আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুসরণকারী : হুলিয়ো কোর্তাসার

বিশ্বসাহিত্য : নভেলা

স্প্যানিশ থেকে বাংলা অনুবাদ : জয়া চৌধুরী

[উপন্যাসটি কোর্তাসার ১৯৫৮ সালে রচনা করেন। আগ্রহী পাঠকেরা জানেন তিনি সংগীতে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। বিপপ সংগীতের স্রষ্টা ইউএসএর স্যাক্সোফোন বাদক চার্লি পার্কারের চরিত্র মাথায় রেখে এই উপন্যাসের নায়ক জিমি কার্টারকে সৃষ্টি করেন। ধ্রুপদী জ্যাজ সংগীতে আধুনিকতার হাওয়া নিয়ে আসে এই বিপপ জ্যাজ। এই বইয়ে জ্যাজসম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এবং বাস্তবের খ্যাতনামা শিল্পীদের নিয়ে এসেছেন তিনি। সুররিয়াল রীতিতে লেখা নভেলাটি অনেক বিদগ্ধ সমালোচক কোর্তাসারের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ১৯৬৩ সালে লেখা Rayuela বা Hopscotch অর্থাৎ এক্কাদোক্কার সমতুল্য বা আরও ভালো লেখা বলেন।]

এ কাজ তো প্রায়ই করি―উৎফুল্ল হয়ে বললাম।

তোকে এত শান্ত দেখাচ্ছে। আমি পারি না, ব্রুনো। এক দিন রাতে আমি সব ছুড়ে ফেলেছিলাম, সবকিছু। টেবিলের ঐ প্রান্তে একজন জাপানি ভদ্রলোক বসেছিলেন, ছুরিটা প্রায় তাঁর চোখে গিয়ে লাগছিল আর কী। ওটা লস এঞ্জেলসের ঘটনা। এত বিশ্রী ঘটনা ছিল… ওদের যখন সব ব্যাখ্যা করে বললাম তখন ওরা আমায় জেলে পুরে দিল। সবকিছু এত সহজ করে ব্যাখ্যা করে দিলাম তবু করল। সেবার আলাপ হয়েছিল ডক্টর ক্রিস্টির সঙ্গে। দারুণ একজন মানুষ। আর ডাক্তারবাবুদের মধ্যে…

বাতাসে একটা হাত ছুড়ল জনি। চারদিকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে লাগল। যেন তার চিহ্ন ছেড়ে যাচ্ছে সব জায়গায়। হাসি পেল। মনে হচ্ছিল ও একলা, একেবারে একলা। পাশে বসে নিজেকে স্রেফ একটা গর্ত মনে হচ্ছিল। জনির যদি মাথায় চাপে তাহলে আমার দিকেও হাত চালাবে। আমাকে মাখনের মতো কেটে ফেলতে পারে ও। ধোঁয়ার মতো কাটতে পারে। হয়তো সে কারণেই মাঝে মাঝে আমার মুখে ব্রাশ বুলানোর মতো করে হাত বুলায়, সাবধানে।

তোর রুটি টেবিলক্লথের ওপরে আছে―জনি শূন্যে আঙুল তুলে বলে―বেশ কড়া বস্তু ওটা। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সুন্দর রঙ, অপূর্ব সুগন্ধ। ওটা এমন একটা কিছু যা আমি নই। একটা আলাদা ব্যাপার, আমার চেয়ে আলাদা রকম কিছু। কিন্তু যদি ওটা ছুঁয়ে দিই, আঙুল বাড়িয়ে দিই, জাপটে ধরি, তাহলে কিছু একটা বদলে যাবে। তোর মনে হয় না ? রুটি আমার থেকে অনেক বাইরে রয়েছে। কিন্তু আমি আঙুল দিয়ে ওটা ছুঁই। ওটা অনুভব করি। বুঝি ওই হলো পৃথিবী। কিন্তু আমি যদি ছুঁয়ে দেখি আর অনুভব করি তাহলেও তখন সত্যি সত্যি বলা যাবে না যে ওটা অন্য কিছুও হতে পারে! নাকি তুই বিশ্বাস করিস না এভাবে কথা বলা যায় ?

