ছোটকাগজ বৈঠা : পাঁচ পাপড়ির শিল্পপুষ্প : মানবর্দ্ধন পাল

ক্রোড়পত্র : লিটলম্যাগ চর্চা
শিহাব শাহরিয়ার―একজন কৃতী কবি, স্বনামধন্য লিটলম্যাগ সম্পাদক, ঋদ্ধ গবেষক―ত্রিগুণে ভূষিত ব্যক্তিত্ব। কোনও পরিচয়েই ন্যূন নন তিনি―এককথায় সারস্বত-নিবিষ্ট মানুষ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বৈঠা শিরোনামে একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করছেন―বিশ বছর। ত্রৈমাসিক প্রকাশনার প্রতিশ্রুতি থাকলেও কখনও তা হয়নি! না ষান্মাসিক হয়েছে, না বাৎসরিক! কখনও ‘আঠারো মাসে বছর’ও গেছে। এই দুই দশকের কালপর্বে যদিও মাত্র পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে তবু তা অনানন্দের নয়, সম্পাদনা কর্মে ঊনও নয়। ‘নাইট কুইন’ ফুল নাকি কয়েক বছর পর একবার ফোটে! বাংলার বাউলের বাণীই তো পরম সত্য : ‘ও আমার নিষ্ঠুর দরদি,/ তুই ফুল ফোটাবি, বাস ছোটাবি,/ সবুর বিহনে ?’
ছোটকাগজ সর্বদা অপ্রাতিষ্ঠানিক। অভাব এর নিত্যসঙ্গী, অর্থসংকট এর কুললক্ষণ। ছোট কাগজের সংসার দিনানুদৈনিক দারিদ্র্যক্লিষ্ট। অফুরান অভাবের সংসারে সে গরিবের চাইতেও গরিব। লিটলম্যাগের চরিত্রই এমন―তাই প্রকাশনায় নিয়মিত অনিয়ম। লিটলম্যাগের নেপথ্যে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থের জোগান থাকে না, সমবায়ী হাতের ছোঁয়া থাকে না, থাকে না বিজ্ঞাপনের নিশ্চয়তা কিংবা সরকারি সহায়তা। কেবল সম্পাদকের বিপুল প্রাণশক্তির জোরেই তা টিকে থাকে। এই বিচিত্র প্রযুক্তির যুগে বিজ্ঞাপনদাতারাও চটকদার ও রঙ-চকচকে ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে আগ্রহী। এসব সীমাবদ্ধতা নিয়ে এ-যুগের লিটলম্যাগ প্রকাশের অসম যুদ্ধযাত্রা―যেন ডিঙিনৌকায় সাগর-পারানি! তাই তো লিটলম্যাগের প্রকাশনা নিরন্তর থাকে না, হয়ে যায় কদাচিৎ।
শিহাব শাহরিয়ারের ছোটকাগজটির নাম, বৈঠা। ইংরেজি ‘লিটলম্যাগ’ শব্দটির বাঙলায়ন ‘ছোটকাগজ’ হলেও তাঁর পত্রিকাটি আভিধানিক বা আক্ষরিক অর্থে নয়―না আকার-আকৃতিতে, না অন্তর্গত ভাবসম্পদে। লক্ষ্যার্থে বৈঠা ‘সুদূরের পিয়াসি’। এর সব সংখ্যাতেই আছে দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের উপস্থিতি এবং প্রায় কেউই দায়সারা লেখা দেননি। তবে কেউ-কেউ নাম ও কথা রক্ষার্থে অনুলেখা দিয়ে অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছেন। তবে সব সংখ্যাতে একাধিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ আছে যাতে হিরের দ্যুতি চকমকিয়ে ওঠে। প্রতিটি সংখ্যার বহুমুখী বিষয়ের বিস্তৃতি পাঠককে যেমন চমকিত করে তেমনই এর গভীরতা মন-মননকে ঋদ্ধ করে। এবার কাগজটির নামকরণ বিষয়ে একটু গভীরে গিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। শব্দসমুদ্রের বাংলা ভাষায় এত নামবাচক শব্দ থাকতে সম্পাদক মহোদয় কেন কাগজটির নাম বৈঠা রাখলেন ? বৈঠার তাৎপর্য কী ?
