আর্কাইভউপন্যাস

পৃথার ছোরা

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস

দীপেন ভট্টাচার্য

এই কাহিনির একজন মুখ্য চরিত্রের নাম পৃথা। এরকম নামে কি কোনও চরিত্র কয়েক হাজার বছর আগে এক মরুভূমির মধ্যে কোনও এক পাহাড়ের ওপর বাস করতে পারে ? অথবা কয়েক হাজার বছর পরের ভবিষ্যতে ?  হয়ত না। কিন্তু আমাদের তো কোন একটা নামের আশ্রয় নিতে হবে। তাই তার নাম পৃথাই থাকুক। আরও থাকুক এরকম নাম—হিরণ, বিষাণ, আসিতোপল, মৃত্তিকা আর দিতা। কী ভাষায় তারা কথা বলত আমি জানি না, যে ভাষাতেই তারা কথা বলুক না কেন তাদের কাহিনি সর্বসময়ের, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিলেছে এক হয়ে।

১. পাহাড়দ্বীপ (অতীত)

দিনের বেলা অনেক নিচে বালি দেখা যায়। বালিয়াড়ির পাড়ে শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের লবণ ঝলকাতে থাকে তুষারের চাদরের মতো। বালির উপত্যকার ওইপাড়ে আর একটা পর্বতশ্রেণি জেগে থাকে উঁচু বায়ুমণ্ডলের মেঘের সঙ্গে।

আমরা নিচের বালিকে বলতাম ঝলসানো মাটি। শীতের সময়, বছরের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময়টিতেও গরম বাতাসের আভায় কাঁপতে থাকে সেই মাটি। বাতাস বইলে শব্দ করত বালিয়াড়ি, ঝিং ঝিং আওয়াজে ভরে উঠত উপত্যকা। বালিয়াড়ির অনেক ওপর দিয়ে চলে যেত মেঘেরা, অজানা অবোধ্য ইচ্ছায়, দিগন্তের প্রান্তে এক অদৃশ্য পৃথিবীতে পৌঁছাবার এক তাড়নায়। পশ্চিম থেকে আসত মেঘেরা, কখনও আসত তারা তাড়াহুড়ো করে, আমাদের সমস্ত ঈর্ষাকে অগ্রাহ্য করে আকাশের বলয়কে এক আশ্চর্য গতিতে মুহূর্তে পার করে দিয়ে। কিন্তু অন্য মেঘেরা নিয়ে আসত উষ্ণ বাতাস, দাঁড়িয়ে থাকত নির্দয় সূর্যের সঙ্গে। ভেসে থাকত অসংখ্য আকৃতিতে, অসংখ্য স্থবির আঙুলে আটকে রাখত মরুভূমির দগ্ধতাকে। আর যখন বৃষ্টি হত তার ফোঁটা উবে যেত মাঝপথে, পৌঁছত না মৃত উপত্যকায়। প্রতিদিন সূর্য উঠত আমাদের ধ্বংস করে দেবার নিবিড় চেষ্টায়, প্রতিদিন আমরা সন্ধান করতাম ছায়ার, প্রতিদিন আমাদের বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা বয়ে চলত এক অসম্ভব প্রকৃতির মধ্য দিয়ে। মরুভূমি পার হয়ে দূরের পৃথিবী আমাদের কৌতূহল জাগিয়ে লুকিয়ে থাকত দৃষ্টির আড়ালে।

বালি পার হয়ে কী ছিল আমরা কেউ জানতাম না। আমাদের আগে অনেকেই সেই বালি পার হতে চেয়েছে, অনেকেই ফিরে আসেনি। তারা কি পৌঁছেছে সেই সবুজ সমতল দেশে যার গল্প আমাদের মুখে মুখে ফিরত ? চামড়ার পিপেতে জল নিয়ে যেত সেই অভিযাত্রীরা। কিন্তু দগ্ধ প্রান্তরে তাদের মুখ যেত শুকিয়ে, শরীর যেত কুঁকড়ে, আর সমস্ত জল যেত বাতাসে মিলিয়ে।

আমরা অপেক্ষা করতাম হেমন্তের। অপেক্ষা করতাম সেই সমস্ত আশ্চর্য সন্ধ্যার জন্য যখন সূর্য ডুবতে থাকত দূর পাহাড়ের পেছনে। প্রতি বিকেলে আমরা বসে থাকতাম শিলাময় প্রান্তে সেই মৃত উপত্যকার ওপর আর আমাদের ওপর ঝলকাতে থাকত রাতের নক্ষত্র। আমরা ভাবতাম কী দিয়ে তৈরি ওই নক্ষত্ররা।

প্রতিবছর হেমন্তের জলবিষুবের সময় উত্তর থেকে ভেসে আসত দুটো বিশাল পাখি আমাদের এই পাহাড়দ্বীপে। তারা উড়ত অনায়াসে বাতাসের ঢেউয়ের স্বচ্ছন্দ গতিতে, নিচের কঠোর মরুভূমি তাদের উড্ডয়নকে বাধা দিতে পারত না। তাদের শুভ্র ডানায় ছিল কালো রঙের ছটা। প্রতিবছর তারা আমাদের জন্য নিয়ে আসত অজানা পৃথিবীর গন্ধ, সাদা পালকের মধ্যে লেগে থাকত পশ্চিম দেশের মাটি। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম তাদের জন্য। তারপর একদিন, এক হেমন্তে তারা এল না। আমরা অপেক্ষা করে থাকলাম তাদের জন্য বৃথা। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেল। পরের বছর জলবিষুবের দিনে একঝাঁক সাদা পাখি অনেক ওপর দিয়ে চলে গেল দক্ষিণে। মরুভূমি জিতল, শুষ্ক তপ্ত বালু জ্বলতে থাকল মরীচিকার জলের নীচে, আর বাতাস বইলে তারা ঝিং ঝিং শব্দ ভরিয়ে দিত উপত্যকা।

২. মৃত্তিকা (বর্তমান)

‘আমি এখানেই মা, চিন্তা করো না,’ নদীর বাতাসের ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে বলে দিতা। ‘রেলিঙের ওপর ঝুঁকিস না বেশি মা,’ দেখতে পায় না দিতাকে মৃত্তিকা, তবু সে জানে কোথায় তার মেয়ে দাঁড়িয়ে। স্টিমারের পেছনে জল ফেনায় ফেনায় ছলকে ওঠে তারপর ছড়িয়ে পড়ে দুটো বিকিরিত সরল রেখায়। ‘শুশুকদের দেখছি মা,’ আবার চেঁচায় দিতা। তার চুল উড়তে থাকে বাতাসে। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকায় মৃত্তিকা, কিন্তু দেখতে পায় না দিতাকে।

দুলারির ওপর ভেসে চলে স্টিমার এক শরতের দিনে, সবুজ সমতলের মধ্যে, তাকে অনুসরণ করে ধূসর শুশুকেরা। সূর্য জ্বলে ওপরে, জলের দেশের ওপরে। হালকা সবুজ শস্যক্ষেত্র বিস্তৃত হয়ে থাকে নদীর দু’পাড় ছাড়িয়ে আবছা হয়ে, প্রায় দেখা যায় না। ভর-দুপুরেও এক কুয়াশা দাঁড়িয়ে থাকে মাঠের গা ঘেঁষে। হঠাৎ হঠাৎই তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে ছোট ছোট দু-একটা গ্রাম, সবক’টাই বিশাল সবুজ পাতার গাছ দিয়ে ঘেরা। আর সেই গাছের পেছনে থেকে বেরিয়ে আসে শিশুরা, পাড় ধরে দৌড়াতে থাকে স্টিমারের পাশ দিয়ে। পেছনে পড়ে থাকে রাজধানী, দিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোতেও আঁধারের মধ্যে, সেখানে নেমেছে চিতা বাহিনি।

শুশুকদের থেকে চোখ তুলে পাড়ের শিশুদের দিকে তাকায় দিতা। তার ঝকঝকে কালো চোখে প্রতিবিম্বিত হয় শিশুদের বিস্ময়; পাড়ের শিশুরা ভাবে কোথায় চলেছে কালো ধোঁয়ার জাহাজ, জলে ভেসে, বোঝাই হয়ে ?

‘এখানে এসে বসো, মা’, মৃত্তিকা দিতাকে ডাকে। ছুটে এসে বসে দিতা মার পাশে। ‘মা শুশুকরা কি বুদ্ধিমান ? জলের নীচে কি তাদের শহর আছে ?’ ‘শুশুকের সভ্যতা আশ্চর্যই হবে’, মৃত্তিকা ভাবে, ‘কিন্তু সেই সভ্যতা আমার দেখা হবে না।’ অন্ধ মৃত্তিকা হাতড়ে ধরে দিতার হাত।

বসে থাকতে পারে না দিতা, ছটফট করে। কিছুক্ষণ পরে উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচায়, তারপর নাচের ভঙ্গিতে হাত ঘোরায়। লাফায়। তারপর মার পাশে রাখা ব্যাগ থেকে আঁকার সরঞ্জাম বের করে। ছবি আঁকে দিতা, এক বিশাল প্রাসাদের ছবি, তার চতুর্দিকে থইথই জল। তার সোনালি শিখরে সূর্য চমকায়। মৃত্তিকাও তুলে নেয় একটা পেন্সিল, আঁকতে থাকে সাদা কাগজে। সে আঁকে কারুকাজের সুন্দর গাছের পাতা। তারপর নিজের আঁকার ওপর হাত বোলায়। তার দৃষ্টির আড়ালে থাকে সেই সবুজ, কিন্তু সে অনুভব করে সবুজের শিহরণ। আঙুলের উত্তাপে মনে হয় একটা লাল আভা ঘিরে রেখেছে সেই পাতাকে, এমন একটা রঙে পাতা জ্বলে যে-রঙের নাম সে জানে না।

ডেকের ওপর বসে থাকে সারি সারি মানুষ, তুরা অভিমুখী। উপচে পড়ছে স্টিমার লোকে। তুরার মানুষ প্রমোদভ্রমণ করে না, শহর থেকে শহরে চলে যেন অন্ধ গলির ইশারায়, ভাবে যাত্রার সমাপ্তি ঘাটে স্টিমার ভিড়লেই, নতুন ডাঙায় যেন আছে নতুন আবিষ্কার—আকাশের সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু এখন তারা পালাচ্ছে রাজধানী থেকে, সেই শহর অধিকার নিয়েছে চিতা সামরিক বাহিনী। চিতারা মনে করে রাজধানীর মানুষেরা তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। রাজধানীর মানুষেরা শুধু তাদের মতো করে থাকতে চেয়েছিল।

‘দেখ মা, এই প্রাসাদটা দেখ।’ মৃত্তিকা দেখে সেই অথই জলের মাঝে প্রাসাদের ছবি। ছবির ওপর হাত বোলায় মৃত্তিকা, প্রাসাদের ওপর অসংখ্য জলের ফোঁটা তার হাতকে যেন ভিজিয়ে দেয়।

‘দেখ মা, সারস উড়ছে।’ দুটো পাখি, সারসের মতোই বড়, উড়তে থাকে স্টিমারের সঙ্গে। খুব ধীরে, সুন্দর সাবলীল ভঙ্গিতে। অতিদূরে বরফের দেশ থেকে গ্রীষ্মের পাখিরা ফিরে আসছে যাযাবর জীবনের পথ ধরে। তাদের বিশাল যাত্রায় ক্ষণিক সাথী হয়ে থাকে এই পাখিরা উড়তে থাকে জলযান স্টিমারের খুব কাছে, ধার ঘেঁষে। তাদের শুভ্র ডানার শেষ প্রান্তে ঈষৎ কালোর ছটা। দিতা আঁকতে থাকে পাখিদের। মৃত্তিকা হাত বোলায় সেই আঁকার ওপর যেখানে উড়ে যায় পাখি, সে মানস চোখে দেখে উড়ন্ত পাখিদের, কিন্তু সে আরও অনেক কিছু দেখে। সে অনুভব করে পাখিরা উড়ে গিয়েছিল এক মরুভূমির ওপর দিয়ে। সেই মরুর মধ্যে আছে এক পর্বতশ্রেণি, তার ওপর মালভূমি, সেখানে কিছু বাড়ি, শস্যক্ষেত। সেই শস্যক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী, সে হাত দিয়ে সূর্যের আলোকে আড়াল করে এই পাখিদের দেখছিল। মৃত্তিকার হাত অনুভব করে বালির উত্তাপ, সেই কিশোরীর উদ্বেগ।

‘আর কী অনুভব করে দিতা ?’ ভাবে মৃত্তিকা, ‘কী দেখে সে তার শিশুচোখ দিয়ে ? সে কি দেখতে পারছে মরুভূমির বালি লেগে আছে পাখির ডানায় ? সে কি দেখতে পাচ্ছে সেই কিশোরীকে ?’