ডিয়ার, হাজার হাজার বছর আগে বহু তাবড় তাবড় জ্ঞানী মাথা ফুটো করে ঘামিয়েছেন সমস্যার সমাধান খুঁজতে।―মানুষের দিন দাঁড়িয়েই থাকে রুটির ওপর―মুখ ঢেকে বিড়বিড় করতে থাকে জনি―আমি ওটা ছোঁবার সাহস করলাম। দু টুকরা করে ফেললাম। মুখে পুরে দিলাম। কিস্যু হলো না। জানি তো; ওটাই তো ভয়ংকর। খেয়াল করে দেখলি যে কিস্যু হলো না ? এটা ভয়ংকর ব্যাপার তো। রুটি দুই টুকরা করলি, চামচ দিয়ে গাঁথলি, আর বাকি সবকিছু আগের মতোই পুনরাবৃত্ত হলো। এগুলো কেন ? আমি বুঝি না এসব, ব্রুনো।

জনির মুখ-চোখ, ওর উত্তেজনা আমাকে ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে ফেলতে শুরু করল। যতবার জ্যাজ প্রসঙ্গে, ওর স্মৃতি নিয়ে, ওর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে যাই, ওকে বাস্তবে নিয়ে আসতে চাই, ততবার প্রসঙ্গটা শুরু করাই কঠিন হয়ে পড়ে। (বাস্তবে―শব্দটা লেখামাত্র আমারই কেমন অদ্ভুত লাগছে। জনি ঠিক বলেছে, বাস্তব এমন হওয়া উচিত নয়। জ্যাজের সমালোচনা করা বিষয়টা বাস্তব হতে পারে না। কেননা সেক্ষেত্রে কেউ একজন থাকবে যে আমাদের চুল টেনে ছিঁড়বে। তবে একই সঙ্গে জনিও তো এভাবে চলতে পারে না। আমাদের সমস্ত পাগলামি তো শেষ করতেই হবে।)

