অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : শায়েস্তা মহলের পাথর-ফলক : মূল : বানু মুশতাক

কন্নড় থেকে ইংরেজি : দীপা ভাস্তি

ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ : শাহেরীন আরাফাত

কংক্রিটের জঙ্গলের গা ঘেঁষে, যেখানে চকচকে সারি সারি উঁচু ভবন আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে ধোঁয়া ছাড়ছে গাড়ি, হর্ন বাজছে একটানা, দিন-রাত থামছে না যেন, যেন চলাফেরাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সেখানে মানুষ, মানুষ, মানুষ― মানুষে মানুষে নেই ভালোবাসা, নেই বিশ্বাস, নেই বোঝাপড়া, নেই এমনকি স্বীকৃতির হাসিটুকুও। আমি নিজেও সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া ছিলাম। তাই, যখন মুজাহিদ বলল তার ট্রান্সফারের খবর, আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছিলাম।

আচ্ছা, আমি তো ভুলেই গেছি! আপনাদের মুজাহিদের ব্যাপারে কিছু বলাই হয়নি, তাই না? মুজাহিদ আমার ঘরের মানুষ। হ্যাঁ, শুনতে মজার লাগছে। স্বভাবতই বউ ঘরে থাকে, তাই তাকে ঘরের মানুষ বলা হয়। তাহলে মুজাহিদ হলো আমার অফিসের মানুষ। আহা! ভুল হয়ে গেল। অফিস তো আমার নয়, কাজের লোকও নন তিনি। আর কী বলব? যদি তাঁকে ‘যজমান’ বলি, মালিক বলে সম্বোধন করি; তাহলে আমি ‘দাস’ হয়ে যাব, যেন আমি কোনও পশু বা কুকুর! আমি একটু শিক্ষিত, ডিগ্রি অর্জন করেছি। এসব মালিক-দাস সম্পর্ক পছন্দ করি না। তাহলে কি স্বামীকে বলি ‘গন্দ’? কিন্তু এটাও তো ভারী একটা শব্দ, যেন কোনও ‘গন্দন্তর’, মহাতাণ্ডব, আমার অপেক্ষায়। কিন্তু এত ঝামেলা কেন? কেউ বলতে পারেন, আমি স্বামীর জায়গায় ‘পতি’ শব্দটা ব্যবহার করি? কিন্তু কোনও বউ তো স্বামীকে পরিচয় করিয়ে দেয় না―‘উনি আমার পতি’ বলে, তাই না? শব্দটা খুব বুকিশ। কেউ বললে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘দেব’― পতিদেব, যেখানে স্বামীর সঙ্গে ঈশ্বরের তুলনা করা হয়। আমি মুজাহিদকে এত উঁচু মর্যাদা দিতে রাজি নই।

আমাদের, অর্থাৎ মুসলিমদের মধ্যে, আল্লাহর পর স্বামীকে বলা হয় পৃথিবীর ঈশ্বর। ধরুন, স্বামীর শরীরে পচা ফোঁড়া, রক্ত আর পুঁজ বেরিয়ে পড়ছে, স্ত্রীরা তা জিহ্বায় চেটে দিলেও স্বামীর ঋণ শোধ হয় না। স্বামী যদি মাতাল হন, নারীলিপ্সু হন, বা যৌতুকের জন্য নির্যাতন করেন, তবু তিনি স্বামী―ধর্মের চোখে পবিত্র। ধর্ম যা-ই হোক না কেন, স্ত্রীকে স্বামীর আজ্ঞাবহ দাসী ও বাধ্য শ্রমিক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

এখন নিশ্চয় বুঝেছেন মুজাহিদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী, আর এসব নিয়েই বা আমার ভাবনা কেমন। এটা আমার ভুল নয়। যখন আমার জীবনসঙ্গী মুজাহিদ বদলি হলো, আমরা কৃষ্ণরাজ সাগর বাঁধ প্রকল্পের মনোরম কোয়ার্টারে চলে এলাম। এরপর সে আমাকে একা রেখে দিল সামনের বাগানের কাঁঠাল-লেবুর গাছ, ডালিয়া-জুঁই-চন্দ্রমল্লিকা-গোলাপ ফুলের গাছপালা আর পেছনের উঠানের কারিপাতা-বরবটি-করলার লতায় ঘেরা পরিবেশে। আর সে? চব্বিশ ঘণ্টার দিনে আঠাশ ঘণ্টাই ব্যস্ত থাকত―হয় অফিসের কাজে, না হয় কর্নাটক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ স্টেশনে গবেষণায়।

এখনও একই অবস্থা। ঠান্ডা বাতাস শরীর আর মনে দোল খেয়ে যায়। কাউকে বলার নেই, বাগানের মাঝে বসে বসে এই স্বামীর কথা বলছি আপনাদের কাছে। হঠাৎ―ওহ! মুজাহিদের স্কুটার! এই সময়? ঘড়িতে মাত্র পাঁচটা। আমি অবাক, নড়লাম না। মুজাহিদ হেসে উঠল, আমি হাসি চেপে রাখলাম। সে হেলমেটটা আমার মাথায় পরিয়ে দিল, হাত ধরে টেনে তুলল―‘চলো, তাড়াতাড়ি! আট মিনিট হাতে আছে! সাজপোশাক করে বের হতে হবে, না হলে…’

