
কুড়িগ্রামে এসে আত্মগোপন করে বিল্লাল হোসেন ওরফে ফাটা বিলাই। মনে হচ্ছে, নামের ওপর বোমা পড়ে বিধ্বস্ত। আসলে তা নয়। এই দেশের মানুষের ক্যারদানির শেষ নেই। অবশ্যই এটাকে সৃজনশীলও বলা যেতে পারে। অন্য কোনও সৃজনশীল কাজ করতে পারুক আর না পারুক, নামের ওপর বোমা মারার ক্যারদানিতে অনেকে ওস্তাদ। এই উপনাম বেশি দেওয়া হয় যারা অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে, বিশেষত সন্ত্রাসমূলক কাজে।
কুড়িগ্রাম এসে ফাটা বিলাই পুরোপুরি সুফি হয়ে গেছে, তা বলা না গেলেও শুধু রাতে ঘুমানোর আগে এক পাইট বাংলা মদ খাওয়া ছাড়া সে শুদ্ধাচার ব্রত পালন করছে, তা হলফ করে বলা যায়। পুরোনো অভ্যাসের মধ্যে এক পাইট মদ্যপান আর ধূমপান সে পরিহার করতে পারেনি। শুদ্ধাচারে আর কোনও ত্রুটি পাওয়া যায় না, মাঝে মাঝে হোটেলে খেয়ে ইচ্ছে করে বিল না দিয়ে চলে আসা ছাড়া। তবে হোটেলওয়ালা যদি খাওয়ার টাকা দেওয়ার জন্য পেছন থেকে ডাক দেয়, তবে হাতজোড় করে বলে, ভাই, ভুল হয়ে গেছে। ভুল তো হতেই পারে। অবশ্যই এতে শুদ্ধাচারের কোনও ত্রুটি বা ক্ষত হওয়ার কথা নয়। শুদ্ধাচারে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কত মানুষ জাতীয় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে, তাতে কি শুদ্ধাচার অশুদ্ধাচার হয়ে গেছে ?
ফাটা বিলাইর শরীরটা আগে শিলকাঠের মতো বেশ মজবুতই ছিল। কিন্তু কুড়িগ্রামে আসার পর থেকে একটু নড়বড়ে হয়ে গেছে, আগের চেয়ে অনেক মাজুল হয়ে গেছে। শহরতলিতে একটি ভাঙা বাসার একটি ছোট্ট রুম ভাড়া নিয়ে একা একা থাকে। সে কখনও রান্না করে না। আগুন দেখলে তার শরীরে এক প্রকার যন্ত্রণা শুরু হয়, শরীর জ্বালা করে, যা সে সহ্য করতে পারে না বলে সে চুলা জ্বালিয়ে রান্না করে খাওয়ার কাজটি জীবন থেকে বিদায় করেছে। সে সিগারেট ছাড়া আর আগুনের কাছে যায় না, এমনকি দূর থেকেও যদি কোথাও আগুন জ্বলতে দেখে সে ভূতগ্রস্তের মতো হয়ে পড়ে এবং তখন সে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। আগুন দেখলে তার শরীরে এক প্রকার মৃদু কম্পন শুরু হয়; হয়তো স্নায়ুবিক বিপর্যয় হতে পারে।
কুড়িগ্রামের জীবনটাকে সে কঠিন নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে নিয়েছে। সকাল নটায় ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি পান করে সিগারেট টেনে প্রাকৃতিক কার্যাদি শেষ করে নিমের ডাল দিয়ে বারান্দায় বসে দাঁত মাজে। তারপর টিউবওয়েলের পানিতে গোসল করে। গোসলের পর দীর্ঘক্ষণ চুল আঁচড়ায়। তারপর লাল রঙের জামা পরে রুমে তালা মেরে আর কোনও দিন খোলা রেখে বের হয়ে গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে শহরে ঢোকে। দুপুরে কোনও ভাতের হোটেলে খায়। তারপর আবার রিকশায় চড়ে এবং রাত নটায় ভাত খেয়ে রুমে