মার্কেসের জাদুবাস্তবতা : সুরাইয়া ফারজানা হাসান

বিশেষ রচনা : প্রবন্ধে জাদুবাস্তবতা
শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে নেওয়া ভালো, জাদুবাস্তবতা বা magic realism ব্যাপারটি কিন্তু দিন শেষে জাদুই, একে পরাবাস্তববাদ বা surrealism-এর সঙ্গে কোনও ক্রমেই গুলিয়ে ফেলা যাবে না। এমনকি এটি জাদু আশ্রিত জাদু-সাহিত্যও নয়, নয় অতিপ্রাকৃত, রূপকথা, পুরাণ কিংবা মিথ। এটি মূলত শিল্প-সাহিত্যের এমন একটি ধারা বা শৈলী যাতে জাদুকরী উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা হয় এবং বাস্তবের জাগতিক পরিবেশ আর জাদুকে একাকার করে দিয়ে এক অসাধারণ বাস্তববাদ তুলে ধরা হয়। সাহিত্যে বাস্তববাদ যেমন জাগতিক ও বাস্তব বিষয়বস্তুকে বিশ্বস্ত ও সরলভাবে উপস্থাপন করা হয়, বিপরীতক্রমে জাদুবাস্তবতা অলীক কল্পনাগুলোকে বাস্তবতায় রূপ দেয়। এ ক্ষেত্রে জাদুবাস্তবতার মহানায়ক মার্কেসের এক উক্তি স্মর্তব্য, ‘আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটি আছে সেটিই জাদুবাস্তবতা।’
গার্সিয়া মার্কেস ওরফে গাবোর বয়ানে একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে সাহিত্যের এই লিখনশৈলীটি বুঝিয়ে দেওয়া যাক। ১৯৮১ সালে প্যারিস রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আপনি যদি বলেন আকাশে হাতি উড়ছে, লোকজন সম্ভবত তা বিশ্বাস করতে যাচ্ছে না। তবে আপনি যদি বলেন যে চারশত পঁচিশটি হাতি আকাশে উড়ছে, লোকজন আপনাকে বিশ্বাস করেই ফেলবে। ওটি আসলে সেই কৌশল যেটি আমার নানি (ত্রানকিলিনা ইগুয়ারান কোতেস) ব্যবহার করতেন। এ ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর সেই ঘটনাটি উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে উপন্যাসের চরিত্রটি হলুদ প্রজাপতি দ্বারা পরিবেষ্টিত। যখন আমি খুব ছোট ছিলাম, তখন এক বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমি তার ব্যাপারে খুব কৌতূহলী ছিলাম। কারণ, লোকটি একটি কোমরবন্ধ পড়ে এসেছিল যেটি সে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে নিজেকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করে। লোকটি প্রসঙ্গে আমার নানি একবার বলেছিলেন, প্রতিবারই যখন লোকটি বাড়ির কাছাকাছি আসত, সে বাড়িভর্তি প্রজাপতি রেখে যেত। তবে আমি যখন ঘটনাটি লিখি, বেশ টের পাচ্ছিলাম, যতক্ষণ না আমি লিখছি যে প্রজাপতিগুলোর রঙ হলুদ, লোকে তা বিশ্বাস করবে না। এছাড়া আমি যখন রেমেদিওস সুন্দরী স্বর্গে যাচ্ছে পর্বটি লিখি, আমার অনেকটা সময় লেগেছে এটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে। একদিন আমি আমার মেহিকোর বাসার পিছনের বাগানে গেছি আর সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, যে মহিলাটি আমাদের বাসায় কাপড় ধোয়াধুয়ি করে, সে শুকোনোর জন্য ভেজা চাদর মেলে