
সব যে হয়ে গেল কালো, নিবে গেল দীপের আলো,
আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে ?।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
পায়ে চলা পথ ধরে আনমনে হাঁটছি।
শোনা যায়, এই রাজধানী পায় এক মেয়র। আভিজাত্য আর রুচির প্রশ্নে আপসহীন। অচেতন অমানিশার অতলে তলিয়েও বজায় রেখেছেন রুচি। সুদূর ইউরোপের দামি ও নামি হাসপাতাল ছাড়া কখনও, এমন কি রোগশয্যাও করেনি গ্রহণ। মরণকালেও গ্রহণ করেনি দেশীয় মলিন বিছানা। মানতে হয়, ভাগ্যগুণে রাজধানীবাসী পায় এমন সমঝদার মেয়র!
সে এক সময় গেছে, এবড়োখেবড়ো থাকে নগরের পায়ে চলা পথ। পথ থাকে হকারের জঞ্জালে আকীর্ণ। খানাখন্দে ভরপুর বিপজ্জনক ফুটপাথ দিয়ে আনমনে হাঁটা যায় না। হকারের জঞ্জাল ডিঙিয়ে লাফানো আরও দুষ্কর। উপকথার আলোকিত সমঝদার সেই মেয়রের বদান্যতায়, পদে পদে বিপজ্জনক ফুটপাথ আজ দেশি টাইলসে মোড়ানো। আরামে হাঁটা যায়, তাই সতর্কতাহীন। দখলদার বাধা হয় যদিবা ঠাঁয়ে ঠাঁয়ে, সেও পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় হুজ্জত ছাড়াই।
এমন মসৃণ পায়ে চলা পথের পর পচা মাংসের গন্ধব্যূহে আচানক আটক হয় আনমন। থমকে দাঁড়াতে হয়; কিন্তু তিষ্ঠিতে পারি না ক্ষণকাল! সজাগ হয়েছে দৃষ্টি। এখানে বহমান সরল রাজপথ। এখানে স্তব্ধ বাতাস। রাজপথের কালো পিঠে প্রাচুর্যময় সোনালি আলো। পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে দিনমণি। প্রখর তবু তাপের তেজ। আমিষ পচা গন্ধ এখানে রচনা করেছে বৃত্ত।
প্রসারিত দৃষ্টি মেলে পলকে দেখি চাপ চাপ মাছি। পচা-গলা এক পা আশ্রয় করে―করে থিকথিক, করে ভনভন! গজ দুই দূরের থিকথিকে কালো মাছির চাপ ত্রস্ত কদমে পার হয়ে যাই। পিছন ফিরে আর তাকাই না। আমিষ পচা গন্ধে আটক তবু আমি।
পিছন ফিরে তাকাই না, তবু কখনও বাঁকা চোখে দেখি ঠিক, শায়িত এক নারী! নারীর মুখ মায়াময়। টাইলসে মোড়ানো মসৃণ ফুটপাথে বাঁপাশ ফিরে শায়িত আছে নারী। শয্যাবিহীন! চোখের পাতা খোলা নাই। ঘুমিয়ে আছে! ঘুমিয়ে আছে কি ?
এখানে দাঁড়িয়ে আছে তরুণ গাছ। গাছের পাতা কচি আর সবুজ। ঘন নয় খুব, ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় দুই চিমটি আকাশ। কচিপাতার ফাঁক দিয়ে এসেছে এক ফালি সোনা রোদ। শায়িত নারীর গালে আঁকা আছে মনে হয়, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছোপ আর সোনালু রোদ্দুর। কতিপয় বেয়াড়া মাছি চেটে নিচ্ছে গালের রোদ, মুদিত আঁখিপাতার মিহি শুদ্ধতা, ঠোঁটের ভাঁজে বসাচ্ছে কামড়। কেন যে তবু মাছি তাড়ায় না নারী!
গন্ধব্যূহ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছি। এখন চৌরাস্তায়। পিছনে ফেলে এসেছি শয্যাহীন শায়িত নারী। জীবিত নারী, তবে অচেতন! জীবিত ও চেতন―আসলে ঘুমন্ত ? জীবিত নয় মৃত; কেবলই মৃত তাই কি মনে হয় ঘুমন্ত ?