উড়তে থাকে সারসদুটি দুলারির জলের ওপর, তারপর হারিয়ে যায় তীর পার হয়ে।

৩. পাহাড়দ্বীপ: পৃথা (অতীত)

কতদিন ধরে আমরা এই পাহাড়ে বাস করছি তা সঠিক করে আমাকে কেউ বলতে পারেনি। দূরে দিগন্তের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ পাহাড়কে আমরা বলতাম পড়ন্ত চিল। অনেকে বছর আগে সেই পাখি নাকি আমাদের পূর্বপুরুষদের তার পিঠে নিয়ে উড়ত ভালো বাসস্থানের খোঁজে। আমি ভাবতাম, উড়েছিল সেই পাখি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত, খুঁজেছিল সেই সুন্দর জায়গাটা যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষরা থাকতে পারবে স্বাচ্ছন্দ্যে। অগুন্তি দিন ধরে উড়ছিল সে, ঝড়ে বৃষ্টিতে প্রখর উত্তাপে আকাশের ধার ঘেঁষে। কখনও প্রবল বাতাসে সে তার প্রসারিত পাখা টানটান করে দীর্ঘ দেহকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল দেশান্তরে, কখনও শান্ত বাতাসে সে পাখা ঝাপটে সৃষ্টি করছিল ঊর্ধ্বচাপ। উড়ে যাচ্ছিল সেই পাখি তুষারাবৃত পাহাড়ের ওপর দিয়ে, বিরাট ঢেউয়ের জলাশয়ের ওপর দিয়ে। তার বিশাল পিঠে পালক আঁকড়ে বসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষেরা। তারা অপেক্ষা করেছিল তাদের আকাক্সিক্ষত দেশের জন্য। কিন্তু একদিন সেই পাখি এসে পড়েছিল এই বিশাল মরুর ওপর। যত বড়, যত শক্তিশালীই হোক না সেই পাখি, মরুর ঝলসানো সূর্যে সে হলো তৃষ্ণার্ত, তার পাখা হয়ে গেল শ্লথ, অবশেষে মুখ থুবড়ে পড়ল সে বালির মধ্যে। তার মাথা ডুবে গেল বালির নীচে, শুধু বেরিয়ে থাকল তার বিশাল লেজ। দূরের পাহাড়টাই সেই লেজ। আমার পূর্বপুরুষেরা বেঁচে গিয়েছিল, তারা উঠে এসেছিল এই পাহাড়দ্বীপে।

আমাদের সবাই বিশ্বাস করত সেই চিল-পাখির কথা। প্রতি সন্ধ্যায় সূর্যের রাঙা আলোয় দূরের সেই নিঃসঙ্গ পাহাড়চূড়া কালো ছায়া হয়ে যখন দিগন্তে দাঁড়িয়ে থাকত আমাদের বর্ষীয়ানরা ছোটদের ডেকে দেখাত পড়ন্ত চিলকে, বলত আমাদের অভিযানের কাহিনি। কিন্তু সেই কিংবদন্তি অনুসরণ করে আমি বুঝতে চাইতাম আমরা কত বছর ধরে বাস করছি এইখানে, কী করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই বিশাল মরুভূমি পার হয়ে এইখানে এসেছিল, আর মরুভূমি পার হয়ে কোথায় বা ছিল আমাদের আদি নিবাস।

আমরা খুব ভালো মাটির পাত্র বানাতাম। সেই পাত্রের গায়ে আঁকা থাকত নানা ধরনের নকশা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, সেই নকশা যুগে যুগে বদলেছে। পরিত্যক্ত বাসস্থানগুলোয় আমি খুঁজে বেড়াতাম পুরনো মাটির বাসন। তার নকশায় খুঁজতে চাইতাম অতীতের স্বপ্ন। নকশা বদলের সময় হিসেবে করতে চাইতাম, আর আমার চোখ পড়ে থাকত সেই আদি-নকশাটার জন্য।

তারপর একদিন আমাদের কুলমাতা হিরণ আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেল, মই দিয়ে নীচে নামি হিরণ-মাতার ঘরে।

হিরণ-মা মাটিতে চাদর বিছিয়ে বসেছিলেন। ঘরের ঠিক মাঝখানে জ্বলছিল আগুন, তার ধোঁয়া বেরিয়ে যায় ছাদের চতুষ্কোণ জানালার মধ্যে দিয়ে। ঘরে ঢোকার সেটা একটামাত্র পথ, ওপরের চতুষ্কোণ জানালার সঙ্গে লাগানো ছিল মই। হিরণের বর্ষীয়ান মুখ লাল হয়ে থাকে আগুনে, অত্যুজ্জ্বল চোখ নিরীক্ষণ করে আমার মুখ, তারপর বলে, ‘শোনো মেয়ে, তোমার মতো বুদ্ধিমান এ পাড়ায় কেউ নেই। অনেক বছর আগে আমি তোমার মতো সজীব ছিলাম, আমার মনে ছিল জানার অদম্য ইচ্ছে, তোমার মতোই আমি ঘুরে বেড়াতাম পুরনো পরিত্যক্ত জায়গাগুলোতে, উৎসের সন্ধানে। তোমার মতই খুঁজতাম মাটির পাত্রের নকশার অর্থ। কোথা থেকে আমরা এসেছি, মরুভূমির ওই পাশে কী আছে, এইসব ভাবনা নিয়েই কেটে যেত সময়। আমাদের কোনও লিখিত ইতিহাস নেই, আর তুমি ভালো করেই জানো আমাদের স্মৃতি কত সীমিত। বংশ-বংশান্তরে মৌখিক সংস্কৃতির কথা আমরা বলি, কিন্তু সেই স্মৃতির ইতিহাস বাস্তবকে বিকৃত করে দেয়। দেখতেই পাচ্ছ আমাদের সবাই এখন পড়ন্ত চিলের উপাখ্যানে বিশ্বাস করে।’

ওপরের জানালা দিয়ে আসা সূর্যের রশ্মি দেয়াল ধরে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যায়। বাইরে গিরিখাত থেকে ভেসে আসে কোনও রাতের পশুর চিৎকার। আমি ঠাণ্ডায় জড়োসড়ো হয়ে বসি। হিরণ আমাকে একটা তরমুজের টুকরো কেটে দেয়। তারপর বলতে শুরু করে, ‘শোনো, পৃথা, আমার বিশ্বাস আমাদের এই পাহাড়দ্বীপের সভ্যতা চার-পাঁচশ বছরের পুরনো। তার আগে আমরা নিশ্চয় বাস করতাম মরুভূমির ওপারে কোথাও।’

এরপরে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে হিরণ-মাতা। তারপর তার খোলা লম্বা সাদা চুল মাথার পেছনে সরিয়ে দিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘সর্বোত্তম সৃষ্টি হচ্ছে জল, সে সন্ধান করে সর্বনিম্ন স্থানের, অথচ প্রতিটি জীবনের মধ্যে দিয়ে সে বয়ে যায় সর্বোচ্চ গুণ সৃষ্টি করে। কিন্তু এখন আমাদের সব জল শুকিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু বদলাচ্ছে, আগের মতো বৃষ্টি হচ্ছে না। শোনো, পৃথা, গতকাল রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি এক বিশাল জলভূমির, বুঝতে পারি না অত জল কোথা থেকে আসবে। সেই জল আমাদের পাহাড়ের ঝর্নার মতো ক্ষীণকায়া নয়, সেই জলের একধারে দাঁড়ালে ওপার দেখা যায় না। বুঝলে পৃথা, সে হলো জলের মরুভূমি, সেও কি সম্ভব ? তার নাম নাকি সমুদ্র।’

জলের মরুভূমি! সে আবার কী ? ভাবি আমি। হিরণ উঠে যায় ঘরের কোনায়। একটা পাত্র থেকে বের করে নিয়ে আসে মোড়ানো কী একটা জিনিস, খুলে ধরে আমার সামনে। কাপড়ের মতন পাতলা ছিল সেটা, তার ওপর নানা নকশা। হিরণ বলে, ‘জানো এটা কী জিনিস ? আমি শুনেছি এর নাম নাকি কাগজ। আর এই যে দেখছ নকশা সেটা নাকি এই পৃথিবীর মাঝে কী আছে না আছে তার প্রতিরূপ। আকাশ থেকে পৃথিবীকে যেন দেখায় এই নকশা নাকি তারই প্রতিচ্ছবি। এর মধ্যে কত জলের মরুভূমি আছে কে জানে!’

আমি সাবধানে সেই কাগজ হাতে নিই। সেই শুষ্ক জিনিসটা মনে হয় এখনই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে। মাটিতে বিছিয়ে দিই সেই কাগজ। কে তৈরি করেছে এমন জিনিস যার ওপর নকশা কাটা যায় অথচ যা কিনা ভেঙে যায় না ?

‘তুমি যে-নকশা দেখেছ তাকে বলে মানচিত্র। আরও একটা জিনিস তোমাকে আমি দেখাতে চাই,’ হিরণ বলে। হিরণ সেই পাত্র থেকে একটা উজ্জ্বল জিনিস বের করে আনে, বলে, ‘আর এটা, জানো এটা কী ? এটা হচ্ছে ধাতু। ধাতুর ছোরা। সাবধানে ধর।’

আমি খুব আলতোভাবে দুহাত দিয়ে সেই ছোরাটা ধরি। ধাতু ? সে আবার কী জিনিস ? ছোরার ফলাটা কী তীক্ষè! মনে হয় এখনি হাত কেটে যাবে।

‘শোনা পৃথা, আমি জানি না ধাতু কেমন করে তৈরি করে। এই ছোরাটা নিশ্চয়ই আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিয়ে এসেছিল মরুভূমির ওপারে কোনও দেশ থেকে যেখানে তারা বা অন্য কোনও জাতি ধাতুর ব্যবহার জানত। যদি আমরা ধাতু পেতাম আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হতো।’

হিরণ মাটি থেকে উঠে আগুনের চারদিকে ঘুরতে থাকে। ঘুরতে থাকে আর বলতে থাকে, ‘এই জিনিসগুলো আমাকে দিয়ে গেছে আমাদের পূর্ববর্তী উপাসক। এর মধ্যে লুকানো আমাদের উৎসের রহস্য, ইতিহাস। আর আজ আমি তোমাকে এইগুলো দিয়ে যাচ্ছি। আশ্চর্য হয়ো না, পৃথা, আগামীকাল থেকে তুমি হবে আমাদের কুলমাতা, আমাদের প্রধান উপাসক।’ ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে হিরণ ধীরে, তারপর দ্রুত, শুকিয়ে যাওয়া মুখে ঘাম ঝরে।

আমি মাটিতে বসে থাকি। অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি আমি নাকি হিরণের যোগ্য উত্তরসূরি। আমি বলি, ‘হিরণ-মা, তুমি এখনও কত স্বাস্থ্যবান, আমাদের তোমার অনেক কিছু দেয়ার আছে এখনও।’

হাসে হিরণ। বলে কাঁপা গলায়, ‘আমার এবার যেতে হবে পৃথা, আমাদের নতুন অধিনায়ক দরকার। তবে তোমার কিছু জিনিস জানা দরকার। গত চল্লিশ বছর ধরে দেখছি আমাদের মানুষদের। আমাদের প্রকৃতি বদলাচ্ছে, শস্য উৎপাদন কমে এসেছে, আমাদের শিশুরা হচ্ছে বিকলাঙ্গ। আমরা এইভাবে বাঁচব না। আমাদের এই পাহাড়দ্বীপ ছাড়তে হবে, খুঁজে বের করতে হবে আমাদের হারিয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষের বংশধরদের।’

‘কিন্তু হিরণ-মা, আমরাই তো একমাত্র মানুষের দল এই পৃথিবীতে।’

‘তুমি এই বুড়োগুলোর কথা শুনছ মা। জন্ম থেকে যা শুনে আসছ সবসময় তা বিশ্বাস কোরো না। নিজের থেকে বিচার করো। তোমার নিজের যুক্তিতে ভরসা রাখবে, খোলা মন নিয়ে সব কিছু জানতে চাইবে। জানবে যে, এখানে থাকলে আমরা ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। শোনো পৃথা, তোমার ওপর দায়িত্ব দিলাম আমি—আমাদের সবাইকে এই মরুভূমি পার করে নিয়ে যেতে হবে তোমার। কথা দাও পৃথা, তুমি এদের সবাইকে বাঁচাবে, নিয়ে যাবে এই জলহীন মরুভূমি পার হয়ে সবুজের দেশে, জলের মরুভূমির পাড়ে। তুমি কুলমাতার সঠিক দায়িত্ব পালন করবে।’ হিরণ আমার হাত ধরে। তার বৃদ্ধ চোখ থেকে জল গড়াতে থাকে। আমি তার কাঁধে মাথা রাখি। সে আমার লম্বা চুলে আঙুল বোলাতে থাকে।

সে’রাতে আমি কুঠুরিতে ঘুমাই না। বনের মধ্যে ঝাউ-পাতায় শুয়ে স্বপ্ন দেখি আমার চারদিকে জল, তার মধ্যে দিয়ে আমার শরীর উড়ে যাচ্ছে। সেই জলের শেষ নেই। সকালে উঠে ভাবি সেই অন্তহীন জলের নাম হিরণ-মাতা বলেছিলেন সমুদ্র।

এর পরের দিন হিরণ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন মহাযাত্রায়। উত্তরের বনের পেছনে যে গভীর গিরিখাত আছে তার মধ্যে উপাসকেরা তাদের শেষ দিনগুলো কাটায়। এই ছিল আমাদের রীতি। আমার বাবা ও মা বেঁচে ছিল না, তাদের বয়স ত্রিশও হয়নি যখন তারা মারা যায়। আমাকে সাহায্য করার জন্যে কোনও আত্মীয় ছিল না, আর এখন পনেরো বছরের একটা মেয়ের ওপর অনেক দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল হিরণ। কী করে সবকিছু সামলাব ভাবি, বুড়োরা আমাকে পছন্দ করত না। এদের মধ্যে বিষাণই ছিল সবচেয়ে বর্ষীয়ান, বয়স ছিল চল্লিশের ওপর। আমি ধারণাই করতে পারতাম না যে কেউ অত বছর বাঁচতে পারে।

