আর্কাইভগল্প

গল্প : কাগজের নৌকা : রুমা মোদক

রোগীর ছেলেমেয়েদের কিছুতেই মানানো যায় না। তারা নাছোড়বান্দা। একজন নব্বই বছরের বৃদ্ধ মারা গেছেন। তাও মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে। তার মৃত্যুকে কেউ অস্বাভাবিক ভাবতে পারে! ডাক্তার, নার্স, আয়া সবার যাবতীয় অভিজ্ঞতাকে হার মানিয়ে তারা এই অস্বাভাবিক আচরণটি করে। মৃতদেহ ঘিরে থাকা হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সবাই ভয়ে, আতঙ্কে, উৎকণ্ঠায় অবাক তাকিয়ে থাকে মৃতদেহ বহন করা ট্রলিটির দিকে। তারা ভাবে কে জানে কোন ভোগান্তি অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য! একবার এক শিক্ষকের মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে ভাঙচুর থানা-পুলিশ কী হল্লাটাই না করেছিল! সেবার বিপুল টাকার বিনিময়ে ঘটনাটা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। এবারও বৃদ্ধের পুত্রকন্যার যে আগ্রাসী শোক দেখা যাচ্ছে, এই শোকের উত্তপ্ত লাভা কোথায় গিয়ে যে থামে ভেবে কূলকিনারা পায় না তারা। অথচ জীবিত অবস্থায় তারা তাদের জীবন ও জীবিকার ব্যস্ততা অগ্রাহ্য করে যে হাসপাতালে বাবার পাশে আকুল হয়ে পড়েছিল তাও নয়। বরং দুদিন তিনদিন পরপর দেখতে এসেছে। একদিন ছেলে তো একদিন মেয়ে। অথচ এখন এদের পিতৃশোকের এ কি মারমুখী দাপট! আত্মীয় পরিজন সবার মতামত অগ্রাহ্য করে নব্বই বছরের বৃদ্ধ লোকটাকে কাঁটাছেড়া পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়েই ছাড়ল ছেলেমেয়েরা। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাদের বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। হাসপাতালে কেউ তার অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিয়েছে।

দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে দেয় রোগীর কন্যাটি। তিনি অবাক হন না। এই রোগীর কন্যাটি মানুষ খারাপ না। তবু তিনি যে প্রতি বেলায় ভাত শক্ত, তারকারি ঝাল, কই মাছ খাই না ইত্যাদি বাহানা করেছেন তার কারণটা তো আর এই কন্যাটি বোঝেনি। তাই বিরক্ত হয়েছে। এইটুকু বিরক্ত না করলে আরও দুয়েকটা দিন থাকা যেত। দুয়েকটা দিন মানে প্রতিদিন দেড় হাজার টাকা।

কন্যার ঠাস করে দরজা লাগানোর অপমানটা যতটা না গায়ে লাগে, তৎক্ষণাৎ তার চেয়ে বেশি অসহনীয় কষ্ট হয়ে গায়ে লাগে উপস্থিত সমস্যাটা। তিনি দেখলেন লিফট বন্ধ। দু হাত ভরতি কয়েকটা ভারী ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সাততলা থেকে নামা কি মুখের কথা! তার উপর ইদানীং হাঁটুর ব্যাথাটা প্রচণ্ড বেড়েছে। এখন কলিং বেল টিপে কন্যাটিকে ডেকে এই লিফট সমস্যার সমাধান করতে পারেন সম্পর্কের এমন সহজতা তিনি রাখেননি। এ নিয়ে তার যে এই মুহূর্তে খুব আফসোস হচ্ছে তাও নয়। লিফটটা বন্ধ না থাকলে কন্যাটির সাথে পুনরায় কথা বলার ব্যাপারটি তার মনেই আসত না। বৃদ্ধ আর অসুস্থ বাবা-মায়ের ছেলেমেয়েদের যে স্বার্থপর আর নির্মম চেহারা প্রতিদিন তিনি দেখে এদের জন্য তার ভেতর কোনও মায়া বা আফসোস জন্মায় না।

