
শহরে ঢুকেই একটা সাদা মাইক্রোবাস বুনো ষাঁড়ের মতো ছুটতে শুরু করে। চালকের পাশের সিটের বাদামি সুট আর কালো চশমা পরা লোকটি এয়ারপোর্ট ছেড়ে হাইওয়েতে নেমে টানা দু ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। এখন তার মতিগতি বোঝা দায়। সে শহরের পাকা রাস্তা ছেড়ে চালককে ভাঙাচোরা গলিতে ঢুকতে বলে, এ গলি-ও গলি করে সেই পাকা সড়কেই আবার ওঠার নির্দেশ দেয়। মনে হয়, পেছন থেকে তাড়া করা দুশমনের চোখে ধুলা দেওয়ার জন্যই বারে বারে তার এই প্যাঁচখেলা। ড্রাইভিং মিরর তেরচা কি সোজা করে নেড়েচেড়ে বসিয়েও চালকের সে রকম কিছু চোখে পড়ে না। তবে অচিরেই সে পথপ্রদর্শকের খেয়ালখুশির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। ‘সাবধান সামনেই স্কুল’ সাইনবোর্ডটি যেন উন্মত্ত ষাঁড়ের দিকে ছুড়ে দেওয়া একখণ্ড লাল রুমাল―দুজনই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঠিক তখন পেছনের সিটের অদৃশ্য লোকটিকে দেখা যায়―হাত তুলে তাদের বাধা দেওয়ার নিষ্ফল ভঙ্গি করছে।
এখন দুপুর বারোটা। সবে মর্নিং-শিফটের ছুটি হয়েছে। ইউনিফর্ম পরা ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে সব রাস্তায়। সাদা মাইক্রোবাসটি তাদের চোখে ধুলা ছিটিয়ে খোলা গেট দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢোকে সামনের বাংলো প্যাটার্নের বাড়ির উঠানে।
দু বার চোখ রগড়াতেই ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়। তারা সোনালি একটা সিন্দুক মাইক্রোবাসের পেট থেকে বেরিয়ে উঠোনের ঘাসে পড়তে দেখে। তখনই দৌড়-দৌড়, ব্যাগের স্ট্র্যাপ গলায় পেঁচিয়ে, পানির বোতল মাটিতে ফেলে, একজন আরেকজনের পা মাড়িয়ে, কার আগে কে যাবে, ধুলাবালির রাস্তায় হুটোপুটি লেগে যায়। চালকসহ আরোহী দুজন ততক্ষণে গাড়ির বনেট নামিয়ে উঠানে এলোমেলো পায়চারি করছে।
বাচ্চাদের কেউ কেউ বাদামি সুট আর কালো চশমা পরা লোকটিকে দু বছর আগে বরবেশে এ বাড়িতেই দেখেছে। তাদের জ্ঞানচক্ষু অত প্রখর নয় যে, এ অবস্থায় তাকে চিনতে পারবে। তা ছাড়া সত্যি কথা বলতে কি, বাচ্চাদের নজর এখন সোনার বরন সিন্দুকটার দিকে, যা সবুজ ঘাসের বুকে দুপুরের রোদে ঝলকাচ্ছে। ওরা সিন্দুকের চারদিক ঘিরে দাঁড়ায়। ছোট ছোট আঙুল দিয়ে ছোঁয়। এর মসৃণ গায়ে পেনসিলের দাগ কাটে। বাজে কি না, টোকা দিয়ে দেখে। তাদের মধ্যের যে কজনের ইংরেজি শেখার বেজায় ঝোঁক, তারা সিন্দুকের গায়ের লেখাগুলো বানান করে পড়তে শুরু করে। ‘হিউম্যান রিমেইন্স অব লেট ফেরদৌসি বেগম ডলি’―লেখা পুরো বাক্যের ডলি শব্দের অর্থ ছাড়া তারা বাকিটা বুঝতে পারে না। এ বাড়ির ছোট মেয়েটির নাম ডলি। সে বরের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে থাকে। আর মাসে একবার করে মাকে টেলিফোন করে। বাক্যের বাকি শব্দের তাহলে অর্থ কী ? এ অবস্থায় খোঁজ পড়ে ক্লাসের ফার্স্টবয়ের।
গৃহকর্ত্রী মনোয়ারা বেগম প্রথমে উঠোনে গাড়ি ঢোকার শব্দ পান বাড়ির পেছনের রান্নাঘর থেকে। তারপর বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় তার কানে আসে। তিনি একই স্কুলে পড়ান ডে-শিফটে। এক্ষুনি তাকে বাসনের ভাত কটা নাকে-মুখে গুঁজে, সিক্সের প্রথম ক্লাস গিয়ে ধরতে হবে। এই অসময়ে কে আবার গাড়ি হাঁকিয়ে বাড়ি এলো! মনোয়ারা বেগমের জগৎ-সংসারে আছে কেবল ডলি-জলি দুই মেয়ে। বড় মেয়ে জলি গত রাতেই ঢাকা থেকে ফোন করে মায়ের খোঁজখবর নিয়েছে। দুই পুত্র ও স্বামী নিয়ে তার সংসার। তারা ভালো আছে। মনোয়ারা বেগমের প্লেটের ভাত কটা আর খাওয়া হয় না। তিনি খাবার বাসন শেষ না করে রেখে, পানির গেলাস হাতে রান্নাঘর থেকে খাবারঘর, তারপর দুটি বেডরুম অতিক্রম করে, ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে চৌকাঠে এসে দাঁড়ান। ঠিক তখন তীক্ষè চিল-চিৎকার আর কাচ ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ শুনতে পায় বাচ্চারা। এটি মরাবাড়ির কান্না, এ শব্দের সঙ্গে তারা কমবেশি পরিচিত। কিন্তু একটি সাদা মাইক্রোবাস, তিনজন পুরুষ আর ঝকঝকে সিন্দুকটির সঙ্গে ম্যাজিক নয়, মৃত্যুর মতো অপ্রিয় বিষয় যে জড়িয়ে আছে, তা তাদের ধারণাতীত। আনন্দ থেকে বিষাদের আকস্মিক এই পট পরিবর্তনে মূল্যবান সিন্দুকটি শববাহী কফিনে রূপান্তরিত হয় এবং উঠোনে বাচ্চাদের আর কোনও ভূমিকা থাকে না। তাদের সরিয়ে সেখানে জায়গা নেয় ডে-শিফটের অপেক্ষাকৃত বড় ছাত্রছাত্রীরা, স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ, আইসক্রিমঅলা, আয়া, দপ্তরি, কেরানি আর আশপাশের বাড়ির লোকজন। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে বাদামি সুট আর কালো চশমাধারী লোকটাকে নিয়ে সাদা মাইক্রোবাস হর্ন বাজাতে বাজাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। গাড়ির পেছনের অদৃশ্য লোকটি উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে ঘটনার পূর্বাপর ব্যাখ্যা করার জন্য।
মনোয়ারা বেগম অজ্ঞান হয়ে ঘরের চৌকাঠে পড়ে গেলে লোকজন ধরাধরি করে তাকে বিছানায় নিয়ে শোওয়ায়। পানি আনতে ছোটে স্কুলের আয়া সফুরা। হাতপাখার খোঁজে দুজন শিক্ষয়িত্রী তোরঙ্গের লেপ-কম্বল লণ্ডভণ্ড করেন। মনোয়ারা বেগম একা মানুষ। সামনে তার পাহাড়সমান দায়িত্ব। চোখে-মুখে জলের ঝাপ্টা দিতেই তিনি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন। ‘কই আমার সোনামানিক কই’ বলে তিনি স্বপ্নাবিষ্টের মতো ছুটে যান উঠানে পড়ে থাকা কফিনটার দিকে। উঠানে তখন গাড়ির পেছনের অদৃশ্য লোকটাকে ছেঁকে ধরে জনতা উপর্যুপরি প্রশ্নের হুল ফোটাচ্ছে। তাদের চাকের ভেতর লোকটি একা, ভয়ে আধমরা। মনোয়ারা বেগমের কানে সেসব সওয়াল-জবাব একবর্ণও ঢোকে না। তিনি ডলি-জলি দু মেয়ের নাম ধরে কফিন জড়িয়ে বিলাপ শুরু করেন। মর্নিং-শিফটের যে তিনজন ছাত্র তখনও ঘটনাস্থলে ছিল, তারা তাতে অস্বস্তিবোধ করে। কফিনের ভেতর জলি নয়, শুধু ডলি আছে―একবার ভাবে ছুটে গিয়ে মনোয়ারা বেগমকে খবরটা বলে আসবে। বড় একটা চমকের আশায় সেই ইচ্ছা ওরা দমন করে। কারণ ওরা জানে যে, ম্যাজিক ছাড়া বন্ধ সিন্দুকের ভেতর মানুষ বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। সেখানে বাদামি সুট আর কালো চশমা পরা লোকটি ডলিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে গেছে। তার ফেরার পর ডালা খুলে মেয়েটির গাত্রোত্থান তাক লাগিয়ে দেবে সবাইকে। ডলি উচ্চতায় বম্বের নায়িকা সুস্মিতা সেনের সমান। বিয়ের দিনের সাদা বেনারসি পরে, দর্শকদের করতালির মধ্য দিয়ে সে লম্বা ঠ্যাং তুলে সিন্দুক থেকে নেমে আসবে। মর্নিং-শিফটের তিনজন ছাত্র ম্যাজিক দেখার জন্য প্রস্তুত হয়।
জনতা ততক্ষণে জেনে গেছে, জলি না ডলিরই লাশ এই কফিনে। সে সিঙ্গাপুরের বারোতলা ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। ‘আত্মহত্যাই যে করছে, ঠ্যালা দিয়া যে ফালাই দেয় নাই, এর প্রমাণ কী ?’ জনতা গাড়ির পেছনের অদৃশ্য লোকটির কাছে জানতে চায়। সে তাদের কোনও প্রমাণ দেখাতে পারে না। খালি মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, ‘ঠ্যালা দেয় নাই, আত্মহত্যাই করছে, দয়া করে আমারে বিশ্বাস করেন!’
মনোয়ারা বেগমের বিলাপের পর্বও সংক্ষিপ্ত হয়। তিনি ভেজা চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এদিক-ওদিক কী যেন খোঁজেন। জনতা তাকে অনুসরণ করে। তিনি হঠাৎ রুক্ষ কণ্ঠে তাদের শুধান, ‘জামাই কই ?’ যে শিক্ষয়িত্রীরা, প্রতিবেশী মহিলারা এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে, তিনি বিলাপ করে করে মন হালকা করছেন, এবার তারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে―হায় হায়, মা কি মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গেল ?
কিন্তু মনোয়ারা বেগম পাগল হন নাই। অজ্ঞান হয়ে চৌকাঠে পড়ার আগে বাদামি সুট আর কালো চশমাধারী ডলির স্বামী রুস্তমকে ঠিকই তিনি উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। বাড়িভর্তি সব লোক কি কানা ? এবার তিনি উঠান কাঁপিয়ে হাঁক ছাড়েন, ‘আজরাইলডা পলাইছে! তোমরা এতগুলান মানুষ তারে ধরতে পারলা না ? যে আমার তরতাজা মেয়ের জান কবজ করল, হে আমার বাড়ির উঠান থিকা পলাইয়া যায়, তারে তোমরা ধরতে পারলা না―এতগুলান মানুষ!’
এতগুলো মানুষ! মনোয়ারা বেগম জনতার পিণ্ডটিতে যেন ঢিল ছুড়েছেন। তারা নড়েচড়ে উঠে পাশের জনের দিকে তাকায়। সত্যি তো এতগুলো মানুষ, নানা কিসিমের, দৌড়ঝাঁপ করে উঠানে এসে দলা পাকিয়েছে, কাজের কাজ কিছুই করেনি। না হলে তাদের চোখে ধূলিপড়া দিয়ে আজরাইলটা অবাধে পালাতে পারে!