দিচ্ছিল আর চারপাশে হু হু করে বাতাস বইছিল। মহিলাটি রীতিমতো শনশনে বাতাসকে শাসিয়ে বলছিল বাতাস যেন চাদরগুলো উড়িয়ে না নেয়। তখন আমার মাথায় এল, আমি যদি চাদরগুলো রেমেদিওস সুন্দরীর জন্য ব্যবহার করি, যেটিতে করে সে স্বর্গারোহণ করবে, ব্যাপারটি তবে কেমন হয়। ঘটনাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য, আমি এভাবেই লিখেছিলাম। যে কেউ যে কোনও কিছু লিখতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত লোকে তা বিশ্বাস করবে আর এটিই হলো জাদুবাস্তবতা লেখার গোপন কৌশল।’
এ তো গেল জাদুবাস্তবতা ধারণাটি আসলে কী এবং এর লিখনশৈলীটা কী রকম―এ প্রসঙ্গ। এখন অবধারিতভাবে প্রশ্ন জাগবে মার্কেস কেন লেখার ক্ষেত্রে জাদুবাস্তবতার দিকে ঝুঁকলেন। একটু জাদুবাস্তবতার অতীত ইতিহাসে ফিরে যাওয়া যাক। ১৯২৫ সালে জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রাঞ্জ রোহ সর্বপ্রথম চিত্রকলায় Realismus Magischer বা জাদুবাস্তবতা কথাটি ব্যবহার করেন, প্রকৃতির জাদুকরী চিত্রায়নের মাধ্যমে নয়া বস্তুনিষ্ঠতা বোঝাতে। তিনি মসৃণ আলোকচিত্রগত স্পষ্টতা এবং যুক্তিবাদী জগতের ‘জাদুকরী’ প্রকৃতির চিত্রায়ন চিহ্নিত করেছিলেন, যাতে মানুষের অদ্ভুততার সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মতে, জাদুবাস্তবতা পরাবাস্তববাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এটি আলাদা। কারণ এতে বস্তুগত বস্তু এবং বিশ্বের জিনিসের প্রকৃত অস্তিত্বের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, পরাবাস্তববাদের আরও বিমূর্ত, মনস্তাত্ত্বিক এবং অবচেতন বাস্তবতার বিপরীতে। রোহের জাদুবাস্তবতা ধারণাটি ঊনবিংশ শতকের রোমান্টিক লেখকদের রূপকথা ও ছোটগল্পে, রোমান্টিসিজমের জায়গায় স্থান করে নেয়, যেটি ইউরোপীয় জাদুবাস্তবতা বলে পরিচিতি পায়, যেখানে কল্পনার জগৎ ক্রমাগতভাবে বাস্তবের জগৎ দখল করে নিচ্ছে এবং জনবহুল করে তুলছে। যাই হোক, অচিরেই সাহিত্যে এই নতুন ধারা অর্থাৎ জাদুবাস্তবতা লাতিন মুল্লুকে জনপ্রিয়তা পায় এবং এ অঞ্চলের লেখকরা লাতিন বাস্তবতার পরিপ্রক্ষিতে জাদুবাস্তবতার অবতারণা করেন। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হলেন মার্কেসের গুরু হোর্হে লুইস বোর্হেস, যার অনূদিত কাফকার মেটামরফোসিস-এর স্প্যানিশ সংস্করণ পড়ে তিনি জাদুবাস্তবতার প্রতি মোহগ্রস্ত এবং দারুণভাবে প্রভাবিত হন।
গাবোর বয়স তখন মাত্র কুড়ি। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন কলম্বিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বোগোতার এভিনিউ হিমেনেস দে কেসাদায় একটি পেনসিওন বা ছাত্রাবাসে থাকছেন যেখানে নানা কিসিমের উপকূলীয় কোস্তেনো ছাত্রদের বসবাস। টুকটাক কবিতা লিখছেন এবং তাঁর মনের গোপন বাসনা তিনি বোর্হেসের মতো লাতিন অঞ্চলের ডাকাবুকো কোনও কবি হবেন এবং তাঁর দু-চারটে কবিতাও পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। তবে সেগুলো খুব একটা জুতসই হচ্ছে না। এমন সময় গাবোর জীবনে কাফকার কিংবা বলা যায় জাদুবাস্তবতার আগমন ঘটে। কোনো এক বিকেলে তাঁর এক বন্ধু তাকে তাঁর প্রিয় কবি বোর্হেসের অনুবাদে কাফকার মেটামরফোসিস পড়তে দেন। কাফকা হাতে পেয়ে তিনি তাঁর ছাত্রাবাসের কামরায় গিয়ে জুতো খুলে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়েন। বইটির প্রথম লাইন পড়লেন, ‘এক দিন সকালে গ্রেগর সামসা, এক অস্বস্তিকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে দেখতে পায়, সে নিজের বিছানায় এক বিশাল পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।’―লাইনটি পড়ে তিনি তাজ্জব বনে যান, তাঁর কল্পনার জগৎ হঠাৎ করে যায় খুলে। তিনি সম্মোহিত হয়ে পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে নিজেকে বলেন, ‘ইশ, ওভাবেই তো আমার নানি গল্প বলতেন!’ পরবর্তীকালে প্যারিস রিভিউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বলেছেন, কাফকার মেটামরফোসিস গল্পটির অদ্ভুতুড়ে প্রথম লাইন পড়ে তাঁর মাথায় যে চিন্তাটি আসে তা হলো, ‘আরে, আমি তো বিলকুল জানতামই না যে ওভাবে কাউকে লিখতে দেওয়া হয়। যদি তা জানতামই, তাহলে অনেক আগেই লেখালেখি শুরু করে দিতাম। আর তাই সঙ্গে সঙ্গে আমিও লিখতে শুরু করে দিই।’
সে সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে তিনি লেখেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত উচ্চাকাঙ্খি প্রথম ছোটগল্প La Tercera Resignación বা ‘তৃতীয় সমর্পণ’। গল্পটি ‘এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা যে কি না নিশ্চিত নয়, সে আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিংবা হতে পারে সে জীবিত এবং মৃত―দুটোই। একজন জীবন্ত ব্যক্তি হিসেবে লোকটির নিজেকে সমাধিস্থ হবার জন্য সমর্পণ করার কথা নয়। অথচ ব্যক্তিটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। সে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না। আর তখন সে তার জীবন, এমনকি মরণেরও সবচেয়ে বড় আতঙ্কে পড়ে যায়―ওরা বুঝি তাকে জীবন্ত কবর দিতে যাচ্ছে।’ গল্পটিতে সরাসরি জাদুবাস্তবতার দেখা না মিললেও, বেশ বোঝা যায়, লেখকের চিন্তার জগতে পরিবর্তন এসেছে, যেটি তাঁকে জাদুবাস্তবতার দিকে ধাবিত করছে।
তবে মার্কেস গবেষক ও জীবনীকার জেরাল্ড মার্টিনের মতে, তিনি কাফকা পড়ে জাদুবাস্তবতায় মনোযোগ দিলেও এর শিকড় তাঁর শৈশবে প্রোথিত। ছোট্ট গাবো (মার্কেসের পারিবারিক নাম) তখন নানা কর্নেল নিকোলাস মার্কেসের সঙ্গে আরাকাতাকা গ্রামে নানাবাড়িতে থাকে। স্কুলে ভর্তি হয়েছে, বয়স নয়-দশ হবে। খেলাধুলার চাইতে বইপাঠ ও কল্পনার জগতে মগ্ন থাকতে, বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে সে। তাঁর সেই কল্পনার জগৎকে উজ্জীবিত করে একটি বই, তা হলো আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত যেটি সে একদিন ভরদুপুরে নানা যখন ব্যবসায়িক কাজে আরাকাতাকার বাইরে অন্য কোনও পুয়েব্লোতে (গ্রাম) গিয়েছেন, নানি দুপুরের খাবারের পর সিয়েস্তা দিচ্ছেন, তখন চুপিসারে তাঁর বহুদিনের শখ নানার ভারী তোরঙ্গ খুলে একটি মলাটবিহীন বই দেখতে পায় যেটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের লোককাহিনি নিয়ে কিতাব, যেটির বাস্তবতার (আরবীয় ইতিহাস, সংস্কৃতি ও তৎকালীন বাস্তব জীবনের উপাদান) পাশাপাশি জাদুকরী উপাদান (জাদুর চেরাগ, উড়ন্ত গালিচা, সিন্দবাদ নাবিক-এর অভিযান, জিনের উপস্থিতি ইত্যাদি) তাঁর শিশুমনে দাগ কাটে, তাঁকে বিমুগ্ধ করে, যার ফলে পরবর্তীকালে তাঁর গল্প-উপন্যাসে সাড়ম্বরে জাদুবাস্তবতার উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় এবং এক সময় তিনি হয়ে ওঠেন জাদুবাস্তবতার সফল রূপকার।
তবে গাবো নানা নিকোলাস মার্কেসের কল্যাণে জাদুবাস্তবতার হদিশ পেলেও, লেখার বা গল্প বলার স্বরভঙ্গি বা সুরটা তিনি কিন্তু পেয়েছিলেন নানি ত্রানকিলিনার কাছ থেকে। প্যারিস রিভিউকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটিতে তিনি বলেন―‘আমার মাথায় কিছু একটা ঘুরঘুর করছিল, যেটি আমি সবসময়ই করতে চেয়েছি, তবে সেই কিছু একটার অনুপস্থিতি আমার লেখায় ছিল এবং আমি নিশ্চিত ছিলাম না, এটি আদতে কী, যতক্ষণ না আমি একদিন আমার সঠিক লেখার সুরটি আবিষ্কার করি―সেই সুর যেটি অবশেষে আমি ব্যবহার করি নিঃসঙ্গতার একশ বছরে। এটি মূলত যেভাবে আমার নানি কিসসা কাহিনি বলতেন, সেটিকে অনুকরণ করে করা। তিনি যখন অতিপ্রাকৃত, আজগুবি বিষয় নিয়ে গল্প করতেন, ওগুলো একদম স্বাভাবিক, নির্লিপ্ত সুরে বলতেন। অবশেষে আমি যখন তাঁর সেই গল্প বলার স্বরভঙ্গিটি আবিষ্কার করি, যেটি আমি সবসময় ব্যবহার করতে চেয়েছি, তৎক্ষণাৎ আমি আঠারো মাসের জন্য লিখতে বসে যাই এবং প্রতিদিনই লিখতে থাকি। নানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি ছিল, সেটি হলো তাঁর মুখের ওপর লেপ্টে থাকা নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি। তিনি আজগুবি কিসসা বলার সময় মোটেই তাঁর অভিব্যক্তি পাল্টাতেন না, আর তা শুনে আমাদের সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। নিঃসঙ্গতার একশ বছর লেখার আগের গল্পগুলোতে জাদুবাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টায়, আমি গল্পগুলো বলার চেষ্টা করেছি সেগুলো বিশ্বাস করা ছাড়াই। আমি আবিষ্কার করেছি, আমার যা করার ছিল, তা হলো ওগুলো আগে নিজে বিশ্বাস করা এবং সেই একই অভিব্যক্তিতে লেখা, যেভাবে আমার নানি আমাদের গল্প শোনাতেন: কাষ্ঠ মুখে।’
