আর্কাইভকথাসাহিত্য

জালালুদ্দিন রুমির রুবাইয়াত : কাজী জহিরুল ইসলাম

কাব্যানুবাদ (দ্বিতীয় পর্ব)

২১.

নাম, যশ, খ্যাতি কতটা হারাল, কপালে কতটা জোটে

কতটুকু তার দখলে রয়েছে ভাবছে না তো সে  মোটে

এসবে চিত্ত বিচলিত নয়, দুঃখ ছোঁয় না কভু

মুক্ত সে মন, আত্মার বাগে সফেদ পুষ্প ফোটে।

২২.

প্রকৃত বন্ধু জেনো সেই লোক যে তোমার মাথা কাটে

প্রতারক শুধু খণ্ডিত মাথা জোড়া দিয়ে তাকে চাটে

তোমার দুঃখে জল ঢালে যারা তারা তো কেবল বোঝা

বুকে টেনে নাও তাদেরকে তুমি হায় কোন বিভ্রাটে।

২৩.

প্রেমের প্রকৃত রূপ দেখেছো কি ? দেখেছো কি তার মুখ ?

কোন আয়নাতে মুখ রেখে তুমি প্রতিদিন খোঁজো সুখ ?

মোহ প্রেম নয়, উদার হৃদয়ে বসবাস করে প্রেম,

অথচ মানুষ প্রত্যহ দেখি কামনায় উন্মুখ।

২৪.

কামনার সুর তোমাকে বধির করে দিয়েছিল বলে

শোনোনি প্রেমের কিন্নর গান বাজে অন্তঃস্থলে

কোলাহল থেকে বের হয়ে এসো কান পাতো অন্তরে

স্পষ্টত শোনো আহ্বান তার নিরবধি ডেকে চলে।

২৫.

তোমারই মধুর নাম জপ করি তোমাকে দেখি না কভু

এতো উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছো অন্ধ কেন যে তবু

কে তুমি হে প্রিয়া অদেখা আড়ালে দূরে সরে যাও শুধু ?

প্রিয়তমা তুমি? নাকি আমি দাস, তুমি হলে মহাপ্রভু ?

২৬.

বিছিয়েছো পথ দুটি আত্মার মধ্যে দীর্ঘ এক

আমার হৃদয় গ্রন্থতে আছে সেই কথা উল্লেখ

রাস্তাটি খুবই স্বচ্ছ ও খাঁটি স্থির খাড়া তাতে চাঁদ

ওরে ও মূর্খ জেগে উঠে তুই তাকিয়ে সে-পথ দেখ।

২৭.

যখন তোমার মুখ থেকে কোনও অমৃত-শব্দ শুনি

বিশ্রুত হয় রাজা-বাদশাহ, পয়গম্বর গুণী

জ্বলন্ত চাঁদ, সূর্যের তেজ লজ্জায় নিভে যায়

শুধু তুমি একা জ্বলো উজ্জ্বল চাঁদ-সুরুজের খুনি।

২৮.

প্রেম নিজে এক মহাসম্রাট পতাকা লুকানো থাকে

কোরানের বাণী সকল সত্য জাদু সে লুকিয়ে রাখে

প্রেম ছোড়ে তীর প্রেমিক-বক্ষ বিদীর্ণ করে রোজ

রক্তের ধারা আড়ালে লুকিয়ে দেখায় যন্ত্রণাকে।

২৯.

আমার হৃদয় কেন বলো এত দগ্ধ যন্ত্রণাতে,

তুচ্ছ-ক্ষুদ্র করে সে আমাকে তুলে নিল নিজ হাতে!

আমি তো এখন বন্দিশিবিরে, কারায় অন্তরীণ

আমার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত কেন সে দিবস-রাতে ?

৩০.

প্রত্যহ তুমি নলের বাঁশির অভিযোগ শোনো শুধু

আমরা কি রোজ বলি না এ কথা, খোদা ‘ইয়া কানা বুদু’

বাঁশিকেও বলি, কেন তুমি রোজ কেঁদে কেঁদে হও খুন ?

