
শোক সংবাদ…! শোক সংবাদ…! শোক সংবাদ…!
আজিজুলের গলার শব্দ। হ্যাঁ, তা তো হবেই। মাইকম্যান হিসেবে আমাদের এলাকায় আজিজুলের খ্যাতি আছে। দীর্ঘদিন যাবৎ সে এই পেশায় নিয়োজিত। সব দিন হয়তো তার প্রচারের কাজ মেলে না, এই কাজে আয়-রোজগারও সামান্য, তবু পেশাটি আজিজুল ধরে রেখেছে। আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আপনারাও, আশা করি, ঐকমত্য পোষণ করবেন―আজিজুল এই প্রচারকাজ থেকে ক টাকা রোজগার করে তা সে গোনতার মধ্যে না নিয়ে ভালোবাসার কারণেই কাজটি করে। বিশেষ করে শোক সংবাদ প্রচার। এই কাজটির প্রতি আজিজুলের পক্ষপাত, দরদ ও ভালোবাসা অনেক বেশি। শোক সংবাদ প্রচার করে আজিজুল মাইকভাড়া এবং ভ্যান কিংবা সিএনজিচালিত অটোভাড়া বাবদ কিছু টাকা রাখে, নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা-পয়সা গ্রহণ করে না। এই যে বিনা-পয়সায় কাজটি করে, এজন্যেও সুখ্যাতি কম না আজিজুলের…।
আজ লোকমান বাশারের শোক সংবাদ প্রচার করছে আজিজুল। লোকমান বাশার লোকটি আমি নিজে। আজিজুল হয়তো এখন খালপাড়ে, হাটখোলার কাছাকাছি, হাটে আমার একটি দোকান আছে, ওষুধের দোকান, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ; সকালে-বিকালে রোগী দেখতাম, আমার ওষুধ খেয়ে কারও অসুখ সারতো কিনা জানি না, কিন্তু রোগী আসত ভালোই, কোনও কোনদিন বিকেলে, বিশেষ করে মঙ্গলবার হাটের দিন, লোকজন বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় সওদা করার পাশাপাশি আমার কাছ থেকে জ¦র, কাশি, মাথাব্যথা, গ্যাসট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয়, গলাফুলা, দাঁতের ব্যথা ইত্যাদি অসুখের ওষুধ নিত; যেন ডা. লোকমান বাশারের হোমিওপ্যাথিক ওষুধও বাজার সদাই। হাটখোলা আমাদের বাড়ি থেকে অনতিদূরেই, আমি আজিজুলের গলা শুনতে পাই―‘সুপ্রিয় এলাকাবাসী, মনোযোগ দিয়ে শুনুন, একটি শোক সংবাদ, শোক সংবাদ―রসুলপুরনিবাসী মরহুম আবুল বাশারের ছোট ছেলে, আমাদের এলাকার গুণী মানুষ, কবি-সাহিত্যিক, ডাক্তার…।’
মাইকম্যান হিসেবে আজিজুলের গলার শব্দ যেন একটা ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে। মাইকে চরাচর ভেদ করে ঘন কালো মেঘের গুরুগম্ভীর ডাকের মতো ওর গলা ভেসে এলে সবাই উৎকর্ণ হয়―মনের অজান্তেই এক টুকরা দুঃখ ও কষ্টবোধ গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে, আহারে, কে-যে চলে গেল, চিরতরে এই ধরাধাম ছেড়ে! মনে মনে সবাই হয়তো, কারণ এই পথেই সবাইকে, দুদিন আগে কিংবা পড়ে, যেতে হবে; তাই বিদায়ী লোকটির আত্মার কল্যাণ কামনা করে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ে। লোকমান বাশারের মৃত্যুর খবরটি শুনেও কেউ-কেউ তার বিদেহি আত্মার কল্যাণ কামনা করে হয়তো দোয়াটি পড়বে কিংবা পড়বে না; কেউ দোয়া পড়ুক কি না-পড়ুক, এটা তাদের ইচ্ছা, এ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। অবশ্য, আমি এটা মনে করতেই পারি, লোকমান বাশারের আত্মার কল্যাণার্থে, যে-সকল আদম সন্তান আজ আজিজুলের কণ্ঠে শোক সংবাদটি শুনছে, তাদের অন্তত ৯০ ভাগই দোয়াটি পড়বে না, কারণ জীবিত থাকতে আমি তাদের সুনজরে ছিলাম, তাদের কাছে সুবোধ ও সুবিধাজনক মানুষ ছিলাম―তা বলা যাবে না। আমার কথাবার্তা তারা পছন্দ করত না। বলা ভালো―আমার কথা তারা হজম করতে পারত না। আমার প্রতি তাদের মনে কীরকম একটা, পাথরের চাঁইয়ের মতো ভারী রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা তৈরি হতো। কেউ-কেউ তো আমাকে ‘নাস্তিক’ বলে গালি দিতে দিতে বমি করে ফেলত…।
অ্যাঁ! এই কথা বলে লোকমান ডাক্তার ?