আমি আর পিছনে ফিরব না। যাব না আমি ডানে কি বাঁয়ে। যাব আমি বরাবর সূর্যমুখী। চোখের উপর ঢলে পড়েছে অস্তগামী সূর্য। বড্ড কড়া তবু তার পতনের আলো। ডানে ও বাঁয়ে সড়ক ধরে বহে চলে ক্ষিপ্র মাতাল বাস। বিরামহীন! পথ পেরুবার সাহস হয় না! কখন চাপা পড়ি। ভয় হয়। চোখে ঠুলি পরে কেবল অপেক্ষা। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লেই পাড়ি দেব পথ।
পিছনে ফেলে আসা পথের দিকে আমি আর ফিরে তাকাই না। ফেলে আসা বহু যুগ আগের কৈশোরে, নিশুতি রাতের অন্ধ পথ পাড়ি দিয়ে দরোজার কাছে পৌঁছুলেই, আবার পিছন ফিরে তাকানোর এক দুর্নিবার আকর্ষণ আসে। মনে হয়, এই বুঝি জিন-পরি-পেত্নি খপ করে ছিনিয়ে নিবে আত্মা। তারপর তারার আকাশে বহুকাল উড়ে উড়ে শিমুলের ন্যাড়া ডালে ঝুলিয়ে দেবে। একবার দেখতে ইচ্ছে করে সেই অরূপ পেত্নির মুখ। কিন্তু পিছনে তাকাতে সাহস হয় না। পড়িমরি ঢুকে যাই ঘরের নিরাপদ দুর্গে।
আজ এই বিকেলের আলোয় একবার ফিরে দেখে আসা যায় শায়িত নারীর মায়াময় মুখ। মন্দ হয় না মোটেও, যদিবা পরখ করা যায়―নারী সে মৃত, না জীবিত ? অথবা ভাবা যায় ঘুমন্ত সে! সে যেমন তেমন অবস্থারই হোক, কিছু তার স্থির ও চলচ্ছবি হতে পারে দারুণ। এ ছবির প্রচারমূল্য পাওয়া যাবে আশাতীত। মাছিতে আবৃত মাংস পচা পা। পচা মাংস ঝরে আর্দ্র পাটখড়ির মতো বেরিয়ে আছে কিঞ্চিৎ হাড়। স্থির ছবি হয় এমন ? চলচ্ছবির চিত্ররূপ, ফেড ইন―মুদিত চোখের মায়াময় নারীর মুখ। মুখ থেকে ক্যামেরা প্যান করবে। মাংস খসে যাওয়া পায়ের পাতায় ক্যামেরা স্থির হবে। পচা আমিষে মাছি বসছে, মাছি উড়ছে, ভনভন শব্দ হচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে পিচঢালা রাজপথ। বাঁ হাতে নাক চেপে সন্তর্পণে পার হয়ে যায় পথচারী। সকলেরই জাগে তীব্র ঘৃণা।
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করো। ফোন ক্যামেরায় ছবি তোলো। অন্তর্জালে জড়ানো ভাইরাল জগতে আপলোড করো। আলোচনায় তোলপাড় হয়ে যাবে জগৎ-সংসার। তারপর সকলই সহজ। কিন্তু আমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরা নাই।
আমার পকেটে জেগে উঠে প্রবীণ দিনের মোবাইল ফোন। ‘কাল আমরা শহিদ মিনারে যাব। আমি আর বাবা। কেন ? জানো না!’
প্রতিদিন প্রতি প্রহরে দুপুরে রোদ্দুরে; প্রতি রাতে প্রতি প্রহরে আঁধারে ঝড়ে; আমার আত্মজা ঘোষণা করে―কাল আমরা শহিদ মিনারে যাব। আমি আর বাবা। যদিও আমরা কোনওদিন শহিদ মিনারে যাই না। আমরা কোনওদিন শহিদ মিনারে যাইনি। সাত প্রজন্ম স্মৃতি-বিস্মৃতির ওধারে শহিদ মিনার। আমরা কখনও সাত প্রজন্ম স্মৃতি-বিস্মৃতির নদী পাড়ি দিয়ে শহিদ মিনারে যাই না। আমাদের প্রতিজ্ঞা আমরা মুঠোফোনে জমা করেছি। যখন তখন জেগে উঠে পণ, আমরা পুলকিত হই, আমাদের আরাম লাগে, আমরা মজে থাকি। বালক পুত্রের কাছে আমি আর আমার কন্যা রহস্য করি―কাল আমরা শহিদ মিনারে যাব। কেন ? জানো না! কন্যার মা ফিসফাস পায় টের। কী শলা করিস রে তোরা ? সমস্বরে রাষ্ট্র করি আমাদের ষড়যন্ত্র, আমাদের পণ―কাল আমরা শহিদ মিনারে যাব। কেন, জানো না!
ফেলে এসেছি সরল পথ। মুখের উপর ঢলে পড়া রবির উত্তাপ, আলো। অস্তগামী তবু বড্ড কড়া! দৃষ্টি পুড়ে যায়। আঁখিপাতা মুদে যায়। তাকিয়ে থাকলে চোখ আঁধার করে আসে। জলে ভরে যায় চোখ। মুদিত আঁখি, পোড়া দৃষ্টি, তারপর অনিশ্চিত আরাম, তারপর লাগে ছায়াময়, তারপর পিঠে সেঁটে থাকে আলোকেশ্বর। এখন পিঠে নিয়ে সূর্যফুল পৌঁছুতে পারি সোজা শহিদ মিনার। কিন্তু আমি পাড়ি দিই চৌরাস্তার পুলসেরাত। কন্যার জমা করা কণ্ঠ, রোধ করতে হবে।
আঙুলের ঘষায় ঘষায় মোবাইল ফোন বাটনের লাল সবুজ চিহ্ন গেছে মুছে। আন্দাজে আর অভ্যাসে সবুজ বাটন টিপে দিলেই কন্যার সঞ্চিত কণ্ঠ রহিত হয়। চৌরাস্তা পাড়ি দিয়ে নিরাপদ ফুটপাথের উপর দণ্ডায়মান পাবলিক টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে, কন্যার মজুদ কণ্ঠ স্তব্ধ করি। মুঠোফোন কানে ঠেকালেই কন্যার জ্যান্ত কণ্ঠ, সঙ্গীতের আবেশে মগজের কোষে কোষে ছড়ায়।
হ্যালো বাবা―
মা বলো―
তুমি কোথায় ?