একটু অপেক্ষা করো, পুরো গল্পটা বলি। আমরা তখনও নবদম্পতি―বিয়ের দশ মাস কেবল পেরিয়েছে। এর আগেও মুজাহিদ কিছু কৌশল চেষ্টা করেছিল। একদিন সে নিজেই আমার চুল বাঁধতে চেয়েছিল, একশ আঠারোটা পিন গুঁজে। খুব সুন্দর হয়েছে ভেবে ছবিও তুলে ফেলেছিল। আমাকে বানরের মতো দেখাচ্ছিল! আরেক দিন আমাকে প্যান্ট পরাতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার ঢিলে প্যান্টও ফেটে গেল, শেষে হাল ছেড়ে দিল। তারপর আমাকে সিগারেট খাওয়াতে চাইল, যাতে সবাই তাকে আধুনিক, প্রগতিশীল ভাবে। অন্যদের সিগারেট খেতে দেখলে আমার বিরক্তি ধরে, তাই ধোঁয়া টেনে বের না করে গিলে ফেললাম, কাশতে কাশতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার ভান করলাম। বেচারা খুব মন খারাপ করল। কিন্তু সব বিপত্তি পার হয়ে তিন মাসে আমরা ‘সাধারণ’ দম্পতিতে পরিণত হই।

‘কোথায় যাচ্ছি?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘বেলগোলা ফ্যাক্টরির ইফতেখার আহমেদের বাড়িতে। ওর সঙ্গে আট দিন আগে পরিচয় হয়েছে, আজ ওর বাড়িতে যাচ্ছি,’ বলল মুজাহিদ।

আমি আট মিনিটেরও কম সময়ে সাজপোশাক সেরে বেরিয়ে এলাম। চেলুভা পিছনে এসে গেটের কাছে দাঁড়ালো। বললাম, ‘রাতের খাবার রান্না করো না, আমি ফিরে এসে রান্না করব।’ এ কথা শুনে সে খুশি হলো।

মুজাহিদও ভালো মেজাজে, ধীরগতিতে স্কুটার চালালো। সে শিস বাজিয়ে হিন্দি গান করছিল, আমি ভাবলাম, ইশ, একটু গালে চিমটি দিই! কিন্তু তখন বেলাগোলা চত্বরে পৌঁছে গেছি।

একটা বাড়ির কাছে এসে স্কুটার থামতেই বাইরে দাঁড়ানো লোকটা হেসে গেট খুলে দিল। আমি নেমে হাঁটতে লাগলাম। শুধু কম্পাউন্ডই আমাদের কোয়ার্টারের চেয়ে বড়। বাগান না পার্ক, বুঝতে পারলাম না। ফুটপাথের দু পাশে পেয়ারা গাছ, লোহার দড়িতে বাঁধা দোলনা। চারপাশে জুঁই আর নানা রকম গোলাপ ফুটে আছে। আমি বিস্মিত।

ওই লোকটাই ইফতেখার নিশ্চয়ই। ঠিক তখনই গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে স্বাগত জানালেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে ইফতেখার ভাই আর শায়েস্তা ভাবি আমাদের সঙ্গে এত ভালো মিশে গেলেন, অবাক হলাম! মুজাহিদ বেশির ভাগ সময় ভাবির সঙ্গে কথা বলছিল, ভাবলাম আলাদা হলে এ নিয়ে রসিকতা করব। কিন্তু ওর কাছে ভাবি  স্বচ্ছ, ভালো মানুষ, কোনও ছল নয় দেখে আর মজা করলাম না। তিনি খুব সরল, উদারমনা, মুহূর্তেই তাদের ছয় সন্তানকে আমাদের সামনে হাজির করলেন। তিন মেয়ে, তিন ছেলে। বড় মেয়ে আসিফা ছাড়া বাকিরা যেন লেজহীন বানরের দল। মনে হলো, ভাবি আমার মন পড়েছেন, বললো―‘কী করব, জিনাত, কোনও প্ল্যানিং করিনি। ফিরে তাকাতেই দেখি ছয়টা সন্তান! আর তোমার ভাই সাহেব,’ ইফতেখারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি যখন ভাবি, অপারেশনটা করিয়ে নিই উনি তখনই মানা করেন। এখন সাত নম্বরের পর করাব।’

‘দরকার নেই শায়েস্তা। আমি তো লালনপালন করছি, তুমি কেন চিন্তা করছ? আল্লাহর রহমতে, সবাইকে ভালোই রাখতে পারি,’ ইফতেখার বলল।

‘আরে! উপার্জন যথেষ্ট হলেই কি হয়? আমার আদরের আসিফাকে পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছে আমার জন্য। জানো এটা কত কষ্টের?’