পাহাড়ের ওপর আমরা চাষ করতাম, শস্য বয়ে নিয়ে আসতাম পাথরের ওপর খোদাই-করা সিঁড়ি ধরে পাথরের ছাদের নিচে বাসস্থানে। উপাসক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো সূর্য ও চন্দ্রের গতিবিধি অনুসরণ করে ঋতু নির্ধারণ, ফসল বোনার সময় বলে দেয়া, অসুখ-সারানো বালির দেবতাকে খুশি রাখা।

হেমন্তের সময় পূর্বে চাঁদ উঠত লাল হয়ে। তখন হাওয়া আসত উত্তর থেকে, বালির ঘূর্ণী হত। আমরা ভাবতাম বালির ঝড় চাঁদকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। তাই বালির দেবতাকে খুশি করতে আমরা নানারকম অনুষ্ঠান করতাম।

হিরণ চলে যাবার এক মাস পর আমি সবাইকে চত্বরে ডাকলাম, বললাম, আমাদের মরুভূমি পার হবার রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। বিষাণ, যে আমার কুলমাতা হওয়া পছন্দ করেনি, প্রথমেই খুব প্রতিবাদ করল, মরুভূমির ওপারে নাকি কিছু নেই, যে মরুভূমি পার হবে সে নাকি মহাশূন্যে তলিয়ে যাবে। আমি বললাম, পৃথিবীতে যদি আর কিছু নাই থাকবে তাহলে উড়ন্ত চিল আমাদের কোথা থেকে নিয়ে এসেছিল। আমাদের এইবার খুঁজে বের করতে হবে নতুন জায়গা। ওপরের মালভূমিতে কয়েকশ বছর চাষ করার পর আমরা আর ফসল পাচ্ছি না। আমাদের শিশুরা দুর্বল, আমাদের বৃদ্ধরা অথর্ব, বনের পশুরা নিশ্চিহ্ন। যদি আমাদের জাতি বাঁচতে চায় তাদের বের করতে হবে নতুন জমি আর নতুন মানুষ।

উড়ন্ত চিলের কাহিনিতে প্রথমে ওরা চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু ‘মানুষ’ কথাটা শুনে আঁতকে ওঠে অনেকেই।

বিষাণ ভিড় কাটিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। ‘এসব বদবুদ্ধি দেয়ার জন্যে কি হিরণ তোমাকে উপাসক নিযুক্ত করেছে ?’ চিৎকার করে ওঠে সে।

‘আমি তোমাদের যা বলছি তা হিরণ-মারই কথা। আমি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম সবাইকে আমি মরুভূমি পার করে নিয়ে যাব।’

‘তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই মরুভূমি কেউ পার হতে পারবে না, বালির দেবতার এই আদেশ। তোমরা কেউ এই মেয়েটির কথা শুনো না,’ উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বিষাণ বলে। আমি বুঝতে পারি অনেকেই বিষাণের কথা শুনছে, মাথা দুলিয়ে সায় দিচ্ছে। বিষাণ বলে যায়, ‘শোনো! মরুভূমির ওপারে মানুষ থাকে না, থাকে পৈশাচিক জীবেরা, তাদের হাত থেকেই বাঁচাতেই পড়ন্ত চিল আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।’

বুঝতে পারি এরপরে আমার কথা কেউ শুনবে না। বাধ্য হয়ে পায়ের কাছে রাখা কাপড়ের বান্ডিল থেকে ধাতব ছোরাটা বের করে আনি। হিরণ আমাকে বলে দিয়েছিল সেটা কাউকে না দেখাতে, কিন্তু উপায় ছিল না। মাথার ওপরে তুলে ধরতেই সেটি সূর্যের আলোয় ঝলকে ওঠে। ওরা কোনও দিন এরকম জিনিস দেখেনি, ওরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। আমি শূন্যে ধীরে ধীরে সেই ছোরা ঘোরাই, আলোর তীব্র প্রতিফলন বারে বারে ওদের চোখে ফিরে আসে, ওরা বারে বারে চোখ কুঁচকায়, সম্মোহিত হতে থাকে।

‘শোনো’, বলি আমি, ‘এই বস্তুর নাম ছোরা। এটি শক্ত পাথরের তৈরি নয়, এটি ঝলমলে পাথরের তৈরি নয়। যে জিনিস দিয়ে এটা তৈরি তার নাম ধাতু। আমি জানি না ধাতু কীভাবে তৈরি হয়, কিন্তু আমি জানি এই ধাতুর ছুরি খুব শক্ত ও তীক্ষ্ণ, পাথর আর জল ছাড়া যেকোনো জিনিস এটা সহজে কাটতে পারে। কে তৈরি করেছে এই জিনিস ? আমি জানি না। কিন্তু যে করেছে সে আছে এই মরুভূমি পার হয়ে। সে আরও কী জিনিস তৈরি করেছে আমি জানি না। কিন্তু হতে পারে তার কাছে আছে অফুরন্ত ফসল, আছে আমাদের শ্বাসকষ্টের ওষুধ। তোমরা কি দেখতে চাও না সেই দেশ যেখানে বাঁচার জন্যে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয় না ?’

সবাই সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার হাতের ছোরার দিকে। অনেকক্ষণ কেউ কথা বলে না, তারপর বিষাণ বলে, ‘যারা এই রকম জিনিস বানাতে পারে তারা আমাদের ছেড়ে দেবে না। কয়েক মুহূর্তে তারা আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তোমরা যদি মরুভূমি পারও হও সেই জাতি যে আমাদের শত্রু হবে না কে বলতে পারে ?’

কিন্তু বিষাণের কথা কেউ শোনে না। ঝলকায় ধাতব ছোরা আমার হাতে, চমকাতে থাকে দুপুরের সূর্যে। সবাই ভিড় করে দাঁড়ায় আমার চারপাশে। সবার হাত ঊর্ধ্বে উঠে আসে, প্রসারিত হয় সেই ধাতব ফলার দিকে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি জনতার মাঝে। আমার ডান হাত আকাশে উত্তোলিত, তাতে উজ্জ্বল থাকে আমাদের ভবিষ্যৎ।

৪. মৃত্তিকা (বর্তমান)

বৃষ্টি নামে। ছোট ছোট ফোঁটার বৃষ্টি আকাশ ভরিয়ে দিয়ে নেমে যায় পৃথিবীর বুকে। দুলারির বুকে জল হয়ে ওঠে ভারী। পাথরের মতো ভারী জল, ভাবে মৃত্তিকা। সে অনুভব করে মুখে জলের ঝাপটা। দিতার হাত ধরে সে ভেতরে বড়ঘরে গিয়ে বসে। অনেক জটলা সেই ঘরে। বাইরে বৃষ্টির সোঁদাগন্ধ দমকা বাতাসে ভেতরের গুমোট আবহাওয়াকে একটু হালকা করে দেয়। দিতা সেখানেও আঁকে, মধ্যে মধ্যে ঘরের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নেয়। মৃত্তিকা ঝোলা থেকে খাবার বের করে, দিতা পা দুলিয়ে একহাতে খাবার খেতে খেতে আঁকে। অন্ধকার হয়ে আসে ঘর। মেঘঢাকা আকাশে সন্ধ্যার আঁধার নামে বেলা থাকতেই। মৃত্তিকার চোখে যে আবছা আলোটুকু ছিল এতক্ষণ বাইরের পৃথিবীর চিহ্নটুকু ধরে তাও মিলিয়ে গেল, শরীরটা খারাপ লাগছে, মাথা ঘোরে।

‘কী হয়েছে মা ?’ উদ্বিগ্ন দিতা জিজ্ঞেস করে। উত্তর দিতে পারে না মৃত্তিকা। অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মেঝেতে। তার হাত তবু শক্ত করে ধরে থাকে দিতার হাত।

অনেক আলো দেখে মৃত্তিকা, তার অন্ধকার জগৎ নিশ্চিন্ত আকাশের নীলে ভরে যায়। কিন্তু আলো মিলিয়ে যায়, অন্ধকার ফিরে আসে। অচেতন মৃত্তিকার মস্তিষ্কের কোথাও কিছু স্মৃতি জাগরিত হয়। সে দেখে মড়ক লেগেছে তার গ্রামে। কোথায় বনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক জীবাণু মানুষের অপেক্ষায়। কে যেন গিয়েছিল বনে, আক্রান্ত হয়েছিল সেই অদৃশ্য জীবাণুতে। তাই আজ ঘরে ঘরে মৃত্যুর ছোঁয়া। এক ছোট কুটিরে একটা নীচু খাটে শুয়ে আছে মৃত্তিকা। পাশে বসে থাকে তার মা ও বাবা। হাত ধরে থাকে মা। তাদের দেখতে পায় সে স্পষ্ট, কিন্তু ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে তার দৃশ্যমান পৃথিবী। বেঁচে গিয়েছিল সে, কিন্তু জীবাণু কেড়ে নিয়েছিল তার দৃষ্টি। শেষ বারের মতো মায়ের মুখটা দেখে রেখেছিল মৃত্তিকা।

স্টিমারের এক ঘরে মেঝেতে পড়ে থাকে অচেতন মৃত্তিকা, অনেক লোক তাকে ঘিড়ে আছে, কিন্তু কেউ কী করবে বুঝে পায় না। হঠাৎ ভিড় সরিয়ে কাছে আসে এক দীর্ঘকায় আগন্তুক পুরুষ, তার কালো চুল ছড়িয়ে থাকে ঘাড়ের ওপর। হাত তুলে সে থামিয়ে দেয় গুঞ্জন, মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা মৃত্তিকার দেহটা নিয়ে অনায়াসে বেঞ্চে তুলে দেয়। বেঞ্চের সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আগন্তুক, মুখ তুলে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আপনারা নিজেদের জায়গায় ফিরে যান, আমি চিকিৎসক, আমি জানি কী করা দরকার।’ সবাই যেন কথাটা বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের ওপর ভরসা করে কিছু করে না, তাই তারা আগন্তুকের ওপর কথা বলতে পারে না, সবাই ফিরে যায় নিজেদের আসনে।

‘কিছু হয়নি তোমার মা’র,’ আশ্বাস দেয় আগন্তুক দিতাকে। জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার নাম কী, আর তোমার মা’র নাম ?’ দিতা উত্তর দেয়, তারপর সে প্রশ্ন করে, ‘তোমার মা কি ওষুধ খায় ? কী ওষুধ খায় জানো জানো ?’ মাথা দুলিয়ে সায় দেয় দিতা, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ব্যাগের মধ্যে খাবার। ব্যাগটা খোলে আগন্তুক, ভেতরে ওষুধ দেখতে পায় না, কিন্তু উজ্জ্বল একটা কিছু চোখে পড়ে। সেটা হাত দিয়ে তুলতে গেলে একটা তীক্ষè ব্যথা অনুভব করে সে, ডান হাতের তর্জনী কেটে গেছে তার। তীক্ষè একটি ছোরায় হাত কেটেছে। তার  ব্যথার অনুভূতি ছাড়িয়ে ওপরে ভেসে ওঠে অন্য একটা কিছু, একটা বোধ। অতি-পরিচিত অথচ ছোঁয়ার বাইরে। তার মনে হয় বদলে গেছে পরিবেশ, মাথা তুলে ঘরের সবার দিকে চায়, দেখে সেখানে আর ঘর নেই। ঘরের বদলে সে বসে আছে এক পাহাড়ি মালভূমির ওপরে, লাল রঙে সূর্য ডুবছে বহু দূরে অন্য পাহাড়ের পেছনে, আর পাহাড়গুলোর মাঝে ছড়িয়ে আছে হলুদ বালি। ওপরে উড়ে যাচ্ছে দুটি সারস। আর দূরে, গিরিখাত পার হয়ে, আর একটি মালভূমি, মালভূমির ধারে চতুষ্কোণ গুহার মত জায়গায় মানুষের বাড়ি। এই দৃশ্যটা রইল শুধু মুহূর্তখানেক, তারপর আবার সে আগের ঘরে ফিরে এল। ব্যাগ থেকে হাত বের করে আনে তর্জনী থেকে রক্ত ঝরছে। আবার ব্যাগে হাত ঢোকায় আগন্তুক, বের করে নিয়ে আসে ছোরাটা। ছোরার বাঁটে কিছু প্রতীক আঁকা, অথবা কোনও কথা—সেই ভাষা সে জানে না। কিন্তু যে মুহূর্তে সে ছোরার ধাতব অংশ ধরে সেই মুহূর্তে সে ফিরে যায় আবার মরুভূমির মধ্যে সেই মালভূমিতে। ছোরাটা রেখে ব্যাগে ওষুধ খোঁজে সে, কিন্তু কিছু পায় না। এরপরে নাড়ি দেখে মৃত্তিকার, তাতে সন্তুষ্ট হয় সে।