কন্যাটিকে তিনি বেশ যন্ত্রণা দিয়েছেন, তিনি নিজেও জানেন, জেনে-বুঝেই দিয়েছেন। সচেতনভাবে। কন্যাটি বাধ্য হয়ে সব সহ্য করেছে তাও তিনি বুঝেছেন, এরকম করা উচিত নয় এটাও তার জানা। কিন্তু আরও একটি কথা তিনি অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, যা এই রোগীর কন্যাটি জানে না, যা নাকি তাকে এরকম সভ্যতা-ভব্যতাহীন আচরণ করতে বাধ্য করে। এই পেশায় আসার পর তিনি ধীরে ধীরে এরকম আচরণ আয়ত্ত করে নিয়েছেন। নইলে যখনই কোনও রোগীর বাসায় গিয়ে থাকতে হয় রোগীর পরিবারের লোকজন তাকে কাজের বুয়ার সমকক্ষ মনে করে সেইমতো আচরণ করে। তাচ্ছিল্যের, অবহেলার। ফ্রিজের বাসি, ফেলনা, থেকে যাওয়া যাতা খাবার খেতে দেয়। মাটিতে পুরোনো বালিশ ও ছেঁড়া চাটাইয়ে শোয়ার আয়োজন করে।

এই রোগীর কন্যাটি অবশ্য তা করেনি। নিজে যা খায় তাই দিয়েছে। তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন এই কর্মজীবী কন্যাটি সাতসকালে ভাত রান্না করে অফিসে যায়, সেই ভাত ফ্রিজে থাকে আর বাচ্চা, বাচ্চাদের বাপ দিনভর তাই গরম করে করে খায়। তবু খেতে বসে তিনি ভাত টিপে উঠে পড়লেন। ফ্রিজে রাখা শক্ত ভাত খেতে পারবেন না বলে গ্লাস নিয়ে ইউনিলিভারের পিউরিফাই ফিল্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। সারা দিন অফিস করে আসা, গৃহস্থালি সারা, রোগী মায়ের জন্য পথ্য তৈরি করা ক্লান্ত কন্যাটির সারা মুখে বিরক্তির ছায়া স্পষ্ট দেখলেন তিনি। তবু টেবিল থেকে উঠে রাইস কুকারে গরম ভাত চাপালো সে। বিরক্তি আর জেদের তীব্র তোড়ে কন্যা নিশ্চুপ গনগনে মুখ নিয়ে ভাত চাপালো তো চাপালোই। সে ভাত রান্না হলে রুই মাছ সহযোগে প্লেটে বেড়ে খেতেও দিল একটি কথাও না বলে।

তিনি জানতেন সকালেই চাকরি নট হয়ে যাবার সম্ভাবনা। তবু তিনি যে কাজের বুয়া নন নেহায়েত, রোগীর দেখাশোনা করতে পারা সুদক্ষ কর্মজীবী নারী, এই ধারণা জারি রাখতে তাকে এসব করতে হয়। আত্মসম্মানের সাথে আপস না করার মোক্ষম উপায় তো এই একটিই আছে তার কাছে।

