আর্কাইভগল্প

জাদুবাস্তব গল্প : বঙ্গালয় : অনন্ত মাহফুজ

প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে জমেলা বেগমের বাড়ির আঙিনায় যে গাছটা সবার আগে পথচারীদের নজরে আসে তার ডালে কোনও পাতা নেই। গ্রামের মানুষেরা সূর্য ওঠার আগের নরম আলোয় দূর থেকে এই গাছের দিকে তাকায়। তাদের কেউ কেউ গাছের কাছে মাথা নত করতে চায়। তবে তারা তা করে না। তারা সৃষ্টিকর্তার কথা স্মরণ করে। রহস্যময় এই গাছটির কাছে তারা যেতে চায়। কিন্তু তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। হাট থেকে সদাই করে ফেরার পথে বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা পুনরায় গাছ থেকে কয়েক শ গজ দূরে দাঁড়ায়। তখন তারা গাছের ডালে পাখিদের আওয়াজ শুনতে পায়। তারা কখনও জ্যোৎস্নারাতে এ পথ দিয়ে যায় না কারণ তারা পাখি দেখতে চায় না অথবা তারা পাখিদের ভয় পায়।

এই সব নিয়ে গ্রামের মানুষ গোলকধাঁধার মধ্যে থাকে। অনেকে মনে করে, এই সব গোলকধাঁধা থেকে তাদের মুক্তি নেই। বহু বছর আগে যখন গাঁয়ে পাখি আসা বন্ধ হয়ে গেল, তখনও জমিলার বাড়ির আঙিনার ন্যাড়া গাছে সন্ধ্যার পর পাখিদের কোলাহল শোনা যেত। গাছে পাতা নেই অথচ রাতে পাখি আসে―এই ঘটনা তাদেরকে ক্রমাগত ভীত করে তোলে। তারা চারপাশের স্রোতহীন নদী পার হয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। কিন্তু আসলে তারা যায় না।   

জমেলা বেগমের বিয়ে হয়ে এ গাঁয়ে আসার অনেক আগে কোনও কালে এ গাছে পাতা ছিল বলে জানা যায়। তারা যে স্মৃতির কথা সবাইকে জানায় তা মূলত জমেলা বেগমের অভিজ্ঞতার বাইরে। অথবা তারা জমেলা বেগমকে এই সব অভিজ্ঞার ভাগ দিতে চায় না। জমেলা বেগমের উঠোনজুড়ে যেসব গাছ আছে, সব গাছেই বহুকাল ধরে পাতা নেই। অথচ গাছগুলো দিব্যি বেঁচে আছে। গ্রামের কোথাও পাতাবিহীন বৃক্ষ নেই। কিছু গাছে ফুল আছে। নিস্তরঙ্গ নদীর কিনারে কিছু গাছে ফলও দেখা যায়। তবে তারা বৃক্ষের ফল খায় না।

এক ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর জমেলা বেগম দেখেছিল ঘরের পশ্চিম কোণের গাছে ফুল ফুটে আছে। এ নিয়ে গাঁয়ের লোকজন বেশ উৎসাহ দেখায়। পাতাবিহীন গাছে হঠাৎ ফুল ফোটার রহস্যের কিনারা করতে না পেরে গ্রামের মানুষ ভীত হয়ে পড়ে। তবে অনেকে বলে, ‘ফুল সৌন্দর্য বাড়ায়। মরা গাছে ফুল ফোটা তাই ভালো লক্ষণ।’ পাশের বাড়ির অন্ধ বৃদ্ধা এ নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, ‘জমেলা বেগমের যেমন ভালো হবে, তেমনি গ্রামের মানুষের সামনে সুদিন অপেক্ষা করছে। সুদিন খুব কাছেই।’ সুদিন আসার আশ্বাস অথবা আশার বাণী অনেক দিন ধরেই শুনে আসছে গ্রামের লোকেরা। তারা এখন সবাই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তারা এখন আর কেউ মনে করে না যে, সুদিন কোনওদিন আসবে।

জমেলা বেগমকে দিয়েই গ্রামের মানুষের দুর্দিনের শুরু বলে এখনও কেউ কেউ প্রচার করে বেড়ায়। অথচ কেউ বলে না কবে জমেলা বেগম এই গ্রামে এসেছে। সবাই বলে, কেরামত বয়াতির সঙ্গে জমেলা বেগমের বিয়ে হয়েছিল। তারা বেশ সুখে ছিল। কিন্তু তারা আসলে সুখে ছিল কি না তা কারও মনে পড়ে না। নজিরন নামের যে বৃদ্ধা আজ চোখে দেখে না সে বলে, ‘আমি যখন বউ হয়ে এ গাঁয়ে আসি, তখনও জমেলা বেগমের বয়স এমনই ছিল।’ এই সব কথায় গ্রামের মানুষ প্রায়ই বিভ্রান্ত থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ও পায়।

