অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

জাদুবাস্তব অনুবাদ গল্প : পায়ে চলা মাছ

মূল : হুলিও কোর্তাসার

বাংলা অনুবাদ : আফসানা বেগম

[হুলিও কোর্তাসার (Juljo Florencio Cortázar), জন্ম : ২৬ আগস্ট, ১৯১৪, বেলজিয়াম। মৃত্যু : ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪, ফ্রান্স। জাতীয়তা: আর্জেন্টাইন। কোর্তাসার লাতিন সাহিত্যের অন্যতম নন্দিত ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। সমগ্র আমেরিকা ও ইউরোপের স্প্যানিশ ভাষাভাষী পাঠক ও লেখকদের উপর তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। কোর্তাসারকে লাতিন আমেরিকান জাগরণের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। দ্বিতীয় উপন্যাস হপস্কচ তাঁকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিলেও মূলত তাঁর জাদুবাস্তব ছোটগল্পগুলোর জন্যই তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প অনুসরণ করেই বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকার আন্তোনিয়োনি নির্মাণ করেন ব্লো-আপ সিনেমাটি।]

পায়ে ভর করে হাঁটতে পারা মাছ নিয়ে একসময় আমি বেশ ভাবতাম। হার্দিন দেস প্লান্তেসে বার বার ছুটে যেতাম তাদের দেখতে। অ্যাকুরিয়ামের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম। তারপর অবাক হয়ে তাদের থমকে থাকা কিংবা মৃদু চলাফেরা দেখতাম। আর এখন আমি নিজেই হয়ে গেছি একটা পায়ে চলা মাছ।

শীতকালীন দীর্ঘ উপাসনা শেষে বসন্তের এক সকালে প্যারিস শহরটা যখন ময়ূরের মতো পেখম মেলছিল, আমার হঠাৎ দেখা হয়েছিল পায়ে চলা মাছেদের সঙ্গে। আমি যাচ্ছিলাম বুলেভাঁখ পোঁখ ওয়াইয়ালের দিকে। সাঁ মাখসেল আর ল্য’পিতালের সামনের রাস্তাটা নিয়েছিলাম। সবুজের মাঝখানে ধূসর রঙ দেখতেই সেখানকার সিংহদের কথা মনে পড়ল। সিংহ আর চিতাবাঘগুলো ছিল আমার বরাবরের বন্ধু। কিন্তু অ্যাকুরিয়ামের অন্ধকার আর স্যাঁতসেতে ঘরগুলোয় সেদিনের আগে আমি কখনও যাইনি। জালের মতো পাঁচিলটার পাশে সাইকেল রেখে আমি টিউলিপ ফুল দেখতে গিয়েছিলাম। সিংহগুলো কেন যেন মনমরা হয়ে পড়ে ছিল আর দেখতে লাগছিল কুৎসিত। আমার সাধের চিতাবাঘটাও ছিল ঘুমিয়ে। তাই বাধ্য হয়ে আমি অ্যাকুরিয়ামের ঘরে ঢুকে পড়লাম। সাধারণ আর আবোলতাবোল মাছগুলোর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম যতক্ষণ না আমার চোখ হুট করে আটকে গেল ওই পায়ে চলা মাছগুলোর দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে এক ঘণ্টা ধরে হা করে তাদের দেখে আমি ফিরে এলাম। কিন্তু পরেও, তাদের ছাড়া অন্য কোনও ভাবনাই কেন যেন মাথায় এল না।

সাঁন জেনিয়েভার লাইব্রেরিতে গিয়ে আমি একটা ডিকশনারি উল্টালাম। দেখলাম পায়ে চলা মাছগুলো অ্যামবিসটোমা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক রকমের উভচর যাদের শুককীট অবস্থায় বড় বড় ফুলকা থাকে। তারা যে মেক্সিকো থেকে আগত তা আস্তেকদের মতো তাদের ছোট্ট আর গোলাপি মুখগুলো দেখলেই বলে দিতে পারতাম। কিংবা পানি ভরা ট্যাংকের উপরের সাইনবোর্ডটা দেখেও বলে দেওয়া যেত। আমি পড়েছিলাম যে আফ্রিকায় খরার সময়ে তাদের দু-একটাকে ডাঙায় চলাফেরা করতে দেখা গেছে। পরে বর্ষাকাল এলে তারা সবসময়ের জন্য পানির তলায় আশ্রয় নেয়। আরও জেনেছিলাম যে তাদের স্প্যানিশ নাম হলো গিয়ে আহোলতে। সেখানে বলা ছিল যে মাছগুলো খাওয়া যায় আর তাদের শরীরের তেল কড লিভার তেলের মতো ব্যবহারও করা যায়। (অবশ্য আজকাল নাকি সেই তেলের ব্যবহার আর নেই।)