মৃত্তিকা তখনো স্বপ্ন দেখে—‘আমি এমন জিনিস দেখেছি যা তোমরা কল্পনা করতে পারবে না,’ কে বলেছিল এই কথা ? তাদের গ্রামে এসেছিল এক অদ্ভুত মানুষ, তাকে কি সাধু বলা যায়। কী নাম ছিল তার ? নিষাদ ? সে কী দেখেছিল মৃত্তিকা জানে না। হয়তো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, বিশাল উল্কাপিণ্ড, দিগন্তব্যাপী বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ? কিংবা মহামারী, রাষ্ট্রযন্ত্রের দুঃশাসন, গণহত্যা। বলেনি সেই সাধু। তার কথা অনুসরণ করে আজ মৃত্তিকা বলে, ‘তোমাদের কল্পনাতেও আসবে না যে, তোমরা যা দেখছ তার এক ফোঁটা দেখার জন্যে আমি কী না করতে পারি।’ নিষাদের চেহারা মন থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, যেমন যায়নি দিতার চেহারা মুখখানি। কতদিন দিতার মুখমণ্ডলের পর হাত বুলিয়েছে সে। মা আর মেয়ের নাক কি একইরকম ? আন্দাজ করে নিয়েছে মৃত্তিকা মেয়ের মুখটাকে। কিন্তু দিতার চোখের রঙ সে দেখেনি কোনওদিন। লোকে তাকে বলেছে ঝকঝকে কালো নাকি সেই রঙ। কালো চেনে মৃত্তিকা। কালো রঙ কি ঝকঝক করতে পারে ? আজ লোকভর্তি এক গুমোট ঘরে কে যেন মৃত্তিকার ওপর ঝুঁকে বলে, ‘দেখতে চাও তোমার মেয়ের মুখ ?’ চিৎকার করে বলতে চায় মৃত্তিকা, ‘চাই, চাই।’ কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না, স্বররজ্জু বিদ্রোহ করে। উত্তর না শুনে সেই আবছা মুখ অপসৃত হতে থাকে। উঠে বসতে চায় মৃত্তিকা, দু হাত বাড়িয়ে সেই ছায়াকে ধরতে চায়, বলতে চায়, ‘যেও না, যেও না, আমায় আর একটা সুযোগ দাও। একবার আমাকে দৃষ্টি দাও।’ কিন্তু ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ে। আবার এক অন্ধকার সমুদ্রে চোখ মন ডুবে যায়। তবু একটা বোধ সমস্ত অচেতনাকে অগ্রাহ্য করে ভেসে থাকে, মেয়ের হাতটাকে শক্ত করে ধরে থাকে মৃত্তিকা।

বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। একটা ভ্যাপসা গরম কেবিনটাকে দখল করে নিতে থাকে। একটা রুমাল দিয়ে মৃত্তিকার কপালের ঘাম মুছে দেয় আগন্তুক। দিতার এক হাত শক্ত করে ধরা থাকে মৃত্তিকার হাতের মুঠোর মধ্যে। অন্য হাতে ধরা থাকে তার সদ্য-আঁকা ছবির পাতা। তাতে আঁকা রাতের আকাশ, নক্ষত্রখচিত। সেই আকাশে একটা তারা উজ্জ্বল। আগন্তুক তাকিয়ে থাকে সেই চিত্রের দিকে, তারপর বিস্মিত স্বরে বলে, ‘আর্দ্রা ?’ অতিদূর আকাশে জ্বলতে থাকে লাল-নক্ষত্র আর্দ্রা। জ্বলছে সে নিয়ত কোটি বছর ধরে। আর কত বছর ?

একটা মুহূর্ত সমস্ত বাস্তবকে ধরে রাখতে পারে। মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরে আসতে শুরু করে। সে অনুভব করে তার মাথায় কে হাত রেখেছে। এক বিশাল অন্ধকারে মৃত্তিকার মনে হয় কোথায় যেন আলো জ্বলছে, সেই আলো জ্বালিয়ে রাখতে ঘরের সব বাতাস নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। গভীর রাতে আকাশে ঝকঝক করে ছায়াপথ। তার নিচে অন্ধকার মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্তিকা। হঠাৎ মাঠের পাড়ে দেখা যায় একটা আলোর রেখা, বাতি নিয়ে কে যেন একজন আসে, কাছে এসে দাঁড়ালেও তার অবয়ব দেখা যায় না। হঠাৎ সে কথা বলে জোরালো পুরুষকণ্ঠে, ‘তুমি এমন জিনিস দেখেছ, মৃত্তিকা, যা কেউ তাদের স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। সময় যখন পেছনে চলতে আরম্ভ করবে শুধু তখনই, যখন সমস্ত অতীতকে আবার পুনর্গঠন করা যাবে হয়তো সবাই সেই সব অত্যাশ্চর্য জিনিস দেখবে।’

চিরন্তন অন্ধকারের কি কোনও বিকল্প হতে পারে ? পারে না। সেই অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টির রূপ খুঁজতে অসুবিধে হয় মৃত্তিকার। সূক্ষ্ম শ্রবণ ও ত্বকের বোধকে অবলম্বন করে পৃথিবীর ছবিকে সে পড়তে চেয়েছে। তার অন্ধত্ব তাকে আর পাঁচটা মানুষ থেকে আলাদা করে দিয়েছে। যদিও সেই জন্মান্ধ নয় তবু সে ভেবেছে জন্মান্ধ জীবদের কথা, তাদের বোধের কথা। তাদের কি রঙের ধারণা আছে ? নিজেকে গাছের মতো মনে হয় মৃত্তিকার, সারাদিন সূর্যের আলো আস্বাদন করে সে। তার দেহ অনুভব করে পৃথিবীর আলিঙ্গন। সন্ধ্যা হলে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। অনেক রাত আছে যখন সে নক্ষত্রের আলো অনুভব করতে চেয়েছে, পারেনি। রাতের পৃথিবী ধীরে ধীরে তার কাছে থেকে অবোধ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আজ তার অচেতনতার আঁধার নদীর নিষ্কল্প তলে যে-আলোর রেখা মুহূর্তে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল সেই আলো খুঁজে পেতে মৃত্তিকা তার মনের গভীরে ঝাঁপ দেয়। সে সাঁতরায় এক অন্ধকার নদী আর সেই নদীর পারে এক দীপশিখা জ্বলতে নিভতে থাকে। কিন্তু সেই দীপশিখা ধরে রাখতে পারে না মৃত্তিকা, যতক্ষণে সে নদীর পারে পৌঁছায় ততক্ষণে সেই আলো অদৃশ্য হয়ে যায় মাঠের অন্য দিকে। আকাশের ছায়াপথও আঁধারে মিলিয়ে যায়। মলিন হয়ে আসে দৃষ্টি। আবার অন্ধকার। মৃত্তিকার জ্ঞান ফিরে আসতে শুরু করলে আগন্তুক উঠে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ ধরে সে দেখে মৃত্তিকার মুখ।  দিতাকে বলে, ‘তোমার মা’র জন্য আমি জল নিয়ে আসছি।’ তারপর ভিড় কাটিয়ে কেবিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় আগন্তুক। বাইরে তখন কালো রাত্রি।

এরপরে সকাল হয়, সকালের ঠাণ্ডা বাতাস খোলা দরজা দিয়ে ঢোকে। মা’র হাতটা ধরে দিতা মেঝের ওপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, এখন তড়বড় করে ওঠে। কোথায় গেল সেই আগন্তুক যে তার মা’কে বেঞ্চে তুলে দিয়েছিল ? জল আনবে বলে যে বেরিয়ে গিয়েছিল ? সে কি আর ফিরেছিল ? মৃত্তিকারও ঘুম ভেঙে যায়, রাতের অসুস্থতা লেগে থাকে শরীরে অবসাদ হয়ে। কোনও এক স্বপ্ন দেখছিল সে, সেই স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে আলোর আশ্বাস। রাতের আগন্তুককে সে দেখেনি, কিন্তু দিতার কথা শুনে তার মনে হল সেই আগন্তুক যেন তাকে বলেছিল, ‘মৃত্তিকা! একদিন আবার তুমি দেখবে এই পৃথিবীকে।’

বাইরে সূর্য উঠতে থাকে। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে তার লাল আলো ডেকে এসে পড়ে। নতুন দিন শুরু হয়, কিন্তু এই দিনটা অন্য দিনটার মতো নয়। স্টিমারের গতি হয়ে আসে মন্থর। দিতা শোনে ডেকে শোরগোল, মৃত্তিকার হাত ছাড়িয়ে সে চলে যায় বাইরে। বাইরে দুলারি নদীর জল সবুজ শ্যাওলায় তখন ঢেকে গেছে। দুলারির জল যেন জল নেই, এক উষ্ণ বাষ্পাচ্ছাদিত সবুজ চাদরের মতো সে নিথর হয়ে থাকে, তারপর হঠাৎই তা থেকে বের হতে থাকে বুদ্বুদ। জল যেন কাদা হয়ে যায়, স্টিমার তাতে চলতে পারে না। সবাই যখন পারের দিকে তাকায় তারা দেখে এক নতুন জগৎ। কোথায় গেল সেই বিস্তীর্ণ মাঠ ? বিশাল মহীরুহে ঢাকা থাকে দুই পার। তাদের সবুজ মাথা উঠে গেছে ওপরে দৃষ্টির বাইরে। গুমোট গরমে ভারী হয়ে আসে বাতাস। গাছের ডালে ডালে জড়ানো কিছু যেন নড়ে ওঠে, তারপর লম্বা দেহ নিয়ে মিলিয়ে যায় মাটিতে। জলের মধ্য দিয়ে ভেসে যায় এক দীর্ঘদেহী সরীসৃপ। বাষ্প উঠতে থাকে নদী থেকে, থকথক করে তাতে শ্যাওলা।

আকাশের দিকে তাকানো যায় না। এক উজ্জ্বল গোলক সেখানে সাদা রশ্মি বিকিরণ করে।

দুলারি নয়, এক শরতের সকালে স্টিমার এসে পড়ে অন্য কোনও বিষুবীয় নদীতে। দৌড়ে ফিরে আসে দিতা। ‘মা,’ চিৎকার করে বলে সে, ‘সব বদলে গেছে।’ বদলে গেছে, বদলে গেছে, মনে মনে বলতে থাকে মৃত্তিকা। বদলে যাবারই কথা। কয়েক হাজার বছর ধরে সে যেন এর জন্য অপেক্ষা করেছে।

দিতা আবার কিছু বলতে চায়। মৃত্তিকা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলে। বাইরে যাত্রীরাও চুপ হয়ে যায়। নদীর বাষ্প জাহাজ বেয়ে ঘরে ঢোকে। মৃত্তিকা সেই গন্ধ পায়। শক্ত করে সে ধরে দিতার হাত। হঠাৎ মনে হয় নদীর ধারে এমন কিছু রয়েছে যা তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এমন কিছু, যার জন্য সে অপেক্ষা ছিল না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার মনের গভীরে ওই অজানার সংকেত ছিল। মনে হলো তার জীবন এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এই অন্ধত্বের বাইরে যা-কিছু হারিয়ে গিয়েছিল তার বিন্দুমাত্র যদি আজ ফিরে পাওয়া যায়।

৫. অসিতোপল (বর্তমান)

আমার নাম অসিতোপল। ছোট এই জাহাজে চলেছি তুরাতে, চিতা বাহিনী থেকে পালিয়ে। দেড়দিন হল নদীতে চলছে এই জাহাজ অথচ মনে হচ্ছে যেন অনাদিকাল। শরতের নদীর বাতাসকে আমি খুব ভালবাসি। কিন্তু প্রথম দিকে কারও সঙ্গে কথা না বলতে পেরে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। পরে জাহাজের ক্যাপটেনের সঙ্গে আলাপ হয় আর এই কথাগুলো সে আমায় বলে, ‘আমি এই লাইনে অনেক দিন ধরে জাহাজ চালাচ্ছি। এই নদীর প্রতিটা শাখা-প্রশাখা, চর গ্রাম বন সব আমার হাতের রেখার মতো চেনা। বলতে পারেন আমি চোখ বন্ধ করে এখানে জাহাজ চালাতে পারি। আমার কাছে এই জাহাজ যেন আমার শরীরেরই অংশ। ছ’বছর। হয়তো ছ’বছর খুব বেশি সময় নয়, কিন্তু এই ক’বছরে তার ইঞ্জিন, ডেক, প্রপেলারকে আমি এমনভাবে চিনেছি যে তারা সব যেন আমার দ্বিতীয় বোধ। আমার পদোন্নতি হবার কথা, হয়েও ছিল। ওপর থেকে লোকজন আসে বছরে বছরে, তারা ভালো রিপোর্টও দেয়। কিন্তু তা হলে আমাকে চলে যেতে হবে বড় অফিসে, কেরানির চাকরি করতে হবে। কেরানিগিরি আমার পছন্দ না। নদীর বাতাস দেখছেন তো, দুলারির মতো বাতাস কোথাও নেই। আমি অনেকদিন সমুদ্রে ছিলাম, কিন্তু সমুদ্র আমাদের কোনও দিকনির্দেশ দেয় না, অসীমের মধ্যে পড়লে কোনও নির্দেশ-ফ্রেম পাওয়া যায় না। কিন্তু নদী সবাইকে আপন করে নেয়। তাই আমি পদোন্নতি প্রত্যাখ্যান করলাম।’

‘আমার বাড়ি তুরাতে। কাজেই বুঝতে পারছেন তুরা থেকে রাজধানীর পথটা আমর জন্য উত্তম। তিন দিনের পথ, যাতায়াতে ছ’দিন। এমন কিছু নয়, এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়ি ফিরে যাই।’