ছিঃ ছিঃ! লোকমান ডাক্তারের মতো একজন গুণী মানুষ, কী তার আদব-কায়দা, আচার-আচরণ, নামকরা কবি-সাহিত্যিক; এই লোক কিনা বলে―‘ভগবান’ বলে আমরা যা জানি, যাকে মান্যতা দিই, তা একটা জড়বস্তু। তার কোনও শক্তি নাই। বেদ-গীতা-উপনিষদ―সব মানুষের রচনা… ?
এই সব কথা, কথাগুলো, আমি ঠিক এভাবে কখনওই বলিনি। কথা এক মুখ থেকে আরেক মুখে গেলেই তা আকার-আকৃতি, বিষয়বস্তু, উপপাদ্য হারিয়ে ফেলে। যেন, কবুতর কাক হয়ে, শুধু ‘ক’ অক্ষরটাই অবিকৃত রেখে, ডাকাডাকির স্বভাব, ওড়াউড়ির ভঙ্গি, সঙ্গীসাথীর সঙ্গে খুনশুটি―সব বদল করে আকাশে পাখনা মেলে। আমার কথাও হয়তো, কাক কবুতর হওয়ার মতো বিকৃত হয়ে তাদের কানে গেছে। ভগবান জড়বস্তু―তার কোনও শক্তি নাই, বেদ-গীতা-উপনিষদ মানুষের রচনা―এই সিদ্ধান্ত দেয়ার আমিই বা কে ? আমার মতো একজন আধাশিক্ষিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, যার কিনা সামান্য কল্পনা ও সৃজনশক্তি আছে, চারপাশের সবকিছুকে একটু ভিন্নভাবে দেখার মতো তৃতীয় একটা চোখ আছে, এই কল্পনা ও সৃজনশক্তি এবং তৃতীয় চোখটির কারণে সে দু-চার ছত্র গল্প-কবিতা লিখতে পারে বটে, তাই বলে―লোকে যা প্রচার করে, ওইসব আধ্যাত্মিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কোনওভাবেই, ভুল করেও লোকমান বাশার দিতে পারে না। এরকম কোনও সিদ্ধান্ত দিতে চাইলে যেরকম শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান থাকা দরকার, তার ছিটেফোঁটাও লোকমান বাশারের মধ্যে নেই। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি―এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা জ্ঞান থাকলেই হবে না, সাহস থাকতে হবে। কারণ, এটা তো সর্বজনবিদিত, শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষেরাও মৃত্যুকে ভয় পায়, পরকালের শাস্তির কথা মনে করে কেঁপে ওঠে; সুতরাং জ্ঞানী (পুথিগত বিদ্যা নাই, তথাকথিত শিক্ষিত নন, ক্ষতি নাই) ও সাহসী মানুষেরাই কেবল বলতে পারেন―এই জগতে আমরা জন্ম নিয়েছি, বেঁচে আছি, একদিন মরে যাব―এটা প্রকৃতির একটা খেলা, গেম অব নেচার; মৃত্যু ও পরকালের শাস্তির কথা মনে করে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার কিছু নেই, আমাদের মনে রাখতে হবে―‘সবার উপরে মানুষ সত্য―তাহার উপরে নাই…’―স্টিফেন হকিং বলতে পারেন―‘ঈশ্বর কিংবা পরকাল বলতে কিছু নাই, সবই রূপকথার গল্প মাত্র―লোকমান বাশার কোন ছার…!