লিফট খোলা না পাওয়ায় সিঁড়ি দিয়েই নামতে শুরু করেন তিনি। ব্যাগের ভেতর মোবাইল ফোনটা বাজতে থাকে। একতলা নেমে ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করতে হবে। ছয় তলায় থামার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দুই হাত ভর্তি তিনটা ভারী ব্যাগ। একটাতে বালিশ আর চাদর। এই জিনিস দুইটা সাথেই রাখেন। হাসপাতালে যখন সে কোনও রোগীর এটেনডেন্স হিসেবে থাকে তখন কেবিন বা ওয়ার্ডে রোগীর সাথেই শোয়। বাসায় এসে রোগীর দেখাশোনা করতে হলে রোগীর পরিবার থাকার ব্যবস্থা করে বটে, তা পছন্দ না হলে নিজের ব্যবস্থা নিজের করে নিতে হয়। আরেকটা ব্যাগে নিজের কাপড়-চোপড়, গামছা, একটা ক্রিম, চিরুনি, একজোড়া স্যান্ডেল একটা থালা আর গ্লাস। এগুলোই তার সংসার। সাথে নিয়ে চলেন তিনি। এই কয়টা জিনিস রাখার জন্য আস্ত একটা বাসা ভাড়া নেওয়ার দরকার পড়ে না। আজকের ব্যাগটা একটু বেশি ভারী। এই রোগীর বাসা থেকে দুইটা ড্রেস আর এক প্যাকেট গুঁড়া দুধ চুরি করেছেন। খালি বাসা পেয়ে এটা ওটা নেওয়ার আকাক্সক্ষা সামলানোর জন্য লোভের সাথে একবিন্দু লড়াই করেন না তিনি। এই কাজে আসার প্রথম থেকেই আত্মসমর্পণ করেছেন। করবেন না কেন ? অন্যায় ? ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব কে করে ? কীভাবে করে ? তার কি এই নির্দয় শহরে এই কাজে আসার কথা ? তিন তিনটা মেয়ে ঘাড়ে দিয়ে মেয়েদের বাপ ক্যান্সারে মারা গেল, মাস শেষে বাসা ভাড়া দূর থাকুক, হাজার তিনেক টাকার চালের বস্তা কেনার টাকার জোগান নেই, তখন তাকে জীবনযুদ্ধের এই অথৈ জলে ফেলে দেওয়ার অন্যায়টা যখন হলো তখন তার বিরুদ্ধে কোথায় নালিশ করতে পেরেছিলেন তিনি ?

নেহাৎ ঘরের বউ, রান্নাবান্না, ঘর-গেরস্থালি করা তিনি জানেন, কী অসীম ধৈর্য ধরে লড়াইটাতে নেমেছেন। বৃদ্ধ মায়ের কাছে তিন মেয়েকে রেখে ছেলেবেলার বান্ধবী দিলরুবার হাত ধরে ঢাকা শহরে পা রেখেছিলেন যখন, বয়স তখন ত্রিশ পেরোয়নি। দিলরুবা হাসপাতালের ক্লিনার। বলেছিল এরকম একটা ক্লিনারের চাকরি জোগাড় করা কঠিন কিছু হবে না। দিয়েও ছিল। মাসখানেক যেতে না যেতেই এই ধান্ধাটার খোঁজ পেলেন, সাথে সাথেই ক্লিনারের চাকরিটা ছেড়ে রোগীর সাথে থাকা শুরু করে দিয়েছিলেন। ধান্ধাটা আসলে তিনি নিজে করেননি। বরং ধান্ধাই তার উপরে এসে পড়েছিল।

দ্য নিউ মেডিকেয়ার ক্লিনিকের ৪০৭ নাম্বার কক্ষের রোগীর ছেলেটি যখন এসে প্রস্তাবটা দিল, তখন সবুজ ইউনিফর্ম পরা তিনি চারতলা পুরো পরিষ্কার করে ওয়াশরুমের বাইরে বসে একটু দম ফেলছিলেন। এই দমের মাঝখানেই ছেলেটি প্রস্তাবটা দিল। এক রাত তার মায়ের সাথে থাকলে এক হাজার টাকা দেবেন। শহরে নবাগত তিনি একটু দরদাম করবেন সেই বুদ্ধিটুকু তখনও শিখে ওঠেননি। এক রাতে এক হাজার! শোনে তিনি এক কথায়ই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সারা মাস রুম বারান্দা মুছে ঝকঝকে করে তিনি পেতেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। সেই রাজি হওয়াই তাকে এই ধান্ধাটার পথ খুলে দিল। দেখলেন হাসপাতালে এইরকম সমস্যার অভাব নেই। বিশেষ করে বুড়া বাবা-মাকে ভর্তি করে ছেলে-মেয়ে কেউ রোগীর সাথে থাকার মতো বৃহৎ ত্যাগ করতে পারে না। কারও বর চায় না, কারও স্ত্রী বাসায় একা থাকতে ভয় পায়, কারও সকালে অফিস থাকে…। নানা বাহানা। মাসের ত্রিশ-দিনই এমন কেইস পেয়ে যান তিনি। মাসিক রোজগার পাঁচ হাজার থেকে গড়ে প্রায় ত্রিশ হাজারে পৌঁছে যায় কয়েক মাসে।