ঢোকে। রুমের দরজা খোলা রাখা আর বন্ধ রাখার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ইঁদুর বিড়াল তেলাপোকা চিকা ছাড়া এই রুমে কারও ঢোকার কারণ নেই। একটা ভাঙা চিরুনি, একটা শিমুলকাঠের নড়বড়ে খাটে হালকা তোশকের ওপর একটা তেলচিটে বালিশ ছাড়া এই রুমে থাকার মধ্যে আছে খাটের নিচে একটা বাংলা মদের বোতল। ভুলক্রমে চোর ঢুকলে ঢুকতে পারে কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না রুমের ভেতরের উৎকট গন্ধে। প্রায় এক বছর হয়েছে এই রুমে থাকে ফাটা বিলাই, কিন্তু কোনও দিন ঝাড়ুর সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। সে কুড়িগ্রামে এসে একটি মহৎ গুণ অর্জন করেছে, প্রয়োজন ছাড়া একটি কথাও ব্যয় করে না। এবং কথাও খুব কাটছাঁট। যেমন রিকশার ভাড়া সাধারণত যত ততই চাইবে। কেউ মুলামুলি করলে সে কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকে। ছোট শহর হওয়ায় অনেকে ফাটা বিলাইর আচরণ সম্পর্কে জেনে গেছে। তাই ভদ্রলোক, যারা দরদামের মতো খিঁচাখিঁচি পছন্দ করে না, তারা বিনা বাক্যব্যয়ে তার রিকশায় উঠে গন্তব্যে গিয়ে নির্ধারিত টাকা দিয়ে নেমে যায়। কারও বাক্য ব্যয় করতে হয় না। তিন বেলা খাওয়া, সিগারেট ও সামান্য মদের টাকা ব্যয় করে বাকি গচ্ছিত টাকা মাস শেষে ছোট বোন আকলিমাকে বিকাশে পাঠিয়ে দেয়। হাত ঝেড়ে নতুন মাসের কাজে নামে।
ফাটা বিলাইর অতীত এমন সাদাসিধে ছিল না। হঠাৎও বদলে যায়নি। একটি ঘটনা হয়তো এর কারণ, অথবা একাধিক কারণও থাকতে পারে।
দুই বছর আগেও ফাটা বিলাই ঢাকায় থাকত, আগারগাঁওয়ের একটা বস্তিতে। নারায়ণগঞ্জের কোথাও বিরামপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। গ্রামের বাড়িতে বাবা-মা, দুই ভাই, দুই বোন থাকে। ষোলো-সতেরো বছর বয়সে রোজগারের ধান্দায় সে ঢাকায় আসে এবং এক দুপুরে সে আগারগাঁওয়ের বস্তির পাশে উদ্দেশ্যহীন ঘুরঘুর করতে থাকে। মনে তার একটা আশ্রয় বা কাজের প্রত্যাশা ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরঘুর করে কোনও আশ্রয় না পেয়ে রাতে পাশের একটি চায়ের স্টল থেকে একটি বানরুটি, এক গেলাস পানি আর এক কাপ চা খেয়ে একটি দোকানের সামনে পড়ে থাকা বেঞ্চিতে রাত কাটানোর জন্য ঘুমিয়ে থাকে। ওই রাতে টহলরত পুলিশ তাকে ছিনতাইকারী শনাক্ত করে থানায় নিয়ে কেস ঠুকে দিয়ে জেলে পাঠায়। ছয় মাস জেলে ছিল। বলা যায়, জেলখানা হলো নিরপরাধের চোখ ফোটানোর ইনকিউবেটর। এখানে সিনিয়র অপরাধীদের সঙ্গে মিশে গাঁজা-মদ খাওয়ার পহেলা সবক নেয় এবং চর্চা শুরু করে। সিনিয়ররা খুব দয়ালু ও উদার, তারা জুনিয়রদের চোখ ফোটানোর জন্য সবক দিতে কোনও প্রকার কার্পণ্য করে না। কোথায় কোন অপরাধ কীভাবে করতে হয়, সব বিদ্যার সুব্যবস্থা জেলখানায় রয়েছে।