বিষয়টি যে আমার জন্য খুবই বিশেষ কিছু হয়ে উঠেছিল তা অবশ্য আমার তখন মনে হয়নি। কিন্তু হলো কী, পরের দিন আমি আবারও সোজা হার্দিন দেস প্লান্তেসে গিয়ে হাজির হলাম। তারপর প্রত্যেক সকালেই আমি সেখানে যাওয়া-আসা শুরু করলাম। কখনও কখনও সকালের পরে আবার রাতেও। অ্যাকুরিয়ামের দারোয়ান মুচকি হেসে আমার হাতে টিকেট ধরিয়ে দিত। পানি ভরা ট্যাংকের সামনে লোহার শিকের উপরে হেলান দিয়ে আমি ক্রমাগত মাছগুলোকে দেখতে থাকতাম। আমার চোখে ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক লাগত না। কারণ সেদিকে তাকানোর পরে মিনিটখানেক গেলেই আমার মনে হতো আমার আর তাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা যোগাযোগ আছে। যেন অসীম কালের হারিয়ে যাওয়া কোনও সম্পর্কের সুতো দুদিক থেকে টেনে টেনে আমাদের মাঝখানের দূরত্ব ঘোচাতে চাইত। সেই প্রথম দিনে তাদের দিকে তাকানোর প্রথম মুহূর্তে পানি থেকে যে এক তাল ফেনা উপরের দিকে ভেসে কাচের ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে যেতে দেখেছিলাম, আমাকে দিনের পর দিন ওখানে ধরে রাখার জন্য ওটুকুই যথেষ্ট ছিল। পায়ে চলা মাছগুলো ট্যাংকের সরু আর এবড়োখেবড়ো শ্যাওলাধরা পাথরগুলোর উপরে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকত। (শুধু আমিই জানি যে সেটা কত সরু আর কতটা এবড়োখেবড়ো।) নয়টা মাছ সেখানে বলতে গেলে সামনেই থাকত। চাপাচাপির চোটে তাদের মধ্যে বেশির ভাগেরই কাচের গায়ে মাথা ঠোকা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। সোনালি চোখ পিটপিট করে তারা ট্যাংকের কাছে যে আসত, তার দিতে তাকাত। বিভ্রান্ত কিংবা হতবুদ্ধি আমি ওই নীরব আর স্থির প্রাণিগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার আশা নিয়ে কিছুটা লজ্জিত হয়েই ট্যাংকের মাঝখানে তাদের স্তূপের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মনে মনে আমি তাদের দল থেকে একজনকে একটু আলাদা করে লক্ষ করতাম। সে ডান দিকের কোনায় সেঁটে থাকত, অন্যদের থেকে খানিকটা পৃথক রাখত নিজেকে। তাই তাকে ভালোমতো দেখতে সুবিধাও হতো। তার শরীরটা ছিল ছোট্ট আর গোলাপি। (তাকে দেখে চীনে তৈরি কারুকাজওলা দুধরঙা গ্লাসের ছবি আমার চোখে ভাসত।) সে ছিল স্বচ্ছ ছোট একটা টিকটিকির মতো যার দৈর্ঘ্য হলে হবে বড়জোর ছয় ইঞ্চি। দেখলাম তার শরীরের শেষ প্রান্তটা গিয়ে ফুরিয়েছে একটা মাছের মতো লেজে; আমাদের শরীরেও যেমন সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গ থাকে নীচে। তার পিঠের উপর থেকে পিছনের দিকে চলে গেছে একটা স্বচ্ছ পাখনা, যা গিয়ে মিলেছে লেজের সঙ্গে। কিন্তু যা দেখে আমি অভিভূত হলাম, তা হলো তার পা। তার পা যেমন ছিল উভচরের পায়ের অপূর্ব আকৃতির অথচ ছোট ছোট আঙুলগুলোর মাথায় তেমনই নিখুঁত মানুষের নখের মতো নখ বসানো। আর সেসব দেখা শেষ করতেই আমি আবিষ্কার করলাম ওর চোখ-মুখ। অভিব্যক্তিহীন চেহারা, ভাষাবিহীন চোখে কোনও অনুভূতি খেলে না। সে জায়গায় আছে কেবল স্বচ্ছ সোনালিরঙা ব্রোচের মতো স্থির দুটো বৃত্ত। সে বৃত্তে জীবনের কোনও লক্ষণ নেই, আছে শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা। সেই চোখের দৃষ্টি আমার চোখে এসে মেলে, যেন তার ইচ্ছেতেই এক হয়। অপলক দৃষ্টি আবার কখনও খেই হারিয়ে সোনালি আভা খসাতে থাকে। তারপর মায়াময় কোনও ঘোরের মধ্যে আটকে যায়। দেখলাম চোখের চারপাশে সরু কালো এক বলয় গোলাপি পেশির উপরে চোখকে খোদাই করে রেখেছে। অনেকটা ত্রিভুজের মতো গোলাপি মাথাটার দুদিকে ঢালু, দেখে মনে হলো সময়ের সঙ্গে ক্ষয়ে যেতে থাকা কোনও পাথরের মূর্তি। ত্রিভুজাকৃতি সমতল অংশটা মুখে যেন একটা মুখোশ পরিয়ে রেখেছে। মুখোশটা দেখে মুখের আকৃতি আন্দাজ করা যায় মাত্র। কমনীয় অথচ প্রাণহীন পাথরের মতো মুখের উপরের সূক্ষ্ম ফাটলে কখনও চির ধরে কি ধরে না। মাথার দুদিকে যেখানে কি না কান থাকার কথা, সেখানে তিনটি করে ছোট্ট পাখা। পাখাগুলো প্রবালের মতো লাল আর পালকে ঠাসা। যদ্দুর মনে হয় ওগুলো ফুলকাই হবে। আর পায়ে চলা মাছের শরীরের ওই অংশটাই কেবল নড়ে। প্রতি দশ থেকে পনেরো সেকেন্ডে পাখাগুলো এদিক-ওদিকে নড়েচড়ে আবারও শান্ত হয়ে যায়। কখনও হঠাৎ করে কোনও একটা পা নড়ে ওঠে। কুঁকড়ে থাকা আঙুলগুলোকে তখন আমি সামান্য একটু মেলতে দেখি। পরমুহূর্তেই আলতোভাবে শ্যাওলার উপরে সে পা রাখে―ব্যাপারটা এমন নয় যে নড়াচড়া করতে আমাদের মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু ট্যাংকটা এতই ছোট আর তার ভেতরে এতটাই চাপাচাপি যে নিজের জায়গা থেকে সরে এদিক ওদিকে ঘোরার সুযোগ বলতে গেলে একেবারেই নেই। নড়াচড়া না করতেই সারাক্ষণ আমরা এত অন্যের মাথা বা লেজ দিয়ে গুঁতো দিচ্ছি। কখনও বেশ ঝামেলা লেগে যায়, একচোট মারামারিও বাঁধে, তারপর লড়তে লড়তে একসময় আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তখন মনে হয় খামোখা এসব ঝগড়াঝাটিতে না জড়িয়ে আমরা চুপচাপ পড়ে থাকলেই পারি।