এটুকু বলে ক্যাপ্টেন কিছু ভাবে, যেন পরের কথাগুলোকে সাজায়।

‘কিন্তু একটা কথা কি জানেন ?’ প্রতিবার যখন আমি বাড়ি ফিরে যাই আমার মনে হয় আমি এক বছর পরে ফিরছি। না, না ক্যালেন্ডারের তারিখ সব ঠিকই থাকে, ব্যাপারটা নিতান্ত মানসিকও নয়। প্রতিবারই আমার তুরার বাড়িটাকে আমি চিনতে পারি না। বছরখানেক পরে কোনও জায়গায় ফিরলে যেমন স্মৃতির কোনা হাতড়ে অনেক কিছু মনে করতে হয়, সেইরকম আর কি ব্যাপারটা। বুঝতেই পারছেন ছ’বছরে এই অভিজ্ঞতাটা আমার অনেক অনেক বার হয়েছে। কিন্তু আমি আমার দিনপঞ্জি দেখি, জাহাজের লগ-বই দেখি, তাতে ওই ছ’দিনের বেশি হিসেব দেখি না। অন্য কর্মচারীরা ? না, তাদের কথা বলতে পারব না, তাদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলি না, আমি জাহাজের ক্যাপ্টেন, বুঝতেই পারছেন আমার প্রতি তাদের বিশ্বাস অটুট রাখা দরকার। আমি এই নিয়ে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছি, কয়েকজনের এই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবার হয়নি।

‘রাজধানীর প্রতিটা যাত্রা আমার জন্য একটা স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন থেকে উঠে যেমন আমরা প্রায়ই ভুলে যাই কী দেখেছি অনেকটা সেই রকম। একটা আবছা স্মৃতির ভাব থাকে। আপনাকেই শুধু বলছি। আপনি তুরা যাচ্ছেন, আপনিও হয়তো এই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাবেন। হয়ত প্রথমে বুঝবেন না। কিন্তু সজ্ঞানে যদি কিছু অনুভব করেন, চেষ্টা করবেন সেই অনুভবকে ভেঙে দিতে, যেমন অনেক সময় স্বপ্ন আমরা ভেঙে দিতে চাই।’

ক্যাপটেন সম্মোহিতের মতো বলতে থাকে। যতই তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি ততই তার বিস্ফোরিত মণি আমাকে এক উদভ্রান্ত জগতে টেনে নিয়ে যায়। এই লোকটা তার প্রতিটা কথা বিশ্বাস করে। তার তরুণ চেহারা যেন বহন করে শতবর্ষের ক্লান্তি, অমরত্বের অভিশাপ। এই মানুষটি ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে।

সূর্যের শেষ আলোর রেখা নদীর ওপর ভেঙে পড়ে। নিচে ঘূর্ণি-তোলা জলের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখতে চাই আমি। এই মুহূর্তগুলো নিয়েই জীবন। একদিন বহু বছর পর এই মুহূর্তটাকে স্মরণ করব যখন শরতের বাতাসে স্টিমারের নিচে ঘূর্ণিজল আমার দৃষ্টি ধরে রেখেছিল। নদীর পারে শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবন মিশে গেছে অম্লজানের আর অঙ্গারের অণু-পরমাণুতে, সৃষ্টি করেছে পরবর্তী শতাব্দীর মানুষের, বৃক্ষের। তাই সবার মধ্যেই বাস করে সেই হারিয়ে যাওয়া অতীত। এই মুহূর্তের ঘূর্ণিজল পরের মুহূর্তে অতীত, কিন্তু যে আলোক-কণিকা তাকে ছুঁয়ে প্রবেশ করেছে আমার চোখে, মনের কোনও গভীর কোষে তার ছোঁয়া রয়ে যাবে ভবিষ্যতের জন্য। সার্চলাইট জ্বলে ওঠে স্টিমারের।

নিচের ডেকে এক অন্ধ মা তার ছোট মেয়েটার হাত ধরে কেবিনে চলে যায়। তুরা থেকে দেখে আসছি তাদের। এক আশ্চর্য আকর্ষণ অনুভব করেছি, কিন্তু কাছে গিয়ে বলতে পারিনি তাদের সঙ্গে। ছোট মেয়েটা সারাক্ষণ কী যেন এঁকে চলেছে। অনেক সময় দেখেছি তার মা সেই আঁকার ওপর হাত বোলাচ্ছে, যেন রঙের উত্তাপ অনুভব করছে।

‘আমার কর্মচারীরা এক মাসের বেশি এই লাইনে কাজ করতে চায় না। অবসাদ, বুঝলেন, অবসাদ,’ ক্যাপটেন আবার বলতে থাকে, ‘কিন্তু আমি নিজেকে আটকাতে পারি না। প্রতিবার ভাবি এইবার আমি সব মনে রাখতে পারব, কিন্তু তা হয় না।’ আবার হারিয়ে যায় তার। জাহাজের এই নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে নদীর পার দেখা যায়। সেখানে মাঝে মধ্যে দু একটা কুটিরের আলো, মন হয় কম্পমান—প্রদীপ শিখার মত। জ্বলে অসংখ্যা জোনাকি, একসাথে হাজার জোনাকী জ্বলে, নেভে, এক অদৃশ্য সংকেতের নির্দেশনায়। 

ক্যাপ্টেন আবার যেন ইহজগতে ফিরে আসে, ‘ঘোড়ায় চড়েন আপনি ? বুনো ঘোড়া দেখেছেন ? প্রতিবার বাড়িতে ফিরে মনে হয় আমি একটা অশান্ত বুনো ঘোড়ার পিঠে মাসের পর মাস ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার মুখ-চোখে হাওয়া লেগেছে, উন্মুক্ত প্রান্তরের উঁচু পাহাড়ের। অথচ আামি কোনও দিন ঘোড়ায় চড়িনি। তবে একটা জিনিস আমি মনে হয় ধরতে পেরেছি,’ ক্যাপটেন আমার সামনে একটা মানচিত্র মেলে ধরে। তাতে দুলারি এঁকেবেঁকে গেছে। ‘এই দেখছেন শাল্মলী গ্রাম, তার পরে দুলারি নদী দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। আমি সব সময় ডানদিকের শাখা নিই। আমার এটা নিশ্চিত বিশ্বাস এইখানে কিছু একটা হয়। আজ মাঝরাতে আমরা সেইখানে পৌঁছব।’

ক্যাপটেনের কথায় আমি কল্পনা করি একটা বিরাট পর্দার, যার ওপারে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অন্য একটা বিশ্ব অন্য সময় নিয়ে। একটা কল্পিত ঝলমলে পর্দা যা রাতের আঁধারে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। ক্যাপটেনের কথা আমার কাছে একেবারে নতুন নয়। রাজধানী আর তুরার অনেক মানুষই এই পথে যাতায়াত করেছে, তাদের অনেকেই ফিরে এসে দুলারি সম্বন্ধে অদ্ভুত কথা বলেছে। আসলে অনেকে নয়, কয়েক জন। দুলারি যেন শুধু বেছে বেছে কয়েকজনকে তার রহস্যের ইশারা দেখিয়েছে। এমন তো হতে পারে, আমি ভাবি প্রতিবার দুলারির সেই নির্দিষ্ট জায়গায় এসে এক ক্যাপটেন দুজন হয়ে যায়, তার মধ্যে কোনটা সত্যি আর কোনটা নকল বোঝার উপায় নেই। একজন ক্যাপটেন, এই মানচিত্রে যেমন দুলারিকে দেখান হয়েছে, সেই নদী ধরেই তিন দিনে তুরায় পৌঁছে যায়, কিন্তু আর একজন গিয়ে পড়ে এক ভিন্ন জগতে, ভিন্ন সময়ে যেখান থেকে বের হতে কয়েক মাস লেগে যায়।

কিন্তু কোয়ান্টাম মাত্রার ছোট ক্ষুদ্র জগতে আমি বিশ্বের বিভাজনের কথা চিন্তা করতে পারি, চাক্ষুষ জগতে সেটা কি সম্ভব ? যদি সম্ভবই হয় তবে শুধু ক্যাপটেন কেন পুরো জাহাজটাই যাত্রীসমেত দুটো হয়ে যাবার কথা। তারা যখন এই পৃথিবীর সময়ে ফিরে আসে তখন অন্য জগতের স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, শুধু কয়েকজনের মনে জেগে থাকে একটা রেশ। শুধু সেই কয়েকজনই দুলারির এই যাত্রা থেকে ফিরে এসে বলেছে এক অদ্ভুত বোধের কথা। এর মধ্যে একজন হল এই ক্যাপ্টেন।

ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে থাকে। আমি জড়োসড়ো হয়ে বসি। আঁধার চেপে বসে নদীর দুধারে। যাত্রীদের কলরব থেমে যায়। ইঞ্জিনের ঘটঘট শব্দের ওপরে সার্চলাইট অন্ধকারকে দ্বিখণ্ডিত করে নদীর জলকে উজ্জ্বল করে রাখে। আকাশের তারার আলো এত শক্তিশালী যেন হীরের সব খণ্ড। পাইলট ঘরে গিয়ে ক্যাপটেনের সঙ্গে বসি। এটা একেবারে অন্য রকম জিনিস, নিজেকে বলি। এই সামান্য সাধারণ জীবনে যে কোনও যাদুর আবির্ভাব আশীর্বাদের মতোই নেয়া উচিত। আমার ইতিহাস সৃষ্টির ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমাদের এই তরুণ ক্যাপটেনের কি তা আছে ? এমনও হতে পারে যে দুলারির এই বুকে অনেক দ্বিখণ্ডিত সত্তা আর ফিরে আসে না। জাহাজ রাজধানীতে ভিড়লেও তারা এসে মিলিত হয় না এই পৃথিবীর সময়ে। এই ক্যাপটেন কতবার এই পথ দিয়ে গেছে, তার বহু প্রতিরূপ ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য সময়ের জগতে। অন্য জাহাজ, অন্য যাত্রীরা সৃষ্টি করে আর এক মহাবিশ্বের, সেখানেও জীবন চলে আগের মত। 

তন্দ্রাচ্ছন্ন হই। মাঝরাতে ক্যাপটেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয়। স্টিমারের শব্দ থেমে গেছে। ঘুম জড়ানো চোখে আমি ক্যাপটেনের চোখের দিকে তাকাই। সে ফিসফিস করে, ‘আমরা পৌঁছে গেছি। শাল্মলী।’

ঠাণ্ডা ভাবটা কেটে গেছে। একটা সোঁদা গন্ধ কেবিনে ঢোকে। বাইরে নিস্তব্ধতা কেটে হঠাৎ একটা চিৎকার আছড়ে পড়ে আমাদের কানে। আমার সারা শরীর চমকে ওঠে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকাই ক্যাপটেনের দিকে। সে হাত তুলে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে বাইরে বেরিয়ে যায়। আমি বসে থাকি অপেক্ষায়। মনে হয়, কয়েক ঘণ্টা কেটে যায়। আমি আবার চেয়ারে বসে ঢুলতে থাকি। বাইরে গিয়ে ক্যাপটেনের খোঁজ করতে সাহস হয় না। এই জাহাজে আমরা দু’জন ছাড়া কি কেউ নেই ? মনে হয় ঘণ্টা দশেক পরে ক্যাপটেন ফিরে আসে, ঘর্মাক্ত চেহারায়।

‘বাইরে কিছুই নেই।’

‘কিছু নেই ? কিছু নেই মানে কী ?’