আমি, এই তো বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। কেন ?
ও, আচ্ছা বাবা―তুমি কি আসার সময় আমাদের জন্য খাওয়ার কিছু আনতে পারবা ?
কী খেতে চাও মা ? কী আনব ?
উম… যেটা পাও, কিছু একটা নিয়ে আসো। না বাবা, যদি সিঙ্গাড়া পাও তাহলে সিঙ্গাড়া নিয়ে আসবা।
আচ্ছা দেখি মা, সিঙ্গাড়া পেলে সিঙ্গাড়া আনব; নইলে দেখি কী আনতে পারি ? বাবা কী খাবে, শুনেছ ?
না, দাঁড়াও জিজ্ঞেস করি ?
মুঠোফোনের এধার থেকে শুনি, কন্যা তার ভাইকে জিজ্ঞেস করছে―
আরে ঐ বুড্ডা, কী খাবি ? বাবা বাসায় আসতাছে ?
দাঁড়াও, আমি বনব।
পুত্র ওর বোনের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বলে―
বাবা শোনো―ঐ যে আপু যেটা বনেছে, সেটাই আনবা। ঠিকাছে ?
ঠিকাছে, আর কিছু ?
ওকে বাই, আপুন সাথে কথা বন।
আপুকে ফোন দিতে গিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পুত্র।
বাসায় ফেরার পথে চীনে দালানের গলির মুখে পেঁয়াজু-সিঙ্গাড়া-পুরির খুপড়ি দোকান আছে একটা। চড়া বাজারের এই কালেও এখানে সিঙ্গাড়া পাওয়া যায় তিন টাকা দরে। সিঙ্গাড়ার সাইজ খুব ছোট। স্বাদ মন্দ নয় অবশ্য। খেতে ভালোই লাগে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছি, সিঙ্গাড়া কিনব। স্টিলের ট্রেতে সাজানো আছে গরম গরম সিঙ্গাড়া। চুলার উপর আধ কড়াই পাম অয়েল পুড়ে পুড়ে কালো। কালো পাম অয়েলের তল থেকে পোড়া পেঁয়াজকুচির মতো অপদ্রব্য ছেঁকে তুলে আনছে কারিগর। চোখ পড়ে সিঙ্গাড়া ভরা ট্রের পাশে বিছানো পেপারে। পেপারের ওপর পেঁয়াজকুচির মতো অপদ্রব্যের স্তূপ।
দোকানদার বলে―কী নিবেন ?
পেপারে অপদ্রব্যের স্তূপ দেখিয়ে আমি বলি―এগুলো কী ?
দোকানদার আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে না। সে ঠোঙা হাতে প্রস্তুত।
তাড়াতাড়ি বলেন, কোনটা কয়টা দেব ?
কী এক শিহরণে গা গুলিয়ে উঠে! দুর্গন্ধময় কী যেন ঝুরঝুর ঝরে যেতে দেখেছি, এই পোড়া পেঁয়াজকুচির মতো অবিকল। নাহ! ছেলেমেয়েকে এইরকম সিঙ্গাড়া খাওয়ানো যাবে না। এইরকম পচা সিঙ্গাড়া কিনব না। স্তূপীকৃত পোড়া পেঁয়াজকুচির সামনে থেকে দ্রুত পদে নিষ্ক্রান্ত হই। ছেলেমেয়ের জন্য আজ অন্য কিছু একটা কিনে নিয়ে যাব। কী কিনব কী কিনব ভাবতে ভাবতে, পথের পাশে দোকানগুলো দেখতে দেখতে, কখন কোন ঘোরে বাসায় এসে যাই। কিছুই আর কেনা হয় না।
দরোজা খুলে পুত্র-কন্যা হাতের দিকে দেখে। আমার হাত খালি! হাতে নাই কোনও তেলে ভেজা ঠোঙা! ভাইবোন সমস্বরে জানতে চায়―বাবা কি আনছো ?
কিছু আন নাই ?
