লিটল ম্যাগাজিন কতটা ছোট, কতটুকু বড় : শফিক হাসান

ক্রোড়পত্র : লিটলম্যাগ চর্চা
কেন লিটল ম্যাগাজিন, উপযোগিতা কী
প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র দিয়েই বাংলা লিটল ম্যাগাজিনচর্চার উদ্ভব কি না, সেই সময়ে উল্লেখযোগ্য আর কোন কোন ম্যাগাজিন ছিল, বিশ্বের প্রথম লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয় কোন দেশ থেকে, কত খ্রিস্টাব্দে, সম্পাদকের নামইবা কী―এমন গুরুগম্ভীর আলোচনায় না গিয়ে আমরা বরং স্বদেশ সমকালে নিজেদের দিকেই দৃষ্টিপাতের চেষ্টা করি। আজ থেকে বছর বিশেক আগেও শিল্প-সংস্কৃতিমনস্ক ভাবুক ছেলে-মেয়েরা লিটলম্যাগ সম্পাদনা করত। এইচএসসি পরীক্ষার পর যখন তাদের হাতে অখণ্ড অবসর; সৃজনশীলতায় নিয়োজিত করত নিজেদের।
তারও আগে ছিল পাড়া-মহল্লা থেকে জেলায় জেলায় ‘একুশের সংকলন’ প্রকাশ করার সংস্কৃতি। ভাষা আন্দোলনের মহিমাকে স্মরণ ও ধারণ করার জন্যই এমন তোড়জোড় ছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে মিশে আছে একুশের উজ্জ্বল অভিমুখ। স্বাধিকার-স্বাধীনতার বীজ রোপিত হতে থাকে ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী ২১ ফেব্রুয়ারির আগ থেকেই। ২১ ফেব্রুয়ারির রক্ত-ঝরা মুহূর্তের পর থেকে সেটা উত্তুঙ্গে ওঠে। দ্রোহ ও বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে থাকে দিকে দিকে। সঞ্চারিত হয় নবজাগরণ; চেতনা পায় নতুন জ¦ালামুখ। তারপর থেকে ৮ ফাল্গুন জাতিকে দেয় আত্মপরিচয়ের অহমিকা, ভাষাচেতনার উদার বাতায়ন। নদীর স্রোতের মতো ভাষা যেমন একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে, তেমনি সময়স্রোতে বদলায় এই জনপদ মানুষের জীবনযাপন, রুচি।
সময় পরম্পরায়, কোনও ঘূর্ণাবর্তের কালে, চোরাস্রোতে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে শুরু করে একুশের সংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশের উন্মাদনা। একুশের চেতনাও যেন এখন ফিকে হয়ে ওঠা একটি বিষয়। দেশপ্রেমের গাঢ়ত্ব নিয়েও কিছুটা প্রশ্ন তোলা যায়। এই ভ্রমান্ধ সময়ে ২১ কি একটা সংখ্যাই হয়ে উঠছে! ২১-এর (৫২) অগ্নিবলয়ের হাত ধরে এসেছে যে ’৭১―সেটাকেও আমরা কতটুকু লালন করছি, মন থেকে―এমন প্রশ্ন উত্থাপন হয়তো বাতুলতা হবে না এখন আর।
অন্যরা হাত গুটিয়ে নিলেও ঢাকা থেকে মারুফ রায়হান প্রতি বছরই সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন একুশের সংকলন। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে―সেটাও এখন অনিয়মিত, ম্রিয়মাণ। শুধু লিটলম্যাগ কেন, সব ধরনের শিল্পই মূলত নিজেদের ভিন্ন আয়নায়, নতুন আলোয় দেখারই আয়োজন। লিটলম্যাগ পরিসরেও আমরা নিজেদেরই দেখতে চাই, দেখাতে চাইতাম। কচি-কাঁচা হাতে সম্পাদনার হাতেখড়িও নিজেদের নবতর রোশনাইয়ে দেখতে চাওয়া। এই দেখার আকাক্সক্ষা ও দেখাতে চাওয়া অভীপ্সার মধ্যেই লুক্কায়িত সম্পাদনার মূলমন্ত্র। এগিয়ে যাওয়ার সোপান, পিছিয়ে থাকার হদিস।
লিটল ম্যাগাজিনের উপযোগিতা কী? এককথায় জবাব দেওয়া যাবে না। আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা, নিদ্রা-জাগরণ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের মতোই লিটল ম্যাগাজিন আলাদা একটি অধ্যায়। স্বতন্ত্র নির্মাণ তো বটেই। বলাবাহুল্য, বিশাল অধ্যায়। এই অতল পরিধির হদিস খুঁজে বের করতে পারবেন অল্প কজন মানুষই।

লিটলম্যাগের প্রাসঙ্গিকতা কি ফুরিয়ে আসছে
সংশয়-ভাবনা দানা বেঁধে আছে সংশ্লিষ্ট অনেকের মনেই―ছোটকাগজ কি আদৌ বেঁচে-বর্তে আছে! থাকলে কোথায়, কী পরিস্থিতিতে অবস্থান করছে। চলমান নিদানকালে লিটল ম্যাগাজিন তথা ছোটকাগজের অস্তিত্ব-উপযোগিতা হয়তো খারিজ করে দেওয়া যায় এককথাতেই। তবে একটু গভীরে ডুব দিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় সে আছে, অবশ্যই আছে। মাটির পিদিমের মতো টিমটিম করে জ্বলছে কোথাও না কোথাও। গৃহকোণে কিংবা পর্বত-উপকূলে। কেরোসিন ফুরিয়ে যাওয়ায় সলতে জ্বালিয়ে হলেও টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব। অন্ধকার রাতের তারার মতো নিজের অবস্থানটুকু জানান দিচ্ছে বহুদূর থেকে।
লিটলম্যাগ সগৌরবে থাকতে না পারুক, খুব একটা অগৌরবেও নেই। যদিও এই নগরসংস্কৃতিতে, বিভাগীয় শহরগুলোতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এসব ‘ঘাসকণা’র অস্তিত্ব বুঝতে পারা কঠিন। ‘বাণিজ্যিক এলাকা’য় খুঁজেও বোধকরি লাভ নেই। এখানে আছে বিলাস-ব্যসনজনিত লাফ-ঝাঁপ, মুনাফালোভী মানসিকতা ও প্রচার-প্রসারের উল্লম্ফন। এসবের পাশাপাশি কিছু মোহনীয় পরিচয় মেলে ‘লিটলম্যাগ’র ছদ্মাবরণে। সেটার স্বাতন্ত্র্য ও সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে যদিও।

কালো অক্ষরের সমুদ্রে অবগাহন―ডুব-সাঁতার
সর্বশেষ যে ‘যথার্থ’ লিটল ম্যাগাজিন পাঠক হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে, সেটার নাম সাঁতার, প্রকাশস্থান ফরিদপুর। ম্যাগাজিনটির একক কোনও সম্পাদক নেই। সম্পাদনা পর্ষদে গালিব রহমানসহ বেশ কয়েকজনের নাম দেখা গেছে। ব্যক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এভাবেই গোষ্ঠীচর্চা বড় হয়ে ওঠে। অঞ্জন সরকার জিমি, নায়েম লিটু, সাইদুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন চট্টগ্রাম থেকে এভাবে সম্পাদনা করতেন একটা লিটলম্যাগ। নামটা নিজের স্মৃতিকোষ সংরক্ষণ করে রাখতে পারেনি। গোষ্ঠীবদ্ধ সম্পাদনার এমন নজির খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে। বস্তুতই, লিটলম্যাগের একক কোনও সম্পাদক নেই। এমনকি পাঠকও কোনও না কোনওভাবে সম্পাদনা প্রক্রিয়ার অংশ।
সারা দেশের নিভৃত এলাকা থেকে নিশ্চয়ই পরিমাণে কম হলেও সত্যিকারের কিছু ম্যাগাজিন বের হচ্ছে, যেগুলো প্রচার ও বিপণনের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়ে শহুরে সভ্যতায় জায়গা করে নিতে পারছে না। ক্ষুদ্রকায়া সাঁতার লিটলম্যাগে তেমন জনপ্রিয় কারও লেখা পাইনি। দৈনিকের সাময়িকীতে, সাহিত্য ম্যাগাজিনে, ঢাউস লিটল ম্যাগাজিন বা ওয়েব পোর্টালে দেখতে দেখতে পরিচিত হয়ে ওঠা কোনও নাম চোখে পড়েনি। আনকোরা লেখকরা লিখছেন, অথচ লেখাগুলো কী তাজা, কী অসীম শক্তিধর, বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরপুর; লেখক-মননের গভীরতা টের পাওয়া যায় সহজেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বাবা-মায়ের কাছে টাকা চেয়ে কেমন ‘সংক্ষিপ্ত চিঠি’ লেখা হতো, এমন হাস্য-রসিকতাপূর্ণ লেখাটির লেখক হালের জনপ্রিয় রম্য লেখকের চেয়ে কোনও অংশে কম প্রতিভা দেখাননি। এমন উক্তি প্রায় প্রতিটি লেখকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই লেখকদের অনেকেই হয়তো হারিয়ে যাবেন সময়ের ডামাডোলে, বৃহৎ পরিসরে এসে নিজেদের জানান দেবেন না কিংবা সমর্থ হবেন না। একসময় চাপা পড়ে যাবে তাদের লেখা-শক্তির কথা। কিচ্ছু আসে যায় না তাতে। ক্ষণিকের জন্য হলেও তারা মেতেছিলেন শিল্প-সৃজনের উল্লাসে, হেঁটেছেন নন্দনের বারান্দায়, ভেসে গেছেন আনকোরা নির্মিতিতে। সময়ের ঘেরাটোপে, ‘প্রহর শেষের রাঙা আলোয়’ কী টিকবে আর কী ক্ষয়ে যাবে বা ‘বয়ে’ যাবে―আগাম বলা সম্ভব নয়। সচেতনভাবে টেকানোর চেষ্টা বোকামির নামান্তরই হয়তোবা।

নেতিয়ে পড়ছে কি বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদ
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের ধারাবাহিকতা চলে আসছিল। সেই সংস্কৃতি বর্তমানে স্তিমিতপ্রায়। অথচ এখন কত ইস্যু দিনে-রাতে, ইস্যুকেন্দ্রিক সংখ্যা প্রকাশ পায় না। কেন এমন বন্ধ্যা পরিস্থিতি! তরুণ সম্পাদকরা সময়ের ভাষা বুঝতে ও বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন নাকি নিজেরাই আধমরা-নির্জীবে পরিণত হচ্ছেন। অগ্নি-গহ্বরে দাঁড়িয়ে ছোটকাগজের হয়ে ওঠার কথা ছিল চেতনার অগ্নিমশাল, বিস্ফোরণোন্মুখ বারুদ, অথচ ছিটেফোঁটাও মিলছে না কোথাও।
লিটলম্যাগ মানেই যে সময়কে ধারণ করতে হবে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়তে হবে, জানান দিতে হবে সম্ভাবনার দিগবলয়―বোধকরি এমন কোনও লিখিত-অলিখিত সংজ্ঞা নেই। অতীতে যা হয়েছে, যুগের দাবি মেটাতেই প্রকাশ পেয়েছে চমৎকার সব সংখ্যা। বর্তমানে যুগচাহিদা পূরণ করার সেই তেজস্বী সম্পাদকের বড় আকাল। অবশ্য ইস্যুর বাইরে গিয়েও ‘গতানুগতিক’ লিটলম্যাগও সম্পাদনা করা যায়, মেতে ওঠা যায় সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে―সেসবেরও বড় অভাব। নিরঙ্কুশ সাহিত্যচর্চার বিচরণভূমি সৃষ্টিতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না এখন। নিজেরাও আছড়ে পড়েছেন বাউন্ডারির সবুজ ঘাস পেরিয়ে মাঠের বাইরে!

অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রযুক্তি?