পত্রিকার নামের জন্য বাংলা ভাষায় বাহারি ও চমকপ্রদ শব্দের অন্ত নেই! একটি মজার কথা মনে পড়ল। আশির দশকে আমাদের ছাত্রজীবনে বন্ধু মনজুরুল আহসান বুলবুল ছড়ার একটি ভাঁজপত্র করেছিলেন―নাম ছিল ‘স্তনন’। সেটি মেয়ে-বন্ধুদের হাতে দিতেই তারা লজ্জায় লাল হয়ে আঁচলে-ওড়নায় মুখ ঢেকে পালাত! অথচ তখন আমরা অনেকেই জানতাম না, ‘স্তনন’ শব্দের অর্থ, মেঘের ডাক দেওয়া, গর্জন। যাক, স্মৃতির ঝুলি বন্ধ করে ‘বৈঠা’ শব্দটির ঠিকুজি-কুলজির সন্ধানে অভিধানের পাতায় চোখ ফেরাই। অভিধানে এর উৎসের দুটি ভুক্তি আছে। হিন্দি বৈঠ্ থেকে বৈঠা। এটি ক্রিয়াপদ, বসা অর্থে প্রযোজ্য। অন্যটির উৎস সংস্কৃত শব্দ ‘বহিত্র’ থেকে। বহিত্র > বহিটঠা > বঠিয়া > বইঠা > বৈঠা > বোঠে। তাই বৈঠা সংস্কৃত শব্দজাত তদ্ভব শব্দ। এর অর্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘নৌকার মুখচওড়া ছোট দাঁড়; কাঠ দ্বারা নির্মিত পাতলা দাঁড়, যা না-বেঁধে হাতে করে বাইতে হয়।’ (জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান ও বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান)।
সর্বজনবোধ্য একটি শব্দ বৈঠা। নগর কিংবা গ্রাম, এমন কি হোন তিনি প্রবাসী―বাংলাভাষী এমন কোনও মানুষ নেই, যারা শব্দটির অর্থ বোঝেন না! এমন সরল, সহজবোধ্য, লৌকিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত অথচ শৈল্পিক শব্দ সত্যি খুঁজে পাওয়া ভার। তাই জনপ্রিয় লোকগানে পাই : ‘মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না।’ কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লোকায়ত ধর্ম-সম্পর্কিত কবিতার পঙ্ক্তি : ‘পাঁচ পীরেরই শির্নি মেনে, চলরে টেনে বৈঠা হেনে।’ বাঙালির লোকজীবন ও সংস্কৃতির ধারক এমন শব্দই সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার পত্রিকাটির নামফলক হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এর পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি সম্পাদকীয়তে লিখেছেন : বৈঠা বাংলার গ্রামীণ ও লোকশব্দ। প্রথমে কে বৈঠা তৈরি করেন এবং বৈঠা নামকরণ কে করেন, তা জানা না গেলেও বৈঠায় আছে লোকনন্দনের একটা ছোঁয়া। দৃষ্টি-নন্দিত এই বৈঠা হারিয়ে যাচ্ছে নৌকা থেকে, হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের গোচর থেকে। আর বাঙালির নতুন প্রজন্ম ও শহরের আধুনিকরা বৈঠা বলতে ভুলেই যাচ্ছেন।’ (জ্যোৎস্না সংখ্যা ২০০৫)। সম্পাদক মহোদয় যথার্থ লিখেছেন। বৈঠাকে তিনি ‘বাংলার গ্রামীণ ও লোকশব্দ’ বললেও অসত্য বলেননি এ কারণে যে, বৈঠা গ্রামীণ সমাজজীবনেরই অঙ্গীভূত এবং লোকবাংলার ভাষিক সংস্কৃতে বেশি ব্যবহৃত। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যযোগ্য। পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদে নামলিপির ওপরে মুদ্রিত হয় একটি বাক্যবন্ধ : ‘লোকনন্দন বিষয়ক পত্রিকা’। পত্রিকার চরিত্র-নির্ধারণিক এই শব্দত্রয় এমনই লাগসই যে, এর অন্তর্গত রক্ত-মাংস-মেদ-মজ্জা এবং আত্মিক পরিচয় বহনে মোক্ষম ত্রিফলা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে নদনদী, খালবিল, হাওর-বাওড়। এই জলাভূমির দেশে নৌকা প্রাচীনতম যানবাহন। জলের সঙ্গে নৌকার আধার-আধেয় সম্পর্ক―আত্মিক সম্বন্ধ। আকার-আকৃতি ও প্রকৃতিতে, রঙেরূপে শত রকমের নৌকা আছে এ দেশে। অঞ্চলভেদে নৌকার বহুবিধ নাম―ডিঙি নাও, কোষা নাও, গয়না নাও, ছিপ নাও, দৌড়ের নাও, পানসি নৌকা, মহাজনী নৌকা, গুদারা নাও, কেরায়া নাও, সাম্পান, আরও কত কী! যন্ত্রসভ্যতার বিকাশের ফলে এসেছে ইঞ্জিনের নৌকা। বাঙালির সামন্তসমাজ ও লোকজীবনের অমর গাথা মনসামঙ্গল কাব্যে চাঁদ সওদাগরের সেরা বাণিজ্যতরীর নাম―সপ্তডিঙা মধুকর। আবার আবহমান কালের বাঙালির স্বপ্নের নৌকার নাম ময়ূরপঙ্খী। কিন্তু যে কোনও নৌকা চালনায় প্রয়োজন পাল, গুণ, দাঁড়, লগি, গেরাফি, নোঙর ইত্যাদি। তবে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় হলো বৈঠা। বৈঠাবিহীন নৌকা এগিয়ে যেতে পারে না, হয় চলচ্ছক্তিহীন। তাই পত্রিকার নাম বৈঠা যেমন শিল্পসম্মত, তেমনই অনিবার্য ও অবিসংবাদী।