পাতাবিহীন গাছে ফুল ফোটার গল্প শোনার পর গাঁয়ের মানুষ আলোচনায় মত্ত হয়। তারা কেরামত বয়াতির প্রসঙ্গ টেনে বলে, ‘বয়াতি আসলে কোথাও পালিয়ে যায়নি। তার অন্তর্ধান রহস্যময়। আসলে তার এত জমি আর সুন্দরী স্ত্রী থাকা ঠিক নয়।’ তারা নজিরনের কথা পুনরায় স্মরণ করে। ফলে তারা বলে যে, জমেলা বেগম একজন নয়। কয়েক শতাব্দী ধরে অনেক জমেলা বেগমের জন্ম হয়েছে। সব জমেলাই দেখতে একরকম। কিন্তু তারা এই সব আলাপের পক্ষে কোনও যুক্তি দাঁড় করাতে পারে না। এ কারণে তারা বলতে পারে না যে, জমেলা বেগমকে তারা কবে এ গাঁয়ে আসতে দেখেছে। আবার কবে কেরামত বয়াতি গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। ফলে জমেলা বেগমের উঠোনের গাছ মরে যাওয়া বা পাতা ঝড়ে যাওয়ার বিষয়ে তারা অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকে। তারা আবার নজিরনের কথা স্মরণ করে এবং বলে, ‘সুদিন আসা মানে কেরামত বয়াতির ফিরে আসা।’

কেরামত বয়াতি চলে যাওয়ার বহু বহু দিন পরেও জমেলার বয়স বাড়ে না দেখে গাঁয়ের মানুষ মাঝে মাঝে অবাক হয়। বিষয়টি একেবারেই মানতে পারে না নটবর সরকার। মানুষের বয়স আটকে যাওয়ার মতো অস্বাভাবিক ঘটনাকে সে ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ জানানো হিসেবে দেখে। তাছাড়া, নটবর সরকার বলে যে, বয়স না-বাড়া একজন নিঃসঙ্গ নারীর একা মৃত বৃক্ষের পাশে থাকা ঠিক নয়।

নটবর সরকার বঙ্গালয়ের অধিপতি। সে কীভাবে অধিপতি হলো সেই ঘটনা গ্রামের দুই-একজন ছাড়া আর কেউ জানে না। সে গ্রামের মানুষের দুঃখ লাঘবের ঘোষণা দেয় এবং বলে যে, সে তাদের সবার অভিভাবক। নটবরকে গ্রামের প্রায় সবাই খুব ভালোবাসে। সে যুবদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার পক্ষে নয় বিধায় যুবরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে। নটবর আরও বলে, ‘আমি সব জমির মালিক। কিন্তু আমার প্রচুর খাদ্যের দরকার নাই। জমি আমার, খাদ্য সবার। সবাই বিনা পরিশ্রমে খাবে। খাওয়ার পর ঘুমাবে।’

দুই

বঙ্গালয়ের মানুষেরা কখনও কখনও দুই ভাগ হয়ে পড়ে। কোনও তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তারা লড়াইয়ে লিপ্ত হয় এবং উভয় পক্ষের অনেক মানুষ মারা যায়। যেমন, তাদের একদল বিশ্বাস করে সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে সারাদিন পরিশ্রম করে পশ্চিমে অস্ত যায় এবং সারারাত বিশ্রাম করে পুনরায় পূর্ব দিকে উদিত হয়। কিন্তু এটা মানতে নারাজ আরেক দল মানুষ। তারা বিশ্বাস করে, সূর্য আসলে বিশ্রাম নেয় না। অস্ত যাবার পরেও সূর্য ভ্রমণ করতে থাকে। তখন সে অন্ধকারে ভ্রমণ করে পূর্ব দিকে চলে যায় এবং সকালে পূর্ব দিকে উদিত হয়। বঙ্গালয়ে এ বিতর্ক বহু দিনের পুরোনো। বাজারের চায়ের স্টলে এ বিতর্ক প্রকট আকার ধারণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় এবং তারা কাঁঠালের ভুতি দিয়ে যুদ্ধ করে। যে পক্ষ জিতে সে পক্ষকে সমর্থন দেয় নটবর সরকার। সে জানায়, যারা জিতে তারা হিরো। সে সবসময় হিরোদের পক্ষে।   