এবার ফিরে যাওয়া যাক নিঃসঙ্গতার একশ বছরসহ মার্কেসের অন্যান্য গল্প উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার প্রসঙ্গে। নিঃসঙ্গতার একশ বছরের প্রথম অধ্যায়ে আমরা এমন এক লোকের সাক্ষাৎ পাই যে প্রথমে বুড়ো ছিল এবং এরপর আবার জোয়ান মানুষে পরিণত হয়। আমরা শুনতে পাই এক নির্ভুল ভবিষ্যতের পূর্বাহ্নে সতর্কীকরণ। আমাদের একটি মুরগির কথা বলা হয় যে ‘একশটি সোনালি ডিম পেড়েছে’ আর আমরা একটি চুম্বক অবলোকন করি যেটি কড়িকাঠ আর আসবাবপত্রে পেরেক ঠুকে স্ক্রু লাগিয়ে দেয়। পদার্থবিদ্যা এবং বাস্তবতা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ভেঙ্গেচুড়ে এক অন্য জগতের দেখা পাই। এখানে গল্পের বিষয়বস্তু তালগোল পাকিয়ে গেলেও তিনি অকপট ভাষায় বর্ণনা করছেন, যেখানে এক বিশেষ প্রকারের বরফ একটি ভূতের চেয়ে কম অথবা বেশি লক্ষণীয় হবে না, যে আপনাকে গোসলখানায় জ¦ালিয়ে মারছে, এক অন্য ভুবনের কথা বলছে যেখানে শূকরের লেজসহ মানবশিশুর জন্ম জীবনের একটি চরম সত্য বলে গ্রহণ করা হয়।
নিঃসঙ্গতার একশ বছরে নির্বিকারভাবে আজগুবি ন্যারেটিভের সবচেয়ে জনপ্রিয় উদাহরণ হচ্ছে―যখন হোসে আর্কাদিও দৃশ্যত (যদিও এটি পুরোপুরি পরিষ্কার নয়) স্নানঘরে মারা যায়, নিজের মাথায় গুলি করে। যখন গুলির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয় সারা বাড়িতে, আমাদের রক্তের এক সরু ধারার যাত্রার কথা বলা হয়, যেটি মাকোন্দো গ্রামটিতে এমনভাবে বয়ে চলে যায়, যেমনটি লোকে যান চলাচল সম্পর্কে বর্ণনায় বলে থাকে। রক্তের ধারা ‘ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির বাইরে অলিগলিতে সরলরেখায় চলে উঁচু-নিচু বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে তুর্কিদের সড়ক পেরিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে আবার আরেকবার বাঁদিকে চলে যায়।’ মজার ব্যাপার হলো গাবোর এই ‘রক্তের ধারা প্রবাহিত হবার’ জাদুটি তাঁর আপেক্ষাকৃত আধুনিক ‘তুষারে তোমার রক্তের ছোপ’ গল্পেও অবতারণা করতে দেখি। ১৯৭৬ সালে লেখা গল্পটিতে এক নববিবাহিত বধূর গোলাপের কাঁটার আঘাতে কেটে যাওয়া আঙ্গুল থেকে রক্ত তুষারে অবিরত ঝরে পড়তে থাকে মাদ্রিদ থেকে পিরেনিজ পর্বতমালা পেরিয়ে প্যারিস অবধি পুরোটা পথে। অবশ্য গল্পে মধুচন্দ্রিমা যাপনের উদ্দেশ্যে আসা বধূটির মৃত্যু ঘটে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং পরে স্বামীর দুঃস্বপ্নময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ার কারণে।
নিঃসঙ্গতার একশ বছর লেখার পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে তিনি লিখলেন আরেকটি গল্প যেখানে লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার মূল রূপটি দেখতে পাওয়া যায়। গল্পটির নাম ‘বিশাল ডানাওলা এক থুত্থুরে বুড়ো’। গল্পে দেখা যায়, তিন দিনের ঝড়বৃষ্টি শেষে পেলায়ো আবিষ্কার করে যে তার বাড়ির উঠোনে বিশাল ডানাওলা এক বুড়ো কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সে দৌড়ে তার বউ এলিসেন্দার কাছে চলে যায়―খুলিতে ধূসর কটা মাত্র চুলের গোছাসহ টেকো মাথার প্রায় দন্তবিহীন লোকটি জীবিত আছে কি না তা দেখার জন্য। প্রতিবেশী এক মহিলার সঙ্গে আলাপ করে ওরা যখন জানতে পারে যে বুড়ো আসলে একজন দেবদূত, পেলায়ো তাকে টেনেহিঁচড়ে গুনা-তারের তৈরি মুরগির খাঁচায় তালাবদ্ধ করে রাখে। ব্যাপারটা মহল্লার সকলেই জেনে যায়, আর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকাবাসী মুরগির খাঁচার সামনে গিয়ে প্রথমে দেবদূতকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠে, এরপর তারা দেখতে চায় ব্যাপারটা আসলেই অলৌকিক কিছু কি না। এদিকে স্থানীয় গির্জার পাদ্রি গনসাগা পরীক্ষা করে দেখতে চান রহস্যময় খাঁচায় আটকানো বুড়ো লোকটি সত্যিই দেবদূত কি না নাকি শয়তানি ফন্দি আঁটা কেউ। তবে তিনি বুড়োর কাছে গিয়ে লক্ষ করলেন তাকে বড্ড বেশি মানুষ বলে মনে হচ্ছে : তার গা থেকে অসহনীয় গন্ধ বের হচ্ছে, ডানার পিছন দিকে পরজীবী আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত এবং বড়বড় পালকগুলো পার্থিব আলো-হাওয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, আর তার কোনও কিছুই দেবদূতের গরিমায় মাপা যায় না। এরপর তিনি আঞ্চলিক বিশপ এবং অবশেষে রোমে মহামান্য পোপকে চিঠি পাঠান এ সংক্রান্ত চূড়ান্ত রায় দেবার জন্য। উৎসুক দর্শনার্থীদের দেখে পেলায়োর বউ উঠোনে বেড়া দেয়। ওরা মাথাপিছু পাঁচ পেসো আদায় করতে থাকে। লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ মেলা এসে উপস্থিত হয়। অবশ্য পেলায়োর পরিতাপের কোনও কারণ ছিল না। যে পরিমাণ টাকা জমেছিল, সেগুলো দিয়ে ঝুলবারান্দাসহ দোতলা অট্টালিকা গড়ে যার জানালাগুলোতে লোহার শিক আঁটা হয়, যাতে দেবদূতেরা সেখানে ঢুকতে না পারে। গল্পের শুরুতে যে নবজাতক ছিল সে এতটা বড় হয়ে যায় যে তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। রোদ আর ঝড়-বৃষ্টিতে মুরগির খাঁচাটি ধসে পড়ায় বিশাল ডানাওলা দেবদূত মরণাপন্ন পথভোলা পথিকের মতো এখানে সেখানে নিজেকে টেনে নিয়ে যান, যেটি বাড়ির গিন্নি এলিসেন্দার মনে দারুণ বিরক্তির উদ্রেক করে। ডানাওলা বুড়ো মানুষটা খেতে না পেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণায় তার ডানার শেষ পালকটা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। সেবার শীতে বুড়ো প্রচণ্ড জ¦রে প্রায় মরতে বসেছিলেন। তবে বসন্তের শুরুতেই রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে আবার তার পালক গজাতে শুরু করে। এক সকালে, এলিসেন্দা যখন দুপুরের খাবারের জন্য পেঁয়াজ কাটছিল, সে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পায় বিশাল ডানাওলা থুত্থুরে বুড়ো মানুষটা উড়াল দিয়ে দূরের ওই সাগরের দিকচক্রবালের দিকে হারিয়ে যাচ্ছেন, যেন পটে আঁকা একটা বিন্দু মাত্র।
