আর্কাইভভাষা গবেষণা

শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু

চতুর্থ পর্ব

মানবর্দ্ধন পাল

[প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরোনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মনি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা, এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিকরূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

কলা

‘কলা’―এই শব্দটি অশুনলে আমাদের চোখের সামনে প্রথমেই একটি সুপ্রজ, সহজপ্রাপ্য ও সাংবাৎসরিক ফলের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাধারণত হলুদরঙা, লম্বাটে, গুচ্ছাকৃতি, সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন ফল কলা। কেবল ফল হিসাবেই নয়; সবজি হিসাবেও কলার পুষ্টিগুণ কম নয়। তাই সৃষ্টি হয়েছে লৌকিক প্রবচন : ‘কাঁচকলা ঝোলে-ঝালে/ পাকা কলা দুধেভাতে।’

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফল কলা। দেশের সর্বত্র কলার ফলন হলেও কলার কথা বললেই নরসিংদী ও বিক্রমপুরের রামপালের নাম মনে পড়ে। রামপালের কলা নাকি প্রায় আঠারো ইঞ্চি লম্বা হয়―একফুটি কলা তো সাধারণ। স্বাদে-গন্ধে, রূপে-রসে, গুণে-মানে, আকৃতি-আকারে এবং নামের বাহারে কলার আছে নানান ধরন। সংস্কৃত শব্দে কলার একাধিক নাম : কদলী, কদলক, রম্ভা। কদলী বা কদলক শব্দের মূল অর্থ―যা বায়ু দ্বারা দলিত হয়। বাতাসে কলাপাতা শতচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলেই বোধকরি এমন অর্থ। কলার রূপ ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আছে নামের বাহার : চাঁপা, চিনিচাঁপা, সুবর্ণচাঁপা, কাঁঠালি, পাহাড়ি, মর্তমান, কাবুলি, সাগর, মদনা, কানাই, বীচি, তুলসি, সিঁদুরে, রাম, সিঙ্গাপুরী―আরও কত কী! অঞ্চলভেদে কলার লৌকিক নামগুলোও মন্দ নয় : বাইশাকলা, আইট্টাকলা, গ্যারাকলা, নিহাইল্যাকলা, মুইট্টাকলা, জাইতকলা ইত্যাদি। প্রাচীনকালে জাহাজের নাবিকেরা একধরনের কলা সঙ্গে রাখত। এগুলো ভেতরে পাকলেও বাকলের রঙ থাকত সবুজ। তাই সহজে নষ্ট হত না। তাই এ-কলাকে বলা হত ‘জাহাজিকলা’। এর লৌকিক নাম―জাজিকলা। লাল এবং সবুজ রঙের পাকা কলাও পাওয়া যায়। শৈশবে রবীন্দ্রনাথের প্রচলিত সেই ছড়াটি আমরা কে না শুনেছি―যাতে বাঙালির সরস রসনার পরিতৃপ্তি বর্ণিত হয়েছে : ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/তাতে কদলী দলি/সন্দেশ মাখিয়া তায়/হাপুস-হুপুস শব্দ/চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিপীলিকা কাঁদিয়া আসে পাতে!’

সব ঋতুতেই সুপ্রজ ও সহজলভ্য ফলের নাম কলা―বাঙালিরও সুপ্রিয় ফল―ছেলে-বুড়ো সবারই। কলার স্বাদ ও সরসতার কারণে এটি খাওয়া জন্য কত লুকোচুরি! ‘ঠাকুরঘরে কে রে ?’ এই প্রশ্নের জবাবে শিশু বলছে―‘আমি কলা খাই না!’ কলা দিয়ে স্থানের নামও কম নেই : কলারোয়া, কলাছড়া, কলাকান্দা, কলাবাগান, কলাসিন্দুর, কলাতলি বীচ―এই স্থানের নামগুলোও কলাফলের সঙ্গে যুক্ত। একদা দীর্ঘকেশী বাঙালি বধূ ও তরুণীদের মধ্যে কেশবিন্যাস করতে ‘কলাবেণী’ বাঁধার প্রচলন ছিল। এখন ‘বয়কাটের’ যুগে খয়রুনদের কেশও নেই, বেণীও নেই! মধ্যযুগের নারীর রূপবর্ণনাকারী কবিরা আধুনিক শিরি, লাইলি ও পদ্মাবতীদের দেখলে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করতেন! আর সাহিত্য-সমালোচনায় যারা কেবল সৌন্দর্য-অন্বেষক ও কলাকৈবল্যবাদী তারাও বিমর্ষ হয়েছেন।

কলা নামক ফলটির গুণ যেমন অন্তহীন তেমনই দোষেরও শেষ নেই! কলা দেখানো, কলা খাওয়ানো, কলা চোয়ানো―বাংলা বাগধারায় এসব অপকীর্তির কথা তো আছেই। কলা দিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিতের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। তবে আদায়-কাঁচকলায় কত সম্পর্কের কথাও কম নেই! আর দুর্জন ও খলস্বভাবী শকুনিমামার অভাব তো নেই বাঙালিসমাজে! তাই দুধকলা দিয়ে আমরা সবাই কমবেশি সাপ পুষি―ছোবলও খাই। আবার সুবিধাভোগী উভয়কুল রক্ষাকারী লোকের সংখ্যাও কম নেই আমাদের মধ্যে―যারা রথ দেখি এবং কলাও বেচি। কলা গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে আর্থিক সমৃদ্ধও আনে। তাই প্রবচন আছে : ‘কলা রুয়ে না-কেটো পাত/তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত।’ আবার সনাতনধর্মীদের শারদীয় দুর্গোৎসবে গণেষদেবতার মূর্তির পাশে থাকে ঘোমটাপরা কলাবউ। প্রাচীন ভারতীয় পুরাণমতে এর তাৎপর্য আবার অন্যরকম। কলাবতীফুলের বিচিত্র রঙের সৌন্দর্যে কে না মোহিত হয় ? কলাভক্ষণ বা কলাচাষের জন্য কলাবান-কলাবতী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে শিল্পকলা অনুধাবনে কলাজ্ঞান আবশ্যক। তাই সংস্কৃত-সাহিত্যে বলা হয়েছে : ‘কলামণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরং।’

