আর্কাইভগল্প

গল্প : ক্ষত : মাহবুব আলী

রাত কত হতে পারে ? সঠিক আন্দাজ করা না গেলেও বোধকরি মধ্যপ্রহরের শেষভাগ। গলির মাথায় জিপ থেমে যাওয়ার শব্দ। এরপর ভারী বুটের আওয়াজ। স্টেনগান-রাইফেল ফায়ার পজিশনে নেওয়ার সেফটি ক্লিপ অন করার খট-খটা-খট। মাঈনুল হোসেন আচমকা টের পেয়ে অন্ধকারের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছেন। দেশের এমন পরিস্থিতিতে আবেগের বশে হঠকারিভাবে শহরে আসা ঠিক হয়নি। সকাল থেকে আড়ষ্ট হয়ে আছেন। এবার আতঙ্ক মাকড়সার জালের মতো সারা বুক জড়িয়ে ধরল। তিনি স্থির হয়ে উঠে বসলেন এবার। নিশ্বাসের শব্দও একদম চুপ। বুটের আওয়াজে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে, অন্তত তিন থেকে চারজন লোক হেঁটে আসছে। গলির উত্তর পাশের বাড়ির বিশাল গেট বরাবর থেমে গেল ভারী আওয়াজ। এরপর দরজায় অস্থির ঠক-ঠক-ঠক। কেউ আরও দূরে দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এল। পদশব্দ। কতগুলো কথা। উর্দু। প্রতিবেশী কয়েকটি পরিবার বিহারি বলে কিছু কিছু শব্দ, জীবনযাপনে নিত্যদিন শুনতে শুনতে শেখা হয়েছে। সুতরাং তারা কী বলে বুঝে নিতে যথাসম্ভব শ্রুতি উৎকর্ণ করে রাখেন মাঈনুল। কথা হচ্ছে অনুচ্চ-উচ্চ। অন্তত কুড়ি ফুট দূর বলে স্পষ্ট বোঝা যায় না। যা শোনা যায়, হালকা সন্দেহমূলক, এমনকি বাক্যগুলো অনুমান করা যায়, সে-সব সাজিয়ে নিলে হয়তো বোঝা যায়; কিন্তু সেই কথাবার্তায় কী ছিল ? তার সারা শরীর হিম হয়ে জমে যেতে শুরু করে। কেউ একজন জিজ্ঞেস করছে―

‘ইধার কোয়ি বাঙালি আয়া হ্যাঁয় ? মালাউন ?’

‘জি নেহি। আপলোগ কাঁহাসে শুনে ? ইধার এয়সা আদমি কোয়ি নেহি আয়া। মালুম হোতা হ্যাঁয় আউর কোয়ি গলি হোগা।’

‘নেহি নেহি পাক্কা ইনফরমেশন মিলা হামকো, আজ ইস গলি মে বাঙালি আয়া। মাজাবার কা ফৌজ।’

‘এহাঁ দু-চার ঘার বাঙালি হ্যাঁয়। শালে লোগ সব ইন্ডিয়া ভাগ গেয়া। আউর যো মহল্লে মে হাম সব বেহারি। সাচ্চা পাকিস্তানি।’

‘অ কে, তব আলাগ গলি হোগা।’

‘আচ্ছা ভাইসাব সাব্বা খায়ের। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’

মাঈনুল মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছেন। রুমের মধ্যে পুব আর পশ্চিমে দুটো খাট দুই-আড়াই ফুটের ব্যবধানে আছে। পুবের খাটে শুয়ে আছে দুই ছেলে। একজন ক্লাস নাইন। অন্যজন সেভেন। তাদের ঘুমের নিশ্বাসকেও ভয় লাগছে এখন। আতঙ্কে চিকন ঘাম জমে উঠেছে কপালে। তিনি তারপরও খুব আলগোছে খাট থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কাঠের পুরোনো জানালায় এখানে-ওখানে ছিদ্র। তারই জুতসই এক ছিদ্রপথে বাইরে দেখার চেষ্টা নিলেন। আকাশে চাঁদ নেই। নক্ষত্র বা তারাদের আলোও জোরালো নয়। আবছায়া অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না। রফিক আহমেদের হাতে বোধহয় বিশাল কৃপাণ খানিক ঝলসে উঠল মাত্র। ওই ছুরি দিয়ে ঈদুল আজহায় গরু-ছাগল জবাই করে সে। মাঈনুলের বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড দড়াম করে ঢিপঢিপ আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। খাটে বসতেও ভয় লাগছে। কেননা সেখানে মচমচ শব্দ হয়।

সকালে বেশ জোরে সাইকেল চালিয়ে আসা। গ্রামে অবস্থান আর নিরাপদ থাকছে না। যখন-তখন পাকসেনা আর বিহারি রাজাকারের হানা চলছে। তাদের হাজারও অত্যাচার। একদিন দুপুরে হামলে পড়ল সাত-আটজন। তখন কেউ কেউ গ্রামেই থেকে গেছে। পালাতে পারেনি। মহিলাদের অনেকে মাটির ঘরের কোঠায়, কেউ চাউল রাখার মাটির ড্রামে, ঘরের চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা নেয়। কেউ ঝোপজঙ্গলে। বিহারিরা ঘরে প্রবেশ করে স্যুটকেস-ট্রাঙ্ক-ব্যাগ হাতিয়ে বের করে নেয় টাকা-অলংকার ইত্যাদি। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল আর হম্বিতম্বি। বেয়োনেট দিয়ে খোঁচায়। মহিলাদের কাপড় টেনে ফেলে। শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়। মোচড় আর থাপ্পড়। মুরুব্বি বা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সামনে খামচে ধরে টেনে-হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে লাঞ্ছিত করে। সেদিন কলাগাছের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সাকিনা। এক সন্তানের মা। সহজে ধরা পড়ে গেল। সাকিনার ফরসা চেহারা ভয়ে কালো হয়ে গেছে। পরনের কাপড় ভিজিয়ে ফেলল সে। বিহারিদের পায়ে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে খুব কাঁদল। মাটিতে গড়িয়ে গেল। তার পরনের কাপড় বিস্রস্ত এলোমেলো। বুকের অনেকখানি উদোম হয়ে গেছে। কেউ এগিয়ে রক্ষা করল না। সাকিনাকে তেমন অর্ধনগ্ন অবস্থাতেই জিপে তোলা হলো। কলাগাছের ঝোপে পড়ে রইল একমাত্র সন্তান। তার কান্নার চিৎকারে ওপরঅলার আরশ কাঁপল কি না কে জানে, মানুষের চোখে-মুখে সেঁধিয়ে গেল প্রাণের ভয়; সাকিনা দু-দিনেও ফিরে এল না।

