চার দশক পেরিয়ে লিরিক : ছোটকাগজ হয়ে ওঠা প্রসঙ্গ : পুলক পাল

ক্রোড়পত্র : লিটলম্যাগ চর্চা
ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন কাকে বলে এ রকম একটি অর্বাচীন প্রশ্নের আলোচনার মাধ্যমে সূত্রপাত ঘটানো যেতে পারে এ প্রবন্ধের। যদিও ছোটকাগজের সংজ্ঞার্থ নির্ধারণের প্রশ্ন এলেই আমার অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা বাহুল্যের রসিকতাটার কথা মনে পড়ে। অর্থশাস্ত্র আজ একটি একাডেমিক ডিসিপ্লিন এবং ছোটকাগজ তা নয়। নয় বলেই তার একক, অর্থবোধক এবং পরম্পরাগত কোনও সংজ্ঞা নাই যা তার সম্পূর্ণ চেতনা বা ভাবনাকে বাক্যের সংহতিতে ধারণ করতে পারে। তাই ছোটকাগজ কাকে বলে এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া প্রায় দুরূহ। প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার একটি আপাত সরল পদ্ধতি হতে পারে ছোটকাগজ কারা বের করেন এবং কেন করেন তার তত্ত্বতালাশের মাধ্যমে। ছোটকাগজের সংজ্ঞায়ন সংক্রান্ত অনেক ছোটকাগজ-সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনের মতামত এখানে উদ্ধৃত করা বাহুল্য মাত্র হবে। এই মতের বাহুল্যও ছোটকাগজের চরিত্র লক্ষণের পরিচয়বাহী। লিটলম্যাগ গবেষক সন্দীপ দত্তের এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা একমত হওয়া যায় :
লিটল ম্যাগাজিন তার নিরন্তর কাজের মধ্য দিয়ে পাঠককে করেছে দীক্ষিত, মননে ঋদ্ধ। পরিশ্রম, নিষ্ঠা, অনুসন্ধিৎসা, যথার্থ সম্পাদকীয়তা, সাহিত্য ভাবনার সঠিক উপস্থাপনাই লিটল ম্যাগাজিনের পথ চলাকে বিস্তৃত করেছে; গভীর অনুসন্ধান, মননশীল চর্চায় বিশেষ ভাবনাকে প্রতিনিয়ত তুলে ধরার কাজ করে চলেছে। লোকসংস্কৃতি চর্চা, কুসংস্কার বিরোধিতা, মানবিক মূল্যায়ন, সমাজ সমীক্ষা, অনুবাদসহ, সাহিত্যসৃজনের নানা কাজে লিটল ম্যাগাজিনের যুদ্ধ থেমে নেই। সমকালের সম-সময়ের আবর্তে দাঁড়িয়ে নিরন্তর তার কাজ করে চলা সৃজনে, অন্বেষণে, প্রতিবাদে, চেতনা প্রসারে, পাঠক দীক্ষায় ও বীক্ষায়।
[জনপদপ্রয়াস, জানুয়ারি, ২০০০]ছোটকাগজ লিরিক-এর প্রারম্ভিক সংখ্যাটি ছিল ক্ষীণকায়। এক ফর্মার একটি কবিতার সংকলন। ‘কবি সম্প্রদায়-এর কবিতা কাগজ’টি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সামরিক শাসক এরশাদের শাসন শুরুর কালে। যদিও পত্রিকার গায়ে কোথাও প্রকাশের সন-তারিখ উল্লেখ নাই। মোট নয়জন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে যাদের মধ্যে ছয়জন কবি এই একুশ শতকের তৃতীয় দশকেও বাংলা ভাষায় কবিতা ও লেখালেখির নানামাত্রিক তৎপরতায় সক্রিয় আছেন। ছোটকাগজ সময়ের সৃজনমনস্কদের চিহ্নিত ও তাঁদের ভিন্নতর প্রকাশ-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি যেন লিরিক-এর প্রকাশভাবনা ও তার পরিপ্রেক্ষিত এবং কবিতার প্রতি ছোটকাগজ লিরিক-এর আদ্যোপান্ত পক্ষপাত কিছুটা আঁচ করা যায় :
সম্প্রতি চট্টগ্রামে কাব্যাঙ্গনটি তরুণ কবি-কর্মীদের দৃপ্ত পদচারণায় মুখর। এই আটপৌরে লিরিক প্রকাশনা মূলত এই মুখরতাকে আরো একটু উস্কে দেয়ার লক্ষ্যেই সন্নিবেশিত। লিরিক অনিয়মিতভাবেই কবিতার সুধারাটির সাথে সংশ্লিষ্টদের অনুভূতিময় শব্দসম্ভারে তৃপ্ত হয়ে বেরুবে। লিরিক প্রথম পথ-পরিক্রমায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছে।
যে নয় জন কবি এই উদ্বোধনী সংখ্যার ক্ষীণকায়াকে অবয়বদান করেছেন তারা হলেন সায়ীদুর রহমান, সৈয়দ রফিকুল আলম, খুরশীদ আনোয়ার, বিপ্লব বিজয় বিশ্বাস, আবু মুসা চৌধুরী, হাফিজ রশীদ খান, আহমেদ রায়হান, ইমদাদুল হক এবং এজাজ ইউসুফী যিনি এই কাগজের স্বয়ং সম্পাদক। আশির দশকের প্রারম্ভে তরুণ কবিদের কবিতার সুর ও স্বরের ধারণা পেতে এই সংকলনের কবিতাটি পাঠক সমীপে উৎকলন করছি :
চোখ দেখে বলে দেয়া যায়
এই দু’চোখ কবির, এই চোখ প্রেমিকের।
কোন নারী লুকিয়ে রাখেন পরকীয়া প্রেম
তাদের কাজল চোখে
এই সব চোখ দেখে, বলে দেয়া যায়।
… … … …
রাস্তার হুল্লোড় বুঝে
চেনা যায় মিছিল দৃষ্টি রেখেছে-তার চোখে
তবে অই স্তব্ধ,
ভয়ঙ্কর, নিরবতা মাখা
চোখ ফেলে বলি,
কার? অই চোখ।
[অই নিরবতা কার, আহমেদ রায়হান]এই কবিতা বিস্তারের উপান্তে তবে কি সামরিক শাসনের প্রচ্ছন্ন ভয় ছড়িয়ে পড়েছে কবির নিজস্ব উপলব্ধিতে!
এই সংখ্যার মুদ্রণ তথ্যে আছেন কেবলই সম্পাদক ও প্রচ্ছদ শিল্পী শহীদুর রহমান। আর আছেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক সায়ীদুর রহমান। মূল্য মাত্র দুই টাকা।
ছোটকাগজ নিসর্গ সম্পাদক সরকার আশরাফের প্রশ্নের জবাবে লিরিক সম্পাদকের উত্তরকালের জবাবটি পাঠকদের জন্য এখানে উল্লেখ করে রাখছি পত্রিকাটির দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এবং ছোটকাগজটির হয়ে ওঠার পরিসরটি তাতে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে উঠবে। দুই ছোটকাগজ সম্পাদকের সওয়াল জবাবের এই উদ্ধৃতিটি বেশ দীর্ঘ, কিন্তু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রথম কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পরেই যে তিনি এরকম উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছেন অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে তারও মন ও মনন পরিণত হয়েছে এখানে রয়েছে তার সরল স্বীকারোক্তি :
কী কী বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন অথবা লিটল ম্যাগাজিন নয়? লিটল ম্যাগাজিন বলতে আপনি কী বোঝেন?
