ্গে স্টাফ অফিসারের স্ত্রী ম্যাডাম পদেতোচিনা এবং তার মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মা-মেয়েকে তিনি সৌজন্য অভিবাদন জানালেন, তারাও মেজরকে দেখে আনন্দ প্রকাশে কার্পণ্য দেখাল না, তার মানে কিছুই ঘটেনি, তারও কোনও ক্ষয়-ক্ষতির কারণ ঘটেনি। সন্তুষ্টচিত্তে তিনি তাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করলেন, নস্যিদানী বের করে এক চিমটির বেশি পরিমাণ নস্যি নিয়ে বেশ কায়দা করে নাকে ঠাসতে ঠাসতে মনে মনে বললেন―‘নাহ তুমি আমাকে আটকাতে পারোনি ছিনাল মেয়েমানুষ, যেমন তুমি তেমন তোমার মেয়ে। শত ফন্দিফিকির করেও লাভ হবে না চান্দু। আমি জিন্দেগিতেও ওকে বিয়ে করব না।’

এরপর কোভালিয়েভ নেভস্কি অ্যাভিনিউ, থিয়েটার ইত্যাদি জায়গাগুলোতে এমন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন যেন কিছুই ঘটেনি। তার নাকও নিজের জায়গাতে গ্যাট হয়ে বসে রইল যেন সেও কখনও কোত্থাও লাপাত্তা হয়নি। তারপর থেকে কোভালিয়েভকে সর্বক্ষণ খোশ মেজাজে হাস্যমুখে দেখা যেতে লাগল, এবং সুন্দরী মেয়েদের প্রতি আরও ব্যাপক মাত্রায় মনোযোগী হতে দেখা গেল। 

চার

চমকদার এ ঘটনাটি ঘটেছিল আমাদের এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরের এক শহরে। সমস্ত ঘটনা মনে মনে চিন্তা করলে আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাব যে এর মধ্যে অনেক অবিশ্বাস্য ব্যাপার আছে। পুরোমাত্রায় অদ্ভুত, অলৌকিকভাবে একটি নাকের স্থানচ্যুতি এবং স্টেট কাউন্সিলরের ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় নাক মশাইয়ের আবির্ভাবের কথা ছেড়ে দিলেও, এ জিনিসটা কোভালিয়েভের কেন বোধগম্য হলো না যে পত্রিকার মাধ্যমে নাক হারানোর বিজ্ঞাপন দেওয়াটা ঠিক শোভন নয় ? তাই বলে আমি এটা বলতে চাইছি না যে বিজ্ঞাপনের পেছনে অর্থ ব্যয়কে আমি বাহুল্য মনে করি। ওরকমটা ভাবলে বড্ড ভুল হবে, এবং যারা অর্থের প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব দেয় আমি তাদের মধ্যেও পড়ি না, তবে এ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করা ঠিক শোভন কিংবা উপযুক্তও নয়, এটাই আমার ব্যক্তিগত মতামত।

আরেকটা রহস্যের কথা না বললেই নয়, নাকটা কী করে সদ্য সেঁকে তোলা রুটির ভেতর এল, এবং সেটা কীভাবে আইভান ইয়াকভলেভিচের কাছে গেল! নাহ ব্যাপারটা একদমই বোঝা গেল না।

কিন্তু সবচেয়ে অসংলগ্ন ব্যাপার হলো কীভাবে লেখকেরা এমন একটা ঘটনাকে তাদের গল্পের জন্য বেছে নিতে পারেন! এই ব্যাপারটা আমার বোধগম্যতার অনেক বাইরে। প্রথমত এটা দেশের জন্য কোনও মঙ্গল বয়ে আনে না, আবার কোনওরকম ক্ষতিও করে না। এতে কারও লাভক্ষতির ব্যাপার নেই। তবে কেউ যখন সেটাকে সুনিপুণভাবে উপস্থাপন করেন তখন বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এটার বিপক্ষে যত যুক্তিই আসুক না কেন, পৃথিবীতে এমন ঘটনা একদম বিরল তা বলা চলে না। হয়তো খুব কম, তবে কোথাও না কোথাও, কখনও না কখনও সেটা ঘটেছে কিংবা ঘটতে পারে।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button