ডলির স্বামী শুধু তাদের চোখে ধূলিপড়া দেয় নাই, স্মৃতির ওপর বিস্মরণের দেয়ালও তুলে দিয়ে গেছে। তারা তাকে মনোয়ারা বেগমের বাড়ির উঠানে দেখেছে কি না, তা-ও মনে করতে পারে না। অন্যদিকে মর্নিং-শিফটের তিনজন ছাত্র বাদামি সুট পরা কালো চশমাধারীকে চেনে, সে ডলির স্বামী কি রুস্তম কি আজরাইল যা-ই হোক, আসলে একজন জাদুকর। জাদুকরের প্রতীক্ষায় তাদের একজন বাড়ির পাঁচিলে উঠে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসে, বাকি দুজন বসে উঠানের ধারের পেয়ারাগাছের ডালে।
জনতা রুস্তমকে তাদের স্মৃতির ভেতর বা চোখের সামনে না পেয়ে একযোগে তাড়া করে গাড়ির পেছনের অদৃশ্য লোকটিকে। মনোয়ারা বেগম হাত তুলে বাধা দেন। তিনি দারোগার মেয়ে, উকিলের স্ত্রী। জানেন, এ অবস্থায় কী করতে হয়। মেয়ে গেছে, শত মাথা কুটলেও আর ফিরবে না। তিনি মা, ডলির বাবা নেই, ভাই নেই, জীবন শুরু না হতেই মেয়ে কেন ঝরে গেল, এর সন্ধান মাকেই করতে হবে। তিনি স্কুলের পৌরনীতির শিক্ষকের সঙ্গে পাড়ার দুটি ছেলেকে পাঠান থানায়। আর জন চারেক ষণ্ডামার্কা লোককে রুস্তমের বাসা কান্দিরপাড়ে যেতে বলেন। তিনি তাদের নির্দেশ দেন, ‘আজরাইল অহনতরি দেশে আছে না পলাইছে, গিয়া দেখো। পাইলে আটকাইবা। পুলিশ গিয়া বাইন্ধা আনব।’
থানায় যায় শুধু পাড়ার ছেলে দুটি। পৌরনীতির শিক্ষক থানার গেট থেকে ‘বাগিচাগাঁও আমার এড্ডু কাজ আছে’ বলে সটকে পড়ে। এদিকে ওই চারজনের নেতৃত্বে মনোয়ারা বেগমের উঠান ঝেঁটিয়ে জনতার বিশাল মিছিল হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় নেমে তারা রুস্তমের ফাঁসি চাই স্লোগান দেয়। দীপিকা সিনেমা হলে তখন ‘স্বামী কেন আসামি’ মাসব্যাপী চলছিল। সিনেমার বিশাল হোর্ডিং কাঁধে করে মেটিনি শোর দর্শকেরা তাদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দেয়। কান্দিরপাড় ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে মিছিলের মাথা যখন রানীরদিঘির দিকে মোড় নেয়, তখন এর লেজটা ছিল পুলিশ লাইনের সামনে। এত লম্বা সর্পিল মিছিল শহরের লোকজন স্মরণাতীতকালে দেখে নাই। এমনকি ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময়ও না। এ খবর পরদিন সব কটা স্থানীয় কাগজে সচিত্র ছাপা হয়।
মনোয়ারা বেগমের বাড়ির উঠানে থাকে শুধু মেয়েরা আর গাড়ির পেছনের অদৃশ্য লোকটি। মর্নিং-শিফটের তিনজন ছাত্র তখনও যে যার জায়গায়। তবে পাঁচিলে বসা ছাত্রটির পায়ে ঝিঁঝি ধরায় সে পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে টানাটানি করছিল। আর পেয়ারা গাছের দুজন ছাত্রকে বিষ-পিঁপড়ের কামড় খেয়ে এরই মধ্যে দুবার ডাল বদল করতে হয়েছে।
পুরুষেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে গাড়ির পেছনের অদৃশ্য লোকটি কলকলিয়ে ওঠে। এখন মেয়েরা তার শ্রোতা। হয়তো ভাবে যে, সে যা বলবে, তারা তা বিশ্বাস করবে। আর বিশ্বাস যদি না-ও করে, মেয়েরা হিংস্র পুরুষগুলোর মতো নাকে-মুখে কিলঘুসি মারবে না। সে মেয়েদের বলে, সে রুস্তমের আত্মীয় না, বন্ধু না, তবে ঘটনাচক্রে তার নাম সোহরাব। সিঙ্গাপুর সে জীবনে যায় নাই, আর যেতে পারবে বলেও মনে করে না। কারণ রুস্তমের ওপর তার যাওয়া না-যাওয়া নির্ভর করছে। এখন শিকে ছিঁড়ে বিড়ালের মুখে পড়বে কি, যে ইঁদুর শিকে ছিঁড়বে তারই তো নাই হওয়ার জোগাড়।
লোকটার হেঁয়ালি কথাবার্তা পেয়ারাগাছে বসা ছাত্র দুটির ভালো লাগে না। একে তো বিষপিঁপড়ের কামড়, তার ওপর বেলা গড়িয়ে এখন বিকাল, সকাল দশটার টিফিনের পর পেটে দানাপানি কিছু পড়ে নাই। জাদুকর আসছে না যখন, কচকচানি বাদ দিয়ে তার সহকারী সিন্দুকের ডালা খুললেই তো পারে! তাকে কথাটা বলার জন্য বাচ্চা দুটি পায়ে পায়ে গাছ থেকে নেমে আসে।
সোহরাব তখন ‘আপনে আমার মা, আপনে আমারে বাঁচান’ বলে মনোয়ারা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে চেঁচাতে শুরু করেছে। মেয়েরা টেনে-হিঁচড়ে মনোয়ারা বেগমের পা থেকে সোহরাবকে ছাড়ায়। তারপর ধমক-ধামক দিয়ে ফের জেরা শুরু করে।
মর্নিং-শিফটের ছাত্র দুটির পেয়ারাগাছ থেকে নেমে পড়াটা ছিল স্বর্গ থেকে পতন। ম্যাজিকের ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে তারা বেইনসাফের দুনিয়ায় প্রবেশ করে রাতারাতি এর ভাবাদর্শের ধারক-বাহক হয়ে ওঠে। প্রথম মাটিতে নেমে তারা আশাহত হয় এই দেখে যে, সোহরাব লোকটা ছিঁচকাঁদুনে, বিদেশ যাওয়ার ধান্দায় আছে এবং জাদুটাদু কিচ্ছু জানে না। তুচ্ছজ্ঞানে তারা হয়তো সোহরাবকে ভুলেই যেত, কিন্তু ভোলে না এই জন্য যে, ‘বাচ্চা হয় না বলে ডলি আত্মহত্যা করেছে,’―এই সংবাদটি সোহরাবের কাছ থেকে ততক্ষণে তাদের কাছে চলে আসে। সারা দুপুর বিষপিঁপড়ের কামড় খেয়ে, খিদা পেটে তারা তা শোনামাত্র বিশ্বাসও করে। তারপর এই একই বুলি, পরীক্ষার পড়া তৈরি করার মতো তারা আওড়ে যেতে থাকে দিনের পর দিন। যেন তাদের পুরুষ হওয়া নির্ভর করছে, এই তথ্যটি মনে রাখা অথবা ভুলে না-যাওয়ার ওপর। শহরের যে শিশুরা আগামী পনেরো-কুড়ি বছর পর পুরুষ হবে, পেয়ারা গাছ থেকে নেমে আসা ছেলে দুটি হয়ে দাঁড়ায় এ ব্যাপারে তাদের দীক্ষাগুরু। ঘটনাচক্রে তাদের দল থেকে বাদ পড়ে মর্নিং-শিফটের তৃতীয় ছাত্রটি, যে পাঁচিলের ওপর পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসে সারা দুপুর ম্যাজিক দেখার অপেক্ষায় ছিল।