সংকটটা কোথায় তাহলে? সদ্য কৈশোর পেরোনো তারুণ্য বুঁদ হয়ে থাকছে বিনোদনের নানামাত্রিক মাধ্যমে। দেশ-কালের বর্তমান-ভবিষ্যৎ সেভাবে আলোড়িত করছে না তাদের? পারিবারিক মূল্যবোধের শেকড়বাকড়ও কি ‘একদা’র খেরোখাতায়! অথচ দিকে দিকে ফোটার দরকার ছিল আগুনের ফুল কিংবা দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ। দেখা পাওয়ার কথা ছিল কুসুমিত ইস্পাতের। একটি জেলা থেকে অন্তত পঞ্চাশটি লিটলম্যাগ প্রকাশিত হতে পারত ফি-বছরে।
৬৪ জেলায় থাকার দরকার ছিল কমপক্ষে চৌষট্টিটি উল্লেখযোগ্য লিটলম্যাগের। যেগুলো বড় মুখ করে ওই জেলার সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করত। প্রযুক্তির উৎকর্ষে তাল মিলিয়ে দেয়ালিকার যুগ পেরিয়ে আমাদের প্রবেশ করার কথা ছিল দ্বিতীয় ধাপে। সেটা হলো না, উল্টো দেয়ালিকা-সংস্কৃতিও বিলুপ্তির পথে। দেয়ালগুলো ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র হতে হতে এখন আরও কোণঠাসা। খেয়ালগুলোও আগের মতো নেই। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের মনোগহিনে সুকুমারবৃত্তির বীজ এখনও আছে, সেটাকে শাণিয়ে তোলার প্লাটফর্মের বড় অভাব। দেয়াল-লিখনের বক্তব্য-ভাষ্য থেকেও হতে পারত লিটলম্যাগের নতুন সংখ্যা প্রকাশের তোড়জোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শীর্ষ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও একসময় ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদের যুক্ততা ছিল ঈর্ষণীয়। কোথায় হারাল সেসব এখন!
সন্তানরা তো বাবা-মাকে দেখে অনেক কিছু শেখে। সচেতন, অচেতন ও অবচেতনভাবে। আগেকার দিনে গৃহিণীরা দুপুরের অবসরে বইপত্র নিয়ে বসতেন। বাবারা বইপত্র কিনতেন, পড়তেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে সংবাদপত্রসহ নানা রুচির পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়ার চল ছিল। বিনোদনমূলক পত্রিকা, সিনে ম্যাগাজিন পড়া হতো আনন্দের সঙ্গেই। আগের হাল থেমে গেলে পেছনের হালও সচল থাকবে না―এটাই স্বাভাবিক। তাই তো আক্ষেপ প্রকাশ করতে হয় বার বার। ইস্যু বা নন-ইস্যু কোনওটিকেই কেন্দ্র করে লিটলম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে না। ইস্যু-ঝড়ের ভেতরে দুই-একটা প্রকাশিত হলেও সেগুলোর পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব চাপা থাকে না। হেলে থাকে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দিকে। আপামর মানুষের প্রাণের কথা কমই থাকে সেখানে।
সবার হয়ে না উঠুক―লিটলম্যাগকে অবশ্যই অনেকের হয়ে উঠতে হয়। তাকে বলতে হয় কল্যাণ ও শুভবোধের কথা; অতীত-বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের গল্প। রেখাচিত্রে এঁকে দিতে হয় নানাবিধ চালচিত্র। চিত্রময় বিচিত্র জামানায় ছোটকাগজই রেখেছিল বড় ভূমিকা। বর্তমানে ভূমিকা-পরিসরটুকু কি হারিয়ে যাচ্ছে? অতিকায় হস্তি লোপ পাওয়ার মতো ছোটকাগজের পতন-শব্দও কি ঠেকানো যাবে না!
মানুষের পাঠাভ্যাস কমেছে, হয়তো আরও কমবে―অস্বীকার করার জো নেই; আলামত সুস্পষ্ট। এখন যেটুকু পাঠ অবশিষ্ট আছে তার অধিকাংশই পরীক্ষা পাসের পড়া কিংবা চাকরি বাগানোর মুখস্থচর্চা। এর বাইরে আউট বই(!) বা রঙবেরঙের ম্যাগাজিন পাঠকের সংখ্যা নিদারুণভাবে কমেছে এটা রূঢ় বাস্তবতা। প্রযুক্তিই কি কেড়ে নিচ্ছে পাঠাভ্যাস, সেই সঙ্গে সৃজনশীল মন ও মননকেও? যুক্তি-তর্কে যাওয়ার দরকার পড়বে না। প্রযুক্তির দাস হয়ে উঠছেন অনেকেই। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ও ঘুম ভাঙার পরে স্মার্টফোনের দাসত্ব করেন না―এমন মানুষ প্রকৃতপক্ষে কজন? প্রযুক্তি আমাদের পরিচালিত করছে যুক্তিহীনতার দিকেই, ঠুনকো বোধের ব্যাপ্তিতে। তাই তো অনেকেই স্রেফ ‘মানুষ-যন্ত্র’ই হয়ে উঠছি।
ইউটিউব চ্যানেল বললে কিন্তু ‘তুমি আমি আমরা’ বোঝায় না। তোমার ভুবন, একান্ত তোমারই বিনোদনের জানালা! এককভাবে বিনোদন উপভোগ করেন অনেকেই ইউটিউবে। প্রযুক্তির এই সর্বগ্রাসী স্রোতে অনেকেই বিলীন হয়ে যাচ্ছি। বিনোদন নিতে গিয়ে নিজেই পরিণত হচ্ছি সঙয়ে―বুঝতেও পারছি না!
বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠপোষকতা কেন মেলে না
সৌজন্য কপির বিপরীতে ‘অসৌজন্য’তা
ছোটকাগজ বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে কি করবে না, ম্যাগাজিন প্রকাশ করলে সেখানে কতটা বিজ্ঞাপন থাকবে নাকি একটাও রাখা যাবে না―এটা আলোচনা তথা বিতর্কের বিষয় হতে পারে।
নিকট অতীতেও যারা সম্পাদনা করেছেন, খেয়ে না-খেয়েই কাজটা করতে হয়েছে। প্রকাশনা ব্যয় মেটানোর জন্য অল্প ক’টি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে গিয়ে জুতার তলি খোয়ানোর ঘটনা ছিল নিত্যকার। এসব করতে গিয়ে তরুণ সম্পাদকের হয়তো দুপুরে খাওয়া হয়নি। ফুটপাথের কোথাও দাঁড়িয়ে একটা শিঙাড়া আর ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিয়েছেন। নানাবিধ গ্লানি ও অপমান সয়ে অবশেষে যে-সংখ্যাটিকে আলোর মুখ দেখাতে সমর্থ হন―সৃষ্টিকালীন যন্ত্রণা পেরিয়ে হাসি ফোটে মুখে। হাসিটুকুন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সৌজন্য হিসেবে কিছু কপি তিনি বিলি করেন, লেখকদের সৌজন্য কপি দেন। অল্প কজন মানুষ হয়তো ‘মুফতে’ না নিয়ে মূল্য পরিশোধ করেন। তিনি হয়তো অনুমান করতে পারেন, কী পরিমাণ ঘাম ঝরানোর পর এমন একটি সৃষ্টি সামনে আসে।
এর বাইরে সম্পাদক লেখক কপিসহ যে কজন বিশিষ্টজনকে ম্যাগাজিনটি কুরিয়ার করেন, ‘পেয়েছি’ বলে প্রাপ্তি স্বীকার করার মানুষের সংখ্যা অত্যল্প। সংস্কৃতি বিকাশের মাধ্যম হিসেবে এই আয়োজনের পেছনে যে সম্পাদক নিজের জীবন-সংসার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছেন ‘ভোক্তাপক্ষ’ সেটা বুঝতেই পারেন না! বুঝলেও গুরুত্ব দেন না।
প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য বাজেট থাকে। কিন্তু এসব বিজ্ঞাপনের অধিকাংশই ঢালা হয় অপাত্রে। এমন সব কাগজকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, যেগুলো আদতে কোনও কাগজই নয়। পত্রিকা স্টলে পাওয়া যায় না, পাঠকের হাতেও দেখা যায় না কখনওই। কিছু কাগজ আবার বিজ্ঞাপনগুলো প্রকাশ করার জন্যই বের হয়! যথাস্থানে ‘দায়মুক্ত কপি’ পৌঁছে দিয়েই কাজ শেষ। বিজ্ঞাপনবাজারে ফটকাবাজি কম চলে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মী অসৎ হলে পার্সেন্টের হিসাবে ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায় আগেই। আবার এমনও শোনা যায়, বড়কর্তাকে খুশি করার জন্য কেউ কেউ নজরানা হিসেবে সুন্দরী তরুণী সরবরাহেও পিছিয়ে থাকেন না। এসব জটিল ও কুটিল পন্থায় যেহেতু সৎ লিটলম্যাগ সম্পাদক যাবেন না, আপস করবেন না―বলাবাহুল্য। তাকে চেয়ে থাকতে হয় তীর্থের কাকের মতো। ‘যৎকিঞ্চিত বিজ্ঞাপন দিয়ে যারা সহায়তা করেছেন’ এমন সম্পাদকীয়-ভাষ্য লেখার সুযোগ অনেকেই পান না।
ব্যক্তি সম্পর্কের কারণে অথবা কাগজের গুরুত্ব বুঝে নিয়মিত পাশে থেকেছেন এমন প্রতিষ্ঠানের উদাহরণও দুর্লভ নয়। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিত। এমন আরও কিছু ম্যাগাজিন খুঁজলে পাওয়া যাবে, যারা কতিপয় প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যখন বুঝতে পারেন, কাগজটির গুরুত্ব তখনই কেবল তিনি ব্যক্তি-সম্পর্কের বাইরে গিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। বর্তমান সময়ে এমন দৃষ্টান্ত দেখানো যাবে কি একটাও? জানা নেই, তবে থাকলে ভালো; সেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব, অহংকারে বুক ফুলিয়ে দেখাতে পারব ভবিষ্যতে।

লিটলম্যাগের লেখক কারা
এটা ঠিক, অনেক নবীন লেখকেরই দেয়ালিকা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের বার্ষিক প্রকাশনা দিয়ে লেখালেখির শুরু। সেখানে থেকে লিটলম্যাগে। হাত মকশো সেরে তারা একসময় বৃহৎ পরিসর―বড় কাগজে লিখতে শুরু করেন।
আবার এক শ্রেণির লেখক আছেন এরা শুধু লিটলম্যাগেই লেখেন। এদের একাংশ মূলত ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ করতে গিয়ে শুধু লিটলম্যাগেই বিচরণ করেন। খুঁজে নেন সীমানাঘেরা পরিসর। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কীসের বিরোধ তাদের, কেন করতে হয় বিরোধিতা?
প্রতিষ্ঠান মানেই এক ধরনের নিয়মকানুন মেনে চলে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। মুনাফা অর্জন, সুনাম অর্জন, প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানো―এই বৃহৎ লক্ষ্যেরই একাংশ। অন্যদিকে এসব মানতে নারাজ একশ্রেণির লেখক। তারা প্রতিষ্ঠানকে চান নিজেদের মতো করে, রুচি অনুযায়ী।
স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোনও প্রতিষ্ঠান চলে না, চলতে পারে না। এসব হচ্ছে সোনার পাথরবাটি। এটা যারা মানতে নারাজ―কালক্রমে তারাই হয়ে ওঠেন লিটলম্যাগের লেখক ও সম্পাদক। অর্থাৎ বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নামই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা!