জেলফেরত বিল্লাল আগারগাঁও বস্তিতেই একটি ছাপরা ভাড়া নেয়। এই ছাপরা ভাড়া নিতে জেল থেকে এক সিনিয়র বলে দিয়েছিল তার এক চেলাকে। এই চেলা ছাপরার ব্যবস্থা করে দিলে সে তার সতীর্থ হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে সঙ্গ পেতে শুরু করে। বিনিময়ে যে উপহারটি পেল, তা হলো―একদিন ছিনতাই করতে গিয়ে সতীর্থ ধরা খেলে সে মারামারি শুরু করে দেয়। তখন আনকোরা বিল্লালও পাশে ছিল এবং সতীর্থকে উদ্ধার করতে গিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। পরে সতীর্থকে উদ্ধারকাজে সফল হয়ে বস্তির ছাপরায় এসে আবিষ্কার করে, তার নাক ফাটা এবং রক্ত পড়ছে। সেই কয়েক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে ‘ফাটা বিল্লাল’ তারপর ‘ফাটা বিল্লাই’ এবং শেষে শব্দের অপভ্রংশ হয়ে ‘ফাটা বিলাই’ উপাধি লাভ করার সৌভাগ্য হলো তার।
শুরু হলো ফাটা বিলাইর নতুন জীবন। নতুন জীবন থেকে আমাদের গল্পটি হওয়া উচিত। তার জন্মরহস্য কিংবা শৈশব- কৈশোর এই গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কোনও উপাদান নয়। কারণ, সাধারণত বাংলাদেশে সাত পাকের সংসারে নিম্নবিত্তের পরিবারের একটি ছেলে যেভাবে বেড়ে ওঠে, প্রথমে স্কুলে যায় তারপর ঝরে পড়ে, তারপর এটা-সেটা করে―এ-রকমভাবেই বিল্লালের শৈশব-কৈশোর কেটেছে। রোজগারের আশায় ঢাকায় আসার পর তার জীবনে ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা এবং ক্লাইমেক্সের চূড়ান্ত ঘটনার কারণে আত্মদহনে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন উপভোগ করতে সে নিভৃত মফস্বল শহর কুড়িগ্রামকে বেছে নেয়।
আগারগাঁওয়ের সতীর্থ মোটা রশিদ, মোটাসোটা বলে তার উপনাম হয়েছে ‘মোটা রশিদ’―ভালো নাম মো. আবদুর রশিদ। এই মোটা রশিদের সঙ্গে সে শহরে ঘুরে বেড়ায় এবং সুযোগমতো মোবাইল ছিনতাই করে বিক্রি করে রোজগার করতে শুরু করে। ছিনতাইয়ের পাশাপাশি দুজনে গাঁজার পুরিন্দা, ইয়াবা ট্যাবলেট, ফেনসিডিল ওরফে ডাইলও বিক্রি করে। মৌসুমি ব্যবসায়ীর মতো যখন যা পাওয়া যায়, তখন তাই করে। ইয়াবা ট্যাবলেট শুধু বিক্রি করে না, নিজেরাও সেবনের অভ্যাস করে। কাঁচা টাকা হাতে আসায় ধরাকে সরা জ্ঞান করে। ইচ্ছেমতো খাও আর উড়াও। বাড়িতে বাবাকে একটি টিনের ঘর করে দিয়েছে। পঞ্চাশ শতক ধানি জমিও কিনে দিয়েছে।
টাকা যেভাবেই আসুক, তার সুবাস ছড়ায়। ফাটা বিলাইয়ের টাকার সুবাস গিয়ে লাগল বস্তির পাশে একটি বাসার এক মাংস ব্যবসায়ীর মেয়ে মুন্নির গায়ে। মুন্নি স্থানীয় একটি গার্লস স্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে। (মেয়েটির নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার্থে মুন্নি ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং স্কুলের নাম উহ্য রাখা হয়েছে।)