বিগত বিশ বছরে শিহাব শাহরিয়ারের বৈঠার যে পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, সানন্দ সংবাদ, তার সবগুলোই সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা। তাই বিগত সংখ্যাগুলোর সংক্ষিপ্ত সালতামামি করা যেতে পারে। বৈঠার বিষয়গুলো হচ্ছে : ১) জ্যোৎস্না সংখ্যা (আগস্ট ২০০৫), ২) বৃষ্টি সংখ্যা (নভেম্বর ২০০৭), ৩) গ্রাম সংখ্যা (ডিসেম্বর ২০১৩), ৪) সমুদ্র সংখ্যা (এপ্রিল ২০২৪) এবং পাহাড় সংখ্যা (জানুয়ারি ২০২৫)। একটি মানবশিশু যেমন লোকচক্ষুর অন্তরালে ধীর লয়ে শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে দেহে ও মানস-সম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তেমনই শিহাবের হাতের বৈঠাটিও। লেখা ও রেখাঙ্কনের প্রাচুর্যে, মানস-সম্পদে ও অঙ্গসজ্জায়, শরীরে ও স্বাস্থ্যে ক্রমেই বৈঠা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। যাদের হাতে পাঁচ পাপড়ির ফুলের মতো বৈঠার পাঁচটি সংখ্যাই আছে তারা এ কথা অবশ্যই মানবেন। প্রতিটি সংখ্যাতে আছে রচনার ভাব অনুসারে পর্ব-বিভাজন। প্রথম জ্যোৎস্না সংখ্যায় আছে আটটি পর্ব কিন্তু পর্বের শিরোনাম নেই। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা দুইশ একান্ন। লেখক তালিকায় আছেন সাতষট্টি জন নবীন-প্রবীণ শব্দসৈনিক। খ্যাতনামা লেখকদের মধ্যে আছেন : কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ূন আহমেদ, বিপ্রদাস বড়ুয়া, করুণাময় গোস্বামী, সেলিনা হোসেন, রফিক আজাদ, জাহিদুল হক, রফিকউল্লাহ খান, বিশ্বজিৎ ঘোষ, আল মাহমুদ, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রাহাত খান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, কামাল চৌধুরী, নাসরীন জাহান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আনিসুল হক, ফারুক নওয়াজ, সালমা বাণী, আবিদ আনোয়ার, শিহাব সরকার প্রমুখ।
বাংলার প্রভাবশালী ও প্রবলতম ঋতু বর্ষা। এর দৃষ্টিগ্রাহ্য ও ছন্দময় রূপ বৃষ্টি। বৈঠার দ্বিতীয় সংখ্যাটি তাই বৃষ্টি নিয়ে। এটির পৃষ্ঠা সংখ্যা তিনশ চৌষট্টি, পর্ব আছে এগারোটি। এ সংখ্যার লেখক উননব্বই জন। বৃষ্টি সংখ্যার পর্ব বিভাজন করা হয়েছে দশকভিত্তিক। এ সম্পর্কে সম্পাদকের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘তিরিশের দশক থেকে বর্তমান শূন্য দশকের এসব লেখককে দশক-ওয়ারী স্থান দেয়া হয়েছে এবং লেখকদেরকে বর্ণানুক্রমে সাজানো হয়েছে। অনেকে হয়তো এই বিভাজন মানতে চাইবেন না। এটি আসলে বিভাজন নয়―সময় অর্থাৎ এক এক দশকের লেখকদের বৃষ্টি-বিষয়ক অনুভূতি ও মেজাজ আলাদা করে বোঝার জন্যই এই পর্ব বিভাজন করা হয়েছে।’ দশকি পর্বের লেখাগুলোর মূল সুর অভিন্ন―শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ও যৌবনে বৃষ্টির অনুভূতি ও স্মৃতিচারণ। বৃষ্টি সংখ্যায় আছে বিশেষ তিনটি পর্ব : কবিতা ও কথাশিল্পে বৃষ্টি, পরিবেশবিদ ও আবহাওয়াবিদদের কথা এবং পুনর্পাঠ। পুনর্পাঠ পর্বে কালোত্তীর্ণ লেখক নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ মুজতবা আলী ও শঙ্খ ঘোষসহ বারোজনের লেখা পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। সংখ্যাটি শুরু হয়েছে জীবনানন্দের একটি দুর্লভ কবিতা এবং কবি আবুল হোসেন ও সরদার ফজলুল করিমের সাক্ষাৎকার দিয়ে। এ সংখ্যার বিশিষ্ট লেখক : আবুবকর সিদ্দিক, আল মাহমুদ দিলওয়ার, সৈয়দ শামসুল হক, অসীম সাহা, ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, নাসির আহমদ, মাহবুব বারী, শামীম আজাদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, তপন বাগচী, মনি হায়দার, আমিনুর রহমান সুলতান, খালেদ হুসাইন, মজিদ মাহমুদ, মতিন রায়হান প্রমুখ।
