আর্কাইভগল্প

গন্তব্য : সুব্রত বড়ুয়া

আবার পড়ি : সুব্রত বড়ুয়ার গল্প

গ্রামের নাম রূপসুন্দরপুর। আমি আগে কখনও এই রূপসুন্দরপুর নামটি শুনিনি। যে দৈনিক পত্রিকার পাতায় ফিচারটি বেরিয়েছিল সেখান থেকেই আমি কাগজে নামটি টুকে নিয়েছিলাম। কাগজটা হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু নামটা আমার মনে থেকে গিয়েছিল। সে তো বছরতিনেক আগের কথা। সেই তখন থেকেই ভাবছিলাম—একবার রূপসুন্দরপুর যাব, দেবীপদের সঙ্গে দেখা করব। কেন ? দেবীপদের সঙ্গে দেখা করব কেন ? দেবীপদ আমার কে ? দেবীপদ কখনও আমার বন্ধু ছিল না। আমরা এক বছর একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়েছি। একই ক্লাসে কিন্তু একই সেকশনে নয়। দেবীপদ ছিল ‘সি’ সেকশনে। আমি ‘এ’-তে। দেবীপদের সঙ্গে আমার তেমন পরিচয়ও ছিল না। দেবীপদ পঞ্চম শ্রেণির প্রাইমারি পরীক্ষা শেষ করে নতুন ভর্তি হয়েছিল। আমি চতুর্থ শ্রেণি থেকেই সে স্কুলে পড়তাম। অন্য শাখার ছাত্র ছিল বলে দেবীপদের সঙ্গে পরিচয় কিংবা বন্ধুত্ব কোনও কিছুরই সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু দেবীপদকে চিনতে হলো অন্য কারণে। ষষ্ঠ শ্রেণির অর্ধবাষিক পরীক্ষায় তিন সেকশন মিলিয়ে পুরো ক্লাসে দেবীপদই হলো প্রথম। আমি দুনম্বর কম পেয়ে, না দ্বিতীয় নই, তৃতীয়। মাঝখানে দেবীপদের চেয়ে এক নম্বর কম ও আমার চেয়ে এক নম্বর বেশি পেয়ে কে দ্বিতীয় হয়েছিল তা আমার মনে নেই। আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেল।

দেখতে ছিপছিপে কালো লম্বা ছিল দেবীপদ। হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। ওর চেহারার মতোই। তবে একেবারে চুপচাপ নিরীহ ধরনের ছেলে ছিল দেবীপদ। কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলত না। বয়সে হয়তো আমার চেয়ে একটু বড়ই ছিল। সম্ভবত দেরি করেই স্কুলের পড়া শুরু করেছিল দেবীপদ।

আমরা শুনেছিলাম—দেবীপদরা খুব গরিব ছিল আর দেবীপদ স্কুলের ছুটির পর কাজ করত একটা সাইনবোর্ড আঁকার দোকানে। আমি যেচেই কয়েকবার কথা বলেছিলাম দেবীপদের সঙ্গে। কিন্তু দেবীপদ কখনও নিজের কোনও কথাই বলত না। স্কুল ছুটি হওয়ার পর খুব তাড়াতাড়ি একাই বেরিয়ে যেত বইখাতা বগলদাবা করে। আমাদের স্কুলে পড়ার সময়ে স্কুলব্যাগ তেমন কেউ ব্যবহার করত না। পাওয়াই যেত না কোনও দোকানে। যে দু-একজন ব্যবহার করত সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম, মাঝেমধ্যে হাত বুলিয়ে ছুঁয়ে দেখারও চেষ্টা করতাম।