এই মুন্নি স্কুল শেষ করে এবং মাঝে মাঝে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে ফাটা বিলাইয়ের সঙ্গে চন্দ্রিমা উদ্যানে চলে যায়। কিছুদিন যাওয়ার পরই সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে উত্তর পাশের ঝোপের আড়ালে দুজনই নিঃস্ব হয়। এভাবে তাদের বন্ধন আরও নিবিড় হতে থাকে। একদিন ছিনতাই করা একটি স্মার্টফোন ফাটা বিলাই মুন্নিকে উপহার দেয়। গভীর রাতে চলতে থাকে তাদের প্রেমালাপ এবং মুন্নির পরীক্ষার পর দুজনে পালিয়ে বিয়ে করবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয় মুন্নি। ফাটা বিলাই ইয়াবা থেকে যা আয় করে, ইচ্ছা করলে সে ভালো বাসা নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার কথা ভাবে না। তার স্বপ্ন অনেক বড়। মুন্নিকে বিয়ে করে বাসা নেবে, মুন্নিকেও জানিয়ে দেয়। উপহারসামগ্রীর পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ার খরচ বাবদ মুন্নিকে সে মাসোহারাও দেয়।
ফাটা বিলাইয়ের সঙ্গে মুন্নির খোলামেলা প্রেমলীলা দেখে মোটা রশিদ ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে এবং সে মনে করে, বিলাইয়ের চেয়ে তার স্বাস্থ্যচেহারা বেশি ভালো, মজবুত আর টাকাও বেশি; তাহলে সে তাকে ভালোবাসবে না কেন ? মনে মনে বলে, ‘আমাকে কি চোখে দেখে না ? ছিনতাইকারী হিসেবেও সিনিয়র। তাহলে সে কেন বিলাইকে ভালোবাসে ?’ এসব বিবেচনা করলে অবশ্যই তার গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেশি এবং মুন্নির উচিত ছিল মোটা রশিদকেই ভালোবাসা। একেই হয়তো বলে নিয়তি। নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে মোটা রশিদ চিন্তামুক্ত হতে পারত কিংবা প্রেমের বেড়াজালে মুন্নিকে আটকানোর চেষ্টা করলেও পারত। কিন্তু তার দ্বিতীয় চিন্তাটি কুৎসিত এবং জঘন্য, যা মুন্নি মেনে নিতে পারেনি। সে মনে করেছে, ফাটা বিলাইয়ের সঙ্গে এই বয়সে যেহেতু খোলামেলা প্রেম করে এবং টাকাপয়সাও নেয়, সেহেতু মেয়েটি চরিত্রহীনা এবং টাকা খরচ করলে তাকে ব্যবহার করা যাবে। সে সরাসরি টাকার বিনিময়ে কুপ্রস্তাব দেয় এবং পরে পস্তায়। ওর মাথাটা একটু মোটাও। ফাটা বিলাইয়ের কাছে মুন্নি মোটা রশিদের কুপ্রস্তাবের কথা ফাঁস করে দিলে ওদের বন্ধুত্বের মধ্যে চুলফাটা দেখা দেয়। তবে মোটা রশিদ আত্মসমর্পণ করলে (যদিও গোপনে গোপনে তৎপরতা চালিয়ে যায়) দুজন পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায়। বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়।
দুজনের গলায় গলায় সম্পর্ক।
একদিন মোটা রশিদ প্যান্ট-শার্ট-টাই কিনে আনে। একজনের কাছে টাইয়ের নট দেওয়ার কৌশলও রপ্ত করে। তার হাতে একটা প্যাকেট। প্যান্ট-শার্ট-টাই পরে যখন ফাটা বিলাইয়ের কাছে আসে, তখন বিলাইয়ের চোখের আয়তন বেড়ে যায়। ফাটা বিলাই জিজ্ঞেস করে, ‘ব্যাপার কী দোস্ত ?’