পুলিশ আসার পর, তৃতীয় ছাত্রটি পাঁচিল থেকে মনোয়ারা বেগমের বাড়ির উঠানে লাফিয়ে পড়ে। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির জন্য পুলিশের নির্দেশে চারজন লোক তখন কফিনটিকে ধরাধরি করে ঘরের ভেতর নিয়ে যাচ্ছিল। সে আগেভাগে ঘরে ঢুকে টেবিলের তলায় লুকোয়। কফিনের ডালা খুলে ডলির চাচাতো ভাই যখন কাঁপা কাঁপা হাতে কাফনের কাপড় সরায়, তখন পুলিশ যে তাকে বলে, ‘কী ভাই, আপনার পারকিনসন রোগ আছে নাকি, হাত কাঁপে কা ?’ এই পর্যন্তই তৃতীয় ছাত্রটি শোনে এবং কফিনের ভেতর ডলি কি সুস্মিতা সেন কাউকেই সে দেখতে পায় না। সে দেখে―ডান কানের ওপর দিয়ে মাথার খুলি বরাবর বাঁ কান পর্যন্ত লম্বা একখানা সেলাই, ভাঙা নাক, চোখের জায়গায় দুটি গর্ত আর একপাটি দাঁত মাড়িসুদ্ধ চিবুকের পাশ দিয়ে ঝুলছে। তখনই হত্যাকারী পুরুষ আর হত নারী―আট বছরের শিশুটির পৃথিবী এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না, এ অবস্থায় ছেলেশিশু হিসেবে তার জায়গা কোথায়। বিষয়টি তাকে বিষণ্ন করে, যন্ত্রণা দেয়। পেয়ারাগাছ থেকে নেমে আসা ছাত্র দুজন তার মাথায় গাট্টা মেরেও, মেয়েরা বাচ্চা না হলে আত্মহত্যা করে―কথাটা বোঝাতে পারে না। কালক্রমে পুরুষের দুনিয়া তাকে ভাবাবেগে আক্রান্ত, আরোগ্যের অতীত, মাইয়্যামানুষ আখ্যা দিয়ে খারিজ করে দেয়।
ডলির আত্মহত্যার সংবাদ মাথায় পুরে, ঠোঁটে লয়ে পেয়ারাগাছ থেকে নেমে আসা ক্ষুধার্ত ছাত্র দুটি মনোয়ারা বেগমের বাড়ি থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে যায়। পথেই তারা সোনালি ব্যাংকের অফিসার তাহমিনা রহমানকে এদিকে হেঁটে আসতে দেখে। তাহমিনার প্রথম বিয়ে ভেঙে গেছে আট বছর আগে, সে দ্বিতীয় বিয়ে করে না এজন্য যে, তা ভেঙে গেলে তাকে যে আবার বিয়ে করতে হবে, সেটি হবে তার তৃতীয় বিবাহ। ছাত্র দুটি ভাবে, আজ হোক, কাল হোক তাহমিনা আত্মহত্যা করবেই। কারণ তার বাচ্চা নাই। তারা তাদের সদ্যলব্ধ জ্ঞান ফলে ওঠার অপেক্ষায় সেদিন থেকে তক্কে তক্কে থাকে।
তাহমিনা যখন মনোয়ারা বেগমের বাড়ির উঠানে ঢোকে, তার আগেই পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে আবার পোস্টমর্টেম করার জন্য ডলির লাশ সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে গেছে। এই ডামাডোলের ভেতর সোহরাব ফাঁক বুঝে ভেগে পড়ে। আর রুস্তমকে ধরে আনতে যাওয়া লোকগুলোর কোনও খবর থাকে না।
রুস্তমের বাসা কান্দিরপাড়―জনতার শুধু এটুকুই জানা ছিল। সম্পূর্ণ ঠিকানার অভাবে তারা রানীরদিঘির বাঁধানো পাড় ধরে ঘুরতে শুরু করে। ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়। অথচ কে নেতৃত্ব দিচ্ছে, মিছিলের লেজ-মাথা এক হয়ে যাওয়ায় তারা তাকে শনাক্ত করতে পারে না। এই সুযোগে, বাচ্চা হয় না বলে ডলি আত্মহত্যা করেছে―কারা যেন রানীরদিঘির চারপাড়ে তা রটিয়ে দেয়। আর তখনই চতুর্ভুজ মিছিলটি নড়াচড়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পুলিশের লাঠিচার্জ কি কাঁদানে গ্যাস ছাড়া, পরদিন সব কটি স্থানীয় কাগজ শহরের লোকজনের বরাত দিয়ে ছাপে যে, এত বড় সম্ভাবনাময় একটি মিছিল যেন চড়ায় আটকে পড়া বহতা নদী, এভাবে মৃত্যুবরণ করতে তারা আগে কখনও দেখে নাই। এসব বিস্তারিত খবরের শিরোনাম ‘সিঙ্গাপুরে নিঃসন্তান গৃহবধূর আত্মহত্যা’ লেখা হয়।
খবরটা মনোয়ারা বেগম আর তাহমিনাই শুধু বিশ্বাস করে না। তাদের দুজনের মতও আবার ভিন্ন। মনোয়ারা বেগম আগাগোড়াই মনে করেন, ডলি আত্মহত্যা করতে পারে না, সে খুনই হয়েছে। তিনি দশ মাস দশ দিন তাকে পেটে ধরেছেন, মেয়ের নাড়িনক্ষত্র সব তার জানা। ডলি আত্মহত্যা করেছে কি খুন হয়েছে, তাহমিনা এ প্রশ্নে একদম চুপ। নিঃসন্তান যে, সন্তান নাই যেহেতু তা তো বোঝাই যায়। তবে তার জন্য রুস্তমকেই সে মনে মনে দায়ী করে। জনসমক্ষে বলার উপায় নেই। কারণ ডলির গা ছুঁয়ে কিরা কেটে তাকে বলতে হয়েছিল, এ কথা পৃথিবীর দ্বিতীয় কাউকে জীবনে সে বলবে না।
খবরের কাগজ মোচড়াতে-মোচড়াতে তাহমিনা হাঁসফাঁস করে। তার গলায় কথার ডেলা, সে না-পারে তা গিলতে, না-পারে উগরে দিতে। সে ভাবে, মানুষ মরলে পর গা ছুঁয়ে কিরা কাটার গুণ বলবৎ থাকে কি না ? তার আফসোস যে, ব্যাংক ছুটির পর মনোয়ারা বেগমের বাড়ি গিয়ে গতকাল সে ডলির মরা মুখ দেখতে পায়নি। বারোতলা ভবন থেকে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়লে মানুষের মুখ দেখতে কেমন হয়, তাও সে জানে না। সে মনোয়ারা বেগমের বাড়ি হয়ে অফিস যাওয়ার জন্য সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়।
মর্নিং-শিফটের ছাত্র দুটি তাহমিনা রহমানকে দূর থেকে আসতে দেখে পা টেপাটিপি করে। তারা দুজনেই জানে, এখন তাদের কী বলতে হবে। ‘এই আপনের বাচ্চা হয় না ক্যান ? আপনে কি আত্মহত্যা করবেন ?’ তাহমিনা পেছন ফিরে তাকায়। ছোট ছোট ছেলেরা কাকে বলছে এ কথাগুলো! ততক্ষণে ভোঁ-দৌড়, দুজনেই একসঙ্গে পালায়।