তার উত্তরে বলেছিলাম, প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা দার্শনিক প্রত্যয়কে আঘাত করার মধ্যেই ছোটকাগজের বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে। কারণ, আমরা জানি এক সময়কার বৈপ্লবিক চেতনা ও তাত্ত্বিকতা জাগতিক ও সামাজিক অগ্রগতির নিয়মেই ৎধফরপধষরংস-এ পরিণত হয়। তা সবকিছুকে নিজস্ব ছাঁচে ফেলে বিচার করতে চায়। তাবৎ সমাজ-সংস্কৃতির ত্রাণকর্তা সেজে বসে সে। লিটল ম্যাগাজিন সত্যিকার অর্থে এ অর্বাচীনতার তফাৎ দেখিয়ে দেয় আমাদের। দ্ব্যর্থকভাবেই, জ্ঞানতত্ত্বের এ পর্যায়ে লিটল ম্যাগাজিনগুলো সমাজের ও চিন্তার রুদ্ধ-স্রোতকে ভেঙে দেয় অনায়াসেই। মূলত বেঁচে থাকার সক্রিয় চেতনাই একটি লিটলম্যাগকে দেয় হয়ে ওঠার মেজাজ। সাম্প্রতিককে উদ্ধার করার এ প্রবণতা সহজসাধ্য নয়। তাই অনেক সময় দেখা যায়, চিন্তা ও দার্শনিকতার ঐ স্তরে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে লিটল ম্যাগাজিনগুলো হয়ে ওঠে পরস্পরবিরোধী এবং অসংলগ্ন। তাই নানা জন্মগত টানাপোড়েন একটি লিটল ম্যাগাজিনের চেহারায় ফুটে উঠবেইÑএটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই খুব একটা। আসল কথা হচ্ছে, একটি লিটল মাগাাজিন শুধুমাত্র সাম্প্রতিককালের চেহারাকেই ধারণ করে না উপরন্তু ভবিষ্যতের সীমানাও চিহ্নিত করে। একটি সৎ ছোটকাগজ আমাদের বলে দেয়; বিপ্লবের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। আসলে রাষ্ট্র ও সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজের মধ্যেই বিরোধিতার বীজ সুপ্ত থাকে। ছোটকাগজগুলো তার অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করে। প্রতিষ্ঠান ও প্রথাবিরুদ্ধতার ক্ষেত্র হিসেবে নতুন ভাবুকদের জন্য একটি মুক্তির মোর্চা গড়ে তোলে। সুতরাং কখনো নিয়ন্ত্রিত হবে না এরকম বোধ ও ভাবনাই ছোটকাগজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
লিটল ম্যাগাজিন এবং সাহিত্য পত্রিকা এই দুয়ের মাঝে ফাঁকটা কোথায়? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় : লিটল ম্যাগাজিনগুলো পুরোনো নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব বা আধিপত্যের (ঐবমবসড়হু) বিরোধিতা করে। বুদ্ধিভিত্তিক ও বিপরীতধর্মী ক্রমঃমনন কর্ষণের ক্ষেত্র এটি। সমস্ত কিছুর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানায় সে। প্রযুক্তি; আমাদের চেতনা এবং ক্ষমতাকে আলাদা করে দিয়েছে। আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তত্ত্বের বিশ্বজনীনতা। লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে আত্মপুনঃনিরীক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তা আমাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে সচল রাখে।
গোষ্ঠীবদ্ধতা কিংবা ইজম―কোনটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য জরুরি তা ঠিক করতে হবে। যে ভাঙতে চায়, তাকে কিছুটা বিশৃঙ্খল, কিছুটা স্বেচ্ছাচারী হতেই হয়। প্রতিষ্ঠিত ঐবমবসড়হু-র বিরোধিতা করতে গিয়ে হয়তো-বা কখনো আপন নিবাসটি হারিয়েও ফেলে। এর সুরাহা হয় না কখনও। আবার সৃষ্টিশীল মানুষের আত্মানুসন্ধান ব্যক্তিকেন্দ্রিক যেমন হতে পারে তেমনি সমষ্টিকেন্দ্রিকও হতে পারে। অনুন্নত বিশ্বের লিটলম্যাগ কর্মীরা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারপরও কিন্তু সে হাতিয়ারের মাধ্যমে উদ্দেশ্য পূরণের চেয়ে মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা চেতনাগত প্রগতির মাধ্যমেই ইচ্ছাপূরণের পক্ষপাতি। তাদের কাজ হচ্ছে, সাহিত্যিক শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এখানেই আসে অহঃর-ঊংঃধনষরংযসবহঃ-র প্রশ্ন। প্রতিষ্ঠিত সামাজিকতা ও চেতনাশক্তির ব্যূহ ভাঙার তাগিদ থেকেই কিছু স্বাধীন কল্পনাশক্তির অধিকারী তরুণ শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করেই একটি লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতা ও পরাজয় লিটল ম্যাগাজিনের নিয়তি হওয়া সত্ত্বেও আলোকপ্রাপ্তির আশায় এক. কনসেপ্টের দিক থেকে, দুই. এস্টাবলিশমেন্ট ভাঙার প্রত্যয় থেকে তাকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হয়। যুক্তির মাধ্যমে মুক্তি শুধু নয়, অনিবার্যভাবে এসে পড়া আঘাত সামলাতে পারস্পরিক সমঝোতাও জরুরি। তাই, লিটল ম্যাগাজিন একটি মিশন, একটি আন্দোলন।
মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা তার নিরন্তর অন্বেষণের সঙ্গে যুক্ত। শিল্প যখন বিমূর্ত তখন সেটি ব্যক্তি এককের। যখন জীবনমুখী তখন সেটি ভবিষ্যৎ মানুষের স্বপ্নের তীব্র আর্তি। সে সমষ্টির অজস্র বিন্যাসও। ক্ষমতার বিভ্রম থেকে মানুষকে ডায়ালেকটিক বা আঞ্চলিক উপভাষার দখলে আনতে তাকে কিছুটা প্রভুগিরি করতেই হয়। উদ্ধারের যৌক্তিকতা বোঝাতে কিংবা নয়া-তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বোঝাতে তাকে মিশনারিদের মতো আচরণও করতে হয়। তবে, এটি মোটা অর্থে আন্দোলন (অবশ্যই ভাত-কাপড়ের নয়) হলেও আসলে স্বাধীন আলোচনার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে জাহাজের চলমানতার সঙ্গে তুলনা করলে তাতে বাঁধা থাকে দার্শনিকতার নোঙর। এটি কাজ চালাবার মতো নয়, প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবধর্মী এবং প্রায়োগিক। স্থানিক শুধুমাত্র নয়, বৈশ্বিক। মস্তিষ্কের সাম্রাজ্যবাদ ও মাস্তানি-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লিটল ম্যাগাজিনগুলো ফোঁপরা আন্দোলন মাত্র নয়―তর্কাতীত গন্তব্য। তাই প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিন প্রলোভন-ঊর্ধ্ব, প্রখর, নির্দ্বিধ-চিত্ত এবং সামগ্রিক পরিবর্তনের পথে আত্মহননের সমতুল্য। সৎ ও সৃজনীমনস্কতার মুখাপেক্ষী। ছোটকাগজ আসলে আনুগত্যহীনতার মিশন।
সব ছোটকাগজই লিটল ম্যাগাজিন নয়, কিছু কিছু লিটল ম্যাগাজিন। এ সব প্রশ্নেরও সমাধান করতে হয়। বাংলাদেশে এমন দু’একজন আছেন যারা চরিত্রে এক রকম, আচরণে প্রতিক্রিয়াশীল। এরা প্রতিষ্ঠানের তৈল-মর্দনকারী মূলত। মানবকুলের এসব প্রতিনিধিরা ছদ্মবেশী সেজে গরম গরম বুলি কপচে লিটলম্যাগের ধুয়ো দিচ্ছে। অন্যদিকে, মার্কসবাদকে অর্ধহজম করে, পুঁজিবাদের সঙ্গে অ-বনিবনাকে পুঁজি করে, আত্মবিকৃতিকামী অবুঝ পাণ্ডিত্যের অহমকে সঙ্গী করে, অল্পবিস্তর লিটলম্যাগের শিককাবাব বানাচ্ছে। সামাজিক প্রেক্ষিতের তাবৎ সুখ-সুবিধাকে বগলদাবা করে এরা আসলে মিডিয়ার ঘাড়ে সওয়ার হতে চায়। এ ধরনের এক সময়কার কিছু লিটল ম্যাগাজিন কর্মী (লিটলম্যাগের ক্ষেত্রে বিপ্লবের দাবিদার) সম্প্রতি ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী বহুজাতিক ডানার তলে সমবেত হয়েছেন। তারা এখন ‘কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি’র সোল এজেন্সি নিয়ে বসেছেন। মূলত লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষমতা এভাবে বিফলে যায়। দু’একজন শিল্পদ্রোহী যুবা এতে সেঁধিয়ে থাকেন। গোঁ ধরে বসে থাকেন। কিন্তু এদের শনাক্ত করবে কারা? এ সম্পর্কে হয়তো কিছু বলা যায়। কিন্তু সেই অধিকার আমাকেই-বা দিয়েছে কে? বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নয়া সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণের অবস্থা বিরাজ করছে। এদের ধাক্কায় কুপোকাৎ হচ্ছে নিভৃতচারীরা। কারণ, প্রতিআক্রমণে যাওয়ার মতো অশ্লীল মানসিকতাও এদের নেই। তাই সমাজ ও সংস্কৃতি একটা স্থিতাবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত এদের উৎপাত চলবেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস―এসব বুদবুদ মুখথুবড়ে পড়বেই। অন্যদিকে, যথার্থ ছোটকাগজটি বেঁচে থাকবে মানুষের আশায়, দূর-স্বপ্নের প্রেরণায় এবং স্বকীয় মহিমায়।

