আর্কাইভক্রোড়পত্রপ্রচ্ছদ রচনা

প্রত্নসন্ধানী পত্রিকা উয়ারী বটেশ্বর : শেখ মেহেদী হাসান

ক্রোড়পত্র : লিটলম্যাগ চর্চা

ছোটকাগজ উয়ারী বটেশ্বর-এর খসড়াসংখ্যা প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২০২৪-এ। শিরোনাম ‘জীবনানন্দ ও তাঁর পরিজন’। বিষয়টি যে কোনও পাঠকের জন্য আকর্ষণীয়―কারণ জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর প্রভাব বাংলা কবিতায় বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। তাঁকে নিবিড়ভাবে জানার জন্য পত্রিকাটি সবার জন্য অবশ্যপাঠ্য। কারণ এখানে স্থান পাওয়া রচনাগুলো মূল্যবান।

জীবনানন্দ দাশের শৈশব-কৈশোরকালের পুরোটা সময় অর্থাৎ ২৮ বছর কেটেছে বরিশালে। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া কবি স্কুল-কলেজ জীবনের শিক্ষা শেষ করে ১৯১৮ থেকে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিবঙ্গের প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৩৫-১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৩৬-১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ তিনি বসবাস করেন কলকাতায়। তবে তাঁর কবিতা রচনার শুরু বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে পড়ার সময়। সেগুলো বরিশাল থেকে ডাকযোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠাতেন তিনি। বাল্যে রচিত সে সকল কবিতার কোনও মূল্যায়ন প্রতিক্রিয়া রবিঠাকুরের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। তবে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপনাকালে রচিত কবিতাগুলো ততদিনে কবি হিসেবে জীবননানন্দ দাশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।

বরিশালের দাশ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা সর্বানন্দ দাশ। বাপদাদার গোঁড়া হিন্দুত্ব ত্যাগ করে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। ওই সময় সমাজে ধর্মীয় বিভেদ, গোঁড়ামি, হিন্দুত্ববাদ, জাত-পাত এক চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল। ব্রাহ্মধর্ম ব্যক্তি রুচি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছিল। ব্রাহ্মধর্মের অনুরাগীবৃন্দ সমাজে মানুষের বিভেদ নিয়ন্ত্রণে জ্ঞানবিস্তারের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিষ্ঠালাভে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিল। সর্বানন্দ দাশ ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম স্তম্ভ শিক্ষা প্রসারে বরিশালে অনেক অবদান রাখেন। নিজ বাড়িতে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে অমর হয়ে আছেন। তাঁর উত্তরসূরি কবি জীবনানন্দ দাশের কবিকৃতির পিছনে এই বরিশাল এবং পূর্ববাংলার অবদান রয়েছে। তাছাড়া জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর পরিজন অবিভক্ত বাংলায় ছড়িয়ে ছিল। আপেল মাহমুদ সম্পাদিত বর্তমান পত্রিকাটিতে মোট ৩৪টি রচনায় নানাভাবে কবি জীবনানন্দ দাশের পরিবার-পরিজনের পরিচিতি, অবস্থান, সামাজিক অবদান বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রবন্ধ-নিবন্ধের বিষয়গুলো আকর্ষণীয়―‘দাশ পরিবার: বিক্রমপুর থেকে বরিশাল’, ‘বরিশালের সর্বানন্দ ভবন’, ‘জীবননান্দ দাশ এবং পূর্ব বাঙ্গালা ব্রাহ্মসমাজ’, ‘বরিশালের শিক্ষাজীবন’, ‘জীবনানন্দের পরিবার ও মনোমোহন চক্রবর্তী’, ‘জীবনানন্দের অনুপ্রেরণায় মা কুসুমকুমারী’, ‘জীবননান্দ দাশ কলকাতার বুকে একটা বরিশাল খুঁজেছিলেন’, ‘শৈলেশ্বর চক্রবর্তী ও দাশ পরিবার’ ইত্যাদি।

