আল মাহমুদের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্বের জটিল রহস্য উন্মোচন : মো. আবুল কালাম আজাদ

প্রচ্ছদ রচনা
[সার-সংক্ষেপ : অপরিমেয় প্রতিভা, মেধা-পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার দ্বারা আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তিনি মূলত কবি। তবে বাংলাদেশের সাহিত্যের বিবিধ শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল প্রতিভাদীপ্ত ও উজ্জ্বল। বাংলা ছোটগল্পে তিনি ভিন্ন মেজাজের গল্প লিখে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তাঁর ছোটগল্পে মানুষের যাপিত-জীবনের অন্তর্গূঢ় রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। তিনি নর-নারীর মানসিক ও জৈবিক সম্পর্ককে সাহিত্যে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক ও বিলাসবহুল নগরজীবনকে পাশ কাটিয়ে তিনি গ্রামীণ আবহে তাঁর গল্পের প্লট নির্মাণ করেছেন। ফলে বাস্তবতার নিরিখে গল্পগুলো যেন এ দেশের গণমানুষের প্রাত্যহিক জীবনের শিল্পরূপ হয়ে উঠেছে। আল মাহমুদের ছোটগল্পের ভাষা স্পষ্ট, প্রাঞ্জল এবং জীবন্ত। গল্পের বিষয়বস্তুর সাথে রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার ছোটগল্পের ভাবগাম্ভীর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। লেখক আল মাহমুদের চেতনায় মিস্টিক ভাব-দর্শন কাজ করত; যা তাঁর ছোটগল্পের নায়ক বা নায়িকা চরিত্রে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।সূচকশব্দ : বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, সমাজতত্ত্ব, সুররিয়ালিজম, লিবিডোচেতনা, মনোবীক্ষণ, কথাসাহিত্য, প্রতীকীব্যঞ্জনা।]
এক
সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ যখন নিজের মনের ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করা শুরু করেছে; মূলত তখন থেকেই গল্পের শুরু। তবে লিখন পদ্ধতি এবং কথা ধরে রাখার সুনির্দিষ্ট কাঠামো আবিষ্কৃত না হওয়ায় মানুষের সেই আলাপচারিতাকে গল্প না বলে ‘প্যাঁচাল’ বলা হতো। তাই প্রাচীন এবং মধ্যযুগে ‘প্যাঁচালী’ বা ‘কথোপকথন’ জাতীয় রচনার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন : সত্যপীরের পাঁচালী, মনসাদেবী বা বিষহরির পাঁচালী ইত্যাদি। ‘গল্প বলার ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন। যাযাবর মানুষের মনে প্রথম যেদিন কথার অঙ্কুর দেখা দিয়েছিল,―সেই কথাকে যেদিন তারা রূপ দিতে পেরেছিল ভাষার মধ্যে,―মানুষের গল্প বলার আকাক্সক্ষা সেই আদিম দিনের। তারপরে মানুষের নন্দন সাধনায় গল্প রচনা ও গল্পের বাসনা দিনে দিনে একাগ্র হয়েছে। আজও গল্প সাহিত্যের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি ও ব্যাপক।’ (চৌধুরী, ২০২১-২২ : ৩) কথাসাহিত্য আধুনিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যধারা। কথাসাহিত্য বলতে সাধারণত গদ্যে লেখা ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ-কাহিনিকে বোঝানো হয়। একজন লেখক তাঁর সমসাময়িক সমাজবাস্তবতা ও প্রতিবাস্তবতা নিয়ে সাহিত্য রচনা করেন। তাই ‘লেখকের মনের মধ্যে সমাজ-জীবন-কল্পনা-রূপ প্রভৃতি বোধ খেলা করে, নানাভাবে নিজ নিজ উপাদান যোগায়, লেখা তৈরি হয়ে ওঠে। পাঠকও শিল্পের আনন্দ, জীবনের জিজ্ঞাসা, কল্পনার রঙ ও মোহ, ইতিহাসের সত্য, সমাজের স্পন্দন পায় এবং পেতে চায়। লেখক এবং পাঠকÑদু-পক্ষ এই তৈরির বা প্রাপ্তির ব্যাপারে সর্বদা সচেতন নাও থাকতে পারে।’ (গুপ্ত, ১৯৮৬ : ১) তবে ‘সাহিত্য ও শিল্পের উপজীব্য চিরকালই মানুষ। মানুষের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক জগত; মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, ব্যথা-বেদনা ও জীবন যাত্রার গানই শিল্প-সাহিত্য। সব যুগের সৃজনশীল শিল্পীরা তাই তাঁদের সৃজনকর্মে মানুষের জয়গানই গেয়ে এসেছেন। সে জয়গানের কোনও কোনওটির সুর কালেজ-কালোত্তীর্ণ, আবার কোনওটি বুদবুদের মত ক্ষণস্থায়ী।’ (মান্নান, ২০০৭ : ১২১) সংজ্ঞার্থ ও সমাজতত্ত্বের ভিত্তিতে ছোটগল্পের মূল্যায়ন সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :
বিশেষভাবে ছোটগল্পে সমাজতত্ত্বঘটিত সমস্যাই আমাদের বর্তমান আলোচ্য। কথাসাহিত্যÑউপন্যাস বা ছোটগল্প যা-ই হোকÑজীবনকে বাস্তবতায়, সামাজিক সম্পর্কে প্রকাশ করতে চায়। ফলে, কথাসাহিত্যে সমাজসত্যের নানাদিকের সরাসরি প্রতিফলন তো ঘটেই, কখনও পরোক্ষ নানা পরিচয়ও রচনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। শিল্পস্বাদের বিচারে ছোটগল্প আর উপন্যাসে যত পার্থক্য থাক না, সমাজজীবনের ভাষ্য একই ধাঁচে এদের মধ্যে ধরা থাকে, সবটা না হলেও অনেকটা তো বটে। … এর পরেও ছোটগল্পের নিজস্ব কিছু বলার থাকে। ছোটগল্পের জাত আলাদা, স্বাদ আলাদা, জীবনকে ধরবার মুঠিটি ছোট, কিন্তু আঁটো। রচনার বিষয় চয়নে সেখানে লেখক অনেক বেশি স্বাধীন, বিস্তৃত ও বস্তুনিষ্ঠ সমাজভূমিকা তৈরির সুযোগ যদিও অনেক কম। সেখানে মানুষকে পুরো ধরে দেবার চেষ্টা নেই, কাহিনিকে বিকশিত করে বৃত্তের পূর্ণতায় বা একটা পথের প্রান্তে এসে থামার গরজ নেই। চকিতে কোনও চরিত্রের অংশমাত্র দীপ্ত হয়ে ওঠে, ঘটনায় একটা চূড়ান্ত বিন্দুতে আবেগ টলমল করে, হঠাৎ কাহিনির ওপরে পর্দা নেমে আসে, অভাবিত কোনও কোণ থেকে আলো এসে পড়ে, লুকানো কোনও রহস্য আবিষ্কৃত হয়ে পাঠকের গড়ে ওঠা বোধকে বিপর্যস্ত করে। বিশেষ আকার আর স্বভাবের জন্য ছোটগল্পের সমাজতত্ত্বের সন্ধানীকে সতর্ক হতে হয়, কিছু স্বতন্ত্র হতে হয়Ñএর বাড়তি সুযোগ এবং সীমাবদ্ধতার কথা মনে রাখতে। (গুপ্ত, ১৯৮৬ : ১০-১৫)