কলার আছে কত অর্থ, কত রূপ, কত মাধুর্য। কলার একটি অর্থ―কালের ভগ্নাংশ। চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির সময়ের অংশকে বলা হয় ‘চন্দ্রকলা’ বা শশিকলা। চন্দ্রকলার আছে ষোলোটি ভাগ। সংস্কৃতে বলা হয় : ‘চন্দ্রস্য ষোড়শো ভাগঃ কলা।’ চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধির প্রতিটি ভাগ একেকটি ‘কলা’। তাই ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে বলা হয়েছে : ‘চন্দ্রে সবে ষোলকলা হ্রাস-বৃদ্ধি তায়।/কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়।’ পুরাণের বর্ণনায় চাঁদে সুধা বা অমৃত আছে। ষোলোকলার পরিপূর্ণতায় আসে পূর্ণিমা। তাই কোনও কাজের সফল সমাপ্তিকে ষোলোকলায় পূর্ণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবার ষোলোকলা একে-একে ক্ষয় হয়ে অমাবস্যায় কলাহীন হয়। এজন্য ‘কলা’ যুক্ত করে চাঁদের কত নাম―কলাধর, কলানাথ, কলানিধি। এই অর্থে শব্দগুলোর প্রয়োগ লক্ষণীয় : ‘আকাশে করেন কেলি লয়ে কলাধরে।’ (মাইকেল)। ‘কলানাথ কতমুদের প্রেম কি কারণ!’ (ঈশ্বর গুপ্ত)। ‘গগন মণ্ডল উগ কলানিধি।’ (বিদ্যাপতি)।

চন্দ্রকলার আছে দুই পক্ষ―পূর্ণিমার দিকে যাওয়ার নাম শুক্লপক্ষ আর অমাবস্যামুখীর নাম কৃষ্ণপক্ষ। চন্দ্রের ষোলোকলার নামগুলোও খুব শ্রুতিমধুর : অমৃতা, মানদা, পূষা, পুষ্টি, ততষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিকা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অঙ্গদা, পূর্ণা ও পূর্ণামৃতা। এই কলা একেকটি করে বৃদ্ধি পেয়ে ষোলোকলা পূর্ণ হয়। পুরাণে বর্ণিত আছে, ষোলো জন দেবতা একেক দিন একেক কলামৃত পান করেন। এই কলামৃত পানকারী দেবতাদের নামও পুরাণে বর্ণিত আছে।

সূর্যের রশ্মি বা তেজের নামও ‘কলা’। সূর্যকলা বারো ভাগে বিভক্ত। এদের নাম : তপিনী, তাপিনী, ধূম্রা, মরীচি, জ্বালিনী, রুচি, সুষুম্না, ভোগদা, বিশ্বা, বোধিনী, বারিণী ও ক্ষমা।

আগুনের শিখার নামও ‘কলা’। এই শিখা দশ প্রকার : ধূম্রা, অর্চি, উষ্মা, জ্বলিনী, জ্বালিনী, বিস্ফুলিঙ্গিনী, শ্রী, সুরূপা, কপিলা ও হব্যকব্যবহা।

সময়ের ভগ্নাংশকেও ‘কলা’ বলে। কলা মানে কালের অংশ। প্রাচীনকালের সময় গণনার রীতি অনুযায়ী আঠারো নিমিষে এক কাষ্ঠা, ত্রিশ কাষ্ঠায় এক কলা এবং ত্রিশ কলায় এক ক্ষণ।

কলার সমুদ্রসম অর্থ নিহিত আছে শিল্পের মধ্যে। সংস্কৃতে বলা হয়েছে―‘শিল্পং কর্ম্ম কলাদিকম্।’ যে-কোনও ধরনের শিল্প এবং বিদ্যাই কলার অন্তর্ভুক্ত। হোক তা সুকুমার-শিল্প বা শ্রমশিল্প কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয়! শৈবতন্ত্র মতে, কলা চৌষট্টি প্রকার। এর বিস্তারিত বর্ণনা দিলে সাতকাহন নয়―চৌষট্টি কাহন হবে। ব্যাখ্যায় না-গিয়ে খুব সংক্ষেপে কেবল এগুলোর সহজবোধ্য কয়েকটি নাম উল্লেখ করা যায় :

নৃত্য, গীত, বাদ্য, নাটক, অভিনয়, বুনন,বস্ত্র তৈরি, রূপচর্চা, কেশবিন্যাস, রতিজ্ঞান, চিত্রকর্ম, চারুকর্ম, কারুকার্য, যুদ্ধবিদ্যা, বশীকরণ, আয়ুর্বেদশাস্ত্র, রন্ধনবিদ্যা, গার্হস্থবিদ্যা, সূচীকর্ম, বাস্তুবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, যান ও যন্ত্রনির্মাণকৌশল, পশুপালন, ইন্দ্রজাল, ভাষাজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষীশাস্ত্র, বৃক্ষবিদ্যা, ললিতকলা ইত্যাদি―এমন কি ছলাকলা পর্যন্ত। আবৃত্তি এবং শুদ্ধ উচ্চারণও চৌষট্টি কলার অন্তর্ভুক্ত। বাংলা কবিতায় প্রধান তিন প্রকার ছন্দের মধ্যে এক প্রকারের নাম―‘অক্ষরবৃত্ত।’ অনেক ছান্দসিক অক্ষরবৃত্তকে ‘কলাবৃত্ত’ ছন্দও বলেন। জীবনের ধর্ম নারী-পুরুষের মিলনও চৌষট্টি কলারই অঙ্গ। তাই বাৎসায়নের ‘কামশাস্ত্র’ ও ভারতীয় প্রাচীন স্থাপত্যে আছে তার শিহরণ-জাগানো বর্ণনা ও চিত্রায়ণ। অজন্তা, ইলোরা, কোনারক এবং প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পে এসবের নিদর্শন পাওয়া যায়। মহাবিশ্বে এমন কোনও বিষয় নেই যা চৌষট্টি কলার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই আর্ট বা ইন্ডাস্ট্রি―যে অর্থেই বলি না কেন, সবই শিল্প এবং চৌষট্টি কলার অন্তর্গত। তাই মধ্যযুগের কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে পাই : ‘বচন ইঙ্গিতে কত নয়নভঙ্গিতে/কত গণ্ডা কলা তায় কহিতে কহিতে।’ কিংবা ‘বিম্বফল জিণী তোর অধরের কলা।’ (বড়ু চণ্ডীদাস)।

এতসব কলাবিদ্যা একজন নারী বা পুরুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। নাম যার ‘কলাভবন’, সেখানে গেলেও কিন্তু এসব কলার সন্ধান পাওয়া যাবে না! কেন না, চৌষট্টি কলা তো বিশ্বকৌষিক জ্ঞানের আধার। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে একজন উপযুক্ত স্ত্রী বা গৃহিণীর বর্ণনায় বলা হয়েছে : ‘গৃহিণী সচিব মিথঃ, প্রিয় শিষ্যা, ললিতকলা বিধৌ।’ অর্থাৎ স্ত্রী হবে স্বামীর সচিব, প্রিয় মুরিদ, যে ললিতকলার সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী। কিন্তু কলাবতীফুল মিললেও কোথায় পাওয়া যাবে সেই কলাবতী অধরারে! তাই তো লালনের ‘মনের মানুষ’-এর আমৃত্য দার্শনিক সন্ধান।