এখন ও ঘুমিয়ে পড়েছে। কিংবা হয়তো অন্তত চোখ দুটো বুজেছে। তাই ঘুমিয়েও পড়েছে। আরেকবার খেয়াল করে দেখলাম আমার পক্ষে ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে এটা জানা যে, কী করছে জনি, জনি নিজেই-বা আসলে কে। ও কি ঘুমায়, ওকে কি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখা যায়, ও কি ঘুমে বিশ্বাস করে ? বন্ধুরা যেমন হয় জনি তার চাইতে ঢের দূরের, ঢের অন্যরকম মানুষ। অন্য কেউ ওর চেয়ে এত অশ্লীল হতে পারবে না, এত সাধারণও হতে পারবে না। জীবনের সবকিছুর সঙ্গে এতখানি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে পারবে না। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুর সঙ্গে এত চলাচল বজায় রাখা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আপাতদৃষ্টিতে ও মোটেই ব্যতিক্রমী কোনও মানুষ না। যে কেউ জনির মতো হতে পারে। বরাবরই সহজেই বিশ্রী অসুখে পড়ে যেতে পারে, চক্রান্তকারীর মতো মন নিয়ে। আবার অনিচ্ছা করেই এসব করে যেতে পারে। অথচ কবিতা আর প্রতিভায় ভরপুর। আপাতদৃষ্টিতে। আমার জীবনটা কেটেছে প্রতিভাবানদের কদর করে। পিকাসো, আইনস্টাইন, তালিকার যত মহান মহান সন্ত আছে, এক মিনিটেই যাদের নাম গড়গড় করে বলে ফেলে মানুষ (গান্ধী, চ্যাপলিন, স্ত্রাভিন্সিক)। মেঘের ওপর দিয়ে যারা চলাচল করেন তাদের মধ্যে যে কোনও মহান ব্যক্তিকেই কদর করবার জন্য সবসময় প্রস্তুত। এদের কারও কোনও কিছুই অদ্ভুত মনে হবে না। এরা আলাদা। এদের দেখে ডিগবাজি খাবারও কিছু নেই। উলটোদিকে জনির সবেগ আচরণে পার্থক্যটা গোপন। এর রহস্য থাকার কারণেই বিরক্তিকর। কারণ জনির আচরণের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। জনি এমন কোনও প্রতিভাধর নয়, কোনও কিছু সে আবিষ্কারও করেনি। জ্যাজ বাজায় যেরকম আরও হাজারো সাদা বা কালো মানুষ বাজান। যদিও তাদের সকলের চাইতে বেশি ভালো বাজায়। এখানে বুঝে নেওয়া দরকার যে বাজনা ব্যাপারটাও শ্রোতাদের সমর্থনের ওপরেই নির্ভর করে। কী ফ্যাশনের পোশাক পরবে, কোন সময়ে অনুষ্ঠান করবে… সংক্ষেপে সেসব কিছুই শ্রোতা দর্শকদের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণ স্বরূপ পানাসসিয়ের কথা বলি। পানাসসিয়ে দেখল যে জনি সোজা কথায় একজন বদ শিল্পী। আমরা অবশ্য বিশ্বাস করি খোলাখুলি যে, বদ আসলে পানাসসিয়ে নিজে। এমন বহু বহু বিষয় খোলাখুলি বিতর্কিত বিষয় বলা যায়। এসব কিছু এটাই প্রমাণ করে যে জনি অন্য কোনও দুনিয়ার লোক নয়। (এক্ষেত্রে পানাসসিয়েই বরং প্রথম অচেনা ব্যক্তি)। জনিকে যদি এমন কথা ওরা বলে তাহলে ও হয়তো হো হো করে হেসে উঠবে। আমি ভালো করেই জানি ও কী কী ভাবে। এসব বিষয় নিয়ে কীভাবে বাঁচে। আমি বলছি এসব নিয়ে যে ও বাঁচে, তার কারণ জনি… তবে ওরকম হবে না। আসলে নিজেই নিজের কাছে যা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইছি তা হলো জনির সঙ্গে আমাদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যার কোনও অবকাশই এখানে নেই। মনে হয় এসবের ফলে সবচেয়ে মূল্য যাকে চোকাতে হয়েছে সে হলো জনি নিজেই স্বয়ং। এসব ব্যাপার আমাদের মতো ওকেও বেশ সমস্যায় ফেলছে। ওদের পরক্ষণেই বলতে ইচ্ছে করবে যে জনি আর সব মানুষের চেয়ে আলাদা… দেবদূতের মতো, যতক্ষণ না প্রাথমিক সততাবোধ ওদের শব্দটা গিলে ফেলতে বাধ্য করে। সুন্দর এক পালটি খাওয়ায়। হয়তো এটাই চিনিয়ে দেবে যে জনি দেবদূতেদের মধ্যে থাকা একমাত্র  মানুষ, সব অবাস্তবের মধ্যে থাকা একমাত্র বাস্তব। হয়তো এজন্যই জনি আঙুল দিয়ে আমার মুখটা ছুঁয়ে দেখছিল। ব্যাপারটা আমায় এত অসুখী করে তুলছিল, এত কাচের মতো স্বচ্ছ দেখিয়ে দিচ্ছিল ওর কাছে নিজেকে। আমার সুস্বাস্থ্য, আমার বাড়িঘর, আমার বৌ, আমার প্রতিষ্ঠা সবকিছু এত সামান্য করে তুলছিল। সবচাইতে সামান্য করে তুলছিল আমার প্রতিষ্ঠা। সবার ওপর তো আমার প্রতিষ্ঠা।