না; সিঙ্গাড়ার দোকানে গেছি সিঙ্গাড়া কিনব তাই। কিন্তু ভালো সিঙ্গাড়া পেলাম না। নোংরা লাগল, এই জন্য কিনি নাই।
অন্য কিছুও পাও নাই; অন্য কিছু আনতা।
কী আনব সেটা ঠিকই করতে পারলাম না। ভাবতে ভাবতে বাসাতেই চলে এলাম। কাল অফিস থেকে যখন ফিরি, তার আগে মনে করিয়ে দিও; নিয়ে আসব।
ছেলেমেয়ের জন্য কী কিনব, ঠিক করতে পারিনি! বয়ানটা ঠিক, আবার ঠিক না। কাপড়-চোপড় খোলার সময় মনে হলো, পুত্র-কন্যার সাথে সোফায় বসে আসল ঘটনা বলি। সিঙ্গাড়া কিনব না ঠিক করার পর ভেবেছি, বাখরখানি নেব। বাসার গলির মুখে বাখরখানি পাওয়া যায়। ছেলেমেয়ের যেমন, বাখরখানি আমারও তেমন প্রিয়।
বাখরখানির দোকানে বসে আছে এক কিশোর। বরাবরই বিকেলবেলা এই ছেলেটিকেই দেখি বেচা-বিক্রি করে। আমি তো প্রায়ই কিনি মিষ্টি বাখরখানি। আজ বাখরখানি ক্রয় করি না। কিশোরের আক্কেল-বুদ্ধি দেখে, আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাই। বেআক্কেল দোকানদার চটের গদিতে বসে আছে। হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি গুটানো। ঠ্যাঙের লোমগুলো এখনও সাবালক হয়নি। লোমের ফাঁকে ফাঁকে ঘামাচি। বাখরখানির গনগনে চুলার আগুনের আঁচে বসে থাকে দিনমান। তাপে-ঘামে দুয়েকটা ফুঁসকুড়ি হতেই পারে। তাই বলে নখ দিয়ে চিপেচিপে সেইসব ফুঁসকুড়ি গলাতে হবে! ছেলেটি নখ দিয়ে ফুঁসকুড়ি গলাচ্ছে। এখন আমি যদি বলি, পাঁচটা বাখরখানি দাও ? সে করবে কী ? হাত তো ধোবে না। ঐ ভাবে ঐ হাত দিয়েই ঠোঙায় ভরে দেবে সাধের বাখরখানি। দেখেশুনে এইসব জিনিস খাওয়া যাবে! দোকানের সামনে দাঁড়ানো মাত্র তদ্রƒপ ছবি দেখি। আমি বাখরখানি ক্রয় করি নাই।
আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আমাদের ইশকুল মাঠের পুব কোণে বিরাট বটগাছ। মাটির উপর মোটা মোটা বটের শিকড় পিঠ বিছায়ে আছে। পিঠের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে মজা। সক্কালবেলা ইশকুলে যাই। ক্লাস শুরুর আগে, ঝিরিঝিরি বাতাসে বট-শিকড়ে বসে থাকি তন্ময়। আমার ভালো লাগে। বটতলায় গামছা বিছায়ে বরফ বেচেন বরফওয়ালা। চৌকোনা বাক্সের ঢাকনা খুলে বাড়ি দেন। ফটাস ফটাস আওয়াজ হয়। হাঁক ছাড়েন বেজায় জোরে―আ..ই..স.কি.রি.ম! আমার মন উদাস করে।
আমার বান্ধবদের কেউ চেটে চেটে খায় লাল-নীল-কমলা রঙের জমাট স্যাকারিন পানি। আমাকে দেখায় লাল-নীল-কমলা জিভ। রঙিন জিভের তারিফ করি। বরফ চোষার দৃশ্য কত মনোহর।
জিবেডা আবার এল্লা বাইর কর ছ্যান। দেহি এহন কীবাহা অঙ অইলো। আইসকিরিমডে বালা আছে। ব্যাপক অইছে জিবের অঙ।
আমার জিভ ফ্যাকাশেই থাকে। আমার কাছে পয়সা নাই। মাত্র আট আনা পয়সা থাকে না আমার কাছে। আব্বাকে বললে পাওয়া যাবে ? আব্বার শার্টের পকেটে অনেক টাকা-পয়সা থাকে। তবু বলতে সাহস হয় না। যদি মারেন! মুখ ফুটে আম্মাকে বলি মাঝে মাঝে। আম্মার কাছে বলতে সাহস লাগে না। আম্মার কাছেও কোনও টাকা-পয়সা নাই। আমার মতোই নিঃস্ব। আম্মা দেবে কোথা থেকে ? তবু একেক দিন কী হয়, আম্মার কাছে পয়সা চেয়ে জ্বালাতন করি। আম্মা দিতে পারেন না আট আনার আধুলি। আধুলি মূল্যের স্যাকারিন মেশানো লাল-নীল-কমলা বরফের রঙে আমার মুখ রঙিন হয় না।
সেদিন ইশকুলে ছুটব, মিষ্টিভাবে আম্মা ডাকেন। কী! হতবাক হয়ে যাই আমি! আম্মা আমাকে পুরো একটা টাকা দেন। উড়ে উড়ে ইশকুলে পৌঁছুই। বরফওয়ালা আসেনি এখনও! ক্লাসঘরে বই রেখে বটতলায় চক্কর মারি। প্রিয় শিকড়ের পিঠে পা ঝুলিয়ে বসি না। ক্লাস শুরুর আগে আট আনার এক নীল আইসক্রিম খাব। কখন আসে বরফওয়ালা! টিফিনের সময় আরেকটা চুষব, কমলা রঙের ?