আর দেখুন, আমি কিছু কথা বলেছি তা ঠিক। যেসব কথা বলতে আমার ভালো লাগে, যেসব কথা নিয়ে আলোচনা করলে আমার মনে প্রশান্তি আসে, আমার আত্মা চমৎকৃত হয়, বিকাশ ঘটে, তা নিয়ে কিছু কথা বলেছি বৈকি। কিন্তু এসব কথা তো আমি হাটে-মাঠে, গাঙপাড়ে বসে বলিনি। বলেছি আমার চেম্বারে বসে। তাছাড়া আমার কথার প্রচার-প্রসার ঘটুক, গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ুক, কিছু লোক আমার ভক্ত হয়ে উঠুক, কিছু লোক আমাকে নাস্তিক বলে গালি দিক, আমার বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করুক, আমার কল্লা কাটতে চাক, পত্র-পত্রিকায় ছবিসহ আমার নাম উঠুক, আমি বিখ্যাত বা কুখ্যাত কিছু একটা হই―এ ধরনের কোনও অভিলাষ আমার ছিল না। আমার কিছু বন্ধুবান্ধব, এই হাতেগোনা আট কি দশজন হবে আর কি, এদের মধ্যে কেউ কেউ বয়সে আমারচে কিছু ছোট, কেউ হয়তো আমার সমবয়সী, কেউবা কিছুটা বড়; রাত সাড়ে ৮টা কি তার কিছু পরে, বাজারের গণেশ কাকার মিষ্টির দোকান ব্যতিরেকে, কাকার হাতে তৈরি জিলিপির খুব কদর, আশপাশের সব গাঁয়েও; কারও বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে, একটু রাত হলেও তারা গরম জিলাপি কিনতে আসে; তো, কাকার মিষ্টির দোকানটাই হয়তো তখন পুরাপুরি খোলা, আর সব বন্ধ হতে চলেছে, বাজারে নীরবতা নেমে আসছে, মাঝে-মধ্যে ঘেউঘেউ করছে বাজারের বটগাছটার গোড়ায় কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা দুটো কুকুর আর চারটে গাভিন কুকুরি; তখন ওরা সবাই আমার দোকান কাম চেম্বারে আসে। সবাই যে সব দিন আসে, তা না। প্রতিদিনই, নিজের জরুরি কাজের জন্য হয়তো কেউ না কেউ অনুপস্থিত থাকে। এমনও হয়―কোনওদিন একজন, কোনওদিন দুজন, কোনওদিন তিনজনও অনুপস্থিত। গাঁ-ঘরের মানুষ, সংসারে কত সমস্যা তো থাকেই। যা হোক, কেউ বা কেউ কেউ অনুপস্থিত থাকলেও সমস্যা হয় না। আমাদের আড্ডা জমে ওঠে…।
শ্রীদামদা আসে তার সেলুন বন্ধ করে। বাজারে এখন চার-পাঁচটি সেলুন। দাদার সেলুনটি সবচে পুরনো। সেলুনের বয়স এখন ত্রিশ বছর এবং দাদার চৈতালি হেয়ার ড্রেসারের বয়স বের করাও সহজ। সেলুনের সাইনবোর্ডে ‘চৈতালি হেয়ার ড্রেসার’-এর নিচেই লেখা―স্থাপিত : ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ। বাজার বসেছে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে। সেবার দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। গ্রাম-জনপদ সব পানির নিচে। হাটবাজার বন্ধ। বড় সড়কেও পানি উঠেছে। বাস-ট্রাক-স্কুটার কিছুই চলে না। রসুলপুর ব্রিজটি এবং ব্রিজের উত্তর ও দক্ষিণ ঘাড়িতে কিছু অংশমাত্র জেগে ছিল। সেখানেই বসত সাপ্তাহিক হাট। প্রতি মঙ্গলবার। বানের পানি নেমে গেলে ব্রিজে-বসা সেই হাট বর্তমান জায়গায় চলে আসে। বন্যা ছিল প্রায় এক মাস। বন্যা থাকতে থাকতেই গাঁয়ে হাট বসানোর কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। হাটের জন্য কেনা হয় পানিতে ডোবা জমি। পানি নেমে গেলে পূর্বপাড়ার জুব্বার আলি বটগাছের চারাটি রোপণ করে। বাজারের বয়স তাহলে এখন ৩৫। আর ৩৫ বছরের বটগাছের ছায়াও দারুণ মনোরম, স্নিগ্ধ; শীতল ও সুবাসিত…।
