আর্কাইভগল্প

গল্প : বাবুই পাখির কান্না : আব্দুল বারী

দুদিক থেকে তালগাছটি দেখা যায়। দক্ষিণের ঘরের জানালা দিয়ে, আবার ঘরের পাশেই ছোট বৈঠক বারান্দা থেকে। সুজান ঘরে খাটের উপর শুয়ে শুয়ে, কখনও বৈঠকখানায় সোফায় বসে গাছটি দেখে। আসলে গাছটি নয়, গাছে ঝুলতে থাকা বাসাগুলিকে দেখে। বাবুই পাখির বাসা। আর তাদের ব্যস্ততা। সারা দিন পাখিগুলোর ব্যস্ততা কমে না। সেই বাসা বানানোর সময় থেকে এখন পর্যন্ত। এখান থেকেই সুজান বুঝতে পারে বাসায় ছানা আছে। এখন ভরা সংসার। পাখিগুলোর মুখে এখন আর সুন্দর করে চেরা খেজুর পাতা বা ঘাসের শির থাকে না। অন্য কিছু থাকে। হয়তো খাবার। এখান থেকে বোঝা যায় না। ঝুলতে থাকা বাসার নলের মতো সরু মুখ দিয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে যায় পাখিগুলো। কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে আসে। কী অপূর্ব দক্ষতা। অনেকটা লম্বা ঝোলা মুখ তবু কী অনায়াসে ঢুকে যায়। বাবুইয়ের বাসা দুই রকমের। একটা বাসা উল্টানো বাটির মতো। নিচের দিকে মাঝ বরাবর লম্বা বার দেওয়া। তাতে বসে থাকা যায়। ওখানে বসে পাখিগুলো বিশ্রাম নেয়। এটা বিশ্রামঘর। তবে একটি বাসায় দুটির বেশি পাখি থাকে না। সব আপন আপন বাসা। বিশ্রামঘর ছাড়া আরেকটি বাসা থাকে লম্বা মুখের আর একপাশ একটু থ্যাবলানো। এখানে ডিম পাড়ে,  ছানা তোলে। ছানা বড় করে। সুজান সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে।

সেদিন সুজান দেখে, দুটো লোক হাতে মাপনি ফিতা নিয়ে তালগাছটার পাশের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে। ফিতা দিয়ে সামনের জায়গা মেপে নিচ্ছে। পেছনে আরও একজন। হাতে কাগজ কলম। মনে হয় মাপজোক লিখে নিচ্ছে সে। লোক দুটো অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ ঘুরে ঘুরে জায়গাটার মাপ নিল। সুজান দেখেছে কয়েক দিন আগে একটা দুধ-সাদা স্করপিও গাড়ি রাস্তাটার ওই দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে ঠেস দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল দুজন লোক। আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। লোকগুলোকে  সুজান চিনতে পারেনি। এ তল্লাটে তাদের কখনও দেখেছে বলেও মনে হয় না। সেদিনের লোকদুটির মধ্যে আজ একজন আছে । তার হাতে কাগজ-কলম। লোকগুলো আবার ফিতা দিয়ে জায়গাটা মাপতে মাপতে তালগাছের পাশের ঝোপটা পেরিয়ে পোড়োবাড়িটার কাছে চলে যায়। তারপর বাড়িটার আড়াল হয়।

সেই কতকালের পুরনো বাড়ি। সুজান এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে দেখছে বহু পুরনো একটা কাঠামো। মোটা মোটা থাম আর পুরু দেওয়ালের কড়িকাঠ দেওয়া মজবুত গড়নের বাড়ি। বহুদিন মেরামত ও রঙ করা না থাকায় পলেস্তারা খসে পড়ছে। ছাদের কার্নিশে, দেওয়ালে বট-পাকুড় গাছ জন্মেছে। বেশ কিছু লতাপাতা দেওয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেছে। জানালার পাল্লা খসে পড়েছে। কেউ হয়তো কয়েকটি খুলে নিয়ে গেছে। বিরাট বাড়িটা কেমন খাঁখাঁ করে। সুজানের বিয়ে হয়ে এখানে আসা তাও প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল। প্রথম প্রথম বাড়িটার তাও কিছুটা শ্রী দেখেছে। সামনেটা একটু পরিষ্কার ছিল। যত দিন গেছে সময় থাবা বসিয়েছে বাড়িটার শরীরে।