‘মানে, এই ঘরের বাইরে কিছু নেই।’

‘তাহলে আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন ?’ জিজ্ঞেস করি আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে।

‘কোথায় ? আমি তো এই ঘরের বাইরেই বের হতে পারলাম না। ওই দরজার বাইরে কিছু নেই।’

‘কিন্তু আমি নিশ্চিত আপনি অনেক ঘণ্টা হল এই ঘরে ছিলেন না।’

ক্যাপ্টেন কিছুক্ষণ ভাবে, তারপর বলে, ‘আপনি ওই দরজাটা খুলে শুধু বাইরে তাকান, কিন্তু বাইরে যাবেন না।’

কিন্তু দরজা খোলার সাথে সাথে একটা শূন্যতা আমাকে যেন ছেঁকে নেয়। একটা জীবন্ত ঘূর্ণি আমাকে গ্রাস করে ফেলে। নিজের শরীরকে অনুভব করতে পারি না, শুধু একটা বোধ জেগে থাকে। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, ‘ক্যাপটেন, আমাকে ধরুন।’ কিন্তু কিছু দেখতে পাই না। আমি এক আকারহীন অস্তিত্ব-অসীমে বিচরণ করি।

তারপর হঠাৎ আমি তাকে দেখতে পাই, সেই অন্ধ নারীকে। সে অসুস্থ। এক ঘর-ভর্তি লোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। আমি তাদের সরিয়ে দিই, ছোট মেয়েটাকে আশ্বস্ত করি। সেই নারীকে তুলে একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিই। মেয়েটি বলে তার নাম দিতা, মায়ের নাম মৃত্তিকা। মৃত্তিকার ব্যাগে ওষুধ খুঁজি, কিন্তু সেখানে রাখা একটা প্রাচীন ছোরায় হাত কেটে যায়। ছোরাটাতে আমার আঙুল ছোয়ালে আমার মনে ভেসে ওঠে এক লাল মালভূমির ছবি, সেই মালভূমির চারদিকে মরুভূমি, সেই মালভূমিতে আটকা পড়েছে এক প্রাচীন জাতি। ছোরাটা আবার ব্যাগে রেখে মৃত্তিকার জন্য জল খুঁজতে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে যাই, কিন্তু আবার আর এক অন্ধকার আমাকে গ্রাস করে নেয়। তারপর আবার তাকে দেখি—মৃত্তিকাকে, কিন্তু সে এখন অন্ধ নয়, এখন সে হাঁটছে এক নিশ্চিত পদক্ষেপে, এই নতুন স্থান-কাল তার জন্য অতিপরিচিত। তারপর অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকি। মৃত্তিকা হাত বাড়িয়ে আমাকে আটকাতে চায়। আমি তার হাত ধরতে চাই। কিন্তু আমার হাত বলে তো কিছু নেই। তখনই আমার ক্যাপটেনের কথা মনে পড়ে, ভেঙে দিতে হবে, এই স্বপ্ন ভেঙে দিতে হবে। আমি আবার খুঁজি সেই কেবিন। শুরু করতে হবে প্রথম থেকে।

এক অন্ধকার মহাশূন্যে আমি কেবিনের দরজা খুঁজে পাই। ভেতরে ঢুকে দেখি ক্যাপটেন চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে তুলি।

‘এর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন ?’ জিজ্ঞেস করি আমি।

‘আপনি গিয়েছিলেন ঘণ্টা ছয়েক তো হবেই,’ ক্যাপ্টেন উত্তর দেয়। 

‘কী বলছেন, আমি তো কয়েক মিনিট মাত্র বাইরে ছিলাম,’ বিস্ময়ে বলি আমি।

ক্যাপ্টেন হাসে, বলে, ‘আমরা শাল্মলীর গোলকধাঁধায় ঢুকেছি, আপনি এটা বুঝতে পারছেন, সবাই পারে না।’

‘তারপর ? তারপর কী হবে, আমরা কি এই ঘরেই বসে থাকব ? মাসের পর মাস, যতদিন না স্টিমার তুরাতে পৌঁছাবে।’

‘আমি বলতে পারব না’, ক্যাপটেন বলে, ‘আমি জানি না এই ঘটনাপ্রবাহের মুখোমুখি আগে হয়েছি কিনা।’ আমি তো আপনাকে বলেছিই এর কোনও কিছুই আমার স্মৃতিতে থাকে না। তারপর হেসে যোগ করে, ‘শুধু ওই ঘোড়ার ব্যাপারটা ছাড়া।’ এটুকু বলে ক্যাপটেন চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে।

তারপর আমি বুঝলাম যে-ঘরটাতে বসে ছিলাম সেটা পাইলট-ঘর নয়। অথচ আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা সেই ঘরে বসে কথা বলছিলাম। ক্যাপটেন গভীর ঘুমে মগ্ন। তাকে জাগাতে চাইছিলাম না, যদিও ঘরটা সম্বন্ধে তাকে এখনই জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম। এমন ঘর তার বর্ণনা দিতে পারব না। আমার মনে হয়েছিল চারটে সাদা দেয়াল আমাদের ঘিরে মহাশূন্যে উঠে গিয়েছিল। অনেক ওপরে সাদা চৌকো ফ্রেমে বাঁধানো ছিল অন্ধকার। টেবিলের ওপর তখনও ছড়ানো ছিল দুলারির মানচিত্র। কিন্তু আমি ধরে তুলতেই সেটা গুড়ো গুড়ো হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

তারপর সাদা দেয়াল মিলিয়ে গেল, ফিরে এলাম আবার পাইলট-ঘরে, ভ্যাপসা গরম হাওয়া ঢুকল ঘরে, আমার কাপড়, সারা শরীর ভিজতে থাকল ঘামে। জানালা দিয়ে দেখলাম নদীর দুপাশে ঘন অরণ্য, আকাশচুম্বী গাছের ওপর হাল্কা মেঘের আস্তরণ। ক্যাপ্টেন ঘরে নেই।

৬. মৃত্তিকা (বর্তমান)

সারাদিন সেই স্টিমার আটকে রইলো এক অদ্ভুত শ্যাওলায়। ক্যাপটেনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল না আরও অনেককে। নৌকো নামিয়ে তীরে যেতে কেউ সাহস পেলো না। তিন দিন হয়ে গেল সবাই রাজধানী ছেড়েছে, প্রাণভয়ে, পালাচ্ছে সবাই চিতাবাহিনি থেকে। এখন ক্লান্তিতে আর কেউ কিছু ভাবতে পারছিল না। সূর্য ডুবে গেল অজানা গাছের গহনে। মনে হল সন্ধ্যা নামতে নামতে জলের ওপরের ঘন রাতের অন্ধকারে নদীর জলে ঝকঝক করলো চোখের প্রতিবিম্ব।

মৃত্তিকা শক্ত হাতে দিতার হাত ধরে থাকে। তার মন খুঁজতে থাকে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। তার সমস্ত জীবনবোধ যেন নির্ভর করছে কোনও একটা কিছু মনে করার ওপর। কাল রাতের বিকারে সে যেন কী দেখেছে, নাকি কাকে দেখেছে ? কী সে শুনেছে ? কিন্তু এই প্রথম নয়। অথচ এই নদীর বুকে সেই ধ্বনি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে সেই আহ্বান, এক আগন্তুক এসেছিল তাকে সাহায্য করতে। সে জানে না তার উত্তর কীভাবে দিতে হবে। কিন্তু সে জানে তার মনের গভীরে সেই উত্তর লুকিয়ে আছে, সেই উত্তরটি পেতে হবে। এই অভিযানে সে কি একা ? দিতাকে জড়িয়ে ধরে মৃত্তিকা। অন্ধ হবার পর থেকে সে তার অসহায়তা অতিক্রম করেছে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির জোরে, তবু আজ এক অপ্রতিরোধ্য অসহায়তায় মন ভরে যায়।

ধীরে ধীরে মনে পড়ে মৃত্তিকার। অন্য একটা জগৎ, সেই জগতে তার জীবন অনেক ঘটনায় ভরপুর। কিন্তু সে তো স্বপ্ন, বাস্তব নয়। অন্তত তাই সে মনে করত। ডান হাত দিয়ে ব্যাগটা কাছে টানে মৃত্তিকা, ভেতরে হাত ঢুকিয়ে অনুভব করে এক ধাতব স্পর্শ, সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেয় যেন বিদ্যুৎ ছুঁয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে এক মরুর দৃশ্য। এই মরুর দৃশ্যের সঙ্গে সে পরিচিত।

ব্যাগ থেকে হাত বের করে দিতার মুখে হাত বোলায় মৃত্তিকা। সে কি দেখতে পাবে তার মুখ ? মৃত্তিকার মা বলেছিল, আমাদের মেয়েরা দূরদর্শী। দিতার মধ্যে সেই দূরদর্শিতার ছাপ দেখেছে মৃত্তিকা। মৃত্তিকা চিন্তা করে দিতার ভবিষ্যৎ। এক অনিশ্চিত পৃথিবীতে কেমন হবে তার জীবন ? মাতৃত্বের দায়িত্ব তার অন্ধকার জগৎকে অনেকখানি ভরিয়ে রাখে। যে-শিশুকে সে বহন করেছে সে অসাধারণ। তার ক্ষমতা মৃত্তিকা সবসময় বোঝে না, কিন্তু সে জানে তার মেয়ে কী আঁকছে। কারণ দিতা আঁকছে মৃত্তিকার মনেরই প্রতিচ্ছবি। যতবার সে তার ব্যাগে রাখা ছোরাটাকে ধরেছে ততবার সেই দৃশ্যগুলো খুব গাঢ়ভাবে মনে এসেছে : জলের ওপর প্রাসাদ, মরুভূমির ওপর এক পাহাড়দ্বীপ। সেইসব দৃশ্য কি বর্তমান স্থান-কালের সীমার বাইরে ?

মহামারীর আগে পাহাড়ে গিয়েছিল নৃতত্ত্ববিদ মৃত্তিকা, মরুভূমিতে ঘেরা ছিল সেই পাহাড়। কয়েক হাজার বছর আগে সেখানে সভ্যতা ছিল। তাদের পরিত্যক্ত বাসস্থানে সে খুঁজেছিল হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর অস্তিত্ব। হঠাৎ করেই তারা যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাদের কয়েক শ’ বছরের দেশ। লাল-পাথরের দেয়ালে তাদের হাতের ছাপে হাত রেখে মৃত্তিকা অনুভব করতে চেয়েছিল অতীত জীবনের উত্তাপ। তার তীক্ষ্ণ চোখ ও মন তৈরি করছিল সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কাহিনি। খোলা গুহার মধ্যে তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে, তাদের ফেলে যাওয়া মাটির পাত্র দেখতে দেখতে মৃত্তিকা যেন তাদের অদৃশ্য আত্মাকে প্রশ্ন করছিল, ‘তোমরা কেন হঠাৎ চলে গেলে একদিন দল বেঁধে ? তোমাদের কেউ আক্রমণ করেছিল ? তোমাদের খাবার কি ফুরিয়ে গিয়েছিল ? এই মরুভূমি পার হয়ে কোথায় তোমরা গিয়েছিলে ?’

এর কয়েক বছর পর, মরুর পাহারদ্বীপ থেকে প্রায় পাঁচ শ মাইল পশ্চিমে, সমুদ্রের ধারে মৃত্তিকা খুঁজে পেয়েছিল একই ধরনের নকশা-কাঁটা পাত্র। মনে হয়েছিল মরুর পাহাড়ের ওপরের লাল পাথর-দেয়ালে বাড়ির মানুষেরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিল এই সমুদ্রপারে। সেইখানে সমুদ্রতীরে পুরাবিদরা খুঁড়েছিল মাটি, পেয়েছিল একটা ছোরা। এত বছর মাটির নিচে থাকা সত্ত্বেও ঝকঝক করছিল সেই উঁচু পাহাড়ের স্বচ্ছ আলোয়। তার কাঠের হাতলে ছিল খুব সূক্ষ্ম কারুকাজ। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে তেজস্ক্রিয় মৌল দিয়ে সেটার বয়েস নির্ণয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। প্রধান পুরাবিদ তাকে বলেছিল এমন অদ্ভুত কাঠের নমুনা সে আগে দেখেনি, এই রকম ছোরার নিদর্শন এই প্রথম তারা দেখল। আনুষঙ্গিক প্রমাণ দেখে মনে হয়েছিল সেটা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো, অথচ গবেষণাগারের বিশ্লেষণ বলছিল সেই ছোরা যেন তৈরি হয়েছে গতকাল। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গবেষণার কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল মৃত্তিকা। প্রধান পুরাবিদ তাকে সেই ছোরাটা রাখতে দিয়েছিল, মৃত্তিকাই তো খুঁজে পেয়েছিল সেটা।

ছোরাটাকে সবসময় সঙ্গে রাখত মৃত্তিকা, তার অন্ধকার জীবনে সেটা জ্বলত নীলাভ আলোয়। ছোরাটার ধাতব অংশ ধরলে মৃত্তিকা যেন দেখত আলোয় ভরা এক জগৎ। স্বপ্নের মতো ক্ষণিক চিত্র যেন, খণ্ড খণ্ড চেতনার মোজাইকে গড়ে তুলেছিল মৃত্তিকা সেই পৃথিবী। মরুভূমিতে ঘেরা ছিল সেখানকার লোকেরা, কিন্তু থাকত তারা এক পাহাড়ের ওপর, স্বপ্ন দেখত তারা মরুভূমি পার হওয়ার। মৃত্তিকা হয়ে যেত একটি কিশোরী।

৭. পৃথা (অতীত)

হিরণ আমাকে যেসব জিনিস দিয়ে গিয়েছিল সেগুলো আমি অনেকবার দেখেছি। ঘরের এক কোনায় পাথর-চাপা দিয়ে রেখেছি সেগুলো। যে-জিনিসটাকে হিরণ কাগজ বলে সম্বোধন করেছে সেটা আমি অনেকবার খুলে দেখেছি, তার মধ্যে যে আঁকিবুঁকি কাটা আছে তার কিছু বুঝি না। ধাতব ছোরাটাকে যতবার হাতে নিয়েছি একটা শিহরণ হয়েছে গায়ে। আমার মাথার মধ্যে যেন অনেক শব্দ শুনেছি, কিন্তু সে ভাষা আমি বুঝিনি। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা—অনেক সময় আমার মনে ভেসে ওঠে এক নারীর মুখাবয়ব, তার পরনের কাপড়ের অংশবিশেষ দেখি, সেরকম কাপড় আমি কোনওদিন দেখিনি। কখনও কখনও মনে হয় সেই নারী অন্ধ, কখনও কখনও নয়। সে কি বাস করে বালি পার হয়ে জলের মরুভূমির পারে ? সেই কি তৈরি করেছে এই ছোরা, এই মানচিত্র ?