যা-হোক, সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতেই শ্রীদামদা চলে আসে। সবদিনই দাদাই আসে প্রথম। তখন দোকানে খদ্দের এলেও কাজ করে না দাদা। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। তা বিশ বছর তো হবেই। আমি বাজারে চেম্বার খোলার পর থেকেই। ২০০৩ সালে আমি বাজারে ওষুধের দোকান দিলাম, চেম্বার খুললাম, রোগী দেখি; ক’দিন পর থেকেই আমার দোকানে সন্ধ্যার পর আড্ডা বসে গেল। তার আগে আমি বাড়িতেই রোগী দেখতাম, বাড়ি থেকেই বিভিন্ন স্থানে রোগী দেখতে যেতাম, এখন রোগী দেখা, ওষুধ বিক্রি, রোগীবাড়ি যাওয়া―এই বাজারকেন্দ্রিক চেম্বারকে ঘিরে। আমি বাজারে চেম্বার খোলার পর, এই বিশ বছরে আমার নতুন-নতুন বন্ধু জুটেছে, পুরনো অনেকেই এখন নাই, কেউ-কেউ পরপারে পাড়ি জমিয়েছে; দু-একজনের নাম করতে পারি, আমার চেয়েও বয়সে ছোট ছিল, একদিন হঠাৎ করেই নাই! মানুষ যে কীভাবে এরকম হঠাৎ করে ‘নাই’ হয়ে যায়, যেতে পারে―কে জানে! এরকম আমার এক বন্ধু ছিল শহিদ। সেও ডাক্তার ছিল। ফার্মাসিস্ট। সরকারি চাকরি করত। সুদর্শন যুবক। আমার চাচাতো বোন আনুর সঙ্গে প্রেম করত। আনুকে বিয়েও করেছিল। দুজনেরই বয়েস কম। কম বয়সে বিয়ে―ওদের দুটি মেয়ে হয়েছিল। শহিদেরও চেম্বার ছিল বাজারে। রোগী দেখত। ওর অসম্ভবপর হাতযশ ছিল। যৎসামান্য, ২০ টাকা ফি নিতো রোগী দেখে, তাতেই ওর আয়রোজগার ছিল প্রচুর; তা হোক―রাত ৮টা-সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতেই নিজের চেম্বার বন্ধ করে আমার দোকানে এসে বসত। আমার সঙ্গে মশকরা করে বলত―ডাক্তার সাহেব, আপনি আমার বউয়ের স্যার, শিক্ষক; আপনাকে তো স্যার বলতেই হবে, না কী বলুন ? আনুকে শিশু-কিশোরীকালে আমি প্রাইভেট পড়িয়েছি। ওর হাতেখড়ি হয়, আরও অনেকের সঙ্গে আমার হাতে। ছাত্রজীবনে আমি প্রচুর প্রাইভেট পড়াতাম। যা-হোক, শহিদ তারপর আপন মনে হাসতে হাসতে সিগারেটের প্যাকেট বের করত। সেই ডা. শহিদুল ইসলাম, ডাক্তার মানুষ, কত মানুষের চিকিৎসা করেছে, কিন্তু কোনও ডাক্তারকে তার নিজের চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই পরপারে চলে গেল! সেদিন, তখন কেবল ভোরের নামাজের আজান হয়েছে, মুসুল্লিরা মসজিদে যাচ্ছে, পুরোহিত কেবল খুলছে মন্দিরের দরোজা, তখনই মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিন নয়, অন্য কারও গলার ডাক ভেসে এল, ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার; আমি আধোঘুম-আধোজাগরণের মধ্যেই অনুভব করছি―এটা আজিজুলের গলা; কিন্তু এই পবিত্র ভোরে কে চলে গেলো চিরতরে ? ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারলাম না, আজিজুল বিরতি দিয়ে কথা বলে; বাতাসে ভেসে এল―‘শোক সংবাদ, শোক সংবাদ, মাত্র কিছুক্ষণ আগে রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা, দুধের ব্যবসায়ী ইনাতুল্লাহ শেখের বড় ছেলে ডা. শহিদুল ইসলাম ইন্তেকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন…।’ স্নিগ্ধ পবিত্র ভোরে মহাদুঃসংবাদ…!