ছোটকাগজের ব্যক্তি প্রচেষ্টার বিন্দু কীভাবে সমধর্মী ভাবনা বৃত্তের পরিধি রচনা করে তার নিদর্শন লিরিক দ্বিতীয় সংখ্যার মুদ্রণ তথ্য থেকে মেলে। বছর দুই পরের অর্থাৎ ১৯৮৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত ২য় সংখ্যায় পত্রিকার কলেবর (৩ ফর্মা, ৪৮ পৃষ্ঠা) বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরা শফিক রহমান নামের লিরিক সম্পাদকের একজন সহযোগীরও দেখা পাই। কবিতা সংকলনের তকমা ছাড়িয়ে এটি ধারণ করে কবিতা বিষয়ক আলোচনার পরিসর। বৈশ্বিক কবিতার প্রতি তরুণ কবিতা কর্মীদের আগ্রহকে প্রসারিত করতে এই সংখ্যায় অন্তর্ভুক্তি ঘটে অনুবাদ কবিতার। ছাব্বিশজন কবির একক কবিতা, দুইজন কবির গুচ্ছ কবিতা এবং দুইজন বিদেশি কবির অনুবাদ কবিতাসহ একজন তরুণ কবির প্রথম কবিতা বইয়ের অলোচনা এই সংখ্যায় গ্রন্থিত হয়েছে। প্রকাশিত কবিদের তালিকায় অনতি তরুণ সেলিনা আখতার শেলী যেমন আছেন তেমনি অছেন হায়াৎ সাইফ এবং ময়ুখ চৌধুরী। অনূদিত কবিদ্বয় হলেন প্রাচীন ল্যাতিন কবি অরিলিয়াস প্রুডেনটিয়াস ক্লিমেন্স (৩৪৮ খৃ.- ৪০৫ খৃ.) ও মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ। অনুবাদ করেছেন যথাক্রমে কবি মোস্তফা ইকবাল ও কবি খুরশীদ আনোয়ার। এই সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ক্ষত্রিয়দের সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করা হয়েছে :
লিরিক ২য় সংখ্যা পরিক্রমায় স্বাধীনতার মহান ক্ষত্রিয়দের স্মরণ করছে, তার সমস্ত গ্রন্থিত মনন ও মেধার বিনয়ী অহংকারে।
একজন তরুণ কবির প্রথম কবিতা গ্রন্থের আলোচনা কোনও প্রতিষ্ঠিত বাজারি পত্রিকা কখনও করে না সাধারণত যদি না অন্যকোনও দূরভিসন্ধি থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে কবি হাফিজ রশীদ খানের প্রথম কবিতার বই জোস্না কেমন ফুটেছে-এর আলোচনা লিরিকে কবিতা বিষয়ক গদ্যের যেমন অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে তেমনি আলোচক মহীবুল আজিজ তরুণ কবির গ্রন্থিত কবিতার দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করার পাশাপাশি একজন প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় কবির জোরালো আবির্ভাবকেও শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কাল কেমন সাক্ষী হয়ে ওঠে এটি তার ছোট্ট প্রমাণ। ছোটকাগজ সাহিত্যের কেবল প্রতিস্পর্ধী নির্মাণের পরিসর সৃষ্টি করে না, হয়ে ওঠে সমমর্মীদের সৃজনসম্ভাবনার দায় ও দরদের আশ্রয়। আলোচনার একটা উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি আরও বোধগম্য হবে :
তবে ইদানীন্তন সময়ে পত্রিকায় এবং লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর যেসব কবিতা দেখছি তা আমাকে বেশ ভাবিত করেছে। তাঁর কবিতার ক্রমোত্তরণ খুবই নিকট প্রসারী এবং অনতিপরিসর সময়েই তিনি তা অর্জন করেছেন।
জোস্না কেমন ফুটেছে―নিয়ে সবশেষে এটুকু বলা যায় যে, একদিকে ভালই হয়েছে। ওখানকার কোন কবিতা পরবর্তী কোন গ্রন্থে থাকবে না। সেকারণেই চাইব ছন্দদুর্বলতা, জড়তাবিহীন একটি সুন্দর পৃথিবী তিনি ভবিষ্যতে আমাদের উপহার দেবেন। জোস্না কেমন ফুটেছের জন্য কবিকে ধন্যবাদ জানাই। অন্তত লাভ এটুকু যে, ভবিষ্যত কাব্য-পৃথিবী নির্মাণে তার প্রস্তুতিপর্বটার সঙ্গে তো পরিচিত হওয়া গেল। বিস্তৃত বিশাল ও দৃঢ় হোক তার জোস্নালোকিত ভূলোক।
এই সংখ্যার দু’জন কবির দুটি কবিতা এখানে উদ্ধৃত করছি। ষাট ও আশির দশকে তারা লিখতে শুরু করেছিলেন। কবিতায় সময়ের প্রকাশভঙ্গির পরিবর্তনের আকাক্সক্ষাটুকু তাতে বোঝা যাবে :
ও মেয়ে যুবতী নয়, যুবতীর চেয়ে কিছু কম;
ও মেয়ে বালিকা নয়, বালিকার চেয়ে কিছু বেশি।
সে সূর্যমুখীর মতো প্রত্যাশায় কল্পনা-প্রবণ,
অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ¦ী চাঁপার কলির পাশাপাশি।
… … … …
… … … …
ও মেয়ে যাবে না আর কানামাছি আঙিনার বুকে,
সংকোচের ঘাস উঠবে খেলার উঠোনে। প্রতিবেশী
হাওয়ায় উড়বে তার কালোচুল দু’চোখের ঘুম;
ও মেয়ে বালিকা নয়, বালিকার চেয়ে কিছু বেশি।
[ও মেয়ে বালিকা নয়, ময়ুখ চৌধুরী]এক
নদীর চরায় নৌকাখানা আটকে গেলে
একলা ধীবর জাল গুটিয়ে ছেঁড়া পালের দুঃখ মাপে
ও যুবা তুই জলবালাকে ভুলে গেলি
ও বাছা তোর লুলুর বাহার ঘরে কাঁদে।
দুই
শিল্পকলার মেন্দিতলে
থোকায় থোকায় জোস্না গলে
গাঁজার গন্ধে ঘুম আসেনা একলা জেগে রই,
মাগো আমার শোলক বলার লুলুর বাহার কই।
[ দু’টি কবিতা, আবু মুসা চৌধুরী]একই বছর ১৯৮৪ সালের চতুর্দশ বিজয় দিবসে প্রকাশিত হয় ৩য় সংখ্যাটি। বাঙালীর বিজয়ী বীরদের নিবেদিত। যখন চারদিকে ভয়ের হিম ঠাণ্ডা হাওয়া। চারদিকে অন্ধকার। তখন সম্পাদকীয়তে জেগে ওঠার ও স্বর্গ নির্মাণের আহ্বান। এবারের সংখ্যা ৬টি পর্বে বিভক্ত। শুরু অরুণ দাশগুপ্তের গদ্য ‘কবিতায় গান ও গানে কবিতা’ দিয়ে। অনূদিত হৃদয়, প্রার্থনার পঙ্ক্তিমালা, স্বরচিত অনুভব, অশ্রুত নিক্কণ ও পুস্তক সমালোচনা। ‘কবিতায় গান ও গানে কবিতা’ একটি ছোট ও সংহত গদ্যে গীতি কবিতার রূপ কেমন তা সূত্রোল্লেখপূর্বক উপস্থান করেছেন। অনূদিত হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন আরব-আমেরিকান কবি নওমি শিহাব নাঈ ও প্রাচীন রোমান কবি আসোনিয়াস। অনুবাদ করেছেন যথাক্রমে কবি হায়াৎ সাইফ ও কবি মোস্তফা ইকবাল। প্রার্থনার পঙ্ক্তি মালা কবি সায়ীদুর রহমানের একগুচ্ছ কবিতা। স্বরচিত অনুভব পর্বে স্থান পেয়েছেন দশ জন কবি। অশ্রুত নিক্কণ পর্বে ছয়জন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে। এ সংখ্যার পুস্তক সমালোচনা পর্বে সম্পাদক নিজে আলোচনা করেছেন কবি আবু মুসা চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই মুরলী বেজে ওঠো। কবিতা নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবার ও লিখবার যে চেষ্টা চলছে তার কিছু আবহ টের পাওয়া যাবে এই সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত কবিতাংশে :
পলক হারা দু’চোখ বেয়ে যখন আমার দৃষ্টি নামে
পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপটে
ইমারতের পাহাড় দেখি, আভিজাত্যের বাহার দেখি
বিপ্রতীপে পথের পিঠে মানুষ দেখি সারি সারি
ক্লিষ্টদেহ ছন্নছাড়া, বাস্তুহারা।
[অন্যরকম মানুষ, হাবিব আহসান]আদিবাসী এক শ্যামা মেয়ে তুই
চোখে বাজে তোর পাহাড়ী-বেহাগ;
আয় কাছে আয় ভালোবেসে শুই
ভাগাভাগি করি বেদনা সোহাগ।
রিক্ততা কিছু অরণ্যে রেখে
স্নিগ্ধতাটুকু করপুটে মেখে
অমিতাভ প্রেমে মানুষের দোরে এ’কে রাখি এই হৃদয়ের দাগ।। [আদিবাসী এক শ্যামা মেয়ে তুই, হাফিজ রশীদ খান]
ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪-তে প্রকাশিত কবি আবু মুসা চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই মুরলী বেজে ওঠো নিয়ে আলোচনায় কবি ও সম্পাদক এজাজ ইউসুফী লিখেন :
শেষ কথা মুরলী সব ফুঁতে একরকম বাজে না। যে বেজে উঠার অঙ্গীকার নিয়ে মুরলীতে ফুঁ দিয়েছেন কবি তাতে সব কটি সুর না উঠলেও একটি প্রধান সুর বেজে উঠে তা সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়ার আকুতি। সে সুর হতাশা আর বিষণ্নতায় ঘেরা। শ্যামের মুরলী চট্টগ্রাম থেকে বাজলো বলে কবিকে সাধুবাদ।
লিরিক কবিতার প্রতি তার শুরুর অঙ্গীকার বহন করে চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে, এ পর্যন্ত প্রকাশিত সবকটি সংখ্যায়। যেনবা কবিতার নতুন পথ ও অবয়ব অন্বেষণই তার অভীষ্ট।
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বুট বাঙালী জাতির ঘাড়ে দৃঢ়ভাবে চেপে বসেছে ততদিনে। সামরিক শাসনের জাঁতাকলে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা যখন তখন ১৯৮৫-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি লিরিকের ৪র্থ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ট্যাবলয়েড আকারে। সম্পাদকের ভাষ্যমতে এটি লিরিকের বিকলাঙ্গ সংখ্যা যদিও স্বৈরশাসনকালে প্রকাশিত প্রথম প্রতিবাদী ছোটকাগজ। এই ট্যাবলয়েড সংখ্যায় কুড়িজন কবির কবিতার সঙ্গে ছাপা হয় কবি ও কথাসাহিত্যিক মহীবুল আজিজের নিবন্ধ ‘নিপাতনে সিদ্ধ গণতন্ত্র’। তার থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি তাহলে বোঝা যাবে কেমন দুঃসাহসী একটা লেখা বুুকে নিয়ে লিরিক ৪র্থ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
: আচ্ছা বলতো এইসব উদ্যোগের অর্থ কী?