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলেন বরফওয়ালা। কোঁকড়ানো লাল গামছা বিছিয়ে জুত করে বসার আগেই তাকে বলি, একটা নারকেল মালাই দেন ? নিয়ত করে আছি নীল বরফ নেব। চাইলাম নারকেল মালাই আইসক্রিম! নারকেল মালায়ের দাম বারো আনা। খেতে স্বাদ তবে জিভে কালার হয় না। আমার কালারে কাজ নাই; আমি নারকেল কুচি মেশানো স্যাকারিন মিঠা বরফই খাব। বরফের কাঠি ধরে বট-শিকড়ে বসেছি।
বরফওয়ালা পা ছড়িয়ে বসেছেন গামছাসনে। দেখি, ওর পায়ে অতিকায় সোনালি ফোঁড়া। বরফওয়ালা ফোঁড়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারপর ধারালো কুটো দিয়ে ফোঁড়া ফাটিয়ে দেন। পুঁজ বের হয় না। কী ক্রোধে দুই আঙুলে চেপে ধরেন ফোঁড়া। ব্যথায় মুখ তাঁর ত্যাড়াব্যাকা হয়। আর গলগল করে বেরুতে থাকে পুঁজ। তার দুহাতের আঙুলে পুঁজের ধারা দেখি। আমার হাতের তালু বেয়ে পড়ছে নারকেল ধোয়া ঘন রস। তার পায়ে বিষফোঁড়া; তার পায়ে জমে বিষ।
আমি আর স্যাকারিন মিষ্টি বরফ চুষি না।
আমার দেখা অবাক ছবি সন্তানের রুচি নষ্ট করতে পারে। তাই কোনওদিন তাদের কাছে ঘৃণার গল্প বলি না।
আজ, আশা দিয়েও সন্তানদের জন্য কিছু আনা হয়নি। পুত্র-কন্যা কিছু খেতে চাইলে, কিনে দিই। না বলি না। আমার ছেলেমেয়ে স্যাকারিন মিষ্টি লাল-নীল-কমলা বরফ চেনে না। ওরা ডিপ ফ্রিজে জমানো, বাহারি মোড়কে মোড়ানো, বহুজাতিক কোম্পানির পবিত্র আইসক্রিম খায়। ওদের জন্য আইসক্রিম কিনতে পারতাম। মনের ভিতর খচখচ করছে।
কন্যা কাছে এসে বলে―
বাবা একটা আইডিয়া পেয়েছি।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, মোবাইলে ভিডিও দেখে দেখে কেক বানাবার পরীক্ষা দিই ?
আচ্ছা, আইডিয়াটা ভালো; কিন্তু আম্মু জানে ?
আম্মুর কাছ থেকে তুমি পারমিশান নিয়ে দাও ?
ওকে মা, বানাও। সাবধানে! দেখ, কিছু যেন নষ্ট না হয়।
খালি খালি বসে থাকতে ভালো লাগে না। বসার ঘরে টিভি অন করে, একটা বই হাতে, সোফায় কাত মেরে থাকলে ভাবনা পালায়। আমার ভাবনাও নাই, দুর্ভাবনাও নাই। ঘরে টিভি চলে অষ্টপ্রহর। এখন একটা বই চোখের সামনে মেলে ধরা যায়। দৈবাৎ হাতে উঠে এল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড। এত ভারি! বুকে রেখে পড়া যায় না। আমি তো পড়ি না। পাতা উল্টেপাল্টে নাড়াচাড়া করি। কী হবে বই-টই পড়ে! তবু দৈবাৎ চোখে উদ্ভাসিত হয় এইসব লাইন। পড়ে দেখা যাক খানিকটা ?
…কোচিং সেন্টারের ঠিক সামনেই ফুটপাতের ওপর দেখলাম একটা মানুষের লাশ। গুলির আঘাতে বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পাশেই পড়ে রয়েছে কিছু নাড়ি-ভুঁড়ি। নাকে আঙুল এঁটে―চোখ দুটো বন্ধ করে পাশ কাটাতে চাইলাম। কিন্তু পা এগুচ্ছিল না। হাঁটু দুটো কাঁপছে থর থর করে। নার্ভাস হয়ে গেলাম। তবু এগিয়ে যেতে হলো। একবার মনে করলাম রাস্তায় নেমে যাই। ফুটপাতে হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। … রাস্তার ওপর দিয়ে পশুদের দানবীয় লরীগুলো যেভাবে ছুটছে… বুক সেন্টারের সামনের ফুটপাতে দেখতে পেলাম চাদর মুড়ি দেয়া আরও একটি লাশ। … চোখে পড়ল জি.পি.ও.’র পেছনের গেটে এক ঝুড়ি রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড আর নাড়ি-ভুঁড়ি। তবু আমি হেঁটে চলেছি―হেঁটে চলেছেন চারপাশের মানুষগুলো। …
বইয়ের কালো অক্ষরে চোখ বুলোলেই তন্দ্রা আসে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যায়। চোখের পাতা বন্ধ করে সোফায় এলিয়ে থাকি। ঘুম কি আসে ?