নির্ভীকভাবে, দু হাত খুলে লেখার স্বাধীনতা মেলে একমাত্র লিটলম্যাগেই। এখানে মালিকপক্ষের ‘এজেন্ডা’র প্রতিকূলে কিছু লেখা হচ্ছে কি না, বিজ্ঞাপনদাতা কিংবা স্পন্সর প্রতিষ্ঠান রুষ্ট হবে কি না, ঠিকমতো মুনাফা অর্জিত হচ্ছে কি না―যাচাই করার ‘নিরীক্ষক বোর্ড’ ওই অর্থে নেই। স্বাধীনচেতা লেখকরা লিটলম্যাগে লিখেই প্রভূত আনন্দ পান, বলার অপেক্ষা রাখে না। লিটল ম্যাগাজিনে লেখার মাধ্যমেই নিজেদের বক্তব্যটি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন বৃহৎ পরিমণ্ডলে। শেষ পর্যন্ত পরিসরটি কতটুকু বৃহৎ হয়, এমন বিবেচনায় না গিয়েও লিটলম্যাগের শক্তি ও সামর্থ্যকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। নাগা মরিচ আকৃতিতে ছোট হলেও তার ঝাল তীব্র; রসনা-যন্ত্র জ¦লে-পুড়ে যায়!

মাপা শব্দের ‘চাপা’ মেকআপ…
নির্দিষ্ট কিংবা অনির্দিষ্ট কোনও বিষয়ে শব্দ গুনে লেখা যায়? নাকি সেটা আদৌ সম্ভব! এই অসম্ভবকে সম্ভব (!) করে চলেছে দৈনিক কাগজগুলো―দিনের পর দিন। গল্প হতে হবে কম-বেশি সাত শ শব্দে, প্রবন্ধ সাড়ে আট শ শব্দে, কবিতা সর্বোচ্চ ১২ লাইনে, বই আলোচনা দুই শ শব্দে… এভাবে প্রতিটি লেখার উপরেই কোনও না কোনওভাবে নেমে আসে শব্দসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের খড়গ। কোথাও কোথাও কিছুটা ব্যতিক্রমও আছে। সেসবও সীমাবদ্ধতার বাইরে যেতে পারে না। বাজারে একই পণ্য আলাদা মাপে ও সাইজে পাওয়া যায়। একই নকশার শার্ট বিক্রি হয় এল, এম, এক্স, এক্সএল, ডাবল এক্সএলসহ আরও ছোট-বড় মাপ-আয়তনে। মৌলিক লেখাও কি তবে এমন পন্থায় সাইজ বা রিসাইজ করা সম্ভব! যেভাবে চান সম্পাদককুল―মাপমতো খাপে খাপে মিলে যাবে ?
পুরো বিষয়টাই যেখানে আবেগ-অনুভূতি ও চিন্তাশীলতাকে ধারণ করে, পাঠকের ভাবনাকে উসকে দিতে চায়―সেখানে এসব ‘ডাইসের খাপে’ সঠিক মাপে লেখা কীভাবে সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত চাকুরে তথা বিভাগীয় সম্পাদককেও দোষারোপ করার সুযোগ নেই। এটুকু পাতায় তাকে কত কীই না দিতে হয়, আঁটাতে হয়। পূজার প্রসাদের মতো একটু একটু করে সব বিভাগের ‘সুষম সমাবেশ’ ঘটানো লাগে। লেখা বড় হলে মেকআপে আঁটানো যায় না। বেচারা গ্রাফিক্স ডিজাইনার কীবোর্ডের সর্বোচ্চ কারিশমায় কতটুকুইবা চাপাতে পারে, ঠেসে দিতে পারে―লাইন স্পেস, ওয়ার্ড স্পেসসহ আরও স্পেস কমিয়ে!
শেষ পর্যন্ত পারা যায় না অনেক কিছুই। আয়তনে বড় হলে সেই লেখা সহজেই বাতিলের খাতায় চলে যায়। ইমেইল থেকে ডাউনলোড করার পর শব্দসংখ্যা দেখেই নিয়তি নির্ধারণ হয়ে যায় অনেক লেখার। যদিও একটি কথা চাউর আছে―দৈনিকের সাহিত্যপাতায় সিন্ডিকেটপ্রথা প্রবল। এখানে ঘরানার বাইরে লেখা প্রকাশ করা হয় না। এই ঘরানার বাইরে এসে, প্রতিবাদী হয়েই কিন্তু লিটলম্যাগের জন্ম হয়। সেখানেও গড়ে ওঠে নিজস্ব গোষ্ঠী ও ঘরানা। এই ঘরানাকে আবার ইতিবাচক রূপে দেখা হয়। একই বিষয়―‘বড়’ করলে অপরাধ আর ‘ছোট’ করলে প্রশংসাযোগ্য―যস্মিন দেশে যদাচার প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয়, একটু ভিন্ন রূপে।

লেখার স্বাধীনতা, বলার ফুরসত
বড় কাগজ নামেই ‘বড়’, কাজের ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতা প্রচুর। লিটলম্যাগ শুধু বড় আয়তনের লেখাই ছাপে না, ব্যতিক্রমী ও সাহসী কিছু লেখাও প্রকাশ করে তর্ক-বিতর্ক, ভয়-ডরের ঊর্ধ্বে উঠে। কিছু কিছু বিষয়ে লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় কাগজে লিখিত-অলিখিত নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। জবাবদিহি করতে হয় জায়গায়-বেজায়গায়। শাসকপক্ষকে ক্ষেপিয়ে কোনও কাগজের পক্ষেই দীর্ঘ পথচলা সম্ভব হয় না। অন্তত বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায়। বিজ্ঞাপনপ্রাপ্তির সুযোগ রদ, ডিক্লারেশন বাতিল, প্রচারে-বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতাসহ আরও তোপের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে লিটলম্যাগ অবশ্যই স্বস্তির জায়গা। ভরসার আধার। যে কোনও বিষয়ের রচনা স্বচ্ছন্দে প্রকাশ করতে সমর্থ হন একজন তেজি সম্পাদক। যিনি দায় বোধ করেন মাটি, মানুষ ও সমকালের প্রতি।
অবশ্য লিটলম্যাগ যে বিপদে পড়ে না, তাও নয়। ছাড়া ছাড়া-ভাবে হলেও এমন কিছু আলামত দেখা যায়। প্রায় এক যুগ আগে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা থেকে ল্যাম্পপোস্ট নামের একটি ম্যাগের স্টল বাতিল করা হয়। অভিযোগ ছিল রাষ্ট্রবিরোধী লেখা প্রকাশ করার। তখন মেলা ছিল বাংলা একাডেমির ভেতরেই, লিটলম্যাগ স্টল ছিল বয়রাতলা ও কাঁঠালতলায়। সে সময় ল্যাম্পপোস্ট ম্যাগাজিন সংশ্লিষ্টরা প্রতিবাদ করলেও বাতিলকৃত স্টল ফেরত পাননি আর। এমন ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কেউ যদি অতি উৎসাহী আচরণ না করে, সাধারণত লিটলম্যাগ নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না। হয়তো বিকল্প এই প্রচারমাধ্যমকে রাষ্ট্র এত ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ ভাবে―ভ্রƒক্ষেপ করার যোগ্যই মনে করে না! অপ্রিয় সত্য এটাও―লিটলম্যাগকর্মীরা নিজেদের সেই শক্তিমত্ত ‘বিরোধী’ জায়গাটা ওই অর্থে সৃষ্টি করতে পারেননি। যেহেতু ‘মরে’ যাওয়াই লিটলম্যাগের স্বভাব, এই কারণেই কি তবে কোনও সম্পাদক খুব বেশি আগে বাড়েন না, বিরোধী দলের দায়িত্ব তুলে নেন না ঘাড়ে-ললাটে ?

ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়?
বাংলা একাডেমিতে লিটলম্যাগের নামে আদতে কী বরাদ্দ দেওয়া হয় ? এমন প্রশ্ন তোলার আগে ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ প্রবাদটিকে স্মরণে আনা যেতে পারে। সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা থেকে শুরু করে সংগঠন―সবাই এখন স্টল পায় একুশে বইমেলায়। অবশ্য লিটলম্যাগ তাহলে কোনটিকে বলব? কর্তৃপক্ষ যথার্থ লিটলম্যাগ বাছাই করতে গেলে হয়তো মাঠের বড় একটি অংশকে ফাঁকাই রেখে দিতে হবে! আশি ও নব্বইয়ের দশক ছিল লিটলম্যাগ প্রকাশের স্বর্ণযুগ। চমৎকার সব ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো এই সময়ে। এর বাইরে পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকে অল্প হলেও কিছু ম্যাগাজিন ছিল। যেগুলো ছিল সত্যিকার অর্থেই ম্যাগাজিন। প্রকাশের উদ্দেশ্য নিছক সাহিত্যচর্চা ছিল না।
বাংলা একাডেমি বছর দশেক আগেও যাচাই-বাছাই করে লিটলম্যাগ চত্বরে স্টল বরাদ্দ দিত। বর্তমানে সেই ‘বাছাই’ ধারা শিথিল হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই তো ম্যাগাজিন স্টলে খুব সহজেই সাপ্তাহিক পত্রিকার নামটি দেখা যায়। নবীন সম্পাদকরাও নিজেদের সরগরম উপস্থিতি বজায় রাখেন। কিন্তু আড্ডা জমে কি? যে লিটলম্যাগ চত্বরের প্রাণ ছিল আড্ডা, আড্ডা থেকেই বেরিয়ে আসত কত অনালোকিত অধ্যায়―সেই আড্ডায় এখন কফি পাওয়া যায় বৈকি! বইমেলায় কফি স্টল এখন সুলভ। কম দামের চা হারিয়ে গেছে বাণিজ্যের খপ্পরে পড়ে। কফির কাপে ঝড় হয়তো তোলেন সম্পাদকরা, কিন্তু তাতে সাহিত্যচর্চা কিংবা ম্যাগাজিনের গুণগত মানের তারতম্য ঘটে না!
দোষারোপের সংস্কৃতিতে যেতে চাচ্ছি না। বুঝতে চাচ্ছি সীমাবদ্ধতার হালহকিকত। লিটলম্যাগকে স্বস্থানে, স্বভূমিতে ফেরাতে তবে কী করতে পারে বাংলা একাডেমি? ‘সেন্সর বোর্ড’ আরও কঠিন করে ফেলবে? তাতে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের অবস্থাই হবে। সেই তেজস্বী সম্পাদক বর্তমানে কমই আছে, যারা বোঝেন কী প্রকাশ করতে হয় আর কী প্রকাশ না করলেও চলে! শুধু ‘নিষ্কলুষ’, ‘নিরপেক্ষ’ সাহিত্যচর্চা লিটলম্যাগের উদ্দেশ্য হতে পারে না। লিটলম্যাগ আরও বড় পরিসরের বিষয়। যদি সেটাকে কেউ আমলে নিতে চান!

সংকটের নাম ভালো লেখা প্রাপ্তি
ভালো লেখা বা ভালো বিক্রি কোনওটাই নেই। লিটলম্যাগ এই দুই বড় সংকটকে নিয়েই পথ চলছে। ম্যাগাজিন বিক্রির টাকা পাওয়া যায় না। স্টলে বিক্রি হলেও সেই টাকা সম্পাদকের হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না।
সম্পাদনার সবচেয়ে বড় সমস্যা লেখা পাওয়া। প্রবন্ধ বা গদ্যজাতীয় লেখার মানুষের বড়ই অভাব। তাই তো সম্পাদক অনেকেরই হাতে-পায়ে ধরেন লেখার জন্য। অল্প কিছু লেখা জোগাড় করেও ফেলেন। তারপর প্রকাশনার খরচ জোগাড় করার জন্য কত কষ্টই না করতে হয় তাকে। মানুষ হয়ে বেঁচে আছেন নাকি খয়রাতি হয়ে―এমন উপলব্ধিও কারও কারও হয় বৈকি!