মাঈনুল হোসেন এগিয়ে দুটো কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনা আর বিহারি পুলিশ হুংকার দিয়ে অনেক গালাগাল করল। রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করতে চাইল। কেউ একজন এসে রাইফেলের বাট দিয়ে জোরে ধাক্কা মারে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। জীবনে কখনও এমনভাবে লাঞ্ছিত হন নাই। তখন তার চোখে মুত্যুভয়। তারা হয়তো মেরে যাবে, কিন্তু তেমন হয়নি; কাঁধের ওখানে ব্যথা স্থায়ী হয়ে থাকল কয়েক দিন। সেদিনই ঠিক করে নেন এখানে থাকা যা, শহরেও তাই; সুতরাং মরি আর বাঁচি গ্রাম ছেড়ে যাবেন। গ্রাম আর নিরাপদ নয়। যখন-তখন পালাতে হচ্ছে। কেউ খেতে বসেছে, স্নানে ব্যস্ত, রাতে ঘুমিয়ে বিভোর, আকস্মিক গুঞ্জন পাওয়া গেল, পাকিস্তানি আর্মি কি বিহারিরা আসছে; যে যেমন অবস্থায় রয়েছে, মাটি-কাদা খানাখন্দক ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে দৌড়ে পাশের গ্রাম বা নিরাপদ জায়গায়। মাঈনুল পরিবারের সকলকে নিয়ে কয়েক রাত নদীর পাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকলেন। এক মধ্যরাতে এমনভাবে পালিয়ে যেতে হয়। ছোট ছেলের ডায়রিয়া, বিছানায় লেপটে গেছে; তাকে প্রায় কাঁধে তুলে বেশ কষ্টে পলায়ন। এখন সবসময় আফসোস হয়, অনেকেই ভারত চলে গেল; তিনি পারলেন না কেন ? বাপ-দাদার ভিটের উপর এত মায়া! এই মায়াতেই মাথায় বিপদ আর আতঙ্ক নিয়ে শহরে আসা। ছেলেমেয়েরা গ্রামে আর থাকতে চায় না। শহরে নিজ বাড়িতে যত সুবিধা, গ্রামে সে-সব কোথায় ? সকালে টয়লেট করতে পুকুরপাড়ের ঝোপজঙ্গল নয়তো বাঁশবাগানে যেতে হয়। রাতে টয়লেটের বেগ চেপে রাখা ছাড়া উপায় নেই। বিবিধ আজগুবি পোকামাকড় আর সাপের ভয়। এ ছাড়া বড়ই অস্বস্তি আর লজ্জা! আশপাশের মানুষজন অচেনা লাগে। তারাও থাকে দূরে দূরে অনাত্মীয় চোখে।

গ্রামে পালিয়ে এসেছিলেন একাত্তরের তেরই এপ্রিল, মঙ্গলবার। উনত্রিশে মার্চ থেকে ওই দিনগুলো মুক্তিকামী মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে দিনাজপুর শহর। প্রাণের ভয় তেমন হয়তো নেই, কিন্তু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আগামী দিনে না জানি কী হয় দুশ্চিন্তায় গলা অবধি আতঙ্ক। শহরে শিডিউল কারফিউ চলছে। অবশেষে যখন তেরই এপ্রিল পাকিস্তান সেনা তিন দিক থেকে শহরে প্রবেশ করতে থাকে, বাঙালির পালানো ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই; সেও বোধকরি যুদ্ধকৌশল। অনেকে পালিয়ে গেল ভারত। মাঈনুল পালালেন উলটো দিকে। পরিবার নিয়ে রিকশা-সাইকেল আর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন চিরিরবন্দর। শাঈলি বড় মেয়ে এসএসসি দেবে, শাহেদ আর জাহেদ ছেলে দুজনও স্কুলের ছাত্র। লাইলি বেগম চোখে রাজ্যের উৎকণ্ঠা নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে―

‘এখানে যে কতদিন থাকতে হবে কে জানে! আলমারিতে সোনার চুরি কখানা আর দুল জোড়া ভুলে রেখে এসেছি।’

‘তুমি ভাবছ দুল-চুড়ির কথা! মানুষ জীবন বাঁচানোর চেষ্টায় সবকিছু ছেড়েছুড়ে দৌড়চ্ছে।’

মাঈনুল হতাশ কণ্ঠে মন্তব্য করে। দেশের এই পরিস্থিতি কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। তার চোখে-মুখে অনিশ্চিত ঠিকানার দুশ্চিন্তা রেখা। শাঈলি হাতে ব্যাগ নিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলে বসে―

‘আমরা তো সবকিছুই ছেড়ে আসলাম মা। কাল-পরশু পরিস্থিতি ঠিক হবে। আমরা ফিরে যাব।’

‘আমার গ্রাম ভালো লাগে না। কাল সকালেই বাড়ি চলে যাব কিন্তু।’

মাঈনুল ছোটছেলের কথায় আশাবাদী হলেন কিনা বোঝা যায় না। বড়ছেলে দুর্বোধ্য দৃষ্টি তুলে গ্রামের চারপাশ দেখে নিতে থাকে। গ্রাম সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই তাদের।