সত্যি কথা বলতে কী, পায়ে চলা মাছদের নিñিদ্র নীরবতাই প্রথম তাদের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে, যার কারণে এক নজরে তাদের দেখতে আমি ট্যাংকটার দিকে হেলে পড়ি। নেশাগ্রস্তের মতো আমি তাদের মৌন ইচ্ছা বুঝতে চেষ্টা করি। বৈচিত্র্যহীন আর নিশ্চল শরীরে যেন ক্রমাগত তারা স্থান-কাল-পাত্রকে অগ্রাহ্য করে। পরে অবশ্য আমি আরও ভালো করে বুঝেছিলাম যে ফুলকাগুলো নাড়িয়ে কিংবা চমৎকার পাগুলো পাথরের উপরে উপর্যুপরি ঠুকে, কখনওবা অপ্রত্যাশিতভাবে সাঁতারের মতো ভঙ্গি করে (তাদের মধ্যে কেউ কেউ শরীরে ঢেউ তুলে সাঁতার কাটতে পারত) তারা আমার কাছে প্রমাণ করেছিল, যে তরলের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা স্থবির পার করে, চাইলে সেখান থেকে পালিয়েও যেতে পারে।

তবে তাদের চোখগুলোই আমাকে মুগ্ধ করেছিল সবচেয়ে বেশি। আশেপাশের ট্যাংকগুলোয় থাকা বিভিন্ন ধরনের মাছেরা মানুষের মতো আবেদন ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কেবল নানারকমের বোকামিই দেখাচ্ছিল। সে জায়গায় পায়ে চলা মাছদের চোখ যেন অন্য কোনও জীবনের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছিল, কিংবা বলতে চাচ্ছিল জীবনকে অন্য কোনওভাবে অবলোকনের কথা। আমি ট্যাংকের কাচের উপরে আমার মুখটা ঠেসে ধরতাম (যদিও দারোয়ানটা মাঝে মধ্যে আমার দিকে তাকিয়ে গলা খাকারি দিত)। আমি আসলে তাদের চোখের মাঝখানে নিবু নিবু সোনালি বিন্দুগুলোকে আরও কাছে থেকে দেখতে চাইতাম। আমার মনে হতো গোলাপি ওই প্রাণিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত নির্জনতা আর অকল্পনীয় ধীরগতির দূরবর্তী পৃথিবীতে প্রবেশের দরজা যেন ওটাই। তাদের মুখের ঠিক সামনে কাচের উপরে আঙুল দিয়ে টোকা দেওয়ার কোনও মানেই হতো না। ওরকম করাতে তারা কেউ কখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তাদের সোনালি চোখগুলো আবছা আলোর মতো টিমটিম করে জ্বলেই গেছে শুধু। বরং তারপর তারা আমার দিকে অতল আর দুর্বোধ্য চোখে তাকিয়ে থেকেছে, যে দৃষ্টির প্রভাবে আমার মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠত।

তাদের এর চেয়ে বেশি কাছে আমি যাইনি। তার আগেই আমি জানতাম, মানে, পায়ে চলা মাছ হয়ে যাবার আগেই আমি সেটা জানতাম। তাদের কাছে সেই প্রথম দিনে প্রথমবারের মতো আসতেই আমি সেটা জেনেছিলাম। বানরের নাক-চোখ-মুখ যেমন মানুষ যা বিশ্বাস করে তার উল্টোটাও প্রমাণ করে দিতে পারে, বানররা আমাদের থেকে যত দূরে যায় ততই তা সত্য মনে হয়। মানুষের সাথে পায়ে চলা মাছের সাদৃশ্যের অভাব আমাকে যেন এটা বিশ্বাস করতে উদ্বুদ্ধ করল যে আমি সত্যি সত্যিই পায়ে চলা মাছ হয়ে পড়েছি। আর মনে হলো খামোখাই আমি এমনটা ভাবছি না। মিল বলতে গেলে শুধু তার ছোট্ট হাতগুলো, একই রকমের আঙুল, তা ছাড়া মানুষের সঙ্গে কোথাও এতটুকু মিল নেই। তবে আমার মনে হলো পায়ে চলা মাছের ছোট্ট সোনালি চোখ বসানো ত্রিভুজাকৃতি গোলাপি মাথাটাই হয়েছিল কারণ, যেটাকে কিছুতেই আমি কোনও মাছের মাথা বলে ভাবতে পারছিলাম না। কোণের মাছটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, সে আমার ভাবনা জানত। জানার কথা তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট লেখা থাকত। তারা আসলে কিছুতেই মাছ ছিল না।