বৈঠার তৃতীয় সংখ্যার বিষয়―গ্রাম। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় বাংলার চিরন্তন পল্লীর বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘অবারিত মাঠ, গগনললাট/ চুমে তব পদধূলি,/ ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়/ ছোট ছোট গ্রামগুলি।/ পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,/ স্তব্ধ অতল দীঘি কালো জল/ নিশীথ শীতল স্নেহ।’ রবীন্দ্র-বর্ণিত বাংলার এই গ্রাম শতাব্দীর পরিবর্তনেও খুব বেশি বদলে যায়নি। এমন গ্রামবাংলাই সমাজ-সংস্কৃতি, যাপিত জীবন, অর্থনীতি সবই এ সংখ্যার লেখকবৃন্দ স্মৃতির আলোকে তুলে ধরেছেন। বাংলার লেখককুল এখন জীবনের প্রয়োজনে নগরবাসী হলেও নাড়ির বন্ধন ও মনের সম্পর্ক বিনা সুতোর মালার মতো পল্লীবাংলার সঙ্গেই সংযুক্ত। গ্রামই উৎপাদনের ভাঁড়ার, অর্থনীতির চাবিকাঠি, উন্নয়নের উৎসমুখ। এ সংখ্যাটি আরও বৃহৎ কলেবর ও সৌষ্ঠবমণ্ডিত। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা পাঁচশ পঁয়ষট্টি। শ-ছুঁইছুঁই লেখকের সমাহার ঘটেছে এই গ্রাম সংখ্যায়। বৈঠার এই পর্ব থেকে শুরু হয়েছে বিভাজিত পর্বগুলোর শিরোনাম। এ সংখ্যার আছে বারোটি পর্ব। সবচেয়ে বড়ো পর্ব ‘স্মৃতি তাড়ানিয়া গ্রাম’―এখানে নবীন-প্রবীণ একাত্তর জন লেখকের সন্নিবেশ ঘটেছে। এ সংখ্যার পর্ব-বৈচিত্র্যের কথা সম্পাদকীয় থেকে পড়ে নিই : “গ্রামের উৎপত্তি, গ্রাম কী, প্রাচীন গ্রাম, প্রত্নতাত্ত্বিক গ্রাম, আধুনিক গ্রাম, কোন জেলায় কত গ্রাম, একটি গ্রামের ইতিবৃত্ত, বৃহত্তর গ্রাম, সীমান্ত গ্রাম, অনন্য গ্রাম, দূর পাহাড় ও প্রান্তের গ্রাম, গ্রামের জীবন-যাপন, গ্রামের নানা বিষয়-আশয়, গ্রামের উন্নয়ন-অর্থনৈতিক অবস্থা, শিল্প-সাহিত্যে গ্রাম, স্মৃতি তাড়ানিয়া গ্রাম এবং ফিরে দেখা গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে এই সংখ্যার কলেবর এবং বিশেষ পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে হেমাঙ্গিনী দত্তের ‘হারানো গ্রাম’।”
এ বইটি বাংলার গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থা জানার জন্য একটি মৌলিক গ্রন্থ। উনিশ ও বিশশতকের বাংলার জনজীবনের অন্তর্নিহিত স্বরূপ হেমাঙ্গিনীর স্মৃতিচারণায় বস্তুনিষ্ঠভাবে রূপায়িত হয়েছে। এ সংখ্যার সেরা লেখকদের মধ্যে আছেন : বিপ্রদাস বড়ুয়া, অনুপম সেন, মাহবুবুল হক, অনুপম হায়াৎ, বাবু রহমান, কাজী রোজী, আমিনুল ইসলাম, জাকির তালুকদার, আনিসুল হক, ফরিদ আহমদ দুলাল, পিয়াস মজিদ, বিমল গুহ, মনি হায়দার, মিনার মনসুর, মাহমুদ কামাল, রফিকুর রশীদ, সেলিনা হোসেন, হরিশংকর জলদাস, ঝর্না রহমান, মজিদ মাহমুদ, মোকারম হোসেন, মতিন রায়হান, শিহাব শাহরিয়ার প্রমুখ।
বৈঠার চতুর্থ সংখ্যার বিষয়―সমুদ্র। উদারতার কথা ভাবলে আমাদের আকাশের কথা মনে পড়ে, বিশালতার কথা জাগলে স্মরণ হয় সাগরের কথা। অনন্ত আকাশ এবং পাহাড়ের মতো সাগর-মহাসাগরও মানুষের দর্শনপ্রিয়। সমুদ্র ভ্রমণপিপাসু মানুষকে সর্বদা হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই ডাক অন্তরে অনুভব করেছেন সম্পাদক শিহাব। তিনি ডাক দিয়েছেন সমুদ্র-সন্ধানী শব্দসাধকদের। সেই আহ্বানের সারস্বত ফসল বৈঠার সমুদ্র সংখ্যা। সূচিপত্রে এর পর্ব সতেরোটি, পৃষ্ঠা সংখ্যা চারশ ছাপ্পান্ন। গ্রাম সংখ্যার (২০১৩) এক দশকেরও বেশি সময় পর বেরোয় সমুদ্র সংখ্যা (২০২৪)। এতে লেখক আছেন সত্তর জন। এর পর্ব-বৈচিত্র্য নিম্নরূপ : ১) সমুদ্র ও সৈকত ২) সমুদ্র কী ও কেন ৩) আমাদের উপসাগর ৪) বঙ্গোপসাগর : আমাদের দ্বীপসমূহ ৫) বঙ্গোপসাগর : কূলে সন্দ্বীপ ও নিঝুম দ্বীপ ৬) সমুদ্রপাড়ের জীবন ৭) সমুদ্র দেখার অনুভূতি ৮) সমুদ্র ও বিবিধ ভাবনা ৯) সমুদ্র-নাবিক ও জলের জীবন ১০) সমুদ্রপাঠ ও বাংলা সাহিত্য ১১) বাংলা কবিতায় সমুদ্র ১২) বাংলা গল্পে সমুদ্র ১৩) বাংলা নাটক ও গানে সমুদ্র ১৪) সমুদ্র ও ঝড় ১৫) সমুদ্র ও মৃত্যু ১৬) সমুদ্র নিয়ে সাক্ষাৎকার ১৭) বঙ্গোপসাগর : সীমানা ও সম্পদ।