বাবা, কেক রেডি।
চোখ মেলে কন্যার উজ্জ্বল মুখ দেখি। আমার তবু ঘুম ঘুম ক্লান্তি। চোখের পাতা আপনিই নেমে যায়।
আচ্ছা, ভাইবোনে মিলে মজা করে খাও।
তুমি টেস্ট করে দেখবা না! কেমন হইছে আমার প্রথম কেক, একটু দেখ ট্রাই করে।
কন্যার যা উৎসাহ! আমি চোখটি মেলে দেখি না। কিঞ্চিৎ কেক টুকরো মুখে পুরলেই-বা ক্ষতি কি ?
কেকটার কিছু একটা প্রব্লেম হইছে। সফট হয় নাই। বাটি থেকে তুলে, কেটে পিস পিস করতে গেছি; আর কেমন ভেঙে ঝুরঝুরা হয়ে যাচ্ছিল। স্লাইস হচ্ছে না।
পিরিচে রাখা টুকরো কেকে দৃষ্টি দিই। কব্জি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কচি পায়ের পাতার মতো এক টুকরো কেক। আঙুল-টাঙুল সব ঝুরঝুর ঝরে গেছে। বাকি আছে পচা মাংসের উপর শুকনো জমাট রক্ত! হাত বাড়িয়েছি কেকের দিকে। এক টুকরো মুখে দিয়ে দেখা যাক, কেমন স্বাদ। কন্যার উৎসাহ মাটি করতে ইচ্ছে করছে না। হাত ছোঁয়ালেই জমাট রক্তের শুকনো কেক চুরমার হয়ে যায়! আর থরথর কেঁপে উঠি। এখনও কত তপ্ত! এই জিনিস কীভাবে খাওয়া সম্ভব!
কী নোংরা-পোংরা জিনিস যে বানাস তোরা! নিয়ে যা তো সামনে থেকে।
আমার আত্মজার বানানো প্রথম কেক আমি খাই না। কন্যার উৎসাহ মাটি হয়ে যায় ?
মশারির নিরাপদ দুর্গে পাতা বিছানায় শুয়েছি। সোফায় ঘাড় এলিয়ে হয়েছিলাম তন্দ্রাচ্ছন্ন। ঘুমের তাড়নায় এত অস্থির লাগে! নিদ্রায় তলিয়ে যাই না অথচ ঘাড়ে ব্যথা হয়। ব্যথা বাড়ে অবিরাম। মশারির মাঝে হাওয়া ঢোকে না। আঁধার গাঢ় হয়ে আসে। গাঢ় আঁধারে ঘুম ভালো হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। চোখ বুজে মটকা মেরে পড়ে থাকি।
নিবিড় অন্ধকারে দৃষ্টির ওপর আছড়ে পড়ে কুচি কুচি শৈশব। আমার শৈশব কুশ্রী। মারি নামে ঘুমঘোর চোখে, আমার ঘুম আসে না। দেখি কেন আহারে অশেষ বিশ্রী রূপ ? আমার শৈশবের আহার্য রং কদাকার। শখের আহার্যে লেগে যায় পুঁজ! দৃষ্টির খাদে নিমগ্ন ঐরূপ ? ঐরূপ, অনুভবে বিকার আনে! আমার আহার-বিহার বিকারে গন্ধে ভরপুর! রক্তের সাথে মিশে আছে পুঁজ। দেহের ভেতর রক্তের বদলে বহে পুঁজের স্রোত ? পুঁজের ভিতর পোকা জন্মে অজস্র…
পোকার কামড়ে আমি দিশেহারা। নিদ্রামগ্ন বউটি পাশে শুয়ে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তার।
এ্যাই, এ্যাই, কী হলো! কী হয়েছে ? কাঁপছো কেন!
বউয়ের স্নেহবাঁধনে ছড়িয়ে পড়ে কম্পনের রেশ। কৃত্রিম হাওয়ায় আঁধার দুলে উঠে। পাতলা আঁধারে হালকা হাওয়ায় আমার দেহ তখনও থরথর।
স্বপন দেখলে ? সারাদিন কী আজেবাজে চিন্তায় বিভোর থাকো! রাতে ঘুমাতে পারো না যে!