: এ হচ্ছে গণতন্ত্রকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। তারা প্রাণটাকে ফানা করে দিচ্ছে গণতন্ত্রকে উদ্ধার করবার জন্য।
: তা গণতন্ত্রটা কি চোকির তলায় না ওদের বউয়ের ইয়ের ভিতর লুকিয়ে আছে যে তাকে উদ্ধার করতে হবে। লাঠি, ঢাল, রাইফেল, টিয়ার গ্যাস দিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধার করবে শাল্লা। [নিপাতনে সিদ্ধ গণতন্ত্র, মহীবুল আজিজ]
সম্পাদকীয় যেমনটা বলছে বাস্তবতা তার চেয়েও ভয়াবহই ছিল বৈকি :
ফাগুনের সাথে চেয়েছিলাম একগুচ্ছ আগুন উপহার দিতে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে গুটিয়ে যেতে হয়েছে একটি সংকীর্ণ আবর্তে। তবু যতটুকু সম্ভব অগ্রসর হতে হয়েছে অনেক মৌন দুঃখ কষ্টের ভেতর দিয়ে।
লিরিক পঞ্চম সংখ্যার শরীর কবিতা ছাড়িয়ে আরও নানা বিষয়কে আকৃত করে। পত্রিকার কলেবর সাড়ে তিন ফর্মার হলেও তার অনেকটা জুড়ে গদ্য স্থান করে নেয়। সম্পাদকীয় ঘোষণা দেয়া হয় ‘শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক’ ত্রৈমাসিক হওয়ার। নামকরণের বিড়ম্বনা বাঙালির আর গেল না। ‘নামে অনেক কিছু আসে যায়’ শিরোনামে নামকরণ বিষয়ক ছোট অথচ কৌতুহলোদ্দীপক প্রবন্ধ লিখেছেন রশীদ আল ফারুকী, সেই কবে, ১৯৮৬ সালে। আজ এই ২০২৫ সালেও একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থান ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ ও নাম বদলের প্রক্রিয়া। এই সংখ্যায় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ গদ্য ছাপা হয়েছে। ‘হাসান আজিজুল হকের বিদ্রোহী পুরুষেরা’ এই শিরোনামে হাসানের গল্পের দ্রোহী পুরুষ চরিত্রগুলোর ওপর বিশ্লেষণের আলো ফেলেছেন কথাসাহিত্যিক মহীবুল আজিজ। এ সংখ্যাটি অনুবাদ কবিতা ও গদ্যেও সমৃদ্ধ। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম রাশিয়ান লেখক ও কবি ইভান বুনিন এর কবিতার অনুবাদ করেছেন আলম খোরশেদ। রাশিয়ান ভবিষ্যতবাদী কবি ও নাট্যকার ভøাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতা বাংলায় ভাষান্তর করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। ‘নিমতিতার জমিদার প্রাসাদ’ শিরোনামে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের লেখার অনুবাদ করেছেন শান্তনু বিশ্বাস। জলসাঘর সিনেমা তৈরির জন্য লোকেশন খোঁজার চমকপ্রদ গল্প। ‘নিমতিতার জমিদার প্রাসাদ’-এর লোকেশনের সঙ্গে গল্পকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের বর্ণনার অপূর্ব মিল, যদিও গল্পকার কখনও সেখানে যাননি। অনুবাদাংশ উদ্ধৃত করছি বেশ নাটকীয় :
নিমতিতা থেকে প্রথমবারের মত ফিরে গল্পকারকে টেলিফোন করলাম। তিনি লোকেশনের ব্যাপারে আমাদের মতই চিন্তিত ছিলেন। অবশেষে জমিদার বাড়ি পাওয়া গেছে, আমি বললাম।
তাই নাকি? কোথায়?
একটা অজানা অচেনা জায়গায়―নিমতিতা।
নিমতিতা? তাঁর স্বরে জায়গাটার সাথে পূর্ব পরিচয়ের আভাস পেলাম
‘আপনি কি চৌধুরীদের জমিদার বাড়ির কথা বলছেন?’
হ্যাঁ আমি সেটার কথাই বলছি: বিস্ময়ে আমার গলার স্বর কেঁপে উঠল।
কিন্তু কি আশচর্য; বললেন গল্পকার, আমি কখনো নিমতিতায় যাইনি, বাঙলার জমিদারের ইতিহাসে চৌধুরীদের সম্পর্কে বিশদ জানার সুযোগ হয়, আর সঙ্গীতপ্রেমী উপেন্দ্রনারয়ণই আমার গল্পের রাজা চরিত্রের মডেল হিসেবে কাজ করে।’
[নিমতিতার জমিদার প্রাসাদ, মূল: সত্যজিৎ রায়, অনুবাদ: শান্তনু বিশ্বাস]কবিতার কাগজ হিসাবে যাত্রা শুরু করে বিষয় বৈচিত্রে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির আত্মীকরণের ঘোষণা সত্ত্বেও লিরিক এই সংখ্যায়ও ১১ জন কবির কবিতা ছাপিয়েছে। গ্রন্থালোচনায় স্থান পেয়েছে আনোয়ার হোসেন পিন্টুর চলচিত্র প্রসঙ্গ। এই যে এক ফর্মার একটি কবিতা সংকলনের যাত্রা পঞ্চম সংখ্যায় এসে বিষয়ে, ভাবনায়, বৈচিত্রে ও কলেবরে সময়কে ধারণ করেছে, প্রচল ভাবনার প্রতি ছুঁড়ে দিচ্ছে চ্যালেঞ্জ তাতেই তার পথ চলার ভঙ্গি ও আত্মবিশ্বাস টের পাওয়া যাচ্ছে। যেমনটা সম্পাদকীয়তে উৎকীর্ণ হচ্ছে :
বিদ্রোহী স্বভাবের কারণে প্রথম সংখ্যার টলটলে পায়ে চলার শুরু থেকে আমরা প্রায়োগিক জ্ঞানের চেয়ে বাস্তবমুখীন অবস্থা বিশ্লেষণে নিজের অবস্থানকে শক্ত পায়ে দাঁড় করাবার চেষ্টায় মননের সাথে দুর্নীতি করেছি। সে পা এখন শক্ত করে দাঁড়াবার মুখোমুখী। অতঃপর যুদ্ধের ভয়ে পাশ কাটানো নয়―সংহত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।
এ সংখ্যা থেকে লিরিক প্রতি তিন মাসে প্রদক্ষিণ শেষ করবে নান্দনিক গতিময়তা।
নিয়তি জেনেও এ হলো ছোটকাগজের নিয়মিত প্রকাশ- আকাক্সক্ষার আশাবাদ!
যদিও লাতিন আমেরিকার কালো হোমার কিউবান কবি নিকোলাস গ্যিয়েনের স্মৃতিতে নিবেদিত ৬ষ্ঠ সংখ্যাটির প্রকাশকাল ১৯৮৯ এর সেপ্টেম্বর। সারাদেশ জুড়ে এরশাদশাহীর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার হুড়মুড় শব্দ শোনা যাচ্ছে। লিরিক সম্পাদকের আরেকজন সহযোগীর দেখা মিলেছে, ওমর ফারুক সেলিম। লিরিক ৬ষ্ঠ সংখ্যাটি সূচিবদ্ধ করেছে প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রবন্ধ, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, গল্প ও গ্রন্থালোচনা। সংস্কৃতি ও সমাজমনস্ক ছোটকাগজের সম্পাদকীয় ভাষ্যে তৎকালীন বাস্তবতার বয়ান বিবৃত হয় এভাবে :
ক. এক খণ্ড ভৌগোলিক দিক থেকে স্বাধীন ভূমি আছে, তবে তা নিরাপদ নয়।
খ. কম আয়তনে বহুল লভ্য জনশক্তি আছে, যার কোন হালাল রুটি রুজির ব্যবস্থা নেই।
গ. হাজার বছরের পুরানো সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, কুলজি, ঠিকুজি সবই আছে কিন্তু অস্বীকারের প্রবণতা সমান সক্রিয়।
ঘ. কয়েকটি সাংঘাতিক অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী ইতিহাস―৫২, ৬৯, ৭১ আছে তবুও প্রেরণাহীন বাঙালী জাতীয় সত্তা।
ঙ. জনগণের আশা আকাক্সক্ষার অনুবর্তী শতকের কোঠা ছুঁই ছুঁই রাজনৈতিক দল আছে কিন্তু গণতন্ত্রেও ঘোড়া ক্লীবে পরিণত।
চ. সাহিত্যে মানুষের মৌলিক বৃত্তিগুলোর সমার্থকতা সৃষ্টিকারী সাহিত্য ও শিল্প স্রষ্টা যেমন আছে, তেমনি এদের বিরুদ্ধ শিবিরও সাংঘাতিক মানে
ঋদ্ধ।
বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে নড়বড়ে অবস্থা তার অন্তর্গত কার্যকারণ অনুসন্ধানে অত্যন্ত সময়োপযোগী ভাষ্য কে. ভিনু রচিত ফিলোসফিক্যাল প্রবলেমস অব রেভ্যুলেশন গ্রন্থের বিশতম অধ্যায়ের অনুবাদ ছাপা হয় এ সংখ্যায়। ‘সাম্যবাদ : স্বপ্ন এবং বাস্তবতায়’ শিরোনামে ভাষান্তর করেন মাসুদ জামান। ছোটকাগজ হয়ে ওঠার জন্য সময়ের দায় অনুভব করতে হয় তাহলেই এরকম ভবিষ্যত প্রয়োজনের রসদ মুদ্রণ সম্ভব হয়। এ সংখ্যায় ঘোষণা দেওয়া হয় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা প্রকাশের। গল্পকার মামুন হুসাইনের ‘রাজ যাত্রা কিম্বা সহজ বেহুলাপাঠ’ গল্পটি এ সংখ্যায় ছাপা হয় পরে যেটা তার স্বাক্ষর গল্প হয়ে ওঠে। আহমেদ রায়হান, খালেদ হামিদী ও বাদল সৈয়দকৃত ফরাসি, ইংরেজি ও রুশ কবিতার অনুবাদ এই সংখ্যাকে ঋদ্ধ করেছে। গ্রন্থালোচনা বিভাগ গ্রন্থ-প্রসঙ্গেতে কবি ময়ূখ চৌধুরীর প্রথম কবিতার বই কালো বরফের প্রতিবেশীর আলোচনা লিখেন কবি হোসাইন কবির, কবি আহমেদ রায়হানের প্রথম কবিতার বই প্রিয় বাঘিনী আমার নিয়ে আলোচনা লিখেন কবি জিললুর রহমান এবং কথাসাহিত্যিক মহীবুল আজিজ এর প্রথম গল্পগ্রন্থ নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ-এর আলোচনা লিখেন সম্পাদক এজাজ ইউসুফী স্বয়ং।