তবে এ তো বরাবর হয়। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। জুতার ফিতাও ঠিক করে বাঁধা ছিল না। পথে নেমে পড়লাম। সেই সময় এমন মনের অবস্থা যে আমি যে কোনও কিছু করতে পারি। রুটি তখন বলদের মতো আকাশে গোলপানা চক্কর কাটছে, ফিরে ফিরে ঘুরে আসছে। বেচারা জনি, বাস্তবের চাইতে এতখানি দূরে থাকে ও। (এটাই তো, এটাই তো। এটাই তো হয়―নিজেকে এরকম বোঝানো আমার পক্ষে ঢের সহজ। এখন যখন আমি একটা ক্যাফেতে বসে আছি, হাসপাতালে দু ঘণ্টা ভিজিট করে এসেছি জনিকে, ওপরে যা যা কিছু আমি লিখেছি সবকিছুই জোরে লিখেছি, মনে হচ্ছে আমি যেন কোনও অভিযুক্ত আসামি। নিজের সঙ্গে অন্তত সামান্য হলেও ভদ্রতা তো করতেই পারি।)

সৌভাগ্যক্রমে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার দিয়ে আগুন আয়ত্তে আনা গেছে। যেটা ভাবা একেবারে খাপে খাপ হয়ে যায় সেটা হলো আগুন আয়ত্তে আনার জন্য মারকেসা নিজে তার কর্তব্য করেছিল। দেদে আর আর্ট বউকাইয়া খবরের কাগজের অফিসে এসেছিল আমায় খুঁজতে। তিনজন ভিক্সে গেলাম ঐ সংগীত শুনতে এখন যেটা বাজারে খুব বিখ্যাত―কিন্তু তখনও সেটা গোপন ছিল―আমোরোউস ডিস্কটা। ট্যাক্সিতে দেদে আমায় বলেছিল মারকেসা কী রকম অনিচ্ছুকভাবে জনিকে আগুনের বিপদ থেকে টেনে বের করেছিল। মুলতা হোটেল (আগেই টাকা মেটানো হয়ে গেছিল, রু লাংরাজ হোটেলের। ওখানে যত আলজিরিয়ানরা থাকছিলেন তাদের কাছে আর পাশের হোটেলের (যেটা তিকা আগেই বুক করে রেখেছিল) বাসিন্দাদের কাছে এই আগুন লাগার ঘটনাটা সাঙ্ঘাতিক এক বিপর্যয় ছিল। জনি যেমন বিরাট এক সুন্দর বিছানায় শুয়ে আবোলতাবোল প্রলাপ বকছিল, মাঝেমাঝে প্যারিস ম্যাচ আর নিউ ইয়র্কার সংবাদপত্র পড়ছিল, মাঝে মাঝে ওর বিখ্যাত পকেট নোটবই যেখানে ডিলান টমাস আর কবিতা বা অসংখ্য পেন্সিলে লেখা নোটস ছিল সেগুলো গুলিয়ে ফেলছিল পত্রিকার সঙ্গে… এসব কিছুই হতো না যদি না আগেই ওকে আগুন থেকে সরিয়ে আনা হতো।