দুই
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)- এর হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের পথ চলা শুরু হয়। রবীন্দ্রনাথকে তাই বাংলা ছোটগল্পের জনক এবং প্রধান কারিগর বলা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্পকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে পৌঁছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গল্পে নর-নারীর প্রেম, ব্যর্থতা, হতাশা, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমস্যা, কুসংস্কার-অসংগতি, জাতিভেদ-প্রথা, ধনী-গরিবের ব্যবধান, শোষণ-নির্যাতন, মানুষের মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়কে গল্পের অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রযুগে অন্যান্য ছোটগল্পকার হলেন, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৪-১৮৮৯), প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮), ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩-১৯৬০), অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১), জগদীশ গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৩৮), প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (১৮৯০-১৯৬৪) প্রমুখ। প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৪-১৯৪৬), রাজশেখর বসু ওরফে ‘পরশুরাম’ (১৮৮০-১৯৬০) ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমসাময়িক গল্পকার। বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব ও বিকাশ পর্বের প্রথম পর্যায়ে উপরোক্ত গল্পকারগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ পর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রধান গল্পকার। তাঁর ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত সব গল্পকারদের সাথে তুলনীয়।
রবীন্দ্র-উত্তর যুগে কল্লোল (১৯২৩), কালিকলম (১৯২৬), প্রগতি (১৯২৭), কবিতা (১৯৩৫) প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুন ধারার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। এ-সময়ের সাহিত্যে লেখকদের মধ্যে ভিন্নধারার মত ও সাহিত্য-দর্শন লক্ষ করা যায়। কল্লোল পত্রিকায় লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত একদল লেখক নিয়ে ‘কল্লোলগোষ্ঠী’ নামে নতুন একটি সাহিত্যসংঘের উদ্ভব হয়; যাঁরা চিন্তাচেতনায় ছিলেন আধুনিক তবে মননচেতনায় নৈরাশ্যবাদী। তাঁদের লেখায় একদিকে যেমন কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, মার্কসবাদী দর্শন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, লিবিডোচেতনা ও ফ্রয়েডীয় চিন্তাধারা প্রকাশ পায়, অন্যদিকে তেমনি আধুনিকতাবাদের সঙ্গে প্রকাশিত হতে থাকে ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম, ইমেজিনিজম, সুররিয়ালিজমের মতো দর্শন ও নানা সাহিত্য-অনুষঙ্গ। এ-সময় বাংলা সাহিত্যে তিন শক্তিমান গদ্যকারের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা হলেন : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) প্রমুখ। প্রতিভা-মেধা ও লেখনীশক্তির দ্বারা তাঁরা বাংলা ছোটগল্পকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়। তাঁদের গল্পে সমাজের উঁ”ু তলা থেকে শুরু করে নিম্নবর্গের ডোম, মুচি, মেথর, চণ্ডাল, ধোঁপা, কারিগর, কৃষক, শ্রমিক, কুলি, মজুর, মুটে পর্যন্ত সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের কথা স্থান পেতে থাকে।
তিন
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এ দেশের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের কথা নতুন করে মনে করে দেওয়ার কিছু নেই। এ-সময় কল্পনার চেয়ে বাস্তবের রূঢ়-খরখরে জীবনের চিত্ররূপ সাহিত্যে উঠে আসতে থাকে। তিরিশের দশকে তুখোড় প্রতিভাবান, পড়াশোনায় মেধাবী ও শিল্পচৈতন্যে আধুনিক একদল সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে। তাঁরা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-প্রতিভাকে উহ্য রেখে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা ও ফর্ম নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে থাকেন। একদিকে বিদ্রোহের ঝান্ডা, অন্যদিকে প্রেম ও সাম্যের মর্মবাণী হৃদয়ে ধারণ করে উল্কার মতো আসেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে প্রতিভার সবচেয়ে বেশি বিচ্ছুরণ ঘটালেও তিনি কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন। রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার করে সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি পত্রিকায় আধ-পাতা, এক পাতার ছোটগল্প নিয়ে হাজির হলেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে ‘বনফুল’ (১৮৯৯-১৯৭৯)। বনফুলের গল্পগুলো ক্ষুদ্র হলেও মানুষের জীবনের গভীরতর তাৎপর্য তুলে ধরতে গল্পগুলো পারঙ্গম ছিল। তৎকালীন কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বাংলা ছোটগল্পে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৯০১-১৯৭৬), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), সুবোধ ঘোষ (১৯০৯-১৯৮০) নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০), অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-১৯৯৫) ও মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-১০১৬) প্রমুখ।