ঘন

আমাদের সাহিত্যমণ্ডলে পঞ্চকবির প্রধান দুই মহারথী রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল বাংলা গানের রাজাধিরাজ। কেবল গান রচনার সংখ্যায় নয়―সুরের বৈচিত্র্যে, বাণীর মোহনীয়তায়, মানবহৃদয় ও প্রকৃতির বহুমুখী ব্যঞ্জনায় তাঁদের গান আমাদের মানসসম্পদ। কথা ও সুরের এমন ‘সহৃদয় হৃদয়সংবেদী’ সমন্বয় আর কারও গানে লক্ষিতব্য নয়। বিশেষত প্রেম ও প্রকৃতির গানে তাঁরা বাঙালির হৃদয়ের সূক্ষ্মতম তন্ত্রীতে অনুরণন তোলেন। তাঁদের গানের অমৃত বাণী, গীতসুধা ও সুরের মধুরিমা বাঙালির মানসলোকের চিরন্তন ঐশ্বর্য।

‘ঘন’ শব্দটির বহুরূপী অর্থবৈচিত্র্যের কথা ভাবলেই তাঁদের কথা, সবিশেষ রবীন্দ্রনাথের গানের কথা মনে পড়ে যায়! তাঁর গানে এই শব্দটির প্রয়োগ―প্রাচুর্য লক্ষ্য করলে অভিভূত হতে হয়! ‘ঘন’ শব্দটি কেবল দ্ব্যর্থবোধকই নয়; এর অন্তরে নিহিত আছে বিচিত্র ভাবের প্রকাশ। শুরুতে প্রাচীনকালের কাব্যকলা থেকে এই বৈচিত্র্যময়তার কয়েকটি উদাহরণ চয়ন করা যাক :

ঘন= প্রবল। ‘নিশি আন্ধকার ঘন বারি বরিষে।’ (বড়ু চণ্ডীদাস)

ঘন= নিñিদ্র। ‘নীল কুটিল ঘন মৃদু দীর্ঘ কেশ।’ (বড়ু চণ্ডীদাস)

ঘন= দ্রুত। ‘মনতোষ ভৈল কাহ্নাঞি ছাড়ে ঘন শ্বাসে।’ (ঐ)

ঘন= দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার পরিমাপ বা সমান তিনটি রাশির গুণফল। যেমন, ৩দ্ধ৩দ্ধ৩= ২৭। গাণিতিক পরিভাষায় বলা হয়, ঘনইঞ্চি, ঘনফুট, ঘনমিটার ইত্যাদি। এসব বৈষয়িক জীবনের মাপজোখের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়াও এর আছে আরও বিচিত্র প্রকাশ।

ঘন= ঠাসবুনন। ঘন কাপড় গ্রীষ্মে আরামদায়ক নয়। (বর্তমান লেখক)।

ঘন= গাঢ়। ঘন দুধ সুস্বাদু হলেও সহজপাচ্য নয়। (ঐ)।

ঘন= নিবিড়। ‘ঘনবনতলে এসো।’ (রবীন্দ্রনাথ)

ঘন= গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন। ‘কালকে ছিল এমন ঘন রাত,/আকুল ধারে এমন বারিপাত।’ (রবীন্দ্রনাথ)

ঘন= ভারী বা প্রশস্ত। ‘ঘন শ্রোণির, গুরু উরুর, দাড়িম-ফাটার ক্ষতধা।’ (নজরুল)

ঘন= মেঘ। ‘এসো হে এসো, সজল ঘন বাদলবরিষণে―’ (রবীন্দ্রনাথ)

কঠিন পদার্থের ঘনত্ব নির্ণয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। ইট-কাঠ-পাথর বা লোহালক্কড়ের পরিমাপ ও ঘনমূল নির্ণয়ের বিষয়টি গণিতের হিসাব-নিকাশ ও পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয়। ‘ঘন’ শব্দটির বহুমাত্রিকতার স্বরূপটি উপলব্ধি করা যায় বিশিষ্ট কবি-লেখকদের রচনা থেকে। আরও কয়েকটি চুম্বক উদ্ধৃতি :

চল, ঘনপতি! ঘন-কুলোত্তম ততমি। (শ্রেষ্ঠ অর্থে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত)।

ঘনরব কৈলে ঘন ঘণ্টার বাজনা। (দ্রুত লয় অর্থে, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)।

গঙ্গার জল ঘন নীল―তটারূঢ় বনরাজী ঘনশ্যাম―। (গাঢ় অর্থে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।

আঁধার কেন গো ঘনতম হয় উদয়-ঊষার আগে ? (গভীর অর্থে কাজী নজরুল ইসলাম)।

হাজি সাহেব একটু ঘন হয়ে বসলেন। (কাছাকাছি অর্থে, সৈয়দ শামসুল হক)।

রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গানের মধ্যে ঋতুভিত্তিক গান অন্যতম। আবার ঋতুর রূপ-রস প্রকাশিত হয়েছে যেসব গানে তার মধ্যে বর্ষা এবং বসন্তই প্রধান। মেঘ থেকে বৃষ্টিবাদলের জন্ম আর মৃদু বৃষ্টিবাদল প্রবলতর হলে তা বর্ষণ। বর্ষণ যখন সদলবলে বজ্র-বিদ্যুতের ঢাকঢোল পিটিয়ে, আকাশ আচ্ছন্ন করে তার প্রাচুর্যতা নিয়ে আসে তখনই হয় ঘনঘোর বর্ষা। তাই তো মন্দ্রিত বর্ষার সুরমাধুরীর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘মেঘমল্লার’ রাগ। ‘মেঘনাদ’ মানে মেঘের শব্দ বা বজ্রের গর্জন। লঙ্কাধিপতি রাবণের এক পুত্রের বীরত্ব-ব্যঞ্জনার সঙ্গে এই নামটি যুক্ত হয়ে আছে। পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণ ও মধুকবির আধুনিক মহাকাব্য মেঘনাদ বধের সঙ্গে অক্ষয় হয়ে আছে দর্পিত এই নাম। মন পড়ে ছাত্রজীবনের কথা। ছড়াকার, টিভি-ব্যক্তিত্ব ও প্রখ্যাত সাংবাদিক বন্ধু মনজুরুল আহসান বুলবুল ‘স্তনন’ শিরেনামে একটি ছড়াপত্র বের করেছিলেন গত শতকের আশির দশকে। সেটি প্রকাশের পর পয়োধরী সহপাঠিনীদের হাতে দিতেই তারা আরক্তিম অধোবদনে পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না! অথচ ‘স্তনন’ অর্থ মেঘের শব্দ―যাতে কুচ বা কাচুলির আভাস বিন্দুমাত্র নেই, নেই লজ্জিত হওয়ার অবকাশও। একেই বলে শব্দের অর্থ না-বোঝার বিড়ম্বনা! বাংলা শব্দের অর্থমহিমা এমনই বিচিত্র!

রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি পর্যায়ের বর্ষাঋতুর গান থেকে ‘ঘন’ শব্দের বিচিত্র প্রকাশভঙ্গি ও অর্থান্তরের কয়েকটি উদাহরণ গানের সংখ্যা উল্লেখ করে চয়ন করা যেতে পারে। শব্দগুলোর অর্থ এবং পদপরিচয় নির্ণয় করলে অর্থান্তরের বহুমুখিতা বুঝতে সুবিধা হয়।

ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা। (২৭)। প্রবল―ক্রিয়া-বিশেষণ।

ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা―। (২৭)। গভীর―বিশেষ্য।

গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া। (২৯)। মেঘ―বিশেষ্য।

হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে―(৩০)। কাজলা মেঘ―বিশেষ্য।

শাওনগগনে ঘোর ঘনঘটা―(৩১)। মেঘের প্রাচুর্য―বিশেষ্য।

গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব―(৩১)। বারবার―বিশেষণ।

আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল―(৩৩)। গাঢ় হয়ে―অসমাপিকা ক্রিয়া রূপে ক্রিয়া বিশেষণ।

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে―কবে নবঘন-বরিষণে―(৪৩)। গাঢ় হয়েছে―ক্রিয়া।

ঘন বনের কোণে কোণে―(৪৪)। গভীর―বিশেষণ।

নীল-অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর―কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে―(৫৫)। কাজলের মত গাঢ়―বিশেষণ।

ওই ঘাসের ঘনঘোরে ধরণীতল হল শীতল―(৬৪)। গভীর অন্ধকারে―বিশেষ্য।

একি গভীর বাণী এল ঘন মেঘের আড়াল ধরে―(৭৩)। জমাটবাঁধা―বিশেষণ।

সেথায় বিজন সাগরকূলে/ শ্রাবণ ঘনায় শৈলমূলে। (৭৪)। জমাট বাঁধে―ক্রিয়া।

দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ,… ঘনবরিষণে জলকলকলে… (৭৯)। গাঢ়, প্রবল―বিশেষণ।

আজি শ্রাবণঘনগহন মোহে… (৯৪)। শ্রাবণের প্রবল মেঘ―বিশেষ্য।

নতুন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে। (৯৮)। গাঢ়তা―বিশেষ্য।

তিমিরনিবিড় ঘনঘোরে ঘুমে স্বপনপ্রায়―(১০৭)। নিঃসীম অন্ধকারে―বিশেষণ।

এই উদ্ধৃতিগুলোতে ‘ঘন’ শব্দের অর্থ, প্রয়োগ এবং পদপ্রকরণের দিকে লক্ষ্য করলে এর বিচিত্র ব্যবহার অনুধাবন করা যায়। লক্ষণীয় যে, ‘ঘন’ শব্দটি কখনও বিশেষ্য, কখনও বিশেষণ আবার কখনও ক্রিয়াপদ বা ক্রিয়া-বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের মতো সাধারণ পাঠক বা শ্রোতাদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় তখন, যখন এক বাক্যে একটি পদ একাধিকবার পাওয়া যায়! যেমন, রবীন্দ্রনাথের গানে পাই : ‘সঘন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া।’ অনুপ্রাস-অলংকারে ঋদ্ধ এ-পংক্তিতে তিনটি ঘনের অর্থ তিন রকম! একটু চিন্তা করে, মগজের বায়াম করে তা বুঝতে হয়। এখানে সঘন= প্রগাঢ়; ঘন= মেঘ; ঘনাইয়া= ঘনীভূত হয়ে। তাই ভাবার্থ দাঁড়ালো―প্রগাঢ় মেঘ ঘনীভূত হয়ে আকাশ আবৃত করল।

এসব তত্ত্বকথা বাদ দিয়ে এবার একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করি।―

এক লোক কাপড়ের দোকানে গিয়ে ঠাসবুননের কাপড় খুঁজতে গিয়ে বললে―‘ঘন বাইনের কাপড় দেখান তো!’

যতই দেখায় গ্রাহকের আর পছন্দ হয় না। অবশেষে বলে―‘ঘনই যদি এত ফাঁক তবে ফাঁক না-জানি কেবা ?’

মান

একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, আত্ম-অহমিকা প্রকাশের লক্ষ্যে আমি আমার নামের প্রথম অংশ নিয়ে এই এপর্বের শিরোনাম করেছি। কিংবা মানসিংহ-প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের বিষয়ও এলেখার উদ্দেশ্য মোটেই নয়। ১৪ অক্টোবর বিশ্ব মান দিবস। ভোক্তাদের স্বার্থে বস্তুর গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য প্রত্যেক দেশে আছে নির্দিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশে এর নাম বিএসটিআই। এছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞান, মহাকাশতত্ত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্র, জলবায়ু ইত্যাদি বিষয়ে উন্নত গবেষণার জন্য আছে গবেষণাগার―যার নাম ‘মানমন্দির’। এসবও আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। চুপিচুপি বলি, এ লেখা মানহানিকর মামলা নিয়েও নয়। বরং ‘মান’ শব্দটির মান যাচাই এবং কতখানি মানসম্মতভাবে আমরা শব্দটি ব্যবহার করছি তা বিবেচনা করাই এপর্বের উদ্দেশ্য। আর ‘মান’ শব্দটিরও-যে আছে কত অর্থ, অর্থের বিকাশ-বিস্তার ও রূপ-রূপান্তর তা পরখ করে দেখাই এ লেখার লক্ষ্য।

এবার অভিধানে আশ্রিত মান শব্দের প্রধান অর্থগুলো পর্যায়ক্রমে জেনে নিই :

মান (মান্ + অ) সংস্কৃত শব্দ। বিশেষ্য পদ। সম্মান, গৌরব, সম্ভ্রম, অহংকার, অভিমান, মর্যাদা, দম্ভ।

মান (√মা + অন) সংস্কৃত শব্দ। মাত্রা, পরিমাপ, সংগীতে তালের মাত্রা বা বিরাম, প্রকৃত মূল্য, উৎকর্ষ বা অপকর্ষের পরিমাণ।

মান (মান + অ) তদ্ভব শব্দ। বিশেষ্য পদ (মানক> মান)। মানকচু, রেঁধে খাওয়ার কন্দবিশেষ।