নটবর সরকার জমেলা বেগমের বয়স নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। ‘আমাদের বয়স তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। জমেলা বেগমের বয়স বাড়বে না কেন ?’ নটবর সরকারের এ প্রশ্নের উত্তর গাঁয়ের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিও দিতে পারেন না। তারও বয়স হয়েছে। চলাফেরা সীমিত। উপাসনালয়ই এখন তার থাকার জায়গা। তিনি মাঝে মাঝে লাঠি ভর দিয়ে বাজারের দিকে যান। গাঁয়ের ভিতর দিয়ে প্রশস্ত যে সরকারি রাস্তা চলে গেছে তার দুই পাশে ব্যবসার জন্য দোকান খুলে বসেছে মানুষজন। দোকান যেখানে ঘন, সেখানে মানুষের আনাগোনা বেশি। বিজ্ঞ সেখানে গিয়ে চা পান করেন। নটবর সরকার বাজারে শত শত মানুষের মধ্যে বিজ্ঞ ব্যক্তিকে এই প্রশ্ন করলে তিনি কথার জবাব না দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। নটবর অনেকটা হুমকির সুরে বলে, ‘বিজ্ঞ, আপনি যদি এ প্রশ্নের জবাব না দিতে পারেন, তাহলে আমি রাজধানীতে গিয়ে আরও বিজ্ঞ কোনও ব্যক্তির সন্ধান করব।’

‘তুমি নগরে যেতে পারো।’

‘আপনি এই সমস্যার সমাধান বের করেন। আর না হলে জমেলা বেগমের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করেন।’

বিজ্ঞ কোনও কথা না বলে লাঠি ভর দিয়ে বাজার থেকে উপাসনালয়ের দিকে হাঁটতে থাকেন। বাজারে যারা তাদের তর্ক শোনে তারা খুব উৎসাহ নিয়ে ঘটনাটি গাঁয়ে রটিয়ে দেয়। তারা একে অপরকে বোঝাতে চায় যে, নটবর সরকার মূলত জমেলা বেগমের তরুণী থাকার রহস্য জানার জন্য তাকে বিয়ে করতে চায়। রহস্য জানা হয়ে গেলে তাদের সংসার ভেঙে যাবে। তারা বলে, গাছে পাতা না থাকার রহস্য নটবর জানে। 

ইতোমধ্যে সারা গাঁয়ে ছড়িয়ে যায় যে, বাজারে এক ধরনের নরম কাইয়ের মতো জিনিস পাওয়া যাচ্ছে যা সুদৃশ্য কৌটার মধ্যে সংরক্ষণ করা থাকে। কাইয়ের মতো সেই বস্তু আসলে মুখে মাখার জন্য। মুখে সেই কাই মাখা হলে নারীরা বুড়ো হয় না। তাদের মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে না। নটবর সরকার এবার রহস্য ধরতে পেরেছে বলে মাইক ভাড়া করে বাজারে ঘোষণার ব্যবস্থা করে। সে আরও জানায় যে, এই রহস্যের সমাধান সে সবার সামনে উন্মুক্ত করবে এবং নিজেকে বিজ্ঞ বলে ঘোষণা করবে। পাতাবিহীন গাছের বেঁচে থাকা এবং জমেলা বেগমের বয়স না বাড়ার মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। এসব বিষয়ে সে বাজারের উন্মুক্ত স্থানে সব রহস্য উন্মোচন করবে। নটবর সরকারের এমন ঘোষণায় গ্রামের লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন বেড়ে যায়। তারা বিকেলে রাস্তার পাশে জড়ো হয়ে এ বিষয়ে গভীর আলোচনা করতে থাকে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে নটবর সরকারের কথায় বিশ্বাস করতে চায় না।

বাজারের উন্মুক্ত স্থানে নটবর সরকারের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকা মানুষেরা ধৈর্য ধারণ করতে চায় না। তারা এর আগেই নটবর সরকারের বাড়ির আঙিনায় জড়ো হতে থাকে। তারা নটবর সরকারের মুখোমুখি হতে চায়। তারা মনে করে, জমেলা বেগম যে অলৌকিক শক্তির অধিকারী তাতে গ্রামের সকলের অধিকার আছে। সবাই সে শক্তি ভাগ করে নিতে পারে। তবে নটবর সরকার তাদের সঙ্গে দেখা করে না। নটবর মনে করে, এতে তার গুরুত্ব কমে যেতে পারে। জড়ো হওয়া লোকজন পাশের দোকানে গিয়ে বাদাম কিনে খায় আর টুকটাক গল্প করে। তারা সব চিন্তা বাদ দিয়ে নটবর সরকারের অপেক্ষা করতে থাকে। তারা মোটামুটি এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, কারও গাছে পাতা না থাকলে তার বয়স বাড়ে না। সুতরাং তারা জমেলা বেগমের বাড়ির পাতাহীন বৃক্ষের জীবন্ত থাকার বিষয়ে অনুসন্ধান করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