 কারা এই লোকগুলো ? এতকাল পর কেন এত জরিপ ? কিছুই বুঝতে পারে না সুজান। সুজানের ছয় বছরের নাতি আয়ান এসে পাশে দাঁড়ায়। সেও ঠাম্মার মতো প্রতিদিন তালগাছ দেখে, পাখি দেখে। দূরের ওই পোড়োবাড়িটা দেখে। ঠাম্মাকে কত কিছু জিজ্ঞাসা করে। বাবুই পাখির ব্যস্ততা তার বড় ভালো লাগে। আয়ান তালগাছটার দিকে আর সুজান পোড়োবাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।

আয়ান ঠাম্মাকে বলে, ঠাম্মা ঠাম্মা, ওইগুলো পাখিদের বাড়ি। ওদের নিজের বাড়ি। 

ঠাম্মা কেমন এক উদাস গলায় বলে, হ্যাঁ, ওগুলো ওদের নিজের বাড়ি।

একদিন দুপুরে এই ছোট বারান্দার সোফায় বসে সুজানই আয়ানকে বাসাগুলো দেখিয়ে বলেছিল,  ওগুলো পাখিদের বাড়ি। নিরাপদ আশ্রয়। এই এটা যেমন আমাদের।

ঠাম্মা, পাখিরা আমাদের মতো খায়, ঘুমায় ?

হ্যাঁ, খায় তো।

আমার মতো বাচ্চা  আছে ? তাদের বাবা-মা ?

সব আছে।

ওদের মা আদর করে ?

খুব আদর করে বাবা। খুব আদর করে। বলতে বলতে সুজান ছোট আয়ানকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। আয়ান কালো কালো দুটো টানা টানা চোখ মেলে তালগাছে ঝুলতে থাকা বাসাগুলো দেখতে থাকে। তার চোখ মনে হয় বাসা ভেদ করে পাখিদের সংসারের অন্দরমহলে চলে গেছে। সে যেন দেখতে পাচ্ছে কোনও বুড়ো বাবুই একটা  ছানাকে খুব করে আদর করছে।

লোকগুলো তালগাছটি থেকে ফুট দশেক দূরে পায়ে চলা সরু রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসে। রাস্তার উপর ওঠে। রাস্তা থেকে বাড়িটা প্রায় একশো মিটার দূরে। এই বড় রাস্তাটি এখন ঢালাইয়ের। পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত মোরাম ঢালা রাস্তা ছিল। উত্তর-দক্ষিণে বয়ে যাওয়া রাস্তাটির দক্ষিণ মাথায় পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে থেমেছে নদীঘাটে। আর উত্তর মাথায় বিশ কিমি দূরে ছোট টাউন। নদীঘাটের ওপারে তেমন  জমজমাট বাজার-হাট নাই। সবই গাঁ গ্রাম। তাই রাস্তায় লোক চলাচল খুব বেশি নয়। তবে এখন ঢালাই রাস্তা হওয়ায় টোটো, অটো চলে। একটু চঞ্চলতা এসেছে।