এসব সংবাদ শুনে আর রাস্তার কোণের ক্যাফে থেকে এক কাপ কনিয়াক নিয়ে আমরা অডিশন রুমে জাঁকিয়ে বসলাম আমোরোউস আর স্ট্রেপ্টোমাইসিন রেকর্ড দুটো শুনতে। আর্ট অনুরোধ করল আলো নিভিয়ে দিতে। কারণ মেঝেয় শুয়ে শুনলে আরও ভালো শোনাবে। তখন জনি সেখানে ঢুকল। গলা দিয়ে সুর ভেজে তার মিউজিক শোনাল। ওখন ওখানে ঢুকল বটে অথচ ও কিন্তু হোটেলে বিছানায় শুয়েছিল। পনের মিনিট ধরে মিউজিক শুনিয়ে আমাদের একেবারে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। বুঝলাম আমোরোউস যে প্রকাশ হতে চলেছে সেটাই ওকে রাগিয়ে তুলেছে। কেননা দোষটা ডিস্ক শুনলে যে কেউ বুঝবে। কিছু লাইনের শেষে চলতে থাকা সেই সুরের ঝাপট নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করা, আর তারপর সবার উপরে সংগীতের শেষটায় এক বন্য অবরোহণ। ভোঁতা ও সংক্ষিপ্ত সুরটা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যেন কারও হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, যেন তা রুটির ভিতর চেপে বসা এক ছুরির কোপের মতো (কদিন ধরে জনি রুটির কথা বলছে)। পরিস্থিতির বদল এমন যে জনি আমাদের কাছে যা ভয়ংকর সুন্দর ও তার কাছ থেকে পালাচ্ছিল। এই বদল থেকে, উদ্বেগজনিত প্রশ্নের হাত থেকে, কিংবা মরিয়া অঙ্গভঙ্গির থেকে পালানোর ইচ্ছা এবং তার জন্য সব দিকই খোলা রয়েছে বলে জনি বেরনোর ঠিক পথটা খুঁজছিল। জনি বুঝতে পারছে না (কারণ ওর কাছে যা বিপুল ব্যর্থতা, আমাদের কাছে সেটাই পথ, অন্তত পথের ইশারা)। আমোরোউস ডিস্ক আসলে জ্যাজ সংগীতের ক্ষেত্রে এক বিপুল মুহূর্ত। জনির বড় আকাক্সক্ষার এই রেকর্ড। যতবার শুনছিল ততবার ভেতরে ভেতরে ওর শিল্পী সত্তা রাগে উন্মাদ হয়ে উঠছিল। রাগারাগি করতে করতে ও মিউজিক নিয়ে আসলে কিছু বলতে চাইছিল। হাত পা ঠুকছিল, মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়লে সেটা সামলানোর চেষ্টা করছিল। ও যা বিশ্বাস করে সেসব কথা প্রকাশ করতে গিয়ে আরও বেশি বেশি একা হয়ে যাচ্ছিল। এটা কৌতূহল উদ্দীপক। সে কথা শোনা প্রয়োজন যদিও সবকিছুই একত্র হয়েছে আমোরোউস ডিস্কে। আমি লক্ষ করে দেখলাম জনি পরিস্থিতির কোনও শিকার নয়। সবাই যেরকম মনে করে জনি ঠিক সেভাবে নির্যাতিত নয়। আমি ওভাবেই আমার আত্মজীবনীতে লিখেছি (নিশ্চিত ইংরিজি সংকলনে এটা পাওয়া যাচ্ছে আর কোকাকোলার মতোই সে সংকলন বিক্রিও হচ্ছে)। যদিও এখন জানি ব্যাপারটা এরকম নয়। অনুসৃত হওয়ার বদলে জনি নিজে অনুসরণ করছে। ওর জীবনে যা যা কিছু ঘটছে তা হলো শিকারির ভাগ্য, কোনও নিগৃহীত পশুর ভাগ্য নয়। কেউ জানতে পারবে না জনি কীসের পিছনে ছুটছে কিন্তু বিষয়টা ওরকমই। ওটা ওখানেই রয়েছে আমোরোউস ডিস্কের মধ্যে, ওর মারিজুয়ানার মধ্যে, এত সব বিষয় নিয়ে বলতে থাকা এমন অসম্ভব প্রলাপের মধ্যে, প্রলাপ আবার চাগিয়ে ওঠার মধ্যে, ডিলান টমাসের নোটবইয়ের মধ্যে… সবকিছুর মধ্যে বেচারা হলো জনি। এটাই ওকে বিশাল করে তুলেছে, ওকে জীবন্ত এক অসম্ভব কিছু করে তুলেছে। এক এমন শিকারি করে তুলেছে যার হাত নেই, পা নেই। এক এমন খরগোশে পরিণত করেছে যে ঘুমন্ত সিংহের পিছনে তাড়া করেছে। আমি দেখি মানে সংক্ষেপে বলতে চাই আমোরোউস শুনবার পরে ভেতরে ভেতরে আমার বমি করতে ইচ্ছে করেছিল। মনে হচ্ছিল এভাবে হয়তো ওটার থেকে মুক্তি পাব। ওটার ভেতরে যা যা ছিল সবকিছু আমার অথবা বাকি সকলের বিরুদ্ধে যায়। হাত-পাবিহীন সেই কালো স্তূপ, সেই উন্মত্ত শিম্পাঞ্জি ওর আঙুল দিয়ে আমার সারা মুখে চলাচল করেছে, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছে।