তিন

একদিন গাঁয়ের সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করে, নদীর পাড়ে একটি নৌকা বাঁধা আছে। একটি লোক নৌকা থেকে নেমে দুই পা-ওয়ালা একটি বানর নিয়ে ঘাটের মানুষের মাঝে খেলা দেখাবার প্রস্তুতি নেয়। তখন সকালের সূর্য গাছের আগায় বসে থাকে। মানুষ মনে করে বেলা বাড়ছে না। ফলে তাদের মধ্যে তাড়া দেখা যায় না। দুই পায়ের বানর কোথায় পাওয়া যায় তা-ও তারা অনুমান করতে পারে না। তারা মনে করে, দুই পা-ওয়ালা বানর আসলে তাদের পরিচিত না-ও হতে পারে। তারা লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘দুই পায়ের বানর আপনি কোথায় পেলেন ?’

বাবরি চুলের কারণে তার চোখ দেখা যাচ্ছে না। মুখও খানিকটা ঢেকে আছে। তাকে রহস্যময় মনে হয়। রহস্যময় মানুষ গম্ভীর সুরে বলে, ‘দুই পায়ের বানর সবখানেই পাওয়া যায়।’ লোকটির রহস্যময়তা তাদের আরও কৌতূহলী করে। তারা দুই পায়ের বানরের খেলা দেখে আর জানতে চায়, ‘আপনার দুই পা-ওয়ালা বানরের নাম কী ?’

‘নটবর সরকার।’

এ কথা শোনার পর তারা পরস্পরের দিকে তাকায়। তাদের কৌতূহল কমে যায়। তারা মূলত ভয় পেতে শুরু করে এবং অনেকে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে। ভীতদের কয়েকজন নটবর সরকারের বাড়িতে যায় এবং জানায় যে, বানরওয়ালা তাকে বানর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এতে নটবর সরকার খেপে যায় এবং বানরওয়ালাকে শাসায়। বানরওয়ালা জানায়, ‘শাসাইয়া লাভ নাই।’

কিন্তু বানরের নাম নটবর সরকারÑএই বিষয়টা গ্রামের মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তারা নটবর সরকারের সঙ্গে বানরের মিল খুঁজতে গিয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিভ্রান্তের মতো বলে, ‘নটবর সরকার আর বানরের মধ্যে ম্যালা তফাৎ।’ তারা বানর আর মানুষের তফাতের কথা চিন্তা করে, কিন্তু কোনও কিনারা করতে পারে না। তারা তখন বলে, ‘ডারউইন এইসব জানে। বইয়েও লেখা আছে।’ তাদের মধ্যে এক যুবক বলে, ‘বিদ্যালয় বন্ধ। কিন্তু বিদ্যালয়ে আগে থেকেই ডারউইন পড়া বন্ধ। ডারউইন একটা বাইঞ্চোৎ।’ ডারউইন গালি খাওয়ার পরে উপস্থিত সবাই স্বস্তি বোধ করে।

আরেকজন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অঙ্ক কষে দেখাতে চায়, দুই নটবরের বয়সের ব্যবধান আসলে দশ বছর। মানুষ আর বানরের বয়সের এই সম্পর্ক নিয়েও তাদের মধ্যে বেশ ঝগড়া হয়। তাদের মধ্যে চুলপাকা মাস্টারের মতো করে সামনের দিকে তাকিয়ে একজন বলে, ‘নটবর সরকারই বানর।’ মানুষ কী করে বানর হয় অথবা বানর কী করে মানুষ হয় এ নিয়ে বঙ্গালয়ের মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তারা পুনরায় লড়াইয়ে লিপ্ত হয় এবং কাঁঠালের ভুতি দিয়ে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে সম্মুখ সারির কয়েকজন যোদ্ধা মারা যায়। যুদ্ধের পরে জিতে যাওয়া লোকজন বিরানি খায়। নটবর সরকার বলে, ‘যুদ্ধে অনেক পরিশ্রম হয়। তাই বিরানি খাওয়া দরকার।’