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। ’৪৭-র দেশভাগ ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। শুধু ধর্মের ঐক্যের কারণে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের সাথে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হয়। এ-সময় বাঙালির মনে নিজস্ব কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিকচেতনা দানা বাঁধতে থাকে। তৈরি হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ। চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বাঙালি ছোটগাল্পিকদের মধ্যে রয়েছেন : মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৬), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৮-১৯৭৯), কাজী আব্দুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭৪), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-২০০০), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩), মাহবুবুল আলম (১৯০৮-১৯৮১), অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪-১৯৫১), আবু রুশ্দ (১৯১৯), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৯-১৯৭৫), সোমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪২), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন সবচেয়ে বেশি নিরীক্ষাধর্মী ও শিল্পসফল কথাসাহিত্যিক। তাঁর নয়নচারা, দুই তীর ও অন্যান্য ছোটগল্পগ্রন্থ দুটি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অমূল্য সংযোজন।
পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষ থেকে বাঙালির জাতীয় জীবনের ওপর প্রথম অভিঘাত আসে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা ‘বাংলা’কে বাদ দিয়ে সংখ্যালঘুর ভাষা ‘উর্দু’কে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে বাংলার দামাল ছেলেরা গর্জে ওঠে। তাঁরা জান দেবে কিন্তু মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবে না। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘ভাষা আন্দোলন’ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিউল প্রমুখের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ-সময়ে নর-নারীর প্রেম, ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, অভাব, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, জাতীয়তাবাদের উত্থান প্রভৃতি বিষয় লেখকদের গল্প রচনার প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এ পর্বে যারা গল্প লিখেছেন তাঁরা হলেন : ইব্রাহীম খাঁ (১৮৯৪-১৯৭৮), মাহবুব-উল-আলম (১৮৯৮-১৯৮১), সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১), আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮), সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬), আবু রুশদ (১৯১৯-২০১০), মিরজা আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৮৪), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১), শাহেদ আলী (১৯২৫-২০০১), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-১৯৯৭), আশরাফ সিদ্দিকী (জন্ম : ১৯২৭), মিন্নাত আলী (জন্ম : ১৯২৭), জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪), শহীদ সাবের (১৯৩০-১৯৭১), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), শওকত আলী (১৯৩৬-২০১৮) প্রমুখ।
পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধ থেকে শুরু করে সমগ্র ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের আকাক্সক্ষা যেমন প্রবলতর হয়ে ওঠে, তেমনি তার ওপর নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক শক্তির নির্মম অত্যাচার আর সীমাহীন বর্বরতা। এই অবরুদ্ধ সময়ের চাপে জর্জরিত রূঢ় জীবন বাস্তবতার মধ্যে লেখকেরা ভিন্নতর আঙ্গিক সন্ধানে ব্যস্ত থাকেন। ফলে ষাটের দশকের ছোটগল্পকাররা সময়ের বাস্তবতায় নিরীক্ষার আড়ালে প্রতিবাস্তবতাকে নির্মাণ করেছেন তাদের গল্পের পরোক্ষ অনুষঙ্গ হিসেবে। ষাটের দশকে বাংলাদেশের ছোটগল্প শিল্প-অন্বেষায় আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়। এ সময় আনোয়ার পাশা (১৯২৮-১৯৭১), আহমদ রফিক (জন্ম: ১৯২৯), হুমায়ুন কাদির (১৯৩২-১৯৭৭), জহির রায়হান (১৯৩৩-১৯৭২), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১৯৩৪-২০২২), বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬-২০২০), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫ – ২০১৬), শওকত আলী (১৯৩৬ – ২০১৮), আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ (১৯৩৮-২০২৩), হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১), রিজিয়া রহমান (১৯৩৯-২০২৯), জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (জন্ম : ১৯৩৯), বিপ্রদাস বড়ুয়া (জন্ম: ১৯৪০), আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), সেলিনা হোসেন (জন্ম : ১৯৪৭) প্রমুখ গল্পকারের ছোটগল্পের বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্পচৈতন্যে স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। এ-সময়ের গল্প ও গল্পকার সম্পর্কে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণীয় :