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। নির্দিষ্ট সময় পরে হয়তো সম্পাদক বেচারা আবিষ্কার করলেন, মাসের পর মাস কাউকে তাড়া দিয়ে যে লেখাটি লিখিয়ে নিয়েছিলেন সেটা প্রকাশিত হয়ে গেছে অন্য কাগজে! লেখার বিষয় পেয়েছেন, লেখাও হয়ে গেছে―প্রকাশের আকুলতা যে পেয়ে বসেছে লেখককে, তর সয় না! বেচারা সম্পাদকের মনের অবস্থা কী হয় তখন―কহতব্য নয়। ঘরে-বাইরে হাজারো বিপ্রতীপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদককে। আঁচড়ে-আঘাতে রক্তাক্ত হতে হতেই জন্ম হয় সম্পাদকের। তারপর চারপাশের এহেন ‘অরাজকতা’ দেখতে দেখতে তার সম্পাদকসত্তার মৃত্যু ঘটতেও সময় লাগে না। হারাতে বসে উৎসাহ-উদ্দীপনা।
কী বিপুল সংকট পেরিয়ে জন্ম হয় একেকটি লিটলম্যাগের! ফুলের দেখা মেলে না, কাঁটা-বিছানো পথে বার বার রক্তাক্ত হতে হয় সম্পাদককে। প্রবন্ধ লেখার লোক নেই, ভালো গল্প নেই, মননশীল গদ্য নেই; বিষয়ভিত্তিক লেখা পাওয়াও সহজসাধ্য নয়―এগুলোর পেছনে নিরন্তর ছুটতে হয় বেচারা সম্পাদককে। এখানে আবার জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনও রয়েছে। একটু একটু করে জীবনক্ষয়ের মাধ্যমে সম্পাদনাকে করে তুলেছেন জীবনের ব্রত। বিপরীতে দফায় দফায় তাকে নীলকণ্ঠ হতে হয়।
আবার ক্ষেত্রবিশেষে উল্টো চিত্রও দেখা যায়। প্রতিষ্ঠিত কাগজের বাজারি লেখা থেকে মুক্তিলাভের জন্য যে ম্যাগাজিনগুলোর জন্ম, এটা কোনও কোনও সম্পাদক বোধকরি ভুলে যান একটা সময়ে এসে। গা ভাসিয়ে দেন গড্ডলিকা প্রবাহে। দৈনিক বা প্রতিষ্ঠিত কাগজের মতো সেই একই ভণ্ডামি দেখা যায় লিটলম্যাগেও। একজনের একাধিক লেখা প্রকাশ করা যাবে না, হলেও সেটা ছদ্মনামেই প্রকাশ করতে ইচ্ছুক সম্পাদক। এমন তরিকায় শফিক হাসান সহজেই হয়ে যেতে পারেন এস. হাসান! কোনও কোনও সম্পাদককে এমন ব্যাখ্যাও দিতে শুনেছি―স্বনামে একজনের একাধিক লেখা ছাপলে লোকে বলবে এই কাগজের পর্যাপ্ত লেখক নেই! সেই ‘লৌকিকতা’, ‘দেখনদারি’ আর তথাকথিত গ্ল্যামারের ঝলকানি যদি লিটলম্যাগেও দেখতে হয় তবে এর জন্মকে বৃথা-বেহুদা বলা ছাড়া উপায় কী!

লেখা তো দিলাম, বিল কোথায়!
লেখা বাবদ অর্থ দাবি করেন এমন লেখকও আছেন চারপাশে। দিনশেষে অথই অন্ধকার ছাড়া আর কীইবা দেখতে পাওয়া যায়! সম্ভাবনার আলো কিংবা স্বর্গীয় পারিজাত ফুল হয়তো কোনও কোনও মেধাবী সম্পাদক দেখতে পান, তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এমন চক্ষুষ্মান গৌণ।
এমন ‘সিনিয়র লেখক’ও আশপাশে অপ্রতুল নন, যারা সুযোগ পেলেই অতীত গৌরবগাথা, স্বর্ণালি গল্প শোনাতে শুরু করেন। বর্ণাঢ্য সেই ইতিহাসে থাকে নানা জৌলুস। রাজা-উজির তারা মারতে পারেন ঠিকই শুধু দেখতে পান না সামনে বসে থাকা লোকটির ত্যাগ-তিতিক্ষাটুকু। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও তিনি কাগজে লিখে কী পরিমাণ টাকা পেতেন, নিজের সম্মানজনক অর্জনের কথা ফলাও করে জানাতে ভোলেন না। বর্তমানে পত্রিকার সম্পাদকরা টাকা দিতে অনীহ, খেদটুকু প্রকাশ করেন অকপটেই!
একদিকে যেমন চক্ষুষ্মান ও বিবেকবান লেখক কমছে, তারচেয়েও বড় আশঙ্কার বিষয়―নেই হয়ে যাচ্ছে লিটলম্যাগের পাঠক। অবশ্য সব ধরনের পাঠকই কমছে। এমনকি চটি বইয়েরও! এখনও যারা পড়তে পছন্দ করেন, সবাই হয়তো জানেনও না, লিটলম্যাগ বলে আলাদা একটি ‘ছাপা-অস্তিত্ব’ আছে। ভবিষ্যৎ সংশয়-দীর্ণ হলেও অতীত তো উজ্জ্বলই ছিল! ভালো লেখা নেই, সঞ্চিত অর্থ নেই, বিজ্ঞাপন নেই, বাজার নেই, কাজের স্বীকৃতি নেই―এমন হাঙর-কুমির উপদ্রুত সমুদ্রে সাঁতার কেটে অগ্রসর হন সম্পাদক। জানেন না গন্তব্যের শেষবিন্দুর হদিস।
বড় কাগজে লিখলে একসময় লেখার বিল, যেটার মুখরোচক নাম সম্মানী, পাওয়া যেত। বর্তমানে সেখানেও ধস নেমেছে। নানাবিধ জটিলতায় অনেক পত্রিকাই বিল দেওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর বেচারা লিটলম্যাগ সম্পাদককে সবসময়ই বলে যেতে হবে ‘আমরা বিল দিতে পারি না’। কৌশলী সম্পাদকরা তোয়াজ করার ভঙ্গিতে বলেন, ‘সম্মানী দিতে পারি না, তবে সম্মান দিই!’
গোষ্ঠীবদ্ধতা-চর্চার শক্তি ও বিপদ
আজকাল সহজেই ভেঙে যায় সবকিছু। বিকল্পধারার রাজনীতি কিংবা স্বপ্নময়ী নতুন সংসারের মতো লিটলম্যাগচর্চার গোষ্ঠীগুলোও হয়ে উঠেছে ক্ষণস্থায়ী। সম্পাদনা পর্ষদ ভেঙে দুই-তিন ভাগ হয়ে যাচ্ছে সহজেই। সম্পাদকমণ্ডলী শেষপর্যন্ত এক থাকতে পারেন না। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে চিড় ধরে। বড় হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত লাভালাভ কিংবা মতাদর্শ।
‘সম্পাদকমণ্ডলী’ বা ‘গোষ্ঠী’ কী! চূড়ান্ত বিচারে এসব সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছুই নয়। শেষ পর্যন্ত একজনের হাত দিয়ে সম্পন্ন হয় পুরো কাজ। ‘মণ্ডলী’ থাকে না, ‘গোষ্ঠী’ নামকাওয়াস্তে থাকে। মানে নামের জন্যই! কায়ক্লেশে পত্রিকা ছাপা হলে সংশ্লিষ্ট(!) সদস্যরা প্রথমেই পৃষ্ঠা উল্টে দেখেন প্রিন্টার্স লাইনে নিজ নামের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে কি না! সেটা থাকলে সম্পাদককে ‘ভালো করেছিস দোস্ত’ মন্তব্য দিয়ে পত্রিকার সৌজন্য কপি কুক্ষিগত করে হাওয়া হয়ে যান! এমনতর ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ পরিস্থিতিতে সম্পাদকমণ্ডলী বা গোষ্ঠী গড়ে না ওঠাই স্বাভাবিক।
গোষ্ঠীবদ্ধতা ভেঙে পড়েছে আরও আগেই। ‘দশে মিলি করি কাজ/ হারি-জিতি নাহি লাজ’ প্রবাদের মতো যদি সম্পাদক আরও নয়জনকে পাশে পেতেন, কাজটা চালিয়ে যেতে পারতেন সহজেই। কিন্তু যারা ‘নাম কামানো’র (কখনওবা অর্থ কামানোও) মতো চিন্তায় মশগুল থাকেন, তারা যে শেষ পর্যন্ত কষ্টসাধ্য কোনও কাজে জড়িত থাকবেন না, বলার অপেক্ষা রাখে না!
অস্তিত্ব বিপন্নের আয়োজন…
লিটলম্যাগ সম্পাদনার জন্য প্রাত্যহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য ত্যাগও আছে। একজন সম্পাদক অচিন্ত্য চয়নকে জানি, তিনি টাকার সংস্থান করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ব্যবহার্য মোবাইল ফোনটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। লতিফ জোয়ার্দার একটা খাসি কিনে পেলেপুষে বড় করে কোরবানি ঈদের আগে বিক্রি করে ম্যাগাজিন প্রকাশের টাকা জোগাড় করেছিলেন। এমন পন্থায়ও লিটলম্যাগ সম্পাদনা করা হয়!
উন্মাদ ম্যাগাজিনের কার্টুনশিল্পী তাহের টিপুর কাছ থেকে জেনেছি আরেকজন ক্ষ্যাপাটে সম্পাদকের গল্প। রাজশাহী অঞ্চলের এই সম্পাদক মৌসুমে বাগানের আম বিক্রি করে লব্ধ টাকায় ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতসারে আরও কতজন সম্পাদক কত বিচিত্র উপায়ে ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন―ইয়ত্তা আছে! এটা ঠিক, অর্থবিত্তবান কেউ এমন ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কাজ করেন না। শুধু যাদের চালচুলোর ঠিক নেই, অর্থ বিত্ত প্রতিপত্তি নেই কেবল তারাই করেন; মাততে পারেন সৃজননেশার বুনো উল্লাসে। সম্পাদনা কেন ‘সর্বজনীন’ হলো না, নির্দিষ্ট শ্রেণিতেই আটকে রইল―গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিকরা নিশ্চয়ই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। তবে একটা প্রশ্নের জবাব মেলে না। লিটলম্যাগ যারা সম্পাদনা করেন, এদের একটা অংশের লক্ষ্যই থাকে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করতে করতে নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার নামই লিটলম্যাগ। বড় কাগজের সঙ্গে এর বিশাল দূরত্ব আছে। যেহেতু বড় কাগজের বিপরীতে দাঁড়িয়েই কোনও কোনও ম্যাগাজিনের জন্ম হয়। তাহলে দৈনিকের সাময়িকীর আনুকূল্য প্রয়াসী হতে হবে কেন লিটলম্যাগ সম্পাদককে! কথিত আছে―প্রকাশের পর লিটলম্যাগের প্রথম সংখ্যাটাই কেউ কেউ পাঠিয়ে দেন দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক বরাবর; রিভিউ করানোর খায়েশ থেকে। যারা এসব করেন, নিজেদের আদর্শ পরিপন্থি কাজই করেন―বলাবাহুল্য। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা করতে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার লক্ষ্য ও আচরণ নিশ্চয়ই এটা নয়!
লিটলম্যাগ ও সাহিত্যপত্রিকা : ফারাক কী ?
লিটলম্যাগের সঙ্গে সাহিত্যপত্রিকার ফারাক কমে আসছে। লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে আছে কি না, অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নটা শুরুতেই সামনে এনেছি। লিটলম্যাগ আর সাহিত্যপত্রিকার চারিত্রিক-বৈশিষ্ট্য আলাদা। বারোয়ারি সাহিত্যকাগজের সঙ্গে লিটলম্যাগকে মেলানোর সুযোগ নেই। নতুন সংস্কৃতিতে সাহিত্যপত্রিকাগুলোকেই লিটলম্যাগ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে! দুটি কাগজের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সেটাকে ‘একীভূত’ করার কী লক্ষ্য থাকতে পারে! সেটা কি এই―লিটলম্যাগ আন্দোলনের রয়েছে দীর্ঘ পথপরিক্রমা, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। এই ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, গায়ে বাড়তি ‘সুগন্ধি’ মাখানোর পাঁয়তারা করা হয়!