আর্ট আর দেদে আমারোউসের ঘোষিত সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছু দেখেনি। (মনে হয় ওরা দেখতে চায়ওনি) তাছাড়া দেদের বেশি পছন্দ হয়েছে স্ট্রেপটোমাইসিন রেকর্ডটা। ওখানে জনি অনায়াসে নিজের সহজ ভঙ্গি আরও উন্নত করে দেখিয়েছে। পাবলিক যা বোঝে তা হলো নিখুঁত হলো কি না। আমার যা মনে হয়েছে জনির ক্ষেত্রে সে হলো বেশ ভালো রকমের ব্যতিক্রম। সে সংগীত নিজের খেয়ালে বইতে দিয়ে নিজে অন্য জায়গায় থেকে যায়। পথে দেদেকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর পরিকল্পনা কী ? বলল জনি খুব কমই হোটেল ছেড়ে বেরোয়। (এখনকার মতো পুলিশও ওকে বের হতে না করেছে)। ও যা যা চেয়েছে সেগুলো রেকর্ড করে এক নতুন ডিস্ক বের করলে ওরা ভালো টাকা দেবে। আর্ট সহ্য করে জনির মাথায় যত রকমের আইডিয়া কিলবিল করে সবকিছু ও শোনে। ও আর মারসেল গাভোতি নতুন করে কাজ করবে একসঙ্গে জনির সঙ্গে। যদিও গত কয়েক সপ্তাহের পর আর্টের সঙ্গে আর সবকিছু নেই যদিও। তাছাড়া আমার দিক থেকে মনেও করি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিউ ইয়র্কে ফিরে একজন এজেন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলা দরকার। অতিরিক্ত হিসেবে যা যা ঘটছে সবই তো বুঝি, বেচারা ছেলেটা।

তিকা খুব ভালোভাবে সবকিছু শেয়ার করছে―দেদে বেশ প্রশংসা করে বলে উঠল―হ্যাঁ। আসলে ওর পক্ষে বিষয়টা এত সহজ। সবসময় শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছায়। ব্যাগ খোলা আর সবকিছু ঠিক করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু জানে না। বদলে আমি…

আর্ট আর আমি আমরা দেখিনি। ওকে আমরা কী বলতে পারি ? মেয়েরা জনি বা জনির মতন মানুষের চারপাশে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে জীবন শেষ করে দেয়। এটা বিচিত্র কিছু নয়। জনির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে গেলে মহিলা হবার কোনও দরকার নেই। কঠিন হলো একজন ভালো উপগ্রহের মতো, একজন ভালো সমালোচকের মতো পালা বদলাতে গেলে ওর থেকে দূরত্ব না বাড়িয়ে পারা যায় না। আর্ট তখন বাল্টিমোরে ছিল না। কিন্তু জনির সঙ্গে যখন আলাপ হয়েছিল তখন আমার সেই সময়ের কথা মনে পড়ত। ও তখন লান আর অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকছিল। লানকে দেখে খারাপ লাগত। কিন্তু জনির সঙ্গে একটা ঋতু কাটানোর পর, ওর মিউজিকের সাম্রাজ্য একটু একটু করে গ্রহণ করবার পরে, ওর দিনের আলোর সম্পদ, যেসব ঘটনা ঘটেইনি তার অসম্ভব সব ব্যাখ্যা পেয়ে, হঠাৎ করে ওর বড্ড নেতিয়ে নরম হয়ে যাবার দশা দেখলে তবেই কেউ বুঝতে পারত লান কেন ওরকম মুখ করে থাকে। অন্যরকম মুখ করে থাকাটা ওর পক্ষে কেন এত অসম্ভব ছিল। কেনই-বা সে মাঝে মাঝে জনির সঙ্গে থাকত। তিকা আরেকটা ব্যাপার। সে আবার অশ্লীলতার ট্র্যাক থেকে পালিয়ে যেত। বিপুল জীবন থেকে পালিয়ে যেত। তার ওপর ওর পাছায় ডলার ছিল, গুলিভরা বন্দুকের চাইতে সে বস্তু ঢের বেশি কার্যকরী। অন্তত আর্ট বউকাইয়া যখন তিকার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বিরক্তি প্রকাশ করত অথবা ওর মাথা ব্যথা করত তখন সে এসবই বলত।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসবেন―দেদে আমায় অনুরোধ করল―আপনার সঙ্গে কথা বলতে ওর ভালো লাগে। 