বাচ্চাদের এসব কথার মানে কী, তাহমিনা বুঝতে পারে না। তবে এ ঘটনায় তার খুব মন খারাপ হয়। সে মনোয়ারা বেগমের বাড়ি না গিয়ে অফিসের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
সোনালি ব্যাংকের দরজায় কানের লতিভর্তি গোল গোল দুলের মতো অনেকগুলো তালা ঝুলছে। অফিস টাইমের আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। তাহমিনা ব্যাংকের বারান্দায় কাঠের লম্বা বেঞ্চিতে বসে। বাচ্চা দুটির কথা ভুলে গিয়ে তার তখন ডলির চেহারা মনে পড়ে। ডলি দুপুরে এসডিপিএসের টাকা জমা দিয়ে তার জন্য বিকেল পর্যন্ত এই লম্বা বেঞ্চিটায় বসে অপেক্ষা করত। সামনের রাস্তা, যানবাহন কি রাস্তার উল্টো পাশের বাড়ির ছাদ, ছাদের তারে মেলা রঙিন কাপড়, সেসবের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সে কিছুই দেখতে পেত না। সে তখন একজন মানুষ খুঁজছিল, যার সঙ্গে কথা বলে মনের ভার হালকা করবে।
ডলি সে সময় নিজের ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা দেহটাকে পুরুষ টানতে অক্ষম, আকর্ষণহীন ভাবতে শুরু করে। তা ছাড়া, রুস্তমের উদাসীন নিষ্ঠুরতার আর কোনও কারণ সে খুঁজে পায় না। বিয়ের এক মাসের মাথায় সিঙ্গাপুর ফিরে গিয়ে রুস্তম ডলির সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। কেন, কী তার দোষ, কী বৃত্তান্ত, সে চিঠি লিখে বা ফোন করেও জানায় না। মাস ছয়েক রুস্তমের চিঠি আর ফোনের অপেক্ষা করে ডলি দুটি টিউশনি নেয় আর সোনালি ব্যাংকে পাঁচ বছর মেয়াদি এসডিপিএস খোলে। ও হয়তো সে সময় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথাই ভাবছিল। আর প্রস্তুত হচ্ছিল নিজের অকম্মা লম্বা দেহটাকে নিয়ে বাকি জীবন একা থাকার। কিন্তু নারীত্বের অবমাননা দিনে দিনে ছাদের তারে মেলা রঙিন শাড়ির মতো ফুলে উঠতে শুরু করে। যদিও সে চোখের সামনের শাড়িগুলোর বাতাসে ফুলে ওঠা তাকিয়ে থেকেও দেখতে পায় না। সে শুধু বঙ্গোপসাগরের নিঃসীম ধু ধু জল দেখে। আর দেখে ঢেউয়ের গায়ে ঢেউয়ের প্রবল অনুরাগে আছড়ে পড়া। কানে শোনে শোঁ শোঁ গর্জন। আর ভাবে, এই দৃশ্য এই শব্দ পেরিয়ে কতদূর সিঙ্গাপুর!
ডলির সমুদ্রময় দৃষ্টির সামনে দুবার বৃত্তাকারে আঙুল ঘুরিয়ে তাহমিনা বলে, ‘কি, বাসায় যাও নাই ? দুপুর থাইক্যা বেঞ্চে বইস্যা আছ!’ ডলি তখন কেন বাসায় ফিরতে চায় না, সে কথা বলে। তার মা আর বোন সারাক্ষণ খোঁটা দেয়, কথা শোনায়। বিয়ের পর বাপের বাড়ি মেয়েদের আর নিজের থাকে না, মা-বোনও পর হয়ে যায়―এমন কথাও সে তখন বলে।
৫ ফুট ৮ ইঞ্চি ডলির পাশাপাশি ৫ ফুট উচ্চতার তাহমিনার হেঁটে বাড়ি ফিরতে অস্বস্তি লাগে। সে ভাবে, ডলি হয়তো তার বাসায় সাবলেট থাকতে চায়। মুখ ফুটে বলতে পারে না, তাই ঘুরেফিরে বারবার আসে। এসে লম্বা বেঞ্চিতে বসে সারা দুপুর তার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু ডলি তাহমিনাকে তার এক মাসের দাম্পত্যজীবনের কাহিনি শোনায়। সে আধাআধি বলে, গোপন করে। গোপন করে, আবার আধাআধি বলে। এভাবে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে এক বৃষ্টিধোয়া অপরাহ্ণে তাহমিনার বাসার বারান্দার ফুলের টবের মাঝখানে তাহমিনাকে গা ছুঁয়ে কিরা কাটিয়ে বলে যে, সে এখনও ভার্জিন। রুস্তম তার সঙ্গে এক বিছানায় শোয় নাই। ‘ইস, ক্যামন বেঢপ লম্বা! মেয়েমানুষ কখনও এমুন হয় ?’ বলতে বলতে সোফা সরিয়ে কার্পেট টেনে নিজের জন্য আলাদা বিছানা পাতে রুস্তম।
এ কথা মনোয়ারা বেগমের জানা ছিল না। আঠারো মাস পর রুস্তম ডলিকে সিঙ্গাপুর যাওয়ার টিকিট পাঠালে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। মেয়েটা না-খেয়ে, না-ঘুমিয়ে চোখের সামনে পাতলা তক্তা হয়ে যাচ্ছে। সে খেতে বসে বলে, ‘মা আমার রুচি নাই, সব নোনতা লাগে।’ রাতে চোখের পাতা এক হয় না, সে শুধু সমুদ্দুর দেখে, সমুদ্রের একঘেয়ে গর্জন শুনতে শুনতে তার মাথা ধরে যায়। শেষের দিকে এমন হয় যে, মনোয়ারা বেগমও ভাত-তরকারিতে নোনতা স্বাদ পেতে শুরু করেন। দিনরাত সমুদ্র দেখেন। সমুদ্রের গর্জন শুনে শুনে তারও মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। এরকম সময়, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের টিকিট পাঠানো রুস্তমকে, মা-মেয়ে যে অকূল দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছিল, তা থেকে উদ্ধারকারী ফেরেশতা বলে মনে হয়। মনোয়ারা বেগমের চোখের সামনে থেকে সমুদ্র সরে দাঁড়ায়। তিনি তটরেখা আবিষ্কারের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। ডলি তখন হঠাৎ কুঁজো হতে শুরু করে। সে ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতা দেহের ভাঁজে ভাঁজে লুকোতে চাইছিল, যাতে নিজের দেহের ভেতর আশ্রয় দিতে পারে স্বামী পরিত্যক্ত দেহটাকে। মনোয়ারা বেগম অবাক হন। ছোটবেলা থেকেই ডলি ডানপিটে। গাছে চড়া, দৌড়-ঝাঁপ করা, ঘরের টিনের চাল থেকে পিছলে নেমে গাছ বেয়ে উঠানে লাফিয়ে পড়া―বড় হওয়ার পরও তার প্রিয় খেলা ছিল। তিনি হঠাৎ-কুঁজো-হওয়া মেয়েকে জিমনেসিয়ামে গিয়ে শরীরচর্চার পরামর্শ দেন। তা যদি করতে না চায় তো, বাড়ির সামনের উঠানে সে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে-ঘুরে দৌড়াতে পারে। মেয়ে কিছুই করে না। যাওয়ার আগের দিন সে শুধু শরীরের সব বাড়তি লোম বিউটি পারলার থেকে খসিয়ে আসে। মনোয়ারা বেগম আর জলি তাকে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। তারা শেষবারের মতো তাকে নিরাপত্তা-বেষ্টনীর ভেতর ঢুকে পড়তে দেখেন যারপরনাই কুঁজো হয়ে।