বিপরীতে এটাও নিদারুণ সত্য―সম্পাদকদের একাংশ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না; ভাবেন গতানুগতিক কয়েকটা গল্প কবিতা প্রবন্ধ গ্রন্থালোচনা জড়ো করলেই বুঝি লিটলম্যাগ হয়ে যায়। সেটা বড়জোর সাহিত্যম্যাগ হতে পারে, সংকলন নাম ধারণ করতে পারে―কোনওভাবেই লিটলম্যাগ নয়। অল্প-কথায় লিটলম্যাগ শনাক্তকরণে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। অন্তত সেটা পড়া থাকলে কিছুটা হলেও প্রভেদ বোঝা যাবে। প্রচারে এগিয়ে থাকবে না, গায়ে-গতরে বেশি বড় হবে না, জনপ্রিয়তার কলঙ্ক থাকবে না গায়ে, দীর্ঘায়ু হবে না…।
আড্ডাই কি জন্ম দেয় নতুন সাহিত্যের ?
লিটলম্যাগের সঙ্গে আড্ডার একটা নিবিড় যোগসূত্র আছে। আড্ডা থেকেই ম্যাগাজিনের জন্ম হয়েছে, এমন নজির প্রচুর। এটাই ‘গোষ্ঠীবদ্ধ সম্পাদনা’। ব্যক্তির বাইরে নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠী তথা লেখক-দল নিজেদের লেখালেখির চর্চা শাণিত করার মানসে পত্রিকা সম্পাদনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন অতীতে। বর্তমানে তেমনটি দেখা যায় না বললেই চলে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগপ্রাপ্তির নির্ভরযোগ্য জায়গা চট্টগ্রামে কারেন্ট বুক সেন্টার থেকে হালের বাতিঘর, ঢাকায় জনান্তিক, লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ, বগুড়ার পড়ুয়া। রাজশাহী, নওগাঁ, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ আরও কোনও কোনও জেলার নামও ক্ষীণস্বরে উল্লেখ করা যায়।
তবে লোক সম্পাদক অনিকেত শামীম আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতলে ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একক উদ্যোগে। এই প্রাঙ্গণও সংকুচিত হয়ে আসছে ক্রমশ। বড্ড অনিয়মিত এখন, লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ খুব কমই খোলা হয়। খুললেও সেখানে আর আড্ডার লোক মেলে না। প্রাঙ্গণ অঙ্গন বারান্দা সবই কোণঠাসা এখন। জীবিকা ও রুচি বদলের তাগিদেই বোধকরি সংশ্লিষ্টরা কমিয়ে দিয়েছেন আড্ডা-পরিসর। অনিকেত শামীমের উদ্যোগে আজিজ সুপার মার্কেটে দুইবার লিটলম্যাগ সম্মেলন হয়েছিল। প্রথম আয়োজনের স্লোগান ছিল―রুখো মৌলবাদ, রুখো সাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয়বার লিটলম্যাগ-চরিত্র্যের সঙ্গে মিলিয়ে চমৎকার স্লোগান দেওয়া হয়েছিল―ছোট্ট ডানায় ধরি অপার আকাশ।
আজিজ সুপার মার্কেটের সেই বিখ্যাত আড্ডাগুলোও আর নেই। বইয়ের মার্কেট পরিচয় ঘুচিয়ে এটা এখন টিশার্টের বড় বাজার। কিছু আড্ডা সরে এসেছে কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে। আড্ডাপিয়াসী শিল্পজনের দেখা সংখ্যায় কম হলেও মেলে এখানে।
লিটলম্যাগ প্রদর্শনী ও পরিচিতিমূলক অনুষ্ঠান বন্ধ কেন
অনিয়মিতভাবে হলেও জাতীয় গণগ্রন্থাগার লিটলম্যাগ প্রদর্শনীর আয়োজন করত। নতুন করে সেখানে যুক্ত হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি। বিগত সরকারের আমলের শেষ দিকে লিটলম্যাগ প্রদর্শনীর পাশাপাশি পুরস্কার দেওয়ার প্রচলনও গড়ে উঠেছিল।
একই আদলে বাংলা একাডেমি চাইলে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারত। করে না তো কখনও! প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলায় আলাদাভাবে লিটলম্যাগের স্টল বরাদ্দ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। দেড় থেকে দুই শ স্টল সাজানো হলেও এগুলোর মধ্যে প্রকৃত অর্থে লিটলম্যাগ কয়টি―প্রশ্নটি করা যায়।
বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরেও আড্ডা জমে বৈকি। আড্ডা মানেই কি সতীর্থদের খারিজ করে দেওয়ার রেওয়াজ? অমুকের-তমুকের সম্পাদনা হয় না, ওসব বাজারি পত্রিকা! ‘বাজারি’ পত্রিকা বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য যারা করেন এদের অধিকাংশই কিন্তু জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে বাজারি পত্রিকারই লেখক কিংবা সম্পাদক। বস্তুত, বাজার কাউকে নিষ্কৃতি দেয় না। বিদ্যমান বাস্তবতায় আরও বড় বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। সম্পাদক না বলে সতীর্থ কাউকে কাউকে ‘সংকলক’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার রেওয়াজও বহুদিনের।
বাংলা একাডেমি আন্তরিকভাবে চাইলে প্রতি বছর বরাদ্দপ্রাপ্ত স্টলগুলো থেকে যে কোনও একটি লিটল ম্যাগাজিনকে ‘সেরা সম্মাননা’ দিতে পারে। অবশ্যই সেটা চুলচেরা যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে।
জন্মদিনকে সামনে রেখে প্রকাশনার তোড়জোড়
জন্মদিন উপলক্ষে, পঞ্চাশ বর্ষপূর্তি, ষাট বর্ষপূর্তি এমন বছরকে সামনে রেখে ঢাউস সাইজের ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। সংখ্যায় সেগুলো কমও নয়। এমনটা হওয়া উচিত ছিল মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখেই! তখন নিরঙ্কুশভাবে বোঝা যেত লেখক আদতে কী ভাণ্ডার রেখে গেছেন, সেই আলোকে করা যেত তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের চুলচেরা বিশ্লেষণ। অবশ্য আলোচনাইবা করবেন কে? অন্যকে নিয়ে লেখার ও বলার মানুষের অভাব বরাবরই। চোখটাই এমন নিজেকে দেখা ছাড়া অন্য কোথাও মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটে না! রিক্ততা ধরা পড়ে সম্পাদনার বিষয় নির্বাচনেও। বাজার যেখানে বড়, সম্পাদক নামধারী সেখানে গরহাজির থাকতে পারেন না!
সাহিত্যবাজারের বড় একটি বৈশিষ্ট্য―কোনও কবি-লেখককে নিয়ে একক সংখ্যা প্রকাশ। জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ঢাউস সাইজ ম্যাগাজিন। জন্মবার্ষিকী বা সামষ্টিক সাহিত্য মূল্যায়নকেন্দ্রিক সংখ্যাগুলোর টাকা সংশ্লিষ্ট লেখকই নেপথ্যে থেকে জোগান দেন। কেউ দেন নগদানগদি, আবার চেয়ারের ক্ষমতায় বলীয়ান ব্যক্তি বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করিয়ে দেওয়ায় ভূমিকা রাখেন। যিনি যে-পন্থাতেই করেন না কেন, সম্পাদকের লাভ তুলে নেওয়াই থাকে মূল লক্ষ্য। সম্মান ও গৌরবের ধন ‘বালিশ’টা বাড়তি পাওনা। ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাজগুলোতে প্রচুর স্তুতি থাকে সত্য, সেখানে সাহিত্য কতটুকু, পাঠযোগ্য কয়টা লেখা থাকে―বরাবরই এসব প্রশ্ন জাগরুক। লেখা বা বিজ্ঞাপন প্রকাশ যেভাবেই হোক―সম্পাদকের লক্ষ্য যদি নাম কামানো বা মুনাফা অর্জন হয়, লিটলম্যাগের মৃত্যু তখনই হয়ে যায়। অবাণিজ্যিকই শুধু নয়, লিটলম্যাগকে লোকসানি খাতেও রাখতে হয়। নইলে এটার বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন হয় বলেই মনে করি।
ছোটটাই সবচেয়ে সুন্দর…
ভারতের বাংলা ভাষাভাষী রাজ্যগুলো থেকে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়, নাতিদীর্ঘ এক-দুই ফর্মার―মোটা প্রচ্ছদ ছাড়াই অথচ কী তেজোদীপ্ত, সাহিত্যমানে ঋদ্ধ! আমরা কেন পারি না? কেন মোটা-তাজা বালিশচর্চায় নিয়োজিত থাকতে হয়! লিটলম্যাগকে কোরবানির গরুর মতো স্বাস্থ্যবান হতে হবে―এমন দিব্যি কেউ দেয়নি! দৈনিক খোলা কাগজে সাবেক সহকর্মী আবুবকর সিদ্দিক ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের লিটলম্যাগ সম্পাদকদের প্রসঙ্গে বলেছিলেন―ওরা অল্পেই সন্তুষ্ট। একটা শিঙাড়া পেলেই খুশি হয়ে যায়। আমাদের তো অনেক কিছুই লাগে!
এটা সত্য, আমরা ভোগ-বিলাসে এগিয়ে। অল্পে তুষ্ট থাকতে পারি না। দেখনদারি পছন্দ করি। সামষ্টিক প্রভাব সম্পাদনায় পড়াটাই স্বাভাবিক। অথচ চাইলে সংক্ষিপ্ত পরিসরেই ম্যাগাজিনগুলোর প্রকাশনা চালু রাখা যায়। ভালো কথা, তেতো কথা খুব বেশি দীর্ঘ হয় না, অল্পতেই কাজ সারা যায়। লিটলম্যাগগুলো চাইলে এক-দুই ফর্মা আয়তন বজায় রেখে দরকারি লেখাগুলোই প্রকাশ করতে পারে। চর্বিত চর্বণ কিংবা গতানুগতিকতা যথার্থ ম্যাগাজিনের উদ্দেশ্য হতে পারে না।
ম্যাগের পাতায় লেগে থাকে সম্পাদকের রক্ত
কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার বেমক্কা প্রশ্ন করে বসেছিলেন―‘এই ম্যাগাজিনে তোমার রক্ত লেগে আছে না?’
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে নিজের সম্পাদিত ম্যাগাজিনটা স্যারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। (প্রকাশ, গল্পবিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন)। উল্টে-পাল্টে তিনি প্রশ্নটা করেছিলেন। কথাটা শতভাগ সত্য, কিন্তু রক্ত লেগে থাকার হদিস জানলেন কীভাবে অধ্যাপক মনীষী!
আরেকটি মোচড়-লাগা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন প্রয়াত লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। একান্ত আলাপে আমাকে তিনি বলেছিলেন―‘আপনি কি এমন একটি নজিরও দেখাতে পারবেন, লিটলম্যাগ সম্পাদনা করে কেউ গাড়ি-বাড়ি করেছেন, বিরাট সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন?’
যতই আমরা পরস্পরের দোষ-ত্রুটি খুঁজি―শেষ বিচারে প্রায় সব সম্পাদকই বঞ্চিত। সংসারত্যাগী কপালপোড়া। এদের সংসার হয় না, হলেও টেকে না। লিটলম্যাগ সম্পাদনার জীবন্ত শহীদ একেকজন। সঙ্গত কারণে সমাজ-রাষ্ট্রও এদের তেমন পোঁছে না, দাম দেয় না। বরং উল্টোদিক থেকেই প্রশ্নটা চাউর রাখি―যথার্থ লিটলম্যাগ সম্পাদনায় সংশ্লিষ্টদের করণীয় কী হতে পারে। কীভাবে বাড়ানো যায় পাঠকের অংশগ্রহণ। বাজার সম্প্রসারণ ও প্রচার-প্রসারের আলোয় আনাটা কতটা জরুরি!