বৈঠার সমুদ্র সংখ্যাটি সম্পাদকের অনেক শ্রম, সাধনা ও প্রতীক্ষার ফসল। এ সংখ্যাটি রূপায়ণ ও প্রকাশের জন্য তাঁকে দশ বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। কেবল অপেক্ষা তো নয়; কর্মপ্রচেষ্টার পাশাপাশি, দুশ্চিন্তা এবং মানসিক যন্ত্রণাও কম ছিল না! সৃষ্টিশীল মানুষের সৃজন-বেদনাও এক ধরনের গর্ভধারণ ও মাতৃত্বের অভিলাষ। মাতৃত্বের সৃজন-বেদনা থাকে দশ মাসের। কিন্তু সমুদ্র সংখ্যার সৃজন-বেদনা সম্পাদককে সইতে হয়েছে দশ বছর! কল্পনা করা যায় ? তবে সম্পাদকের প্রাণশক্তি, একনিষ্ঠতা এবং ‘যুদ্ধং দেহি’ নিরাপস-চেতনা এমনই প্রবল-যে তিনি রণে ক্ষান্ত দেননি, রণক্লান্তও হননি! নানা বাধা-বিপত্তি, সমস্যা-সংকট অতিক্রমের সাহস নিয়ে ছোট কাগজের সম্পাদককে উজান তরীর মাঝি হতে হয়। শিহাব শাহরিয়ার সম্পাদকীয়র শেষ অনুচ্ছেদে সেই দুঃসময়ের কথা জানিয়েছেন : ‘আগের সংখ্যাগুলোতে অনেক সিনিয়র লেখকরা লিখেছেন, এখানে দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয়, এখনকার লেখকরা অনেক ব্যস্ত কিংবা ব্যস্ততার অভিনয় করেন অথবা লিখতে চান না, যে কারণে এই ধরনের ছোটকাগজ করা দুরূহ হয়ে উঠেছে বৈকি ? আগে শামসুর রাহমান বলেন, সৈয়দ শামসুল হকই বলেন, তাঁরা লেখা দিতেন সময়মতই, কিন্তু তার অভাব অনুভব করছি।’
সম্পাদকের এই সীমাহীন দুঃখের ভার অদূর ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে কি না সন্দেহ! ‘শেষ পারানির কড়ি’র মতো স্মরণে রাখতে হবে রবীন্দ্রবাণীই : ‘অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার।’
খ্যাতিমান কয়েকজন লেখকের প্রয়াণ এবং নবীন প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের অনীহার ফলে মানসম্মত রচনার সংকটের কথা ভেবে সম্পাদক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেও বৈঠার সমুদ্র সংখ্যার সাহিত্যমান অক্ষুণ্নই থেকেছে। এ সংখ্যায় স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের মধ্যে আছেন : আবুল মোমেন, স্বকৃত নোমান, হরিশংকর জলদাস, আসাদ মান্নান, হাফিজ রশিদ খান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সরকার মাসুদ, মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, হামিদ কায়সার, আনোয়ার কামাল, ওবায়েদ আকাশ, অনিকেত শামীম, চন্দনকৃষ্ণ পাল, কাজী রোজী, মাসুদুল হক, পাপড়ি রহমান, পুলিন রায়, পিয়াস মজিদ, সরকার আবদুল মান্নান, মোহিত কামাল, ফরিদ আহমদ দুলাল, ঝর্না রহমান, মনি হায়দার, মনিকা চক্রবর্তী, অলোক বসু, ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম, আইনুন নিশাত, আনু মুহাম্মদ, ড. নোমান সিদ্দিকী, মেহেদী ইকবাল প্রমুখ।
সম্পাদকের বিষয়-নির্বাচনের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়! সব বিষয়ই বাংলার প্রকৃতি ও বাঙালির জীবন-ঘনিষ্ঠ। বাঙালির সৌন্দর্যচেতনা ও জীবন-সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে-থাকা বিষয়গুলো তিনি নির্বাচন করেছেন। লিটলম্যাগের বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখা সংগ্রহ করা একটা বড় সমস্যা। এতো সাধারণ সংখ্যা নয় যে, কিছু গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ সংগ্রহ করে তার মুদ্রিত রূপে প্রকাশ করলেই হলো। বিষয়ভিত্তিক সংখ্যার জন্য সুনির্দিষ্ট লেখক নির্বাচনই শেষ কথা নয়। লেখা প্রাপ্তির জন্য সাক্ষাতে বা টেলিফোনে বার বার অনুরোধ করা, স্মরণ করানো, তাগিদ দেওয়া, সময় বেঁধে দেওয়া, স্বীকৃতি আদায় করা, অবশেষে সশরীরে ধর্না দেওয়া! এতসবের পরও কেউ কথা রাখেন, কেউ রাখেন না! তবে আমার সৌভাগ্য এই যে, কেবল প্রথম সংখ্যা ছাড়া আর সব সংখ্যাতে সম্পাদক আমার লেখা ছেপেছেন।