লোকগুলো রাস্তায় উঠে উত্তর মুখে হাঁটতে থাকে। দক্ষিণের ছোট বারান্দা থেকে সুজান যদিও দেখতে পায় না তাদের। তবু অনুমান করে একটু দূরে সেদিনের সেই সাদা গাড়িটি হয়তো দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় তিন বিঘা জায়গার উপর বাড়িটি। তবে সব জায়গাজুড়ে বাড়ি নাই। চারপাশে অনেকখানি করে জায়গা রেখে বাড়িটি তৈরি। বাড়িতে মালিক যখন বাস করত তখন ওই জায়গাগুলোতে বিভিন্ন ফল-ফুলের গাছ ছিল। চারপাশ অনুচ্চ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এখন ঝোপঝাড় আর আগাছার জঙ্গল। দু-চারটে ফলের গাছ এখনও আছে। বাড়িটার উত্তর দিকে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা খান দশেক ঘর। একতলা। বাড়ির কাজের লোক, কামলা, ঝি, চাকর থাকার জায়গা ছিল এগুলো। বাড়ির মালিক চলে যাওয়ার পর সেগুলো ফাঁকা পড়েছিল। সুজানের তখন এ বাড়িতে সবে বছর কয়েক আসা হয়েছে। দুটি পরিবার কোথা থেকে এসে বসবাস শুরু করে ওই একতলা ঘরগুলোতে। ছিন্নমূল মানুষ। কোথাও থেকে হয়তো তাড়া খেয়ে এসেছে। এ বাড়ির মালিকের সঙ্গে লতায় পাতায় একটু পরিচয় ছিল। তাই এখানে এসে ওঠে। সুজান শুনেছে পরে নাকি এরা ওই বাড়ির মালিকের কাছ থেকে খানিকটা জায়গার দলিল পত্র ওদের নামে রেজিস্ট্রি করে নিয়ে এসেছে।

সেই থেকে পরিবার দুটি ওখানেই বাস করে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে কয়েকটি ঘর নিয়ে তাদের জগৎ। এই ক বছরে পরিবারের লোকজন বেড়েছে। বড় বাড়ির পাশের যে চাকরদের থাকা লম্বা প্লটটি ছিল এখন সেটা  তাদের দখলে। কোনও হইচই নাই, উৎসব নাই। নীরবে দিনপাত করে। সুজান বাড়ির ছাদে উঠে মাঝে মাঝে দূর থেকে তাদের নিরানন্দ সংসার দেখে। ছোট ছোট বাচ্চা হামা টেনে বা ছোট ছোট পায়ে অগোছালো উঠানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এক পাশে খড়ের গাদা, গোয়ালবাড়ি, ছাগল, গরু, মুরগি সব থিক থিক করছে।  মাঝের এই রাস্তা আর ঝোপঝাড়ের সীমানা পেরিয়ে ওরাও কোনওদিন সুজানের কাছে আসেনি, সুজানও কোনওদিন যায়নি। তবু দূর থেকে কেমন একটা আত্মীয়তা থেকে গেছে অনুভবে। ময়লা খাটো কাপড় পরা ক্ষয়িষ্ণু যৌবনের মেয়েরা এই পথ দিয়ে কোথাও গেলে চোখাচোখি হয়। তবে কথা হয় না। বাড়ির মরদরা সারা দিন কোথায় কোথায় খেটে বেড়ায়। সাঁঝ আঁধারে বাড়ি আসে।

কয়েক দিন পর আবার সাদা গাড়ি আসে। একটি নয়, দুটি গাড়ি। বেশ কয়েকজন গাড়ি থেকে নামে। একজনের হাতে একগুচ্ছ কাগজ। তালগাছটার কাছে এসে দাঁড়ায় তিনজন। কয়েকজন পায়ে হাঁটা পথ ধরে বাড়িটির দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে তারা সবাই ফিরে আসে। তারপর চলে যায়।

ওই নিরানন্দ পরিবারের দুজন বয়স্ক নারী-পুরুষ আসে সুজানদের বাড়ি। এই প্রথম এল তারা। চোখে মুখে চরম উদ্বেগ। দারুণ এক আতঙ্ক। বৈঠক বারান্দায় বসে তারা একটা হলদে হয়ে আসা দলিলের ভাঁজ খোলে। সেটা মেলে ধরে সুজানের স্বামীর সামনে। বলে, দেখুন তো বাবু, এতে আমাদের নাম আছে কিনা ?  ভালো করে দেখুন। সোনামনি সরকার আর রতন সরকারের নাম আছে কিনা ? থাকবে তো, থাকতেই হবে। বড়কর্তা তো উকিলের সামনে এই দলিলে আমাদের নাম লিখে দিল। বলল, রতন, এই লিখে দিলাম, যা তোরা পূর্ব-পশ্চিম একতলা বাড়িগুলোতে বাস করগে। সেই থেকে আমরা বাস করছি। ওরা এসে বলে কিনা এসব ওরা কিনে নিয়েছে। সব ওদের। বড়কর্তা সেই কবে মরে গেছে। তার বেটা, নাতিরা নাকি সব বেচে দিয়েছে। আমাদের জায়গা, বাড়িঘর কি করে বেচে বলুন তো ?