অনেক রাতেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। মনে হয় ঘরের কোনায় যেখানে মানচিত্র আর ছোরাটা যে পাথরটার নিচে চাপা আছে সেই পাথরটা কাঁপছে। আমার ঘরে আরও কয়েকজন থাকে। তারাও যেন স্বপ্ন দেখে, অস্ফুট শব্দে স্বপ্নের মাঝে গোঙায়। ওপরের চতুষ্কোণ জানলার মধ্যে দিয়ে অনেক রাতে চাঁদ দেখা যায়। নীচের গিরিখাত থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে নিয়ে আসে নেকড়ের ডাক। অনেক রাতেই ঘুম ভেঙে গেলে কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে মই বেয়ে মালভূমির ওপরে উঠে আসি। জ্যোৎস্নায় পাহাড়ের নিচে বালিয়াড়ি বালু চিকচিক করে, অনেক সময় মনে হয় জল। জলের মরুভূমি কি এইরকম ? ওপরে মেঘহীন আকাশ। ভরা-চাঁদ ভেসে থাকে রামধনুর চক্রের মাঝে। কিছুক্ষণ পর পর নিচের বালি উড়িয়ে দিয়ে যায় শীতের হাওয়া। সেই বালি উড়ে যায় পশ্চিমে। ভাবি, এ’বার আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে, সময় হয়েছে এই পাহাড়দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার।

অবশেষে আমরা রওনা হই, পিঁপড়ের মতো মানুষের সারি মরুভূমির হলুদ বালিতে পরিশ্রান্ত পা ফেলে চলে। পার হতে হবে বালির সমুদ্র সাথের জল ফুরিয়ে আসার আগেই, খাবার শেষ হবার আগেই। দিনের বেলা তাঁবু ফেলে ঘুমাই আমরা, আর রাতে চাঁদ ও নক্ষত্রের আলোয় পথ চলি। এই হল আমাদের মহাযাত্রা—হিরণকে কথা দিয়েছিলাম আমি। হিরণ আমাদের সঙ্গে আসেনি, সে রয়ে যায় পাহাড়দ্বীপের এক গিরিখাতে।

রাতে জ্বলজ্বলে ছায়াপথের নিচে চলতাম আমরা, উত্তরে ধ্রুবতারাকে পাশে রেখে। দিন পনেরো চলার পর ধীরে ধীরে বালি পার হয়ে দেখা দিল এক ধরনের রুক্ষ লাল মাটি। ছোট ঝোপের মতো গাছ। পাথরের বিশাল স্তম্ভের মতো লাল পাহাড়। তারপর একদিন বিকেলবেলা হাঁটবার আয়োজন করছি এমন সময় পশ্চিমের আকাশে উঠলো মেঘ, চমকালো বিদ্যুৎ, নামলো বৃষ্টি। পরদিন দেখা গেল সবুজ গাছ। আমি কখনই সন্দেহ করিনি আমাদের জন্যে একটা বড় পৃথিবী অপেক্ষা করছে। আমরা সেই সবুজ দেশে পেলাম জল, পেলাম কাদ্য, কিন্তু সেখানে ছোরাটির কারিগরদের খুঁজে পেলাম না।

৮. অসিতোপল (বর্তমান)

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ মাথা তুলে দেখি ক্যাপটেন ঘরে নেই। বাইরে গেছে ? আমার বাইরে যেতে সাহস হয় না। কিন্তু এই ঘরে বন্দি হয়ে থাকাও সম্ভব নয়। দরজা খুলে দেখি বাইরে তেমনি অন্ধকার। কোথায় যাওয়া সম্ভব ? বাইরে পা বাড়াতেই মনে হলো শূন্যে ভাসছি। আমি যেন সাঁতার কেটে চললাম। তারপর হঠাৎই মনে হলো এক নদীর পার ধরে হাঁটছি। ভোর কি সন্ধ্যে হচ্ছে বলতে পারব না। আর তখনই কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসল সেই ছোট মেয়েটা, তার দুটো বেণী পেছনে উড়ছিল। কাছে এসে তাকাল আমার দিকে যেন কতদিনের চেনা। জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মাকে দেখেছেন ?’ আমি বলতে চাইলাম দেখেছি। মনে করতে চাইলাম তাকে কোথায় দেখেছি, কখন দেখেছি। বলতে পারলাম না তাকে দেখেছি এক অসীম অন্ধকারে, সে অসুস্থ ছিল এটুকুই শুধু আছে মনে। বললাম, ‘তোমার নাম দিতা না ?’ সে যেন আশ্চর্য হলো, বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি তো আমাকে চেনেন।’ আমি বুঝলাম না সে কী বলতে চাইছে, কিন্তু তার হাত ধরলাম, নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘দিতা’! তোমার মা নিশ্চয়ই সাধারণ নারী নন। সেই গোধূলি আলোয় দিতা ও আমি নদীর পার ধরে হাঁটতে থাকলাম দিতার মার খোঁজে। ‘এই আমাদের পৃথিবী এখন দিতা’, হাঁটতে হাঁটতে তাকে আমি বলি। ‘এর পথ আমি চিনি না, আমার ঘড়ি এর সময় বলতে পারবে না, তুরায় আমাদের আর ফেরা হবে না।’

আমি ডান হাত তুলে আঙুলগুলো দেখলাম। আমার তর্জনীতে একটা ক্ষত, সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। নদীর পারে বিশাল উঁচু গাছগুলো আকাশকে ঢেকে রেখেছিল। তারপর তাকে দেখলাম একটা ছায়ার মতন, নদীর তীরে বসে আছে। ‘মা!’ চিৎকার করে দিতা দৌড়ে যায়।

৯. অন্য এক অসিতোপল (ভবিষ্যৎ)

আমার নাম অসিতোপল। তুরাতে কাজ করি। আমি কাজ করি অস্থিত ছোট কণার ওপর। এই ধরনের কণারা ইলেকট্রন বা প্রোটন নয়, তাদের অস্তিত্ব খুব অল্প সময়ের জন্যে, তারপর তারা অন্য ধরনের অনেক কণায় রূপান্তরিত হয়। বিজ্ঞান বলে রূপান্তরিত শক্তি হবে আদিশক্তির সমান। কিন্তু এই ধরনের অস্থিত কণা সেই শক্তি-সংরক্ষণ তত্ত্ব যেন মেনে চলে না, তবে আমি নিশ্চিত নই। ওই ধরনের কণাকে আমি নাম দিয়েছি ক-কণিকা। খুব সাবধানে মেপে দেখেছি রূপান্তিত শক্তি মূল-কণিকার শক্তি থেকে কম। বাকি শক্তিটুকু কোথায় গেল এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। আলোতে বা ওই ধরনের তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণে যে সেই বাকি শক্তিটুকু যায়নি সেটা আমি নির্ধারণ করেছি। অবশেষে আমি এই ধরণের একটা সিদ্ধান্তে আসলাম—কণারা অন্য মাত্রার স্থান-কালে বিচরণ করতে পারে, তাদের বাকি শক্তিটুকু হয়তো অন্য কোনও মহাজগতে হারিয়ে যায়। আমি এই বিষয়ে একটা গবেষণাপত্র তৈরি করছিলাম, এমন সময় চিতারা রাজধানীতে সৈন্য নামাতে শুরু করল। রাজধানীতে থাকা আরা নিরাপদ হবে না ভেবে অনেকের সাথে আমি এক তুরাগামী স্টিমারে উঠি।

সেই জাহাজেই আমার সঙ্গে পরিচয় হয় দিতা ও তার মা মৃত্তিকার।

যাত্রার আগেই তাদের আমি দেখি। ডেকের ভিড়ে একটা বেঞ্চের ওপর বসেছিল দিতা আর মৃত্তিকা। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পড়ন্ত লাল সূর্যের আলোয় জটলা করছিল তিন-চার তলার স্টিমারেরা। তাদের মধ্যে খেলা করছিল ধূসর শুশুকেরা। দিতা নিবিষ্ট মনে কী যেন এঁকে যায়, তার মুখের একাগ্রতা আমাকে টানে। আমি এসে বসি দিতার পাশে। ও আঁকছিল রাতের আকাশ, নক্ষত্রখচিত। সেই আকাশে একটা তারা খুব উজ্জ্বল। অন্যান্য তারাদের প্যাটার্ন দেখে আমি চিনতে চেষ্টা করি তারাটাকে। হঠাৎ চিনতে পারি। বিস্ময়ে আমার ভুরু নেচে ওঠে। তারপর অবাক দৃষ্টিতে তাকাই দিতার দিকে। জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি জানো ওই তারাটার নাম কী ?’ দিতা মাথা নাড়িয়ে বলে, না। মৃত্তিকা এতক্ষণে বুঝতে পারে আমার উপস্থিতি। কোনও কথা না বলে সে দিতার আঁকার ওপর হাত বোলায়—এমনভাবে যেন সে অনুভব করে তারার নীলাভ উত্তাপ। শুধুমাত্র তখনই বুঝলাম মৃত্তিকা অন্ধ। মনে হল চোখে না দেখেও মৃত্তিকা যেন জানতো দিতার প্রতিটা ক্রিয়া-কর্ম। শুধু মাতৃত্বের বন্ধন কি দৃষ্টি দিতে পারে ?

আমি মৃত্তিকাকে উদ্দেশ্য করে বলি, ‘যে-তারাটা ও এঁকেছে তার নাম আর্দ্রা। শীতের রাতে কালপুরুষের কাঁধে বসে থাকে সে লাল হয়ে। অনেকে বলে খুব শীঘ্রই সেটা বিস্ফোরিত হবে। সেই বিস্ফোরণকে বলে অতিনোভা বিস্ফোরণ। কিন্তু শীঘ্র বলতে কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। আজও হতে পারে আবার এক লক্ষ বছর পরেও হতে পারে। আর এই নক্ষত্রটা আজ বিস্ফোরিত হলে সেই সংবাদ পৃথিবীতে এসে পৌঁছতে আরও সাড়ে ছ’শ বছর লাগবে। সেই আলো পৃথিবীতে যেদিন প্রথম পৌঁছবে তখন আর্দ্রা এরকমই উজ্জ্বল হবে।’

আমি জানি ছায়াপথের একটা বাহুতে সূর্য প্রবেশ করছে। দশ কোটি বছর লাগবে সেই বাহু অতিক্রম করতে। সেই সময় ধরে অনেক পুরনো নক্ষত্র বিস্ফোরিত হবে, তাদের মধ্যে অনেকগুলো হবে পৃথিবীর খুব কাছে। আর্দ্রা এইরকম একটা নক্ষত্র যে তার জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে। তার অতিনোভা বিস্ফোরণ হবে, কিন্তু দিতার তো সেটা জানার কথা নয়।

মৃত্তিকা আমার দিকে তাকায়। তার অস্বচ্ছ দৃষ্টির পেছনে দেখতে পাই এক স্বচ্ছ মন। ‘তারপর, তারপর কী হবে ?’ জিজ্ঞেস করে সে অধীরতায়।

‘কেউ ঠিক জানে না। আলোর পেছনে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসবে বিশাল গ্যাসীয় বস্তু, অতি শক্তিশালী কণিকারা, আছড়ে পড়বে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওপর, উজ্জ্বল হয়ে উঠবে রাতের আকাশ, বায়ু হবে শুষ্ক।’

‘আমরা কি সেই আঘাত সহ্য করতে পারব ?’

‘ঠিক জানি না, এই ধরনের গণনা বেশ জটিল।’ মৃত্তিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, তারপর বলি, ‘আমার নাম অসিতোপল। রাজধানীতে থাকি, তুরাতে যাচ্ছি।’ মাথা ঝুঁকিয়ে মৃত্তিকা আমার সম্বোধনকে স্বীকার করে, বলে, ‘আমার নাম মৃত্তিকা, আর এই আমার মেয়ে দিতা। আমরাও তুরা যাচ্ছি।’

‘সবাই তুরা যাচ্ছে,’ বলি আমি, ‘আমরা পালাচ্ছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিতা বাহিনি জয়ী হবে না।’

মৃত্তিকা বলে, ‘হ্যাঁ, তারা জয়ী হবে না।’

আমি মৃত্তিকার চোখের দিকে তাকাই, তার কথায় যে শক্তি রয়েছে তা যেন সব অন্ধত্বের ঊর্ধ্বে।

ভেসে যায় স্টিমার দুলারির বুকে। ভাবতে থাকি আমি স্থান-কালের সীমাবদ্ধতার কথা। দিতা আমাকে আরও ছবি দেখায়—একটা গাছের ছবি মাঠের মাঝখানে। আমি বুঝতে চাই সেই শিশুর মন। সেই মন কি অনুভব করে অতি দূরের কম্পন ? সে কি বুঝেছে আর্দ্রার বিস্ফোরণ ?