সম্পাদকীয় ভাষ্য থেকে জানা যাচ্ছে লিরিক সপ্তম সংখ্যাটি ‘দেশের ঋদ্ধ পুরুষ ও অনুপম অনুভবের অনন্য গদ্যকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ধারণ করবার কথা ছিল।’ কথা রাখতে না পারার আক্ষেপ থাকলেও এই সংখ্যাটিও নানা লেখায় ঋদ্ধ। দেশি-বিদেশি প্রবন্ধ, গুচ্ছ কবিতা, গল্প, অনুবাদ গল্প, অনুবাদ কবিতা, সাম্প্রতিক চিন্তা, গ্রন্থালোচনা মিলিয়ে মোট ১০৮ পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা। দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা অগ্রজ কবি মোস্তফা ইকবালের প্রয়াণে স্মৃতি তর্পণ করেন সম্পাদক নিজে তার কাব্যকৃতির ওপর বিশদ আলোচনা করে। সাহিত্যের দায়বদ্ধতা নিয়ে আফ্রিকান লেখক ইজিকাইল মেফালিলি’র প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন সিদ্দিক আহমেদ। ছয়জন সমসাময়িক তরুণ কবির গুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়েছে এই সংখ্যায়। কবিরা মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন বিশ্বের নানা ভাষার কবিতা যা এই সংখ্যার গুরুত্ব বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। খ্যাতির শিখরস্পর্শী লাতিন কথাকার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্পের ভাষান্তর করেছেন মহীবুল আজিজ। ‘নতুন কবিতা ভাবনা প্রসঙ্গে’ শিরোনামে কবি খালেদ হামিদী লিখেছেন চিন্তা উদ্রেককারী গদ্য। প্রকাশনা প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে সেসময় এমন অনেকের কবিতার বই প্রকাশিত হয় যারা লেখালেখির নবিশি পর্যায়ও অতিক্রম করেননি। অথচ অনেক প্রতিভাবান তরুণ কবিতা কর্মী অর্থাভাবে গ্রন্থিত হওয়ার কথা ভাবতেই পারছিলেন না। এ নিয়ে অনতি তরুণ পুলক পালের ‘সাম্প্রতিক কবিতার বই : ভিন্নমত’ বিষয়ক গ্রন্থালোচনা সেসময় সাহিত্য আড্ডাগুলোর আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। ষষ্ঠ সংখ্যার প্রিন্টার্স লাইনে সহযোদ্ধার সংখ্যা ক্রমবর্ধিষ্ণু, প্রায় ১২ জন।
পূর্ব ঘোষণা অনুসারে লিরিক-এর অষ্টম সংখ্যাটি ছিল বিরলপ্রজ কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নিয়ে। প্রায় তিনশো এর অধিক পৃষ্ঠাজুড়ে ছড়িয়ে আছে উভয় বাংলার অপ্রথাগত লেখক সাহিত্যিকদের ইলিয়াস-এর সাহিত্যকৃতির পাঠ, মূল্যায়ন ও সমালোচনা। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের নেওয়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর প্রবাদ প্রতিম সাক্ষাতকার। লেখকের প্রবল আপত্তি ও দোদুল্যমানতার পরেও তাঁর ২য় উপন্যাস খোয়াবনামা’র অংশবিশেষ এর মুদ্রণ। অষ্টম সংখ্যার প্রিন্টার্স লাইনে যুক্ত হয় পাঁচ জনের সম্পাদনা পরিষদ―সোহেল রাববি, জিললুর রহমান, সেলিম ওমর ফারুক, পুলক পাল, আহমেদ রায়হান। পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে সম্পাদনা পরিষদে আরো যুক্ত হন সাজিদুল হক, বাদল সৈয়দ, শেখ মিরাজুল ইসলাম ও শ.ম. বখতিয়ার। অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছিলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। অঙ্গসজ্জা করেছিলেন দেবাশীষ রায়। এই দলটিই লিরিক-এর পরবর্তী সংখ্যাগুলো প্রকাশনার অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর দুটি পোর্ট্রেট ছাপা হয়। স্কেচ করেছিলেন শিল্পী শফিকুল ইসলাম এবং উডকাট করেছিলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন।
অতি-উক্তি আমাদের স্বভাবে নিবিড়। অবলীলায় তাই বলতে পারি কাজটা ভিন্নতা ও বিশিষ্টতার দাবি রাখে, যদিও বাণিজ্যিক বুদ্ধিতে সওয়ার হয়ে বিশেষ সংখ্যার হিড়িক চলছে সম্প্রতি। সাহিত্যিক সুখ্যাতি ও অর্থের ঔদার্য এ ধরনের প্রকাশনার পৃষ্ঠপোষক। হয়তো লিরিকও অভিযুক্ত হবে এই দায়ে। তবে আমাদের স্বস্তি বাঙলা কথাসাহিত্যের ধারায় বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, মানিক এবং সৈয়দ ওয়ালিউল্লার পর সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিমান, মেধা সম্পন্ন ও অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখককে নিয়ে সময়োচিত কাজটি করতে পারার আনন্দটুকু আমাদের আছে।
[ সম্পাদকীয়, লিরিক, আ.ই.স]
ইলিয়াসকে নিয়ে সংখ্যা প্রকাশের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল সম্পাদকের ভাষ্যে জানা যাক :
১৯৯২ সালে লিরিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা প্রকাশ ছিল যুগান্তকারী একটা ঘটনা। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দারুণ আলোড়ন তৈরি হয়। ইলিয়াসকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা কীভাবে বের করলাম তা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষত্রিয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। বিংশ শতকের আশির দশকের শেষ দিকে তাঁর চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসটি কীভাবে যেন হাতে পেয়ে যাই। উপন্যাসের প্রতি আমার তেমন আগ্রহ ছিল না কোন কালেই। এখনও বিশেষ নেই। কিন্তু এটি পড়তে শুরু করার পর আর থামতে পারিনি। ঘোরগ্রস্তের মতো পড়ে শেষ করে ফেলি। এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সংখ্যা বের করেছে কলকাতার লিটলম্যাগ বিজ্ঞাপনপর্ব। একদিকে, উপন্যাস পাঠের ঘোর। অন্যদিকে, হাসান সংখ্যার অনুপ্রেরণা আমাকে ‘আখতারুজ্জমান ইলিয়াস সংখ্যা’ প্রকাশে উৎসাহিত করে। কাজ শুরু করে দিই। প্রথমে তাঁর রচনাবলী সংগ্রহ। পাশাপাশি মগ্ন হই পাঠে। প্রতিদিন তাঁকে যেন নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকি। গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠের কারণে কোথাও কোথাও থমকে দাঁড়াতে হয়েছে―মতের অমিলের কারণে। কিছু চিন্তা মনে হয়েছে তাঁরই স্বরূপ প্রকাশক। আবার কোথাও তাঁর ভাবনাকে মনে হয়েছে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। এগুলো টুকে রাখতে থাকি। তবে, এসব তাঁর সৃজনশীল রচনার প্রতি আমার বিরাগ জন্মাতে পারেনি। তাঁর রচনাকে আরও মানবিক মনে হয়েছে।
এ পর্যায়ে লিরিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নিই। তাঁর ওপর প্রকাশিতব্য এই সংখ্যাটিতে লিখবার জন্য বাংলাদেশ এবং ওপার বাংলার বিভিন্ন ঔপন্যাসিক এবং প্রাবন্ধিকদের কাছে চিঠি পাঠাতে শুরু করি। কিন্তু তেমন করে সাড়া পাচ্ছিলাম না। পরে ব্যক্তিগত যোগাযোগ শুরু করি। অনেকেই লেখা দেবেন বলে কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। অনেকে বিমুখ করেছেন। কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদার ও মঞ্জু সরকার খুবই সহযোগিতা করলেন। নিজেরা লিখলেন। অন্যদের উৎসাহিত করলেন লিখতে। সুশান্তদা বড় একটি প্রবন্ধ রচনা করে সেটি ‘পাঠক সমাবেশ’-এর বিজুর কাছে দেন। ঢাকাস্থ বন্ধুবর সেলিম উল্লাহ সেটি সংগ্রহ করে আমাকে পাঠানোর কথা। এর মধ্যে রূপম পত্রিকার সম্পাদক আনোয়ার আহমেদ বড় একটি জালিয়াতি করলেন। বিজুর কাছ থেকে লেখাটি নিয়ে ফটোকপি করে আজকের কাগজ-এর সাহিত্য পাতায় ছাপিয়ে দিলেন। এতে এই বিজ্ঞের কী লাভ হলো জানি না―আমার মনে দাবাগ্নি জ্বলে ওঠে। তার সঙ্গে রফাদফা করতে ঢাকায় চলে আসি। শাহবাগে তাকে আর খুঁজে পাইনি। সুশান্তদা আমার রাগ প্রশমিত করতে আরও একটি লেখা তৈরির অঙ্গীকার করলেন। পরে, ইলিয়াস সংখ্যায় সুশান্ত দা’র দুটো লেখাই ছাপা হয়। একটি পুনর্মুদ্রণ হিসেবে।