ছোটকাগজ বড় ভূমিকা রাখতে পারবে তখনই―যখন আমরা এর শক্তি-সামর্থ্যরে জায়গাটা চিহ্নিত করতে পারব। আবেগ আর ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থের চিন্তা বাদ দিয়ে নজর দিতে পারব বৃহতের দিকে, গণকল্যাণে। তখনই, যুগান্তকারী বিপ্লবে ছোটকাগজের একেকটি শব্দ হয়ে উঠবে বুলেটসম। যা ধারে-ভারে দুভাবেই কাটবে!
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিস্তর রক্ত ঝরিয়েছেন লিটলম্যাগ সম্পাদনা করে। ষাটের দশকে কণ্ঠস্বর, শূন্যের দশকে আবহমান সম্পাদনা তার উজ্জ্বল কীর্তি। কণ্ঠস্বর সম্পাদনার অভিজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছেন পুরো একটি বই―ভালোবাসার সাম্পান। মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে আরও বরেণ্য সাহিত্যিকের উত্থানকাল চিত্রিত হয়েছে। লেখক ও সম্পাদক হয়ে ওঠাটা যে কতটা কঠিন আর আত্মঘাতী সেসব ‘অজানা’ তথ্য জানা গেছে এই বইয়ে।
কাকে বলি লিটলম্যাগ
কিংবদন্তির মতো ঘোরে-ফেরে কিছু লিটলম্যাগের নাম। সব আমার দেখা হয়নি, পড়ার সুযোগ মেলেনি। সুন্দরম, উত্তরমেঘ, সমকাল, স্বাক্ষর এমন আরও কিছু নাম তাই চোখে না দেখা স্বপ্ন-গল্প। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা বিরাট একটি মোচড় দিয়ে গেছে। সম্পাদকের বিচিত্র বিষয়ে অসীম পাণ্ডিত্য থাকলে ঢাউস অথচ চমৎকার সব সংখ্যা প্রকাশ করা যায়, প্রয়াত মীজানুর রহমান তার প্রকৃষ্ট নজির স্থাপন করে গেছেন।
নাঈম হাসান সম্পাদিত নিরন্তর লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার আরেকটি উজ্জ্বল বাতিঘর। কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত ছোটগল্প ম্যাগাজিন এখনও গল্পচর্চার গুটিকয়েক কাগজের ব্যতিক্রমী নজির। আন্ওয়ার আহমদ ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক। সম্পাদনা করতেন গল্পপত্রিকা রূপম। পাশাপাশি আরেকটি কাগজও সম্পাদনা করতেন―কিছুধ্বনি। চার দশকেরও বেশি সময় যাবত পুলক হাসান সম্পাদনা করছেন খেয়া। পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেন আরেকটি লিটলম্যাগ―প্রতিস্বর। কিছুকাল সম্পাদনা করেছিলেন বিহঙ্গকাল নামে আরেকটি কাগজ। খেয়ার রবীন্দ্র সার্ধশতবার্ষিকী সংখ্যা, নূরুল হক সংখ্যা, কাশীনাথ রায় সংখ্যা, সেলিম সারোয়ার সংখ্যা মনোযোগ কেড়েছে অনেকের। বর্তমানে লিটলম্যাগ প্রকাশনার ক্ষীণ ধারাটিকে লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে ধরে রেখেছেন অল্প যে কজন সম্পাদক, পুলক হাসান তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
বেশ কয়েকজন সম্পাদককে দেখেছি একাধিক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতে। লতিফ জোয়ার্দার ও বঙ্গ রাখাল বোধকরি সর্বাধিক সংখ্যক ম্যাগের সম্পাদক। একজন সম্পাদককে কেন একাধিক নামের লিটলম্যাগ সম্পাদনা করতে হয়? সম্পাদক নিজে ছাড়া অন্যদের পক্ষে এই প্রশ্নের জবাব মেলানো কঠিনই হবে।
এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে আমার মুগ্ধ পাঠতালিকায় ছিল বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিন। সব কটিই যে যথার্থ অর্থে লিটল ম্যাগাজিন এমন দাবি করব না। খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ, হাবিব ওয়াহিদ সম্পাদিত অনিন্দ্য, শামীম হোসেন সম্পাদিত নদী, হুমায়ুন কবির সম্পাদিত ঘুংঘুর, জাকির তালুকদার সম্পাদিত বাঙাল, শাহানা আকতার মহুয়া সম্পাদিত ছান্দস, আসমা বীথি সম্পাদিত ঘুড়ি, আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত অমিত্রাক্ষর, মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ সম্পাদিত ঊষালোকে, আবদুল মান্নান স্বপন সম্পাদিত ধমনি, মাহমুদ কামাল সম্পাদিত অরণি, লুবনা চর্যা সম্পাদিত সহজ, শফিক আজিজ সম্পাদিত কার্পাস, ইসলাম রফিক সম্পাদিত দোআঁশ, সাজ্জাদ আরেফিন সম্পাদিত নান্দীপাঠ, মজিদ মাহমুদ সম্পাদিত পর্ব, বঙ্গ রাখাল সম্পাদিত নিহারণ, আমিরুল বাসার সম্পাদিত সাম্প্রতিক, শওকত হোসেন সম্পাদিত হালখাতা, গোলাঘর, শাজান শীলন সম্পাদিত কহন, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর সম্পাদিত কথা, তৌহিদ ইমাম সম্পাদিত মারমেইড, মামুন মুস্তাফা সম্পাদিত লেখমালা, রিফাত চৌধুরী সম্পাদিত ছাঁট কাগজের মলাট, শফিক সেলিম সম্পাদিত মানুষ, আনোয়ার কামাল সম্পাদিত এবং মানুষ, অরবিন্দ চক্রবর্তী সম্পাদিত মাদুলি, সরকার আশরাফ সম্পাদিত নিসর্গ, জাহিদ আনোয়ার সম্পাদিত অঞ্জলি লহ মোর, অনিকেত শামীম সম্পাদিত লোক, শাহিন লতিফ সম্পাদিত মেঘ, রনি অধিকারী সম্পাদিত অনুভূতি, রূপান্তর, আঁখি সিদ্দিকা সম্পাদিত মলাট, মাসুম মুনাওয়ার সম্পাদিত চিরকূট, ওবায়েদ আকাশ সম্পাদিত শালুক, বীরেন মুখার্জী সম্পাদিত দৃষ্টি, চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত গল্পকথা, আহমেদুর রশীদ টুটুল সম্পাদিত শুদ্ধস্বর, রনজু রাইম সম্পাদিত কবিতাসংক্রান্তি, মাজহারুল আলম তিতুমির সম্পাদিত স্বর, চন্দন চৌধুরী সম্পাদিত বেহুলাবাংলা, রাজা সহিদুল আসলাম সম্পাদিত চালচিত্র, আলী প্রয়াস সম্পাদিত তৃতীয় চোখ, শাহনাজ পারভীন সম্পাদিত দ্যোতনা, কিং সউদ সম্পাদিত সন্ধ্যা, ইসমত শিল্পী সম্পাদিত নান্দিক, নাহিদ হাসান রবিন সম্পাদিত পারাপার, অপরাজিত, এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত লিরিক, নাহিদা আশরাফী সম্পাদিত জলধি, সিরাজ সালেকীন সম্পাদিত উলুখাগড়া, মনিরুল মনির সম্পাদিত খড়িমাটি, হারুন পাশা সম্পাদিত পাতাদের সংসার, সুমন শিকদার সম্পাদিত বেগবতী, তানিম কবির সম্পাদিত ক খ গ ঘ, সাইফুল আমিন নোমান ভূঁইয়া সম্পাদিত আকাশলীনা, শিহাব শাহরিয়ার সম্পাদিত বৈঠা, আবু হেনা আবদুল আউয়াল সম্পাদিত পরাবাস্তব, প্রত্যয় জসীম সম্পাদিত গদ্য, রবু শেঠ সম্পাদিত পুনশ্চ, মোহাম্মদ নূরুল হক সম্পাদিত মেঠোপথ, চিন্তাসূত্র, পাপড়ি রহমান সম্পাদিত ধূলিচিত্র, মঈন চৌধুরী সম্পাদিত প্রান্ত, হাফিজ রশিদ খান ও চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া সম্পাদিত পুষ্পকরথ, তপন বড়ুয়া সম্পাদিত গাণ্ডীব, অচিন্ত্য চয়ন সম্পাদিত অদ্রি, শিল্পস্বর, হিরণ¥য় হিমাংশু সম্পাদিত হুড়কা, জাহিদ সোহাগ সম্পাদিত অনুবাদ, তুষার প্রসূন সম্পাদিত অনুভব, সরসিজ আলীম সম্পাদিত ভনে, জাহাঙ্গীর আলম জাহান সম্পাদিত আড়াঙ্গী, কাদের বাবু সম্পাদিত বাবুই, মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ সম্পাদিত কিচিরমিচির, সদ্য সমুজ্জ্বল সম্পাদিত ঘরামি, অরণ্য প্রভা সম্পাদিত পুণ্ড্র, আযাদ নোমান সম্পাদিত চর্যাপদ, অজয় কুমার রায় সম্পাদিত টাঙ্গন, আবু সাঈদ সম্পাদিত বইচারিতা, বদরুল হায়দার সম্পাদিত কবিতাচর্চা, সরকার আমিন সম্পাদিত মঙ্গলসন্ধ্যা, পুলক হাসান সম্পাদিত খেয়া, প্রতিস্বর, হানিফ রাশেদীন সম্পাদিত প্রতিকথা, সালাম মাহমুদ সম্পাদিত পরাগ, হাসানআল আব্দুল্লাহ সম্পাদিত শব্দগুচ্ছ, আবু মকসুদ সম্পাদিত শব্দকাহন, মিজানুর রহমান বেলাল সম্পাদিত দাগ, শামস আরেফিন সম্পাদিত কবিতার ডানা, নৈরিৎ ইমু সম্পাদিত আক্ষরিক, তানভীর পিয়াল ও হাসনাত শোয়েব সম্পাদিত ডাক, বাবুল হোসেইন সম্পাদিত লিপি, আহমেদুর রশীদ সম্পাদিত শুদ্ধস্বর, হাবীব ইমন সম্পাদিত স্পর্ধা সবসময়ে, পারভেজ হোসেন সম্পাদিত সংবেদ, জাবেদ ইমন সম্পাদিত অহর্নিশ, মোজাফ্ফর হোসেন সম্পাদিত শাশ্বতিকী, অহনা নাসরিন সম্পাদিত চন্দ্রাবতী, রিসি দলাই সম্পাদিত চারবাক, রনি বর্মন সম্পাদিত বামিহাল, আফরোজা পারভীন সম্পাদিত রক্তবীজ, অনুপম হাসান সম্পাদিত রাঢ়বঙ্গ, সাদাত উল্লাহ খান সম্পাদিত প্রতিবুদ্ধিজীবী প্রভৃতি।
সময়ের ঘেরাটোপ, দুঃসময়ের ছায়া
মাসিক বা দ্বিমাসিক সাহিত্যপত্রকে কেউ লিটলম্যাগ বলে না। লিটলম্যাগের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও পড়ে না এসব। তবে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক বা ষাম্নাসিক ম্যাগাজিনকে কি লিটলম্যাগ বলা যাবে? এখানটায় এসে একটু থমকাতে হয়। আবু এম ইউসুফ সম্পাদিত অনুপ্রাণন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত নতুন দিগন্ত, শহীদ ইকবাল সম্পাদিত চিহ্ন কি সত্যিকার অর্থে লিটলম্যাগ?