উল্লিখিত রচনাসমূহে জীবনানন্দ দাশের কবিসত্তা, আবেগ, মান-অভিমান, আকুতি বহু কিছুর মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে। জীবনানন্দের জীবনে তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশের প্রভাব―তাঁর ভাই-বোন, বন্ধু-স্বজনের কথাও এখানে আলোচিত হয়েছে। এমনকি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কবির বিয়ের ঘটনা এবং তাঁর স্ত্রী লাবণ্যর কথা আলোচিত হয়েছে। পত্রিকাটি কেবল ছোটকাগজ নয়, বরং এটি গবেষণা পত্রিকা। এ ধরনের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করা বেশ শ্রমসাধ্য। সম্পাদক নিষ্ঠার সঙ্গে, সুচারুরূপে সে কাজটি করেছেন। লেখা নির্বাচন, যাচাই ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। 

এখানে ছাপা হয়েছে একটি দুর্লভ রচনার পুনর্মুদ্রণ। পুনর্মুদ্রিত রচনা বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এটি দুষ্প্রাপ্য বই। অতীতে ছাপা হয়েছে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই। বরিশালে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণের ইতিবৃত্ত স্থান পেয়েছে এই বইতে। বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের উদ্দেশ্য ছিল―‘একমাত্র সত্যস্বরূপ, নিরাকার, পূর্ণ, পরমব্রহ্মের প্রতি প্রীতি ও তাঁহার সাধনদ্বারা উপাসনা করা, ব্রাহ্মমণ্ডলীর ও জনসাধারণের আধ্যাত্মিক ও অপরাপর উন্নতি ও হিত-সাধনের সহায়তা করা এবং বরিশাল ব্রহ্মসমাজের ট্রাস্টডিডির লিখিত নিয়মাবলীর কোনও নিয়মের অথবা তাহার তাৎপর্যের ব্যতিক্রম না করিয়া নিয়মতন্ত্রপ্রণালী অনুসারে ব্রাহ্মসমাজের কার্য্য সকল সম্পাদন করাই বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের উদ্দেশ্য।’ ব্রাহ্মসমাজ তৎকালীন গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। বইটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণÑপ্রথমত পূর্ববাংলায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, দ্বিতীয়ত কবি জীবনানন্দ দাশেরই পূর্বপুরুষ সর্বানন্দ দাশ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রাণপুরুষ। এ বই পাঠান্তে ব্রাহ্মসমাজের সর্বজনীন ধর্মীয় চিন্তার নানা দিক জানার পাশাপাশি কবি জীবনানন্দ দাশের পূর্বপুরুষের ইতিহাসও জানা যাবে।

উয়ারী বটেশ্বর-এর সম্পাদক আপেল মাহমুদ। তিনি একজন নিষ্ঠাবান গবেষক, সাংবাদিক ও সম্পাদক। অনেক দিন যাবৎ সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে আকর অন্বেষণ করে চলেছেন। তাঁর গবেষণার ধরন ধারাবাহিক দিন-তারিখের ইতিহাস রচনা নয়। তিনি ইতিহাসের সত্যিকারের উপাদান সংগ্রহের মাধ্যমে নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন। তাঁর রচনা হয় বিশ্লেষণাত্বক ও তুলনামূলক। কখনও কখনও একাডেমিক ইতিহাসবিদও তাঁর কাছে হার মানেন যুক্তি-তর্কে-প্রমাণে। এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে তাঁর শরৎচন্দ্র, পুরান ঢাকা, জীবননান্দবিষয়ক গবেষণায়। এমন একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ যখন ছোটকাগজ সম্পাদনায় হাত দেন তখন তা হয় খাঁটি বা আকর। ইতিহাসের ধূলিকণা, কাঁকর চষে তিনি বের করে এনেছেন ‘জীবনানন্দ ও তাঁর পরিজন’ সম্পর্কে নতুন চিন্তাসূত্র। ছোটকাগজের সম্পাদক হিসেবে জীবনানন্দ গবেষণায় তাঁর নতুন মাত্রা যোগ অভিনন্দনযোগ্য। প্রশংসনীয়।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button