গার্সিয়া মার্কেসের গল্পের কাহিনিটি ইতিবাচকভাবে বলা যায় বেশ সাদামাটা, নিষ্প্রভ। আর এর সমাপ্তির বর্ণনায় লক্ষণীয়ভাবে যথেষ্ট ভাবাবেগ প্রকাশের উদ্ভাবনী দক্ষতার ঘাটতি দেখতে পাওয়া যায়। জাদুকরী উপাদান সরিয়ে রাখলে গার্সিয়া মার্কেসের গল্পের কাহিনি এবং দৈবাৎক্রমে অলৌকিক বর্ণনা একঘেয়ে ক্লান্তিকর বলে মনে হতে পারে। অনেকটা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের মতো, যেন সর্বজ্ঞানী কোনও ব্যক্তি গল্পটির অদ্ভুত বয়ান দিচ্ছেন। তবে গল্পটির বিশেষ শক্তিটা আসে এর বিস্ময়কর খুাঁটিনাটি বর্ণনা থেকে যেটি ক্লান্তিকর তো নয়ই বরং স্ব-মহিমায় প্রায়শ ঝলসে উঠে। চিত্রবিচিত্র মানুষ এবং ঘটনা প্রবাহ একটার পর একটা এমনভাবে আসতে থাকে যে, এরপর কী ঘটা উচিত, পাঠক তা সবসময় অনুমান করে উঠতে পারে না―রহস্যময় জাগতিক বিষয়, নাকি জাদু, কোনটি ? ―যেটি তাকে আনমনা করে তুলতে পারে। তবে পাঠকের এই জাদুবাস্তবতার অভিজ্ঞতা ভিন্ন, এর উপাদানগুলো স্পষ্টত পৃথক করে মার্কেসকে তাঁর পূর্ববর্তী লেখকদের থেকে। কাফকা এবং অন্যরা এ ধরনের জাদুবাস্তব গল্পকাহিনি লিখলেও তাঁর মতো লক্ষ¥ীছাড়া ঔদাসীন্য দেখিয়ে এমন চমৎকার খুঁটিনাটি অবতারণা করতে পারেননি কেউ।
এছাড়া গল্পটিতে ভ্রাম্যমাণ মেলার অন্যতম আকর্ষণ এক অলৌকিক প্রদর্শনী দেখতে পাই। এক মেয়ে বাবা-মায়ের অবাধ্য হবার কারণে মাকড়সায় পরিণত হয়েছে। তার দর্শনের প্রবেশাধিকার মূল্য দেবদূতটির চেয়ে কম ছিল বলে সেখানে দর্শনার্থী লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। লোকজন তাকে তার এই কিম্ভূতকিমাকার দশা সম্পর্কে যে কোনও ধরনের প্রশ্নই করতে, এমনকি তার এই ভৌতিক অবস্থার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হবার জন্য ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবটুকুই পরখ করে দেখতে পারত। সে ছিল ভয়ানক বিষাক্ত মাকড়সা, ওর আকৃতি ছিল ভেড়ার মতো, আর মুখখানা যেন এক বিষণ্ন পরিচারিকার। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ব্যাপার তার ওই উদ্ভট আকৃতি নয়, বরং নিজের দুর্ভাগ্যের বর্ণনায় গভীর পরিতাপ। বাস্তবে শিশু থাকা অবস্থায় সে পিতামাতার অনুমতি ছাড়াই বাড়ি থেকে চুপি চুপি পালিয়ে একটি নাচের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, এবং সারারাত নাচানাচি করে যখন সে বনের ভিতর দিয়ে ফিরে আসছে, এমন সময় একটি আকস্মিক ভয়ানক বজ্রপাত আকাশটাকে চিরে দু টুকরো করে। আর সেই চেরা অংশ থেকে চলে আসা আলো ঝলকানির গন্ধক তাকে মাকড়সায় পরিণত করে। গল্পে একজন কুষ্ঠ রোগীরও দেখা মেলে, যার গায়ের দগদগে ঘায়ে সূর্যমূখী ফুলের কুঁড়ি গজিয়েছে। এই দুটো অলৌকিক জাদুবাস্তবতার উপস্থাপন মার্কেসের ‘নিষ্পাপ এরেন্দিরা ও তার নির্দয় দাদিমার অবিশ্বাস্য দুঃখের কাহিনি’, ‘বড়মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’সহ বিভিন্ন গল্প উপন্যাসিকায় দেখতে পাওয়া যায়।