দেবীপদ হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় একেবারে ফার্স্ট হয়ে যাওয়ায় সবাই বেশ অবাক হয়েছিল। আমাদের শিক্ষকরাও ক্লাসে ওর কথা বলতে লাগলেন। আরও বেশি করে বলতেন সম্ভবত ওর বাড়ির আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করেই। আমি কিছুতেই দেবীপদর কথা ভুলতে পারতাম না। আমার জায়গাটা ও কেড়ে নিয়েছে। মাত্র দু-নম্বরের কথা কেউ বলবে না, মনেও রাখবে না। আমাদের একজন আত্মীয় এই রেজাল্টের কথাটা প্রায়ই তুলতেন। তিনি বেশ হতাশার সুরেই বলতেন, তুমি বোধহয় আর কোনও দিন ফার্স্ট হতে পারবে না। তাঁর কথার মধ্যে বেশ একটা আনন্দের রেশও থাকত। সম্ভবত তিনি চাইতেনও না যে আমি আবার প্রথম স্থানে চলে যাই। এই এতদিন পরও তাঁর বলার ভঙ্গিটা আমার বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে। কিন্তু তিনি কেন সেটা বলতেন তা আজও আমি বুঝতে পারি না।

আমাদের স্কুলে পরীক্ষা হতো বছরে মাত্র দুবার—অর্ধ-বার্ষিক ও বার্ষিক। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। বার্ষিক পরীক্ষায় দেবীপদকে হারাতেই হবে, প্রথম স্থান আবার আমাকে পেতেই হবে। কিন্তু দেবীপদ আগে যেমন ছিল এখনও তেমনিই রয়ে গেছে। প্রায় সবাইকে এড়িয়ে চলে, স্কুল ছুটি হওয়ার পর খুুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। আলাদা সেকশনের ছাত্র ছিলাম বলে দেবীপদের সঙ্গে আমার খুব একটা দেখাও হতো না। আস্তে আস্তে দেবীপদর কথা প্রায় ভুলেই গেলাম।

এদিকে বার্ষিক পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এল। যথারীতি পরীক্ষাও হয়ে গেল। পরীক্ষা আমার ভালোই হয়েছিল কিন্তু আবার প্রথম হতে পারব কি না তা অবশ্য আমি জানতাম না। তা ছাড়া কতই বা আমার তখন বয়স। বড় জোর বারো বছরের মতো। স্কুলের পরীক্ষা, তাতে প্রথম হওয়া—এসব দিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা আমার মাথায় আসত না। আমি তখন আরও একটি জগতের সন্ধান পেয়ে গেছি। গল্পের বই পড়তে গেলে আর কিছু চাই না। ক্লাসের পড়ার বইয়ের নিচে রেখে লুকিয়ে পড়ি। গল্পের মানুষদের নিয়ে ভাবনার শেষ থাকে না। অপুর জন্য খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ডাকঘরের অমলের কথা ভাবতে থাকি মনে মনে। রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলের মতো বইগুলোও মন কেড়ে নেয়। আর ডিটেকটিভ কাহিনির বই পেলে তো কথাই নেই। বড়দের বইও লুকিয়ে চুরিয়ে পড়ে ফেলি। গল্প তো সব বইয়ের মধ্যেই থাকে। গল্পের মানুষগুলো কেবল নানারকম হয়। ওদের সুখদুঃখ, হাসিকান্না, ভালোমন্দ—সবকিছুর সঙ্গে আমি নিজেও কেবল যেন জড়িয়ে পড়ি। সেসব মানুষের রক্তমাংসের আসল মানুষ বলে মনে হয়। সেখানে পরীক্ষার পড়ার মতো ব্যাপারগুলো তেমন একটা জায়গা করে নিতে পারে না। কেবলই মনে হতো, আমার পুরোনো আমির মধ্যে একটা নতুন আমি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু তার সত্যিকারের আদল আমি বুঝতে পারতাম না।

একসময় বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোল। আমিই প্রথম, দেবীপদ দি¦তীয়—নম্বরের ব্যবধানও অনেক। আমার খুব খুশি হওয়ার কথা ছিল। হয়েছিলামও। হঠাৎ দেবীপদের কথা মনে পড়েছিল। স্কুলের ক্লাস শেষ করে, সাইনবোর্ডের দোকানে কাজ করার পর—কী-ই বা আর সময় পেত দেবীপদ! যদি আমার মতো বইখাতা থাকত, বাসায় পড়ার সময় পেত, তাহলে দেবীপদ নিশ্চয়ই প্রথম হতো। আমার মনে হয়েছিল যেন আমি আসলে দেবীপদের কাছে হেরে গেছি। খুব মন খারাপ করেছিল তখন।

২.

আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম বেশ সকালেই—আটটা সাড়ে আটটার দিকে। রূপসুন্দরপুর কীভাবে যাওয়া যাবে তার একটা ধারণা পেয়েছিলাম বিভিন্নজনকে জিজ্ঞেস করে। বাসেই যেতে হবে। ঘণ্টাখানেক লাগবে বাসে। নামতে হবে—মিয়ার হাটে। সেখানে থেকে মাইল দুয়েক যেতে হবে। সেখানেই রূপসুন্দরপুর। বাস থেকে নামার পর রিকশা পাওয়া যাবে। আজকাল গ্রামের পথে রিকশা-স্কুটার সবই পাওয়া যায়। ঘরে ঘরে টেলিভিশন। একেবারে গ্রামের ভেতরেও মোবাইল রিচার্জ করার দোকান।

আমার কাঁধে কাপড়ের একটা থলে। সেখানে বিস্কিটের প্যাকেট, পানির বোতল আর একটা ছাতা। মোবাইল ফোনটাও আছে সেখানে। সবাই বলে দিয়েছে—কোনও অসুবিধে নেই। মোবাইলের নেটওয়ার্ক এখন গ্রামেও পাওয়া যায়।

বাসে তেমন ভিড় ছিল না। ছুটির দিন এবং সকালের দিক বলেই একটু ফাঁকা ছিল। জানালার পাশ ঘেঁসে বসতে পেরেছিলাম। মাঝারি সাইজের মিনি বাস। বেশ পুরানো যেমনটা হয় এসব লাইনে। বসার সিটগুলো দেবে গেছে। কোনওটা বেশ ছেঁড়া। কিন্তু যাত্রীদের এসব নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ আছে বলে মনে হলো না। পোটলা-পুটলি প্রায় সবারই হাতে। গ্রামের হাটবাজারে যদিও আজকাল প্রায় সবই পাওয়া যায় তবু শহর থেকে কিনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আলাদা। বাসে উঠে বসার পর খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। অল্পক্ষণের মধ্যেই যাত্রীতে ভরে গেলে ছেড়েছিল বাসটা। আমার খুব অবাক লাগছিল। এই ছুটির দিনে এত সকালেও কত মানুষ যাতায়াত করছে। যানবাহনগুলোতে যাত্রীর কমতি নেই।

ভাড়া দেওয়ার সময় কন্ডাক্টরকে বলেছিলাম—মিয়ারহাটে আমাকে নামিয়ে দিতে। আমি তো এই দিককার পথে তেমন একটা আসি না। শেষবার এসেছিলাম সেও দশ-পনেরো বছর আগে। কন্ডাক্টর আমার কথা শুনল কি না ঠিক বোঝা গেল না। নির্বিকার মুখে কেবল মাথা নেড়ে অন্যজনের কাছ থেকে ভাড়ার টাকা বুঝে নিতে লাগল। আমি তেমন ভরসা পেলাম না কিন্তু আমার তো অন্য কোনও উপায় নেই। ভাবলাম—আরও তো লোক নামবে সেখানে, নিশ্চয়ই তেমন কোনও অসুবিধে হবে না।

শহর এলাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর খোলা মাঠ, সবুজ গাছপালা দেখে মনটা ভরে গেল। তাজা হাওয়ার পরশটাই আলাদা। একটা স্নিগ্ধতার আবেশ যেন পুরো শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। কিন্তু সেও তো আর তেমন নিরবচ্ছিন্ন নয়। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশেই আট-দশটা দোকান, ইটের পাকা দালান। দোতলা-তিনতলাও চোখে পড়েছিল। বাজার সংস্কৃতির অবদান। গ্রামের মানুষও এখন অনেক কেনাকাটা করে। পটেটো চিপস, চানাচুনের প্যাকেট ইত্যাদির সমারোহ বাস থেকেই দেখা যাচ্ছিল। কত তাড়াতাড়িই না বদলে যাচ্ছে গ্রাম।