আগুন নিয়ে ওকে জ্ঞান দিতে পারলে আমার ভালো লাগত (আগুনের কারণে, যে ব্যাপারে ও নিশ্চিত করেই দক্ষ) কিন্তু সেটা এতটাই নিরর্থক হবে জনির ক্ষেত্রে। জনিকে যদি বলা যায় আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে তাহলে তা যতখানি নিরর্থক লাগবে এটা ঠিক সেরকম নিরর্থক ব্যাপার। ওই সময়ের জন্য সবকিছু ঠিকঠাক যাচ্ছিল। কৌতূহলী (ও অস্থির) বলে জনিকে ঘুরে ঘটা কোনও ঘটনা খুব কমই ঠিকঠাক চলে। আর তখন সেসব দেখে আমিও দারুণ তৃপ্ত হয়ে থাকি। এখন সত্যি বলতে কী আমি এতটাও সরল নই যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেব। এটা স্থগিত করলেই ভালো হয়। মানে এক রকমের একটা রেহাই। মুখের সঙ্গে নাক আটকে থাকাটা যেভাবে অনুভব করি, ঠিক সেরকমভাবেই ভালো করে ব্যাপারটা অনুভব করছি। আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কেবল আমিই এটা অনুভব করছি দেখলে অবশ্য রাগ হয়। আমিই সবসময় কষ্ট পাচ্ছি এ কথা ভাবলে রেগে যাই। আর্ট বউকাইয়া, তিকা, দেদে খেয়াল করছে না যে প্রতিবার জনিই কষ্ট পাচ্ছে। কখনও জেলে যাচ্ছে, কখনও বা অন্যকে মারতে চাইছে, বালিশে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, কিংবা হোটেলের প্যাসেজ দিয়ে নগ্ন হয়ে দৌড়ুচ্ছে। ওদের সঙ্গে লেপটে রয়েছে, একেবারে যেন মরে যাচ্ছে―এসব ব্যাপারস্যাপার দেখলে আমার রাগ হয়। যারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেন অথবা মানবতার খারাপ দিকগুলো ধিক্কার জানিয়ে ভারী ভারী প্রবন্ধ লেখেন তারা এসব জানেন না যে পৃথিবীর পাপ ধুতে গেলে শূন্যে পিয়ানো বাজানো যেমন অর্থহীন, ঠিক সেরকমই অর্থহীন এসব। বেচারা স্যাক্সোফোন বাজিয়ে! স্যাক্সোফোন বাজিয়ে শব্দটার মধ্যে যেমন অদ্ভুত এক অসম্ভাব্যতা রয়েছে; যত সামান্যই তা হোক না কেন ও আসলে অসংখ্য বেচারা স্যাক্সোফোন বাজিয়ের মধ্যে অন্যতম একজন বাজিয়ে শুধু।

