আর্কাইভক্রোড়পত্রপ্রচ্ছদ রচনা

নজরুল প্রতিভার উন্মেষপর্ব : প্রসঙ্গ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা ও মোসলেম ভারত : রবিউল হোসেন

প্রচ্ছদ রচনা

কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত মাসিক সওগাত (১৯১৮) পত্রিকায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬) শীর্ষক গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর লেখক হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ (শ্রাবণ ১৩২৬) প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা’য় (১৯১৮)। এ কালের আরেকটি প্রধান পত্রিকা মোসলেম ভারত (১৯২০)Ñএ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রতিভার উন্মেষকালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। নজরুলের উন্মেষপর্বের লেখা প্রকাশ, রচনা মূল্যায়ন তথা কবিখ্যাতির বেশির ভাগ উল্লিখিত পত্রিকা তিনটি ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। সওগাত একটি দীর্ঘজীবী সাময়িকপত্র। নজরুল জীবনে পত্রিকাটির প্রভাব স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। আলোচ্য নিবন্ধের শিরোনাম অনুযায়ী নজরুল প্রতিভার উন্মেষপর্বের দুটি প্রধান সাময়িকপত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা ও মোসলেম ভারত-এর অবদান মূল্যায়ন করার প্রয়াস করা হবে।

সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রেরণা আসে সমাজ ও সংস্কৃতি ভাবনা থেকে। বাঙালি মুসলমান মানসে তা রূপ লাভ করে শেখ আলীমুল্লাহর সম্পাদনায় সমাচার সভারাজেন্দ্র (১৮৩১) প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মুসলমান সম্পাদিত প্রায় সহস্রাধিক সাময়িকপত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) ও ভোলার কবি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক (১৮৮৩-১৯৭৬)-এর সম্পাদনায় ত্রৈমাসিক বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকার প্রকাশ বাঙালি মুসলমান সমাজে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা বাঙালি মুসলমানের সাময়িকপত্রের ধারায় পত্রিকাটি প্রথম বারের মতো সাহিত্যচর্চার সকল ক্ষেত্রে বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠে।১

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের যাত্রা শুরু হয় মীর মোশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) রচিত রত্নবতী (১৮৬৯) প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এরপর ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই লেখালেখি করে খ্যাতিমান হয়েছেন। তবে বাঙালি মুসলমান সমাজের সামাজিক-সাহিত্যিক জাগরণে প্রথম যূথবদ্ধ প্রচেষ্টা শুরু হয় ১৯১১ সালে কলকাতায় ৯নং অ্যান্টনী বাগান লেনে মৌলভী আবদুর রহমান খানের বাড়িতে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।২ ‘সাহিত্য-সমিতি’র মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল―এ অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টির আগ্রহ তৈরি করা; সম্প্রদায় নির্বিশেষে সাহিত্যিকদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করা; নতুন নতুন লেখক তৈরি করা; সর্বোপরি সমাজকে আলোকিত করা। এই শুভ প্রচেষ্টাগুলোর বাস্তব রূপায়ণের জন্য সমিতির পক্ষ থেকে ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন করে।৩ সমিতির অপর মুখপত্র সাহিত্যিক বের হয় ১৯২৭ সালে। এছাড়া নিয়মিত সাহিত্য সভা, সাধারণ সভা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বার্ষিক সাহিত্য-সম্মিলন, রজত-জয়ন্তী সম্মিলন, ঈদ সম্মিলন আয়োজন করা, লাইব্রেরি স্থাপন ও পরিচালনা করা, অন্যান্য সাহিত্য-গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রভৃতি সমিতির নিয়মিত কর্মকাণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। সংগঠনটি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থেকে দেশভাগ পর্যন্ত তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।৪

বিশ শতকের প্রথমার্ধে সাহিত্য-পত্রিকার৫ প্রকাশ বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জীবনচর্চার প্রায় সকল ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া বাঙালি মুসলমান সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে পত্রিকাটি মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।৬ পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে মুসলমান সমাজকে সকল প্রকারের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।৭ ‘নিবেদন’ শিরোনামে প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে লেখা হয় :

এই উন্নতির যুগে সকলেই উন্নতির পথে খরবেগে ধাবিত হইতেছে। বঙ্গীয় মুসলমান সমাজকেও উন্নত হইতে হইবে। জাতীয় উন্নতির জন্য জাতীয় সাহিত্য আবশ্যক। আমাদের জাতীয় সাহিত্য বলিতে আমরা বুঝি এমন সাহিত্য যাহাকে দণ্ডযন্ত্র (ষবাবৎ) রূপে অবলম্বন করিয়া আমরা উন্নত হইতে পারি।৮

উপর্যুক্ত সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে পত্রিকাটি বাঙালি মুসলমানের জাগরণ-কালের সাহিত্যের স্বরূপ ও প্রকৃতি কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। অর্থাৎ ভাষা, সাহিত্যিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সৌভ্রাতৃত্ব, মানবতাবোধ প্রভৃতি সকল কিছুকে জাতীয় সাহিত্যের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করতে মুসলমান সমাজের প্রতি সাহিত্য-পত্রিকা আহ্বান জানায়। সাড়ে পাঁচ বছরের জীবনকালে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত রচনাসমূহ ও সমিতি আয়োজিত কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়―‘সাহিত্য-সমিতি’ ও সাহিত্য-পত্রিকা তার কথা রেখেছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সকল খ্যাতিমান লেখকের রচনা প্রকাশ করে পত্রিকাটি সচেতন মহলের নজর কাড়ে। উল্লেখ্য, পত্রিকাটির মাধ্যমে প্রথম বারের মতো অবরুদ্ধ মুসলিম মহিলা সমাজ তাঁদের রচনা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। নবজাগরণের যে ব্যাপকতা সে অর্থে হয়তো সম্পূর্ণভাবে ‘সাহিত্য-সমিতি’ ও তার মুখপত্র যথাযথ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নিÑ তথাপি জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমানের বিকাশে সংগঠনটি ও উল্লিখিত মুখপত্রটির ভূমিকা সমকালে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

মারফতী, পাঁচালি, ব্যঙ্গ, বঙ্গ-মারফতী, লেটোর গান ইত্যাদি নজরুলের বাল্যকালের রচনা―যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।৯ করাচিতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকুরিকালীন তাঁর সাহিত্যিক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। করাচি থেকে তিনি নিয়মিত কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য-সাময়িকীতে লেখা পাঠাতেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা, সওগাত,  প্রবাসী (১৯০১), ভারতী (১৮৭৭), ভারতবর্ষ (১৯১৩), সবুজপত্র (১৯১৪) প্রভৃতি প্রথম সারির সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এভাবে সাহিত্য-পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও একমাত্র সব সময়ের কর্মী মুজফ্ফর আহমদ (১৮৮৯-১৯৭৩)-এর সঙ্গে তথা ‘সাহিত্য-সমিতি’র সঙ্গে নজরুলের অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। ১৯২০ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে যাবার পূর্বে সাত দিনের ছুটি নিয়ে নজরুল কলকাতায় এলে মুজফ্ফর আহমদ-এর সঙ্গে ৩২, কলেজ স্ট্রীটে ‘সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে তাঁদের প্রথম দেখা হয়।১০ আলাপের এক পর্যায়ে মুজফ্ফর আহমদ ভাঙনের মুখে থাকা ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে নজরুলকে ‘সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে এসে ওঠার অনুরোধ করেন।১১ সাহিত্য-পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মোজাম্মেল হকও অনুরূপ অনুরোধ করেছিলেন। উল্লেখ্য, করাচি সেনানিবাস থেকে নজরুল যেসব কবিতা ও গল্প পাঠাতেন―মুজফ্ফর আহমদ সেগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করতেন।১২ মুজফ্ফর আহমদ নজরুল-প্রতিভার অন্তর্নিহিত শক্তি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বিধায় এমনটি করেছিলেন মর্মে অনুমান করা যায়। নজরুলের করাচি অবস্থানকালীন লেখালেখির পরিচয় দিতে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-১৯৭৬) আমার বন্ধু নজরুল শীর্ষক গ্রন্থে  লিখেছেন :

নজরুলের চিঠি এসেছে। “… তোমাকে একটা আনন্দের খবর দিই। এখান থেকে কলকাতার কয়েকটা কাগজে গল্প পাঠিয়েছিলাম। একটাও ফিরে আসেনি। সব ছাপা হয়েছে। এন্তার লিখছি এখানে বসে বসে।

আমি লিখলাম, ‘বহুত বহুত সালাম হাবিলদার সাহেব!’