মনে পড়ে ইলিয়াস ভাইয়ের অনুমতির জন্য আমি, জিললুর রহমান এবং সোহেল রাব্বি (বর্তমানে মৃত) তাঁর কর্মস্থল ঢাকা কলেজে দেখা করতে যাই। তিনি বললেন―‘আমি কি খাই কি পরি, এসব জানতে চাও?’ বললাম, ‘না, আমরা টেপ রেকর্ডারে আপনার কথা ধারণ করতে চাই।’ তিনি খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। বললেন―‘তোমরা এক কাজ কর আমাকে লিখিত প্রশ্ন দাও, আমি উত্তর লিখে দিব।’ তাঁর সঙ্গে আর বেশি কথা বলার সাহস হলো না। সন্ধ্যায় লেখক শিবির অফিসে প্রশ্নগুলো পৌঁছে দিতে বললেন। সোহেল রাব্বির বাসায় গিয়ে বিকেলের মধ্যে প্রশ্নগুলো তৈরি করলাম। জিললুরের হাতের লেখা স্পষ্ট বলে তাকে দিয়ে কপি করালাম। সন্ধ্যায় লেখক শিবির অফিসে গেলাম প্রশ্নগুলো নিয়ে। কিন্তু তিনি ব্যস্ত বলে দেখা করলেন না। একজনকে পাঠিয়ে প্রশ্নগুলো তার হাতে দিতে বললেন। তা-ই দিয়ে এলাম। তিনি প্রশ্নগুলোর উত্তর কিন্তু দিলেন না। তা আজও আমার কাছে এক রহস্য হয়ে আছে। তাঁর মৃত্যুর পর, নিরন্তর পত্রিকায় প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানকে লেখা একটি চিঠিতে দেখলাম; ইলিয়াস ভাই লিখেছেন―‘এজাজ আমাকে কিছু কঠিন প্রশ্ন দিয়ে গেছে। তুমি এই প্রশ্নগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে আমার একটি সাক্ষাৎকার নিলে ভাল হয়। একদিন আমরা বসি।’
তারপর এক শীতের সকালে সেই সময়ের চলচ্চিত্রবোদ্ধা হিসেবে পরিচিত শাহাদুজ্জামান আমার বাসায় এলেন। জানালেন, তারা ইলিয়াস ভাইয়ের ওপর (সম্ভবত আতিকের নৃ পত্রিকা) একটি সংখ্যা করতে চান। আমি বললাম―‘ভালতো।’ তিনি বললেন, ‘চলেন একসঙ্গে কাজটি করি।’ আমি তাকে না করলাম। বললাম, ‘আমি অনেকটুকু কাজ করে ফেলেছি। কারো সঙ্গে আমার কাজ করা সম্ভব নয়।’ শাহাদুজ্জামান বললেন, ‘আপনার সংগৃহীত লেখাগুলো দেখতে পারি।’ আমি তাকে সব লেখাপত্র দেখালাম। মনে হলো তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আমার পরিকল্পনার কথাও তাকে জানালাম। তিনি ইলিয়াস ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা বললে আমি সানন্দে রাজি হয়ে যাই। শাহাদুজ্জামান জানালেন দুপুরে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবেন। আমি তার সঙ্গে যেন যাই। আমার তখন ভ্রমণভীতি প্রবল। আমার পক্ষে হঠাৎ করে যাওয়াও সম্ভব না। তাকে নিয়ে সবুজ আড্ডায় গেলাম। তখন সকাল থেকেই আড্ডা শুরু হতো। গিয়ে অনুজ মাসুদ জামানকে বলতেই রাজি হয়ে গেল। নব্বই মিনিটের ৩/৪টি ম্যাক্সাল ক্যাসেট দিয়ে বাসে তাদের ঢাকার পথে তুলে দিলাম। মাসুদ ফিরে এসে জানাল; পুরো একটা দিন আলাপ হয়েছে শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে। মাসুদ কথাগুলো ক্যাসেটে রেকর্ড করতে সাহায্য করেছে। এভাবেই তৈরি হয়ে গেল বাংলা ভাষার এক বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিকের দুর্লভ সাক্ষাৎকার। এখনও আমি হলফ করে বলতে পারি, বাংলা ভাষায় এরকম মাস্টারপিস সাক্ষাৎকার আর দ্বিতীয়টি নেই।
এরপর আমার প্রশ্নগুলোর কথা ভুলেই গেলাম। ঢাকা রওনা হওয়ার পথে শাহাদুজ্জামান আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন―আমি সাক্ষাৎকারের জন্য ক’পৃষ্ঠা দিতে পারব। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম পৃষ্ঠার কথা চিন্তা করবেন না। সেটি আমি দেখব। আপনি যত ইচ্ছে স্পেস নিতে পারেন। পরে কম্পোজ হয়ে ছাপানোর পর এটি প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার সাক্ষাৎকারে দাঁড়ায়। সাক্ষাৎকার তো ভালোভাবে নেয়া হয়ে গেল। কিন্তু ইলিয়াস ভাই সেটি কোনোভাবেই ছাড়তে চান না। আমি তাগাদা দিই―উনি সময় বাড়ান। অন্যদিকে, ভয়ও কাজ করছিল। সাক্ষাৎকারটি না অন্য কোথাও ছাপা হয়ে যায়। একদিন শেষ পর্যন্ত এই দুর্লভ সাক্ষাৎকারটি, অর্থাৎ ইলিয়াস ভাইয়ের টাইপ করা কপি আমার হাতে এসে পৌঁছে। এটি লিরিক-এ ছাপা হয়ে আজ তা ইতিহাস।
লিরিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। ১৯৯৩ সালে সন্দ¦ীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র দু’দিনব্যাপী ‘প্রথম অল ইন্ডিয়া লিটল ম্যাগাজিন কনফারেন্স’র আয়োজন করে কলকাতার শিশির মঞ্চে। সারা ভারত থেকে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা এতে যোগ দিয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যার জন্য লিরিক-কে শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন সম্মাননা দেওয়া হয়। আমার সৌভাগ্য হয়, বাংলা কথাসাহিত্যের কিংবদন্তি অমিয়ভূষণ মজুমদারের হাত থেকে ক্রেস্ট ও সম্মাননা পত্র গ্রহণ করার।
সেই কিংবদন্তিসম সাক্ষাতকারের শাহাদুজ্জামানকৃত ভনিতাটুকু উদ্ধৃত করছি :
প্রগতি প্রতিক্রিয়ার জুজুর ভয় নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন গল্প লেখেন না, আলাপও করেন না, আলাপ করেন একেবারে ঝাঁপি খুলে। জগতে এমন কোনো ব্যাপার নেই যাতে তাঁর কৌতূহল নেই, এমন কোনো প্রসঙ্গ নেই যা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপে কোনো বাধা আছে। ঘড়ঃযরহম যঁসধহ রং ধষরবহ ড়ভ সব―কার্ল মার্কসের এই উক্তিটি তাঁর সম্বন্ধে সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরিকল্পনা যখন করলাম তখন ধরেই নিয়েছিলাম যে এ জন্যে বেশ দীর্ঘ সময় দরকার। পুরো একটা দিন বরাদ্দ চাইলাম তাঁর কাছে। দিন ধার্য হলো ৫ অক্টোবর : ১৯৯১। সেদিন তিনি ছুটি নিলেন তাঁর কর্মস্থল থেকে। সারা দিন ধরে কথা, কথোপকথন। আমাদের সঙ্গে অনুজপ্রতিম মাসুদ জামান, পাশে ক্যাসেটের অবিরাম ঘূর্ণন।
আমাদের সেই কথোপকথন অক্ষরে রূপ দেওয়া গেল পাঠকের জন্যে। কিন্তু অনিবার্যভাবে উহ্য রইলো কথার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর প্রবল হাসির শব্দ, পাইপ টানবার ভঙ্গি, চোখের পাতায় ফুটে ওঠা উদ্বেগ কিংবা আবেগ, কখনো কখনো বিরক্তি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যার অন্যতম লেখক জিজ্ঞাসা পত্রিকার সম্পাদক শিব নারায়ণ রায় এসেছিলেন লিরিক প্রকাশনার দেড়যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে। লিরিক গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে। তৎকালীন একটি স্মৃতির উল্লেখ এস্থানে প্রাসঙ্গিকই হবে আশা করি―চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দুইদিনব্যাপী সে আয়োজনের দ্বিতীয় দিন শেষে আমরা সবাই তার সঙ্গে এক ঘরোয়া আড্ডায় যোগ দিই সম্পাদক এজাজ ভাইয়ের ২৪, পাঁচলাইশ আ/এ বাসভবনে। তিনি সেখানেই আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। আড্ডার এক পর্যায়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা ও ইলিয়াসের উপন্যাস প্রসঙ্গে শুরু হয় তুমুল তর্ক। ইলিয়াসের সেরা উপন্যাস কোনটি ? তার পক্ষপাত খোয়াবনামার প্রতি, আমরা ছিলাম চিলেকোঠার সেপাই-এর পক্ষে। তার যুক্তি ছিল খোয়াবনামা উপন্যাস হিসেবে পরিপূর্ণ এবং নিখুঁত নির্মাণ আর চিলেকোঠার সেপাই-এ আর্টিষ্টিক ফø আছে বিশেষ করে যেসূত্রে ঔপন্যাসিক ঘটনাকে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ভাষ্য ছিল চিলেকোঠার সেপাই অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত আর তিনি যেটাকে আর্টিষ্টিক ফø ভাবছেন সেটি অনেক বেশি যোগাযোগসংবহ। নানা যুক্তি তর্ক শেষে তিনি বলেছিলেন তাকে দু’টি উপন্যাসই আবার পড়ে দেখতে হবে। উপন্যাস দু’টি আর পড়তে পেরেছিলেন কি না এখন তিনি সে জিজ্ঞাসার ওপারে।