সুজান ও তার স্বামী কাগজটা নিয়ে দেখে দাতা অমরেন্দ্র চৌধুরী, গ্রহীতা সোনামনি সরকার ও রতন সরকার। আরও সব নানা বয়ান লেখা। দাগ-খতিয়ান সবই আছে। তবে অংশের ঘরে পরিমাণটা নিতান্তই কম। হয়তো তিন বিঘা ওই বাড়ির জায়গার অনেকগুলো দাগ আছে। তার কোনও একটি ছোট অংশ এদের নামে লিখে দিয়েছে। এখন পুরনো কাগজপত্র আর ম্যাপ বের করে ওই ছোট্ট অংশটি খুঁজে বের করতে হবে। সেটা কোন দিকে তা দেখতে  হবে। তবে বোঝা যাবে ওদের প্লটটি ঠিক কোন জায়গায়।

লোকগুলো এক বুক হতাশা নিয়ে ফিরে যায়। কেমন বিমর্ষ বেদনা ক্লান্ত মুখ। কোথা থেকে একদিন ভেসে এসেছিল। হয়তো বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি ত্যাগ করে এসেছিল। আসতে বাধ্য হয়েছিল। তারপর এখানে এসে শিকড় গেড়েছিল। সেই শিকড় এবার উপড়াতে চলেছে। আবার ভেসে যেতে হবে। নিরাশ্রয়ের যন্ত্রণা বুক পেতে নিতে হবে। বড় করুণ দেখায় মুখগুলো।

মানুষগুলো কদিন খুব ছোটাছুটি করে। অনেকের কাছে যায়। সুজান বারান্দা থেকে সব দেখতে পায়। তারা একটু আশ্বাসবাণী শুনতে চায়। পঞ্চায়েত থেকে বিডিও অফিস, বিএলআর ও অফিস সবার দ্বারে দ্বারে ঘোরে। ঠাঁইটুকুর বন্দোবস্ত চায়।

কিন্তু পেরে উঠবে কি ? এদের কথার মূল্য দেবে কে ?  উপর মহলের অনেক দূর পর্যন্ত ওদের চেনাজানা। নেতা-মন্ত্রী সব ওদের হাতে। আর এসব ছা-পোষা মানুষদের হাত বড় ছোট হয়। দলিল থাকলেও মাটি থাকে না।  দখল হয়ে যায়। ক্ষমতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়।

সুজান ভেতর ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা বোধ করে। কোনও কিছু মন দিয়ে করতে পারে না। ভেতরে কোথাও যেন একটা ভাঙনের শব্দ শুনতে পায়। মাথার উপর দিকে কেমন একটা চাপ ধরে থাকে। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। খিদে হয় না। মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। একটা কুয়াশামাখা মুখ। কাছ থেকে  দেখেও স্পষ্ট কিছু দেখতে পেত না। একটা তরল বেদনা মায়ের মুখে জড়িয়ে থাকত। একদিন ভরা সংসার ফেলে চলে আসতে হয়েছিল তাদের। মা সেই যাতনা ভুলতে পারেনি কোনওদিন। আফসোস করত মানুষটা। ফেলে আসা বাড়ির কত কথা বলত। মাটি মানুষের আশ্রয়। সেই মাটি না থাকলে মানুষ নিরাশ্রয়। তাই মাটির জন্য মানুষ কাঁদে। মাটিহারা মানুষ দেশ হারা হয়। মা হারাও। এক খণ্ড নিজস্ব মাটির সঙ্গে নাড়ির যোগ থাকে। সুজানের মায়ের সেই যোগ কেটে গিয়েছিল। তাই সারা জীবন বেদনার কুয়াশায় ডুবে থাকত মা।