ডলির এই কুঁজো হয়ে নিরাপত্তা-বেষ্টনীতে ঢুকে পড়াটা তাহমিনার মনে হয়, বারোতলা ভবন থেকে ঝাঁপ দেয়ারই পূর্বপ্রস্তুতি। তখন সে হাত দুটি ডানার মতো গুটিয়ে রেখেছিল। পাঁচ মাস পর সে দু হাত সোজা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবশ্য যদি খুন না-হয়ে সে আত্মহত্যা করে থাকে।
পোস্টমর্টেম করে খুনের কোনও আলামত পাওয়া যায় না। বারোতলা থেকে পড়ে ডলির মৃত্যু হয়েছে এবং সে ভার্জিন ছিল―এ তথ্য রিপোর্টে আসে। পরদিন স্থানীয় কাগজে পুরো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছক করে ছাপা হলেও ‘নিঃসন্তান গৃহবধূর সিঙ্গাপুরে আত্মহত্যা’ শিরোনামের কোনও বদল হয় না। ফলে মনোয়ারা বেগম ও তাহমিনা ছাড়া শহরের বাকি লোকজন তাদের আগের ধারণায় অটল থাকে।
তাহমিনা পাঠককে বিভ্রান্ত করার অভিযোগ এনে কাগজে প্রতিক্রিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে মনে করে, কিরা কাটার জন্য ডলির যে-কথা তাকে গোপন রাখতে হচ্ছে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টের সূত্রে কাগজগুলো তা প্রকাশ করতে পারে। এতে করে মৃত ডলি নিঃসন্তানের অপবাদ থেকে রেহাই না পেলেও শহরের লোকগুলো অন্তত আসল কারণ জানতে পারবে। তা ছাড়া পাঠককে সত্য জানানো পত্রপত্রিকার অবশ্যই কর্তব্য।
সেদিনও মনোয়ারা বেগমের বাড়ি হয়ে ব্যাংকে যাওয়ার জন্য তাহমিনা সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়। সে নির্বিঘ্নে সেখানে পৌঁছে জলির ছেলে দুটিকে বাড়ির উঠানে ঘোড়া ঘোড়া খেলতে দেখে। জলি তাকে জানায়, মনোয়ারা বেগম পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়ে থানায় গেছেন।
মর্নিং-শিফটের ছাত্ররা তাহমিনার অপেক্ষায় বাড়ির গেটে জড়ো হয়। এবার তারা দুজন নয়, সংখ্যায় অনেক।
মনোয়ারা বেগমের বাড়ি থেকে তাহমিনা বেরিয়ে এলে তারা বলে, ‘আপনের বাচ্চা হয় না ক্যান, আপনে কি আত্মহত্যা করবেন ?’ এবার তারা কথাটা বলেই পালিয়ে যায় না। জায়গায় দাঁড়িয়ে বারবার একই প্রশ্ন করতে থাকে। তখন ঘোড়া ঘোড়া খেলা ছেড়ে ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা জলির ছেলে দুটিও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাহমিনা ভয় পেয়ে যায়। সামনে একটা খালি রিকশা পেয়ে এক দৌড়ে সে উঠে পড়ে।
তাহমিনা ভেবে অবাক হয়, কী করে যেন ডলির পরিণতির সঙ্গে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। মর্নিং-শিফটের বাচ্চাগুলো ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা ডলির সঙ্গে ৫ ফুট উচ্চতার তাহমিনাকে ধর্মসাগরের পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখেছিল কি ? এমন বিসদৃশ দৃশ্য কারও চোখ এড়ানোর কথা নয়। তা ছাড়া অন্য কোনও কারণ সে খুঁজে পায় না। এ শহরে তাহমিনা এসেছে চাকরির সূত্রে। ডলি সোনালি ব্যাংকে এসডিপিএস না খুললে এই মৃত মেয়েটির সঙ্গে তার কোনওদিন দেখাই হতো না। ভয়ে তাহমিনার বুক শুকিয়ে যায়। এই অনাত্মীয় শহরটিতে সে একা ঘর ভাড়া করে থাকে। বাচ্চাগুলো যদি এভাবে উত্ত্যক্ত করে, সে এখানে তিষ্ঠাবে কেমন করে। তার তো যাওয়ারও কোনও জায়গা নেই। তাহমিনা রিকশায় বসেই কাগজে প্রতিক্রিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয় এবং ঠিক করে যে, সে মনোয়ারা বেগমের বাড়ির দিকে আর কখনও যাবে না।
থানায় মনোয়ারা বেগমকে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা থেকে কিছুতেই নাড়ানো যায় না। তিনি হত্যা মামলাই করবেন। তদন্ত অফিসার বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গিয়ে ছোট দারোগাকে পাঠিয়ে দেয়। সে বয়সে তরুণ―এখনও বাদির অর্থহীন আবদার শোনার ধৈর্য বা ইচ্ছা পুরোপুরি লুপ্ত হয় নাই। তার বক্তব্য হলো, খুনের কোনও ক্লু নাই। ময়নাতদন্তেও এমন কোনও আলামত পাওয়া যায় নাই, যার ভিত্তিতে তিনি হত্যা মামলা দায়ের করতে পারেন। ‘কিন্তু আমার মেয়ে আত্মহত্যা করবে কেন ?’ মনোয়ারা বেগম তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন। ছোট দারোগা তার জবাবে বলতে চেয়েও বলে না যে, বিয়ের দু বছর পর ভার্জিন থাকাটা কি একজন মেয়ের আত্মহত্যার কারণ হতে পারে না! ছোট দারোগা তা বলে না, কারণ এটি সমগ্র পুরুষ জাতির কলঙ্ক বলে তার মনে হয়। সবশেষে হাতের লাঠি নিয়ে খেলতে খেলতে সে মনোয়ারা বেগমকে আশ্বাস দেয়―ঘটনাস্থল বাংলাদেশ নয়, সিঙ্গাপুর; খুনের কোনও আলামত সেখানে আছে কি না, তারা ইন্টারপোলে খোঁজ নিয়ে দেখবে।