স্টিমার রওনা হয়ে গেলে বাইরে অন্ধকার হয়ে আসে দ্রুত। আর এক সন্ধ্যার সূর্য দুলারিকে রাঙিয়ে দিয়ে চলে যেতে থাকে দিগন্তের ওপারে। দূরের সূর্য যখন মিলিয়ে যায় প্রাচীন মহীরুহের পেছনে, তার দীর্ঘ ছায়া পড়ে থাকে ধূসর মাটিতে, এক অব্যক্ত না-পাওয়ার আকৃতিতে ভরে যায় হৃদয়। পৃথিবীর ছায়া জেগে ওঠে পুবের আকাশে। স্টিমারের পেছনে গাঙচিলেরা উড়তে উড়তে হারিয়ে যায় অন্ধকারে। শুশুকেরা ফিরে যায় কোথায় যেন জলের তলায় তাদের আস্তানায়। দূরের পার মিশে যায় নিশ্ছিদ্র কালিমায় আর গাঢ়-অন্ধকারে উঠে আসে কালপুরুষ, তার কাঁধে জ্বলে লাল-তারা আর্দ্রা। প্রতিটা সন্ধ্যার মধ্যে যেন লুকিয়ে থাকে অজানা অবোধ্য এক জিজ্ঞাসা। প্রতিটা রাত্রি আমাদের জন্য অন্ধত্বের আভাস দিয়ে যায়। আর এখন দিতা ও মৃত্তিকার পাশে বসে আমি অনুভব করি কোনও অচেনা দূর-জগতের আহ্বান।

আমার মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু যাত্রার দ্বিতীয় দিন রাতে, শাল্মলী পার হবার সময়ে আমাদের স্টিমারকে সরাসরি আঘাত করে একটা বড় জাহাজ, অন্তত তাই আমার স্মৃতিতে ছিল। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের স্টিমার ডুবে যায়। এর পরের ঘটনা আমার ভাল করে মনে নেই। কিন্তু আমি দিতা ও মৃত্তিকাকে জলে ডোবা থেকে উদ্ধার করি, অন্তত সেটাই তারা আমাকে বলে, আমার সেই উদ্ধারের কোনও স্মৃতি ছিল না। তারা বলেছিল শাল্মলী পার হবার সময় কোনও এক বিষুবীয় অরণ্যে, জলজ শ্যাওলার আস্তরণে নাকি আটকে গিয়েছিল আমাদের জাহাজ, তবে এরকম কিছু আমি মনে করতে পারলাম না। দুলারির পারে কীভাবে বিষুবীয় অরণ্য সৃষ্টি হবে তার কোনও ব্যাখ্যা আমাদের কারুর কাছেই ছিল না। অন্যদিকে সেই রাতে দুলারির বুকে আমাদের জলযান ছাড়া অন্য কোনও জাহাজের খোঁজ পাওয়া যায় না, কাজেই অতবড় দুর্ঘটনার কারণটি আমাদের কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়।    

এদিকে মৃত্তিকার সঙ্গে স্টিমারে আমার যে দেখা হয়েছিল তার কোনও স্মৃতিই তার ছিল না। সে বলেছিল, এক সন্ধ্যায় সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তখন এক দীর্ঘকায় আগন্তুক তাকে ও দিতাকে সাহায্য করে। তার মনে সেই আগন্তুক আশার আলো জাগিয়েছিল। মৃত্তিকার মনে হয় সেই আগন্তুক আমিই ছিলাম।

এরপরে মৃত্তিকা ও দিতার সঙ্গে আমার একুশ বছর কেটে গেছে।

চিতাদের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হবার পরে, আমরা রাজধানীতে ফিরে আসি, সেখানে যুদ্ধ থেকে জীবিত ফেরা কয়েকজন বন্ধু চোখ ও মস্তিষ্কের ওপর তাদের গবেষণা আবার শুরু করে। কয়েক বছর বাদে মৃত্তিকা ছিল তাদের প্রথম রোগী, মৃত্তিকার চোখের দৃষ্টি তারা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। মৃত্তিকা বলত, জাহাজের কেবিনে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে যে আগন্তুক এসেছিল, তার কন্ঠস্বর মৃত্তিকার মনে আছে স্পষ্ট। সেই আগন্তুক তাকে বলেছিল, সে অত্যাশ্চর্য ঘটনা দেখবে। মৃত্তিকার ধারণা যেহেতু সেই আগন্তুক আমিই ছিলাম, তাই আমার অঙ্গীকার আমি নাকি পূরণ করেছি, মৃত্তিকা তার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে।     

মৃত্তিকার ব্যাগটা হারিয়ে যায়নি, সেখানে একটা ছোরাটা ছিল। নিতান্ত খেয়ালেই আমি সিদ্ধান্ত নিই ছোরাটাকে আমার পরীক্ষায় ব্যবহার করবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কণাত্বরক-যন্ত্রের সাহায্যে আমি খুব দ্রুতগতিসম্পন্ন ভারি কণা দিয়ে ছোরাকে আঘাত করাই। আমি জানতাম এর ফলে ছোরার মধ্যে অনেক অস্থির ক-কণা সৃষ্টি হবে। বলতে গেলে পুরো ছোরাটাই অস্থিত কণা দিয়ে তৈরি হবে। আমি সেই কণিকাগুলোর রূপান্তরের পর ছোরাটার কী চেহারা হবে তা দেখতে আগ্রহী ছিলাম। কণাত্বরক-যন্ত্র কিছুক্ষণ চালানোর পর ছোরাটা দেখতে যাই। কিন্তু সেখানে কিছু ছিল না। ছোরাটি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে সেটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। কিন্তু মৃত্তিকার কাছে তা মনে হয়নি। মৃত্তিকা জানত ছোরাটি কোথায় গেছে। মরুর পাহাড়দ্বীপে, সে বলেছিল। আমি বলেছিলাম, তাহলে তো তোমার আবার সেটি সমুদ্রতীরে আবিষ্কার করার কথা। মৃত্তিকা বলল, ‘আর এক জগতে আমি ক্রমাগতই সেটি আবিষ্কার করে চলেছি, তুমি ক্রমাগতই তাকে কণা-ত্বরক দিয়ে অতীতে বা ভবিষাতে পাঠাচ্ছ, বারে বারেই আমরা শাল্মলীর গোলকধাঁধায় পড়ছি।’

‘তাহলে এই জগতে আমরা সেই চক্র থেকে বের হয়ে এসেছি ?’ জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

‘আমি ঠিক বলতে পারব না,’ আনমনা হয়ে গিয়েছিল মৃত্তিকা, ‘হতে পারে যে মুহূর্তে ছোরাটি তোমার কণা-ত্বরক থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই মুহূর্তে আর একটি অতীত সৃষ্টি হয়, আর একটি পাহাড়দ্বীপ, আর একজন পাহাড়দ্বীপের কিশোরী, আর একজন মৃত্তিকা, আর একজন অসিতোপল। আর সেই অসিতোপল বারে বারেই ওই অতীতটা সৃষ্টি করে যাবে।’    

‘যুদ্ধে যদি চিতারা জয়ী হত তাহলে তো আমার আর গবেষণা করা হত না,’ বলি আমি, ‘সেইক্ষেত্রে ছোরাটাকে কণা-ত্বরক যন্ত্রে আমারা রাখা হত না। অতীতের পাহাড়দ্বীপে সেটা পৌঁছাত না, আর না পৌঁছালে তুমিও সেটা সমুদ্রতীরে পেতে না।’

‘তাহলে তুমি বলছ যুদ্ধে চিতাদের হার পূর্ব থেকেই নিশ্চিত ছিল ?’ মৃত্তিকার প্রশ্নে অশেষ কৌতূহল।

‘মহাবিশ্ব নিতান্তই উন্মাদ, নইলে সময়ের মধ্যে বদ্ধ ভ্রমণের যে অসীম চক্রের কথা ভাবছি তা সে কী করে সে অনুমোদন করবে ? আর যদি করেই থাকে তবে কার্যকারণে পূর্বনির্ধারিত ঘটনাপ্রবাহও তার মধ্যে পড়বে।’

‘আমি এটার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না,’ মাথা নাড়ায় মৃত্তিকা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃত্তিকা বলেছিল, “তবে আর একটি জিনিসের উত্তর আমরা হয়ত কখনই জানব না। ছোরাটি কোথায় তৈরি হয়েছিল, সময়ের এই চক্রে সেটি কীভাবে প্রবেশ করেছিল।”

‘এমন যেন ছোরাটির অস্তিত্ব ছিল সবসময়ই, সেটির সৃষ্টির কোনও ইতিহাস নেই,’ আমি যোগ করি।

আমি নিজেই নিজের কথা বুঝতে পারি না। মৃত্তিকা আমার দিকে চেয়ে থাকে, আমরা দুজনেই বুঝি আমার ব্যাখ্যার তাৎপর্য সমস্ত বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে।

‘আর ছোরাটি ছুঁলে যে মরুর চিত্র মনে ফুটে উঠত ?’ জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

‘তুমি সেটা আমার থেকে ভাল জানবে। এর জন্য বোধহয় তোমার ক-কণারা দায়ী। তারা ছোরার মধ্যে প্রোথিত হয়ে সেটিকে একটি রেকর্ডিং যন্ত্রে পরিণত করেছিল। তবে এটি আমার অনুমান মাত্র।’

মৃত্তিকার ব্যাখ্যাটা আলৌকিক মনে হলেও একেবারে ফেলে দিতে পারি না।

আর একটা জিনিস আমার স্মৃতির সবচেয়ে দূরতম কোণ ছুঁয়ে থাকে। সেই স্টিমারে আমার পরিচয় হয়েছিল জাহাজের ক্যাপটেনের সঙ্গে। সেই ক্যাপটেন আমাকে দুলারি সম্বন্ধে অদ্ভুত সব কথা বলেছিল। কিন্তু সেসব আমার মনে পড়ে না একদম। সেই দুর্ঘটনায় ক্যাপটেনও বোধহয় মারা যায়, অন্তত তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী কথা বলেছিল সে ? শাল্মলীর গোলকধাঁধা ? যেখানে মানুষ বহুভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে ? যে মৃত্তিকার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল জাহাজে সে হারিয়ে গিয়েছিল দুলারির এক শাখায়। আর যে মৃত্তিকা আর দিতাকে আমি উদ্ধার করি তারা আমাকে একবারই দেখেছিল—যখন মৃত্তিকা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই ‘আমি’ তো এই ‘আমি’ ছিলাম না। শাল্মলীর গোলকধাঁধায় সৃষ্ট আর এক ‘আমি’ কি আমার পূর্ব পরিচিত মৃত্তিকাকে খুঁজে পেয়েছে ? তাদের স্থান-কালে কি চিতাদের বিরুদ্ধে রাজধানী আর শংরার অধিবাসীরা বিজয়ী হয়েছে ? নিশ্চয় হয়েছে, নইলে ছোরাটি ওই মৃত্তিকার কাছে থাকত না। নিজের গড়া এই তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে চাই—তাতে সান্ত্বনা পাই।    

ও, হ্যাঁ! আর একটা জিনিস বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ছোরাটাকে আমি একটা কাগজে মুড়ে রেখেছিলাম, সেটা ছিল দুলারির মানচিত্র। সেই মানচিত্রটাও ছোরাটির সাথে হারিয়ে গিয়েছিল।

১০. পৃথার কথা (অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ)

লাল-মাটির পাহাড় পেরিয়ে ছিল সবুজ বন, বিস্তৃত উপত্যকা। সেই উপত্যকা পেরিয়ে একদিন হঠাৎই আমাদের সামনে দেখা দিল জল—এত জল যে তার অন্য প্রান্ত দেখা যায় না। জলের মরুভূমি ? হিরণের কথা মনে পড়ে আমার। সমুদ্র ? আমরা সবাই ছুটে গিয়েছিলাম সেই জলে, মুখে তুলে নিয়েছিলাম—নোনতা স্বাদের সেই জল খেতে পারিনি। কিন্তু সেই সমুদ্রে এসে পড়ছিল বহু স্বাদু জলের স্রোতস্বিনী। হিরণমাতাকে যে কথা দিয়েছিলাম তা রাখতে পেরেছি।

সৈকতে দাঁড়িয়ে কাপড়ের ভেতর থেকে মানচিত্রটা বের করলাম, কিন্তু তার ভাঁজ খুলতে গিয়ে সেটা প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে নিচে ভেজা বালির ওপর পড়ে গেল। আমি নিচু হয়ে কয়েকটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম। তারপর হাত মুঠো করে সেগুলো গুড়ো করে মুঠি খুলে দিলাম। বাতাসে তা উড়ে গেল জলের ওপর দিয়ে। এরপরে কোমরবন্ধনীতে বাঁধা ছোরাটা বের করে হাতে নিলাম, সেটা কি আমাকে নিয়ে যাবে তার নির্মাতার কাছে ?

সূর্য ডুবে যায় সমুদ্রের ভেতর, অন্ধকার হয়ে আসে। আমরা সবাই সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই অত্যাশ্চর্য সূর্যাস্ত দেখতে। ঘনায়মান অন্ধকারে দূরে জলের শেষ সীমানায় কী আছে তা দেখতে চাইলাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কালপুরুষ উঠে এসেছে সমুদ্র থেকে, তার কাঁধে জ্বল জ্বল করছে একটা নক্ষত্র সব আলোকে ছাপিয়ে। অথচ কাল সেখানে ছিল সাধারণ একটা লাল-তারা। কে যেন বলে, ‘আর্দ্রা! আর্দ্রা বিস্ফোরিত হয়েছে।’ মনে হল ছোরাটা থেকে একটা লাল আভা বের হচ্ছে, সেখান থেকেই যেন কথা ভেসে আসে, ‘এই সময়ে এই নক্ষত্রের মৃত্যু হওয়ার কথা নয়।’ আমি বুঝতে পারি না সেই কথার মানে কী। পশ্চিমের শেষ লাল রঙটুকু যখন মিলিয়ে যায় তখন আবার শুনি, ‘তবে সময়ের কথা কে বলতে পারে ? ভবিষ্যৎ হয়েছে অতীত।’ সেই সময়ে আমার হাত থেকে ছোরাটা পড়ে গেল জলে। আমি সেটাকে খুঁজতে গেলাম, কিন্তু ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে সেটা যে কোথায় নিয়ে গেল। 

  লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও কথাসাহিত্যিক

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

—————–

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button