বৈঠার সম্পাদক কবি শিহাব শাহরিয়ারের কথা ভাবলেই মনে পড়ে আরেকজন খ্যাতিমান সম্পাদক মীজানুর রহমানের কথা। তিনি বেশ কিছু বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা করেছেন প্রকাশ করেছেন। তাঁর পত্রিকার শিরোনামটিও স্বনামধন্য―মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। বিষয়ও কেবল অনন্য নয়, অসাধারণ―পক্ষী, নদী, বৃক্ষ ও পরিবেশ, গণিত, শামসুর রাহমান ইত্যাদি। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি ছিল দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনায় সমৃদ্ধ। একালের বৈঠা-সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার যেন মীজানুর রহমানের উত্তরসাধক। বৈঠা আকৃতিতে ততটা ঢাউস প্রকৃতির না-হলেও সেই ঐতিহ্যের ধারক এবং অনুগামী। এই পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার মতো তথ্যের আকর হিসেবে লেখক-গবেষকদের সংগ্রহে রাখার উপযুক্ত।
সম্প্রতি, জানুয়ারি ২০২৫-এ প্রকাশিত হয়েছে বৈঠার পাহাড় সংখ্যা। এই সংখ্যা অন্য সংখ্যাগুলোর তুলনায় সমৃদ্ধ এবং আয়তনে বিস্তৃত। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা সাত শতাধিক। ২০২৪-এর এপ্রিলে প্রকাশিত সমুদ্র-সংখ্যার পর এক বছরের কম সময়ের মধ্যে এই বৃহৎ কলেবর সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদক এ সম্পর্কে লিখেছেন : ‘দীর্ঘ এক বছর ধরে লেখা সংগ্রহ করে, সম্পাদনা করে নির্দিষ্ট সময়ে করাটা কষ্টের ছিল, কিন্তু প্রকাশের পর আনন্দটাই বেশি। টার্গেট ছিল এক শ জন লেখকের লেখা নেয়া, অবশেষে পঁচাশি জন লিখেছেন।’ তবে শেষ পর্যন্ত লেখক-সংখ্যা পঁচাশিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা উত্তীর্ণ হয়েছে একশ একে। পাহাড় নিয়ে এতজন লেখকের লেখা একক প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করা সহজ কথা নয়। লেখার বিষয় একটি কিন্তু তাতে আছে বিচিত্রবিধ ভিন্নমাত্রিকতা। তাই সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার সংগৃহীত লেখাগুলো উনিশটি পর্বে বিভাজন করেছেন। তাতে সম্পাদকের গুণপনা বিধৃত। এই পর্ব-বিভাগ নিম্নরূপ : ০১) পাহাড় ০২) পাহাড় কী ও কেন ০৩) পাহাড় : রহস্য ও মিথ ০৪) পাহাড় : বিবিধ ভাবনা ০৫) পাহাড়: সংখ্যা ও সৌন্দর্য ০৬) পাহাড়ি জনপদ : জনগোষ্ঠীর জীবন ০৭) পাহাড় দেখার অনুভূতি ০৮) সবুজ পাহাড় কেন টানে ০৯) পাহাড় : সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা ১০) দূর দেশের পাহাড় ১১) পাহাড় : বাংলা কবিতায় ১২) বাংলা গল্পে পাহাড় ১৩) পাহাড় : বাংলা গানে ১৪) পাহাড়িদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি ১৫) পাহাড় : ভূমিধ্বস ১৬) পাহাড় : অর্থনীতি ১৭) পাহাড় : আমাকে নাড়ায় ১৮) সাক্ষাৎকার : তিন এভারেস্ট বিজয়ী ১৯) পাহাড় : তারুণ্যের অনুভূতি। গল্পপর্বে সংকলিত হয়েছে সর্বোচ্চ সংখ্যক পনেরোটি গল্প। এই পর্ববিন্যাস থেকে উপলব্ধি হয় বৈঠার পাহাড় সংখ্যার বহুকৌণিক ব্যাপকতা।
বৈঠার পাহাড় সংখ্যায় দেশি-বিদেশি লেখক তালিকায় আছেন : আসাদুল্লাহ্, কমল কুজুর, বর্ণালী সান্যাল, শ্যামলী সরকার, আদিত্য নজরুল, আবেদীন মোহাম্মদ জয়নুল, আসিফ আজিজ, ওমর কায়সার, জয়দেব কর, রোকসানা ইয়াসমিন মনি, সৈয়দা নাজনীন আখতার, আলমগীর খোরশেদ, জাকিয়া শিমু, তিথি বালা, পাপড়ি রহমান, শেলী সেনগুপ্তা, জিয়াউল হক, জমশেদ উদ্দীন ডা. এম এ সামাদ, রজব বকশী, রাজীব কুমার সাহা, শফি কামাল বাদল, সালাহ উদ্দিন আহমেদ মিন্টু, চিংলামং চৌধুরী, জ্যোতি পোদ্দার, শাহেদ কায়েস, শিহাব শাহরিয়ার, সুমন বনিক, আবু মকসুদ, কাজী আনারকলি, কামরুজ্জামান ভূঁইয়া, গোলাম কিবরিয়া পিনু, গোলাম শফিক, চন্দনকৃষ্ণ পাল, ডা. হারুন-অর-রশিদ, নন্দিনী লুইজা, মোস্তাফিজুল হক, রাজিয়া রহমান, শেলী সেলিনা, সুমন কায়সার, অলোক বসু, জরিনা আখতার, ফরিদা ইয়াসমিন সুমি, ফারুক তাহের, মতিন রায়হান, মাহবুবা ফারুক, সালমা সুলতানা, সৌম্য সালেক, হরিশংকর জলদাস, কাকলি পাল, ভার্গব বন্দ্যোপাধ্যায়, মালেক ইমতিয়াজ, রেহানা মাহমুদ, সরদার মোজাম্মেল, হামিদ কায়সার, কামাল উদ্দিন, জান্নাতুল নাঈম, তামান্না