এবার চুটিয়ে একটা কবিতা লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দাও। গল্প আর লিখো না।”১৩

করাচি-পর্বে নজরুলের (১৯১৭-১৯২০) দশটি লেখা সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা, প্রবাসী ও নূর (১৯২০)-এ প্রকাশিত হয়। নজরুলের লেখক খ্যাতি অর্জনে এ-পর্বের রচনাগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি যে ক্রমশঃ শিল্প ও রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছেন তা স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। করাচি-পর্বের লেখাগুলো নিম্নরূপ :

সওগাত : ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ (গল্প; জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬), ‘স্বামীহারা’ (গল্প; ভাদ্র ১৩২৬), ‘কবিতা-সমাধি’ (হাসির কবিতা; আশ্বিন ১৩২৬), ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ (প্রবন্ধ; আশ্বিন ১৩২৬)।

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা : ‘মুক্তি’১৪ (কবিতা; শ্রাবণ ১৩২৬), ‘হেনা’১৫ (গল্প; কার্তিক ১৩২৬), ‘ব্যাথার দান’১৬ (গল্প; মাঘ ১৩২৬)

প্রবাসী : ‘আশায়’ (হাফিজের গজলের ভাবানুবাদ; পৌষ ১৩২৬)

নূর : ‘মেহের নেগার’ (গল্প, মাঘ ১৩২৬), ‘ঘুমের ঘোরে’ (ফাল্গুন ১৩২৬)।১৭

বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে কলকাতায় ফিরে প্রথমে বন্ধু শৈলজানন্দের মেসে ও পরে মুজফ্ফর আহমদের আশ্বাসে নজরুল ‘সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে উঠেছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ ‘সাহিত্য-সমিতি’র অফিসের পাশে একটি কক্ষে থাকতেন। এই কক্ষের এক পাশে নতুন একটি তক্তপোশে নজরুলের থাকার ব্যবস্থা হলো। সন্ধ্যা দৈনিক নবযুগ (১৯২০) প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত তিনি সমিতির অফিসেই থাকতেন। এ সময়পর্বে নজরুলের সঙ্গীতচর্চা, লেখালেখি ও আড্ডা সমান তালে চলেছিল। তবে কলকাতায় বসবাসের প্রথম বছরে নজরুল লেখক খ্যাতি অপেক্ষা সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে, বিশেষ করে রবীন্দ্র-সঙ্গীত শিল্পীরূপে সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।১৮

‘সাহিত্য-সমিতি’তে নজরুলের আশ্রয়লাভ তাঁর লেখক জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নজরুল প্রতিভার উন্মেষপর্বের উল্লেখযোগ্য সকল কবিতাই এ সময় রচিত হয় এবং সেগুলোর অধিকাংশ প্রকাশিত হয় মোসলেম ভারত-এ।১৯ ‘সাহিত্য-সমিতি’তে নজরুলের অবস্থান মূল্যায়নে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ বলেন :

গত মহাযুদ্ধের (১ম মহাযুদ্ধ) পর হইতে দেশে যে দুর্দ্দিন যাইতেছে তাহা সাহিত্য সৃষ্টির পক্ষে অনুকূল নহে। তথাপি যে বাঙ্গালী মুসলমানের সাহিত্যচর্চা রুদ্ধ হইয়া যায় নাই, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা যে তার অন্যতম কারণ, সে সমন্ধে বোধ হয় কাহারও সন্দেহ থাকিতে পারে না।২০

সাহিত্য সমিতির ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জীবন-ইতিহাসের সহিত জড়িত। ১৯১৫ সনে এই সমিতি পুনর্গঠিত হওয়ার পর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার জন্ম হয়। ১৯১৮ হইতে দীর্ঘ ৫ বৎসর এই সমিতির সঙ্গলাভ ও সমিতি পরিচালিত পত্রিকার সেবা করিবার সৌভাগ্য আমার ঘটিয়াছিল। আমার মনে হয় এই সময় সাহিত্য সমিতির স্বর্ণযুগ। আজ যাঁহারা মুসলিম সাহিত্যে দিক্পাল বলিয়া খ্যাত তাঁহারা প্রায় সকলেই এই সময় এই সমিতির প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিলেন। ডা. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি মোজাম্মেল হক, (এম.এল.এ), কাজী আবদুল ওদুদ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, ডা. লুৎফর রহমান, চৌধুরী এয়াকুব আলী, কবি গোলাম মোস্তফা, শাহাদাৎ হোসেন ইত্যাদি সকলেই এর পাঠাগারে সমবেত হইতেন এবং সমিতির পত্রিকার রসদ যোগাইতেন। সেই সঙ্গে ১৯২০ সনে আসিয়া জুটিলেন হাবিলদার কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর সংসর্গের যাদুস্পর্শে যুবকদের আসিল মত্ততা আর প্রৌঢ়দের আসিল যৌবন। কাব্য সাহিত্যে দেখা দিল নূতন জোয়ার।২১

সে সময় ‘সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে নিয়মিত আড্ডা হতো। মুজাফ্ফর আহমদ লিখেছেন―‘নজরুল আসার পর থেকে এবং কার্যত মোসলেম ভারতে’র সম্পাদকীয় অফিস এ বাড়িতে হওয়ায় আড্ডাটি বড় বেশী জমজমাট হয়ে উঠল।’২২ আড্ডায় যাঁরা প্রায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, অধ্যাপক সানাউল্লা, কবি চণ্ডীচরণ মিত্র, মাখনলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ আফজাল-উল হক, মোহাম্মদ মুজফ্ফর আহমদ, মোহাম্মদ গোলাম জিলানী, মোজাম্মেল হক, শেখ নূর মোহাম্মদ, আবু লোহানী, শাহাদৎ হোসেন, মৌলভী কিসমৎ আলী, মৌলবী হাতেম উদ্দীন, কাজী সাম্সুজ্জোহা, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, কবি শশাঙ্কমোহন সেন, ডাঃ লুৎফর রহমান, আকবর আলী, এয়াকুব আলী চৌধুরী, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, নৃপেন্দ্রচন্দ চট্টোপাধ্যায়, বরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, মনসুর উদ্দীন, এস. ওয়াজেদ আলি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কিছু দিনের মধ্যে নজরুল  ‘সাহিত্য-সমিতি’র আড্ডার মধ্যমণিতে পরিণত হন।

এছাড়া তখনকার কলকাতা শহরে অনুষ্ঠিত বিখ্যাত ‘গজেনদার আড্ডা’২৩, ‘ভারতীর আড্ডা’য় প্রভৃতি সাহিত্য-সভায় যোগদান করে নজরুল লেখক-সমাজে সমাদৃত হলেন। এভাবে ‘সাহিত্য-সমিতি’র নেতৃবৃন্দ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত সাহিত্যিক, সংগীত ও নাট্য ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তিনি পরিচিত হলেন। কলকাতার সাহিত্য-সমাজে তিনি লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। এক পর্যায়ে ‘সাহিত্য-পত্রিকা’র সম্পাদক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সঙ্গে কবি নজরুল শান্তিনিকেতন গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।২৪ ব্যক্তি জীবনে ‘সাহিত্য-সমিতি’র অবদান সম্পর্কে সমিতির রজত-জয়ন্তীর অভিভাষণে নজরুল বলেন :

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সহিত আমার যোগ বহুদিনের। কয়েকজন বন্ধুর আহ্বানে আমি বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির আড্ডায় আশ্রয় নিই। এখানে আমি বন্ধুরূপে পাই মিঃ মুজফ্ফর আহমদ, মি. আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ বন্ধুগণকে। আমাদের আড্ডা ছিল সত্যিকার জীবন্ত মানুষের আড্ডা। আমরা তথাকথিত ‘য়্যারিস্ট ক্রাট’ বা আড়ষ্ট কাক ছিলাম না। বোমারু বারীন দা এসে একদিন আমাদের আড্ডা দেখে বলেছিল, হাঁ আড্ডা বটে। আজকাল তরুণেরা যে নীড় সৃষ্টি করে বসে আছে তা আমরা করিনি। আমরা জীবনকে করেছিলাম উপভোগ। যাক, সেদিন যদি সাহিত্য সমিতি আমাকে আশ্রয় না দিত তবে হয়ত কোথায় আমি ভেসে যেতাম, তা আমি জানিনা। এই ভালবাসার বন্ধনেই আমি প্রথম নীড় বেঁধেছিলাম। এ আশ্রয় না পেলে আমার কবি হওয়া সম্ভব হত কিনা আমার জানা নেই।… এই সমিতি আমার জীবনের পরিণতির প্রধানতম সহায়ক। কাজেই এর কাছে আমি চিরঋণী। ২৫