মৃদু হেসে মোটা রশিদ বলে, ‘ভদ্রলোক হইলাম। এখন ছিনতাই করলে কেউ কথা বললে হিসাব কইর্যা কথা কইবো। বুঝলি ? এই নে তোর জন্যও আনলাম।’
সে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলে ফাটা বিলাই হাসতে হাসতে প্যাকেট খুলে দেখে একটি নীলচে প্যান্ট ও হালকা গোলাপি রঙের শার্ট এবং মেরুন রঙের টাইয়ের ওপর ছোট ছোট বুটি। ফাটা বিলাই হাসতে হাসতে মরে।
মোটা রশিদ টাই বাঁধা শেখায়।
ওরা প্রতিদিন প্যান্ট-শার্ট-টাই আর শু পরে পকেট মারতে বা ছিনতাই করতে বের হয়। মোটা রশিদ কারও মানিব্যাগ কিংবা অন্য কিছু ছিনতাই করলে পাশে থাকা ফাটা বিলাইয়ের হাতে চালান করে দেয়, তারপর দুজন দুদিকে চলে যায়। এভাবে তারা বহুমাত্রিক কোম্পানির মতো অনেক প্রকার কাজে জড়িয়ে যায়। পোশাকে-আশাকে ভদ্রলোক হওয়ায় চোখের সামনে মানিব্যাগ সরিয়ে ফেললেও কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না―একদিন বাসে তাই প্রমাণিত হলো।
মুন্নিকে কুপ্রস্তাব দেওয়ার পর সে মোটা রশিদকে খুব তেজ দেখিয়েছিল। এই তেজের অহংকারকে চুরমার করে মুন্নির প্রতি তার প্রেমকে সার্থক করতে গোপনে গোপনে বস্তির কমলা ভাবিকে লাগিয়ে দেয়। মোটা রশিদ টাকাও খরচ করতে থাকে। সে মুন্নিকে টাকা দিয়ে কিনতে চায় আর কমলা ভাবিকে পারিতোষিক দিয়ে খুশি করে। কমলা ভাবি আবার মুন্নির হাতখরচার টাকা থেকে কিছু নিজের কাছে রেখে দেয় গোপনে। প্রতিদিনই কমলা ভাবির কাছ থেকে অগ্রগতির রিপোর্ট নেয় মোটা রশিদ। কমলা ভাবিও বানিয়ে বানিয়ে নানা কথা বলে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখে। মোটা রশিদ রোমাঞ্চিত হয়।
একদিন সন্ধ্যায় জিপিওর সামনে এক ব্যক্তি প্রাইভেট কারের জানালা খোলা রেখে মোবাইল ফোনে কথা বলছিল, তখন মোটা রশিদ সুযোগমতো মোবাইল নিয়ে চম্পট। মোবাইলের মালিক একজন বড় পুলিশ কর্মকর্তা, যা রশিদের জানা ছিল না। তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলেন। বস্তিতে এসে সে দেখে, অনেক দামি মোবাইল সেটÑ মোটা রশিদ খুশিতে গদগদ এবং নিজের নিরাপত্তার জন্য মোবাইলটি ফাটা বিলাইয়ের কাছে রাখে।
পুলিশ বিভাগের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফাটা বিলাইয়ের কাছে পাওয়া গেল মোবাইল সেট। তার জবানবন্দি অনুযায়ী মোটা রশিদ ও ফাটা বিলাই প্রথমে থানা হাজতে ধোলাই খেয়ে শরীরের পরিমাণের অতিরিক্ত বাতরস সঞ্চয় করে। পরে বিচার-আচারের মাধ্যমে জেলে থাকে তিন বছর। মোটা রশিদ চুরি করল, তার সাজা হলো কি না দুই বছর। ফাটা বিলাইয়ের হলো তিন বছরের সাজা। জগতের বিচার এমনই হয়।
এবার জেলে গিয়ে আরও সিনিয়র পেয়ে যায় ফাটা বিলাই এবং উচ্চ ক্লাসের ছাত্র হিসেবে সবক পায়। সে যেন আগারগাঁওয়ে না থেকে অন্যত্র থাকে, সে ব্যবস্থা করে দেয় এক সিনিয়র। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থাকার ব্যবস্থা হবে মালিবাগ এলাকায়। ছিনতাইয়ের মতো ছোটলোকী কাজ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শও দেয় ওই সিনিয়র। তাকে হতে হবে চাঁদাবাজ। চাঁদাবাজদের সমাজে আলাদা মর্যাদা। মানসম্মানও কম না। এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের ওঠাবসার সুযোগ আছে। বলতে গেলে, জেলখানা থেকেই তার একটা বড় প্রমোশন হয়েছে।
মালিবাগ থাকার ব্যবস্থা হলেও তার মন পড়ে রইল আগারগাঁওয়ে। তাই প্রথমে সে আগের জায়গায় ফিরে আসে। তবে ভাগ্য অনুকূলে রইল না। সে আগারগাঁওয়ে এসে দেখে, অন্য একজন ভাড়াটে উঠে গেছে তার ছাপরায়। আর মুন্নি মোটা রশিদকে বিয়ে করে বস্তির পাশে একটি এক রুমের বাসায় থাকা শুরু করেছে। মুন্নির পরামর্শে মোটা রশিদ ছিনতাই ছেড়ে দিয়ে কাঁচামালের ব্যবসা শুরু করে। মুন্নিকে দেখার পর তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। নিজেকে সংযত রেখে বলল, ‘কী রে মুন্নি ? তুই কী করলি ? আমার বুকে চাক্কু মারলি ক্যান ?’