ডা. শহিদুল ইসলাম, অধ্যাপক বাদল দাস, আইনজীবী আকমল হোসেন অকালে মারা গেছে। শহিদের স্ট্রোক হয়েছিল, বাদলদা আর আকমল সাহেবের চড়ামাত্রায় ডায়াবেটিস ছিল। শহিদ চিকিৎসা নিতে না-পারলেও বাদলদা আর আকমল সাহেব যথাসম্ভব দেশের বড়-বড় ডাক্তার দেখিয়েছিলেন, মায় চেন্নাইয়েও নিয়েছিল চিকিৎসা, কিন্তু কোনও চিকিৎসাই কাজে আসেনি, অকালে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু মানুষ কেন এভাবে অসময়ে, অকালে বিদায় নেবে, কেউ জানে না। সবই নাকি ঈশ্বর, ভগবান কিংবা আল্লাহতায়ালার খেলা। আমি যদি বলি―এসব, যাকে আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা, নিয়ন্ত্রণকর্তা, মানুষের পাপপুণ্যের বিচারমালিক বলি, তার নিষ্ঠুর খেলা, তাহলে কি আমার পাপ হবে, আমি কি অপরাধী হব, বিচার শেষে আমাকে কি নরকে বা দোজখে নিক্ষেপ করা হবে ? সব যদি তাঁর ইশারা-ইঙ্গিতেই সংঘটিত হয়, আমার মনে প্রশ্ন জাগে, জাগতেই পারে―মাটির মানুষ হিসেবে আমার কী দোষ … ?
ডা. শহিদ, অধ্যাপক বাদল দাস কিংবা এডভোকেট আকমল হোসেন এখন আর আমাদের আড্ডায় যোগ দেন না, কিছুদিনের ব্যবধানে নতুন করে আসতে শুরু করেছে বাউল সাগর সরকার, ঋষিবাড়ির কমল সাধু, সদ্য-বিপত্নীক স্কুলশিক্ষক আবদুল আলিম…।
হায়রে মানুষের জীবন! কচুপাতার পানি! দেখতে-দেখতেই নেই। কীভাবে যে গড়িয়ে পড়ে। আলিমের বউ বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেল। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করল আলিম। বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। বউটির প্রথম প্রসব ছিল এবার। ব্যথা উঠেছিল দুদিন আগে কিন্তু প্রসব হচ্ছিল না। শেষমেষ হাসপাতালে নিয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। ডাক্তার সিজার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই সময়ও দিল না মেয়েটি। ওটিতে নিতে-নিতেই শেষ। ওই যে বলেছি, মানুষ কেন অকালে, স্ত্রীকে কাঁদিয়ে স্বামী; স্বামীকে কাঁদিয়ে, একা ফেলে স্ত্রী, চিরতরে চলে যাবে, কেউ জানে না। আলিমের বউ মারা গেল পেটের সন্তান পেটে নিয়েই। আলিম এখন, যতক্ষণ স্কুলে থাকে, তখন তাকে কিছুটা চেনা যায়, যেন এই আমাদের বাছিরন নেছা উচ্চবিদ্যালয়ের সুদক্ষ গণিতের শিক্ষক, গণিতের কত সূত্র যে তার জানা, হোক পাটিগণিত কি বীজগণিত কিংবা ক্যালকুলাস; কিন্তু স্কুল ছুটি হলেই আলিমকে আর চেনা যায় না, সে তখন মধ্যদুপুরে একাকী আকাশে ঘুরে বেড়ানো চিলের মতোই নিঃসঙ্গ এক অচিন পাখি…।