মূলতঃ ‘সাহিত্য-সমিতি’র কর্মকাণ্ডে নজরুলের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সাহিত্য-পত্রিকার উদ্যম ও পরিচিতি বাড়িয়ে দেয়।২৬ হবীবুল্লাহ বাহারও সাহিত্য-সমিতিতে নজরুলের আগমন ও অবস্থান সম্পর্কে অনুরূপ মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, নজরুল ও মুজফ্ফর আহমদের সমিতিতে যোগদান নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেবল নজরুল নন, কবি শাহাদৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, ডাঃ লুৎফর রহমান, এয়াকুব আলী চৌধুরী, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, আবদুল কাদির, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ইব্রাহীম খাঁ, আবু লোহানী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ‘সাহিত্য-সমিতি’কে কেন্দ্র করে তাঁদের সাহিত্যিক জীবন গড়ে তোলেন।২৭ বলতে গেলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমকালীন সকল খ্যাতিমান, উদীয়মান এবং নবীন লেখকদের লেখা পাঠ ও প্রকাশের প্লাটফর্ম হয়ে ওঠে সমিতির আড্ডা, সাহিত্য সভা, বার্ষিক সম্মিলন এবং মুখপত্র দুটি।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নজরুল ১৯২০ সালে ‘সাহিত্য-সমিতি’ ছেড়ে অন্যত্র বাসা নেন। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু মুজ্জফর আহমদ। দুজনেরই উদ্দেশ্য ছিল সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ বের করা। পত্রিকাটি বেরও হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকাটির আর্থিক পৃষ্ঠপোষক এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মতপার্থক্য হওয়ায় নজরুল নবযুগ ত্যাগ করেন।২৮ তবে ‘সাহিত্য-সমিতি’ ও সাহিত্য-পত্রিকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অটুট ছিল। এসবের প্রমাণ হলো―নিয়মিত সাহিত্য-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করা ও সমিতি আহুত সভা-সম্মিলনে যোগদান করা। নজরুলের কবিখ্যাতির ভিত্তিভূমি তৈরিতে এ-পর্বের রচনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।২৯ এ পর্যায়ে নজরুল লিখিত ও সাহিত্য-পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাগুলোর সূচি তুলে ধরার প্রয়াস করা হলো৩০ :

তৃতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা (বৈশাখ ১৩২৭) : প্রিয়ার দেওয়া শরাব (কবিতা, হাফিজের গজল অবলম্বনে),

 মানিনী বধূর প্রতি (কবিতা),

দ্বিতীয় সংখ্যা (শ্রাবণ ১৩২৭) : গান, অতৃপ্ত কামনা (গল্প)

চতুর্থ সংখ্যা (মাঘ ১৩২৭) : সাঁঝের তারা (গল্প)

চতুর্থ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা (শ্রাবণ ১৩২৮) : বিজয়-গান (ঐ অভ্রভেদী তোমার ধ্বজা উড়লো আকাশ পথে),

মা (শিশুতোষ কবিতা)

তৃতীয় সংখ্যা (কার্তিক ১৩২৮) : মরণ-বরণ (কবিতা, এস এস এস ওগো মরণ),

খোকার বুদ্ধি (শিশুতোষ কবিতা)

চতুর্থ সংখ্যা (মাঘ ১৩২৮) : বন্দী বন্দনা (গান, আজি রক্ত-নিশি ভোরে), নিশীথ-প্রীতম (কবিতা),

খোকার গপ্প বলা (শিশুতোষ কবিতা), খোকার বুদ্ধি (শিশুতোষ কবিতা), চিঠি (গল্প)

পঞ্চম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা (কার্তিক ১৩২৯) : অগ্নিবীণা (পুস্তক-পরিচয়)

চতুর্থ সংখ্যা (মাঘ ১৩২৯) : আরবী ছন্দের কবিতা, দোদুল দুল (কবিতা, মোতাকাবির ছন্দ; ভূমিকা ও ‘দোদুল দুল’ কবিতা যথাক্রমে ‘প্রবাসী’র চৈত্র ১৩২৮ ও চৈত্র ১৩২৯ থেকে পুনর্মুদ্রিত), পুস্তক পরিচয় : অগ্নিবীণা ও ব্যাথার দান গ্রন্থের আলোচনা

ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা (বৈশাখ ১৩৩০) : দীওয়ান-ই-হাফেজ (পদ্য)

 দ্বিতীয় সংখ্যা (শ্রাবণ ১৩৩০) : জাত জালিয়াৎ (পদ্য)

নজরুল ‘সাহিত্য-সমিতি’ ছেড়ে গেলেও সমিতি কর্তৃপক্ষ নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। সমিতি-আহুত বার্ষিক সম্মিলনে তাঁর উপস্থিতি যেমন অনিবার্য ছিল, তেমনি নিজেও সম্মিলন উদ্বোধন করেছেন, সভাপতিত্ব করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, সঙ্গীত জলসায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। এসব সম্মিলনে নজরুল-প্রদত্ত বক্তব্য থেকে আমরা অন্য এক নজরুলের সন্ধান পাই। এ পর্র্যায়ে ‘সাহিত্য-সমিতি’র সভা-সম্মিলনে নজরুল কীভাবে মূল্যায়িত হয়েছিলেন তা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

সমকালে অভিযোগ ওঠে―নজরুলের দেবার অপরিমেয় শক্তি ছিল; কেবল কার্পণ্য করার কারণে জাতি তাঁর দান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মতো জ্ঞানার্জন করে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে উন্নত ও উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেননি ইত্যাদি। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ‘সাহিত্য-সমিতি’র রজত-জয়ন্তী (১৯৪১) উৎসবের সভাপতির অভিভাষণে নজরুল বলেনÑ ‘এ আমার কার্পণ্য নয়, স্বার্থপরতা নয়Ñ এ আমার স্বধর্ম, এ আমার স্বভাব।’ তিনি আরও বলেন :

যদি আমার বাঁশী না বাজে―আমি কবি বলে বলছিনে―আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি―আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন―আমায় ভুলে যাবেন; বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি―আমি প্রেম দিতে এসে ছিলাম, প্রেম নিতে এসে ছিলাম―সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেম-হীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।৩১   

এ প্রসঙ্গে এমদাদ আলী লিখেছেন :

এই কথা প্রচার করিয়া কোন কোন কবি বা সমালোচক নজরুল ইসলাকে খাটো করিতে চান, কিন্তু তাঁহাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হইতে বাধ্য।…

আলাওল হইতে নজরুল ইসলামের পূর্ব্ব পর্যন্ত মুসলিম বাংলা সাহিত্যে বহু কবির আবির্ভাব হইয়াছে, কিন্তু কেহই আমাদের বিহ্বল মনকে তেমন ভাবে উদীপ্ত করিতে পারেন নাই, যেমন করিয়াছেন নজরুল ইসলাম। সেইজন্য তাঁহার সমস্ত দোষ-ত্রুটিসহ তাঁহাকে প্রাণ ভরিয়া ভালবাসি―তাঁহার রচনার ভিতরে যে স্বচ্ছতা ও সবলতা বিদ্যমান, তাহাই সকলকে তাঁহার দিকে আকৃষ্ট করে।৩২

নজরুল সাহিত্যাঙ্গনে বিরল প্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন যুগস্রষ্টা। তথাপি তাঁর ব্যক্তি-জীবন ও কর্ম নিয়ে লেখক-সমালোচকদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই। সে দীর্ঘ ইতিহাস এখানে তুলে ধরার অবকাশ নেই। এ পর্যায়ে প্রবন্ধের শিরোনাম অনুযায়ী আমরা দেখার চেষ্টা করব ‘সাহিত্য-সমিতি’ আয়োজিত বার্ষিক সম্মিলনসমূহে নজরুল কীভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন।

ষষ্ঠ সম্মিলনের ‘মহিলা-সাহিত্য শাখা’র সভানেত্রী বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের ভাষ্য―‘এক নজরুল ইসলামের প্রতিভায় যে অনেক আবর্জ্জনা ভাসিয়া গিয়াছে, এ কথা উল্লেখ না করিলে অকৃতজ্ঞতা হইবে।’৩৩ অন্যদিকে রজত-জয়ন্তী  উৎসবে পঠিত ‘সাহিত্য সমিতি ও নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক রচনায় আবুল কালাম শামসুদ্দীন অভিমত দেন :