আমার মনে হলো এরকম ধরনের একটা প্রাণি নিয়ে কোনও পৌরাণিক কাহিনি থাকতেই পারে, মানে, আমি বিশ্বাস করি যে তা নিশ্চয় আছে। এরকম একটা ব্যাপার প্রাচীন কাহিনিতে থাকতেই হবে। পায়ে চলা মাছেরা একসময় মানুষ হতে শুরু করেছিল, তারপর হতে হতেও হয়নি। রহস্যময় মানবজীবন পাবার আগেই  কোনও কারণে রূপান্তরের প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমি কল্পনা করতে শুরু করলাম যে তাদের বিফলতার কথা তারা জানে। তারা নিজেদের শরীরের কাছে বন্দি, নিরুপায়। তারা যেন অসীম কালের তরে গভীর এক নিস্তব্ধতায় নিমজ্জিত, চরম হতাশার কোনও ধ্যানে আবদ্ধ। ভাষাবিহীন তাদের দৃষ্টি, অভিব্যক্তিহীন নিবু নিবু চোখের চোখধাধাঁনো উজ্জ্বল সোনালি বৃত্তের আকুতি আমার ভেতরটা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিত। তারা শুধু বলত, ‘বাঁচাও, রক্ষা করো আমাদের।’ আমি বিড়বিড় করে তাদেরকে আশার কথা শোনাতাম, উপদেশ দিতাম, শিশুসুলভ স্বপ্ন দেখাতাম। নিজের জায়গায় নিথর দাঁড়িয়ে তারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত তো থাকতই। কেবল থেকে থেকে তাদের গোলাপি ফুলকার ছড়িয়ে থাকা ডালপালাগুলো হঠাৎ করেই শক্ত হয়ে যেত। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমি বুকের মধ্যে বোবা কান্না অনুভব করতাম। মনে হতো তারা নিশ্চয়ই আমাকে লক্ষ করছে, আমার সমস্ত আগ্রহ আর শক্তিকে তাদের জীবনের দুর্বোধ্য কষ্টকে আলিঙ্গন করতে আহ্বান করছে। নিশ্চিতভাবে তারা মানুষ ছিল না, কিন্তু এর আগে আমি কখনও মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণির প্রতি এত তীব্র টান অনুভব করিনি। পায়ে চলা মাছগুলো যেন অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেল, কখনও হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর বিচারক। ওই স্বচ্ছ চোখের মধ্যে কী যে এক তুমুল বিশুদ্ধতা লুকিয়ে ছিল যে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে তুচ্ছ মনে হতে লাগল। তারা তখন তাদের জীবনকালের শূক অবস্থায়। আর শূক মানেই হলো গিয়ে ছদ্মবেশ, এমনকি কল্পিত চেহারাও। আস্তেকদের আদলে তাদের মুখের আড়ালে অভিব্যক্তি ছাড়াই দুর্দমনীয় নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠতে দেখতাম। দেখে মনে প্রশ্ন আসত, অনাদিকাল ধরে তারা কীসের প্রতীক্ষায় থাকে?

আমি তখন ভয় পেতে শুরু করলাম। ভয়টা এজন্যে নয় যে সেখানকার অন্য দর্শক কিংবা দারোয়ান হুট করে আমার খুব কাছে চলে আসবে, বরং এজন্যে যে আমার আসলে ওই পায়ে চলা মাছগুলোর সঙ্গে একা থাকাটা আর সাহসে কুলাচ্ছিল না। ‘কী হে, তুমি তো দেখি ওই মাছগুলোকে জ্যান্তই তোমার চোখ দিয়ে গিলে খাবে, হুম?’ দারোয়ান হাসতে হাসতে বলল একদিন। সম্ভবত সে আমাকে কিছুটা পাগল ভেবেছিল। কিন্তু দারোয়ান যা মোটেও খেয়াল করেনি তা হলো, ওই মাছগুলো, ওরাই তাদের শান্ত আর সর্বগ্রাসী চোখে ধীরে ধীরে আমাকে গিলে ফেলছিল, ওই মানুষখেকো সোনালি চোখগুলো দিয়ে। অ্যাকুরিয়াম থেকে যে  কোনও দূরত্বে থাকলেও আমি কেবল তাদেরই কথা ভাবতাম। শেষে এমন হলো যে, যত দূরেই যাই, কেবল তাদেরই ভাবনা। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আমি যেহেতু সেখানে প্রতিদিন উপস্থিত হই, আবার রাতের অন্ধকারেও কেবল তাদের অনঢ় অস্তিত্বের কথা ভাবি, অন্ধকারে ধীরে ধীরে একটা হাত বাড়াতে দেখি, পরমুহূর্তেই দেখি আরেকটা হাত তাকে জাপটে ধরে। তাদের চোখ হয়তো অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পায়। কারণ তাদের চোখে কোনও পরদা নেই।