মুন্নির সাফ সাফ জওয়াব, ‘তুমি যে ছিনতাইকারী তা আগে জানলে তোমার দিকে তাকাইতাম না। তোমারে আমি ঘিন্না করি। তারপর তুমি গেলা জেলে। আমি কি বিয়া ছাড়া থাকুম ?’
মুন্নির কথা শুনে ফাটা বিলাই শেকড় কাটা লাউগাছের মতো মিইয়ে যায়। নিজেকে কোনও রকম সংযত করে একটা অশ্লীল গালি দিয়ে সে আগারগাঁও থেকে প্রস্থান করে।
সেদিন ফাটা বিলাইর মনে হয়েছিল, ভালোবাসা ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন।
তার চারপাশ খুব ফাঁকা মনে হতে থাকে। মনে হয় তার কেউ নেই। তার পায়ের নিচেও মাটি নেই। মুন্নি কীভাবে পারল তাকে ত্যাগ করতে, সে বুঝে পায় না। তার মনে হয় অসীম শূন্যতায় সে বুদ্বুদের মতো ভাসছে।
ভাসতে ভাসতে জেলের সিনিয়রের পরামর্শ অনুযায়ী সে মালিবাগের একটি বাসার ব্যাচেলর রুমে থাকা শুরু করে। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় রেললাইনের আশপাশের ছোট দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন চাঁদা তুলে জাহিদের কাছে জমা দিতে। এই কাজে সে নিরাপদ বোধ করে এবং ছিনতাইকারীর মতো যখন-তখন ধরা খেয়ে মার খাওয়া থেকে বেঁচে যায়। এখন তার মনে হয় মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়া আছে। পুলিশের হাতে ধরা খেলেও বটবৃক্ষরা ছাড়িয়ে আনবে, যেমন সিনিয়রদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া চাঁদার কিছু টাকা পুলিশের হাতে যাওয়াতে নিরাপত্তার ব্যূহ আরও সুদৃঢ় হয়। চাঁদাবাজি ছাড়া সাইড বিজনেস হিসেবে ইয়াবা বিক্রি করে। কারণ, ইয়াবা ব্যবসার মুনাফা অনেক বেশি। এই কাজের জন্য অবশ্যই বটবৃক্ষেরও ইশারা আছে।
আবার হাতে কাঁচা টাকা আসতে শুরু করে এবং উদার হস্তে খরচ করতেও থাকে। বাবাকে আরও পঞ্চাশ শতক জমি কিনে দিয়ে সে সুপুত্রের দায়িত্ব পালন করে নিজে ভারমুক্ত হয়। এখন ছোট বোন আকলিমার বিয়ে দিতে পারলেই সংসারের সব দায়িত্ব থেকে তার মুক্তি। তারপর নিজের সংসার করবে কি করবে না চিন্তা করা যাবে। টাকার স্রোত দেখে সে শহরে ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখে। রাজনীতি করার স্বপ্নও দেখে। প্রথমে কমিশনার তারপর এমপি।
ফাটা বিলাই আবার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে মালিবাগের এক মেয়ে, মিলির (ছদ্মনাম) সঙ্গে। সে মুন্নির চেয়ে সুন্দরী হলেও লেখাপড়া করে না। সেভেন পর্যন্ত পড়ে এখন বিয়ের পিঁড়িতে বসার অপেক্ষায়। এই অবসর সময়ে ফাটা বিলাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সময়টা ভালোই কাটে। হাতখরচটাও পায়। তারা দুজন সময় সময় একত্র হয় এবং দুজন দুজনকে সবটুকু উজাড় করে দেয়। তবে ফাটা বিলাইকে মুন্নি যেভাবে ভালোবাসত, সে ভালোবাসা মিলির মধ্যে নেই। কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব। মিলিও জানে, সে অবসর সময় পার করছে আর ফাটা বিলাইও জানে যে, এই সম্পর্ক কেবল শারীরবৃত্তীয়, মানসিক কোনও টান নেই। মুন্নি সব প্রেম নিয়ে গেছে, প্রেম বলতে যা বোঝায়, তার মনে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। যখন তার মুন্নির কথা মনে হয়, তখন নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে। আর এই দহনকে নিবারণ করতে সে কোনও কোনও রাতে অতিরিক্ত মদ্যপান করে অথবা ইয়াবা সেবন করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। বাইরের আগুন নির্বাপণ করা যায়, কিন্তু মনের আগুন নির্বাপণ করা যায় না।