আজ সবুজ শ্যামল শান্তির গ্রামও আর নিরাপদ নেই। মে মাসের একদিন বিহারিরা এসে এর-ওর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল। গ্রামের দক্ষিণে রেললাইন। সেখানের কালভার্ট ব্রিজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এক দুপুরে গুড়গুড় শব্দে ট্রেন এগিয়ে আসছে। ট্রেনের মধ্যে হাজার হাজার বিহারি। তাদের কপালে সাদা কাফনপট্টি। আগুনের মশাল হাতে হাতে। তারা পাকিস্তান সেনাদের পথ দেখিয়ে চিনিয়ে দিতে থাকে। এখানে-ওখানে আগুন লাগায়। আগুনে পুড়ে যায় সবকিছু। ধানের পুঞ্জ, ঘরের চাল আর গাছগাছালি। গ্রামের মানুষজন সবাই যে যেখানে পারে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। মাঈনুল হেঁটে দৌড়ে পৌঁছালেন খুনিয়াদিঘি পেরিয়ে উত্তর ভোলানাথপুর। সেখানে কলেজের এক বন্ধু আছে। সেই রাত কোনওমতো পার হলো। পুনরায় ফিরে এলেন দক্ষিণে মাহাদানি গ্রামে। এখন সেই গ্রামও নিরাপদ মনে হয় না। এদিকে অনেকগুলো দিন আর মাস পেরিয়ে যেতে যেতে ছেলেমেয়েরা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। যথাযথ খাবার নেই, শান্তিতে বিশ্রাম নেই, পড়াশোনা নেই হাজারও সমস্যা। তাদের কে বোঝায় মানুষের জীবন কত ঝুঁকিতে আছে। যখন-তখন এখানে-ওখানে আগুন লাগানো, চলছে মারধর-হত্যা, জোর করে তুলে নেওয়া আর বিবিধ অপরাধ।

একদিন দুপুরে খেতে বসেছেন। সেও আর কী খাবার। উচ্ছে ভাজি, তেল-পেঁয়াজ কেনার টাকা নেই; কোনওমতে জংলি আয়োজন। জাহেদ মন খারাপ করে খেতে বসে না। শাহেদ ভাত মুখে তুলে পানি দিয়ে গিলছে। মাঈনুলের খুব খারাপ লাগে। এ ছাড়া করার কী আছে ? কলেজ বন্ধ। চাকরি আছে কি না কে জানে। তারপরও আশা আছে একদিন সবকিছু পুনরায় স্বাভাবিক হবে। এইসব দুশ্চিন্তা আর হতাশ ভাবনার মধ্যে শোরগোল শোনা গেল, ‘খান আইসেছে বা রে…খান আইসেছে’। তখন সকলেই যে যেমনভাবে পারে নদীপাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করল। তাদের আশপাশে ছিটকে পড়ছে পাকিস্তান সেনার রাইফেলের গুলি। মাঈনুল সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার শহরে গিয়ে দেখতে হবে; দেশের পরিস্থিতি কেমন ?

একদিন-দুইদিন করে জুন মাসের আকাশ দেখে আজ এসেছেন। গর্ভেশ্বরীর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত এসে বুকে ঢিপঢিপ শব্দ জোরালো হতে লাগল। আত্রাই পার হওয়ার পর একজনকেও দেখতে পান নাই যারা কিনা শহরের দিকে এগোচ্ছে। জেলা বোর্ডের শীর্ণ রাস্তা কেমন ভুতুড়ে আর ভয়াবহ লাগে। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে সাইকেল প্যাডেলে চাপ দিতে থাকেন। তার সাইকেলের রডে জাহেদ। শাহেদ তার সাইকেলে। এভাবে মডার্ন মোড় পর্যন্ত আসতে আসতে দেখেন, চেনা শহর বড় অদ্ভুতরকম অচেনা; মুভিতে দেখা জনমানবশূন্য ওয়েস্টার্ন নগরীর মতো। মডার্ন সিনেমা হলের ফ্রন্টে উর্দু মুভির পোস্টার। রঙ্গিলা। নবাগত নায়িকা নিশোর ছবিকে বড় করে সামনে রেখে অন্যান্য অভিনয় শিল্পীর ছোট ছোট চেহারা। যথারীতি লাউডস্পিকারে গান বাজছে। ‘কিস্নে তোরাহ্ দিল হুজুর কা।’ রাস্তায় মানুষজন কম। কতগুলো মহিলা জটলার মতো দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করছে। অনেকের হাতে তিন ফুট লাঠি আর ছোট ছোট চাকু। এইসব দৃশ্য দেখে মনে হয়, শহরে আসা ঠিক হয়নি। মাঈনুল বুকের আতঙ্ক চোখে-মুখে প্রতিভাত হতে দিলেন না। ছেলেরা ভয় পাবে।

আজ রাতে সত্যি সত্যি প্রচণ্ড আতঙ্কিত হলেন। রফিক আহমেদের সঙ্গে আর্মিদের কথা শেষ হলে একটু পর জিপ স্টার্ট নেওয়ার শব্দ হলো। তারা খুব মৃদু শব্দে চলে গেল মনে হয়। এবার মনে সাহস এনে জানালার পাল্লা একটু খুলে চাপাস্বরে ডাকলেন,―

‘রফিক ভাই…ও রফিক ভাই, ব্যাপার কী ?’

‘আপনি মালুম ক’রেছেন তা হলে! আর্মি আসলো। শোনেন একদম সাইলেন্ট থাকেন। বাতচিত ভি বন্দ্।’

‘আচ্ছা। ভাই ভয়ের কিছু ?’