ফোনটা বেজেই চলেছে। ছয়তলার সিঁড়ি শেষ করে ব্যাগগুলো ফ্লোরে রেখে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করেন। অচেনা নাম্বার। বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। কয়েক দিন ধরে উৎপাত শুরু হয়েছে। পুলিশ ফোন দিয়ে নানারকম প্রশ্ন করে তাকে। কতদিন ধরে এ পেশায় আছেন ? কোন কোন হাসপাতালে কাজ করেন। প্রথমে ক্লায়েন্ট ভেবে সব গড়গড় করে বলে দিয়েছেন। পরে যখন বুঝতে পেরেছেন তখন অলরেডি তার অবস্থান, কাজ, বাড়ির ঠিকানা সব বৃত্তান্ত বলা হয়ে গেছে। জানেন না এখন ভাগ্যে কী আছে। অচেনা নাম্বার থেকে আসা কলটাকে বাজতে দেন। বন্ধ হয়ে গেলে আবার দু হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে নামতে শুরু করেন।

কই যাবেন এখন ভাবনাটা খুব বেশি অস্থির করে না। যেহেতু নতুন রোগী নেই দুই দিন, বাড়িতে মেয়েদের কাছে থেকে আসা যায়। অনেক দিন বাড়ি যাওয়া হয় না, দেখা নেই মেয়ে দুটোর সাথে। বড় মেয়ের বাড়িতেও যাওয়া যায়। নাতি হয়েছে দুই মাস এখনও দেখতে যাওয়া হয়নি। তবে বড় মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার একটা অসুবিধা আছে। খালি হাতে নাতির মুখ দেখলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের সম্মান থাকবে না। সবাই জানে মা ঢাকায় চাকরি করে। আলাদা খাতির আছে তার বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। এই খাতির শুধু চাকরির বরাতেই অর্জন করেননি। বরং দুই ভরি সোনার গহনার বিনিময়ে কিনতে হয়েছে। বিয়েতে বড় মেয়েকে দুই ভরি সোনার গহনা দিয়েছেন, এলাকা কেন, পুরো গ্রামেই বিষয়টি অবিশ্বাস্য গল্প হয়ে মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে। বিয়েশাদিতে সোনার গহনা দেওয়ার মতো ক্ষমতা গ্রামবাসীর নেই। বাড়ির কোনও ছেলে দুবাই কিংবা কুয়েত থাকার বদৌলতে দুয়েকটা পরিবার সোনার গয়না দিলেও একটা আংটি নয়তো চিকন সুতার মতো একটা চেইন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এর বেশি কেউ স্বপ্নেও দেখে না। সেখানে দু ভরির গয়না! 

এটুকু জোটাতে কম কষ্ট করতে হয়নি তাকে। যখন যে রোগীর সাথে থেকেছেন, সে হাসপাতালেই হোক কিংবা বাড়িতে, সবসময় তার যেমন সতর্ক দৃষ্টি থেকেছে রোগীর দিকে, ঠিক ততখানি থেকেছে রোগীর আত্মীয়স্বজনদের ব্যাগ, সোনার গহনার প্রতি। বিয়ে বাড়ির ভারী গহনা নিয়ে তো কেউ আর হাসপাতালে আসে না। ছোটখাটো আংটি, গলার চেইন এসবই ভরসা। সোনার গয়না আর নগদ টাকাপয়সা ছাড়া অন্য কিছুতে তিনি নজর দিয়েছেন কম। পুরোনো জামাকাপড়, বাসন পত্র, এটা-সেটার প্রতি তেমন দৃষ্টিই দেননি তিনি কোনওদিন। টাকা, সোনাদানা না পেলে অন্যকিছু। 