চলন্ত বাসে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, এভাবে হঠাৎ করে এই রূপসুন্দরপুরে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমি যে দেবীপদকে চিনতাম হয়তো এ দেবীপদ সে দেবীপদ নয়। নামের মিল থাকলেই যে একই! মানুষ হবে এমন তো কোনও কথা নেই আর, যদি সেই দেবীপদই হয়ও, তাতেই বা কী! আজ এত দিন পর দেবীপদ যে আমাকে চিনতে পারবে তারই বা নিশ্চয়তা কী! মাঝখানে তো এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এক দুবছর তো নয়, এ তো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তা ছাড়া আমার তো দেবীপদের সঙ্গে তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতাও ছিল না। দেবীপদর নিশ্চয়ই আমার কথা মনে থাকার কথা নয়। আর সত্যি কথা বলতে কী, দেবীপদর সঙ্গে তো আমার কোনও কাজও নেই। দেবীপদ যদি জিগগেস করে, আপনি কেন এসেছেন আমার কাছে ? কী কাজ আপনার ? তাহলে তো জবাব দেওয়ার কিছুই নেই আমার।

কয়েকবারই ভাবলাম—মিয়ারহাটে নেমে আবার ফিরতি বাসই ধরব কি না। সত্যিই তো আমার কোনও কথাও নেই দেবীপদের সঙ্গে। কী বলব আমি তাকে ? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। কেন ? তারও কোনও জবার নেই। আসলে পত্রিকার পাতায় ফিচারটা পড়ার পর থেকেই আমার দেবীপদের কথা খুব মনে পড়ে গিয়েছিল। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর মাস কয়েক ক্লাস করেছিল দেবীপদ। তারপর একদিন হঠাৎ আর আসেনি। আর কোনও দিন আসেনি। হারিয়ে গেল দেবীপদ। কেন আসেনি সে কথা আমরা জানতে পারিনি। দেবীপদ কি অন্য কোনও স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ? কিংবা অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল ? অথবা এমন কোনও ঘটনা ঘটেছিল যে স্কুলেই আর পড়তে পারেনি। হয়তো পুরো সংসারের দায়িত্বটাই এসে পড়েছিল ওর ওপর। তাই পড়ালেখা বাদ দিয়ে পুরোপুরিই কাজে লেগে পড়তে হয়েছিল ওকে। আমাদের সঙ্গেও তার কোনও দিন দেখা হয়নি ওর। আমরা কেউ কিছুই জানতে পারিনি। এমন ঘটনা তো কতই ঘটে।

৩.

মিয়ারহাটে নেমে প্রথমেই একটা চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খেয়েছিলাম। সঙ্গে একটি টোস্ট বিস্কিট। ঘন দুধের চায়ের মধ্যে টোস্ট বিস্কিট ডুবিয়ে খেতে ভালোই লাগছিল। চা-বিস্কিটের দাম দেওয়ার সময় চা-দোকানিকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম রূপসুন্দরপুরের কথা। দোকানিই পরামর্শ দিয়েছিলেন একটা রিকশা নিয়ে যাওয়ার জন্য। দেবীপদের কথা বলতেই দোকানি বলেছিলেন, ও। আপনি আর্টিস্ট বাবুর বাড়ি যাবেন ? রিকশাঅলাকে বললে সে-ই নিয়ে যাবে।

ইট বিছানো রাস্তা। হালকা ঝাঁকুনি খেতে খেতে এসেছিলাম এই দেড় মাইল পথ। মনে হচ্ছিল হেঁটে এলেই ভালো হতো। মাঝে মাঝে লোকদের দেখা পাচ্ছিলাম। তারা কৌতূহলভরা চোখে দেখছিল আমাকে। অজানা অচেনা লোক দেখলে এভাবেই তাকায় গ্রামের মানুষ। আমার অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু কিছুই তো করার ছিল না আমার। আমি এসেছি রূপসুন্দরপুরের আর্টিস্ট দেবীপদকে দেখতে। না, শুধু আর্টিস্ট দেবীপদকে নয়, আমার সতীর্থ পুরোনো এক দেবীপদকে দেখতে।