‘আল্লাহ্ মালিক। আর শোনেন, কাল সুবহে সাদিকের পর চলে যাবেন। কেন যে এখুন আসলেন! সিচুয়েশন ভালো হোক তারপর আসবেন।’

‘জি ভাই।’

‘এখুন জানলা বন্ধ ক’রে রাখেন। আ রে আপনি তো ডিম লাইট ভি জ্বালিয়ে রাখছেন! বন্ধ কোরেন।’

মাঈনুল হোসেন খুব দ্রুত সুইচ অফ করে দিলেন। চারিদিকে নেমে এল ছায়া ছায়া অন্ধকার। শাহেদ উঠে পড়েছে। সে আলগোছে উঠতে উঠতে বলে―

‘বাবা বাথরুম যাব। অন্ধকার করে রেখেছ কেন ?’

‘আন্দাজে আন্দাজে যা বাবা। আর্মি এসেছিল। আমি তোমাদের কত বোঝালাম, মানুষজন আগে যাক, খবর-টবর নিই তারপর না হয়…তোমরা তো কথাই শোনো না।’

শাহেদ ফিসফিস শব্দের অর্থ বোঝে। সে পা টিপে টিপে বারান্দা ধরে পশ্চিমে এগিয়ে গেল। মাঈনুল পেছনে এসে পুনরায় চাপা গলায় নির্দেশ দিলেন, ‘বাবা উঠানে নামার দরকার নেই। ওদিকে আর যাস না। এখানেই মুতু কর।’

শাহেদ ঘরের পশ্চিম পিলারের ওখানে বসল। উঠানের সবটুকু জুড়ে লম্বা লম্বা ঘাস আর অচেনা গুল্মলতা। কে জানে কোথায় কোনও সাপ লুকিয়ে আছে কিনা। সাপ নাকি রাতের বেলায় খাবারের সন্ধানে বেরোয়। সবজান্তা সিরিজ বইয়ে এসব পড়া হয়। তার বই পড়ার নেশা। এই কয়েক মাস পর এসে আলমারি আর বইয়ের অবস্থা দেখে কান্না-কান্না চেহারা। বইগুলো এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেকগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। যা একবার নষ্ট হয়, সেটা আগের মতো আর ভালো করা যায় না।

মাঈনুল হোসেন পরদিন খুব সকালে রওয়ানা দিলেন। এবার শহরের খালপাড়া বা মেথরপট্টির রাস্তা দিয়ে বালুবাড়ি মহারাজা স্কুলের মোড় হয়ে কুমারপাড়া। সেখানে আর্মি চেক পোস্ট। বটগাছের নিচে ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো ট্রেঞ্চ করে বালুর বস্তা দিয়ে ঘেরা সীমানার উপরে ভারী মেশিন গান। সেটির ম্যাগাজিনে রোল হয়ে ঝুলে আছে চকচকে কার্টিজ। মাইনুলের হৃৎস্পন্দন বাড়তে শুরু করল। একজন আর্মি সিভিল ড্রেসে রাস্তার মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা দেখে সহজে বোঝা যায়, এই লোক পাঞ্জাব বা বেলুচিস্তানের। তার হাতে বেতের একটি স্টিক। চোখের দৃষ্টি বড়ই সন্দিগ্ধ। স্টিকের ইশারায় থামতে হুকুম দেয়। মাঈনুল সাইকেলে ব্রেক দিতে দিতে পিছলে পড়ে গেলেন প্রায়। ব্রেকের রবার ক্ষয় হয়ে গেছে। লোকটি কোনও কথা না বলে স্টিক দিয়ে সপাং শব্দে জোরে আঘাত করল। মাঈনুলের পিঠে আগুন ঝলসে উঠল যেন। উহ্ বা আহ্ কাতরধ্বনি করার উপায় নেই।

‘কিঁউ কুচে কিদার ভাগতে হো ? ইস ব্যাগ মে কেয়া হ্যাঁয় ? গ্রেনেড ? খোলো খোলো জলদি।’

মাঈনুলের বাঁ-পায়ের ত্বক ছড়ে গেছে। সাইকেল থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে প্যাডেল ঘষে এই অবস্থা। সেদিকে না তাকিয়ে ব্যাগ খুলে দেখাতে শুরু করেন। কয়েকটি বই। রবিঠাকুরের সঞ্চয়িতা, টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস আর নেয়ামুল কোরআন। বইগুলো উঠোনের স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এসবের মধ্যে পরনের কাপড়। তিব্বত টুথপেস্ট আর বোরোলিন ক্রিমের কিছু ব্যবহার করা টিউব। এগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। যে কয়েকদিন শহর মুক্ত এবং বাঙালি নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন ভারতীয় বোরোলিন কেনা। এখন সেটাই গ্রেনেড বা মাইনের মতো আতঙ্কিত করে তুলল। এই আর্মি যদি লেবেল পড়ে দেখে তবে রক্ষা নেই। পাকিস্তান সেনার বেশিরভাগই নাকি অশিক্ষিত বা থ্রি-ফোর পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করে। শোনা কথা। তারা তাই নিষ্ঠুর এবং জল্লাদ। কথা সত্য না মিথ্যা কে জানে। পাঞ্জাবি হাতের স্টিক বাতাসে ঘোরোতে ঘোরোতে জিজ্ঞেস করে,―

‘তুম কেয়া জব করতে হো ? আউর ইধার কাঁহা যায়েগা ?’

‘জি স্যার, হাম কলেজ মে ইংলিশ পড়াতা হ্যাঁয়। ইয়ে দো লেড়কে মেরা বেটা আছে। ইস নজদিকি মে মেরা বহেন কা ঘর। দোদিন ছুট্টি মানানে…।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক হ্যাঁয়।…ইয়ে কিতাব ক্যায়া হ্যাঁয় ?’