সবই জীবনে পদে পদে ঠেকে শেখা অভিজ্ঞতা। পাঁচ হাজার বেতনে প্রাথমিকভাবে চলা সংসারের আয় ত্রিশ হাজারে পৌঁছালে দেখা গেল মেয়েগুলার আদর-আবদার মিটিয়ে ঘরে মায়েদের শখের আসবাব ড্রেসিং টেবিল, স্টিল আলমিরা কিনে বেশ পাড়া-পড়শির চোখ টাটানো যায়। রোগীদের ব্যাগ-ট্যাগ হাতিয়ে যে দুই চার হাজার পাওয়া যায়, মাস শেষে তাও জমে বেশ ভালো একটা সংখ্যা দাঁড়ায়। এসবের বরাতে মায়ের ঘরটা টিন থেকে ইটের গাঁথুনিতে যায়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সরিয়ে নেওয়ার ছোটখাটো বিষয়টা রোগীর আত্মীয়স্বজনেরা টেরই পায় না। এসব ছোটখাটো জিনিস এদের কাছে বাস্তবিক অর্থেই এত ছোটখাটো, টের পাবার মতো গুরুত্বই বহন করে না। অথচ এই দিয়ে তার দিন বদলে যায়। কারও কিছু সরাতে তার হাত কাঁপে না মোটেই, মনে হয় যা সরালে কারও ক্ষতি হয় না, বরং অন্য আরেকজনের উপকার হয় তা কোন হিসাবে অন্যায় হয় ? এই সমাজের অন্যায়ের হিসাবটাই তার কাছে বড় অন্যায় মনে হয়।

পাঁচতলার সিঁড়ি থেকে নেমে চারতলায় পৌঁছালে ফোনটা আবার বাজতে থাকে সাইরেন বাজানো ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির মতো আত্মা কাঁপিয়ে। ছোটবেলায় আওয়াজ শুনলেই বিপদাশঙ্কায় সন্ত্রস্থ সবাই দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে জানতে যেত কোথায় আগুন লেগেছে। কখনও খুব কাছে আকাশমুখী ওঠে যাওয়া আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যেত,মনে হতো নিজের ঘর গিলতে আসছে রাক্ষসের মতো। বুকের ভেতরে ধক ধক ধক লাফাতো আত্মা। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। মনে হতো আর রক্ষা নাই।

গত কয়েক দিনে অচেনা নাম্বারের ফোনকলে এমন শৈশবের স্মৃতি ফিরে আসে। মনে হয় আর রক্ষা নাই। চার তলায় দাঁড়িয়ে আবার ফোনটা খুলে দেখেন তিনি। মেয়েরাও ফোন দিতে পারে কোনও প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। মেয়েগুলোকে নিয়ে ইদানীং খুব দুশ্চিন্তায় থাকেন। মেয়েগুলো বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। কোনও দিন জানতে চায় না মা ঢাকায় কী করে আসলে। দুইটা পিঠাপিঠি। একসাথে কলেজে যায় আর কলেজের বড়লোকের মেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে জামা-কাপড়ের অর্ডার দেয় অনলাইনে। এদের অনলাইনের খরচ মেটাতে মেটাতে ইদানীং তার কাহিল দশা। নিয়ন্ত্রণ করা খুব দরকার, অনুভব করেন। কিন্তু ছোট থেকে মা বাবার আদর যত্ন না পাওয়া মেয়েদের প্রতি কঠোর হতে পারেন না মোটেই। এতে যে আখেরে মেয়েদের ক্ষতিই করছেন এটাও উপলব্ধি করেন।