সুজান বড় হয়ে বুঝেছে সারা পৃথিবী জুড়ে ছিন্নমূল মানুষের স্রোত নিরন্তর বয়ে চলেছে। এই বহমানতা সেই আদিম কাল থেকে চলে আসছে। এখনও থামেনি। বরং দিন দিন বাড়ছে। আদিম মানুষ জীবিকার তাগিদে ছুটে বেরিয়েছে এক ভূমি থেকে আরেক ভূমিতে। এক অরণ্য থেকে আর এক অরণ্যে। এখন মানুষ প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ধর্ম, রাজনীতি আর ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পড়ে ঘরহারা হচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে চলেছে ধর্ম আর রাজনীতিকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা দখলের লড়াই। ছিন্নমূল হচ্ছে লাখো লাখো মানুষ। খবরের কাগজ, টিভিতে এসব মানুষের কথা শুনে চোখ ভিজে যায় সুজানের। গৃহহারা মানুষদের কথা শুনলে মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সুজানের মাথার ভেতরও বেদনার কুয়াশা ছেয়ে যায়।

কয়েক দিন পরে একটা সাদা গাড়ির সঙ্গে একটা জে সি পি আসে। তালগাছটার গোড়ার মাটি সরিয়ে দেয়। তারপর ধাক্কা দিয়ে গাছটাকে সশব্দে মাটিতে উপড়ে ফেলে। বাবুই পাখির বাসাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। কিছু বাসা পাতার সঙ্গে লেগে থাকে। আর কিছু মাটির উপর গড়াগড়ি খায়। আকাশে বাবুই পাখিগুলো মাতম শুরু করে। অস্থির চিৎকার আর কান্নায় ভেঙে ভেঙে পড়ে তারা। পাক দিয়ে নেমে আসে মাটিতে পড়ে থাকা বাসার উপর। থ্যাঁতলানো ছানার উপর। কোনও কোনও ছানার এখনও পালক গজায়নি। নীলচে চোখের পাতার নিচে মোটা মোটা কালো চোখ। পাতলা চামড়ায় ঢাকা মাথা। ধান ফুলের মতো হলদে ঠোঁটের কষা বেয়ে লাল রক্ত ঝরছে। কারও ছোট নরম বুক মাটির আঘাতে চুপসে গেছে। কেউ উপরের দিকে ঠোঁট দুটো হাঁ করে মরে আছে। বড় ভয়ানক সে দৃশ্য। মা পাখিদের বিরামহীন কান্না আর নিষ্ফল প্রতিবাদ বাতাসকে আরও করুণ করে তোলে।

আয়ান একবার ছুটে গিয়ে দেখে আসে। লুটিয়ে  থাকা বাবুই বাসা, থেঁতলে যাওয়া ছানা আর বাবুইয়ের কান্না দেখে তার কান্না থামে না। একটা ভয়ানক মৃত্যুকে হাতের তালুয় করে নিয়ে আসে। সুজানের শাড়ির আঁচল ধরে বুক ফেটে কাঁদতে থাকে। আর জিজ্ঞাসা করে―ঠাম্মা, তুমি যে বলেছিলে, ওটা ওদের নিজের বাসা, আপন ঘর, তাহলে ভাঙলো কেন ? বলো কেন ভাঙলো ? ছানাগুলো থেঁতলে পড়ে আছে কেন ? বলো না ঠাম্মা, বাবুই পাখি কাঁদে কেন ? হাতে ধরা মৃত ছানাটি সুজানের সামনে তুলে ধরে আর বারবার জানতে চায় একই প্রশ্নের উত্তর।

সুজান অস্ফুটে বলে, গরিব, দুর্বল আর সংখ্যালঘুদের কোন নিজস্ব মাটি থাকে না আয়ান। নিজের বাড়ি বলে তাদের কিছু হয় না। প্রতিদিন তাদের মরতে হয়। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে সরে সরে যেতে হয় অন্য প্রান্তে। তুমি এখন এসব বুঝবে না আয়ান, বুঝবে না। আর বলতে পারে না, চোখ ঢেকে আসে বাষ্প।

জেসিপি এগিয়ে যায় বাড়িটার দিকে। বাবুই পাখি আর একদল নারী-পুরুষের আহাজারি বাতাসে পাক খেতে থাকে।

 সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button