জেসমিন, দিলু নাসের, ফারহানা ইলিয়াস তুলি, রওনক আফরোজ, রওশন হাসান, রোকসানা রহমান, শাহনাজ পারভীন মিতা, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সেলিনা শিউলী, সুলতানা শিরীন সাজি, হামিদা বানু, ইউসুফ মুহম্মদ, মানবর্দ্ধন পাল, চন্দন চৌধুরী, জেবুন নেসা রীনা, তালুকদার লাভলী, নুরুন্নাহার মুন্নী, ফারজানা হক, মনি হায়দার, মনির জামান, মহিবুল আলম, মাসুদুল হক, মেহনাজ মুস্তারিন, মোজাম্মেল হক নিয়োগী, মোস্তফা মঈন, মোহিত কামাল, রিমি রুম্মান, স্বপন বিশ্বাস, আহমেদ বাবুল, চৈতী চক্রবর্তী, তপন বাগচী, পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য, মিষ্টু সরকার, হাফিজ রশিদ খান, বাসু দেব নাথ, বাসুদেব সূত্রধর, আনজীর লিটন, ওবায়েদ আকাশ, জাহিদ রহমান, পুলিন রায়, ফরিদুর রহমান, শফিক হাসান, এম এ মুহিত, শফিক হাসান, বাবর আলী, মো. হামিদ উদ্দিন, নিশাত মজুমদার, নাজনীন আখতার, মাকসুদা আক্তার, আশিকুর রহমান, বুশরা আক্তার।
পাহাড় পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। প্রকৃতির অজস্র রহস্য ও বিপুল সম্পদ লুকিয়ে আছে মৌনী পাহাড়ের শরীরে ও গর্ভে। ঘন-সবুজ অরণ্য ও শিলাময় লালাভ মাটি দিয়ে গড়া পাহাড়ের অপরূপ দেহ। এর বঙ্কিমতার ভাঁজে-ভাঁজে স্বচ্ছ জলের শীতল ঝরনা, বর্ষাকালে সাদা-কালো মেঘের আবরণ, শীতে ঘন কুয়াশার চাদর-জড়ানো। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পাহাড়ের হরিৎ শরীর রুক্ষ হয়ে যায়। পাহাড়ের সবুজ বনবীথি পাতা ঝরিয়ে কংকালসার দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টি ও বর্ষার প্রার্থনায় যেন উন্মুখ। ঋতুচক্রের আবর্তনে পাহাড় রূপ বদলায়। তাতে পাহাড় হয়ে ওঠে আরও রহস্যময়। পাহাড়ের এই বিচিত্র স্বরূপ লেখকরা আত্মবোধের আলোকে তুলে ধরেছেন নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দর্শন। তাই পাহাড় দেখার ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং তার নির্যাসের শৈল্পিক বিবরণই প্রায় সকল রচনার মূল বিষয়। গল্প প্রবন্ধ আত্মকথা―সকল ধরনের লেখাতেই অমোচনীয় স্মৃতির ঝাঁপি পাখা মেলেছে। অনেক স্মৃতিকথার বিবরণভঙ্গি এমনই মনোগ্রাহী এবং শৈল্পিক যে, মনের চোখে ও কল্পনায় সে-ভ্রমণের অংশীজন হওয়া যায়। যেমন কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাস লিখেছেন : ‘সমুদ্রের পরেই যে পাহাড় আমার প্রিয় জায়গা। পাহাড়ে গেলে কথা না-বলার মন্ত্র শেখা যায়। মৌন থাকার শিক্ষা তো পাহাড়ই দেয় আমাদের! এই কোলাহলময়, মুখর, কথাসর্বস্ব জীবনে মৌনতার যে কত প্রয়োজন, পাহাড়ে গেলে বোঝা যায় তা। তাই পাহাড় আমায় টানে।’ (ঝাঁপ দিলে পাখি হব, পৃ. ৩৭১)।
প্রাবন্ধিক-গবেষক আসাদুল্লাহ তাঁর রচনায় দেশ-বিদেশের পাহাড়ের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি তিনি পাহাড়ের উৎপত্তি, বিজ্ঞান ও পবিত্র কোরআন শরিফে পাহাড় সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি এবং বিবরণ দিয়ে লিখেছেন : ‘পাহাড়ের যে গুহায় মুহাম্মদ (সা.) ধ্যান সাধনা করতেন তার নাম হেরা। তিনি ফেরেস্তা জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে প্রথম বাণী হেরা গুহাতেই পেয়েছিলেন। যে ওহী বা বাণী হেদায়েত বা নূরস্বরূপ। তাই জাবাল পাহাড় পরিচিতি পায় ‘জাবালে নূর’ বা আলোর পাহাড় নামে।’ (পাহাড়গুলো শুধু পাহাড় নয়, পৃ.৩৬)।
শিহাব শাহরিয়ার মনোলোকে কবি হলেও মননশীল রচনায় তিনি গবেষক। গবেষক হিসেবে তাঁর চর্চিত বিষয় বাংলাদেশের আদিবাসী ও সারা দেশে, বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। হয়তো ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কণ্ঠলগ্ন শেরপুর জেলার টিলাসমৃদ্ধ ও আদিবাসী-অধুষিত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে তাঁর এই নিষ্ঠা এবং মনোযোগ। তাই তিনি তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ডালু, মাহাতো, বম, ম্রো, গারো―এই পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাপন ও সংস্কৃতির বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরেছেন। বাড়ির পাশের ‘আরশি নগর’-এর খোঁজ আমরা অনেকেই রাখি না! কিন্তু শিহাব শাহরিয়ার হয়তো ‘জন্মের দক্ষিণা’ হিসেবে জন্মজেলা ও আশপাশের আদিবাসী- সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ।