… তারা ছিলেন প্রবলভাবে জীবনবাদী ও সমাজসংলগ্ন। তাঁদের গল্পের বিষয়ে যেমন দেশবিভাগ পূর্বকালের জীবনচিত্র রূপায়িত তেমনি আছে বিভাগ পরবর্তী কালের। উদ্বাস্তুসমস্যা, মন্বন্তর, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দাঙ্গা ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা গল্প লিখেছেন, তবে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের গ্রামজীবন। গ্রামের বা শহরের যে ধরনের বিষয় তখনকার গল্পকারেরা অবলম্বন করুন না কেন, গল্পে যাপিত জীবনের সংকট ও সমস্যার আলেখ্যই তাঁরা রচনা করেছেন। কোনো কোনো শিল্পীর রচনায় শ্রেণিসংগ্রামও প্রমূর্ত হয়েছে। (আহমদ, ১৯৮৮ : ৩৮)
’৭১-র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ, পাক-বাহিনীর নারকীর অত্যাচার, নারী নির্যাতন, নির্বিচারে নর-নারীর হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন প্রভৃতি অনুষঙ্গের বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর নানা ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা গল্পগুলো এ-সময় পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। লেখকেরা মনের আনন্দে বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রীক নানা সমস্যা ও তার সামূহিক সমাধান কল্পনা করে গল্প লিখে তা প্রথাবদ্ধ ফ্রেমে শৈল্পিকরূপ দিতে থাকেন। এ ধারার লেখকের মধ্যে কেউ কেউ ব্যতিক্রম ছিলেন। যাঁরা বাঙালির অতীত ঐতিহ্যের সূত্র ধরে বর্তমানের মধ্যে সাযুজ্য বিধানের চেষ্টায় সমাজের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। বাংলাদেশের সমাজতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ ভূখণ্ডে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে উচ্চবিত্ত তেমন নেই, তবে কেউ কেউ মধ্যবিত্ত; কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই নিম্নবর্গের শ্রেণিচরিত্র। তারা হাজার বছর ধরে নিজেদের মনন ও চৈতন্যে এ দেশের চিরায়ত সংস্কৃতি ধারণ করে বসবাস করছেন। তাই নব্য বাংলাদেশি লেখকদের অনেকের গল্পে উঠে আসতে থাকে চিরায়ত বাংলার লোকজসমাজ তথা কৃষক-শ্রমিক, মুটে-মজুর-কুলি, মেথর, ধোপা-ডোমসহ সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী নানা পেশাজীবী মানুষের মর্মন্তুদ জীবন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এদেশের গল্পকারদের বিষয়বৈভবের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আসে। সমালোচকের মন্তব্য :
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আদিবাসীগণ এই সময়ের ছোটগল্পে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। কোনো কোনো গল্পকার এদের জীবন ও অবস্থানের নৃতাত্ত্বিক ও অধুনাতম অনুপুঙ্খ পরিচয় জেনে নেয়ার জন্য দীর্ঘ সময় এদের সঙ্গে বসবাস করছেন। ফলে অনিবার্যভাবেই ছোটগল্প লাভ করেছে নির্মোহ এক বাস্তবতার সৌন্দর্য। এমন সব প্রতীক, রূপকল্প, প্রত্নকল্প তারা ব্যবহার করেছেন যা একান্তই নতুন। রীতির ক্ষেত্রটিও প্রথাগতের বাইরে এসে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য লাভ করতে চাইছে। ভাষিক বয়ন ক্রমেই পৌঁছে যাচ্ছে গল্পের পাত্র-পাত্রীদের জীবনে। ফলে গল্পে এক ধরনের কাঠিন্য অনুভূত হলেও যথার্থতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ছে এবং সর্বোপরি জীবনের প্রতি গভীর এক মমত্ববোধ এই সব গল্পের প্রাণের পরিচয় হয়ে উঠেছে। (আবদুল মান্নান, ২০০৭ : ১৭৭)
স্বাধীনতা-উত্তর নিরুত্তাপ সময়, সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে সমস্ত কথাসাহিত্যিক ও ছোটগাল্পিক বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন তাঁরা হলেন : কাজী ফজলুর রহমান (জন্ম : ১৯৩১), আবুবকর সিদ্দিক (১৯৩৬-২০২৩), আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন (১৯৩৪-২০০২), মকবুলা মনজুর (১৯৩৮-২০২০), আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯), খালেদা এদিব চৌধুরী (১৯৩৯-২০০৮), নাজমা জেসমিন চৌধুরী (১৯৪০-১৯৮৯), জুবাইদা গুলশান আরা (১৯৪২-২০১৭), আমজাদ হোসেন (১৯৪২-২০১৮), আবু কায়সার (জন্ম : ১৯৪৫), হুমায়ুন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২), আবুল হোসেন (১৯৪৭-১৯৭৫), জুলফিকার মতিন (১৯৪৬-২০২৫), আরেফিন বাদল (জন্ম : ১৯৪৮), বুলবুল চৌধুরী (১৯৪৮-২০২১), শান্তনু কায়সার (১৯৫০-২০১৭), আফসান চৌধুরী (জন্ম : ১৯৫২) প্রমুখ যশস্বী ছোটগল্পকার।