যা হোক, এখন আমি জানি যে তখন ব্যাপারটা মোটেও অদ্ভুত ছিল না। এমনটা যেন হবারই ছিল। প্রতিদিন সকাল সকাল যে ট্যাংকটার উপরে প্রায় উপুড় হয়ে আমি তাদের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতাম, তার জন্য তাদের দিক থেকে পুরস্কারটা ছিল সেই কষ্টের চেয়ে বড়। তারা নিশ্চিত ভোগান্তির মধ্যে ছিল। আমার শরীরের প্রতিটা কণা তাদের শ্বাসরুদ্ধকর কান্নার দিকে ধাবিত হতো, যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছত ট্যাংকটার শক্ত আর অমসৃণ তলদেশে। অনমনীয় সেই তলাটাতে তারা কিছু একটার অপেক্ষায় পড়ে থাকত। যেন সুদূর কোনও অতীতে তাদের শাসন করার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে, যেন তার আগের যুগ ছিল তাদের স্বাধীনতার, সেই যুগের পৃথিবী ছিল পায়ে চলা মাছদের প্রভুত্ব চর্চার পৃথিবী। সেই ভয়াবহ আফসোস ছাড়া তাদের ওই বেদনাক্লিষ্ট পাথরের মতো নিথর অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখে অন্য কোনও ভাবনার ছায়া থাকার কথা ছিল না। তরল পরিপূর্ণ যে নরকে তাদের ঠাঁই হয়েছিল, ওই একটি বেদনার অন্তিম চিহ্ন রাখতে রাখতে সেখানে তারা তলিয়ে যেত। প্রমাণের তেমন আশা ছিল না বটে, কিন্তু আমি তাদের দেখাতে চাইতাম যে তাদের না-বলা চিন্তাধারা আমি ধরে ফেলেছি। শুধু তারা জানত আর জানতাম আমি। তাই যা ঘটেছিল তা আমাদের কারও কাছেই অস্বাভাবিক ঠেকেনি। বেমানান লাগেনি যে, অ্যাকুরিয়ামের কাচের ঘেরাটোপে আমার মুখ বরাবর চেপে বসানো, তাদের চোখের মণি আর মণির চারপাশের পৃথকরঙা ঘেরবিহীন সোনালি চোখগুলোর রহস্য পড়তে চাওয়ার আকাক্সক্ষা ক্রমাগত ধাবমান। কাচের খুব কাছে থেকে আমি পায়ে চলা মাছের স্তব্ধ মুখ দেখেছি। সেখানে বিস্ময় বা ভাবাবেগের আভাস নেই। ট্যাংকের অন্যদিকের কাচে আমি আমার নিজের চেপে রাখা মুখের প্রতিচ্ছবিও দেখেছি। দেখে তখনই জেনেছি আর চমকে সরে গেছি।