চাঁদাবাজ হিসেবে ফাটা বিলাই এলাকায় মোটামুটি পরিচিতি পেয়েছে। তবে পরিচিতি যতই থাক না কেন, তাকে চাঁদা তুলতে হয় বড় ভাই গাউসের (ছদ্মনাম) নামে। গাউসের কথায় তাকে উঠতে-বসতে হয়। গাউসের কত সিনিয়র আছে, তা অবশ্যই সে জানে না। সবার সিনিয়র হলেই তাকে গডফাদার বলা হয়। ফাটা বিলাই সে পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। গডফাদারদের যোগ্যতা নাকি অনেক বেশি। তাদের শিক্ষাদীক্ষাও অনেক। রাষ্ট্রের কলকবজাও নাড়াচাড়া করতে পারে। এত দূর পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন সে দেখে না, সে গাউসের জায়গাটি দখল করা পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্ন, একসময় এলাকায় তার নামে চাঁদা তুলবে আর ব্যাগ ভরে টাকা বাসায় দিয়ে আসবে এখন সে যেমন করে। কী যে এক অদৃশ্য শক্তি গাউসের! সে বসে থাকে চারতলা ভবনের এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে আর জায়গামতো গিয়ে বললেই হয়, বড় ভাই গাউস পাঠাইছে। ব্যস, খামভর্তি টাকা হুড়হুড় করে চলে আসে হাতে। সে ভাবে: একদিন কিছু চেলা গিয়ে বলবে―বড় ভাই ফাটা বিলাই পাঠাইছে…। আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! ধরাছোঁয়ার বাইরে সে বসে থাকবে এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে আর তারা ব্যাগভর্তি টাকা দিয়ে যাবে।
এক রাতে ঠিক নটার সময় ফাটা বিলাইয়ের দরজায় টোকা পড়ে। দরজা খুলে দেখে এক অচেনা মানুষ। সে ভেতরে নিয়ে চেয়ারে বসতে দেয়।
লোকটি বলে, ‘যেহেতু এই লাইনে কাম করেন, তাই…বুঝেন তো সব কামে চেনা-পরিচয় দেওয়া লাগে না।’ কথা শেষ করে সে একটি খাম ধরিয়ে দেয় ফাটা বিলাইয়ের হাতে, তারপর বলে, ‘বিশ হাজার আছে। আরও ত্রিশ হাজার পাবেন কাজ শেষে। আমিই দিয়া যাইবো। কোনও চিন্তা নাই।’ তারপর বাম হাতে রাখা সতর্কতার সঙ্গে আরেকটি ছালার ব্যাগ দিয়ে বলে, ‘আইজ রাতেই গুলিস্তানের যে কোনও বাসে ঢিল দিয়া ভিতরে ফ্যালাইবেন। ফালাইয়া যত তাড়াতাড়ি পারেন দৌড়ে পালাইবেন যেন কেউ ধরতে না পারে।’
লোকটি আর বসেনি। যেহেতু টাকা নিয়েছে তাই কাজ করতেই হবে। না-হয় তার জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। দশটার সময় খেয়েদেয়ে ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে গুলিস্তানের মোড়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ গাজীপুর থেকে আসা একটি বাসে ব্যাগ থেকে বের করে বস্তুটি নিক্ষেপ করে। মুহূর্তের মধ্যে বিকট শব্দে বাসের ভেতরে আগুন জ¦লে ওঠে। ফাটা বিলাইর পেছনে তাকানোর সময় নেই। সে দৌড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে জনতার ভিড়ে মিশে যায়। তারপর সুযোগমতো রিকশায় চড়ে বাসায় ফেরে। বাসে কী ঘটল, তার দেখার বিষয় না। সে টাকা পেয়েছে, টাকার বিনিময়ে কাজ করেছে, ব্যস। এর বাইরে তার কিছু জানার বা বোঝার কোনও প্রয়োজনও নেই।