বর্তমান সময়ে যেসব গল্পকার গল্প লিখে বাংলাদেশের ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : তাপস মজুমদার, সৈয়দ ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আতা সরকার, আবু সাঈদ জুবেরী, মঞ্জু সরকার, হরিপদ দত্ত, আহমদ বশীর, মুস্তফা পান্না, সিরাজুল ইসলাম, জাফর তালুকদার, সেলিম রেজা, কাজী শামীম, মঈনুল আহসান সাবের, ইসহাক খান, এহসান চৌধুরী, ইমরান নূর, সুশান্ত মজুমদার, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হারুন হাবীব, ভাস্কর চৌধুরী, বিপ্লব দাশ, ইসমাইল হোসেন, মহিবুল আজিজ, নকীব ফিরোজ, মোহিত কামাল, নাসরীন জাহান, জাকির তালুকদার প্রমুখ। বাংলা ছোটগল্প প্রায় দেড়শ বছরের যাত্রাপথ অতিক্রম করলেও এ ধারায় সার্থক গল্প ও গল্পকারের সংখ্যা নেহাতই কম। উপরন্তু, বিভাগোত্তর কালে ভৌগোলিকভূখণ্ড বিভক্ত হওয়ার ফলে মানুষের চিন্তাচেতনাতে দ্বিখণ্ডিতা ও দ্বিধাগ্রস্তের ছাপ পড়েছে। ছোটগল্পের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নিম্নোক্ত মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য :
বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে সত্য প্রতিষ্ঠা পায়, তা এই যে, আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় ছোটগল্প দাবি করতে পারে গৌরবের আসন। তবে বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় বঙ্গÑউভয় ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ ছোটগাল্পিকের অবির্ভাব এখন ক্বচিৎ-কদাচিৎ। ইতঃপূর্বে যাঁরা ভালো গল্প লিখেছেন, তাঁরা অনেকেই, হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। প্রবীণরা, অনেকেই পূর্বে-লেখা গল্পগুলো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে …নতুন ভাষ্যে করছেন উপস্থাপন। (ঘোষ, ২০০২ : ১৯৬-১৯৭)

চার
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক আলোকিত কবি আল মাহমুদ। সম্ভবত কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ও পল্লিকবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)-এর পরে বাংলা কবিতায় গ্রামীণ জীবন ও প্রান্তিক মানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রামের সার্থক মেলবন্ধন হয়েছে আল মাহমুদের কবিতায়। আল মাহমুদের কবিতার প্রধান বিষয় হচ্ছে নর-নারীর প্রেম। এছাড়া তাঁর কবিতায় স্বদেশবোধ, প্রকৃতি, যৌনপ্রবৃত্তি এবং বিবেকের দ্বৈরথ, সৃষ্টিতত্ত্ব ও রহস্য, অধ্যাত্মবাদ প্রভৃতি বিষয় চমৎকারভাবে স্থান করে নিয়েছে। কবিতায় শৈল্পিকভাবনা, শব্দ-ছন্দ-চিত্রকল্প ও বিষয়বস্তুর অপূর্ব সমন্বয়, ভাষার কারুকার্য এবং এ অঞ্চলের মানুষের নিখুঁত জীবনাচারণ তাঁর কবিতায় অবিকৃতভাবে ফুটে উঠেছে।
‘আল মাহমুদের প্রথম প্রকাশিত রচনা ‘বেপরোয়া’ নামক একটি ছোটগল্প। এটি কলকাতার সত্যযুগ পত্রিকায় তাঁর ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত হয়। এর পরে কিছু গল্প লিখলেও মুখ্যত তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন।’ (বানু, ২০০০ : ২০২) লোক লোকান্তর (১৩৭০), কালের কলস (১৩৭৩), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৪) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের বহুল পঠিত ও জনপ্রিয় কবিতাগুলোর মাধ্যমে আল মাহমুদ তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ও নিজের জাত চেনাতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতায় প্রাজ্ঞ হলেও আল মাহমুদ কেবল কবিতা রচনার মধ্যেই সীমবদ্ধ থাকেননি। সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। বাংলাভাষার একজন পাঠকনন্দিত কথাসাহিত্যিক হিসেবে আল মাহমুদের আসন পাকাপোক্ত। বিষয় নির্বাচন ও চরিত্র-চিত্রণের ক্ষেত্রে আল মাহমুদের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর আলোচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে দিন যাপন (১৯৯০), ডাহুকী (১৯৯২), উপমহাদেশ (১৯৯৩), কাবিলের বোন (১৯৯৩), কবি ও কোলাহল (১৯৯৩) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আল মাহমুদের প্রথম ছোটোগল্প সংকলন পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫)। এরপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮৩), গন্ধবণিক (১৯৮৬), প্রেমের গল্প (১৯৯১), ময়ূরের মুখ (১৯৯৪), আল মাহমুদের গল্প (১৯৯১), গল্পসমগ্র (১৯৯৭) প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ। আল মাহমুদের জনপ্রিয় গ্রন্থের মধ্যে পাখির কাছে ফুলের কাছে (১৯৮০) সর্বজনপঠিত ও আলোচিত একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। আলোচ্য প্রবন্ধে আমাদের অন্বিষ্ট কথাশিল্পী আল মাহমুদের ছোটগল্প বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপের সন্ধান করা।
পাঁচ
জীবনের এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ পরিচর্যা থেকে আল মাহমুদ তাঁর গল্পগুলো রচনা করেছেন। নর-নারীর প্রাত্যহিক জীবন, চেতনাপ্রবাহ, লিবিডো তাড়না ও মানসিক টেনশন আল মাহমুদের গল্পের প্রধান অনুষঙ্গ। অভিনব বিষয়বস্তু, রচনারীতির বৈচিত্র্য, সার্থক চরিত্র-চিত্রায়ণ, বর্ণনাভঙ্গির কুশলতায় আল মাহমুদের ছোটোগল্প যেন গণমানুষের প্রতিদিনের চালচিত্রে পরিণত হয়েছে। গ্রাম-বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষ, খেটে খাওয়া গার্হস্থ্য জীবন ও মধ্যবিত্তের প্রতিচিত্র তাঁর ছোটোগল্পের উপজীব্য বিষয়। “আল মাহমুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত ঢাকার বর্ণমিছিল প্রকাশনী থেকে ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। পাঁচটি ছোটগল্প এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। যথা : ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘কালো নৌকা’, ‘রোকনের স্বপ্নদোলা’, ‘জলবেশ্যা’ ও ‘বুনো বৃষ্টির প্ররোচনা’ ইত্যাদি। উল্লেখ্য, আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত গল্পগ্রন্থের ‘কালো নৌকা’ গল্পটি ফ্রান্সে অনূদিত হয়েছে। ‘এশিয়া ওশেনিয়া’ নামক আন্তর্জাতিক সংকলনে স্থান পেয়েছে ‘কালো নৌকা’ গল্পটি। এ সংকলনে বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই একটিমাত্র গল্প।” (রসুল, ২০২৩ : ১০৫-১০৬)