তার (নজরুলের) অবস্থানের ফলে সাহিত্য সমিতিও খুব চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। নজরুলের সাথে দেখা করার জন্য শুধু মুসলমান সাহিত্যিকরা নন, অনেক হিন্দু সাহিত্যিকও সমিতি-অফিসে যাতায়াত করেছেন। কবি মোহিতলাল মজুমদার, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি অনেকেই নজরুলের সাথে কাব্য ও সাহিত্যালোচনা করে মেতে উঠতে দেখেছি। সাহিত্য-সমিতির সভা-সমিতিগুলিও নজরুলের আবির্ভাবের জন্য যথেষ্ট প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। সাহিত্য সমিতির তখনকার ত্রৈমাসিক মুখপত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল নজরুল ইসলামের গল্প বা কবিতাগুলি। মোটকথা, সে-সময়টাকে সাহিত্য সমিতির এক স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। সাহিত্য সমিতি যেমন নজরুলের সংস্পর্শে তখন নবজীবনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, তেমনি সাহিত্য সমিতিও সম্ভবতঃ গর্ব করতে পারে, নজরুল প্রতিভাকে আত্মস্থ হওয়ার প্রথম সুযোগ সে দিতে পেরেছিল।৩৪ 

সপ্তম সম্মিলনের সভাপতি সৈয়দ এমদাদ আলীর বক্তব্য :

বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকার একজন অপরিচিত কবির দু একটা কবিতা পড়িয়া মন যেন কেমন করিতে লাগিল। ভাবিতে লাগিলাম, কে ইনি? হঠাৎ একদিন মোসলেম ভারত বহিয়া আনিল তাঁর ‘শাতিল আরব’ কবিতা। উহা পড়িয়া মন আনন্দে নাচিয়া উঠিল। একটা নূতন সুর, একটা নূতন শক্তি লইয়া কাজি নজরুল ইসলাম বাংলার কাব্য সাহিত্যের আকাশে উদিত হইলেন।

আমাদের সমাজ এইরূপ একজন কবির (নজরুল) জন্যই উন্মুখ হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের মত প্রতিভা লইয়া নজরুল ইসলামের জন্ম না হইলেও রবীন্দ্রনাথের পরে তাঁহার মত প্রতিভাশালী কবি আর নেই। তাঁহার অনেক দোষ ত্রুটি আছে স্বীকার করি, তবুও নজরুল ইসলাম আমাদের যাহা দিয়াছেন বহুদিন কেহ আমাদের সেরূপ কিছু দিতে পারেন নাই, কারণ তাঁহারা জাগরণী মন্ত্রের সন্ধান পান নাই।৩৫

সাহিত্যিক নজরুল শুরু থেকেই সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ফলস্বরূপ সমকালের বিভিন্ন সংবাদ-সাময়িকপত্রে তাঁর রচনা নিয়ে মূল্যায়নধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়। এ পর্যায়ে সাহিত্য-পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাগুলো সমকালের পত্র-পত্রিকার পাতায় কীভাবে মূল্যায়িত হয়েছে তার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাহিত্য-পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৬ সংখ্যায় নজরুলের প্রথম কবিতা ‘হেনা’ প্রকাশিত হয়। কবিতাটি সম্পর্কে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (১৮৭০-১৯২১) সম্পাদিত মাসিক সাহিত্য (১৮৯০) পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৬ সংখ্যার  ‘মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’ অংশে মন্তব্য করা হয় :

শ্রী কাজি নজরুল ইসলাম বঙ্গ বাহিনীর একজন হাবিলদার। ইনি করাচীর সেনানিবাসের কর্ম-কোলাহলের মধ্যেও মাতৃভাষাকে স্মরণ করিয়াছেন, মাতৃভাষার অনুশীলন করিতেছেন। রবীন্দ্রনাথের পদ্য-গল্পগুলি পড়িয়াছেন, এবং তাঁহার অনুসরণে ‘মুক্তি’ লিখিয়াছেন। বাঙ্গালী সৈনিক-শিবিরে যে ভাষার সাধনা করিতেছেন, সে ভাষার আশা করিব না?―অনুকরণ সম্পূর্ণ সফল হইলেও অনুকরণ। এ অনুকরণ সর্বাংশে সফল হইয়াছে, এমন কথাও বলিতে পারি না। কিন্তু একজন নব-ব্রতী মুসলমান রবীন্দ্রনাথের ছন্দের ও ভাষার এতটা সন্নিহিত হইয়াছেন, ইহাও অল্প প্রশংসার বিষয় নহে।৩৬

মাসিক সাময়িকী সাহিত্য-এর ফাল্গুন ১৩২৬ সংখ্যার ‘মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’ অংশে ছোটগল্প ‘হেনা’ প্রসঙ্গে বলা হয় :

শ্রী কাজি নজরুল ইসলামের ‘হেনা’ ঠিক ছোট গল্প নহে; উল্লেখযোগ্য আখ্যান। রচনায় সম্পূর্ণ সাফল্যের পরিচয় নাই, কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আশাপ্রদ আভাস আছে। আর একটু সংযম, আর একটু সংহতি গল্পটির আরও উৎকর্ষ সাধন করিতে পারিত। নবীন লেখক বাহুল্য বর্জনে অভ্যস্ত  হইলে তাঁহার গল্প আরও মনোরম হইতে পারিবে। কাজি নজরুল ‘বঙ্গ-বাহিনী’র অর্থাৎ বাঙ্গালী পল্টনের হাবিলদার। করাচির কর্মক্ষেত্র একজন বাঙ্গালী মুসলমান মাতৃভাষার সাধনা করিতেছেন, যুগধর্মের এই দান বাঙ্গালী সাদরে গ্রহণ করিবে। … কল্পনাই গল্পের একমাত্র উৎস নয়, দৃষ্টজগতেও আখ্যান বস্তু ছড়াইয়া আছে। কাজি নজরুল যে জীবন যাপন করিতেছেন, তাঁহার মাথার উপর মৌমাছির ঝাঁকের মত সেই জীবনের ও সেই প্রতিবেশের আখ্যান-বস্তু নিশ্চয়ই উড়িতেছে। তিনি কল্পনার জালে সেই সকল আখ্যান-বস্তু ধরিবার চেষ্টা করিলে গতানুগতিকতার বাধা অতিক্রম করিয়া মৌলিকতার পথে অগ্রসর হইতে পারিবেন; বাহুল্য ও ‘সেন্টিমেন্টালিটি’র উপাদানে নাটুকে গল্প রচনার দুর্ভাগ্য ও দায় হইতে অব্যাহতি পাইবেন।৩৭ 

‘সাহিত্য-সমিতি’তে বসবাসের কালে নজরুল-জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ‘সাহিত্য-সমিতি’র অফিসের একটি কক্ষে পূর্ব থেকে ভাড়া থাকতেন শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের (১৮৬০-১৯৩৩) পুত্র আফজাল-উল হক (১৯০৬-১৯৮২)। আফজাল-উল হক তখন মোসলেম ভারত প্রকাশের আয়োজন করছেন।৩৮ তাঁর ঘরের বড় ‘তখতপোশখানাই’ ছিল মোসলেম ভারত-এর অবিজ্ঞাপিত সম্পাদকীয় দপ্তর।৩৯ ততোদিনে মোসলেম ভারত-এর কিছু লেখা প্রেসে চলে গিয়েছে। পরের মাসেই কাগজটি বের হবে। নজরুল যেদিন ‘সাহিত্য-সমিতি’তে বসবাসের জন্য এলেন সেদিনই আফজাল-উল-হক তাঁকে প্রকাশিতব্য মোসলেম ভারত-এ লিখতে আহ্বান জানালেন। নজরুলও সম্মত হলেন। ঠিক হয় তাঁর করাচি-পর্বে লেখা একটি পত্রোপন্যাস মোসলেম ভারত-এ ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হবে। পত্রোপন্যাসটির নাম ঠিক করা হলো বাঁধন-হারা। উপন্যাসটি মোসলেম ভারত-এর প্রথম সংখ্যা (বৈশাখ ১৩২৭) থেকে ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। এরপর পত্রিকাটির প্রায় প্রতিটি সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে নজরুলের নতুন নতুন রচনা। এ পর্বে পত্রিকাটিতে নজরুলের যে-সকল লেখা বেরিয়েছিল সেগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি যেমন কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছিলেন, তেমনি সাহিত্য-সাময়িকী হিসেবে মোসলেম ভারতও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।৪০ মুজফ্ফর আহমদ আরও লিখেছেন :