‘কলেজকা স্যার। নেয়ামুল কোরআন।’

‘আচ্ছা আচ্ছা মুসলিম হো। আব ভাগো ইঁহাছে।’

মাঈনুল সবসময় আশঙ্কায় থাকলেন যে কখন স্টিক আবার সপাং করে পিঠে আছড়ে পড়ে। তারপর বেশ ধীরস্থির, কিন্তু দ্রুত ব্যাগের জিপার টেনে কিছু দূর হেঁটে এসে সাইকেলে উঠলেন। এখন এখান থেকে পালাতে পারলেই মুক্তি। অনেকখানি পথ একটানে ছুটে এলেন। আত্রাইয়ে পানি বেড়েছে। এবার সাইকেল কাঁধে তুলে নদী পার হতে হবে। আশপাশে চারিদিক ফসলের ক্ষেত। কোথাও কোথাও ইরি আবাদ চলছে। যুদ্ধে তো পেটের ক্ষুধা বন্ধ হয়ে থাকে না। তিনি এতক্ষণে ক্ষুধার সাড়া পেতে শুরু করলেন। ছেলেদের মুখেও কিছু পড়েনি। তাদের শুকনো চেহারা দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। বাবা এখন অসহায়। কী করতে পারেন তিনি ?

নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে পুনরায় ফিরে এলেন শহরে। রেডিওয় শোনা যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের এখানে-ওখানে গেরিলা আক্রমণ করে প্রায় আশি শতাংশ ভূ-খণ্ড দখল করে ফেলেছে। পাকিস্তান আর্মির পরাজয় নিশ্চিত। তারা এই পরাজয় মুহূর্তে মরণকামড় বসাতে পারে। গ্রামে গ্রামে অত্যাচার-নির্যাতন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। গ্রামে থাকা আরও বিপৎসংকুল। শহর যে নিরাপদ তেমন নিশ্চয়তা নেই। তারপরও পাকিস্তান সরকার সকলের প্রতি ফিরে আসার আহ্বান করে চলেছে। রেডিওয় চলছে মুহুর্মুহু প্রচার। কেউ কেউ ভারত থেকে চলেও এসেছে। মাঈনুল সেই আহ্বানে আস্থা রাখবেন কিনা দ্বন্দ্বে ছিলেন। তার আরও সমস্যা, পেট ভরে তো দূরের কথা, সারাদিন একমুঠো খাবার ঠিকমতো জোটানো যাচ্ছে না। কাজ নেই। ইনকাম নেই। কলেজের চাকরি আছে কি না সেও অজানা। এইসব ভাবনার ঘোরে থেকে থেকে আল্লাহ্ ভরসা বুকে নিয়ে সপরিবারে চলে এলেন। প্রতিবেশী বিহারি পরিবার সেবার রাতে নিরাপত্তা দিয়েছে। এই গল্প লাইলি বেগম শুনেছেন। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক। সকলেই শুনেছে। বোধকরি একটু ভরসা আসে। সবকিছু আল্লাহ্র দয়া ও রহমত। প্রতিবেশী হলো উপলক্ষ। আর এ হলো তাদের প্রতিদান। যেমনভাবে কিনা তেরই এপ্রিল, মঙ্গলবার, পাকিস্তান আর্মি যখন শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুক্তিযোদ্ধারা কৌশল হিসেবে পিছু সরছে; তখন কোথাও কোথাও বাঙালি বিহারি মারামারি শুরু হয়। মাঈনুল সহজ সরল মানুষ। তিনি প্রতিবেশী পরিবারের বারো চোদ্দোজন মানুষকে এদিক-ওদিক লুকিয়ে থাকবার সুযোগ করে দিলেন। তারপর রাস্তায় নেমে সাইকেলে ওঠার আগে অনুরোধ করা হলো। যতদিন ফিরে আসা না হয়, আল্লাহ্র রহমতে বেঁচে থাকেন, তবে বাড়িঘর দেখে রাখবেন। সেই বাড়ির কিছু নেই। দেয়ালের কাঠামো একলা দাঁড়িয়ে উপহাস করে মাত্র।

একনাগাড়ে গ্রামে অবস্থান, আর্থিক সংকট এবং অন্যান্য সমস্যার মধ্যে বাড়ির চিন্তা হয়। কোনওকিছু সঙ্গে আনতে পারেন নাই। সময় বিষকাঁটা দংশনের মতো পেরিয়ে যায়। সকলে মিলে বেঁচে থাকতে পারবেন কি না, কবে শেষ হবে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনো, অস্বস্তিকর হাজারও দুশ্চিন্তায় সারাক্ষণ দিশেহারা থাকতে হয়। জুন মাসের শেষে মেঘলা দিনে বাড়িঘরের অবস্থা দেখার আকাক্সক্ষা তীব্র হয়েছিল। তাই এসেছিলেন। সকল জিনিসপত্র লুট হয়ে গেছে। উঠান আর এখানে-সেখানে পড়ে আছে বই। সেগুলোর বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বনেদি ঘরানার বিশাল আলমারি ভেঙেচুরে শেষ। কাঠের নতুন জানালা দুটো খুলে নিয়ে গেছে। দরজা আধভাঙা। যুদ্ধ বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সময়ে কেউ বেঁচে থাকতে প্রাণ নিয়ে এদিক-ওদিক পলায়ন করে। কেউ সুযোগের ব্যবহারে মাতোয়ারা হয়। যে পরিবার দুটোকে তেমন ভয়ংকর দিনে আশ্রয় দিলেন, তাদের বাড়িতেই দেখলেন চেনা তোষক-বালিশ-তৈজস আর অন্যান্য জিনিসপত্র; একটুও শব্দ করতে পারলেন না। এখন শুধু নিশ্চুপ দেখে যাওয়া সময়। বিহারিরা ঠেলাগাড়িতে লুটের মালামাল এনে নিজ নিজ বাড়িতে জমা করছে। চেহারায় অন্যরকম জেল্লা। ইরশাদ, অলি হাসান, নবি হাসান, মুন্না, মিন্টু আর কে কে, তাদের তেমন চেনেন না। সবাই দামি দামি পোশাক, হাতে ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস পরে অস্থির পায়ে এদিক-ওদিক বড় ব্যস্ত ঘুরে বেড়ায়। তাদের চোখের দৃষ্টিতে কুটিল অভিসন্ধি আর ভয়ংকর দাপট খেলা করে। মাঈনুল বোধকরি বোঝেন। এমনই হয়। তিনি চুপচাপ দেখে যান। এখন সময় খারাপ। কোনও শব্দ করা যাবে না। বিহারিদের বক্রহাসি শুধু উপহাস করে। কোথাও বুঝি শয়তানি লুকোচুরির ফাঁদ। মাঈনুল আতঙ্কে থাকেন। পারতপক্ষে বাইরে বেরোন না। একদিন খুব ভয় পেলেন। ইরশাদ সেদিন বিকেলে জিজ্ঞেস করে―