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার জুলফিকার খান কাকা আসেন কদাচিৎ। চাকরি থেকে অবসর নিতে-নিতেই খান কাকা শহরের ভাড়াবাসা ছেড়ে দিয়ে সস্ত্রীক গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছেন। তার ছেলে বউ নিয়ে আমেরিকা থাকে। ছেলে, ছেলেবউ, দুজনেই বড় চাকরি করে। গত ১০ বছরে একবারও দেশে আসেনি। মেয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকে অস্ট্রেলিয়া। বাড়িতে দুই বুড়া-বুড়ি। ছেলে আছে, মেয়ে আছে, নাতি-নাতনি আছে, তারপরও তারা নিঃসঙ্গ। জীবন, দেখুন কেমন! কেউ কারও কথা মনে রাখে না। নিজের স্বজন―মা-বাবা, ভাই-বোন, কাকা-কাকি, খালা-ফুফু, কাউকে মনে করার সময়ই যে হয়ে ওঠে না…।
খান কাকা বুড়া হয়েছেন, নিঃসঙ্গ; কোমরের ব্যথায় কাতর বউয়ের সেবাযত্ন করতে করতে দিন কাটে; তবু খুব প্রাণবন্ত। কোন কাজে কখনওই বিরক্ত হন না। ভ্রƒ কুঁচকান না। এই বুড়া বয়সেও চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গান। আমার চেম্বারে এসেই হাঁকডাক শুরু করে দেন―এই যে ডাক্তার সাহেব, মুড়ি-চা কই ? মুড়ি-চা ছাড়া কি রবীন্দ্রসঙ্গীত আসে ? শ্রীদাম কী বলো… ?
শ্রীদামদা আর জুলফিকার কাকা সম্ভবত সমবয়সী। বয়স সত্তর বা তার কাছাকাছি হবে। শ্রীদামদা মুচকি-মুচকি হাসে। সে জানে―মুড়ি, চানাচুর, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, সরিষার তেল, ডিশ―সব কিছুরই জোগাড় আছে, সবাই এসে পৌঁছলেই মুড়ি তৈরি করা হবে। … আর চা ? রুকুর মা জানে কখন-কখন চা দিতে হবে। বাজারের সব চায়ের দোকান এখন বন্ধ। এই মহিলার দোকান রাত ১১টার আগে বন্ধ হবে না…।
কোথাও আড্ডা শুরু হলে, সেই আড্ডার গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আড্ডা নিজের গতিতেই চলে। কার মুখ থেকে যে কী বের হয়, কী বের হবে―তা কল্পনা করাও কঠিন। শ্রীদামদার সেলুনে, সামনের দেয়ালের মাঝ বরাবর দৃশ্যমান জায়গায়, যাতে খুব সহজে সবারই চোখে পড়ে, সাদা কাগজে লাল কালিতে লেখা স্টিকার লাগানো―‘এই সেলুনে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা নিষিদ্ধ’, কিন্তু দাদা আমার চেম্বারে বসে সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়েই বকবক করে। সমাজ-সংসার, দেশের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়েও চর্চা আছে শ্রীদামদার। এখন বলল―‘দেশটা কোন দিকে যেতেছে, কও তো দেহি ব্যাংকার…।’
কোনদিকে যেতেছে মানে ? দেশ সামনের দিকেই যাচ্ছে…।
হেঁয়ালি কইরো না ব্যাংকার। বাজারঘাট করো তো ? বাজারে যে আঙরার আগুনের মতো গনগনে আগুন―কোনও কিছুতেই হাত দেওয়া যায় না, হাত পুড়ে যায়―তা তোমার চোখে পড়ে না ? বাজারের পরিস্থিতি মনে রাইখা কথাডা কও… ?