ফৌজ হতে ফিরে আসার আগে কাজী নজরুল ইসলাম তেমন কোন কবি-খ্যাতিই লাভ করেনি। তার কবিতার বান ডেকেছিল তার ফৌজ হতে ফিরে আসার পরে। সত্যই বান ডেকেছিল। কী সৌভাগ্য নতুন মাসিক মোসলেম ভারতের যে, কাগজখানা বের হওয়ার মুখেই তা কাজী নজরুল ইসলামের মত একজন উদীয়মান কবিকে প্রায় বাঁধা লেখক হিসেবে পেয়ে গেল। আর নজরুল ইসলামেরও সৌভাগ্য বলতে হবে যে, তার কবিতার স্রোত বইয়ে দেওয়ার জন্যে নূতন হলেও একখানা প্রথম শ্রেণীর মাসিক তার হাতের মুঠোয় আপনাআপনি এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মানতে হবে যে, মোসলেম ভারতের প্রথম শ্রেণির  কাগজ হওয়ার পেছনে নজরুলেরও অবদান আছে।৪১

মোসলেম ভারত সাম্প্রদায়িক কাগজ ছিল না। উন্নত মান ও মার্জিত রুচির, বিষয় গৌরব ও আঙ্গিক বিবেচনায় পত্রিকাটি হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিদগ্ধ মহলে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পত্রিকাটির মটো বা শিরোমন্ত্র ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি―‘মানব-সংসারে জ্ঞানালোকের দিয়ালি-উৎসব চলিতেছে। প্রত্যেক জাতি আপনার আলোটাকে বড় করিয়া জ¦ালাইলে তবে সকলে মিলিয়া এই উৎসব সমাধা হইবে।’ মটো ছাপা হতো পত্রিকাটির নামের পর।৪২  আর পত্রিকাটির দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা অর্থাৎ মহরম সংখ্যা থেকে রবীন্দ্রনাথের বাণীর ওপর স্থান পায় কোরআনের সুরা ‘আর-রাদ’-এ ১১ নম্বর আয়াতের এই ভাষ্যটি―‘যে পর্যন্ত কোন জাতি তাহাদের পরিবর্তন না করে, সে পর্যন্ত আল্লাহ্ তাহাদের (কোন) পরিবর্তন করেন না।’ এই সংখ্যা থেকেই বাংলা মাসের নামের ওপর আরবি মাসের নাম ছাপা হয়। এই ধারা পত্রিকাটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিল।৪৩

প্রধানত দুইটি উদ্দেশ্য নিয়ে মোসলেম ভারত যাত্রা শুরু করে। এক. পশ্চাদপদ মুসলমান সমাজকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হওয়া এবং দুই. হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন করা। আর এই উদ্দেশ্য দুটো পূর্ণ করতে সম্পাদক জাগরণ-প্রত্যাশী মুসলমান যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন। পত্রিকাটির মটো এবং সম্পাদকীয় বক্তব্য আমাদের সেদিকেই দৃষ্টি দিতে বলে। বিষয়টি সম্পর্কে আমরা আরও পরিষ্কার ধারণা পাবো পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে। ‘আমাদের কথা’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে বলা হয় :

আজ দেশময় একটা জাগরণের সাড়া পড়িয়াছে …। যেরূপ অবস্থা দেখা যাইতেছে, তাহাতে বোধ হয় যেন এ সমাজ (মুসলমান) ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে সাগ্রহে সে পথে অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিতেছে। … সেই আশায় আশ্বস্ত হইয়াইÑ সেই শুভ উদ্দেশ্যের কামনা করিয়াই আজ আমরা আমাদের বড় সাধের মোসলেম ভারত আমাদের সাহিত্যিক সমাজের সম্মুখে উপস্থিত করিতে সাহসী হইয়াছি।

আর একটি কথা। বর্ত্তমানে “আমাদের সাহিত্যিক সমাজ” বলিলে কেবল মুসলমান সমাজকেই বুঝাইবে না, পরন্তু বঙ্গদেশবাসী বঙ্গভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমান মানবসঙ্ঘকেই বুঝাইবে।…

তাই আজ আমরা আহ্বান করিতেছি বাঙ্গলার হিন্দু-মুসলমান লেখকবৃন্দকে, তাঁহাদের কৃতিত্বে এই মহামিলনের প্রশস্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত হউক। আর বিশেষ করিয়া আহ্বান করিতেছি বাঙ্গলার মুসলমান সমাজের মুখোজ্জ্বলকারী যুবকবৃন্দকে…। … জাতির মধ্যে যে জাগরণের সাড়া পাওয়া যাইতেছে, চারিদিকে যে আশার ক্ষীণ আলোক প্রস্ফুট হইবার প্রয়াস পাইতেছে, মোসলেম ভারত তাহারই মূর্ত বিকাশ বক্ষে ধারণ করিয়া ধন্য হউক।৪৪  

মোসলেম ভারত প্রায় দেড় বছর চলেছিল। এ সময়পর্বে পত্রিকাটির মাত্র সতেরোটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সংখ্যাগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি, পত্রিকাটি তার স্বল্পায়ু জীবনকালে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমকালীনদের লেখা প্রকাশ করে পাঠকের নিকট দেওয়া কথা রেখেছিল।

পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, মোসলেম ভারত প্রথম সংখ্যা বের হয় নজরুলের পত্রোপন্যাস বাঁধন-হারা নিয়ে। বাঁধন-হারা বাঙালি মুসলমান রচিত প্রথম পত্রোপন্যাস। সমকালে উপন্যাসটি লেখক ও পাঠক সমাজের নজর কেড়েছিল। এরপর পত্রিকাটির প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় নজরুলের একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যায়ে সংখ্যা অনুযায়ী মোসলেম ভারত-এ প্রকাশিত নজরুলের রচনাগুলোর পরিচয় দেওয়া হবে।

প্রথম বর্ষ, প্রথম খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, বৈশাখ ১৩২৭: বাঁধন-হারা (পত্রোপন্যাস, ধারাবাহিক)

প্রথম বর্ষ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭: বোধন (কবিতা, হাফিজের গজল অবলম্বনে), বাঁধন-হারা

(দ্বিতীয় কিস্তি), সাত্-ইল্-আরব৪৫ (কবিতা)

প্রথম বর্ষ, প্রথম খণ্ড, তৃতীয় সংখ্যা, আষাঢ় ১৩২৭: বাঁধন-হারা (তৃতীয় কিস্তি), বাদল-প্রাতের শরাব (কবিতা)

প্রথম বর্ষ, প্রথম খণ্ড, চতুর্থ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩২৭: খেয়াপারের তরণী৪৬ (কবিতা), বাদল-বরিষণে (রূপক গল্প),

বাঁধন-হারা (চতুর্থ কিস্তি)

প্রথম বর্ষ, প্রথম খণ্ড, পঞ্চম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩২৭: কোরবানী (কবিতা), বাঁধন-হারা (পঞ্চম কিস্তি), উদ্বোধন

(ত্রৈমাসিক বকুল থেকে)

প্রথম বর্ষ, প্রথম খণ্ড, ষণ্ড সংখ্যা, আশ্বিন ১৩২৭: মোর্হরম (কবিতা), বাঁধন-হারা (ষষ্ঠ কিস্তি), দূরন্ত পথিক

(কথিকা, ‘চয়নিকা’ অংশে সূচিভুক্ত; পরবর্তীকালে রিক্তের বেদন-এ সংকলিত)

প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৭: দূরের বন্ধু (গান), বাঁধন-হারা (সপ্তম কিস্তি)

প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, কার্ত্তিক ১৩২৭: ফাতেহা-ই-দোয়াজ্ দহম্ (আবির্ভাব কবিতা), বাঁধন-হারা

(অষ্টম কিস্তি), দিওয়ান-ই-হাফিজ (কবিতা, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা)

প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় সংখ্যা, পৌষ ১৩২৭: দিওয়ান-ই-হাফিজ (কবিতা, তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা), আশা (গান)

প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ সংখ্যা, মাঘ ১৩২৭: বিরহ-বিধুরা (কবিতা), দিওয়ান-ই-হাফিজ (কবিতা, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংখ্যা),

 বাঁধন-হারা (নবম কিস্তি)