না সেই আগের নাম্বারটাই। অচেনা। ঠিক করেন আপাতত অচেনা কোনও নাম্বারের ফোন ধরবেন না। পুলিশ তার পিছু পড়েছে। তিনি কি অন্যায় করেছেন ? অন্যায় যদি কিছু করে থাকেন তো তা একটাই। এই মেয়েদের শাসন না করা। খবর পান, এলাকার ছেলেদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় তারা। আজ মোহিনী পার্কে একজনের সাথে বোটে ঘোরে তো পরদিন আরেকজনের সাথে শহরের নতুন গজিয়ে ওঠা ফাস্টফুড বার্গারকিংয়ে পিৎজা খায়। এই নির্লজ্জ বেহায়াপনা হোটেল টোটেলে রাত কাটানো পর্যন্ত পৌঁছেছে কি না এখনও জানেন না তিনি। সব খবর তার কানে আসে। পাড়াপড়শিরা পবিত্র দায়িত্ব মনে করে গায়ে পড়ে ফোন দিয়ে জানায়। তিনি রেগেমেগে ভীষণ শাসন করবেন ভেবে মেয়েদের কল দেন। ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করেন কী কী বলবেন, কিন্তু তাদের কণ্ঠে আম্মু ডাকটা শুনেই তার ভেতরের তীব্র গরল কথারা শান্ত সুবোধ তরল হয়ে ভেতরে অপত্য স্নেহের নহর বইয়ে দেয়। তিনি কিচ্ছু বলতে পারেন না। শাসনের অভাবে মেয়েগুলো পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বড় অন্যায়টা তার হচ্ছে এই যে তিনি মেয়েগুলোকে শাসন করতে পারছেন না।

মনে মনে ঠিক করেন আরও কিছু টাকাপয়সা জমলেই মেয়েগুলাকে পার করে দিবেন। দেরি করবেন না মোটেই। এদের বাপের রেখে যাওয়া এই আপদগুলোকে জায়গামতো রেখে যেতে পারলে তাকে পুলিশে ধরলেই কী, মরে গেলেই কী।

ফোনটা ব্যাগে রেখে আবার সিঁড়ি ভাঙতে থাকেন। এবার বাড়ি গিয়েই ফোনটা বন্ধ করে দেবেন। সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে হাঁপিয়ে যান তিনি। কেবল সিঁড়ি ভাঙার ক্লান্তি নয়। ভেতরের উৎকণ্ঠা, মেয়েদের জন্য উদ্বিগ্নতা সব মিলেমিশে তাকে বড় ক্লান্ত করে তোলে। একটু জিরোনোর জন্য দাঁড়ান। চারতলার ফ্ল্যাট থেকে দরজা খুলে বের হয়ে ভদ্রলোক এক নজর তাকে দেখে কি দেখে না। খ্যাঁক খ্যাঁক করে ওঠে রুক্ষ নির্মম পাহারাদারের মতো। মানুষ কুকুর বিড়ালকেও এমন দূর দূর করে না। এ্যাই কে তুই ? কোন বাসা থেকে চুরি করে বাইর হইছস ? এই কে তুই ? চিল্লাপাল্লা করে ঘরবাড়ি সব এমনভাবে কাঁপিয়ে তোলে ভদ্রলোকটি, আশপাশ থেকে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে আরও গোটাকতক ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা। ছোটখাটো একটা জটলা বেঁধে যায় সিঁড়ির গোড়ায়।

মাইয়াদের বাপ মারা যাওয়ার পর মানুষের কত রূপই যে দেখেছেন তিনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার সময় ঈদে মেয়েদের বাপের দেওয়া নতুন শাড়িটাও রেখে দিয়েছিল শাশুড়ি। পুত্রশোকের চেয়ে শাড়িটা মূল্যবান হয়ে উঠেছিল তার কাছে।

এখন তার আয়-রোজগারে চোখ টাটায় পাড়াপড়শি তো বটেই, নিজের ভাইয়ের বউদের পর্যন্ত। হিংসায় ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না কেউ। অথচ প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার সময় বোরকা হাউজের ভ্যারাইটিজ বোরকা, ইলিশ মাছ, কেক, চানাচুর, বিস্কুট কী না নেয় এদের জন্য।

আর যে দিলরুবা, সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে এসে যে কি না টিকে থাকার পথটা দেখিয়ে দিয়েছে, সে পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। দিলরুবাও তার দেখাদেখি একই পেশায় আসতে চেয়েছিল কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেনি। তিনি দিলরুবাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, এই চাকরিটা কেবল চাকরির মতো করলেই হয় না। ক্লায়েন্টের প্রতি মায়া জন্মাতে হয়। কিন্তু দিলরুবা বোঝেনি। ওর মায়া জন্মাতো না, ও মায়া দেখাত। ফলে ধান্ধাটায় টিকতে পারেনি।