লিরিক প্রকাশনার দেড় যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে দেশের নিবেদিত প্রাণ ৭টি ছোটকাগজ সম্পাদককে সম্মাননা প্রদান করা হয়। তারা হলেন স্পার্ক জেনারেশন সম্পাদক স্বপন দত্ত, সমুজ্জ¦ল সুবাতাস সম্পাদক হাফিজ রশিদ খান ও চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া, গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়ুয়া, নিসর্গ সম্পাদক সরকার আশরাফ, প্রতিশিল্প সম্পাদক দুর্বাশা দুর্বার, কবির মনি ও মারুফুল আলম, গ্রন্থী সম্পাদক শামীম শাহান ও জীবনানন্দ সম্পাদক হেনরী স্বপন প্রমুখ।
কবিতাকে ঘিরেই লিরিকের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। আশির মধ্যভাগ থেকে বাংলা কবিতার রূপ বদলের যে আকাক্সক্ষা অনেক তরুণ কবির অভীষ্ট ছিল সেই ভাঙচুরের মধ্যে সময় এগিয়ে যেতে থাকে। তিরিশ পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতার যে উৎকেন্দ্রিক যাত্রা তার পরিবর্তনকামিতায় বাংলা কবিতা খুঁজে পেতে চায় তার নবনির্মিতির দর্শন। কবিতার এই নবনির্মিতির দর্শনকে ধারণ করে প্রকাশিত হয় লিরিক নবম সংখ্যা। অর্থাৎ ‘উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা’। মূলত ১৯৯৩ সালে ছোটকাগজ লিরিক উত্তর আধুনিকতার ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা প্রকাশ করার পর নতুন এ প্রত্যয় নিয়ে সারাদেশে নানা বিতর্কের শুরু হয়। এর মাধ্যমে সূচনা ঘটে বাংলা কবিতার পালাবদলের। নব্বইয়ের সূচনা লগ্নে বাংলা কবিতা তার ঘরে ফিরতে শুরু করে ইতিবাচকতায়। কবিতার এই লোকযাত্রার নিজস্ব চিহ্ন ধারণের পথে প্রধান সারথি লিরিক নবম সংখ্যাটি। আজকের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সমগ্র দেশজুড়ে তরুণ কবিতাকর্মীদের কাব্যভঙ্গি ও কাব্যস্বরের যে ইতিবাদী পরিবর্তন ঘটেছে তার কৃতিত্ব অবশ্যই লিরিক-এর এই সংখ্যাটি দাবি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে কিছু বিষয় এখানে বলা জরুরি। বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতার সূচনা নিয়ে বাতাসে যেমন বহু কথা ভেসে বেড়ায় তেমনি বিকৃত ইতিহাস রচয়িতাদের মুদ্্িরত পাঠও দৃষ্টির অগোচর নয়। একটি বিষয় দ্ব্যর্থহীনভাবে আজ বলা দরকার এটি বাংলাদেশে কবি এজাজ ইউসুফী প্রথম আত্মস্থ করেন এবং লিরিক পরিবারে এ বিষয়ে দীর্ঘদিন বিস্তারিত আলাপ আলোচনা ও বিতর্কের পর এই সংখ্যাটি প্রকাশের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং এ কথা আজ দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাই বাংলা কবিতার শরীরে যে রূপবদলের চিহ্ন পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তার কৃতিত্ব লিরিক সর্বাংশেই দাবি করতে পারে। আর এভাবেই একটি ছোটকাগজ নিজের কাল ও সময়কে নিরন্তর নির্মাণের অনুধ্যান চালিয়ে যায়। এই সংখ্যার দুটি কবিতা এখানে উদ্ধৃত করছি :
সিবগাতাল্লাহে ওয়ানমান―
আহসান মিনাল্লাহে সিবগাতান।
আমরা আল্লাহ-র রঙে রঞ্জিত হয়েছি
আর কে এমন আছেন এমন সুন্দর?
রূপোলী বর্ণে খুব মোহময় হয় বুঝি আল্লাহ-র ক্লান্ত দু’খানি চোখ
কালো পর্দার অন্তরালে জলপাই নিয়ে খেলে
বালিকা বেশী পরলোক।
সিবগাতাল্লাহে ওয়ানমান
আহসান মিনাল্লাহে সিবগাতান।
ধূসর রূপোলী রঙে রঞ্জিত আল্লাহ-র
বাহুর ইঙ্গিত যেন বাবরের ধূসর কামান
কালো নেকাবের ফাঁকে রাঙা দুটি ঠোঁট নেড়ে
বালিকা বেশী পরলোক
সারে আত্মার চন্দন চর্চা আর সন্ধ্যার সাগর সিনান।
তরঙ্গিত রূপোলী বর্ণে নিতে দীক্ষা এখন দূরে
সার বেধে দাঁড়িয়েছে ভিক্ষু যত দিন
পরলোকে ঠোঁট রেখে আল্লাহ সবুজ বর্ণ তার চোখ
খোলে যেন অশালীন
প্রাণী এক, রক্তাভ ঠোঁট তার, খুলে নেবে বুভুক্ষু জোছনা চাদর
পরকাল ম্লান হেসে স্তনবৃন্ত থেকে ঢেলে দেয়
বাইকাল ছন্দের ম্রিয়মান গোলাবী আদর।
সিবগাতাল্লাহে ওয়ানমান, আহসান মিনাল্লাহে সিবগাতান
রূপোলী বর্ণ থেকে বের হয় মানব ও মানবীর নয়া খান্দান। [আল্লাহর রঙে, শাহিদ আনোয়ার]
‘আউপ্পা গালা বদনা ক্যালা
তোঁয়ারে খেলাত লইতাম ন
আঁর নানারত ফিডা বানাইলে
তোঁয়ারে আদ্দান দিতামন।’
‘আয়রে আমার গোলাপ পুল’ খেলায়
দুধভাত বানিয়ে তোমাকে হেনস্তা করা সেইদিন
স্মৃতিস্থ যদিও
আমি খুব দুধভাত ভালোবাসি
সেহেরী মাখানো দুধভাত এবং স্মৃতিজ শৈশব
প্রাচীন পিঠার স্বাদে পরস্পর কলহ রচনা―
নিজেকে নিজেই দেখি ‘দুধভাত’ ক্রমাগত
কেউ কেউ ক্ষোভার্দ্র―‘দুধভাতে উৎপাত’?
হেনস্তার কোল ঘেঁষে ইন্দ্রদেব মেঘের আড়াল চায়
চারপাশে প্রতাপী সূর্য দুধভাতের ভীষণ প্রণয়ী
[দুধভাত প্রকল্প, জিললুর রহমান]উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা দুই একে দেয় আরও সংহতি যা লিরিকের দশম সংখ্যা। ঘা লাগে বাজারি পত্রিকার প্রাতিষ্ঠানিক নন্দনে। শুরু হয় প্রতিআক্রমণের। মূল বিষয়কে সরিয়ে রেখে পরিপার্শ্বকে নিয়ে চলে এক ধরনের মিডিয়া সন্ত্রাস। প্রতিষ্ঠানের কেনা বুদ্ধিজীবীরা রাতারাতি উত্তর আধুনিকতার তাত্ত্বিক সেজে বসেন। পাশ্চাত্য পোস্ট মর্ডানিজমকে আত্মস্থ না করেই এক ধরনের স্বাদু খিচুড়ি পরিবেশন শুরু করেন দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর পাতায়। তার জবাবে জিললুর রহমানের সম্পাদনায় লিরিক বুলেটিন প্রকাশ করতে হয় ‘উত্তর আধুনিকতা বিতর্ক ও বিভ্রান্তির উত্তর’ শিরোনামে। অনেক কথিত ছোট কাগজ কর্মীরাও মিডিয়ার প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে হঠকারী কাজ করে বসেন। লিরিক তার একাকী প্রবজ্যায় কখনও পিছিয়ে পড়ে না। এগিয়ে চলে সাধে, সাহসে, সৌন্দর্যে তার পনরতম সংখ্যা সমেত।
লিরিক উত্তর আধুনিক কবিতা বিষয়ে মোট পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা যথাক্রমে নবম, দশম, একাদশ, ত্রয়োদশ, পঞ্চদশ সংখ্যা প্রকাশ করে এবং বিভ্রান্তির প্রতিউত্তরে একটি বুলেটিনও প্রকাশ করে। ২০২০ সালে প্রকাশিত পনরতম সংখ্যাটি পরিসরে একহাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে এই চিন্তা ও দর্শনের পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য প্রবন্ধ/ নিবন্ধ/ কবিতা/ বিতর্ক/ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। ত্রয়োদশ সংখ্যাটিতে ২০০৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত উত্তর আধুনিকতার বিপক্ষে রচিত বেশিরভাগ লেখা সংকলিত করা হয়েছে এবং নামকরণ করা হয়েছে ‘উত্তর আধুনিকতা ভিন দিগন্ত সংখ্যা’। বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এর পক্ষে-বিপক্ষে লিখেছেন। সম্পাদক নিজে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে বিভিন্ন লেখকের উত্থাপিত বিভিন্ন জিজ্ঞাসা ও অভিযোগের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলা যায় অবক্ষয়ী আধুনিক কবিতার বিপ্রতীপে এই নতুন কাব্যতত্ত্বের বিশাল প্রভাব বাংলাদেশের কবিতায় আজ সাদা চোখেও প্রতিভাত। মোদ্দাকথায়, একটি লিটল ম্যাগাজিন বাংলা কবিতার আঙ্গিকই পরিবর্তন করে দিয়েছে। লিরিক সম্পাদক কবি এজাজ ইউসুফীর ভাবনায় উত্তর আধুনিকতার স্বরূপ :