চিহ্ন প্রকাশিত হয় ছয় মাস অন্তর অন্তর। অন্যদিকে অনুপ্রাণন ও নতুন দিগন্ত ত্রৈমাসিক। এগুলোকে লিটলম্যাগের তালিকায় ফেলা যাবে? আমাদের বুদ্ধি-রুচি অনুযায়ী নিজস্ব সংজ্ঞা বলে―একটি সংখ্যা প্রকাশ পরবর্তী অন্য সংখ্যাটি কোন মাসে বা বছরে প্রকাশ পাবে―এই হদিস না থাকার মধ্যেই যথার্থ লিটলম্যাগের পরিচয় নিহিত। ভিন্নমত থাকতে পারে। থাকুক, সেটা নিশ্চয়ই সৌন্দর্যবর্ধক বিষয়।
সুব্রত বড়ুয়া সম্পাদিত কালি ও কলম, মোহিত কামাল সম্পাদিত শব্দঘর, আব্দুল্লাহ অলিদ সম্পাদিত নব ভাবনা মাসিক ও দ্বিমাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন হলেও লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্য কিছুটা হলেও ধারণ করে। এসব কাগজ আগের মতো নিয়মিত প্রকাশিত হতে পারছে না। সার্কুলেশনও কমেছে হয়তো। অনিয়মিত হলে কিংবা বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও এগুলোকে লিটলম্যাগ বলার সুযোগ নেই। সারা দেশে এমন আরও কিছু কাগজ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। যেগুলোর অনেকটাই থেকে যাচ্ছে ঢাকায় বা বড় শহরে বসবাসকারী লোক-চক্ষুর আড়ালে।
আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লিটলম্যাগের প্রকাশ পাওয়া একটু অস্বস্তির বিষয়ই বৈকি! যেসব ম্যাগাজিন নিয়মিত সময় মেপে প্রকাশিত হয়, সেটাকে যদি ‘সময়’ বিবেচনা করি তাহলে লিটলম্যাগ নিশ্চয়ই ‘দুঃসময়’-এর প্রতীক! সেই হিসাবে সময়ের চেয়ে দুঃসময়ই বড়, অগ্রসর প্রচারমাধ্যম। এর বাইরেও যেসব ম্যাগাজিন দ্রুতই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে প্রকাশ করে ফেলে পরবর্তী সংখ্যা, সেগুলোকেও লিটলম্যাগ হিসেবে আখ্যায়িত করতে নিশ্চয়ই বাধবে আমাদের!
মন জাগাতে, রুচি ফেরাতে
আজিজ সুপার মার্কেটে অনিকেত শামীমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ’-এর স্লোগান―মন জোগাতে নয়, মন জাগাতে। কথাটা যথার্থই চমৎকার। মন জোগানোর মতো চটুল অনেক লেখাজোখা বাজারে পাওয়া যায়। সেগুলো মনকে বিনোদিত করে, প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করাটা শেখায় না। চতুর্পার্শ্বের বাস্তব পরিস্থিতি দেখতে উদ্বুদ্ধ করে না। অন্যদিকে লিটলম্যাগ বরাবরই মনকে জাগাতে চায়। বস্তুত, মন জাগানোর ক্ষমতা, প্রশ্ন উসকে দেওয়ার গুণ ভালো লিটলম্যাগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন জাগলে মানুষও জাগ্রত হবে, পাল্টাবে সমাজ-দেশ। দূরীভূত হবে অশুভের আস্ফালন।
লিটলম্যাগ পাঠ সবদিক দিয়েই পাঠকের জন্য লাভজনক। যেহেতু অনেক ধরনের রচনার সমাবেশ থাকে, সহজেই খুঁজে নেওয়া যায় নিজের পছন্দের লেখাটি। দৈনিক পত্রিকা হোক কিংবা যে কোনও ধরনের ম্যাগাজিন―শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব লেখাই পড়বেন, বলতে গেলে এমন পাঠক বিরল। নিজের রুচি ও পছন্দের সঙ্গে মিলিয়েই পড়া হয়। ভর্তুকি মূল্যের একটি লিটলম্যাগে কমসে কম পাঁচটি গল্প মেলে, অন্যদিকে পাঁচটি গল্পের একটি বইয়ের বাজারমূল্য অন্তত দুই শ টাকা। অগ্রসর পাঠক এই হিসাব করেন, সাশ্রয়ের পাশাপাশি নিজেকে এগিয়ে রাখেন সময় থেকে আরও নিরাপদ দূরত্বে!
পাঠকের রুচি ফেরাতে, রুচিবান করে গড়ে তুলতে লিটলম্যাগ বরাবরই অবিকল্প।
টিকছে না হাতে লেখা পত্রিকাও
হাতে লেখা পত্রিকার প্রকৃষ্ট নজির হিসেবে দেয়ালিকার নাম উল্লেখ করা হয়। শেষ পর্যন্ত এটাও সত্য দেয়ালিকা কোনও পত্রিকা নয়। যদিও পত্রিকার অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে সেটা। একটা সময়ে হাতে লেখা পত্রিকার চল ছিল দেশে। পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন দুই বন্ধু শফিক রেহমান ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। পরবর্তীকালে এরা দুজনেই স্ব স্ব নামে খ্যাতিমান হন।
এর বাইরেও বাংলাদেশে বেশ কিছু হাতে লেখা লিটলম্যাগ পেয়েছি। কিশোরগঞ্জ থেকে জীবন শাহ সম্পাদিত সেঁজুতি, ময়মনসিংহ থেকে আফেন্দি নূরুল ইসলাম সম্পাদিত বঙ্গবাণী, চট্টগ্রাম থেকে উৎপলকান্তি বড়ুয়া ছড়ার কাগজ সম্পাদনা করতেন, নামটা মনে নেই। পটুয়াখালীর আন্ধারমানিকে এমন পত্রিকা আছে বলে শুনেছি। বাংলাদেশের আরও জায়গায় খুঁজলে নিশ্চয়ই এমন পত্রিকার খোঁজ মিলবে। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজ্যে এমন পত্রিকা প্রকাশের নজির আছে।
শুধু হাতে লেখা নয়, হাতে ‘বানানো’ পত্রিকা প্রকাশের ঘটনাও চাক্ষুষ করেছি। ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের মেসে থাকতাম একসময়। রুমমেট সাইফুল আমিন সম্পাদনা করতেন আকাশলীনা ম্যাগাজিন। নিজের কম্পিউটারে লেখাজোকা জমায়েতের কাজ করতেন। মেকআপও দিতেন নিজেই। ফাইনাল হলে হাতিরপুল বাজার থেকে অফসেট কাগজে প্রিন্ট নিতেন। তারপর ফটোকপি করতেন নির্দিষ্ট ‘প্রচারসংখ্যা’ ও চাহিদা অনুযায়ী। পেস্টিংটা শিখে নিয়েছিলেন। বাসায় বসে ম্যাগাজিনে রূপ দিতেন দোকান থেকে প্রিন্ট করে আনা কাগজগুলোকে।
নিজেই ভাঁজ করতেন, ভাঁজ পরবর্তী স্ট্যাপলার দিয়ে পিনআপ করা হতো। তারপর বুকপোস্টে ও কুরিয়ারে সেই স্বপ্নমোড়ানো কাগজ ছড়িয়ে পড়ত দেশের আনাচেকানাচে। অনুরাগী লেখকদের হাতে হাতেও দিতেন। ডাক বা কুরিয়ার করার পন্থাটিও কি সহজ! অত টাকা কি একজন ছাত্র-বেকার সম্পাদকের থাকে। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর খবরটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে জানাতে পারেননি তাঁর স্ত্রী লাবণ্য দাশ। জীবনানন্দপ্রেমী একজন বড় মানুষকে জানাতে না পারার কারণ হিসেবে বলেছিলেন―‘ফোন করতেও তো দুইটা পয়সা লাগে, ভাই’।
পয়সার দুনিয়ায় আবেগের ঠাঁই নেই। তবু আবেগ কারও কারও মনে বাসা বাঁধে। তারা হয়ে ওঠেন শিল্পের দাস। এই যে সম্পাদকরা শেষ যন্ত্রণাটা নেন লেখককে পত্রিকা কুরিয়ারের খরচ নিজের ঘাড়ে নিয়ে―ঠিক কজন লেখক সম্পাদককে জানান ‘ম্যাগাজিন পেয়েছি। ধন্যবাদ।’ সৌজন্যবোধের হিসাবটা তলানিতে। এখন বেয়াড়া গোছের কেউ প্রশ্ন করে বসতেই পারেন―এত কষ্টই যখন, কাগজ বের করার কী দরকার?
দরকার হয়তো নেই, আবার আছেও। তবে প্রশ্নটির জবাব নেই। এ এক বিপন্ন বিস্ময়, অন্তর্গত বোধে শিল্প খেলা করে, সেখানে আলোর নাচন! আর আলোর নাচন যিনি দেখতে পান―অন্ধকারকে থোড়াই কেয়ার করেন!
প্রচারসংখ্যা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা
প্রচারসর্বস্ব দেশে গ্ল্যামারের জয়জয়কার। তাই কেউ কেউ লিটলম্যাগের এই উদ্যোগকে ঠিক সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেন না। আমার ম্যাগাজিন সম্পাদনার শুরুর দিকে বন্ধুবর সিরাজুল ইসলাম হৃদয় যুগপৎ অপমানজনক ও কৌতূহল উদ্দীপক কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেছিলেন ‘চোইদ্দ কপি বাইর অইবো, তিনজনে পরিবো!’ তার দৃষ্টিতে লিটলম্যাগ হচ্ছে―মুদ্রণ হয় চৌদ্দ কপি আর পাঠক তিনজন!
খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না তাদের। জনমনে কত ভ্রান্ত ধারণাই না প্রচলিত আছে। দ্বিতীয় ‘তিরস্কার’টা পেয়েছি গুরুস্থানীয় একজনের কাছ থেকে। পত্রিকায় লেখা চেয়ে ঘোষণা দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘এসব করো কেন? মানুষজন তোমাকে চেনে। প্রথম আলোতেও তো তোমার লেখা ছাপা হয়!’
লিটলম্যাগ অবশ্যই আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রচারের মাধ্যম। সবার না হোক, কারও কারও তো অবশ্যই। পুলক হাসান বলেন, ‘আমি নিজের বিকাশের জন্য ম্যাগাজিন সম্পাদনা করি। নিজের লেখা থাকে, অন্যদের লেখাও প্রকাশ করি।’ তাই বলে লিটলম্যাগ সম্পাদনা মানেই যে নিজেকে চেনানোর পাঁয়তারা বিষয়টা সবসময় এমন নয়।
লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয় তিন শ থেকে এক হাজার কপি। পরিমাণে কম-বেশিও হয়। তবে এটাকে প্রচারসংখ্যায় পিছিয়ে ভাবার কারণ নেই। লাখো কপির প্রচারসংখ্যার দৈনিক পত্রিকাও পরদিনই সের দরে বিক্রির উপযুক্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে লিটলম্যাগ অবশ্যই তা নয়। পাঠকের বুকসেলফে শোভা বর্ধন করে দীর্ঘকাল যাবৎ। আবার যারা লেখেন এসব কাগজে, তাদেরও থাকে সংরক্ষণ করার তাড়না। তাই তো সম্পাদককে লেখা পাঠানোর পর থেকেই তাদের তাড়া শুরু হয়ে যায়―কবে প্রকাশিত হবে সংখ্যাটি!