বাংলাদেশ মূলত নদীমাতৃক। খালবিল-ঝিলের দেশ, হাওর-বাওড়ের দেশ, ষড়ঋতুর দেশ―অসমতল পাহাড়ি দেশ নয়, লালমাটি কাঁকড়ের দেশ নয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর এবং দক্ষিণাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ছাড়া দেশের আর কোথাও তেমন পাহাড় নেই। বাকি সব সমতল বা জলাভূমি। সিলেট ও মৌলভীবাজারে যা আছে তা ভূতত্ত্বের সংজ্ঞার্থে ঠিক পাহাড় নয়, টিলামাত্র―বলা যায়, টিলাগড় বা টিলাপুঞ্জ। তবু যা আছে তা-ও কম নয়! বাংলাদেশের পাহাড়ের এই সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিচয়, নাম এবং জেলা-উপজেলাভিত্তিক পরিচয় তুলে ধরেছেন লেখক জিয়াউল হক। তিনি গবেষকের দৃষ্টিতে পাহাড়কে বিভাগ এবং অঞ্চল অনুসারে বিভাজন করেছেন। এ লেখা যেন সালতামামির মতো বাংলাদেশি পাহাড়ের সার্বিক পরিচয়। তথ্যময় এ লেখা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে সর্বমোট পাহাড়ের সংখ্যা ২৮২টি। জিয়াউল হকের এই লেখাটির অনন্যতা এখানে যে, এটি আদমশুমারির মতো পাহাড়শুমারি।
পাহাড় চিরকাল সমতলবাসী মানুষের মনে অদম্য আকর্ষণের স্থল। পাহাড়ি জনপদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি পাহাড়ি মানুষের বিচিত্র সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ আমাদের হাতছানি দেয়। পাহাড়ি মানুষের সংগ্রামী জীবনযাপন, বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস, অসাধারণ পোশাক-আশাক ও নিয়ত বেঁচে-থাকার সংগ্রাম সমতলের মানুষকে আকর্ষণ করে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে-থাকা মৌনী পাহাড়ের সবুজ বনভূমি মানুষের কেবল আনন্দের উপাদান নয়; আমাদের অর্থনীতিতেও পাহাড়ের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে পাহাড়ের সৃষ্টিরহস্যের বৈজ্ঞানিক-ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, পাহাড় নিয়ে পৌরাণিক ধ্যানধারণা, পাহাড়ি জনজীবন ও সংস্কৃতি, পাহাড়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং স্মৃতিময় শৈল্পিক রচনায় ভরপুর বৈঠার এই পাহাড় সংখ্যা। তবে ঊনতা কি নেই কোথাও ?
ঊনতা বা অপূর্ণতা সবকিছুতেই থাকে। শিল্প-সাহিত্যের সাফল্যে পূর্ণতার শীর্ষবিন্দু কখনও স্পর্শ করা যায় না! সেখানে সার্থকতার সীমা সর্বদা দিগন্তরেখার মতো অসীম এবং স্পর্শের অতীত। পূর্ণতার লক্ষ থাকে, অভীপ্সা থাকে কিন্তু তা অধরা। তাই বলা যায়, বাংলা কথাসাহিত্যে পাহাড়ের রূপায়ণ আছে, ভারতীয় পুরাণে কৈলাস-গন্ধমাদনসহ বহু পাহাড়-পর্বতের কথা আছে―সেসব নিয়ে লেখা থাকতে পারত! তাছাড়া চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁদের ঘাঁটিও ছিল পাহাড়ে। বিপ্লবীদের পাহাড়সংশ্লিষ্ট সেই ইতিহাস নিয়েও লেখা থাকতে পারত। পাহাড় এবং অন্যান্য সংখ্যায় যারা গদ্য লিখেছেন তাদের মধ্যে কবির সংখ্যাই অধিক। সকল সংখ্যায়ই চোখে পড়ার মতো একটি দুর্বলতা এই যে, বিষয়ভিত্তিক কবিতার কোনও পর্ব নেই! তবে সেসব ঊনতার কথা না-ভেবে শিহাব শাহরিয়ারের বৈঠার এই পাহাড় সংখ্যায় যা আছে তা এককথায় অসামান্য এবং অসাধারণ। সম্পাদককে প্রাণময় অভিনন্দন ও বৈঠার পাহাড় সংখ্যার শতাধিক লেখককে শতদল-শুভেচ্ছা। বৈঠার উপদেষ্টা সম্পাদক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ‘দূরাগত বংশীধ্বনির মতো’ বৈঠার সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি তাঁকে শ্রদ্ধাভাজন করেছে। জয়তু বৈঠা ও বৈঠাধারী শিহাব শাহরিয়ার।
লেখক : প্রাবন্ধিক