ছয়
আল মাহমুদের প্রথম গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫)। এ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘পানকৌড়ির রক্ত’। এটি একটি প্রতীকী গল্প। এ গল্পের কথক আনোয়ার। যার ডাকনাম আনু। উত্তম পুরুষের জবানিতে লেখা গল্পটিতে লেখক পানকৌড়ি তথা ধনেশ পাখি শিকারের অনুষঙ্গে সদ্য বিবাহিত ষোড়শী যুবতী আদিনার রূপ-সৌন্দর্য-কাম ও পুরুষের যৌন চেতনার শিল্পভাষ্য তুলে ধরেছেন। বিবাহের সাতদিনের মাথায় আনু, তার স্ত্রী আদিনা, দুই শ্যালিকা মদিনা ও সখিনাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির সামনে বিস্তীর্ণ বিলের মধ্যে পাখি শিকার করতে যায়। বস্তুত শিকারের প্রতীকী চিত্রকল্পের মধ্যে লেখক তাঁর মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট, মনোবিকলন, মধ্যবিত্তের নানা অনুষঙ্গ এবং নর-নারীর অন্তর্গত লিবিডোচেতনা জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত গ্রন্থের নামগল্পে লেখক প্রতীকী মননে চিত্রায়িত করেছেন নরনারীর যৌন-জীবনের বাস্তবতা। এ গল্পে আদিনা-আনুর লিবিডোতাড়িত যৌনজীবনের রক্তিম অভিজ্ঞতা চিত্রণে একটি শিকার-কাহিনির প্রতীকী পরিপ্রেক্ষিত ব্যবহার করেছেন লেখক। বন্দুকের গুলিতে ধনেশ পাখিকে বিদ্ধ করার প্রতীকে আল মাহমুদ কামতপ্ত আনু কর্তৃক আদিনাকে সম্ভোগ করার চিত্র রূপায়িত করেছেন।’ (বোস, ২০১৬ : ৪৮) ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পে আল মাহমুদ লিখেছেন :
আমি আবার আমার একনলা বন্দুক হাতে ত্রিকোণাকৃতির চরভূমির নরম গুল্মলতায় পা মাড়িয়ে চলতে লাগলাম। নদীটা যেখানে বাঁক নিয়েছে আমি সেখানে এসে পেশাদার শিকারীর মতো হাঁটু গেড়ে বন্দুক বাগিয়ে বসলাম, আমার বসার সাথে সাথে কালো বেলুনের মতো একটা পানকৌড়ি পানির ওপর ভেসে উঠল। আমি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে গুলি ছুড়লাম। গুলির শব্দ আর বন্দুকের পাল্টা ধকলে আমার চোখের সামনে সমস্ত নিসর্গচিত্রটি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আমি দেখলাম, একটি শ্যামবর্ণ নারীশরীর নদীর নীলিমায় আপন রক্তর মধ্যে তোলপাড় করছে। (মাহমুদ, ১৯৯৭ : ১৯)
‘মধ্যবিত্ত নরনারীর হৃদয়গত অনুরাগের কথা উপস্থাপিত হয়েছে আল মাহমুদের ‘পানকৌড়ির রক্ত’ গল্পে। এ গল্পে আনোয়ার-আদিনার অন্তর্জাত অনুরাগের স্পর্শে হয়েছে আলোড়িত, শিহরিত। আনোয়ার-আদিনার অনুরাগ বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে পরিণতি পেয়েছে। ছাত্রাবস্থায় আনোয়ারের বাসায় পারিবারিকভাবে আদিনার আসা-যাওয়া ছিল। আদিনার লাবণ্য, বিনম্র বিচরণ আনোয়ারকে মুগ্ধ করে। অল্প পরিচয় ও স্বল্প সংলাপে উভয়ের ভেতরে সঞ্চারিত হয় মৃদু অন্তর-আকর্ষণ।’ (রহমান, ২০০৯ : ১৩২) সদ্য বিবাহিত আনু শ্বশুরবাড়িতে অবকাশ যাপন করতে এসে বিলের মধ্যে কালো রঙের ধনেশ তথা পানকৌড়ি পাখি শিকার করতে গিয়ে স্ত্রী আদিনার সাথে পাখিটার কোথায় যেন মিল লক্ষ করে। শিকারি হিসেবে আনোয়ার আদিনার সঙ্গে ধনেশ পাখিটির সাদৃশ্য ধরতে না পারলেও প্রেমিক বা স্বামী হিসেবে আনু পানকৌড়ির সাথে আদিনার সাদৃশ্য ঠিকই খুঁজে পায়।
‘একটা বিষয়ে পাখিটার সাথে আমার সাতদিন আগে বিয়ে করা স্ত্রীর একটা মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। সেটা তরতাজা একটা সতেজ ভাব। আদিনা কালো হলেও যেমন তার চামড়ায় সতেজ ভাবটা সবসময় লেগে থাকে, পাখিটার কালো তেলতেলে পালকের মধ্যেও তেমনি ভাবটা দেখেই আমি চিনতে পেরেছি।’ (মাহমুদ, ১৯৯৭ : ৪)
লিবিডোচেতনার বাইরে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এ গল্পে নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের অনুপম পরিচয় পাওয়া যায়। শহরতলির জীবনভাবনা, দি¦তীয় শ্রেণির সরকারি চাকুরি, স্বাভাবিক প্রেম, বিয়ে ও রতিক্রিয়ার প্রকাশভঙ্গিতে ‘পানকৌড়ির রক্ত’ আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম।
যৌনতা হলো এক ধরনের জৈবিক চাহিদা, টান। যা নর-নারীর অবচেতন মনে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এবং সুযোগ পেলেই তা প্রকাশ পায়। যৌনচেতনা প্রকাশের সময় ব্যক্তিমানস, সিদ্ধ-নিষিদ্ধ, পাপ-পুণ্য, মান-অপমানের তোয়াক্কা করে না। আল মাহমুদের পানকৌড়ির রক্ত গল্পগ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘কালো নৌকা’। গল্পটি মানবজীবনের আদিম ও অকৃত্রিম আকর্ষণ ও লিবিডোচেতনার নতুন মাত্রা নির্মাণ এবং সৌন্দর্যচেতনার নানা অনুষঙ্গ নিয়ে রচিত হয়েছে। তবে গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে নর-নারীর শারীরিক আকাক্সক্ষা। গল্পকার এ গল্পে যৌনতাকে বিশেষ আবহে প্রকাশ করেছেন। একমাত্র সন্তান দামোদরের মৃত্যুর পর পিতা রাসুর সঙ্গে পুত্রবধু কালীর সমাজবহির্ভূত জৈবিক সম্পর্কের শিল্পরূপ ‘কালো নৌকা’। আল মাহমুদ অত্যন্ত প্রাজ্ঞ শিল্পীর মতো রাসু জলদাস ও তার পুত্রবধূ কালীর জৈবিকতাড়নাকে একসূত্রে গেঁথেছেন। ‘কালো নৌকা’ গল্পে কালীর শরীরের গন্ধ, চুলের গন্ধ, সাগরজলের নোনাগন্ধ এবং শ্বশুর-পুত্রবধূর লিবিডোতাড়নাকে শৈল্পিক বুননে লেখক সফল করে তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে গল্পকার লিখেছেন :