‘নদী-পাড় থেকে যেদিন কেটেছো জীবন হয়েছে ধু ধু’।

৩১.

রাত্রিকে বলি, চাঁদের প্রণয়ে যদি মজে থাকো বেশি

হবে না কখনও গভীরে প্রবেশ প্রেম হয়ে যাবে শেষই

রাত্রি আমাকে জবাবে জানায়, এ-দোষ আমার বলো?

সূর্য দেখিনি অসীম চিনি না আমি যে আঁধার-কেশী।

৩২.

তোমার সঙ্গে মিলন ঘটেছে অথবা কখনও ঘটল না

আমাদের প্রেম ভূ-লোক-দ্যুলোকে কোথাও কখনও রটল না

তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই, নেই কোনো পাগলামি

বিস্ময় হলো নিজের ভেতরে দেখিনি আগুন গনগনা।

৩৩.

পদচুম্বনে কাল চলে যায় হাতের স্পর্শ দূর

প্রেম-বৈভবে ভেতরে আমার চলে শুধু ভাঙচুর

অথচ দেখো না আমার দু চোখে অশ্রুর বারি কণা

হৃদয়ে অহর্নিশি বাজে কোন করুণ কান্না-সুর?

৩৪.

গড়েছো আমাকে প্রেম দিয়ে তুমি রক্ত ও ত্বক জামা

বিস্তৃত মাঠ দিয়ে বলো তাকে বন্ধুকে তুই থামা

আমার গহিনে বোনা আছে এক তোমার হৃদয়বীজ

অভয়াশ্রমে ছুটি আর গাই তোমারই আশেকনামা।

৩৫.

চাহিদা তো শুধু একখানি চুমু, দিয়েছো আমাকে ছয়

দানানুগ্রহের নজির এমন পৃথিবীতে বিস্ময়

কোথায় পেয়েছো ঔদার্যের এমন শিক্ষা তুমি

কার্পণ্যের ছিটেফোঁটা নেই, দানে তুমি নির্ভয়।

৩৬.

ইবাদতকালে মাটির বক্ষ যখন স্পর্শ করি

এই দেহ-মনে তোমাকেই শুধু ভীষণ আঁকড়ে ধরি

ফুল, পাখি, বাগ, সুন্দরী নারী, বৃত্তাবর্ত ঘোরা

অজুহাত শুধু তোমাকে পাবার নানান তসবি পড়ি।

৩৭.

বন্ধুর মুখ দৃষ্টি-সীমায় যখন স্পষ্ট ভাসে

আমার চোখেরা আত্মসুখের অনাবিল হাসি হাসে

দৃষ্টি এবং বন্ধু কি আর ভিন্ন তখন হয়?

নিজের ভেতরে বন্ধুকে পেয়ে হাসে মন উচ্ছাসে।

৩৮.

তুমি ছাড়া আর কার কথা বলি, অথচ থামিয়ে দিলে!

তুমি কাছে এলে নিস্তব্ধতা পৃথিবীকে খায় গিলে

দ্বিধা, শঙ্কায় পালিয়ে গিয়েছি হৃদয়ের বাড়ি থেকে

চোর চোর বলে ধরে ফেলে তুমি আত্মায় টেনে নিলে।

৩৯.

গনগনে এক চুল্লি জ্বেলেও উত্তাপ টের পায় না

তুমি গৃহে এলে সকলেই দেখে উষ্ণতার এক আয়না

সুদীর্ঘ কাল প্রতীক্ষা করে টের পায় সকলেই

কেন ঘর থেকে শীতের দাপট গ্রীষ্মকালেও যায় না।

৪০.

হৃদয়কে করো খরায় পোড়ানো তৃষ্ণাকাতর মরু

ক্লান্তিবিহীন ছুটে চলো শুধু খোঁজো অরণ্য-তরু

নিভৃত-নীরব প্রবল তৃষ্ণা গোপনে লুকিয়ে রাখো

হেঁটে যাও একা লক্ষ্যের দিকে সেতু পার হও সরু।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button