মুদ্রিত লিটলম্যাগ সহজেই হারিয়ে যাওয়ার নয়। নিজের গ্রহণযোগ্যতাই জায়গা করে নেয় মানুষের অন্দরমহলে, করোটিতে। দৈনিকের সাহিত্যপাতাটি ‘মাগনা’ পাওয়া যায় মূল কাগজের সঙ্গে, যেহেতু লোকে খবর পড়ার জন্যই দৈনিকটি কেনে। ‘সাহিত্য’ পড়ার জন্য কেনে এমন নজির অল্পই। অন্যদিকে গাঁটের পয়সা খরচ করেই লিটলম্যাগ কিনতে হয়। একটির স্থায়িত্বকাল একদিনের, অন্যটি টিকে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য। থেকে যায় সময় ও দুঃসময়ের দলিল হিসেবে।
অন্তর্জাল কি ‘খেয়ে’ দিচ্ছে কাগজকে
খরচ কম তাই লোকে অনলাইনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। যারা একসময় কাগজের ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন তারাও ঝুঁকে পড়েছেন ওয়েব ম্যাগাজিন সম্পাদনার দিকে। অবশ্য ওয়েবসাইটের কনটেন্টকে কীভাবে ‘ম্যাগাজিন’ নাম দেওয়া যায়, সেটা শোভন ও সঙ্গত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন হতে পারে।
প্রদেয় লেখাটি মুদ্রণে দেরি দেখে কোনও কোনও লেখকের তর সয় না। সহজেই লেখাটি পাঠিয়ে দেন অন্তর্জালে। সেটা প্রকাশ পেয়ে যায় দ্রুততম সময়ে। এখানে যেহেতু কাগজ কেনার বালাই নেই, ছাপাছাপি ও বাইন্ডিংয়ের যন্ত্রণা নেই, চাইলে পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই যে কোনও লেখাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা সম্ভব। অনলাইন ও অফলাইন দুই মাধ্যমেরই কিছু সুবিধা-অসুবিধা আছে। তবে প্রিন্ট পত্রিকা প্রকাশের ধারা কমে যাওয়াটা হতাশাজনক। অনেকেই যেভাবে নামমাত্র টাকায় ওয়েব পোর্টাল সম্পাদনায় মনোযোগ দিচ্ছেন―এটাকে অগ্রসর ধারা বলব নাকি পিছু হটে ‘আত্মসন্তুষ্টি’ নামে আখ্যায়িত করব! লিটলম্যাগ কখনওই ‘সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য’র বিষয় নয়, তাহলে এখনকার সম্পাদকরা কেন সহজ পথটা বেছে নিচ্ছেন।
অন্তর্জাল হয়তো খেয়ে দিচ্ছে ছোটকাগজকে, কিন্তু এর বড় ভূমিকা ও গৌরব কখনও ফুরানোর নয়। ছোটকাগজের বিকল্প কখনও লহমায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া অন্তর্জাল নয়।
বিষয়ভিত্তিক লিটল ম্যাগাজিন
লিটলম্যাগের নির্দিষ্ট কোনও সংজ্ঞা বা পরিধি-মাপক বৈশিষ্ট্য নেই। বিষয়ভিত্তিক প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন আছে। যেগুলোর তালিকা করে কুলিয়ে ওঠা যাবে না। গল্পবিষয়ক লিটলম্যাগের কথা আগেই বলেছি। এর সঙ্গে অল্প কিছু সিনেমা ও থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিষয়ভিত্তিক এসব পত্রিকার সংখ্যা হাতেগোনা। অন্যদিকে কবিতার কাগজ অগণন।
মুক্তগদ্যবিষয়ক একমাত্র পত্রিকা নির্ঝর নৈঃশব্দ্য সম্পাদিত মুক্তগদ্য। দশ বছর চালানোর পর ঘোষণা দিয়েই তিনি পত্রিকাটি বন্ধ করে দিয়েছেন। বই নিয়ে ছিল বেশ কয়েকটি ম্যাগাজিন। আহমাদ মাযহার সম্পাদিত বইয়ের জগৎ, আহমেদ ফিরোজ সম্পাদিত রিভিউ। বর্তমানে এমন আরও তিনটা পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। শামসুল কিবরিয়া সম্পাদিত বইকথা, ফয়সাল আহমেদ সম্পাদিত এবং বই, আবু সাঈদ সম্পাদিত বইচারিতা।
ছড়াবিষয়ক বেশ কিছু লিটলম্যাগ প্রকাশিত হতো একসময়। তবে পাঁচমিশালী ম্যাগাজিনের সংখ্যাই বেশি। পরিমাণে অল্প আছে কথাসাহিত্যের কাগজ। তবে অধিকাংশ ম্যাগাজিনই বিষয়হীন। গতানুগতিক পন্থায় দুই-দশটা গল্প, কয়েকগুচ্ছ কবিতা, দুইটা প্রবন্ধ ও বই পরিচিতি দিয়েই সূচিবিন্যাস হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের লিটলম্যাগ জগতে সবচেয়ে বড় ঝলকটি দেখিয়েছে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। সম্পাদক মীজানুর রহমানের মৃত্যুর পর হালকাচালে হাল ধরেছেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম। প্রকাশ করেছেন দুই-তিনটি সংখ্যা। দেখা যাক, তিনি এই ম্যাগাজিনকে কত দূরে নিয়ে যেতে পারেন।
মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রকাশক সম্পাদকের স্ত্রী নূরজাহান বকশী। একসময় স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ব্যস্ত সময় কাটত কাঁটাবনের প্রেসপাড়ায়। এমন যোগ্য সহচর পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। মীজানুর রহমানকে আমরা ভাগ্যবান সম্পাদকই বলতে চাই। স্ত্রীর তিরস্কারের পরিবর্তে সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
পরদেশে বাংলার মুখ
জীবন-জীবিকার তাগিদে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের স্থানচ্যুতি ঘটতে পারে, কিন্তু তার সম্পাদকসত্তার মৃত্যু হয় না। শিল্পসত্তা নীরবে-সরবে তার পিছু পিছু হাঁটে। তাই তো আমরা পরদেশ প্রবাসেও কাউকে কাউকে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতে দেখি। মেতে উঠতে দেখি সৃজন-নেশায়। এমন প্রচেষ্টা বিস্মিত করে, আনন্দও দেয়।
আবু মকসুদ সম্পাদিত শব্দকাহন, ফকির ইলিয়াস সম্পাদিত বর্ণমালা, হাসানআল আব্দুল্লাহ সম্পাদিত শব্দগুচ্ছ, হুমায়ুন কবির সম্পাদিত ঘুংঘুর, সৈয়দ ওয়ালী সম্পাদিত লোকন। এসব ম্যাগাজিন প্রবাস থেকে প্রকাশিত হয়। এই তালিকাই শেষ নয়, দেশে দেশে এমন আরও বাংলা লিটল ম্যাগাজিন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
ব্রিটেনের লন্ডনকে কেউ কেউ আদর করে ডাকেন ‘তৃতীয় বাংলা’ বলে। আদতেই ওটা তৃতীয় বাংলা। ব্রিকলেনসহ আরও বাঙালিপাড়া আছে। যেখানে বাংলা ভাষাভাষীরা বিশেষ করে বাংলাদেশিরা এতভাবে মাতৃভাষার যত্ন-আত্তি করে যাচ্ছেন নিঃসন্দেহেই সেটা তৃতীয় স্থান অধিকার করার দাবিদার। আগামীতে চতুর্থ বা পঞ্চম বাংলার নাম আলোচনায় উঠে এলেও অবাক হবো না!

তবু লিটলম্যাগ, তবু আশাবাদ
বস্তুত লিটলম্যাগ সম্পাদনায় যখন থেকে লেনদেন যুক্ত হয়েছে, চলে এসেছে দেনা-পাওনা ও প্রাপ্তির চুলচেরা হিসাব তখন থেকেই মৃত্যু ঘটেছে এর। সৎ সম্পাদকরাও হাবুডুবু খাচ্ছেন এমনতর অনাচারে। বর্তমানে লিটলম্যাগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে প্রবলভাবে, আবার হচ্ছে না-ও! জনরুচি ভাগ হয়ে গেছে। অন্তর্জাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাঠকের মস্তিষ্কে।
সাহিত্যচর্চার বাহন ব্লগগুলো একসময় বিকল্প প্লাটফর্ম হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে সেই জায়গা দখল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। ‘ফেসবুক লেখক’ নামে আলাদা একটা শ্রেণির উদ্ভবও হয়েছে। ফেসবুক সাহিত্যচর্চার অন্তরায় নাকি সহায়ক, লেখক সৃষ্টি ও লেখার উৎকর্ষ কতটা নিশ্চিত করতে পারছে এই বায়বীয় মাধ্যম―এমন প্রশ্ন-গুঞ্জনও নতুন নয়। তবে দিন দিনই ফেসবুক সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিস্তর মানুষ হাত শাণিত করে চলেছেন এই ক্ষণিক-মাধ্যমে।
প্রবাসী টাকায় লিটলম্যাগ নামে কিছু বালিশ সংকলন প্রকাশ হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন যাবৎ, বর্তমানে সেসবও তেমন একটা দেখা যায় না। তবে কি সম্পাদকরাও পেয়ে গেছেন হাত মক্শো করার বিকল্প মাধ্যম! একজন সৎ সম্পাদকের দায় অবশ্যই আছে। সেটা নিজের চর্চার জন্য যেমন জরুরি, তেমনি অন্যদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার ক্ষেত্রেও। একসময় প্রচুর কাগজ প্রকাশিত হলেও এর অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় কাগজ বলে মন্তব্য করেছেন কোনও কোনও নাক-উঁচু মহল। আবার ‘অনেক অকবির কবিতাও প্রকাশ করেছেন দেখছি’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এমন বোদ্ধা-অধ্যাপকের সাক্ষাৎও পেয়েছি কয়েকবার। লিটলম্যাগ কি ‘পাকা’ ও ‘শক্তপোক্ত’ লেখা প্রকাশের মাধ্যম? মোটেও তা নয়। এই বাস্তবতা জ্ঞানভারাক্রান্তরা মেনে নিতে পারেন না। কে কবি আর কে কবি নয়, এমন গুরুগম্ভীর দায়িত্বও তারা নিজ কাঁধে তুলে নেন স্বপ্রণোদিত হয়ে!
স্বমহিমায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠুক লিটলম্যাগ
প্রাণে বাজুক নতুন সুর, মনে অন্য আলো…
লিটল ম্যাগাজিন কি প্রচারের মুখাপেক্ষী? যদি না-ই হবে, একশ্রেণির সম্পাদক কেন প্রথম কপিটাই পাঠিয়ে দেন দৈনিকের দপ্তরে, সাহিত্য সম্পাদক বরাবর―রিভিউ করানোর তাড়নায়? আবার একশ্রেণির সম্পাদক তাদের সাহিত্য ম্যাগাজিনকে কেন নিজেকে লিটল ম্যাগাজিন হিসেবেই পরিচিত করাতে চান! সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে থাকলে ক্ষতিটা কী? ‘গ্ল্যামার’সর্বস্ব দুনিয়ায় এসবও বড় একটি প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে। বারোয়ারি কাগজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল মনে করছে না কেন নিজেকে। তাহলে চরিত্র পাল্টানোর সুযোগ তো রয়েছেই। সুযোগ নিচ্ছে না কেন! কেন স্বমহিমা নিয়ে হয়ে উঠছে না ‘সুবোধ লিটলম্যাগ’? ঝেড়ে ফেলছে না অপরিচয়ের গ্লানি!
কোনও কোনও লিটলম্যাগের দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হচ্ছে। কালেভদ্রে হলেও এটা স্বস্তির। এমন ধারা সম্প্রসারিত হতে থাকলে বন্ধ্যাদশা ঘোচার ইঙ্গিতবহ হয়ে উঠবে। লিটলম্যাগের বড় বাজার সৃষ্টি জরুরি। যেহেতু ছোটকাগজ বরাবরই বড় ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দলছুট হয়ে না থেকে নিজেদের একীভূত করার সময় এসেছে।
আছে দুঃখ, আছে বেদন―এসবের ভেতর দিয়েই অনন্ত জাগবে। লিটলম্যাগ স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়াবে আবার। এমন আশাবাদ জিইয়ে রাখি স্বপ্নদেখা দু চোখে।
লেখক : প্রাবন্ধিক