আমিই দামোদর, আমার দিকে দেখ কালী। দামোদরকে আমিই জন্ম দিয়েছিলাম। সে তো আমার মতোই ছিল কালী, আমিই ছিলাম। আরও কাছে আয় কালী। … ‘তুই সতী, তুই সতী, তোর বুকে আমার সতীর গন্ধ। তুই সতী হয়ে যা কালী।’ রাসুর শক্ত বাহুর প্রেষণে কালী একবার শুধু অস্পষ্টভাবে আওয়াজ তুলে উচ্চারণ করলো, ‘দামোদর’। (মাহমুদ, ১৯৯৭ : ৩১)
কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ তাঁর ‘রোকনের স্বপ্নদোলা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রোকনের মধ্যে স্বপ্নচৈতন্য সৃষ্টি করে ম্যাজিক-রিয়ালিজমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ গল্পে রোকন যেন যাপিত জীবনের সমস্ত রেশ থেকে ছুটি নিয়ে সর্বদা কামনাজর্জর অন্তরভাবনায় নিমগ্ন থাকে। কলেজ অধ্যাপক রোকন সস্ত্রীক কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনযোগে চট্টগ্রাম যাত্রাকালে ট্রেনের কামড়ায় অলৌকিক ও বিস্ময়কর সব ঘটনার মুখোমুখি হন। ট্রেনে স্ত্রীর পাশে বসা অপরিচিত এক ভদ্রমহিলাকে রোকনের চেনা ও পরিচিত মনে হতে থাকে। রোকন তখন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তার মানসলোকে ভেসে ওঠে নূরজাহান, আরতি, কুসুমসহ আরও অনেক চেনা মুখ। এ প্রসঙ্গে গল্পকার মাহমুদ লিখেছেন :
রোকন মনে মনে বলল, এখন তোমাকে আমার ভালো লাগছে। তোমার চোখ আভাময় হয়ে উঠেছে। তোমার ঠোঁট দৃঢ়তার বদলে কামনায় কাঁপছে। … তোমার মাংসের মধ্যে যে ঢেউ বইছে তা কি আর ঐ শেওলার ব্লাউজের আড়ালে চেপে রাখতে পারছ? না, পারছ না। তোমার মাংসের দুটি ঢেউ আমি দেখতে পাচ্ছি। এখন তোমাকে আমার ভালো লাগছে। রোকেয়ার চেয়ে ভালো। আরতি, নূরজাহান, কুসুমের চেয়ে ভালো। (মাহমুদ, ১৯৯৭ : ৪১)
আল মাহমুদ তাঁর ‘জলবেশ্যা’ গল্পে বেহুলা-লখিন্দরের সনাতন মিথকে ভেঙে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চেয়েছেন। এ গল্পে বেদে-নারী বেহুলা কর্তৃক এলাকার সম্ভ্রান্ত পুরুষ আবিদ বেপারীকে শিকার, হত্যা এবং অর্থ-সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ‘জলবেশ্যা’ গল্পে দেখা যায়, নারীসঙ্গমের প্রতি আবিদ ব্যাপারীর প্রচণ্ড আকর্ষণ। বেদেপাড়ার বেহুলার রূপ তাকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে। বেউলাকে আপন করে কাছে পাওয়ার নেশা ব্যাপারীকে অস্থির করে তোলে। তাই একরাতে পাড়ার সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবিদ ব্যাপারী নৌকা ভাসিয়ে দেয় বেদে বহরের দিকে। ‘সমগ্র বেদে বহর যখন আলো নিভিয়ে নিদ্রামগ্ন তখন জলবেশ্যার নৌকা জেগে থাকে নিশ্চল কালো চোখের মতো। সেখানে বেহুলা সুন্দরী তার দেহের পসরা সাজিয়ে অপেক্ষমাণ। আবিদ নির্ভয়ে বেউলাকে সুখ সম্ভোগের প্রস্তাব দেয়। বেউলার রূপসুধা পান করার জন্য আবিদ ব্যগ্র হয়ে ওঠে।’ (রসুল, ২০২৩ : ৯৬) গল্পকার আল মাহমুদ বেউলার রূপ-সৌন্দর্য সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন :
পেট আর বুক দিয়ে হাঁটু আর উরতের ওপর চেপে বসায় পেছন থেকে তার পিষ্ট স্তন দুটির ফুলে ওঠা পর্যন্ত আবিদ ব্যাপারী লোভাতুরের মতো দেখতে লাগল। যেন কোনো নায়রী নাওয়ের বালক মেঘনার বুকে আঁত্কে ভেসে ওঠা গাঙশুশুকীর সুডৌল বুকের এক অংশ দেখে ফেলে অবাক হয়ে মনে মনে ভাবছে, অমা মাছেরও আবার বুনি আছে। (মাহমুদ, ১৯৯৭ : ৫৯)
আবিদ ব্যাপারীর অতৃপ্ত কামনা পূর্ণ হওয়ার আগেই বেউলা নৌকার ছইয়ে ঝোলানো বিষাক্ত কালনাগিনী সাপের ঝুড়িটি তার নগ্ন পা দিয়ে ঠেলে খুলে দিলে মুহূর্তে একটি কালসাপ বের হয়ে এসে আলিঙ্গনাবদ্ধ ব্যাপারীকে ছোবল দিয়ে বসে। ক্ষণকাল বিলম্ব না করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আবিদ ব্যাপারী। বেদেনী বেউলা তখন সুযোগ বুঝে টাকার থলেটি হাতিয়ে নেয়। লাশটাকে কায়দা করে একটা জেলে নৌকার উপর রেখে প্রেম-পসারিণী বেউলা তখন নতুন খদ্দের ধরার উদ্দেশে পাড়ি দেয় অন্য ঠিকানায়। আলোচ্য গল্পে গল্পকার বেউলা ও আবিদ ব্যাপারীর দেহকামনায় জর্জরিত করার প্রয়োজনে নানা প্রতীক ও অলংকার ব্যবহার করেছেন। ‘সাপ’ সেখানে অন্যতম একটি কামনার অনুষঙ্গ। এছাড়া গল্পটিতে চরিত্রগুলোর মুখে প্রয়োজন অনুযায়ী আঞ্চলিক ভাষার সার্থক ব্যবহার করেছেন।
‘বুনোবৃষ্টির প্ররোচনা’ গল্পে কলেজের অধ্যাপিকা মরিয়মের অনুপস্থিতিতে তার স্বামী মাহমুদ বাড়ির গৃহপরিচারিকা জমিলার প্রতি প্রবল কাম-আসক্তি অনুভব করে। এক বৃষ্টির দিনে বাড়ির প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যস্ত গৃহপরিচারিকার সুঠাম দেহ আর স্তনযুগলের ঝলকানি দেখে মাহমুদের মনে যৌন-উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ গল্পে মধ্যবিত্ত যুবকের চিত্তবৈকল্যের পরিচয় উন্মোচিত হয়েছে। বর্ষণস্নাত দিনে গল্পের নায়ক মাহমুদের মনে অতৃপ্ত কামনার অনুভূতি সৃষ্টি হলে গৃহপরিচারিকা জমিলা যেন তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ভেজা শরীরে গৃহকর্মী জমিলাকে মাহমুদের কাছে অনিন্দ্য সুন্দরী মনে হয়। বিশেষ করে তার ভরা যৌবনা নারীদেহের আকর্ষণ মাহমুদের মনে লিবিডোভাবনায় ঝংকার তোলে। তবে জমিলার ‘শরীরে কামজ ক্লেদের আবরণ থাকলেও মনের শুচিতায় সে পূর্ণ মানবীতে পরিণত হয়েছে।’ (রসুল, ২০২৩ : ৯৮) নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ কাঠামোয় গৃহপরিচারিকাদের গৃহস্বামী কর্তৃক লালসার শিকার হওয়া নতুন কোনও বিষয় নয়। পৃথিবীর সব দেশের সমাজতাত্ত্বিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এ প্রবণতাটির অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। আমাদের দেশেও প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকা খুললে এ ধরনের উদাহরণ অহরহ চোখে পড়ে। পেটের দায়ে, জীবনের নির্মম বাস্তবতা স্বীকার করে নারীরা অন্যের গৃহে কাজ করতে যায়। বাস্তবে সে-সকল কাহিনি আরও নির্মম ও হৃদয়বিদারক। মান-সম্মান আর লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েরা সব ঘটনা লাইম লাইটে আনেন না। ঘটনার আড়ালে লুকিয়ে থাকে আরও কত-শত নতুন কাহিনি। কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষ কর্তৃক নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হেনস্থা, ইভটিজিং-এর শিকার হন। ‘বুনোবৃষ্টির প্ররোচনা’ গল্পের লেখক আল মাহমুদ নেতির মধ্যে ইতিবাচক সদার্থক ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। গল্পে গৃহকর্মী জমিলা গৃহস্বামী মাহমুদের হৃদয়ে কেবল লালসা নিবৃত্তির পাত্রী হয়েই থাকেনি বরং লেখকের বর্ণনায় সে লাস্যময়ী নারী অবয়বে পরিপূর্ণা মানবীতে পরিণত হয়েছে। এখানেই গল্পকারের সার্থকতা।
‘আল মাহমুদের রচনায় রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে সমাজতন্ত্র উপস্থাপিত হলেও গ্রামীণ জীবনযাত্রা ও লোকজ ঐতিহ্যের সফল রূপকার হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। তাঁর কবিতায় আঞ্চলিক শব্দের মানানসই ব্যবহারও তাকে কাব্য সাহিত্যে স্মরণীয় করে তুলেছে। জসীমউদ্দীন বা জীবনানন্দ দাশের প্রতিধ্বনি বা প্রতিচেতনা নয় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়েই তিনি উপস্থিত হয়েছেন বাংলা কাব্যাঙ্গনে।’ (মান্নান, ২০০৭ : ১২১) ‘মানুষের আদিম জৈবকামনার নিরাভরণ চিত্র প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং আবেগী পরিচর্যায় অঙ্কিত হয়েছে আল মাহমুদের ছোটগল্পে। ‘পানকৌড়ির রক্ত’ কিংবা ‘জলবেশ্যা’-র মতো দুঃসাহসী গল্পে কাম-বাসনার পটে মনস্তত্ত্বের জটিলতা উন্মোচনে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন আল মাহমুদ।’ (ঘোষ, ২০০২ : ১৯৫) সমকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আল মাহমুদের এসব ছোটগল্প রচনা অসীম সাহসী পদক্ষেপ বলতে হবে।
সাত
আল মাহমুদের ছোটগল্পের বিষয়ভাবনা ও প্রকরণ সৌকর্য নান্দনিকতার পরিচয় বহন করে। আধুনিক মানুষের জীবনে নানা সংকট ও সম্ভাবনাকে তিনি গল্পের প্লটে সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন। নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনাতেও আল মাহমুদের ছোটগল্প শিল্পোত্তীর্ণ। তাঁর গদ্যভাষা কাব্যিক, গীতল-আনন্দবাদী ও বিবৃতিধর্মী। আল মাহমুদ তাঁর চারপাশের মানুষকে ফটোগ্রাফিক মেমোরির মতো পর্যবেক্ষণ করতেন। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনচৈতন্য বোঝার চেষ্টা করতেন। তাই তাঁর ছোটগল্পে বারংবার নারী, প্রকৃতি, গ্রামীণ গার্হস্থ্যজীবন ও নিম্নবর্গীয় মানুষের রোমান্টিক অনুভূতির প্রতিচিত্র শৈল্পিক রূপ লাভ করেছে। নর-নারীর যৌনজীবনের নানা জটিল দিকগুলোও আল মাহমুদের গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ব্যক্তির ভেতরে প্রতীকী গল্পবয়ানে আল মাহমুদের তুলনা নেই, অসম্ভব মায়াবী এসব গল্পে তিনি যেন জীবনের বহুমাত্রিক রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন।
আকরগ্রন্থ :
মাহমুদ, আল (১৯৯৭)। গল্পসমগ্র-১, অনন্যা, ঢাকা।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :
আবদুল মান্নান, সরকার (২০০৭)। বাংলা কথাসাহিত্য আধুনিকতার কুশীলব, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
গুপ্ত, ক্ষেত্র (১৯৮৬)। রবীন্দ্রনাথ : ছোটগল্পের সমাজতত্ত্ব, পুস্তক বিপণি, কলকাতা।
ঘোষ, বিশ্বজিৎ (২০০২)। বাংলা কথাসাহিত্য পাঠ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
চৌধুরী, শ্রীভূদেব (২০২১-২০২২)। বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প ও গল্পকার, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
বানু, ড. সায়েদা (২০০০)। বাংলাদেশের ছোটগল্পে বাস্তবতার স্বরূপ, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা।
বোস, চঞ্চল কুমার (২০১৬)। বাংলাদেশের ছোটগল্প জীবনজলধির শিল্প, সুচয়নী পাবলিশার্স, ঢাকা।
মান্নান, ইয়াহ্ইয়া (২০০৭)। আল মাহমুদের উপন্যাস বিষয় ও চিন্তা, প্রীতি প্রকাশন, ঢাকা।
রসুল, মোমেনুর (ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)। ‘আল মাহমুদের ছোটগল্প : ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের আলোকে’, (সৈয়দ আজিজুল হক সম্পাদিত) সাহিত্য পত্রিকা বাংলা-বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
রহমান, মোঃ মুস্তাফিজুর (২০০৯)। বাংলাদেশের ছোটগল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের রূপায়ণ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
লেখক : কবি, কথাকার ও এম.ফিল. গবেষক