‘আঙ্কেল, আপনার লাড়কি মেট্রিক দিলো ?’

‘বইপত্র নষ্ট হয়ে গেছে বাবা। কীভাবে পরীক্ষা দেবে ?’

‘আ রে আঙ্কেল, ইম্তেহান কে লিয়ে পড়নে হোগা! কিতাব ফাঁড়কে লিখতে হবে।’

‘সেই কিতাবই তো পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানপাট বন্ধ।’

‘সহি বাত্। আপ ফির্ক না করে, হামি কিতাব জোগাড় কোরবে।’

শাঈলি জানালা দিয়ে দেখে। কথোপকথন শোনে। তার ফরসা চেহারা পাণ্ডুর হয়ে যায়। ইরশাদের মুখভঙ্গি সুবিধের নয়। মাঈনুল দুশ্চিন্তায় দিশা পান না। শেষে এ কোন রাজ্যে এলেন! ছেলেদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না। সারাক্ষণ বিবিধ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উদ্ভ্রান্ত করে রাখে। একদিন সুযোগ বুঝে তবু কলেজে গেলেন। শিক্ষকের সংখ্যা নগণ্য। কোথায় ছাত্র, কোথায় হাজিরা রেজিস্টার; কিছুই নেই। শেষ বিকেলে একদিন গণেশতলা যেতে লিলিমোড় হয়ে জেলরোড এসে কী ভেবে পুবের রাস্তায় এগোলেন। খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম হল অ্যান্ড পাবলিক লাইব্রেরি (বর্তমান নাম: হেমায়েত আলী হল অ্যান্ড লাইব্রেরি) খোলা। দোতলায় আলো দেখা যায়। নিউজপেপার রুমে তিন-চারজন কাগজ পড়ছে। চেনা মুখ। মুনশিপাড়ার বিহারি। এরা বেশির ভাগই ভারতের বিহার-কাটিহার আর অন্যান্য জায়গা থেকে আগত রিফিউজি। আজ এরা বাংলাদেশের প্রভু। মাঈনুল বুকের মধ্যে সীমাহীন ক্ষোভ আর জ্বালা নিয়ে ঘরে ফিরলেন। সারারাত যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারলেন না। কী করবেন এখন ?

ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখ, শুক্রবার। পাকিস্তান আক্রমণ করে বসল ভারত। দেশের পরিস্থিতি অন্যরকম হতে শুরু করেছে। তারপর ছয় তারিখ, সোমবার, ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ হয়ে গেল অন্যরকম। মাঈনুল ভয়ে ভয়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি আর বিহারিরা আবার বাঙালি নিধন শুরু করবে না তো ? কোনওসময় গোপন স্বপ্ন দেখেন। সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের পতাকা। তার কেন্দ্রে নতুন রাষ্ট্রের সীমানা রেখা জ্বলজ্বল করছে। সেই পতাকা নিজ হাতে পুনরায় ঘরের ছাদে উত্তোলন করছেন। আবার এও আশঙ্কা আসে। দেশ স্বাধীন হবে তো ? এমন দোলাচলের একরাতে দরজায় অস্থির টোকা। রাতের কোন সময় জানা নেই। আকাশে চাঁদের আলো। মাঈনুল আলগোছে দরজা খুলে বেরোলেন। ইরশাদ, নবি হাসান, অলি হাসান, মুন্না আর কে কে আবছায়ায় চেনা যায় না। তারা প্রায় ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে।

‘ক্যায়া প্রফেসর সাব, আপনা লাড়কিকো বুলাইয়ে, বারাত আয়া হ্যাঁয়, আভি শাদি মুবারক হোগা।’

‘শাদি! এসব কী বলছ ইরশাদ ?’

‘আ বে ইয়ে বুড্ডা কুছ সমঝতা নেহি। উস্ সে বুলাও।’

‘দেখেন স্যার, ইরশাদ ভাইয়া আপনার মেয়েকে পছন্দ্ কোরে। হামরা ওর সঙ্গে শাদি দেবে। এক্ষুনি।’

‘আমার মেয়ে ছোট। পড়াশোনা করে। বড় হোক তারপর চিন্তা করব।’

‘নবি ভাইয়া, ইয়ে শালে প্রফেসার বাত নেহি সমঝতা। ওর বেটি আভি ভি ছোটি আছে। হা হা হা! শালি কো দেখতে হোবে, মাল বড়া না বাচ্চি।’

‘হামরা সবাই শাদি কোরবে বুঝলেন। ওর মাকে ভি। বাহুত মাজা কোরব।’

‘এসব কি নোংরামি ইরশাদ! তুমি শরিফ ফ্যামিলির ছেলে। প্লিজ তোমরা যাও। কাল সকালে বাতচিত করব।’

‘আ বে নবি হাসান, কেনো ইয়ার্কি কোরছিস ? স্যার আচ্ছা আদমি হ্যায়। হা হা হা! আপনি ভোয় পাবেন না স্যার। ডরাবেন না।’

‘আপনার লাড়কি কো ডাকেন। একটু দেখে যাই। কেমুন মাল ? ইরশাদ শালে দিওয়ানা হোয়ে গেছে।’

‘সে নাই। ওর আন্টির বাসায় গেছে কাল।’

‘ইসোব বাত শুনবে না স্যার। এক্খুনি শাদি হোবে। নবি হাসান কালমা পড়াবে। কি বে তুই কালমা পড়াতে জানিস তো ? হা হা হা!’