পাতলা আঁধারে মশারির ঢেউ। দেখা যায় পষ্ট। দিনের আলো নিবে যাবার আগে দেখেছি কী বাজে ছবি, বউকে বলা যায় ? বউকে বলি―
অফিস থেকে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। পলাশি মোড় পার হয়ে ফুটপাথে হাঁটছি। অত খেয়াল করে হাঁটছিলাম না। পথচারী মানুষের ভিড় নাই। দমকা বাতাসের সাথে আসে ভয়ানক বিশ্রী গন্ধ। গন্ধ সোজা পেটের ভিতর ঢুকে যায়। এত মারাত্মক দুর্গন্ধ, মনে হলো পেটের নাড়িভুঁড়ি উগলে উঠে আসবে। পেটের ভিতর তছনছ করে ফেলে একদম। সামনে দেখি একটা অল্পবয়সী মহিলার লাশ! বয়সটা ভালো বোঝা যায় নাই। আমার কাছে অল্পবয়স্কই মনে হলো। এক পলকের দেখা তো। পায়ের পাতার মাংস পচে গলে আঙুলের হাড় বেরিয়ে আছে। পায়ের ওপর থিকথিক করছে মাছির ঝাঁক। বাঁ কাত করে শোয়ানো মহিলা। পরনে সালোয়ার নাই, কামিজ আছে। ঊরুর কাছে এক ছোপ রক্ত। ভয়ানক দুর্গন্ধ তিষ্ঠীতে দেয় না ক্ষণকাল। অল্প তফাতে দুজন রিকশাওয়ালা ফুটপাথে বসে ভাত খায়। লাশের পাশে বসে, এত তীব্র দুর্গন্ধের মাঝে ভাত খাওয়া যায় ? মহিলা কি মৃত ছিল ? কখন, কে ফুটপাথে রেখে যায় এমন মানুষ!
দেশে কি মতলববাজ মানুষের অভাব আছে ? কে কখন কোন মতলবে, কোন পাপ ঢাকতে, ফুটপাথে ফেলে রাখে অচেতন নারী! রাতদুপুরে এইসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না; ঘুমাও ? ঘুমানোর চেষ্টা করো।
চোখ বন্ধ করি। চোখে ভাসে সেই মহিলার ছবি। চোখ মেলি, তবু দেখি সেই আঙুলের হাড়। ভ্যাপসা গরমে ঘামে ভিজে উঠে শরীর। ভেজা ঘাম শুকিয়ে আবার শিরশির কাঁপন উঠে দেহে।
বিছানায় মটকা মেরে পড়ে থাকা অসহ্য। বিছানায় পড়ে থাকি না। মশারির ভিতর তন্দ্রাচ্ছন্ন বসে থাকা আরামের ? মশারির ভিতর বসে থাকা যায় না। সারা রাত তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোরের ভিতর শুয়ে বসে সকালের অপেক্ষা করি। সকালে, আলোর পথ মাড়িয়ে উল্টো পথের ফুটপাথ দিয়ে নির্বিঘ্নে হেঁটে যাব অফিসে ? রাতের অন্ধকারে ঘরের ভিতর হাঁটা যায় ? হাঁটতে ইচ্ছা করে না।
আকাক্সক্ষার নির্ভার আরাম আসে সকালের স্নানের পর। অফিসে বেরুবার সময় হয়ে এল। বউ দেখি টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে খাবার। কাল রাতের বেলা খাওয়া হয়নি। খেতে ইচ্ছেই করেনি। টেবিলে সাজানো বাটি ভরা পায়েস আর প্লেটে গরম রুটি। কেজি দুধে দু মুঠো চিনি-সাগর চাল ফেলে রাধা সুগন্ধী পায়েস আমার পছন্দ। বউ আমার রেধেছে প্রিয় খাদ্য। গোসলের পর খিদে পাই টের। ঝটপট খেয়ে রওনা হতে হবে অফিসে। অফিসে যাবার সময় হয়েছে। রয়েসয়ে খানা-খাদ্য খাবার অবসর নাই।
আহারে বসে কাল হলো পায়েসেরই গন্ধ। আজ সকালের নরম নির্ভারে পায়েসের গন্ধ অন্যরকম। পচা পচা গন্ধে খিদে মরে যায়। কোন সুদূরের ওপার থেকে হাওয়ায় ভেসে এল এই গন্ধ ? বাটি ভরা গরম গরম পায়েসের ওপর জমেছে দুধের সর। অন্নপূর্ণা দুধের সর ? সরের রঙে মন মজে না আজ। বিশ্রী বোধে কেমন কেমন লাগে। বউকে বলি―তোমার চাল কি ছিল অনেক দিনের বাসি ?
কেন ? নতুন প্যাকেট ছিঁড়লাম আজই। বাসি হবে কেন!