‘বিশাল থুত্থুরে ডানাওলা বুড়ো’ গল্পে গার্সিয়া মার্কেস সব ধরনের প্রতীকী দৃশ্যের অবতারণা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় এবং এমনকি রূপকার্থেও ব্যবহার করতে দেখা যায়, তবে তিনি কোনও ঘটনার সহজ ব্যাখ্যা এড়িয়ে গেছেন। যদিও এই নোংরায় মাখামাখি, অসুস্থ জীবটি, সত্যিকারার্থে প্রতিদিনকার পৃথিবীর অলৌকিকতার শোভনভাবে প্রতিনিধিত্ব করে, তবে তিনি এই পৃথিবীর কারও পূর্বানুমানের সঙ্গে খাপ খান না―পাদ্রি, আবেদনকারী এমনকি পাশাপাশি যে প্রদর্শনী চলছিল তার দর্শনার্থী অবধি। এই বিবেচ্য দেবদূতটি কেবল অননুপ্রাণিত এবং অজ্ঞেয় নন, বরং খানিকটা বীভৎসও বটে। গল্পটিতে কাউকে তার সঙ্গে সফলভাবে যোগাযোগ করতে সক্ষম দেখা যায় না। তিনি যদি স্বর্গীয় কিছু বলেও থাকেন পাঠক তার একটি শব্দও বুঝে উঠতে পারে না। তিনি মনুষ্যসমাজে উড়ে এসেছেন, কিছুদিন তাদের সঙ্গে থেকেছেন এবং কোনও প্রকার ব্যাখ্যা অথবা দৃশ্যমান উদ্দেশ্য ছাড়াই প্রস্থান করেছেন। যদি গল্পটিকে প্রতীকী অর্থে পাঠ করা হয়, সকলে কেবল একটি কথাই বলতে পারবেন, ডানাওলা বুড়ো মানুষটি মূর্ত করেন এই পৃথিবীর অভেদ্য রহস্য এবং পরবর্তী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড―দুটোই। তিনি সত্যিকারার্থে নশ্বর কিংবা অতিপ্রাকৃত―যাই হোন না কেন―তিনি আমাদের বোধশক্তির বাইরে অধিষ্ঠান করেন। আমরা তার ইতিহাসের অলিখিত যবনিকা সম্পর্কে আমাদের নিজেদের অনুমান প্রদর্র্শন করতে পারি, তবে তার অস্তিত্ব সবসময় অদৃশ্য থাকে। যখন তিনি আজানা গন্তব্যে উড়াল দেন, তার সম্পর্কে, তিনি যখন প্রথম এসে পৌঁছান তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানতে পারি না।’
এমনই দুর্দান্ত সব লিখন শৈলীর মাধ্যমে মায়েস্ত্রো মার্কেস পাঠক হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন জাদুবাস্তবতার মহানায়ক হিসেবে।
তথ্যসূত্র :
১. ম্যাজিক রিয়ালিজম, উইকিপিডিয়া।
২. শন গ্লাচ, হোয়াট ইজ ম্যাজিকাল বিয়েলিজম ইন লিটারেচার ? এক্সপ্লোরিং এল রিয়ালিসমো মাখিকো, রাইটার্স.কম, ২৬ আগস্ট, ২০২৫।
৩. ডানা জিওয়া, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং জাদুবাস্তবতা, স্নাইপার লজিক, ১৯৯৮।
৪. প্যারিস রিভিউ, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, দ্য আর্ট অব ফিকশন, ১৯৮১।
৫. জেরাল্ড মার্টিন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, এ লাইফ, ২০০৮।
৬. গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস: ওয়ার্কিং ম্যাজিক উইথ ব্রিকফেসড রিয়ালিজম, দ্য গার্ডিয়ান, ৯ মে, ২০১৭।
লেখক : মার্কেস গবেষক, বহুভাষিক অনুবাদক, স্প্যানিশ ভাষা বিশেষজ্ঞ
সচিত্রকরণ : রজত