‘আ বে সব জানতে হ্যাঁয়। আজ মাকে আউর বেটিকে ভি পেলব । বাহুত মাজা হোবে। মাদারচোদ বাঙালি।’

এরপর আর কথা থাকে না। লাইলি বেগম পাশের ঘর থেকে উঠে এসেছে। শাহেদ-জাহেদের পেছনে শাঈলি থরথর করে কাঁপছে। ঘরের উজ্জ্বল আলো বুঝি দপ করে নিভে গেল। বাইরের আবছায়া অন্ধকার হামলে ঘিরে ধরল চারপাশ। শাহেদ কাউকে কিছু বুঝে উঠবার সুযোগ না দিয়ে একছুটে দৌড়ে ইরশাদের বুকে দমাদম ঘুষি মেরে বসল। এদিকে ধস্তাধস্তি আর বিভীষিকাময় চিৎকার আর্তনাদে ভারী হয়ে গেল সময়। মাঈনুল আচমকা ধাক্কা খেয়ে একপাশে ছিটকে পড়লেন। শাহেদ মেঝেতে গোঙাতে শুরু করেছে। তার গলা থেকে নেমে এসেছে রক্তের স্রোত। নবি হাসানের হাতে রক্তমাখা ড্যাগার। আবছায়ায় দেখা যায় রক্তের রং কালচে লাল। মাঈনুল তখনও হতবিহ্বল উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। আকস্মিক তার চোখে-মুখে এক গমক উষ্ণতা এসে পড়ল। রক্তের স্বাদ নোনতা। কেউ মাথায় আঘাত করল এ সময়। মাঈনুল জ্ঞান হারালেন। তারপরের ঘটনা অন্ধকার। তামসিক আঁধারে কোনও বোধ থাকে না। শেষবার শ্রুতিতে শুধু বজ্রপাত হয়ে ধাক্কা দেয় এক অসহায় ডাক অথবা কী ? অচেনা আকুতি। অন্ধকারের দেয়ালে সব ভেসে যায়। আর্তচিৎকার।

‘বাবা!’

একাত্তরের চোদ্দোই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, দিনাজপুর শহরের অবস্থা যখন আরও থমথমে, না জানি কী হয় কী হয়, ঠিক তখন রাত সাড়ে নয় বা দশটার দিকে এক পাগলকে ইকবাল স্কুলের পশ্চিমে রাস্তার ওপারে ডোবাপুকুরে নেমে যেতে দেখা যায়। সেখানেই পড়ে থাকে। কয়েক দিন পর আকাশে-বাতাসে বিজয়ধ্বনি ঝংকার তুলে জেগে ওঠে। ভারতীয় ট্যাংক আর বিভিন্ন রকম সামরিক যান শহরের রাস্তা কাঁপিয়ে প্রবেশ করছে। কোনও কোনও ট্যাংক, ট্রাক আর জিপের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের উল্লাস। তাদের হাতে থাকা অস্ত্রের মুখে আগুন ঝলসে দেওয়া গগনবিদারী আওয়াজ। কারও বুকে সবকিছু ফিরে পাওয়ার উদগ্র বাসনা। মুক্তির অনাবিল আনন্দ। তখন সকালের আলোয় সেই পাগল নির্বিকার-নিস্পৃহ পুকুরের হাঁটু বা কোমর পানিতে নেমে বারবার ডুব দিতে থাকে। তার শরীরের সকল পর্যায়ে নোংরা গন্ধ পুরীষময় হতে থাকলেও খেয়াল থাকে না। সে একজন পাগল মাত্র। কপালের উপর কালসিটে ফোলা দাগ। তার পরনে একটি ছেঁড়া-আধছেঁড়া প্যান্ট বই কিছু নেই। শরীরের শুকনো কোমরে নেমে এসেছে ঊর্ধ্বভাগ, দুপুরের মতোই উৎকট নাভি, তার দু-চোখের ভাষাও কেউ পড়তে পারে না। সেখানে মৃত্যুর মতো অন্তর্যামী গভীর ক্ষত বা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আগুন। কারও চোখে পড়ে, পড়ে না। তাকে চিনে নেয় একজন যুবক। সে তার ছাত্র। শিবলি সাদিক। মুক্তিযোদ্ধা।

জোহর নামাজ শেষের সময়, ডিসেম্বর মাসের মেঘলা-কুয়াশা আকাশ, কখনও রোদ, বাতাসে শীত, ভারতীয় বিশাল যানগুলো তখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে ধেয়ে চলছিল, কোথাও আবার দু-একটি পুবে লিলিমোড় এগিয়ে যেতে থাকে, পাগল তখনও পুকুরের ময়লা-আধময়লা ঘনীভূত সবুজাভ প্রচণ্ড শীত পানিতে ডুবছে আর উঠছে। কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দুটো হাত তুলে বিড়িবিড় ফরিয়াদ। তার কান্না গোঙানোর মতো আর্তনাদ। মিহি সুরে প্রলম্বিত হতে থাকে। পরক্ষণে আবার হাসি-অট্টহাসি। পুকুরের দক্ষিণে বাড়ির উত্তর দেয়াল বেয়ে নেমে আসা বরই গাছ। সেটির মতো আকণ্ঠ পিয়াসি আর নতজানু একজন, জীবনের সকল ক্লেদ ধুয়ে মুছে উঠতে চাইছে; কিন্তু সে পারছিল না।