প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, পঞ্চম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩২৭: মরমী (গান), স্নেহ-ভীতু (গান)

প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ সংখ্যা, চৈত্র ১৩২৭: গান (‘আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে চলতো নিতুই সকাল সাঁঝে’।

এটি ছায়ানট-এ ‘প্রতিবেশিনী’ শিরোনামে সংকলিত হয়েছে।)

দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম খণ্ড, প্রথম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩২৮: কার বাঁশী বাজিল? (কবিতা), গান

দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, আশ্বিন ১৩২৮:৪৭ বাদল-দিনে (কবিতা), দিল্-দরদী (কবিতা, সঙ্গীত-সঙ্ঘের

বার্ষিক উৎসবে উক্ত), পলাতকা (কবিতা, ভারতী থেকে সংগৃহীত ও ‘চয়নিকা’ অংশে মুদ্রিত)

দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম খণ্ড, তৃতীয় সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৮: কামাল পাশা (কবিতা), বিদ্রোহী৪৮ (কবিতা)

দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম খণ্ড, চতুর্থ সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৩২৮: ফতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্ (তিরোভাব, কবিতা)

দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম খণ্ড, পঞ্চম সংখ্যা, পৌষ ১৩২৮: বিজয়িনী (কবিতা) 

এরপর মোসলেম ভারত আর প্রকাশিত হয়নি। পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি, কাগজের দুর্মূল্য, মুদ্রণাদির ব্যয়বৃদ্ধি, রাজ-নিগ্রহ, সম্পাদকের অসুস্থতা প্রভৃতি কারণে এটি বন্ধ হয়ে যায়।৪৯ পত্রিকাটির দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আমাদের কথা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। মোসলেম ভারতে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’ ও ‘মোহররম’ কবিতা অগ্নি-বীণা’য় (১৯২২) স্থান পেয়েছে।৫০  গ্রন্থভুক্ত হওয়ার কালে উপর্যুক্ত কবিতাগুলো নজরুল যথাযথভাবে সম্পাদনা করেছেন―যা তাঁর শিল্প-নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে।

উল্লেখ্য, ১৯২২ সাল নজরুল জীবনে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ সময় তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়―আমি চির-বিদ্রোহী বীর―/ (আমি) বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ (বিদ্রোহী), ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!’ (প্রলয়োল্লাস), ‘(আমি) যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন মহাবিপ্লব হেতু/ এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু! (ধূমকেতু), ‘ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই/ অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই!’ (কামাল পাশা), ‘পরাধীনা! একই ব্যথিত ঢালিল দু-ফোঁটা ভক্ত-বীর।/ শহীদের দেশ! বিদায় বিদায়! এ অভাগা আজ নেশায় শির।’ (শাত-ইল-আরব), ‘বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,/ ঐ হলো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পায়।’ (খেয়া পারের তরণী), ‘(ওরে) হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।’ (কোরবানি), ‘জাগো ওঠো মুসলিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক। শহীদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক।’ (মোহররম) প্রভৃতি কালজয়ী বাণী। এসব কবিতা তাঁর সমগ্র কবি-প্রতিভার কোনও কোনও বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করে।৫১ এ বছরই বের হয় তাঁর গল্প-সংকলন ব্যথার দান ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী। আত্মপ্রকাশ করে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ধূমকেতু (১১ আগস্ট ১৯২২)। ঘোষণা করা হয়―‘সর্ব্ব প্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’ (২৬ আশ্বিন ১৩২৯) আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছেন :

১৯২২ সালে প্রকৃতপক্ষে নজরুল-সাহিত্যের ফুলগুলি যেন প্রথমবারের মতন ফলে পরিণত হয়েছিল। কবির প্রথম কবিতাগ্রন্থ অগ্নি-বীণা-র ১২টি কবিতাই সুপক্ক ফলের মতন। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়!!’ এরকম ঘোষণা দিয়ে নজরুল বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন। অগ্নি-বীণা-ও অনেকগুলি কবিতা ছিল সমর-কবিতা―যে-ধরনের কবিতা বাংলা ভাষায় আগে কখনো দেখা দ্যায়নি। ব্যথার দান-এর গল্পগুচ্ছেও যুদ্ধের একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল―এ রকম গল্প ছিল না বাংলা সাহিত্যে। যুগ-বাণী প্রবন্ধগ্রন্থে এমন-এক তেজ ও জোশ ঝলকে উঠেছিল, যা বাংলা সাহিত্যে ছিল অভিনব। যেন সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মধ্যবর্তী ক্ষীণ দেয়ালটি নজরুল ঝড়ের মতন এসে এক লহমায় ভেঙেচুরে দিলেন। ‘বিদ্রোহী কবি’ এই অবিধায় চিহ্নিত হয়ে গেলেন নজরুল সেই ১৯২২ সাল থেকে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে।৫২ 

সাহিত্য-পত্রিকা ও মোসলেম ভারত কেবল নজরুলের লেখাই প্রকাশ করেনি, তাঁর রচনা মূল্যায়নেও পত্রিকাদুটি ভূমিকা রেখেছে। সাহিত্য-পত্রিকার কার্তিক ১৩২৯ সংখ্যার ‘পুস্তক-পরিচয়’ শিরোনামে অগ্নি-বীণা-র পরিচয় প্রদানে লেখা হয়―“অগ্নি-বীণার প্রত্যেকটি কবিতাই বীরত্বব্যঞ্জকÑ মরনোন্মুখ জাতির প্রাণে নব উদ্দীপনার সঞ্চার করিবে। … জাতীয় জাগরণের দিনে অগ্নি-বীণার বীরোদাত্ত বাণী বাঙ্গালী জাতি আদরের সহিত গ্রহণ করিবে বলিয়াই বিশ্বাস।”৫৩ মাঘ ১৩২৯ সংখ্যার ‘পুস্তক-পরিচয়’ অংশে বলা হয়―‘প্রেমের বিচিত্র ব্যাখ্যান ও মানব মনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে লেখকের অপূর্ব নৈপুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।… কবি নজরুল ইসলামের শব্দ নির্বাচনের যে অসামান্য কৃতিত্ব তাঁহার কবিতাসূমহে প্রকাশ পাইয়াছে, ব্যথার দানের গল্পগুলিতেও তাহা অক্ষুণ্ন রহিয়াছে।’৫৪ মোসলেম ভারত-এর ভাদ্র ১৩২৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘খেয়াপারের তরণী’ ও ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতা দুটি সম্পর্কে মোহিতলাল মজুমদারের একটি মূল্যায়নধর্মী পত্র। পত্রে তিনি লিখেছেন―‘সাহিত্য-সৃষ্টির প্রেরণা যে তাঁহার মনোগৃহে সত্যই জন্মলাভ করিয়াছে, তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ তাঁহার ভাব, ভাষা ও ছন্দ।… কবির লেখনী জয়যুক্ত হউক।’৫৫  কার্তিক ১৩২৭ সংখ্যায় সুধাকান্ত রায় চেীধুরী কবিতায় নজরুলকে উদ্দেশ করে লিখেছেন―‘ছন্দে গানে বাজাও কবি বাজাও প্রাণের গান,/ মুগ্ধ কর বিশ্বজনে দাও গো নূতন প্রাণ।’৫৬

সাহিত্য-পত্রিকা, মোসলেম ভারত, সওগাত প্রভৃতি সাময়িকপত্রে নজরুলের সম্পৃক্তি কিংবা ধূমকেতু সম্পাদনা―এ সবের কোনও একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করে নজরুল-প্রতিভার উন্মেষ-পর্বের যথার্থ চারিত্র্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে করাচি-পর্ব থেকেই তাঁর লেখালেখিতে রাজনীতি সচেতনতা ও বয়ন-কৌশলের নৈপুণ্য চোখে পড়ার মতো। আর ‘সাহিত্য-সমিতি’তে বসবাস কালে তথা কলকাতা-বাসের প্রথম পর্বে নজরুলের লেখক-আড্ডা, মজফ্ফর আহমদের সংস্পর্শ ও প্রভাব, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ, পরাধীন ভারতের দুঃখ, আফজাল-উল হক ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে সখ্য প্রভৃতি তাঁর সাহিত্যকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে তিনি হয়ে উঠেছেন চিরকালের ‘বিদ্রোহী কবি’। আজ শতবর্ষ পরেও নজরুলের এই বিশেষ কবিসত্তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বাংলা সাহিত্যে এ এক নতুন সুর, নতুন স্বর―যা একই সঙ্গে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। কেবল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা ও মোসলেম ভারত নয়―সমকালে বিজলী, নারায়ণ, সওগাত, সহচর, প্রবাসী, মাসিক বসুমতী, মাসিক বঙ্গবাণী, ভারতী, ধূমকেতু, মানসী ও মর্মবাণী, পল্লশ্রী প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়ও নজরুল লিখেছিলেন। উল্লিখিত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি―তাঁর রচনার বিষয় হিসেবে এসেছে প্রেম ও প্রকৃতি ভাবনা। তবে আমাদের মানতে হবে যে, সাহিত্য-পত্রিকা ও মোসলেম ভারত-এ নজরুল প্রধানত সমকাল সচেতন কবি, ‘বিদ্রোহী কবি’।  