মনোয়ারা বেগম বাড়ি ফিরে ইন্টারপোলের চিঠির অপেক্ষায় থাকেন। জলির ছেলে দুটি ঘোড়া ঘোড়া খেলতে খেলতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। পরের দিকে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো দু ভাই ডলির আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। জলি ভয় পেয়ে তাদের নিয়ে ঢাকা ফিরে যায়। মনোয়ারা বেগম স্কুলে পড়ানোর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। সাগরের শোঁ শোঁ গর্জন শুনে মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে গ্লাসভরে নোনা পানি পান করেন। বিছানায় ফিরে পরের দিন কখন কোথায় যাবেন, তা ছকে ফেলেন। সেই মতো সকাল সকাল বেরিয়ে প্রথম যান থানায়। দুপুরে এসপির অফিস। বিকেলে এমপির বাসা। এসপির আবার গ্যাসট্রাইটিস। বাসায় লাঞ্চ করে। মনোয়ারা বেগম এসপির বাংলোর সামনের কাঠগোলাপ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দুপুরবেলাটা কাটিয়ে দেন। উর্দিপরা দারোয়ান তার চোখে সমুদ্রের ধু ধু নিঃসীম জল দেখে ভাবে, তিনি ডলির জন্য কাঁদছেন।
কোথাও যখন কোনও আশা নেই, সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মনোয়ারা বেগম প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখতে বসেন। এ কাজ তার মাঝরাতের পরিকল্পনাবহির্ভূত। তিনি লেখেন―মা, মাগো, মা জননী, আপনি দেশের আইন প্রশাসনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারিণী মা। তাই মাগো, এই দুঃখিনী মা আপনার কৃপাদৃষ্টি কামনা করে। মায়ের বুক খালি মাগো, তার সন্তানকে আপনি ফিরিয়ে দেন।
এতটুকু লিখে প্রতিবারই চিঠিখানা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। লেখা বন্ধ করে তিনি চোখের জলে চিঠির কাগজ ভিজিয়ে ফেলেন। ফের নতুন কাগজে কপি করতে করতে চোখের জলে ভিজিয়ে দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত হয়ে শুতে যান।
দিবারাত্রির এই কঠিন প্রতীক্ষার পর সিঙ্গাপুর থেকে ইন্টারপোলের জবাব আসে। সঙ্গে আসে কয়েক দফায় করা চার পৃষ্ঠার দীর্ঘ এক তদন্ত প্রতিবেদন। তাতে নতুন তথ্য মাত্র কয়েকটি। রুস্তম সিঙ্গাপুর তদন্ত পুলিশকে বলেছে যে, মৃতা ফেরদৌসি বেগম ডলি সন্তান ধারণে অক্ষম ছিল। তাই আত্মহত্যার মাসখানেক আগে সে পাগল হয়ে যায়। পাগলামির নমুনাস্বরূপ সে জানালার প্যারাপেটে বসে ডলির গান গাওয়ার কথা উল্লেখ করে। তদন্ত পুলিশ রুস্তমের বক্তব্যের সঙ্গে ফ্ল্যাটের ল্যান্ডলেডি মিসেস হুয়াংয়ের কথার মিল খুঁজে পায়। তারা তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে। চাইনিজ বংশোদ্ভূত এই নারী প্যারাপেটে বসে দুর্বোধ্য ভাষায় ডলির গান গাওয়ার কথা বলেন। মিসেস হুয়াং বাংলা বোঝেন না। ডলির গান তার দুর্বোধ্য লাগতেই পারে।
অথচ সিঙ্গাপুর তদন্ত পুলিশ এটি ডলির পাগলামির অন্যতম লক্ষণ বলে চিহ্নিত করে। ডলি যে গান গাইতে গাইতে কাঁদত মিসেস হুয়াংয়ের দেওয়া এমন ভাষ্য শুনে, মৃতার বিকৃত মস্তিষ্কের ব্যাপারে তাদের কোনও সন্দেহ থাকে না। করোনার কোর্টে দিনব্যাপী এসব দলিলপত্র, তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত চলে। অতঃপর সিঙ্গাপুরের স্ট্রেট করোনার আত্মহত্যার রায় লিপিবদ্ধ করেন। সন্তান ধারণ করতে চাওয়া, না-করতে পেরে পাগল হয়ে যাওয়া, এসব তো পরের কথা, ডলি যে ভার্জিন ছিল, বাংলাদেশের ছোট দারোগার মতো সিঙ্গাপুরের তদন্ত পুলিশও তা সমগ্র পুরুষজাতির কলঙ্ক মনে করে ধামাচাপা দেয়। তার তখন দু হাজার বছর আগের ভার্জিন মেরির সন্তান ধারণের অলৌকিক কাহিনিটি মনে পড়ে। আপনা থেকে ডান হাত উঠে আসে বুকের ওপর। সে ভক্তিভরে পরপর দুবার ক্রশচিহ্ন আঁকে।
মনোয়ারা বেগম স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। মৃত স্বামীর সহকারী আত্মহত্যার প্ররোচনায় দায়ে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় মামলা করার জন্য বাড়ি এসে পরামর্শ দেয়। এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যে ১০বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, তা উল্লেখ করতেও ভোলে না। মনোয়ারা বেগম অবাক হয়ে তার দিকে তাকান। ‘কিন্তু আমার মেয়ে আত্মহত্যা করবে কেন ?’ ছোট দারোগার মতো স্বামীর সহকারী উকিলকেও তিনি একই প্রশ্ন করেন। হলে হত্যা মামলাই হবে, না হলে হবে না। ফলে ডলির অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে সিঙ্গাপুর কি বাংলাদেশ কোথাও কোনও মামলা হয় না। রুস্তম এক বছর পর দ্বিতীয় বিয়ে উপলক্ষে দেশে আসে।