রাস্তার দুপাশে ধানখেত, একটু দূরে দূরে সবুজ গাছপালার ভিড়ে মানুষজনের বাড়িঘর, অন্ধকার ছায়াঢাকা পুকুর। কখনও কখনও বাড়িঘরের একেবারে সামনে দিয়েই রাস্তা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়ির সামনে ছোট বা মাঝারি পুকুর আর পুকুরপাড়ে ঝাঁকড়ামাথার গাছ। কোথাও কোথাও হাঁসগুলো নেমে গেছে পুকুরে। সাঁতার কাটছে একসারিতে কিংবা অর্ধচন্দ্রাকার বৃত্তের মতো ছক বানিয়ে। সেগুলো দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি ফিরে যাচ্ছিলাম আমার শৈশবে, আমার কৈশোরে। এইরকম সুনসান দিনের নিবিড় নৈকট্যমাখা সময় আমার কী যে ভালো লাগে! মধ্যষাটের এই জীর্ণ দেহটার খোলস ছেড়ে চিরকালের এক মগ্ন কিশোর যেন বেরিয়ে আসে আমার ভেতর থেকে। তখন চারপাশের রূপ-রস-গন্ধ সবকিছুই যেন অপরূপ আর মধুময় হয়ে ওঠে।

এ হয়তো চিরসত্য যে মানুষ বারবার তার শৈশব ও কৈশোরে ফিরে যেতে চায়। প্রিয় সময় ও প্রিয় পরিবেশের মধ্যেই মানুষ বেঁচে থাকার ইচ্ছে পোষণ করে। কিন্তু বাস্তব জগৎ ক্রমেই বদলে যায়। একবার যে সময় ও যে পরিবেশ অতিক্রম করে মানুষ চলে আসে আর কোনও দিন সেখানে কখনও তার ফিরে যাওয়া হয় না। সেখানে তাই ফিরে যাওয়ার মতো কোনও কিছুই কোনওকালে ঘটে না। তবু এই স্বপ্ন-বাস্তবতার মধুরতা মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমারও যেন তাই-ই ঘটেছিল। একধরনের আচ্ছন্নতা যেন ঘিরে ধরেছিল আমাকে।

সে আচ্ছন্নতা ভেঙেছিল রিকশাঅলার কথায়। সামনে আলপথের চেয়ে সামান্য কিছু প্রশস্ত একটি মাটির রাস্তা, দুপাশে তার ঘাস ও আগাছা। মাঝখানে মানুষের পায়ে হাঁটার পথ। সেখানকার ঘাস উধাও হয়ে গেছে। রিকশাঅলা আঙুল তুলে আর্টিস্ট বাবুর বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েছিল। ঘন গাছপালার আড়ালে একটা বাড়ির কিয়দংশ মাত্র চোখে পড়েছিল আমার।

দেবীপদ বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে কী যেন করছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। মাথার চুল আমারই মতো সাদা-কালো। বেশির ভাগই সাদা। তবে চুলের পরিমাণ তেমন বেশি নয়। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চশমার পাওয়ারও বেশি বলেই মনে হলো। খালি গা। পরনে চেক লুঙ্গি।

আমি হাত তুলে নমস্কার জানিয়েছিলাম। তিনিও প্রত্যুত্তরে নমস্কার বলেছিলেন। তিনি অবশ্যই আমাকে দেখে অবাক হয়েছিলেন। আমি তো আসলে তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত আগন্তুকই।

তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমি কার কাছে এসেছি কাকে খুঁজছি। আমি তাঁকে বলেছিলাম যে, আমি তাঁকেই খুজছি, তাঁর কাছেই এসেছি। তাঁর নামই তো দেবীপদ বাবু। আর্টিস্ট।