সবচেয়ে খারাপ হলো ব্যাপারটা যদি এভাবেই চালিয়ে যাই তাহলে শেষমেষ আমি জনির সম্পর্কে যত না লিখব তার চেয়ে ঢের বেশি নিজের সম্পর্কে লিখে চলব। নিজের সঙ্গে দেবদূতের মিল খুঁজে পেতে শুরু করেছি। অবশ্য আমায় তা কম সম্মান যোগ করছে না। বাড়ি ফিরে আমিও ছিদ্রান্বেষীদের মতো ভেবেছি আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া দরকার। জনির ওপরে লেখা হাজার বইয়ের মধ্যে আমি কেবল ওর এসব ঘটনা নিয়ে লিখেছি। একদম অনুপুঙ্খ করে তা লিখেছি। তার মানবসত্তার আবেগপ্রবণ দিক নিয়ে লিখেছি। আমার কাছে এটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন মনে হয়নি যে জনি কেন বিশ্বাস করে ও পাতাভর্তি জারে পরিপূর্ণ মাঠে রয়েছে। কিংবা ও যেসব ছবির দিকে চেয়ে থাকে তারা নড়াচড়া করে―এমন কথা ব্যাখ্যা করবারও প্রয়োজন মনে হয়নি আমার। কিংবা জনি মারিজুয়ানার ফ্যান্টাসিতে থাকে তা সম্পর্কেও লিখিনি। কারণ যাই হোক না কেন, সবকিছুর শেষে ওরা নেশা ছাড়ানোর চিকিৎসাতেই তো বিশ্বাস করে। তবে এটা বলা যেতে পারে যে জনি আমায় অঙ্গীকারবদ্ধ করে রাখে যে আর বলে নিজে ওসব ফ্যান্টাসিতেই থাকবে। ওর ব্যাগে থাকা বাকি কতশত রুমালের মতো আমার কাছে ওগুলো রাখে যাতে সেসব উদ্ধার করবার সময় চোখের সামনেই দেখা যায়। বিশ্বাস করি একমাত্র আমিই ওর সবকিছু সহ্য করি। ওদের সঙ্গেই থাকি, ওদের ভয় পাই। এ কথা কেউ জানে না, এমনকি জনিও নয়। কোনও বড় মানুষের কাছে লোকে যেভাবে স্বীকারোক্তি করে জনির কাছে তারা এসব কিছু স্বীকার করতে পারবে না। তিনি এমন এক মায়েস্ত্রো যার একটা স্বীকারোক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা সকলেই অনুগত থাকি। এ কেমন দুনিয়া ভাই যে আমাকে গাঁটের মতো আচরণ করতে হয় ? কোন শ্রেণির দেবদূত আমি ? জনির মধ্যে কম তো বিপুলতা নেই। যেদিন থেকে ওকে চিনেছি, ওর কাজের অনুরাগী হয়েছি সেদিন থেকে এ কথা আমি জানি। কিছু দিন যাবৎ এসব আমায় আর অবাক করে না। যদিও প্রথমটায় এই বিশালতার অভাব দেখে বিরক্তিই লেগেছিল। এর হয়তো একটা কারণ হতে পারে কেউ যখন কারও সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হয় তখন এটা যে তার একটা চারিত্রিক দিক সেকথা ভাবতে চায় না। তার ওপর আবার ও একজন জ্যাজম্যান, সুতরাং এ সম্বন্ধে তো ভাবতে রাজিই হয় না। জানি না কেন (জানা নেই কেন) আমি এক বিশেষ মুহূর্তে বিশ্বাস করি, সে বিশেষ মুহূর্তে জনির ভিতর সেই বিরাটত্ব ছিল। অথচ যাকে দিনের পর দিন সে অস্বীকার করেছে (হয়তো বা আমরাই অস্বীকার করেছি। বাস্তবে ব্যাপারটা তো এমন নয়)। কারণ আমরা সৎ লোক, আর জনির ভেতরে যতদূর সম্ভব অন্য এক জনির ভূত থাকে। সেই অন্য জনি মহত্ত্ব দিয়ে পরিপূর্ণ। সেই ভূত খেয়াল করে যে এই পক্ষে না থাকাটা উল্লেখ করলেও সেটা নেতিবাচকভাবেই প্রকাশিত হবে। ও অবশ্য সুখীই থেকে যায়।

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button