শুধু একটা ব্যাপার ছিল অদ্ভুত, তা হলো, অবলীলায় এ কথাটা আমার জানা বা বোঝা। একেবারে প্রথমবারের মতো বিষয়টা উপলব্ধি করা যে, আমার মতো একটা মানুষের চোখের সামনে তার অস্তিত্বের জীবন্ত কবর হয়ে গেল। অ্যাকুরিয়ামের বাইরে আমার মুখটা আবারও এগিয়ে এসেছিল, আমি আমার মুখের ছবির দিকে লক্ষ করেছিলাম, পায়ে চলা মাছদের মনোভাব বোঝার নিশ্চিত অনুভবে আমার ঠোঁট সমান্য কুঁচকে ছিল। আমি তখন একটা পায়ে চলা মাছ, তখনই আমি জেনেছিলাম যে আর কিছু বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি লোকটা ছিল অ্যাকুরিয়ামের বাইরে, তার চিন্তাধারা ছিল অ্যাকুরিয়ামের বাইরের মানুষের ভাবনার মতো। তাকে বুঝে নিয়ে, তাকে তার মতো থাকতে দিয়ে আমি জেনেছিলাম যে আমার দুনিয়ায় আমি এক পায়ে চলা মাছ। আর সেটা জানতে পেরে ভয়ে আমি শিউরে উঠেছি যে একটা পায়ে চলা মাছের শরীরে আমি বন্দি। আমার মানুষসুলভ চিন্তাভাবনাসমেত একটা মাছের শরীরে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। পায়ে চলা মাছের শরীরে আমার জীবন্ত অস্তিত্বের কবর খচিত হয়েছে। বোধবুদ্ধিহীন কিছু প্রাণির মাঝখানে অর্থহীন ভাসাভাসা চলাফেরা ছাড়া এখন আমার আর কিছু করার নেই। কিন্তু একটা পা আমার মুখের উপর আঘাত করতেই আমি ভাবনার ঘোর থেকে বেরিয়ে এলাম। ধাক্কার উৎস দেখার জন্য আমি সেদিকে সামান্য ফিরলাম, দেখলাম আমার পাশেই আরেকটা পায়ে চলা মাছ যে আমারই দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট লেখা, কোনও যোগাযোগ সম্ভব নয়, যা সে-ও জানে আর আমিও জানি। অথবা আমি নিজেও আসলে তার ভেতর থেকে কথা বলছিলাম। আমরা দুজনে মানুষের মতো করে ভাবছিলাম, যদিও আমরা অনুভূতি প্রকাশে অপারগ। আমাদের অভিব্যক্তি কেবল জাঁকজমকপূর্ণ চোখের সোনালি দীপ্তিতে সীমাবদ্ধ। আমরা কেবল অ্যাকুরিয়ামের বাইরে দাঁড়ানো কাচের গায়ে মুখ ঠেসে ধরা মানুষটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকতে পারি।

লোকটা আমাদের কাছে বার বার আসত। কিন্তু আজকাল খুব কম আসে। মাঝে মধ্যে আস্ত একটা সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, তাকে দেখি না। কাল অবশ্য তাকে দেখেছিলাম। সে আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল আর তারপর হুট করেই চলে গেল। দেখে মনে হলো আমাদের প্রতি তার সেই আগের টান আর নেই। কিংবা সে হয়তোবা কেবল অভ্যাসের কারণেই ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছে। ক্রমাগত চিন্তা করে যাওয়াই যেহেতু আমার একমাত্র কাজ, তাই তাকে নিয়ে আমি অনেক কিছু ভাবি। আমার মনে হয় আমাদের দেখা হবার প্রথম থেকেই আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছিলাম। আমি জানতাম যে তার মনে আমাদেরকে ঘিরে যে রহস্যের আনাগোনা চলছে তা নিয়ে সে অন্য সমস্ত কিছুর চেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু একসময় তার আর আমার মাঝখানে যোগাযোগের সেতুগুলো কেন যেন ভেঙে পড়ল। কারণ আমাকে নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে থাকতে সে নিজেই এখন একটা পায়ে চলা মাছ। মানুষের জীবনের কাছে এখন আমি অচেনা। আমার মনে হয় একেবারে শুরুর দিকে চাইলে  কোনওভাবে আমি তার কাছে ফিরে যেতে পারতাম। হ্যাঁ, কোনও না কোনওভাবে ঠিকই পারতাম। আর তার ভেতরে আমাদেরকে জানার আগ্রহটাও জারি রাখতে পারতাম। কিন্তু এখন আমি চিরতরে এক পায়ে চলা মাছ হয়ে গেছি। তবে আমি যদি কখনও মানুষের মতো চিন্তায় এতটুকু মগ্ন হই তবে সেটা কেবল এই জন্যে যে, পায়ে চলা মাছ তার পাথরের মতো গোলাপি করোটির ভেতরে ঠিক মানুষের মতোই ভাবনাচিন্তা করে। আমার বিশ্বাস প্রথম দিকে আমি যখন ওই লোকটা ছিলাম, তার সঙ্গে প্রচুর কথাবার্তা বলতে পেরেছিলাম বলেই এটা সম্ভব হলো। আর আজকে আমরা দুজনেই একা। লোকটা আর আসে না। আমি আমাকে সান্ত্বনা দিই এই বলে যে সে হয়তো আমাদেরকে নিয়ে একটা গল্প লিখছে। আমি এই বিশ্বাস নিয়ে খুশি থাকি যে সে গল্পের কাহিনি সাজানোতে ব্যস্ত আছে। পায়ে চলা মাছদের সমস্ত কথা সে নিশ্চয়ই লিখবে।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button