তিনি হেসে বলেছিলেন, আমার নামই দেবীপদ। তবে আমি আর্টিস্ট নই। সামান্য সাইনবোর্ড আঁকার কাছ করি, রঙ-তুলি নিয়ে কারবার। সেজন্যই লোকে আর্টিস্ট বলে।

তারপর তিনি বাড়ির সামনে প্রশস্ত দাওয়ার দিকে যেতে বলেছিলেন আমাকে। মাটির উঁচু দাওয়া। দুথাক ইট বসিয়ে সিঁড়ির মতো করা হয়েছে। দেবীপদ আগে উঠে গেলেন। তারপর আমাকে উঠতে বললেন। আমি সাবধানে পা ফেলে দাওয়ায় উঠলাম। তারপর এগিয়ে দেওয়া জলচৌকিতে বসলাম। দেবীপদ এই ফাঁকে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরলেন একটু পরই। গায়ে একটি গেঞ্জি পরেছেন এবার। এসে আর একটি জলচৌকিতে নিজেও বসলেন। তারপর জানতে চাইলেন তাঁর কাছে আমি কেন এসেছি।

কী বলব আমি ? আমি কি বলব, আমি আমার স্কুলজীবনের এক সতীর্থকে খুঁজতে এসেছি যে একদিন হঠাৎ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে কথা সরাসরি বলা যায় না। বললাম, আপনাকে নিয়ে একটা ফিচার বেরিয়েছিল পত্রিকায়।

কিন্তু সে তো বেশ আগের কথা। শুধু সেজন্য আপনি এসেছেন আমার কাছে ? আশ্চর্য! দেবীপদ হাসলেন একটু।

আমাদের দেখা হওয়ার পর এই প্রথম আমি তাঁকে হাসতে দেখলাম। আমিও হাসলাম। বললাম, আপনি অবাক হবেন সে আমি জানতাম। আমার কাণ্ড দেখে আমি নিজেও কম অবাক হইনি।

তারপর থামলাম। ঝোলা থেকে পানির বোতলটা বের করে একটু পানি খেলাম। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছলাম।

দেবীপদ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কোনও কথা বলেননি। আমি বললাম, পত্রিকার ফিচার পড়ে আপনাকে দেখার জন্য আমি ছুটে আসিনি আপনার কাছে। আমি এসেছি অন্য কারণে। আমার চেনা একজন মানুষের সঙ্গে আপনাকে মিলিয়ে দেখতে।

আপনার চেনা মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ? কী আশ্চর্য! আপনি কেমন অদ্ভুত কথা বলছেন।

তখন আমি তাঁকে সব বললাম। আমাদের সেই স্কুলের কথা। পরীক্ষার কথা। হঠাৎ একদিন দেবীপদের হারিয়ে যাওয়ার কথা।

আপনি এই এতদিন ধরে এসব কথা মনে রেখেছেন ? দেবীপদ তো আপনার তেমন বন্ধুও ছিল না। তবু আপনি দেবীপদকে ভোলেননি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। আপনি এবার বলুন সেই দেবীপদই তো আপনি ?

হ্যাঁ, আমিই সেই দেবীপদ। হঠাৎ বাবা মারা গেলেন। সংসারের হাল আমাকে ধরতে হলো। আমার আর লেখাপড়া করা হলো না। ছবি আঁকতে খুব ভালো লাগতো। সেটিই আমাকে বাঁচিয়ে রাখল।

দেবীপদ উঠে গেলেন। ঘরের ভেতর থেকে তাঁর আঁকা কয়েকটা ছবি নিয়ে এলেন। আমি দেখলাম। খুব যত্নের সঙ্গে সেগুলো রেখেছেন দেবীপদ। আর্টিস্ট দেবীপদ।

আমি কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। শুধু চুপচাপ বসে রইলাম। কী বলব আমি ? একটা স্তব্ধ সময় যেন আমাদের দুজনকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখেছে। মানুষের জীবনে কত কিছুই না হয়, ঘটে।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button