ঘন দুধ পিয়ে পিয়ে ঢোল হয়েছে সেদ্ধ চাল। বাসি-পচা সেদ্ধ চাল, দুধের সরের আস্তরণে যেন মৃত বাদামি পোকা। বিশ্রী বোধে কেমন কেমন লাগে। মন বলে না, খাই। বউকে বলি―আজকের পায়েসটা দেখতে ভালো লাগছে না। কেমন যেন লাগছে। খেতে রুচি হচ্ছে না একদম।
অন্যদিন অন্য সময় হলে, বউয়ের ভেঙচি দেখতে হতো নির্ঘাত। আজকে ভোরে নরম মেজাজ তার। নম্রস্বরেই বলে―ভালো ঘুম না হলে সকালে খাবার খেতে এমন বোধ হয়। আস্তে আস্তে জোর করেই খাও।
কাল রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি। হাবিজাবি ছবি কত দেখেছি সারা রাত্রি। আমারই মনের ভুলে বর্ণে গন্ধে আহার্যরূপ যায় পাল্টে ? সারাদিন মেলা খাটুনি আছে। খেতে হবে। মনে অরুচি হলেও খেতে হবে। পেটে আছে খিদে। আমার জিভে অরুচি নাই।
ভেবেছি, নারীর লাশ উপেক্ষা করে পাড়ি দেব পথ। অমন ভয়াল বীভৎসের মুখোমুখি কে হয় ? আমি আর ওমুখো হব না। খেয়ালে ফেলে এসেছি সেই স্থান। তবু সচকিত হই। কাল দেখা ফুটপাথের সেই নারী নাই। কাল কি শুয়ে ছিল কোনো নারী! কী ব্যকুলতায় উচাটন হয় মন! ফুটপাথে পড়ে থাকা মানুষ, কে নিয়ে যায় তুলে ? কখন যায় নিয়ে ? রাতের আঁধারে রাজপথে কুকুরের দল ঝাঁক বেঁধে ঘোরে। কুকুরের ঝাঁক ছিবড়ে খেয়েছে লাশ! রয়ে যাওয়া ছিন্ন উচ্ছিষ্ট নাড়ি-ভুঁড়ি হাড়, মিউনিসিপ্যালিটির পরিচ্ছন্নতা বাহিনী ময়লার ট্রাকে তুলে নিয়ে ফেলে ভাগাড়ে ? অবাঞ্ছিত ঝঞ্ঝাট সরিয়ে সাফসুতরা করেছে ফুটপাথ। সেখানে, পরিষ্কার ফুটপাথে বসেছে ভাতের দোকান যথারীতি। এখনও খেতে বসেনি কোনও খদ্দের। আজ সকালে বৃষ্টি নামে ঝুম। তারপর থেকে চিমসে রোদ।
আমার পথে পড়ে প্রাচীন বৃক্ষ কড়ই। বৃদ্ধ কড়ইয়ের সারা গায়ে ঘায়ের চলটা। বৃষ্টি জলে হয়েছে ভীষণ কালো। বৃক্ষের গোড়ায় আছে কিঞ্চিৎ আড়াল। আড়ালে শরম রেখে রিকশাওয়ালা করে মূত্র বিসর্জন। এখানে ফুটপাথে, বৃক্ষের গোড়ায় বৃষ্টিহীন দিনেও থাকে তাই মুতের প্লাবন। বৃষ্টির পর রোদের আঁচ পেয়ে মুতের গন্ধ হয় বিকট। মূত্রে ঝরে শ্রমের বিষ। বিষ ছড়ায় গন্ধ। বিষগন্ধে আমার তন্ময় ভাব ছিঁড়ে যায়। বিষগন্ধে মাথা ধরে।
মুঠোফোনে কন্যা কথা কয়ে উঠে। কাল আমরা শহিদ মিনারে যাব! পকেট হাতড়ে মুঠোফোন উদ্ধার করতে না করতেই কেটে যায় কল। অচিন কল। মুঠোফোনের পর্দায় চোখ রেখে হাঁটছি। আচমকা বাধা পাই। স্তব্ধভাবে দাঁড়াই। সমুখে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে রুগ্ণ-জীর্ণ পুরুষ। এখানে ফুটপাথের পাশে ভার্সিটি বাগান। বাগানের এক চেরির ডাল পথের উপর ছায়া দেয় এক তিল। এক তিল ছায়ায় মাথা রেখে রোদের ভিতর পা বিছিয়ে দিয়েছে করুণ মানুষ। পুরুষ মানুষটির পায়ের কব্জির ওপর থেকে হাঁটুর নিচ অবধি পুরো ব্যান্ডেজে ঢাকা। ভেজা ব্যান্ডেজ। পায়ের তলে পুঁজের নহর। আর ভয়ানক দুর্গন্ধ। চেনা চেনা! সকালের নির্ভার আনন্দ খাদ্যে এই রং এই গন্ধ মিশেছিল অবিকল ? কী যে বিশ্রী লাগছে! শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না একদম। এই পুঁজের নহর পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। কিন্তু টলে উঠে পা। টলায়মান পা ফেলে কোনদিকে যাব ? ডান দিয়ে বহে চলে নরকের ত্রাস; বাঁয়ের দেয়ালে কীটের কিলবিল! কোন পাশ পাড়ি দিয়ে যাই! দেহে আমার ঘাম ছুটেছে, চোখে আমার ঘুম এসেছে, কাঁপছি থরথর!
ফুটপাথের মসৃণ টাইলসে করুণ পুরুষের পাশে শুয়েছি। আরাম লাগছে। কন্যা আমার অবিরাম ডেকে যায়, হ্যালো বাবা―কাল আমরা শহিদ মিনারে যাব। কেন জানো না! মুঠোবন্দি মোবাইল ফোনের ক্ষয়ে যাওয়া সবুজ বাটন টিপে দেওয়ার আগেই আলগা হয়ে যায় মুঠো। আকাশে আকাশে মেঘ ধেয়ে আসে। কন্যার ডাক মেঘে ডুবে যায়। তারপর অন্তহীন নিবিড় কালোয় ভরে উঠে চোখ।
সচিত্রকরণ : রজত