তথ্যনির্দেশ ও টীকা

১. বাঙালির জাতিগত বিকাশে সওগাত, মোসলেম ভারত, ধূমকেতু (১৯২২), সাম্যবাদী (১৯২৩), শিখা (১৯২৭), নওরোজ (১৯২৭), জাগরণ (১৯২৮), সঞ্চয় (১৯২৮), মোয়াজ্জিন (১৯২৮), জয়তী (১৯৩০), বুলবুল (১৯৩৩) প্রভৃতি সাময়িকপত্রসমূহেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এরপর ইমরোজ (১৯৪৯), সমকাল (১৯৫৭), মেঘনা (১৯৫৭), পূর্বালী (১৯৬০), পূর্বমেঘ (১৯৬০), যাত্রী (১৯৬০), সুন্দরম (১৯৬৩), স্বাক্ষর (১৯৬৩), স্বদেশ (১৯৬৩), কণ্ঠস¦র (১৯৬৫), পূর্বলেখ (১৯৬৬) প্রভৃতি পত্রিকা প্রগতিশীল চিন্তা-চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ ধারার কৃষ্টি (১৯৪৭), সীমান্ত (১৯৪৭), সংকেত (১৯৪৮), অগত্যা (১৯৪৯), মুকতি (১৯৫০), পরিচিতি (১৯৫১), যাত্রিক (১৯৫৩), স্পন্দন (১৯৫৩) প্রভৃতি পত্রিকা একদিকে দীর্ঘজীবী হয়নি অন্যদিকে প্রগতি-চিন্তায় তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। রবিউল হোসেন, সমকাল পত্রিকার সমাজিক ভূমিকা, ঝিনুক প্রকাশনী, ঢাকা ১৯১৫, পৃ. ১৯

২. রবিউল হোসেন, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি : সাহিত্যকর্ম ও সমাজচিন্তা, কথাপ্রকাশ, ঢাকা ২০২০, পৃ. ২৬

৩. আবদুল আজীজ আল্-আমান, নজরুল পরিক্রমা (দ্বিতীয় খণ্ড), হরফ প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৬০, পৃ. ৪

৪.  এম. আব্দুর রহমান, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ইতিহাস, বুলবুল প্রকাশনী, কলকাতা ১৩৮২, পৃ. ১

৫. এখন থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা’কে কেবল সাহিত্য-পত্রিকা ও ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’কে কেবল ‘সাহিত্য-সমিতি’ হিসেবে অভিহিত করা হবে।

৬. ত্রৈমাসিক এ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। তবে চতুর্থ বর্ষ থেকে সম্পাদক হিসেবে কেবল মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক-এর নাম ছাপা হয়। পত্রিকাটি তার সাড়ে পাঁচ বছরের জীবনকালে সমকালীন অধিকাংশ হিন্দু-মুসলমান লেখকদের রচনা প্রকাশ করে ইতিহাস হয়ে আছে। উল্লেখ্য, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং সম্পাদক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। 

৭. সংবাদ-সাময়িকপত্রে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের প্রতিফলন পাওয়া যায়। আবার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ঘটনাপ্রবাহের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এক্ষেত্রে সম্পাদকীয়ের ভূমিকা হয়ে ওঠে সব চেয়ে বেশি সক্রিয়। কেননা সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয় সমকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে পত্রিকার মতামত, করণীয় ও দৃষ্টিভঙ্গি। সম্পাদকীয় অংশকে এজন্যে পত্রিকার প্রাণ অর্থাৎ দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করা চলে।   

৮. ‘নিবেদন’ (সম্পাদকীয়), বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা, কলকাতা, বৈশাখ ১৩২৫, পৃ. ১

৯. মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, সওগাত-যুগে নজরুল, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা ১৯৮৮, পৃ. ১১

১০. প্রতিষ্ঠাকালে ‘সাহিত্য-সমিতি’র ঠিকানা ছিল―৪৭/১ মীর্জাপুর সড়কস্থ বাড়ির নীচতলায়।

১১. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, মুক্তধারা, ঢাকা ১৯৯৯, পৃ. ৩৪

১২. ড. সুশীলকুমার গুপ্ত, নজরুল-চরিতমানস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ২০১২, পৃ. ২৯

১৩. রফিকুল ইসলাম, নজরুল-জীবনী, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা ২০১৩, পৃ. ৪৮

১৪. নজরুল কবিতাটির নাম দিয়েছিলেন ‘ক্ষমা’। সম্পাদক ‘মুক্তি’ নাম দিয়ে কবিতাটি ছেপেছিলেন। প্রথম ছাপা কবিতা হিসেবে নজরুলের ‘মুক্তি’ পাঠকের নজর কেড়েছিল। গল্পটি পড়ে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (১৮৭০-১৯২১) তাঁর নিজের পত্রিকা সাহিত্য-তে (১৮৯০) ভাদ্র ১৩২৬ সংখ্যায় মন্তব্য করেন―‘বাঙ্গালী সৈনিক-শিবিরে যে ভাষার সাধনা করিতেছেন, সে ভাষার আশা করিব না?’ (উদ্ধৃত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সমকালে নজরুল ইসলাম, কথাপ্রকাশ, ঢাকা ২০১৫, পৃ. ২৯)

১৫. গল্পটি পড়ে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি পূর্বোক্ত সাহিত্য পত্রিকার ‘মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’ বিভাগে মন্তব্য করেছিলেন―“‘হেনা’ গল্পটি একটি উৎকৃষ্ট রচনা।” (উদ্ধৃত, আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, সুপ্রীম পাবলিশার্স, কলকাতা ১৯৯৭, পৃ. ১৯)

১৬. গল্পটিতে নজরুল ‘লালফৌজ’ শব্দটি প্রয়োগ করেছিলেন। ‘লালফৌজ’ শব্দটি রুশ বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গতি পূর্ণ হওয়ায় এবং ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে রুশ বিপ্লব সম্পর্কিত আলোচনা অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ায় গল্পটি প্রকাশকালে মুজ্জফর আহমদ উল্লিখিত শব্দটির বদলে ‘মুক্তিসেবক সৈন্য’ কথাটি বসিয়ে দেন। (উদ্ধৃত, আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, সুপ্রীম পাবলিশার্স, কলকাতা ১৯৯৭, পৃ. ২১) 

১৭. রফিকুল ইসলাম, নজরুল-জীবনী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৮। ইসমাইল হোসেন সিরাজী সম্পাদিত ও ৩৩-এ বেনেপুকুর রোড, কলকাতা থেকে মাসিক নূর (১৯২০) প্রকাশিত হয়। 

১৮. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯

১৯. আবদুল আজীজ আল্-আমান, নজরুল পরিক্রমা (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭০

২০. মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ‘বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ধারা’ (সপ্তম ‘সম্মিলনে’র সাহিত্য শাখার সভাপতির অভিভাষণ), মাসিক মোহাম্মদী, ষোড়শ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫০, পৃ. ৩৫৪

২১. মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ‘বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ধারা’, মাসিক মোহাম্মদী,  ষোড়শ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৫৪

২২. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৪

২৩. কলকাতার ৩৮ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে সাহিত্যিক গজেন্দ্রচন্দ্র ঘোষের বৈঠকখানায় সন্ধ্যায় আড্ডাটি শুরু হতো। এই আড্ডাতেই এক সন্ধ্যায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে নজরুলের আলাপ হয়।  

২৪. তপন মণ্ডল, ‘বাঙালির নজরুল-বাংলার নজরুল’, তবু একলব্য, কলকাতা ২০২২, পৃ. ২২-২৩

২৫. সপ্তম বার্ষিক সম্মিলনের অভিভাষণ যা মোহাম্মদী পত্রিকায় অষ্টম সংখ্যায় ছাপা হয়। মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩

২৬. রবিউল হোসেন, সেরা বঙ্গীয়-মুসলমান সাহিত্য-পত্রিকা সংগ্রহ, গাঙচিল, কলকাতা ২০২৩, পৃ. ২১

২৭. মুহম্মদ হবীবুলল্লাহ বাহার ‘সাহিত্য-সমিতির ইতিহাস’, মাসিক মোহাম্মদী, চতুর্দশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা, বৈশাখ ১৩৪৮, পৃ. ৪৫৪

২৮. আবদুল মান্নান সৈয়দ, কাজী নজরুল ইসলাম : তিন অধ্যায়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ২০০৭, পৃ. ১২

২৯. আজহারউদ্দীন খান, বাংলা সাহিত্যে নজরুল, সুপ্রীম পাবলিশার্স, কলকাতা ১৯৭৯, পৃ. ৩৪

৩০. দ্বিতীয় বর্ষে প্রকাশিত নজরুলের তিনটি রচনার পরিচয় পূর্বে দেওয়া হয়েছে।

৩১. ? নজরুল ইসলাম, মাসিক মোহাম্মদী, চতুর্দশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩৫

৩২. সৈয়দ এমদাদ আলী, মাসিক মোহাম্মদী, ১৬শ বর্ষ ৮ম সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫০, পৃ. ৩৩৭

৩৩. বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, মাসিক মোহাম্মদী, দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪১

৩৪. আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মাসিক মোহাম্মদী, চতুর্দশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৪৬। কারও কারও মতে, নজরুল ১৯২০ সালে সাহিত্য-সমিতিতে আস্তানা গেড়ে প্রায় দুই বছর এক নাগাড়ে অবস্থান করেন। (মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, মাসিক মোহাম্মদী, ষোড়শ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ, ৩৫৪) মুজফ্ফর আহমদও এ সময় সমিতিতে যোগ দেন। (মুহম্মদ হবীবুল্লাহ, মাসিক মোহাম্মদী, চতুর্দশ বর্ষ সপ্তম সংখ্যা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৪)

৩৫. সৈয়দ এমদাদ আলী, মাসিক মোহাম্মদী, ষোড়শ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫০, পৃ. ৩৩৭

৩৬. উদ্ধৃত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সমকালে নজরুল ইসলাম, কথাপ্রকাশ, ঢাকা ২০১৫, পৃ. ২৯

৩৭. উদ্ধৃত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯-৩০

৩৮. মোসলেম ভারতের সম্পাদক হিসেবে শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের নাম ছাপা হতো। কিন্তু সম্পাদকীয় এবং পরিচালনা অর্থাৎ সব দায়িত্ব পালন করতেন মোজাম্মেল হকের পুত্র আফজাল-উল হক। কেবল ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আফজাল-উল হক পিতা মোজাম্মেল হকের নাম ব্যবহার করতেন। তবে মোজাম্মেল হক পত্রিকাটির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কহীন ছিলেন না। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার ‘মঙ্গলাচরণ’ শীর্ষক প্রথম রচনাটি কবি মোজাম্মেল হকের লেখা কবিতা। কবিতাটির শেষাংশÑ ‘দানের বন্ধু দয়ার সিন্ধু,/নরের কুশল-কামী,/হে প্রভু, এ দাস নিবেদে চরণে,/‘মোসলেম-ভরত’ উজল কিরণে/হউক ভাস্বর এই শুভ বর/বরষ দিবস যামী।’ সৌমিত্র শেখর (সম্পা.), নির্বাচিত মোসলেম ভারত, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১৪, পৃ. ৩৪   

৩৯. মোসলেম ভারতের বিজ্ঞপিত সদর দপ্তর ছিল ৩ নম্বর কলেজ স্কোয়ার।

৪০. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২-৪৩

৪১. মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৩-৪৪

৪২. মোবাশ্বের আলী, নজরুল ও সাময়িকপত্র, .. .. .., পৃ. ৬৫

৪৩. সৌমিত্র শেখর (সম্পা.), নির্বাচিত মোসলেম ভারত, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা ২০১৪, পৃ. ১৯

৪৪. সৌমিত্র শেখর (সম্পা.), নির্বাচিত মোসলেম ভারত, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০-২১ 

৪৫. সংখ্যাটির ভৎড়হঃরংঢ়রবপব হিসেবে ‘শাত-ইল-আরবে’র ছবি মুদ্রিত হয়। পত্রিকার ১৩৯ পৃষ্ঠার বর্ণনানুযায়ী ছবিটির চিত্রকর ছিলেন একজন সৈনিক তথা স্বয়ং নজরুল। কবিতাটি রচনার ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় গুলিস্তা ১৩৫২ সংখ্যায় অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। (মোবাশ্বের আলী, নজরুল ও সাময়িকপত্র, .. .. .., পৃ. ৬৭)

৪৬. কবিতাটি ঢাকার নবাব পরিবারের নবাবজাদী মেহেরবানু খানমের আঁকা একটি ছবি অবলম্বনে রচিত। মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫। ‘বাদল প্রাতের শরাব’ ও ‘খেয়া-পারের তরণী’ কবিতা দুটি পাঠ করে মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত সম্পাদককে একটি পত্রে লিখেছিলেন―‘মুসলমান সমাজের নব জাগরণের অনেক লক্ষণ সর্বত্র দেখা যাইতেছে, কিন্তু বাঙ্গলা দেশে সেই লক্ষণ নিশ্চয় হইয়া উঠিয়াছে বাঙ্গালি মুসলমানের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য সাধনায়।… আপনার মোসলেম ভারত পত্রে সে সে সাধনার সিদ্ধির পরিচয় আছে।’ পত্রটি মোসলেম ভারত-এর ভাদ্র ১৩২৭ সংখ্যায় ছাপা হয়। (মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৬-১৫৭) 

৪৭. সংখ্যাটি ‘মহরম সংখ্যা’ রূপে প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা থেকে প্রথম পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বাণীর ওপরে পূর্বে উল্লিখিত কোরআনের বাণী ছাপা হয়েছে।

৪৮. কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় নলিনীকান্ত সরকার ও প্রবোধ কুমার সানাল সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিজলীর ২২ পৌষ ১৩২৮ সংখ্যায়। মাঘের প্রবাসীতে ‘বিদ্রোহী’ বের হয়েছিল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির প্রথম প্রকাশের গৌরব মোসলেম ভারত নিতে পারেনি। কেননা মোসলেম ভারতের কার্তিক ১৩২৮ সংখ্যাটি বিলম্বে বের হয় এবং তা ফাল্গুন মাসের পূর্বে নয় বলে নানা জনের মত পাওয়া যায়। (মুজফ্ফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৯) উপর্যুক্ত পত্রিকা দুটি ছাড়াও দৈনিক বসুমতি, প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), সাধনা  বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতু (২৬ শ্রাবণ ১৩২৯, প্রথম সংখ্যা) পত্রিকায় কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।    

৪৯. সৌমিত্র শেখর (সম্পা.), নির্বাচিত মোসলেম ভারত, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫

৫০. ‘বোধন’ কবিতাটি স্থান পেয়েছে বিষের বাঁশী কাব্যে (১৯২৪)। ‘বাদল-প্রাতের শরাব’ স্থান পেয়েছে পূবের হাওয়া (১৯২৬) কাব্যে। এ সময় কবিতাটি ‘নিকটে’ শিরোনাম গ্রহণ করে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুতে রচিত কবিতা ‘দিল-দরদী’ গ্রন্থভুক্ত হয় ফণি-মনসা (১৯২৭) কাব্যে। ‘বাদল বরিষণে’ গল্পটি স্থান পেয়েছে ব্যথার দান গল্পগ্রন্থে। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার কালে উপর্যুক্ত রচনাদুটি নজরুল যথাযথভাবে সম্পাদনা করেছিলেন।

৫১. আবদুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইসলাম : কবি ও কবিতা, রোদেলা, ঢাকা ২০১৬, পৃ. ৫৯

৫২. আবদুল মান্নান সৈয়দ, কাজী নজরুল ইসলাম : তিন অধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭

৫৩. উদ্ধৃত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪১-৪২

৫৪. উদ্ধৃত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫

৫৫. সৌমিত্র শেখর (সম্পা.), নির্বাচিত মোসলেম ভারত, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২৫-৩২৭

৫৬. উদ্ধৃত, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩২

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button