আজকের এই ভদ্রলোকের ব্যবহারটাও তার অভিজ্ঞতায় নতুন যুক্ত হলো। কী পরিচয় দেবে সে নিজের ? আসলে কী সে ? কে সে ? হৈ চৈ, হল্লা শোনেই কি না পুলিশের দলটা সিঁড়ি বেয়ে ওঠে আসে উপরে। তার দিকে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করেই হাতকড়া পরিয়ে দেয় তারা।

পুরুষ মহিলা শিশু মিলিয়ে পাঁচ সাতজন লোকের অক্সিজেন মাস্ক খুলেছে সে। সেই নব্বই বছরের বৃদ্ধ লোকটিও একজন। তার এক ছেলে যে হোমড়া-চোমরা, মন্ত্রী-মিনিস্টার এটা তো তার জানার কথা নয়। ছেলেটিকে তো কোনওদিন বাপের রোগশয্যার ধারে কাছে আসতেও দেখেনি সে। অন্য দুই ছেলে মেয়েকেও দেখেছে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করতে। দেখতে এসেই নিজের বাপকে ‘বুইড়া মরে না ক্যান’ বলে মুখ ঝামটা দিতে পারে কল্পনাও করতে পারেন না তিনি। সব বুঝতেন লোকটি। ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকতেন অবোধ শিশুর মতো।

সামনে বলতেন না, ওরা চলে যাওয়ার পর দুর্বল, অসহায়, নির্জোর, চরম আক্ষেপের গলায় তাকে বলতেন, আমি মরি না ক্যান! জীবনকে যাপন করতে না পারা অসহ্য বেদনা স্পষ্ট তার কণ্ঠে। অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন তিনি। তিনি কোনও অন্যায় করেননি। মানুষটিকে মুক্তি দিয়েছেন। মৃত্যুর পর ছেলের এই যে দোর্দণ্ড দাপট, এ মূলত দেখানো। সবাইকে দেখানো, দেখ ব্যাটা আমি কতো হোমড়াচোমরা!

 যাদের অক্সিজেন মাস্ক খুলেছেন এদের কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করে বউ ছেলেকে অসহায় কাঁদতে দেখেছেন তিনি। কাউকে ভর্তি করে স্বামী ছেলে মেয়েকে দেখেছেন ভীষণ বিরক্ত হতে।

তার সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে তিন বছরের শিশুটার অক্সিজেন মাস্ক খুলতে। হার্টে ছিদ্র, ব্রেইনে রক্তক্ষরণ। ডাক্তার বলেছে দু দুইটা অপারেশন লাগবে তার, হার্টে একটা, মাথায় একটা। রিক্সাওয়ালা বাপ আর কাজের বুয়া মা সারারাত কাঁদে। হাসপাতালের খরচ জোগানোর টাকা নেই, অপারেশনের খরচ জোগানো তো কল্পনারও অতীত। তিনি দেখছিলেন অসহায় বাবা মা দুজন কী অথৈ সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। অক্ষমতা আর অপরাধবোধে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে অপত্য স্নেহ। তার নিজের মতোই অপত্য স্নেহ। বলতে পারছে না ডাক্তারকে, হাসপাতালের খরচ চালানোর ক্ষমতা নেই, তাদের রোগী ছেড়ে দিতে। ডাক্তারি ভাষ্যের দাড়ি কমারও অর্থ বোঝেন তিনি। হাসপাতালে দীর্ঘদিন থাকার অভিজ্ঞতায় এর দেয়ালের ভাষাও পড়া যায়। স্পষ্ট বুঝে ছিলেন বাচ্চাটি বাঁচবে না। কিন্তু ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে মরবে এই অসহায় বাপ মা দুইজন। রাতের আঁধারে বাচ্চাটার অক্সিজেন মাস্ক খুলে বাপ মা দুজনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। না মোটেই অন্যায় করেননি তিনি।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button