মান = বিশেষণ। বিদ্যমানতা অর্থে সংস্কৃত প্রত্যয়বিশেষ। বুদ্ধিমান, ধৃতিমান, শ্রীমান। স্ত্রীলিঙ্গার্থে মতি।

মান = বিশেষণ। সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয় থেকে জাত ‘শানচ’-এর রূপ। শব্দায়মান, ঘনায়মান।

আসুন, এখন মান্যবর কবি-লেখকদের রচনা থেকে ‘মান’ শব্দটির কয়েকটি বিচিত্র প্রয়োগ দেখি :

‘রাধে তেজ (ত্যাজো) ভয়, মান, রাগে।’ (লজ্জা অর্থে, বড়ু চণ্ডীদাস)

‘যৌবনে নারীর মান উদকে নৌকার যান।’ (সমাদর অর্থে, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)

‘নৃপতি করিল মান, নিজ কন্যা দিব দান।’ (অঙ্গীকার অর্থে, মুকুন্দরাম)

‘নাচিছে নাটক গাইছে গায়ক রাগ তাল মান লয়।’ (সঙ্গীতে তালের বিরাম, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)

‘তৃতীয় মান হইতে আরবী এবং পঞ্চম মান হইতে দ্বিতীয় ভাষা আরম্ভ হইবে।! (শ্রেণি, ড. শহীদুল্লাহ)

তুমি মান বা না-মান। (স্বীকার করা, ক্রিয়া, বর্তমান লেখক)

‘মান’ শব্দটি আমরা সাধারণত সম্ভ্রম, মর্যাদা বা ইজ্জত অর্থে বুঝি। ‘সম্মান’ মানের আরেকটি সমার্থক শব্দ। ‘মান’ শব্দের সামনে ‘সম’ উপসর্গ যুক্ত করে তৈরি করা শব্দ। কোনও সুকর্মের কৃতিত্বেই মানসম্মান অর্জন হয়। মান মানুষকে মর্যাদাবান করে তোলে। মহাজনেরা বলেন, মান অর্জন করতে সময় লাগে―তা সারাজীবনের সাধনার বিষয়। কিন্তু মান-খোয়ানো যায় মুহূর্তে। এজন্যই লৌকিক প্রবাদ আছে, ‘শত কোপে লাঙল, এক কোপে চেলি।’ অর্জন সময়ের, বিসর্জন পলকের। যাক সেসব। নীতি ও তত্ত্বকথার দরোজা বন্ধ করে এবার চোখ ফেরাই ‘মান’ শব্দটির বৈচিত্র্যের অন্দরমহলে।

‘মান’-এর অর্থ পরিমান-জ্ঞাপকতা―যা দিয়ে মাপ বা ওজন করা যায়। এখান থেকেই মানদণ্ড, তুলাদণ্ড, ঘনমান, মানচিত্র, গজ-ফুট-ইঞ্চি, লিটার-মিটার, লক্ষ-কোটি, কানি-কাঠা, শতক-একর―এসব বিভিন্নরকম বস্তুগত পরিমাণ নির্ধারকের সৃষ্টি। মানচিত্র মানে ভূমি, দেশ বা রাষ্ট্রের সীমানা-নির্ধারক চিত্র―ভূপ্রকৃতির নির্ণায়ক চিত্রদ্বা। আর তাল-মান, সোম-ফাঁক―সুর ও সঙ্গীতের সময় নির্ণয় করে। আমরা শিক্ষাজীবনে পাটীগণিত ও বীজগণিতে উৎপাদকের মাননির্ণয় কে না-করেছি ? বাংলাদেশ ব্যাংক যখন কাগুজে নোটের ওপর ছেপে দেয়, ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে… টাকা দিতে বাধ্য থাকিবে’ তখন রাষ্ট্র সেই নোটের মানই নির্ধারণ করে।

‘মান’ শব্দটিকে পূজা, মান্য, সমাদর, সম্ভ্রম ইত্যাদি অর্থেও ব্যবহার করা হয়। বাংলা প্রবাদে আছে, ‘থাকলে মান ও হুঁশ/ তবেই হয় মানুষ।’ কথাটি মিথ্যা নয়। পদ-পদবিও মানুষের মান নির্ধারণ করে। নারী-পুরুষের মানে কোনও তফাৎ নেই কিন্তু পুরুষের মানহানি ও নারীর মানহানিতে বাংলা ভাষায় আকাশ-পাতাল তফাৎ। মানী মানুষেরই মানহানি হয় আবার প্রতিকার চেয়ে বিচারালয়ে মানহানির মামলা-মোকদ্দমাও হয়। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘চাঁদা দিতে চাঁদি ফাটে মানের গুড়ে বালি।’ এসব শুধু হাসির খোরাক নয়―মানহানিকরও। কম হলেও প্রকৃত মানী মানুষ তো সমাজে আছেই কিন্তু মেকি মানী লোকেরও অভাব নেই! মান-ভিখারিও পাওয়া যায় যত্রতত্র। ইদানীং চোখ খোলা রাখলেই মঞ্চের আশেপাশে, শোভাযাত্রায়, টিভিপর্দায় মানীদের কাছাকাছি দেখা যাবে শূন্য কলসি মেকি মানী ও মান-ভিখারিদের আনাগোনা! সম্মান পেতে ও ক্যামেরাবন্দী হতে কী আপ্রাণ চেষ্টায় লালায়িত তারা! মানসম্মান এমন মানস-উৎকর্ষের নাম যা মন্ত্রতন্ত্র, তাবিজ-কবচ, মানত-মাদুলিতে মিলে না―তা সাধনায় স্বোপার্জিত।

মানীদের আমরা মানপত্র দিই ও মান্য করি, মানহীনকে অবজ্ঞা করি আর মান-খোয়ানিকে করি অপমান। কিন্তু বৈষ্ণব সাহিত্যে চরিত্র বর্ণনায় পাই ‘তৃণাদপি সুনীচেন, অমানীনা মানী যেন।’ অর্থাৎ ঘাসের মত অবনত থাকা এবং মানহীনকে মান দেওয়া বৈষ্ণবের গুণ।