বিয়ে খুব ঘটা করে হয়। বিস্তর টাকাকড়ি খরচ করে রুস্তম। আলোকসজ্জা আর আতশবাজিতে এক বছর আগেকার অপ্রিয় ঘটনাটি চাপা পড়ে যায়। বিয়ের বরযাত্রীর সঙ্গে বাদ্য বাজাতে বাজাতে ব্যান্ডপার্টি চলে মনোয়ারা বেগমের বাড়ির সামনে দিয়ে। তিনি সেই বাজনা শুনতে পান না। সমুদ্রের বিপুল জলরাশি ছাড়া তিনি চোখে আর কিছু দেখেন না। কানে শোনেন শুধু শোঁ শোঁ গর্জন। ব্যান্ডপার্টি নিয়ে বরযাত্রী যখন তার বাড়ির সামনে দিয়ে যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রী বরাবর তখনও চিঠি লিখে চলেন। চিঠি লেখাই মনোয়ারা বেগমের এখন একমাত্র কাজ। তার বাড়ির উঠান থেকে সেসব চিঠি কুড়িয়ে নিয়ে টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের বাচ্চারা পাখি বানায়। তাদের চিঠি-পাখিরা উড়ে উড়ে শহরের ঘরবাড়ির বারান্দায়, ছাদে, কার্নিশে গিয়ে বসে। তাহমিনা ছাড়া চোখের জলে লেপটানো, অন্ধের হাতের বাঁকাচোরা বর্ণমালার করুণ চিঠিগুলো কেউ খুলেও দেখে না। তারা যার যার বারান্দা, ছাদ, কার্নিশ থেকে চিঠির পাখি ধরে এনে, ময়লার ঝুড়িতে দলা করে ফেলে দেয়।
তাহমিনা পরদিন স্থানীয় কাগজ খুলে রুস্তমের শুভবিবাহের সচিত্র খবর দেখতে পায়। তখন তার মনোয়ারা বেগমের কথা মনে পড়ে। তবু সে সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে মনোয়ারা বেগমের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতে পারে না। কারণ এখন মর্নিং-শিফটের বাচ্চারা শুধু নয়, জিলা স্কুল, ঈশ্বর পাঠশালা আর মডার্ন স্কুলের ছাত্ররাও ‘কি আপনের বাচ্চা নাই ক্যান, আপনে কি আত্মহত্যা করবেন ?’―এই একই কথা তাহমিনাকে দেখামাত্র বলতে শুরু করে। তারপর সে স্কুলের সামনে দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। ফলে শহরের প্রায় কোনও রাস্তাই তার চলাচলের যোগ্য থাকে না। ক্রমে সে বাসা থেকে সোনালি ব্যাংকে যাওয়া-আসার একটা ঘুরপথ আবিষ্কার করে, যার পাশে বাচ্চাদের কোনও স্কুল নাই।
এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর সাদা একটি মাইক্রোবাস আবার শহরে ঢুকে উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো ছুটতে শুরু করে। চালকের পাশের বাদামি সুট আর কালো চশমা পরা লোকটি রুস্তম। আর পেছনের সিটে সোহরাব। এবার চালককে কিছু বলতে হয় না। সে শহরের পাকা রাস্তা ছেড়ে ভাঙাচোরা গলিতে ঢোকে। আবার এগলি-ওগলি করে সেই পাকা সড়কে ওঠে। তারপর তারা ‘সাবধান সামনেই স্কুল’ সাইনবোর্ডটি দেখতে পায়। সবে মর্নিং-শিফটের ছুটি হয়েছে। ইউনিফর্ম পরা ছাত্র-ছাত্রীরা দল বেঁধে সব রাস্তায়। সাদা মাইক্রোবাসটি ধুলো উড়িয়ে তাদের পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যায়। ছাত্ররা তাতে বিচলিত হয় না। তারা জানে, গাড়িতে কী আছে এবং তা কোথায় যাচ্ছে। গাড়িটিকে অনুসরণ করে করে তারা ঠিক পৌঁছে যায় রুস্তমের দ্বিতীয় শ্বশুরবাড়ি টমসম ব্রিজ। সেখানে সাদা মাইক্রোবাসের পেট থেকে একটা সোনার বরণ কফিন রুস্তম, সোহরাব আর চালক টেনে বের করে উঠানে নামায়। ছাত্ররা ধীরে সুস্থে এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘বউ আত্মহত্যা করছে ?’ ওরা তিনজনই জবাব দেয় ‘হ।’ বাচ্চারা সবজান্তা, গম্ভীর মুখে শুধোয়, ‘বাচ্চা হয় নাই ?’ সোহরাব রুস্তম একসঙ্গে মাথা নাড়ে, ‘না।’
অফিসে খবরটা শুনে তাহমিনা রহমান খেপে ওঠে। চিৎকার করে বলে, ‘রুস্তম লোকটা আস্ত একটা খুনি। ওর ফাঁসি হওয়া উচিত। আমি সমস্ত কথা ফাঁস করে দিব।’ কথাটা এক টেবিল থেকে আরেক টেবিল, আরেক টেবিল থেকে আরেক টেবিল―এভাবে সাত টেবিল ঘুরে তার কাছে হুমকি হয়ে ফিরে আসে। সে শোনে, ‘জানের মায়া থাকলে খবরদার, পিছনে লাগতে যাইয়্যেন না।’ তাহমিনা এবার এক লাফে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়―‘কে বলল কথাটা ? কে বলল ? আসুক দেখি সামনে, কার এত সাহস!’ সে সাত টেবিলের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে। সাত টেবিলের সাতজনই চুপ। ঘাড় গুঁজে মন দিয়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে। অফিস থেকে বেরোনোর সময় তাহমিনাকে হঠাৎ পেছন থেকে কে একজন, ‘কার এত সাহস, আইজ রাইতেই টের পাইবেন’ বলেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
পরদিন শহরের রাস্তায় তাহমিনাকে না পেয়ে বাচ্চারা ঠিক করে, তারা তার বাসায় যাবে। বাসায় গিয়ে তাহমিনা রহমানকে আগের সেই কথাটি আবার বলে আসবে। সেইমতো মর্নিং-শিফটের বাচ্চাদের নেতৃত্বে জিলা স্কুল, মডার্ন স্কুল আর ঈশ্বর পাঠশালার সব ছাত্ররা টাউন হল মাঠে জড়ো হয়। তারপর তারা তাহমিনার বাসার বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে বলে, ‘এই আপনের বাচ্চা হয় না ক্যান, আপনে কি আত্মহত্যা করবেন ?’ কথাটা কয়েকবার তারা বলে, প্রথম আস্তে আস্তে তারপর নামতা পড়ার মতো গলা ফাটিয়ে। তাতেও যখন তাহমিনা বারান্দায় এসে দাঁড়ায় না, তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বাসার দরজা ভেঙে ফেলে। ভেতরে ঢুকে তারা দেখে, সোনালি ব্যাংকের অফিসার তাহমিনা রহমান, যে প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার দশ বছর পরও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেনি এইজন্য যে, তা ভেঙে গেলে তাকে আবার যে বিয়ে করতে হতো, সেটি হতো তার তৃতীয় বিবাহ―সে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে।
বাচ্চারা তাতে ভয় পায় না। তাদের চোখ ঠিকরে সর্বজ্ঞের আবিল হাসি বিচ্ছুরিত হয়।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