বঙ্গালয়ের মানুষেরা যুদ্ধ ধরে রাখতে চায় না। তারা মনে করে, যুদ্ধ আসলে কোনও কাজের জিনিস না। তবে নটবর সরকার বলে, ‘যুদ্ধ আসলে খেলা। যুবকদের খেলা দরকার আছে। এতে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে।’ নটবর সরকারের কথায় যুক্তি আছে বলে ধরে নেয় গ্রামের মানুষ। ফলে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলো খালি পড়ে আছে। গ্রামের বিজ্ঞ যুবদের রাস্তা ছেড়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা বললে যুবরা জানায়, ‘তারা রাস্তাতেই ভালো আছে। উন্মুক্ত জায়গা। বিদ্যালয় মানে বেড়া, বদ্ধ জায়গা। বদ্ধ জায়গায় জ্ঞানের বিকাশ হয় না।’ অথবা তারা বলতে চায়, জ্ঞানের বিকাশ আসলে কোনও কাজের না। নটবর সরকার তাদের সমর্থন করে এবং বিরানি খাওয়ায়।    

চার

যারা পাতাহীন জীবন্ত বৃক্ষের রহস্যভেদ করতে নামে তারা জমেলা বেগমের বাড়ির কাছে যায়। তারা মিন মিন করে জমেলা বেগমকে ডাক দেয়, ‘জমেলা বেগম বাড়িতে আছো ?’

জমেলা বেগম বাড়ির বাইরে আসে। সে দেখতে পায় তার সামনের লোকগুলো শিয়ালের মতো। শিয়াল টাইপের মানুষগুলো তার এখানে কেন এসেছে তা সে জানতে চায়। লোকগুলোর মধ্যে কৃষ্ণ বর্ণের একজন বলে, ‘উঠোনের বৃক্ষটি জীবিত না মৃত তা আমাদের দেখা দরকার। আমরা বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসেছি।’ জমেলা বেগম বলে, ‘বৃক্ষের পাতা নিয়ে তোমাদের এত মাথাব্যথা কেন ? পাতা থাকলেই কী আর না থাকলেই কী ?’ কেউ একজন পিছন থেকে জানতে চায়, ‘আপনার বুড়ো না হওয়ার রহস্য কী ?’ জমেলা বেগম কিছু বলার আগে একজন সন্দিহান হয়ে জানতে চায়, ‘তুমি গাছের পাতা ছিঁড়া ফেলো ? তুমি আমাদের বোকা বানাতে চাও ?’

কিন্তু তারা খুব অবাক হয়ে দেখে, বানরওয়ালা গাছের নিচে বসে আছে। তাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে গাছটা। তারা ওপরের দিকে তাকিয়ে আরও বেশি অবাক হয়। তাদের মধ্যে মাঝবয়সী কয়েকজন জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। যারা দাঁড়িয়ে থাকে তারা বিস্ময় নিয়ে দেখে যে, গাছে অনেক সবুজ পাতা। বানরওয়ালার দুই পাশে দুই বানর। বানরগুলো দুই পা-ওয়ালা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সের এক কিশোরী বলে, ‘এখানে বানর আসলে একটাই।’ এ কথা শোনার পর গ্রামের লোকজন পুনরায় বানরের দিকে তাকায়। তারা আবার বিভ্রান্ত হয়। যুবরা বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং  প্রত্যেকেই দেখে যে, দুই বানরের মধ্যে সে একটি।

সেই দিন সারাদিন তুমুল বৃষ্টি হয়। পানির তোড়ে অনেকের ঘরবাড়ি ভেসে যায়। বঙ্গালয়ের মানুষেরা বহুদিন পর তৃপ্তিবোধ করে। তারা জানায়, নটবর সরকার আসলে বানর। তারা আরও বলে, বৃষ্টি তাদের মাথা খুলে দিয়েছে। তারা তখন রাস্তায় জমে যাওয়া পানির মধ্যে সাঁতার কেটে কেটে নটবর সরকারের বাড়ির দিকে যেতে চায়। কারণ তারা বানর দেখতে চায়। তখন কেউ একজন ঘোষণা দেয়, ‘নটবর সরকার বাড়িতে নেই।’ তখন মানুষের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন দেখা যায়। গ্রামের মানুষেরা পুনরায় ব্যাপকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা দেখে যে, বানরওয়ালা আসলে জমেলার স্বামী এবং তার দুই হাতে দুই পা-ওয়ালা দুটি বানর। তারা দেখে দুটি বানরের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই এবং দুটি বানরের গলাতেই দড়ি লাগানো।

বঙ্গালয়ে ফসল ভালো হয় এবং এ বছর পাতাহীন গাছ দেখা যায় না। এর মধ্যে কিছু লোক জানায়, তারা নটবরের খোঁজ পেতে চায়। তারা প্রতিদিন নটবর সরকারের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করে। তারা জানায়, তারা নটবর সরকারকে ভালোবাসে।  

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button