‘তা নয়। মেয়েদের বেশি পড়ার দরকার নেই বলেই আমি থামিয়ে দিয়েছি। হাই স্কুল সার্টিফিকেটই যথেষ্ট। মহীশুর শহরে কলেজে যাওয়ার দরকার কী? আগামী বছরেই বিয়ে দেব,’ ইফতেখার উত্তর দিল।

‘অবশ্যই না। আমি কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে করেছি। সতেরো বছরে ছয় সন্তানের মা হয়েছি। মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলে…’

ভাবি থেমে গেলেন।

মুজাহিদ আর আমি চুপচাপ শুনলাম। আসিফা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল ভাইকে কোলে নিয়ে। ওর যৌবনের সৌন্দর্য দেখে আমার কষ্ট হলো। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত শুনে আমার বুক চিনচিন হয়ে উঠল। ভাবলাম, শায়েস্তা আমাকে ছাড়িয়ে গেছেন সৌন্দর্যে। ইফতেখার হঠাৎ উঠে বললেন, ‘শায়েস্তা, তুমি আর জিনাত একটু বাইরে এসে বসো। আমি কিছু ফুল তুলছি।’

আসিফা ভাইয়ের মুখে দুধের বোতল দিয়ে তাকে আদর করছিল। শায়েস্তা এক দোলনায় বসলেন, আমি আরেকটায়। দোলনাটা খুব পছন্দ হলো, জোরে জোরে দোল দিতে লাগলাম। উপরে উঠে আবার নিচে এসে মাটি ঠোকরানোর আনন্দ! ইফতেখার ভাই প্লাস্টিকের ঝুড়ি কোমরে বেঁধে ছোট ছোট জুঁই ফুল তুলতে শুরু করলেন। মুজাহিদ সামনের বাগানে বাচ্চাদের নিয়ে খেলছিল। কিছুক্ষণ পর ইফতেখার এসে সেই ঝুড়ি স্ত্রীর হাতে দিয়ে পেয়ারা গাছে উঠলেন। ভাবি দোলনায় বসে ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে লাগলেন।

ইফতেখার আমার আর শায়েস্তার জন্য পেয়ারা নিয়ে এলেন। স্ত্রীর পাশে দোলনায় বসে বললেন, ‘আসিফা মা, একটু চা নিয়ে আয় তো!’

আসিফা তখন ভাইকে শোয়াচ্ছিল, হঠাৎ বাবার ডাক শুনে চা বানাতে গেল। আমরা যতক্ষণ ছিলাম, ইফতেখারের দশ কাপ চা হয়ে গেল।

ভাবি জুঁই ফুলের মালা দুটো ভাগ করল, একটা আমার হাতে দিল। অপরটা মাথার মুকুটের মতো পরল। তার লম্বা চুলের সঙ্গে মানাচ্ছিল ভালোই। আসিফা এল, চা দিয়ে গেল। ভাবি ওকে উপেক্ষা করছিল। আর এত ফুল দিয়ে সাজছিল, বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি।

‘এখানে এসো, আসিফা,’ আমি ডাকলাম। আমার ফুলগুলো ওর চুলে বেঁধে দিলাম। মেয়েটির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। চুপচাপ বাড়ির ভেতর চলে গেল, হাতে ইফতেখারের খালি চায়ের কাপ।

আকাশ অন্ধকার হতে লাগলো। অন্ধকার নেমে এল। ফিরব ভাবছি, ইফতেখার বললেন, ‘জিনাত আপা, দেখেন, এই পেয়ারা গাছটা শায়েস্তার জন্য লাগিয়েছি। এখানের প্রতিটি গাছ-ফুল তার প্রিয়। এই আনাব-এ-শাহী আঙুরের লতা, এই দোলনাগুলো… ও খুব পছন্দ করে।’

‘ইফতেখার ভাই, আপনাদের একসাথে দেখে ভালো লাগল। ভাবির পছন্দ-অপছন্দের এত খেয়াল রাখেন!’

‘এটাই শেষ নয়। আমি যদি বাদশাহ হতাম, তাজমহলকেও হার মানানো এক প্রাসাদ বানাতাম, নাম দিতাম শায়েস্তা মহল!’

মুজাহিদ তখন বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা বন্ধ করে আমাদের কাছেই দাঁড়িয়েছিল। ইফতেখার ভাইয়ের কথা কেটে বলল, ‘ওহো! থামো, ইফতেখার ভাই, কী বলছ বুঝতে পারছ? বাদশাহ তাজমহল বানিয়েছিলেন মৃত স্ত্রীর সমাধি হিসেবে। আল্লাহ শায়েস্তা ভাবিকে দীর্ঘজীবী করুন। তিনি তোমার সামনেই বসে আছেন, আর তুমি শায়েস্তা মহল বানানোর কথা বলছ!’

ইফতেখার একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘কিন্তু কেউ তাজমহলকে সমাধি ভাবে না। এটা প্রেমের নিদর্শন। সেই অর্থেই বলেছি।’

মুজাহিদ ছাড়ল না, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মৃত প্রেমের নিদর্শন।’

‘কিন্তু প্রেম তো মরে না, মুজাহিদ।’

‘হুম… মরে না। কিন্তু এ সবই খুব ফিল্মি ভাই। মা মারা গেলে মায়ের ভালোবাসাও চলে যায়, যে ভালোবাসা আর কেউ দেবে না। কিন্তু স্ত্রী মারা গেলে ব্যাপারটা আলাদা, কারণ আরেকটা স্ত্রী তো পাওয়া যায়।’

মুজাহিদ যা বলল শুনে আমি স্তম্ভিত। শায়েস্তা ভাবির মুখে হালকা হাসি ফুটল। তিনি উঠে বললেন―‘হ্যাঁ, আমার দাদি বলতেন, স্ত্রী মারা গেলে, সেই কষ্টটা নাকি কনুইয়ে লেগে যাওয়া আঘাতের মতো―এক ঝটকায় ব্যথা, তারপর কিছুই থাকে না। না রক্ত, না দাগ, না স্মৃতি।’

আলোচনার দিকটা আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ ইফতেখার উত্তেজিত হয়ে উঠে শায়েস্তার হাত ধরে বললেন, ‘শায়েস্তা, কী বলছ তুমি? তোমার নামের শক্তিতেই আমার দেহের প্রতিটা কোষ সজীব। তোমার প্রাণশক্তিই তো আমার হৃদস্পন্দন। তুমি―এ কথা কি তোমার মন থেকে বলেছ? এটাই কি তোমার বিশ্বাস?’

আমি হাসি ধরে রাখতে পারলাম না। মনে পড়ল, ভাবি বলেছিলেন, ইফতেখার ভাই তার চেয়ে দশ বছরের বড়। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বয়সে সেই মানুষটা যেন প্রথম প্রেমিকের মতো ভালোবাসার শপথ নিচ্ছেন। আর ভাবি  রাজকন্যার মতো তাকিয়ে আছেন। এই দৃশ্য হয়তো আর কখনও দেখব না।

মুজাহিদ বড় হাসিতে ফেটে পড়ল। শায়েস্তাও লাজুক হেসে উঠলো।

আমরা দ্রুত চলে এলাম।

শায়েস্তা ভাবির ওখানে অনেক খেয়ে এসেছিলাম, তাই মুজাহিদ রাতের খাবার চাইল না, শুধু এক গ্লাস দুধ খেল। আমিও তাই ভাবলাম, রান্নার চিন্তা করতে হলো না। সে বই নিয়ে বসল, আমি ফেমিনা ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বুলালেও ভাবছিলাম শায়েস্তার পরিবার নিয়ে।

‘আমি জানি… তুমি আসলে ম্যাগাজিন পড়ার ভান করছ…’

‘আচ্ছা, তাহলে বলো, আমি কী ভাবছি?’

‘বলব? তুমি ভাবছো শায়েস্তা ভাবির ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে, গোলগাল কালো চোখ,’ মুজাহিদ হাসতে হাসতে বলল।

‘হয়তো। তবে তার চেয়ে বেশি আমি ভাবছি তুমি সেখানে যা বলেছিলে তা নিয়ে।’

‘জানতাম তুমি ওই বিষয়ে বেশি চিন্তা করবে। আমি জানতাম। তুমি এ নিয়ে বেশি চিন্তা করবে। সত্যি বলছি জিনাত, তোমাকে বুঝতে হবে―বিশ্বখ্যাত প্রেমের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা সম্রাট তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মারা যাননি। হারেমে অগণিত নারী ছিল।’

‘এটা সম্রাটের বিষয় নয়।’

‘ঠিক আছে, শাহজাহানের কথা বাদ দিই। আমাদের আধুনিক প্রেমের বাদশার কথা বলি? আদতে ইফতেখারের নারীসঙ্গ দরকার। শায়েস্তার জন্য একটা বিশেষ জায়গা আছে। কারণ বহু বছর ধরে তাদের সম্পর্ক বেশ ভালো। হোক সেটা শায়েস্তা, নার্গিস, কিংবা মেহরুন।’

‘যথেষ্ট। আর বলো না। দশ জন্মেও ইফতেখার যতটা ভালোবাসে ততটা ভালোবাসতে পারবে না তুমি।’

‘প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের মধ্যে পুনর্জন্মের কোনও ধারণাই নেই। আমি এসব বিশ্বাস করি না। দ্বিতীয়ত, আমি এখনই তোমাকে শত গুণ ভালোবাসা দেখাতে রাজি… তুমি যতই আপত্তি করো না কেন…’

আমি ভাবতেই পারছিলাম না কীভাবে সে বুদ্ধিদীপ্তভাবে আলোচনার বিষয় পাল্টাল। হঠাৎই মুজাহিদ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আর পাগলাটে প্রেমে ভাসিয়ে দিল―একদম পশুর মতো!

সেই রবিবার সকাল ৯টা। মুজাহিদ তখনও বিছানায় ছিল, তখন ইফতেখার ভাই শায়েস্তা ভাবিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এলো। আমি বললাম, মুজাহিদ এখনও ঘুমিয়ে আছে, তারা আমার সঙ্গে বসে গল্প করতে লাগল। আমি গরম গরম সমুচা এনে দিলাম; কিন্তু ইফতেখার ভাই একটাও খেলেন না। নিজের অংশ শায়েস্তার প্লেটে দিলেন, এক কাপ চা খেয়েছেন মাত্র, তারপর বাজারের শাকসবজি কেনার জন্য বেরিয়ে গেলেন।

শায়েস্তা ভাবি  ময়ূররঙা শাড়ি পরেছিলেন, অল্পকিছু গয়না। অসাধারণ সুন্দর লাগছিল। আমাদের বিয়ের অ্যালবাম তার হাতে দিয়ে ঘরে গেলাম। ফিরে এসে দেখি, তিনি একটি ছবিতে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সেটা আমার গ্র্যাজুয়েশনের ছবি, গাউন পরা। পাশে বসতেই তিনি বললেন, ‘জিনাত, আমার ইচ্ছা, আসিফাকেও এমন গাউন পরিয়ে এভাবে ছবি তোলাব। সে প্রথমবারেই মাধ্যমিক পাস করেছে। আমরা তাকে আর পড়াইনি, কারণ ঘর-বাচ্চা দেখার কেউ নেই।’

‘কাউকে রাখুন সাহায্যের জন্য, ভাবি ।’

‘একজন ছিল। সে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে আর ফেরেনি। কোনও এজেন্ট তাকে দাম্মামে পাঠিয়ে দিয়েছে বলে শুনেছি। আর কাউকে পাইনি।’

‘আসিফা এই বছর তো আর কলেজে যেতে পারবে না। অন্তত আগামী বছর থেকে ভর্তি করান।’

‘সেটাই করব। আমাদের সুবিধার জন্য ওই মেয়েটাকে কেন অত্যাচার করব? উফ, জিনাত, ভুলেই গেছি জিজ্ঞেস করতে। সন্তান না নেওয়ার জন্য অপারেশন করানো কি বিপজ্জনক?’

‘কোনও বিপদ নেই, ভাবি। আমার মায়ের পরিবারে তিন ভাবি আর দুই বোন দুই-তিন সন্তানের পর অপারেশন করিয়েছেন। সবাই ভালো আছেন।’

‘সত্যি? তাহলে এবার করাব। তুমি যদি সাথে যাও, আমার ভয়ও কেটে যাবে।’

‘ভাবি, আজ তো তোমায় অসাধারণ লাগছে! খুব সুন্দর দেখাচ্ছে! আমাকেও এভাবে সাজাতে শেখাও,’ মুজাহিদ উঠে এসে বলল।

‘দুষ্টু!’ শায়েস্তা ভাবি খেলাচ্ছলে তার পিঠে চাপড় মারলেন।

আমি জোর করে তাদের লাঞ্চ করালাম। সন্ধ্যায় বেলাগোলা ফিরল তারা। এখন আর আমার দিনগুলো একা হয়ে থাকত না কেআরএসে। শায়েস্তার বাড়িতে যখন ইচ্ছে যেতাম। বাচ্চাদের সঙ্গে খেললে সময় কেটে যেত খুব দ্রুত। শায়েস্তা ভাবিরাও একই রকম। তিনি তার সন্তানদের ভালো শিক্ষা দিতে চেয়েছিলো, বিশেষ করে আসিফাকে। বাড়ির কাজ থেকে মুক্ত করে ডিগ্রি করাতে চেয়েছিলো। আর ওর সুস্থতা, ওর আনন্দ। এর বাইরে আর কিছু চাননি।

শায়েস্তাকে পরীক্ষা করা মহিলা ডাক্তার বলেছিল ডেলিভারির জন্য এখনও ১৫-২০ দিন বাকি। তাই ওই রবিবার আমি সবাইকে বাড়িতে ডেকেছিলাম, আসিফাকেও নিয়ে আসতে বলেছিলাম। খুব আনন্দের দিন ছিল একটা। আমার প্রচুর কাজ ছিল, এক মুহূর্তও অবসর ছিল না। শায়েস্তা আর মুজাহিদ কৌতুক করছিলো; ইফতেখার চিরকালীন প্রেম বোঝানোর চেষ্টা করছিলো; বাচ্চারা হৈ চৈ করছিল; আসিফা চুপচাপ ছিল, নিঃসঙ্গ। এর মাঝেই এক বিশাল ভোজন শেষে তাদের বিদায় দিলাম যখন, রাত নয়টা পেরিয়ে গেছে।

আমি পাঁচটার এলার্মে উঠে গেলেও আরও ঘুমোতে ইচ্ছে করছিল। এমন সময় দরজার বেল বাজল। উঠে পড়লাম, শাল গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে দেখি ইফতেখার ভাই।

‘আরে, ইফতেখার ভাই! এসো, এসো, এত সকালে?’

‘বসার সময় নেই বোন।’

এখান থেকে যাওয়ার পর রাত একটার দিকে শায়েস্তার প্রসববেদনা শুরু হলো। আমি ফ্যাক্টরি জিপে তাকে মহীশুরের শিল্পা মাতৃসদনে নিয়ে গেলাম। তিনটায় সে প্রসব করল। ছেলে হয়েছে।’ ইফতেখারের মুখে একটু লজ্জা দেখলাম।

আমি খুব খুশি হলাম। ওহ! কতদিন পর কোনও নবজাতক দেখব, জন্মের উৎসবে যোগ দেব! ইফতেখারকে সেখানে রেখে আমি ছুটে গেলাম ঘুমন্ত কুম্ভকর্ণ মুজাহিদের কাছে। কম্বল ছুড়ে ফেলে তাকে ঝাঁকিয়ে তুললাম। ‘উঠো―শিগগির উঠো―শায়েস্তা ভাবির ছেলে হয়েছে! তুমি এখনও ঘুমোচ্ছ!’

মুজাহিদ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘শপথ করছি জিনাত, ছেলে হোক বা মেয়ে, আমি রাত জেগে তোমার বাচ্চার দিকে তাকিয়ে থাকব।’

‘উফ, লজ্জা নেই তোমার। ইফতেখার ভাই বাইরে আছেন। ওঠো, তার কাছে যাও।’ চায়ের কাপ এনে দিলাম, তখন ইফতেখার চার-পাঁচ শলাকা সিগারেট শেষ করে ফেলেছেন। কাপটা দিয়ে বললাম, ‘শায়েস্তা ভাবির অবস্থা ভালো তো?’

‘হুম, কিছুটা ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, হয়তো রক্ত দিতে হতে পারে। পরে লাগেনি। শায়েস্তা অনেক দুর্বল, আমি এখন যাচ্ছি।’ ইফতেখার ভাই কাপ রেখে অলস মুজাহিদ উঠে আসার আগেই চলে গেলেন।

মুজাহিদ আর আমি মহীশুরের পথে রওনা হলাম। সে রসিকতা করছিল, আমার বাচ্চা হলে সে কী করবে, কীভাবে লালন-পালন করবে ইত্যাদি। নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখি ইফতেখার ভাইয়ের পুরো পরিবার সেখানে উপস্থিত। আসিফা সব বাচ্চাদের বাইরে নিয়ে গেল, কারণ তারা ভেতরে হৈচৈ করছিল।

শায়েস্তা ভাবি আমাদের দেখে হেসে উঠলেন। যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত খুশি কেন?’ সে বলল, ‘বাচ্চাটা খুব সুন্দর ভাবি। তুমি দেখলেও খুশি হয়ে যাবে।’

বাচ্চাটা সত্যিই খুব সুন্দর, গোলাপের মতো নরম আর গোলাপি রঙের। চোখ শক্ত করে ঘুমাচ্ছে। শায়েস্তার ঠোঁট ফ্যাকাশে, দুর্বল হাসি দিল। পাশে বসলাম, বাচ্চাটা তুলে নিলাম।

‘শায়েস্তা ভাবি, বাচ্চার ওপর তো নজর লেগে যাবে। এত সুন্দর সন্তান কী করে জন্ম দিলে তুমি?’ আমি ঠাট্টা করলাম।

‘চিন্তা করো না। যদি মুজাহিদকে বলো, ও তোমার হাতে আরও সুন্দর বাচ্চা তুলে দেবে,’ উত্তরে বলল।

হঠাৎ মুজাহিদ ইফতেখার ভাইকে নিয়ে ঢুকল। বাচ্চাটা আমার হাত থেকে নিয়ে একবার দেখে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরল। ‘ভাবি, আমি বাচ্চা চুরি করে নিয়ে পালালে তুমি কী করবে?’ জিজ্ঞেস করল।

শায়েস্তা বিনা দ্বিধায় উত্তর দিল, ‘কী লোক দেখো, অন্যের বাচ্চা চুরি করে পালাবে। নিজের সেনাবাহিনী তৈরি করো, তারপর দেখব।’ ইফতেখার হেসে উঠল।

আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। যাবার সময় শায়েস্তা ভাবির সঙ্গে কথা বললাম, ‘সব বাচ্চাদের দেখাশোনা করা আর তোমার জন্য মেটারনিটিতে খাবার পাঠানো একা আসিফার পক্ষে কঠিন হবে। আমি সল্লু, ইমু, নবীন আর কামালকে আমার কাছে রেখে দেই তোমার ফিরে আসা পর্যন্ত?’

‘ঠিক আছে জিনাত। আসিফা আমার মেয়ে নয়, সে আমার মায়ের মতো। শুধু এখন নয়, স্কুল ছাড়ার পর থেকেই সে সব গৃহকর্ম সামলাচ্ছে, বাচ্চাদের দেখছে। আমি বেশি দিন থাকব না। পরশুই বাড়ি ফিরব,’ তিনি বলেন।

‘তাহলে… অপারেশনটা?’

‘আমি এখন একটু দুর্বল। ডাক্তার বলেছে ১৫ দিনের মধ্যে আসতে। তখন করাবো।’

‘ঠিক আছে, তাহলে আমি যাই।’

শায়েস্তা বাড়ি ফেরার পর আমি কয়েকবার তাকে দেখতে গেলাম। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপারটি হলো, এক রবিবার মুজাহিদ আর আমি মহীশুরের পথে ট্রেনে বসে যখন যাচ্ছিলাম, তখন― ট্রেন বেলাগোলা স্টেশনে থামলো, অবাক হয়ে দেখি, শায়েস্তা ভাবি ইফতেখার ভাইয়ের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় স্কার্ফ আর ফুলহাতা সোয়েটার পরা। মুজাহিদ বগির দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল। তারা দ্রুত আমাদের কম্পার্টমেন্টে উঠল।

আমি মূর্খের মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি মহীশুর ফিরে যাচ্ছেন কেন?’

শায়েস্তা ভাবি  যেন তার পুরোনো প্রাণবন্ততাকে ফিরে পেয়েছেন। মাত্র পনেরো দিন বিশ্রামে থাকা, কোন অভাব-অনটন ছাড়াই সহজ জীবন যাপন করা একজন মাকে কেন নিজের কাজে মহীশুর যেতে হবে? আমার মনের কথা পড়ে নিয়ে শায়েস্তা ভাবি  বললেন, ‘আচ্ছা, আমি তো কখনও পনেরো দিনের বেশি প্রসবোত্তর বিশ্রাম নিইনি। শুধু গরম কাপড় পরি, এটুকুই। আর যদি তার সাথে না থাকি, সে খুব নিস্তেজ হয়ে যায়। আমি সুস্থ। সারাদিন শুয়ে থাকব কেন? আমার প্রথম মেয়ের জন্মের পরও শুধু পনেরো দিন বিছানায় ছিলাম।’

এরপর আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। আমি দেখেছি আমার বড় বোনেরা, এবং শাশুড়িরা প্রসবোত্তর বিশ্রামে থাকতে কেমন করতেন। ডেলিভারির পর তিন মাস ধরে বিছানা ছাড়তেন না। ঠান্ডা জল স্পর্শ করা নিষেধ ছিল। সকালে উঠলেই আম্মা তাদের উপর গরম জল ঢালতেন তিন বড় পাত্র থেকে, তারপর মলিন হয়ে পড়লে দশটা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখতেন। শেষমেশ আম্মা ভাবতেন দশটা কম্বলও কম, তাই প্রত্যেকের ওপর একটা বড় ম্যাট্রেস বিছিয়ে দিতেন। পনেরো মিনিটের মধ্যেই নতুন মা প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করতেন। আম্মা তাকে উঠিয়ে দেয়ার পর ঘাম মুছে খাসির মাংসের স্যুপ দিতেন, মাথার চুল সাম্বরানির ধোঁয়ায় শুকিয়ে দিতেন, পেটের চামড়ার ভাঁজের ওপর ভয়েল শাড়ি টান-টান করে বাঁধতেন যাতে পেট ফ্ল্যাট থাকে। এরপর মেথি গুঁড়ো আর এক প্লেট ঘি খাওয়াতেন… কিন্তু স্বামীরা ওজন বেড়ে যাবে বলে ঘি খেতে নিষেধ করত, তাই বৌরা চালাকি করে প্লেট বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেলত, আম্মা টের পেতেন না।

এরপর, বাচ্চাকে খাওয়ানোর পর দুপুর আড়াইটায় নতুন মা উঠে যেতেন। সঙ্গে সঙ্গে ভাত, গোলমরিচের স্যাঁতস্যাঁতে শাক-সবজি আর চার টুকরো নরম মাংসের ঝোল প্রস্তুত। শুধু ফোটানো গরম পানিই পান করতে হতো। সন্ধ্যায় প্রচুর ঘি, বাদাম আর এলাচ দিয়ে তৈরি শাভিগে অথবা মিষ্টান্ন, রাতে রুটি বা ব্রেড আর মাংসের মেলোগারা কারি। চল্লিশ দিন এই কঠোর খাদ্যাভাস পালন করে নতুন মা নতুন শাড়ি আর গহনা পরতেন ঠিক কনের মতো।

আমার ভাই বা জামাইরা যদি নতুন মায়েদের সাথে বেশি সময় কাটাত, আম্মা বিরক্ত হতেন। আম্মা গম্ভীর মুখে বলতেন, ‘এ কী বেহায়াপনা! স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকতে দিলেই… সুযোগ নেয়… আমার কী… তোমরা সুস্থ থাকলে স্বামীরা তোমাদের সাথেই থাকবে। নবযৌবন নষ্ট করলে তোমরাই কষ্ট পাবে। ব্রাম্বরা, শেট্টর পরিবারের মেয়েদের দেখো! প্রসবের পরও পাঁচ মাস বিশ্রামে। আমরা কি তাদের মতো যত্ন নিতে পারি? তাই তারা সবাই এত বলিষ্ঠ, সুস্থ।’

নতুন মা উঠে বসলে আম্মা বলতেন, খারাপ জল কোমরে চলে যাবে; দাঁড়ালে ভয় দেখাতেন, অজ্ঞান হয়ে পড়বে, শুয়ে থাকতে বলতেন। ‘প্রসবের পর চল্লিশ দিন বাচ্চা আর নতুন মায়ের জন্য চল্লিশটি কবরের মুখ খোলা থাকে। প্রতিদিন একটি করে কবর বন্ধ হয়। শরীর থেকে নতুন প্রাণের জন্ম কি সামান্য কথা? মায়েরও যেন নতুন জন্ম হয়,’ আম্মা বলতেন।

আম্মার কথায় বিশ্বাস করলে, শায়েস্তার জন্য এখনও পঁচিশটা কবর মুখ খুলে আছে। অথচ সে এভাবেই বেড়াচ্ছে! মুহূর্তেই এইসব ভাবনা মাথায় ঘুরে গেল।

কিন্তু সেই পঁচিশ কবরের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। চল্লিশ দিনের শেষে শায়েস্তার বাড়িতে একটা উৎসব হলো। আমি শায়েস্তা ভাবির বাচ্চার জন্য রুপোর পায়েল আর কাপড় নিয়ে, আর তার জন্য একটা ব্লাউজ পিস নিয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন একটা টেলিগ্রাম এল―

‘মা গুরুতর। সঙ্গে সঙ্গে আসো।’

মুজাহিদ ও আমার কোনও প্রস্তুতি ছিল না। আমরা হাতের নাগালে পাওয়া কয়েকটি কাপড় তাড়াহুড়ো করে সুটকেসে ভরলাম আর সাথে সাথেই মহীশুরের পথে রওনা দিলাম। সেখান থেকে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে চলে এলাম। বাড়ি পৌঁছেই দেখলাম আম্মার অবস্থা একেবারে শোচনীয়। ভয়াবহ হার্ট অ্যাটাকের পর তিনি সম্পূর্ণ দুর্বল, মুখ মলিন। যখন বুঝতে পারলেন আর বেশি দিন বাঁচবেন না, সমস্ত সন্তানদের পাশে পাওয়ার আকুলতা জেগে উঠল। আমি ছিলাম কনিষ্ঠ, শেষে পৌঁছলাম। তৃতীয় দিনে আম্মা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন―দেখে মনে হচ্ছিল যেন শুধু ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমার আম্মা… যিনি আমাকে লালন-পালন করেছেন, আদর করেছেন, তিনি এখন আমার চোখের সামনে শুয়ে আছেন কাঠের গুঁড়ির মতো। কীভাবে সেই দৃশ্য আমি সহ্য করলাম আজও জানি না।

আম্মার শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো। আমি অনুভূতিহারা।

কেআরএসে ফিরে গেলে আমি একা হয়ে যাব এবং আরও গভীর শোকে ডুবে যাব―এই ভেবে মুজাহিদ এক মাসের ছুটি নিয়ে আমার সাথেই রইল। আম্মার চল্লিশা পালনের চার-পাঁচ দিন পর আমরা কেআরএসে ফিরে এলাম।

সেদিন ঘরে আমি না বসতে পারলাম, না দাঁড়াতে পারলাম। এক অজানা অস্থিরতা, এক যন্ত্রণাবোধ আমাকে গ্রাস করছিল। হয়তো এতদিন মানুষের ভিড়ে থাকার পর হঠাৎ একা হয়ে পড়ায় এমন হচ্ছিল। মুজাহিদ তখনও ছুটিতেই ছিল, তাই আমরা দুজনেই শায়েস্তা ভাবির বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম; আমি তার ও নতুন বাচ্চার জন্য কেনা উপহারগুলো হাতে নিলাম।

বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম বাগানটা যেন অযত্নে পড়ে আছে। ঘরে শিশুদের কোনও চিহ্ন নেই। হলের একটি চেয়ারে বসে চারদিক দেখলাম; শায়েস্তা ভাবির ঘরের দরজা বন্ধ। মুজাহিদ বসে পড়ল, আর কিছুই করার না পেয়ে সংবাদপত্র হাতে নিল। আমি দরজায় জোরে আঘাত করলাম―ভাবছিলাম বিকেল চারটা পর্যন্ত সে কীভাবে ঘুমোচ্ছে!

‘ভাবি … শায়েস্তা ভাবি … আমি, জিনাত। দুই মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এসো। নইলে দরজা ভেঙে ঢুকব!’

দরজা খোলার শব্দ পেলাম। ইফতেখার ভাইও বেরিয়ে এলেন। আমি ধরে নিয়েছিলাম তিনি ফ্যাক্টরিতে থাকবেন, তাই একটু বিব্রত বোধ করলাম। দুই পা পিছিয়ে গেলাম। ইফতেখার মুজাহিদের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। আর কী! আমার মাথা ঘুরে উঠল। সব জানালা-দরজা বন্ধ; বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী―ময়ূরনীল শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা, হাত-পায়ে মেহেদি, সবুজ-লাল চুড়ি―তিনি নিশ্চিতই শায়েস্তা নন। আঠারো বছরের বেশি বয়স হয়নি এই তরুণীর। নতমস্তকে দাঁড়িয়ে… তিনি শায়েস্তা নন। চোখের জল পড়ার আগেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার শায়েস্তা ভাবি কোথায়?’

‘সে আর নেই। আমরা কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই সে অনেক দূরে চলে গেছে।’

‘এই মেয়েটা কে?’ আমি নির্দয়ভাবে প্রশ্ন করলাম।

‘শায়েস্তার চল্লিশার পরদিনই ওকে বিয়ে করেছি। গরিব ঘরের মেয়ে। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য কাউকে তো দরকার।’

‘অবশ্যই, তিনি বাচ্চাদের খুব ভালোই দেখাশোনা করছেন সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। ইফতেখার ভাই, আপনি যা ইচ্ছে তাই করুন। কিন্তু শায়েস্তাকে যেসব ভালোবাসার কথা বলতেন, ওকেও সেগুলো বলবেন না। আপনি শায়েস্তা মহল বানাননি, তার কবরকে পাথরের স্ল্যাব দিয়ে ঘিরে দেননি সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনার সেই চিরন্তন, গভীর ভালোবাসা যদি তার কানে পৌঁছে যায় আর তিনি যদি জেগে উঠে ফিরে আসেন, তাহলে কিন্তু আপনি বিপদে পড়বেন।’

আমার মুখ থেকে আর কী বেরিয়ে আসতে পারে সেই ভয়ে আমি দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। আসিফা স্কুল থেকে তার সব ভাইবোনদের নিয়ে এসে বাগানে বসিয়েছিল, সম্ভবত বাবাকে বিরক্ত না করার জন্যই। তাকে দেখে আমি এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম।

‘জিনাত আন্টি!’ সব বাচ্চারা সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ঘিরে ধরল। আসিফা আমার কাছেই দাঁড়াল, একঝাঁক ছোট বাচ্চা আর আসিফার কোলে দুই মাসের এক শিশু। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।

কোথাও দূরে হয়তো শায়েস্তা ভাবি ফিসফিস করে বলছিলেন, ‘ও আমার মেয়ে না, ও আমার  মা…’

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button