প্রেমাস্পদের কাছে কপট রাগকেও মান বা অভিমান বলা হয়। লোকে বলে, ভালোবাসায় ফুলের আঘাতও সয় না! তাই প্রেমের আঘাত ও ভালোবাসার কাঁটা থেকে সৃষ্টি হয় এই মান-অভিমানের। মধ্যযুগের কাব্য-সাহিত্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও পদাবলিতে পারস্পরিক ক্ষণিক বিরাগ বা অভিমানের ফলে শ্রীরাধার মানভঞ্জনের একটি পর্ব আছে। তাতে প্রেমাস্পদের মান-ভাঙানোর জন্য কত প্রাণপণ চেষ্টা! তাই চন্দ্রশেখর ব্রজবুলি ভাষার পদাবলিতে বলেছেন : ‘কাহে তুহুঁ কলহ করি কান্তসুখ তেজলি/অব সে রোয়সি কাহে রাধে।/মেরুসম মান করি উলটি ফিরি বৈঠিলি/নাহ তব চরণ ধরি সাধে।’ রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানেও এই অভিমান-ভাঙানোর চেষ্টায় অন্ত নেই। তাঁর বসন্তদিনের একটি গানে পাই : ‘বনে এমন ফুল ফুটেছে,/ মান করে থাকা আর কি সাজে।/ মান-অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে/ চলো চলো কুঞ্জমাঝে।’ ‘মান’ নামে কোনও ফুল নেই, মানের কোনও কলিও নেই! অথচ ‘মানকলি’ বলে একটি মধুর ব্যঞ্জনাময় শব্দ আছে বাংলা ভাষায়। প্রেমাস্পদের মধ্যে পারস্পরিক কপট কলহ বা স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার অমø-মধুর মন কালাকালিকে বলে ‘মানকলি’।

মজার ব্যাপার হলো, একটি বিশেষ ধরনের কচুর নাম হলো ‘মান’―মানকচু। নিরামিষভোজী বৈষ্ণবের খাদ্য-তালিকায় মানকচু অন্যতম উপাদান। তাই বৈষ্ণব পদকর্তা রাধিকার মান-ভাঙানোর কথা বলতে গিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করেন। দুই মানকে―অভিমান ও মানকচু―পদকর্তা এক করে যমক তৈরি করেন। বলেন, ‘মানের গোড়ায় কিছু ছাই দিয়ে আসি/তাহলে মান বাড়বে বেশি।’ অভিমান এবং মানকচু এখানে দুই অর্থ হলেও যমকের মাধ্যমে একাকার হয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

আমরা লক্ষ্য করি, সব অনুষ্ঠানেই একজন বা একাধিক উপস্থাপক বা ঘোষক থাকেন। তারা সুমধুর কণ্ঠ ও শুদ্ধ উচ্চারণের অধিকারী হলেও প্রায়ই তাদের বলতে শোনা যায় একটি ভুল শব্দ―‘সম্মানীয় প্রধান অতিথি’ বা ‘সম্মানীয় সভাপতি’! ‘সম্মানীয়’ বলে ঘোষক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বা সভাপতিকে বিশেষ মর্যাদা দিতে চান। কিন্তু ঘোষক জানেন না, ‘সম্মানীয়’ বললে মর্যাদা না-দিয়ে বরং অপমান করা হয়! কারণ, ব্যাকরণের নিয়মে ‘সম্মান’ শব্দটি ‘মান’ ধাতু বা ক্রিয়ার মূল থেকে উৎপন্ন। এর সঙ্গে ‘ঈয়’ প্রত্যয় যুক্ত হয় না―কেবল ‘ইত’ বা ‘অনীয়’ যুক্ত হতে পারে। তাই শুদ্ধ শব্দটি হবে সম্+মান্+ইত= সম্মানিত কিংবা সম্+মান্+অনীয়= সম্মাননীয়। তা কখনও সম্মান+ঈয়=সম্মানীয় হয় না! কারণ, ‘ঈয়’ প্রত্যয় কেবল বিশেষ্য বা নাম শব্দের পরে যুক্ত হয়। ‘মান’ বিশেষ্য বা নাম শব্দ হলে তার অর্থ হয় ‘মানকচু’। এর আগে সম্ উপসর্গ যুক্ত করলে (সম্+মান= সম্মান) অর্থ হয় ‘বিশেষ কচু’! আর ‘সম্মান’ শব্দের পরে ‘ঈয়’ প্রত্যয় যোগ করলে হয় (সম্মান+ঈয়) ‘সম্মানীয়’। তখন ‘সম্মানীয়’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়―‘বিশেষ কচুর’ বা ‘বিশেষ কচু-সম্পর্কিত’।

তাই সভা-সমাবেশে কাউকে মর্যাদা দিতে গেলে ‘সম্মানিত’ বা ‘সম্মাননীয়’ বলা উচিত। তাহলেই প্রকৃত সম্মান দেওয়া হয়। কখনও ‘সম্মানীয়’ বলা ঠিক নয়। কেন না, ‘সম্মানীয় সভাপতি’ বললে ‘বিশেষ কচুর সভাপতি’ বোঝায়। তাতে কাউকে মর্যাদার বদলে অসম্মান এবং অপমান করা হয়। তবে রক্ষা এখানেই যে, অধিকাংশ সভাপতি বা প্রধান অতিথি ‘সম্মানীয়’ শব্দটির সঠিক অর্থ এবং বুৎপত্তি জানেন না! যদি কেউ জানেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। তখন অনুষ্ঠানের ঘোষককে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে―নইলে তিনি মানহানির মামলাও করতে পারেন। মানী মানুষের মান প্রাণের চেয়েও মূল্যবান।

মান নিয়ে অনেক মাতব্বরি হলো। এবার মানে-মানে বিদায় নিই। এসব ভুল-ভ্রান্তির কথা বললে ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যায়―একথা মানি। তবে বিশ্বাস না-হলে স্বীকৃত অভিধান বা বৈয়াকরণের আশ্রয় নিতে পারেন।

পত্র

‘পত্র’―এই সংস্কৃত শব্দটির অর্থ সকলেই জানেন―চিঠি কিংবা গাছের পাতা। ‘পত্রপল্লবশোভিত ঘনবনরাজি’―বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখের রচনায় এমন সমাসবদ্ধ শব্দবন্ধ সচরাচর চোখে পড়ে। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের শিশুকালের প্রথম রচনা ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে।’ বৃষ্টিপতনের সঙ্গে পত্রকম্পনের ছন্দোময় চিত্রকল্প শিশু রবীন্দ্রনাথের মনে বিপুল আনন্দ সঞ্চার করেছিল―এই ছন্দস্পন্দন আজও আমাদের মুখেমুখে ফেরে। এই ‘পত্র’ শব্দটির অন্তরেও আছে পাতাবাহারের বর্ণবৈচিত্র্যের মত বহুবিচিত্র অর্থের বাহার।

চিঠিপত্র যোগাযোগের একটি মাধ্যম। প্রিয়জনের সঙ্গে পত্রালাপে কেবল খোঁজখবর আদান-প্রদানই হয় না―মানসিক প্রশান্তি দেয়, স্মৃতিতাড়িতও করে। পত্রের মধ্যে পরশ থাকে প্রাণের। চিঠিতে থাকে চিত্তের ছোঁয়া। বাংলার লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতে চিঠিপত্র নিয়ে বিরহের অনেক গান আছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে :

‘আঙ্গুল কাটিয়া কলম বানাইয়া/নয়নের জলে করব কালি।’

‘চিঠিতে কি ভরে মন বিনা দরশনে/ শিশিরে কি ফোটে ফুল বিনা বরিষণে।’

‘আমি কেমন করে পত্র লিখি রে/ গ্রাম পোস্টাফিস নাই জানা―’

আর জগন্ময় মিত্রের চিঠি-সম্পর্কিত সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত পুরনো দিনের গানের কথা কার না মনে আছে : ‘যত লিখে যাই তবু না ফুরায়, চিঠি তো হয় না শেষ―’। চিঠির গুরুত্ব একালে আর তেমন না-থাকলেও কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর চিঠি-সম্পর্কিত গানটি বেশ জনপ্রিয় : ‘ভালো আছি, ভালো থেকো,/আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ কিংবা কবি মহাদেব সাহার ‘চিঠি’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন : ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও,/খামে ভরে তুলে দিও আঙুলের মিহিন সেলাই,/ভুল বানানে হলেও লিখো প্রিয়।’ প্রযুক্তির পত্র ও হাতেলেখা চিঠির চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে পাপিয়া সারোয়ারের একটি বাংলাদেশি আধুনিক গানে : ‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম/বন্ধুর কাছে মনের খবর ক্যামনে পৌঁছাইতাম।’ অতিআধুনিক মেইল-ফ্যাক্সের কথা না-থাকলেও পুরনো প্রযুক্তির টেলিফোন ও টেলিগ্রামের উল্লেখ এখানে আছে। আধুনিক লোকগানে এখন এমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শব্দের ব্যবহার দুর্লক্ষ্য নয়।

প্রিয়জনের কাছে চিঠি লেখালেখি, পত্রের আদান-প্রদান এখন শুধু স্মৃতির পাতায়। সেই-যে মধ্যযুগের শেষে অষ্টাদশ শতকে রাজা-বাদশাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সন্ধিপত্রের মাধ্যমে পত্রের সূচনা হয়েছিল তা এখন নেই। উন্নত দেশে তো বটেই, এদেশেও এখন চিঠি বিলুপ্তপ্রায়। ই-মেইল, ফ্যাক্স, ফোন, এসএমএস, টতইট্ ইত্যাদি কমিয়ে দিয়েছে মানুষের চিঠি লেখার অভ্যাস। প্রযুক্তি দখল করেছে পত্র লেখার প্রবণতা। জীবন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, বাড়ছে ব্যস্ততা, অভাব-দারিদ্র্য শুষে নিচ্ছে আনন্দময় সময়! তাই কমছে পত্রালাপ। একদা কথাশিল্পী যাযাবর বলেছিলেন, যা এখন আপ্তবাক্যের মত : ‘বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে আমাদের জীবনে চিঠিপত্রের বিকল্প যত কিছুই আসুক, চিঠির পরিপূরক হতে পারে না! তাতে কাজের দিকটি হয়ত সারে কিন্তু ভাবের দিক অপূর্ণই থেকে যায়। হৃদয়ানুভুতি ও মনের আবেগ হস্তাক্ষরের নিপুণ শিল্পে চিঠিতে আমরা যেভাবে প্রকাশ করতে পারি তা প্রযুক্তির মাধ্যমে হয় না। হাতে লেখা চিঠিতে কেবল কালির আঁচড় এবং আঙুলের ছোঁয়াই থাকে না, তার ভেতরে থাকে প্রাণের স্পর্শ। প্রীতির সেই মধুরিমাই আমাদের মুগ্ধ করে ও মন কাড়ে। তাই তো কবি সুকান্ত লিখেছেন : ‘কত চিঠি লেখে লোকে, কত প্রেমে, আবেগে…।’ তাই সেকালের প্রেমিক হৃদয়ের আকাক্সক্ষা ‘চিঠি দিও প্রতিদিন, চিঠি দিও।’ কালিদাসের মেঘদূত কাব্যে বিরহী যক্ষ তাই মেঘকে দূত করে প্রিয়ার কাছে হিমগিরিতে পত্র পাঠাত।

এখন সেই মেঘদূত নেই, চিঠি বিলি করা ডাকপিয়নও আগের মত নেই। পথের মোড়ের ডাকবাক্স অবলুপ্ত। বুকে কম্পন-জাগানো নীলখাম নেই―কাঁপা হাতে খাম-খোলার উদ্বেগ নেই! ফুলের ছবিআঁকা গোলাপি রঙের রাইটিংপ্যাড নেই! নেই রাবীন্দ্রিক হরফে লেখা ‘ভুলো না আমায়’ কিংবা ‘যাও পাখি বল তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’ ধরণের চিঠি লেখার প্যাড। ডাকপিয়নের কাছ থেকে কাঁপা হাতে, দুরুদুরু বুকে সুগন্ধমাখা চিঠি গ্রহণের সুখদুঃখের অনুভূতিও নেই! কিন্তু চিঠির সেই অবলুপ্ত শিহরণের কথা মনে রয়ে গেছে অন্তত অর্ধশতাব্দী আগের বাঙালির মনে!

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এখন যোগাযোগ সহজতর করে দিয়েছে। ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী―বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। মুহূর্তেই পেয়ে যাই পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তের খবর। কিন্তু এই প্রযুক্তির ধারা আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও বাড়িয়েছে বিপুল পরিমাণে। তিন দশক আগেও মা তার সন্তানকে বলতেন, কর্মস্থলে গিয়ে চিঠি লিখে পৌঁছা-সংবাদ দিস্। মায়ের সেই নিরাপদে পৌঁছানোর খবর চিঠিতে পেতে লাগত আট থেকে দশ দিন। কিন্তু এখন এই মুঠোফোনের যুগে মায়েরা প্রতিঘণ্টায় খবর নেন, কোথায় আছি―পৌঁছাতে আর কতক্ষণ ?

বিশিষ্ট মানুষের লেখা চিঠিপত্রের যেমন ঐতিহাসিক মূল্য আছে তেমনই লেখার প্রসাদগুণে সাহিত্য-মূল্যও আছে। এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে মহা মুল্যবান মানিক-রতন, অনেক দামি মনিমুক্তা-হিরেজহরত। তাই বাংলা সাহিত্যে ‘পত্রসাহিত্য’ নামে আলাদা একটি অধ্যায় আছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চিঠি বাংলা পত্রসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ বিষয়ক বই রাশিয়ার চিঠি, ইয়োরোপ যাত্রীর ডায়েরি, জাপানযাত্রীর ডায়েরি, জাভাযাত্রীর ডায়েরি তো মূলত প্রদর্শন ও দর্শনের তত্ত্ব-তথ্যে ভরা পত্রসাহিত্যই। আর ‘প্রিয় মোতিহার’ সম্বোধন করে বিজ্ঞানী বন্ধু অধ্যাপক মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের আত্মনিবেদিত চিত্তের প্রফুল্ল প্রেমের চিঠিগুলোর কাব্যিক মূল্য অবিসংবাদী। যাক পত্রসাহিত্যের সেসব কথা।

অভিধান বলে, ‘চিঠি’ শব্দটি হিন্দি কিন্তু ‘পত্র’ সংস্কৃত। ‘চিঠি’ শব্দটির প্রয়োগ প্রথম পাওয়া যায় কৃষ্ণদাসের লেখায়, ১৫৮০ সালে। ‘চিঠিপত্র’ শব্দটি সমার্থক কিংবা চিঠি ও অন্যান্য কাগজপত্র অর্থে। কিন্তু গভীরতর অর্থের বিচারে ‘পত্র’ শব্দটি বৈচিত্র্যে ভরা। এর কয়েকটি উদাহরণ দিই :

‘একটি করিয়া পত্র সর্বলোকে নিতে।’ (পাতা অর্থে, বৃন্দাবন দাস)।

‘পত্র পড়ি প্রভুর মনে হৈলা কিছু দুঃখ।’ (চিঠি অর্থে, কৃষ্ণদাস)।

‘হাত্থে লইল পত্র মসী।’ (কাগজ অর্থে, মুকন্দরাম চক্রবর্তী)।

‘ঘোষপুকুরের কিনারায় মাসিক পত্র পড়ছে বসে।’ (সাময়িক পত্রিকা অর্থে, রবীন্দ্রনাথ)।

‘প্রত্যেক পত্রে স্বর্ণ বিভূষিত কোরানের কয়েক নক্সা আছে।’

(বইয়ের পাতা অর্থে, সমাচার দর্পণ)।

‘আমরা গত পত্রে বহুবিবাহের অকর্ত্তব্য বিষয়ে… এক পত্র লিখিয়াছিলাম।’ (প্রথম ‘পত্র’ অর্থ পত্রিকার গত সংখ্যা। দ্বিতীয় ‘পত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠি বা রচনা, অক্ষয়কুমার দত্ত)।

‘কাঁপিছে বিষাদ-ভরে নয়নপলক-পত্র।’ (চোখের পাতা অর্থে, রবীন্দ্রনাথ)।

অভিধানে পত্রের আরও অর্থ পাওয়া যায়। পত্র মানে, লিপি, লিপিকা, আদেশলিপি, অঙ্গীকারপত্র, সোনা বা রুপার পাত, বিয়ের পাকা কথার প্রতিজ্ঞাপত্র। যোগদানপত্র, প্রজ্ঞাপনপত্র, পদত্যাগপত্র, উকিল নোটিশ―এসব অফিসিয়াল পত্র। মুসলিম বিয়ের কাবিননামাও একধরনের পত্রই। হিন্দুদের বিবাহপূর্ব অনুষ্ঠানকে মঙ্গলাচরণ বা ‘পাটিপত্র’ বলে। বছর পঞ্চাশেক আগে আমাদের তারুণ্যে পত্রমিতালির একটি উচ্ছ্বাস ছিল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বন্ধ্প্রত্যাশী তরুণ-তরুণীরা নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানিয়ে ঠিকানা ছাপাত চটুল সিনে-ম্যাগাজিনে। সেই সূত্রে চলত পত্রালাপ ও ভাববিনিময়। পত্রালাপে কেবল প্রীতির বিনিময়ই হয় না―কখনও বিরোধও সৃষ্টি হয়। তা থেকে ক্রমান্বয়ে পত্রাঘাত এবং পত্রযুদ্ধও হয়! ‘পত্রপাঠ বিদা’ বলেও একটি কথা আছে। পত্রবাহককে আদর-আপ্যায়ন না-করে শুকনো মুখে বিদেয় করাকে বলে ‘পত্রপাঠ বিদায়’। শোনা যায়, প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাদের আমলে পোষা কবুতর নাকি পত্রবাহকের কাজ করত। ‘পত্রপুট’ বলেও একটি শব্দ আছে―মানে পাতা দিয়ে তৈরি পাত্র। এই নামে রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্যও আছে। ‘পর্ণকুটির’ মানে পাতায় ছাওয়া ঘর, যা গরিবের আবাস। পাতার অপভ্রংশ ‘পাত’। যে-পাতা খাবারের পাত্র বা থালা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা-ই ‘পাত’। এজন্যই বলা হয়, গরিবের ঘরে তিন বেলা পাত পড়ে না। খনার বচনে বলা হয়েছে―‘কলা রুয়ে না-কেটো পাত/তাতেই কাপড়,তাতেই ভাত।’ এই ‘পাত’ মানে পাতা। আবার প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাদের নির্দেশনামা তাম্রলিপি-রৌপ্যলিপিও লেখা হতো ধাতুর পাতেই। ‘পাত’ কেবল পাতা অর্থেই নয় ‘পতন’ অর্থেও প্রয়োগ হয়―বৃষ্টিপাত, রক্তপাত, শিলাপাত, প্রপাত, ধারাপাত, বজ্রপাত ইত্যাদি।

‘পত্রী’ মানে পাতা আছে যার। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের কথা আছে। ‘পত্রী’ শব্দের আরেকটি অর্থ―পক্ষ বা পাখা আছে যার। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই শব্দটি পদবি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়―পত্রী, পত্রনবীশ ইত্যাদি। ভারতের একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি ও চিত্রশিল্পীর নাম পূর্ণেন্দু পত্রী।

নোবেলজয়ের পর রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিদিন প্রচুর চিঠি আসত। সেসবের জবাবও তিনি স্বহস্তে দিতেন―এমনকি নাম-পরিচয়হীন অতি তুচ্ছ চিঠিরও। একবার চট্টগ্রামের এক কবিরাজি ঔষধ বিক্রেতা তার দোকানের জন্য একটি নাম চেয়ে কবির কাছে সবিনয়ে চিঠি লিখেছিলেন। দিন পনেরোর মধ্যেই সেই চিঠির উত্তর এল। রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজহাতে লিখেছেন, ‘আমি আপনার দোকানের নাম দিলাম “ভৈষজ”।’ বাঙালির চিঠিপত্রের সেসব ইতিহাস ও ঐতিহ্য আজ কেবলই স্মৃতির মণিকোঠায় বন্দি।

[চলবে]

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button