এটার দার্শনিক প্রত্যয়টি কিরকম তা একটু খতিয়ে দেখা যাক। এখানে বলা প্রয়োজন, পাশ্চাত্যে ‘মডার্নিজম’ তথা ‘আধুনিকতা’ উদ্ভবের পেছনে ফরাসি বিপ্লবের সর্বমানবিক আবেদন, গণতন্ত্রের উত্থান, পুঁজির বিকাশ, শিল্পবিপ্লব, মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষা এবং যন্ত্র-প্রযুক্তির আকাশছোঁয়া বিকাশ তার ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল। সৃজিত ঘোষ তাঁর ‘উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন―‘আধুনিকতা শব্দের অর্থ এখন, রক্ষণশীলতা। মধ্যযুগের অবসানের পরে রেনেসাঁস এবং রোম্যান্টিসিজমের মাধ্যমে যে-আধুনিকতার অভ্যুদয় ঘটেছিল―ইতিহাসের নিয়মেই আজ তা অবক্ষয়ে বিকারগ্রস্ত। সেদিনের প্রগতিশীল বন্ধু আজ অত্যাচারী প্রভু; শিল্পী তার ভৃত্য এবং শিল্প তার পণ্য।’ সুতরাং আমরা দেখাতে চেয়েছি পুঁজিবাদ তার যুক্তির সব ভিত্তিভূমি হারিয়ে সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ক শক্তিরূপে হাজির হয়েছে। আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হওয়ার কারণে আমাদের জ্ঞান ও মানসজগৎ তার আদলেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু আজ মানব-মুক্তির ‘মহাআখ্যান’ উপনিবেশমুক্ত দেশগুলোতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আধুনিকতার আগ্রাসনের কাল সমাপ্ত হতে চলেছে। এরকম একসময়ে নিজেদের কৃষ্টি-ঐতিহ্যের প্রতি মুখ ফেরানোর কারণেই আবিষ্কার করতে পারছি, নিজেদের অবহেলিত জ্ঞানকাণ্ড এবং তার রত্ন-ভাণ্ডার।
আজকে উত্তর আধুনিকতা বলতে সাধারণত সমসাময়িক এমন এক অভিজ্ঞানকে বোঝায় যা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে কেবল নয়, সঙ্গে সঙ্গে তা আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত এক সমৃদ্ধ অতীতকেও চিহ্নিত করে। উত্তর আধুনিকতা প্রচলিত সব জগদ্দল প্রথার বিরুদ্ধে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে। এতদিনকার ভাবোন্মত্ততা, সত্যাসত্য, ধড়িবাজ বিশ্বাস, কারণ, আইডেনটিটি, উদ্দেশ্য এবং সর্বোপরি মানব-মুক্তির বিশাল সব তত্ত্বের প্রতিও সে এক সোচ্চার প্রতিবাদ। ইতিহাসও আজ পুনর্বিবেচনার মুখোমুখি। পুঁজিবাদী রসায়নে সৃষ্ট আধুনিকতাকে কাটা চিহ্নের নিচে ফেলে আমাদের নিজ অস্তিত্বের নতুন অভিসন্দর্ভ নির্মাণের প্রস্তুতি একে বলা চলে। পশ্চিমের জ্ঞানতত্ত্বের (ঊঢ়রংঃবসড়ষড়মু) বিপরীতে এটি আমাদের মননের স্বরূপ বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা। তাছাড়া ঔপনিবেশিকতা আমাদের শেকড়মূলের কত গভীরে প্রোথিত তাকে আজ ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়ে খনন করে দেখার সময়ও এসেছে বলে মনে করি। একে আমাদের জাতীয় সত্তা বিনির্মাণের রাজনীতিও বলা যাবে। আজকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কালে রাজনীতি, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে উত্তর আধুনিকতার কার্যকারিতা প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে। কিন্তু উত্তর আধুনিকতা আমাদের দেশে এখনও সেরকম বহু-বিস্তারী অভিসন্দর্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বলা যাবে না। তবে সচেতন প্রয়াস একে নির্দ্বিধায় বলা যায়। বিশেষ করে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় এর চরিত্রলক্ষণ স্ফুটতর হতে শুরু করেছে। আধুনিকতার ধারণাটি আমাদের একরৈখিক এবং সৃজনমুখবঞ্চিত, যন্ত্রপাতির দখলভুক্ত এবং একধরনের অবসাদগ্রস্ত চৈতন্যের নিগড়ে আবদ্ধ করে রেখেছিল এতদিন। বেহুদা নগ্নতা, অসংলগ্ন চিৎকার, বিকৃত যৌনতা, নির্বস্তুক নেতির প্রণোদনায় এক ভিন্ন বৈপরীত্যে আমরা নিজেদের নিক্ষেপ করেছি। অন্যদিকে, নারী ও প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত করে চলেছি চরমভাবে ধর্ষণ। ঔচিত্যবোধের সম্পূর্ণ বিলুপ্তির আয়োজনও চলছে সরবে-নীরবে। অশিষ্ট রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ধূম্রজালে মজ্জমান বাঙালি জীবনে এতটুকু আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা কোথাও লক্ষণীয় নয়। বরঞ্চ সাম্যবাদের স্বপ্ন তিরোহিত হবার পর ইতর ও দূষিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে। ঠিক এমনি এক নষ্ট-কালখণ্ডে উত্তর আধুনিকতা আমাদের লুপ্তপ্রায় প্রত্ন-স্মৃতিসমূহকে নতুন সংবীক্ষণে যশস্বিনী করতে চায়। মূলত চট্টগ্রামের লিরিক-সহ বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে এ নতুন ভাবনা বিকাশের আতিপাতি শুরু হয়েছে। উত্তর ঔপনিবেশিক চেতনার রজঃস্বলা এই বোধ আজ সাহিত্যের কবিতা শাখায় বিশেষভাবে প্রস্ফুটিত। তবে অন্যান্য মাধ্যমেও নজর কাড়ার মতো কাজ হয়েছে। কারণ, আধুনিকতার সার্বিক বিপন্নতার বিপ্রতীপে এ আমাদের এক সুখকর কালখণ্ড নির্মাণের প্রয়াস বৈ কিছু নয়। গোটা বিশ্বেও আজ আধুনিকতার অচলায়তন ও প্রাচীনের গণ্ডি ভেঙে ফেলার ডাক এসেছে ‘পোস্টমডার্নিজম’-এর তত্ত্বে। প্রতিদিনইÑশিল্প, সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং সমাজ-সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হচ্ছে এর নব্য-সদর্থক চেহারা। আমরাও এর সঙ্গে সমমাত্রিক ও বিপরীত অভিঘাতে সম্মুখবর্তী। বাংলাদেশে ছোটকাগজ লিরিক-ই প্রথম এই পথ বিনির্মাণ করেছে।
দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময় পেরিয়ে এসেছে লিরিক; চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে পুরো বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চায় জাগরণের ঢেউ তুলেছে। এই দীর্ঘযাত্রায় প্রথম সংখ্যার এক ফর্মা থেকে সর্বশেষ সংখ্যা হাজার পৃষ্ঠার কলেবরে সমৃদ্ধ হয়েছে। কেবল কবিতা দিয়ে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়কে আধেয় করেছে লিরিক। প্রিন্টার্স লাইন কেবল সম্পাদক ও প্রচ্ছদ শিল্পীর উল্লেখের পরিধি ছাড়িয়ে সম্পাদনা পরিষদে উপনীত হয়েছে। অসংখ্য তরুণ রচনার অগ্নিতে শুচি হয়েছে লিরিক-এর সাদা পৃষ্ঠার কালো অক্ষরগুলো। এই ক্রমান্বয়ী অগ্রগামিতায় বিভিন্ন সময়ে অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। নানাভাবে একে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করেছেন। কালের স্বাভাবিক নিয়মে অনেকে হারিয়েও গেছেন। প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানই লিরিককে দিয়েছে আজকের অবয়ব, সুষমা। কারও অবদানই ফেলনা নয়। ছোটকাগজ এই সংঘবদ্ধ শক্তিতেই ক্রমপ্রসারমান থাকে। এই সংঘবদ্ধতাকে সাহিত্যপাড়ায় লিরিক গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাচ্ছেন অনেকে। লিরিক এক্ষেত্রে অনেককেই পেয়েছে সহযোদ্ধা হিসেবে। যাদের মেধাবী ও ধীমান রচনা, সম্পাদকীয় পরামর্শ, নন্দন চেতনা, আর্থিক সহায়তা এবং সর্বোপরী কায়িকশ্রমে লিরিক হয়ে উঠেছে নতুন চিন্তার বাহন। লিরিক-এর উদার জমিনে হাত মকশো করে অনেকেই হয়ে উঠেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পদ। যারা এখনও সাহিত্যিক সৃজনকর্মে ও তৎপরতায় সমান সক্রিয়।
যেদিন লিরিক ছোটকাগজ হিসেবে তার সকল চিহ্নকে ধারণ করে ছোটকাগজের প্রতিষ্ঠিত উদাহরণ হয়ে উঠবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সম্পাদক ঘোষণা দিয়েই সেদিন লিরিক প্রকাশ বন্ধ করে দেবেন। কেন না এ এক একাকী যুদ্ধ। অন্তর্গত রক্তের ভিতরে অযুত জিজ্ঞাসার আগুনে নিজেকে প্রতিনিয়ত পোড়াতে হয়। পুড়িয়ে পুড়িয়ে করে তুলতে হয় বিশুদ্ধ। জিজ্ঞাসার অবসানে অগ্নিরও নির্বাপন ঘটে। যদিও অন্তর্জালের এই বিশাল বিস্তৃতি, ওয়েবজিনের তীব্র ঢেউ, সংযুক্ত বিশ্বের অন্তর্জালিক বাস্তবতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হবার নিজস্ব দেয়ালিকা ছোটকাগজ ছাপানোর প্রাসঙ্গিকতাকেই আজকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক