অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : দশ দিনের অনশন : মূল : হরিশঙ্কর পারসাঈ

বাংলা অনুবাদ : রিয়াজ মাহমুদ

[হরিশঙ্কর পারসাঈ ২২ আগস্ট, ১৯২৪ ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের হোশাংবাদ জেলার জমানী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দিতে এম.এ. করার পর কিছুদিন অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে সম্পূর্ণরূপে লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন এবং জব্বলপুর থেকে বসুধা নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেন।

পারসাঈ ব্যঙ্গ শৈলীকে সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। ব্যঙ্গরচনার দ্বারা তিনি সমাজের অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তির মর্মমূলে কঠোর আঘাত হেনে চিন্তার জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন। বিকলাঙ্গ শ্রদ্ধা কা দৌড় গল্পগ্রন্থের জন্য তাঁকে ১৯৮২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে

ভূষিত করা হয়।

তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে, হাঁসতে হ্যাঁয় রোতে হ্যাঁয়, জেইসে উনকে দিন ফিরে প্রভৃতি ছোটগল্প; ‘রানি নাগফনি কি কাহানি’, ‘তট কি খোজ’ প্রভৃতি উপন্যাস; তব্ কি বাত আওর থি, ভূত কে পাঁও পিছে, বেঈমানী কি পরত, পগণ্ডিয়োঁ কা জামানা, শিকায়াত মুঝে ভি হ্যাঁয়, আওর অন্ত মেঁ প্রভৃতি প্রবন্ধ এবং সদাচার কি তাবিজ, বৈষ্ণব কি ফিসলন, তিরছি রেখায়েঁ, ঠিঠুরতা হুয়া গণতন্ত্র, বিকলাঙ্গ শ্রদ্ধা কা দৌড় প্রভৃতি ব্যঙ্গরচনা।

১০ আগস্ট, ১৯৯৫ মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুর শহরে হরিশঙ্কর পারসাঈ মৃত্যুবরণ করেন।

 হরিশঙ্কর পারসাঈ রচিত ব্যঙ্গগল্পের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সদাচার কা তাবিজ থেকে এই গল্পটি নেওয়া হয়েছে।]

আজ আমি বন্নুকে বললাম, ‘দেখ বন্নু, এই যুগে আইন, আদালত, সংসদ, সংবিধান সব বেকার হয়ে গেছে। বড়-বড় দাবি এখন অনশন আর আত্মাহুতির হুমকি দিয়ে আদায় করা হচ্ছে। ২০ বছরের মধ্যে প্রজাতন্ত্র এতটা পেকে গেছে যে, এক ব্যক্তির মারা যাওয়া বা না-খেয়ে থাকার হুমকিতে ৫০ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে। তুই কিন্তু চাইলে ওই মহিলার জন্য অনশন করতে পারিস।’

বন্নু ভাবতে লাগল। সে রাধিকা বাবুর স্ত্রী সাবিত্রীর পেছনে গত কয়েক বছর ধরে ঘুরছে। ভাগানোর চেষ্টা করে একবার বেধড়ক পিটুনিও খেয়েছে। রাধিকা বাবুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে বিয়ে করবে তাও সম্ভব না। কারণ সাবিত্রী দেবী বন্নুকে দুই চক্ষে দেখতে পারে না।

বন্নু ভেবে-চিন্তে বলল, ‘এই কাজের জন্যও অনশন করা যায়?’

আমি বললাম, ‘যায় মানে! বর্তমানে সবকিছুর জন্যই অনশন করা যায়। এই তো সেদিন বাবা সনকি দাস অনশন করে আইন করে নিয়েছেন যে, প্রত্যেকেই জটা রাখবে এবং কেউ তা ধোবে না। এখন সবার মাথা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। সেই তুলনায় তোর দাবি তো নস্যি―সামান্য একজন নারীর জন্য।’

সুরেন্দ্র ওখানে বসেছিল। সে বলল, ‘এসব কী বলছ, তুমি? কারও বউ ভাগানোর জন্য অনশন করা যায় নাকি? লজ্জা বলে তো একটা জিনিস আছে, নাকি? মানুষ হাসবে না?’

আমি বললাম, ‘রাখ তোর লজ্জা! সাধু-সন্তরা লজ্জা পাচ্ছে না, আমরা কেন পাব? আমরা তো সাধারণ মানুষ। বাকি রইল হাসির কথা। গো-রক্ষা আন্দোলনে সারা দুনিয়ার মানুষ এত বেশি হেসেছে যে, তাদের এখন পেট ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। আগামি দশ বছর পর্যন্ত এরা আর হাসতে পারবে না। যে হাসবে সে পেট ব্যথায় মারা যাবে।’

বন্নু বলল, ‘কিন্তু এ ক্ষেত্রে সফল হওয়া কি সম্ভব?’

আমি বললাম, ‘এটা তো ইস্যু বানানোর উপর নির্ভর করে। ভালো ইস্যু তৈরি করা গেলে সাবিত্রীকে পেতেও পারিস। চল, আমরা কোনও এক্সপার্টের কাছে যাই। বাবা সনকি দাস এই বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। ভালো প্র্যাকটিস চলছে তাঁর। তাঁর নির্দেশনায় এই মুহূর্তে চার ব্যক্তি অনশন করছে।’

আমরা বাবা সনকি দাসের কাছে গেলাম। পুরো বিষয়টা শুনে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, কোনও সমস্যা নেই। মামলা আমি নিতে পারি। তবে কথা হচ্ছে, আমি যেভাবে বলব, কাজ সেভাবেই করতে হবে।’ এরপর বাবা বন্নুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কি আত্মদাহের হুমকি দিতে পারবি?’

বন্নু কেঁপে উঠল। বলল, ‘আমার ভয় হয়।’

‘জ্বলতে হবে নারে পাগলা, কেবল হুমকি দিবি।’

‘আগুনে পোড়ার কথা শুনলেও আমার ভয় লাগে।’

বাবা বললেন, ‘আচ্ছা, তুই তাহলে অনশন কর। ইস্যু আমি বানাব।’

বন্নু আবারও ভয় পেল। বলল, ‘মরে যাব না তো?’

বাবা বললেন, ‘চতুর খিলাড়ি কখনও মরে না। এক চোখ সে মেডিক্যাল রিপোর্টের উপর রাখে, আরেক চোখ রাখে মধ্যস্থতাকারীর উপর। চিন্তা করিস না। তোকে বাঁচিয়েও নেব এবং ওই মহিলাকে পাইয়েও দেব।’

১১ জানুয়ারি

আজ বন্নু আমরণ অনশনে বসেছে। তাঁবুর মধ্যে ধূপের বাতি জ্বালানো হয়েছে। একদল ভক্ত ভজন গাইছে, ‘ঈশ্বর সবাইকে সুমতি দাও।’

প্রথম দিনেই একটা পবিত্র আবহ তৈরি হয়ে গেছে। বাবা সনকি দাস এই বিষয়ে বিরাট ওস্তাদ। বন্নুর  নামে তিনি যে বক্তব্য লিখে লোকজনের মাঝে বিলি করেছেন, তা খুবই জোরালো। বন্নু বলছে, ‘আমি আত্মার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমার আত্মা বলছে―আমি অসম্পূর্ণ। আমার আত্মার বাকি অংশ রয়েছে সাবিত্রীর কাছে। তোমরা আমার দ্বিখণ্ডিত আত্মাকে মিলিয়ে এক করো, নয়তো আমাকে নশ্বর দেহ থেকে মুক্তি দাও। আমি আমার খণ্ডিত আত্মাকে এক করার জন্য অনশনে বসেছি। আমি সত্যের উপর আছি, সুতরাং আমার কোনও ভয় নেই। সত্যের জয় হোক, আত্মার জয় হোক।’

খবর শুনে সাবিত্রী রেগে আগুন হয়ে ছুটে এসেছে। এসেই সে বাবা সনকি দাসকে বলল, ‘এই হারামজাদা আমার জন্য অনশনে বসেছে কেন?’

বাবা বললেন, ‘ওকে গালমন্দ করো না, দেবী। সে এখন পবিত্র অনশনে বসেছে। ও যদি হারামজাদা হয়েও থাকে, তাহলেও সে এখন আর হারামজাদা নেই। এখন সে অনশনরত পবিত্র মানুষ।’

সাবিত্রী বলল, ‘এ বিষয়ে আপনারা আমার কাছে জিজ্ঞেস করেননি কেন? ও তো আমার ঘৃণারও অযোগ্য। ইচ্ছে হচ্ছে, ওর মুখের উপর থুতু নিক্ষেপ করি।’

বাবা শান্তস্বরে বললেন, ‘দেবী, তুমি তো কেবল ইস্যু। ইস্যুর কাছে কি কখনও জিজ্ঞেস করে আন্দোলন করা হয়? গো-রক্ষা আন্দোলনকারীরা কি গরুর কাছে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তোমাকে রক্ষা করার জন্য আমরা আন্দোলন করব কি না? তুমি চলে যাও, দেবী। আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি বা তোমার স্বামী এখানে আর এসো না। এক-দুই দিনের মধ্যে জনমত তৈরি হয়ে যাবে। তোমাদের গালি-গালাজ তখন জনগণ বরদাস্ত করবে না।’

মহিলা বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। বন্নু কিছুটা মিইয়ে গেছে। বাবা ওকে বোঝালেন, ‘চিন্তা করো না। জয় তোমারই হবে। জয় পরিণামে সত্যেরই হয়।’

১৩ জানুয়ারি

বন্নু ক্ষুধা মোটেও সহ্য করতে পারে না। তৃতীয় দিনেই সে কাহিল হয়ে গেছে। বন্নু জিজ্ঞেস করছে, ‘জয়প্রকাশ নারায়ণ কি এসেছে?’

আমি বললাম, ‘তিনি পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনে আসেন। এটাই তাঁর নিয়ম। তাঁকে খবর দেওয়া হয়েছে।’

সে জিজ্ঞেস করল, ‘এ বিষয়ে বিনোবা কী বলেছেন?’

বাবা বললেন, ‘তিনি সাধ্য ও সাধনের মীমাংসা করেছেন। তবে কিছুটা ভেঙে নিলে তার কথা আমাদের পক্ষে প্রয়োগ করা যেতে পারে।’

বন্নু চোখ বন্ধ করে ফেলল। বলল, ‘জয়প্রকাশ বাবুকে তাড়াতাড়ি আসতে বলুন।’

আজ কয়েকজন সাংবাদিক এসেছিল। ওরা মেজাজ খারাপ করা প্রশ্ন করছিল। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘উপবাসের হেতু কী? এর মধ্যে কি কোনও সর্বজনীন মঙ্গল নিহিত আছে?’

বাবা বললেন, ‘এখন হেতু দেখার সময় নাই। ওর প্রাণ বাঁচানোই এখন সবচেয়ে বড় হেতু। অনশন করতে বসাটাই এত বড় আত্মবলিদান যে, এর হেতু এমনিতেই পবিত্র হয়ে যায়।’

আমি বললাম, ‘সর্বজনীন মঙ্গল অবশ্যই আছে। অনেকেই অন্যের স্ত্রী অপহরণ করতে চায়। কিন্তু কীভাবে করবে, সেই পথ তারা জানে না। অনশন যদি সফল হয়, তাহলে জনগণ একটা সঠিক পথের দিশা পাবে।’

১৪ জানুয়ারি

বন্নু আরও দুর্বল হয়ে গেছে। সে এখন উল্টো আমাদেরকে অনশন ভাঙার হুমকি দিচ্ছে। এর ফলে আমাদের মুখ কালো হয়ে যাবে। বাবা সনকি দাস ওকে খুব করে বোঝালেন।

বাবা আজ একটা দারুণ কাজ করেছেন। স্বামী রসানন্দ নামের এক লোকের বক্তব্য পত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়েছেন। স্বামীজি বলেছেন, ‘তপস্যার ফলে আমি ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। আমি অনুসন্ধান করে দেখেছি যে, বন্নু পূর্বজনমে ঋষি ছিল এবং সাবিত্রী ছিল ওই ঋষির ধর্মপত্নী। ওই জন্মে বন্নুর নাম ছিল ঋষি বনমানুষ। তিন হাজার বছর পরে সে আবার নরদেহ ধারণ করেছে। সাবিত্রীর সাথে ওর জন্ম-জন্মান্তরের সম্বন্ধ। এটা ঘোর অধর্ম যে, একজন ঋষির স্ত্রীকে রাধিকা প্রসাদের মতো কোনও সাধারণ মানুষের স্ত্রী করে রাখা। সমস্ত ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে আমার আবেদন, তারা এই অধর্ম যেন আর চলতে না দেয়।’

এই বক্তব্য ভালো কাজ দিয়েছে। কিছু মানুষকে ‘ধর্মের জয় হোক’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে। একদল লোক রাধিকা প্রসাদের বাড়ির সামনে গিয়ে স্লোগান দিয়েছে, ‘পাপের বিনাশ হোক, ধর্মের জয় হোক।’

স্বামীজি মন্দিরে মন্দিরে বন্নুর প্রাণরক্ষার জন্য প্রার্থনার আয়োজনও করেছেন।

১৫ জানুয়ারি

রাতে রাধিকা বাবুর ঘরে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে। জনমত তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের এজেন্টরা নর-নারী নির্বিশেষে সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছে―

‘বেচারা পাঁচদিন ধরে না খেয়ে পড়ে আছে।’

‘ধন্য হোক এই নিষ্ঠা।’

‘তারপরও তো পাষাণীর মন গলছে না।’

‘ওর মরদটাও কেমন বেশরম।’

‘শুনেছি, আগের জন্মে ইনি ঋষি ছিলেন।’

‘স্বামী রসানন্দের বক্তব্য পড়নি?’

‘ঋষির ধর্মপত্নীকে ঘরের বউ করে রাখা জঘন্য পাপের কাজ।’

আজ এগারোজন ভাগ্যবতী নারী বন্নুকে তিলক পরিয়েছে এবং আরতি করেছে। বন্নু খুব খুশি হয়েছে। সৌভাগ্যবতীদের দেখে ওর চিত্ত-চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রিকার পাতা অনশনের খবরে ছেয়ে গেছে। বন্নুর প্রাণ বাঁচানোর দাবি এবং সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের আবেদন নিয়ে একদল লোককে প্রধানমন্ত্রীর বাংলোয় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। দেখা যাক সাক্ষাৎ না করে কয়দিন থাকতে পারেন।

সন্ধ্যায় জয়প্রকাশ নারায়ণ এসেছেন। তিনি বললেন, ‘কয়জনের প্রাণ বাঁচাব। আমার কি আর কোনও কাজ নেই। প্রতিদিনই কেউ না কেউ অনশনে বসে যাচ্ছে। এরপর চিৎকার করছে, প্রাণ বাঁচাও। আরে ভাই, বাঁচতে চাইলে খাবার খাও। প্রাণ বাঁচানোর জন্য মধ্যস্থতার দরকার পড়ছে কেন? অন্যের বউ তুলে আনার জন্য অনশন করা হচ্ছে, অনশনের মতো পবিত্র অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে―এও কি কোনও কথা!’

আমরা তাঁকে বোঝালাম, ‘এটা অন্যরকম ইস্যু। বন্নু মনের ডাক শুনতে পেয়েছে।’

জয়প্রকাশ শান্ত হলেন। বললেন, ‘মনের ডাক শুনে থাকলে তো আর বলার কিছু থাকে না।’

আমি বললাম, ‘তাছাড়া কোটি-কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগ এর সাথে এক হয়ে গেছে।’

জয়প্রকাশ বাবু মধ্যস্থতা করার জন্য রাজি হলেন। সাবিত্রী এবং তার স্বামীর সাথে সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবেন বলে কথা দিলেন।

বন্নু কাতর চোখে বার বার জয়প্রকাশ বাবুর দিকে তাকাচ্ছিল। জয়প্রকাশ চলে যাওয়ার পরে বন্নুকে বললাম, ‘আরে বেকুব, এমন অসহয়ভাবে কারও দিকে তাকাতে নেই। কেউ যদি তোর দুর্বলতা বুঝতে পারে, তাহলে যে কোনও নেতা-ফ্যাতা এসে তোকে কমলার রস খাইয়ে দেবে। দেখছিস না, ঝাঁকে ঝাঁকে নেতা ব্যাগের মধ্যে কমলা নিয়ে তাঁবুর আশেপাশে ঘুরঘুর করছে?’

১৬ জানুয়ারি

জয়প্রকাশ বাবুর মিশন ব্যর্থ হয়েছে। কেউ মানার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বন্নুর প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে, কিন্তু করার কিছু নেই। আগে ওর অনশন ভাঙ্গাও, তারপরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের কোনও পথ খুঁজে বের করা যাবে।’

আমরা নিরাশ হলাম, কিন্তু বাবা সনকি দাস নিরাশ হলেন না। তিনি বললেন, ‘প্রথমে সব আবেদনই প্রত্যাখ্যান করা হয়। এটাই প্রথা। এখন আন্দোলন তীব্র করতে হবে। পত্রিকায় ছাপিয়ে দাও যে, বন্নুর প্রস্রাবের সাথে প্রচুর এসিটোন আসছে। ওর অবস্থা আশঙ্কাজনক। এরকম বক্তব্য ছাপাও যে, যে কোনও মূল্যে বন্নুর জীবন রক্ষা করতে হবে। সরকার বসে-বসে কি তামাশা দেখছে? বন্নুর মহামূল্য প্রাণ বাঁচাতে সরকারকে অযথা কাল বিলম্ব না করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

বাবা এক অদ্ভুত মানুষ। কত বুদ্ধি যে তাঁর মাথায় খেলে! বললেন, ‘এবার আন্দোলনে জাতপাতের ধুয়া তুলতে হবে। বন্নু ব্রাহ্মণ আর রাধিকা কায়স্থ। এদিকে ব্রাহ্মণদের ক্ষেপিয়ে তোলো, ওদিকে কায়স্থদের ক্ষেপিয়ে তোলো। ব্রাহ্মণ-সভার মন্ত্রী আগামীবার ইলেকশনে দাঁড়াবে। তাকে বলো, ব্রাহ্মণদের ভোট টানার এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ।’

আজ রাধিকা বাবুর পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে, বন্নু সাবিত্রীর কাছ থেকে রাখি বাঁধিয়ে নিতে পারে। প্রস্তাব আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি।

১৭ জানুয়ারি

আজকের পত্রিকার কিছু শিরোনাম―

‘বন্নুর প্রাণ বাঁচাও!’

‘বন্নুর অবস্থা আশঙ্কাজনক!’

‘মন্দিরে-মন্দিরে বন্নুর প্রাণ-রক্ষার জন্য প্রার্থনা!’

এক পত্রিকায় আমরা বিজ্ঞাপনের রেটে এই খবরও ছাপিয়ে দিয়েছি যে―‘কোটি-কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি, বন্নুর প্রাণ রক্ষা করা হোক। বন্নু মারা গেলে এর পরিণাম ভয়ঙ্কর হবে।’

ব্রাহ্মণ-সভার মন্ত্রীর বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তিনি এটাকে ব্রাহ্মণ জাতির মর্যাদার ইস্যু বানিয়েছেন। ডাইরেক্ট অ্যাকশনের হুমকিও দিয়ে রেখেছেন।

চার গুণ্ডাকে আমরা কায়স্থদের ঘরে পাথর নিক্ষেপ করার জন্য ভাড়া করেছি। এই কাজ শেষ করে ওরাই আবার ব্রাহ্মণদের ঘরেও পাথর নিক্ষেপ করবে। টাকা বন্নু অ্যাডভান্স দিয়ে দিয়েছে। বাবার বিশ্বাস, কাল-পরশু নাগাদ কার্ফ্যু জারি হবে। একশ চুয়াল্লিশ ধারাও জারি হতে পারে। এতে আন্দোলন আরও দৃঢ় হবে।

১৮ জানুয়ারি

রাতে ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের ঘরে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে। সকালে ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের মধ্যে তুমুল পাথর বিনিময় হয়েছে। শহরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিনিধিবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘এখানে আইনি জটিলতা আছে। এটা করতে হলে বিবাহ-আইন সংশোধন করতে হবে।’

আমরা বলেছি, ‘তাহলে তা-ই করুন। আইন সংশোধন করুন, অধ্যাদেশ জারি করুন। বন্নু মারা গেলে সারা দেশে আগুন লেগে যাবে।’

তিনি বললেন, ‘প্রথমে অনশন ভাঙাও।’

আমরা বললাম, ‘আগে নীতিগতভাবে আমাদের দাবি মেনে নিন এবং একটা কমিটি গঠন করে দিন। কমিটির কাজ হবে, বন্নু কোনও উপায়ে ওই মহিলাকে পেতে পারে সেই পথ খুঁজে বের করা।’

সরকার এখনও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। মনে হচ্ছে, বন্নুকে আরও কষ্ট পেতে হবে। অবস্থা যা ছিল তা-ই রয়ে গেছে। আলোচনা থমকে আছে। অনর্থক ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে। রাতে আমরা পুলিশ চৌকিতে পাথর নিক্ষেপ করিয়েছি। এটা অবশ্য ভালো কাজ দিয়েছে। এদিকে ‘প্রাণ বাঁচাও’ দাবি আরও জোরদার হয়েছে।

১৯ জানুয়ারি

বন্নু খুব দুর্বল হয়ে গেছে। ভয় পাচ্ছে―মরে যাব না তো! এদিকে সে বলতে শুরু করেছে যে, আমরাই ওকে ফাঁসিয়েছি। এই কথা কোথাও বলে দিলে আমাদের জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে যাবে। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমরা ওকে বোঝালাম, এখন যদি অনশন ভেঙে ফেলিস তাহলে জনগণ তোকে এমনিতেও মেরে ফেলবে। আমাদের প্রতিনিধি আবারও সাক্ষাৎ করতে যাবে।

২০ জানুয়ারি

‘অচলাবস্থা’

একটা মাত্র বাস পোড়ানো হয়েছে। বন্নুকে আর সামলানো যাচ্ছে না। ওর পক্ষ থেকে আমরাই বলছি, ‘ও মরে যাবে, কিন্তু নত হবে না।’

সরকারকেও একটু আতঙ্কিত মনে হচ্ছে। সাধুসঙ্ঘ আজ দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ব্রাহ্মণ-সমাজ আল্টিমেটাম দিয়েছে যে, ১০ জন ব্রাহ্মণ আত্মদাহ করবে। সাবিত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বন্নুকে দেখার জন্য মানুষের লাইন লেগে গেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহামন্ত্রীকে আজ তার করা হয়েছে। জায়গায় জায়গায় প্রার্থনা-সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ড. লোহিয়া বলেছেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত এই সরকার আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ন্যায়সংগত কোনও দাবি পূরণ হবে না। বন্নুর উচিত সাবিত্রীর বদলে এই সরকারকেই ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’

২১ জানুয়ারি

বন্নুর দাবি নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে। প্রায়োগিক সমস্যাসমূহ সমাধান করার জন্য একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভজন এবং প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বাবা সনকি দাস বন্নুকে কমলার রস পান করিয়েছেন। নেতাদের কমলা ব্যাগের মধ্যেই শুকিয়ে গেছে। বাবা বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে জনভাবনার কদর হওয়া উচিত। এই প্রশ্নের সাথে কোটি-কোটি মানুষের ভাবনা জড়িত। ভালোই হয়েছে যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান হয়েছে, অন্যথায় সহিংস বিপ্লব হয়ে যেত।’

ব্রাহ্মণসভা থেকে বিধানসভার জন্য মনোনয়নপ্রার্থী নিজের প্রচারের জন্য বন্নুকে কিনে ফেলেছে। ভালো রকমের মূল্য দিয়েছে। বন্নুর দাম অনেক বেড়ে গেছে।

মানুষ লাইন ধরে তার চরণধুলা গ্রহণ করছে। বন্নু সবাইকে বলছে, ‘সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে। আমি তো কেবল অছিলা মাত্র।’

চারদিক স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে―সত্যের জয়! ধর্মের জয়!

 লেখক : পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা, হিন্দি ও উর্দু ভাষার অনুবাদক

 সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button