কাজটি সেরে আসার ঠিক আধা ঘণ্টার মধ্যে লোকটি এসে আরও ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে পিঠ চাপড়ে অভিনন্দন জানিয়ে অন্তর্হিত হয়। ফাটা বিলাই ভেবে পাচ্ছে না, কে এই লোক। কেনই-বা বাসে বোমা ফাটানোর জন্য টাকা দিল।
সবকিছু ছাপিয়ে তার মুন্নির কথা মনে পড়ে। মুন্নির কথা মনে পড়তেই মদের বোতল নিয়ে বসে অথবা ইয়াবা সেবন করে ঝিম ধরে পড়ে থাকে। আজও মুন্নির কথা মনে পড়ে, আবার গুলিস্তানের বাসের আগুনের শিখা চোখে ভাসতে থাকে। একটি মেয়ের একটা চিৎকার কেবল কানে লেগেছিল। তারপর সে সেই স্থান থেকে সটকে পড়ায় কী হয়েছে মনে পড়ছে না। তার মনে হচ্ছে, আগুনের শিখাটি যেন দাউ দাউ করে জ¦লছে আর সারা শহরকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে।
ফাটা বিলাই মদের বোতল নিয়ে বসে এবং ঢক ঢক করে গিলে প্রায় অচেতন হয়ে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে থাকে।
ভোরে মোবাইল ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে ফাটা বিলাইয়ের। ফোন করে তার ছোট ভাই আলাল। আলালের কণ্ঠে ভীতসন্ত্রস্ত ভাষা, বলে, ‘তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলের গেইটে আইয়ো।’
আলালের কথা শুনে তার শিরদাঁড়ায় বয়ে বেড়ায় একটি হিমধারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটে গিয়ে দেখে, আলাল কান্নায় ভেঙে পড়েছে। সে অস্ফুট উচ্চারণে বলে, ‘গুলিস্তানের বাসে পেট্রল বোমায় বাবা মারা গেছে আর আকলিমার শরীর পুইড়া গ্যাছে। সে বাঁচে কি না সন্দ, এখনও কওন যাইতাছে না।’ সে আরও জানায় যে, গত রাতে ওই বাসের দশজন মানুষ জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে।
আলালের কথা শুনে ফাটা বিলাই পাথরের মানুষে পরিণত হয়। কারণ, রক্তমাংসের মানুষ হলে স্থির থাকা সম্ভব হতো না। সে হয়তো পাগল হয়ে যেত অথবা মূর্ছা যেত। কিন্তু তার যেন কিছুই হয়নি।
বাবাকে দাফন করে আকলিমার চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যায় ফাটা বিলাই। ছয় মাস পর আকলিমা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। তার বুক পুড়ে গেছে এবং স্তন কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আকলিমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। এখন এই মেয়েকে কে আসবে বিয়ে করতে ? এই জগতে এমন কোনও মানবরূপী ফেরেশতা কি আছে ?
আকলিমাকে বাড়িতে রেখে ফাটা বিলাই অভিশপ্ত ঢাকা ছেড়ে কুড়িগ্রামে আত্মগোপন করে। হয়তো আত্মদহনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে অথবা আকলিমার সমপর্যায়ে যন্ত্রণা পাওয়ার লক্ষ্যে সে দূরে মফস্বল শহরে নিঃসঙ্গ জীবনকে বেছে নিয়েছে। আর যা রোজগার করে নিজে বেঁচে থাকার মতো খায়খরচা বাদ দিয়ে বাকি সব টাকা আকলিমাকে পাঠিয়ে দেয়।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