তেরই এপ্রিল, মঙ্গলবার, শিবলি হাজারও মানুষের সঙ্গে দিগি¦দিক-দিশেহারা ভারতীয় সীমান্তের দিকে প্রাণ নিয়ে রাধিকাপুর পালিয়ে যায়। বাবা-মা আর ছোট দুই ভাইবোনসহ আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। সেখানে কতদিন, দিনের মধ্যে দিন গড়াতে গড়াতে একদিন ট্রাকে বসে চলে যায় দেরাদুন। মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। শরণার্থী শিবিরে মা-বাবা-ভাইবোনের খোঁজ নিতে সময়-সুযোগ আর সক্ষমতা থাকে না। এরপর যুদ্ধের ময়দান। কত ঘটনা কত কাহিনি। তারপর ষোলোই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ঢাকার রেসকোর্স (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী) ময়দানের খোলা প্রান্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. কে. নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন। শত্রুমুক্ত হলো দেশ। নিজের স্বদেশভূমি। শিবলি সেদিন সন্ধেয় ফিরে আসে দিনাজপুর শহরে। প্রিয় ঠিকানা। একসময় দলের ক্যাপ্টেনকে অনুরোধ করে ছুটে যায় মিশন রোড। বাবা-মা কেউ তখনও ফিরে আসেনি। তাদের শান্তির নীড় ঘরবাড়ি দেখে বুকের মধ্যে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠে। উঠানের সবটুকুতে ঘাস আর বিবিধ গুল্মলতায় ভরে গেছে। কোনও আসবাব নেই। এমনকি সে বছর জানুয়ারি মাসে বেশ কিছু টাকা খরচ করে বসানো নতুন দরজা-জানালাও খুলে নিয়ে গেছে লুটেরারা। এসব লুটেরা ছিল বিহারি। উনিশ শ সাতচল্লিশ সালে দেশভাগের পর হাজারে হাজারে বিহারি বা উর্দুভাষী মানুষজন এই বাংলাদেশে চলে আসে। এদের ভাষা-জীবনযাপন ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। অথচ দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে শুধু মুসলমান বলে হাজার মাইলের ব্যবধানে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান। এরা কোনওকালেই বাঙালির বন্ধু ছিল না। এরা হলো পাকিস্তানের দোসর। এরাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালিদের বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা-ধর্ষণ বিবিধ অপরাধ করেছিল।

শিবলি পরদিন সকাল এগারো কি বারোটার সময় ষষ্টিতলা মোড় হয়ে দলের সঙ্গে একত্র হতে পথে নামে। একবার সাধ হয় শাঈলির সঙ্গে দেখা করার। কেমন আছে সে ? সেই বাড়িতে কেউ নেই। উদোম প্রান্তরের মতো বীভৎস পড়ে আছে। তারা সম্ভবত ফিরে আসেনি। সে আবার রাস্তায় নেমে আসে। এভাবেই দেখা পায় পাগলের। শিবলি মৃত্যুর মতো থমথমে ভয়াবহ রাস্তায় আসতে আসতে সেই ডোবাপুকুরে তাকিয়ে বিস্মিত হয় বটে, তবে পাগলে কিনা করে ভেবে চলে যেতে পা বাড়িয়েও কী ভেবে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যুদ্ধে অনেক কিছু হয়। হাজারও ঘটনা মানুষের জীবন এলোমেলো করে দেয়। এই কয়েক মাসে প্রত্যেক মানুষের জীবনে অনেক অনেক ঘটনা হাজারও পরিবর্তন এনে দিয়েছে, যেভাবে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম আর দক্ষিণ-এশিয়ার মানচিত্রের পরিবর্তন। শিবলি অনেকক্ষণ তাকিয়ে অবশেষে একই সঙ্গে হতবাক এবং প্রচণ্ড দুঃখিত হতে থাকে। সে রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে নেমে যায় ডোবাপুকুরের দিকে।

‘স্যার ? স্যার…স্যার ?’

তার চিৎকার পাগলের শ্রুতিতে পৌঁছে না অথবা বিশ্বাস করে নেওয়া যায়, সেই জিজ্ঞাসার জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা উদ্দিষ্ট মানুষের নেই। শিবলি কী করবে, কিছু করা যায় কিনা ভেবে নিয়ে জড়িয়ে চেপে ধরে। পাগলের শরীরের নোংরা দুর্গন্ধে বাতাস বিবমিষার মতো উগড়ে উঠতে চায়। তখন আরও কয়েকজন মানুষ পুকুরের উপরে রাস্তায় জড়ো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে পাগলকে চিনতে পারে। তখন গুনগুন ফিসফিস প্রকারান্তরে জোর আওয়াজে রূপান্তরিত হতে থাকে। কেউ তবু নিচে নেমে আসে না বা যায় না। শিবলির কাঁধে তখনও একটি রাইফেল হয়তোবা ভয়ার্ত করে রেখেছে পরিবেশ। পাগলের নাম মাঈনুল হোসেন, কলেজের শিক্ষক; সকলেই শেষমেষ শনাক্ত করে নেয়। যারা জানে না, জেনে নেয়; কিন্তু কীভাবে এমন ঘটনা হয়েছে ? সেই গল্প রচনা হাজারও কাহিনির মতো শুরু হয় তখন। অকথিত গল্পের কিছু কি কল্পনা নাকি অবাস্তব ? এ রকম শত শত কাহিনি আড়ালেই থেকে যায়। যে জানে সে বোঝে, যুদ্ধ কারও কারও জীবনে চরম নিষ্ঠুর ক্ষতের সত্য গল্প রচনা করে দেয়। সেই ক্ষত কাহিনি বড়ই নির্মম। কেননা তেমন ক্ষত কখনও শুকায় না। কখনও কখনও সেই ক্ষত দিনযাপনের হাজার কাব্যকথায় আচ্ছাদিত থেকেও দগদগে আগুনের মতো ঝলসে ওঠে। আর…

অনেক মানুষ অন্য কারও বুকের ক্ষত উপলব্ধি করতে পারে না।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button