শোন শ্রীদাম, নবাব শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আটমণ চাল পাওয়া যেত, কল্পনা করতে পার―কী রকম সস্তা ছিল চালের দাম। চালের দাম সস্তা ছিল ঠিকই, কিন্তু মানুষের হাতে পয়সা ছিল না। এত সস্তার চালও কিনতে পারত না অনেকে। না-খেয়ে মানুষ মারা যেত। এখন সাধারণ মানের এক কেজি চালের দাম ৬০-৭০ টাকা, কিন্তু খাদ্যাভাবে মানুষ মারা যায় না…।
তাই নাকি ? যা বলেছ ব্যাংকার! তুমি একটা দার্শনিক-বক্তব্য শোনাইলা। কিন্তু আমি বলি, মানুষ না-খাইয়া মরছে না, তা হয়তো ঠিক, কিন্তু মানুষ কাইঞ্জামড়া ধরতেছে…।
কাইঞ্জামড়া…!
তুমি শিক্ষিত মানুষ, ও তুমি বুঝবে না। তুমি মুড়ি খাও আর আরামসে সিগারেট টানো। ডাক্তার, আমার গেলাস কই ? ব্যাংকারের কথা শুনে আমার মেজাজ বিগড়াইয়া গেছে…।
আচ্ছা দাদা, দিচ্ছি…।
শ্রীদামদা’র জন্য একটা গ্লাস আলাদা করে রাখি। দাদা হিন্দু মানুষ, তাতে আবার নরসুন্দর, অন্যের গ্লাসে পানি খান না, বিষয়টা তা না। এই গ্লাসে দাদা স্পিরিট মেশানো পানি খান। রেক্টিফাইড স্পিরিট। পানিতে রেক্টিফাইড স্পিরিট মেশালে মদের মতো এক ধরনের বস্তু তৈরি হয়। দামে সস্তা, শহরে অনেকেই নাকি এটা মদ-হিসাবে পান করে। শ্রীদামদাও সেই কোন-কালে, শহরের সেলুনে কাজ করত, তখনই এই বস্তু খাওয়া শিখেছিল, এখনও খায়, আমার চেম্বারে। আমি দাদাকে এক গ্লাস পানিতে দুই আউন্স রেক্টিফাইড স্পিরিট মিশিয়ে গ্লাসটা দাদার হাতে তুলে দিলাম…।
আবদুল আলিম শিক্ষক মানুষ, ক্লাসে প্রচুর কথা বলতে পারে, আমরা জানি শিক্ষার্থীদের গণিত সুচারুরূপে রপ্ত করানোর জন্য প্রচুর কথা বলেও, কিন্তু আড্ডায় সে কথা বলে কম। অন্যের কথা শুনতেই সে পছন্দ করে। চুপচাপ শোনে। কিন্তু আজ সে জুলফিকার খানের কথা ধরে বসল। বলল―‘আপনার কথাটা মানানসই হয়নি, কাকা। আপনি কি চাল-ডাল, মাছ-মাংস, তরিতরকারির দাম জানেন ? মোটা চালই ৬০-৭০ টাকা কেজি, নিম্নমানের মসুরের ডালও দুইশ টাকার কমে মেলে না, এক কেজি গরুর মাংসের দাম আটশ-সাড়ে আটশ টাকা, খাসির মাংস হাজার-বারোশ টাকা কেজি, এক কেজি ব্রয়লার মুরগি, কদিন আগে যা কেউ খেতেই চাইত না, এখনও, বেশির ভাগ হিন্দুরা তো বটেই, মুসলমান অনেকেই খায় না; তারও কেজি তিনশ টাকা, এক হালি ডিমের দাম ৬০ টাকা, এক কেজি শসার দাম ৭০-৮০ টাকা, একটা ছোট-আকারের ডাব, রোগীর পথ্য, যার ভেতরে দু ঢোকের বেশি পানিও থাকে না, তারই দাম একশ টাকা, এক কেজি দুধের দাম একশ দশ টাকা, এক হালি লেবু ৬০ টাকার কমে মেলে না; কোনওকিছুর দাম যে কমবে, সেই নমুনাও নাই। সরকারের চেয়ে ব্যবসায়ীদের শক্তি অনেক বেশি…।
আলিম, শোন; দু বছরের করোনা-সংক্রমণ, তার পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পুরো দুনিয়ায়ই তীব্র মন্দা, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, আমরাও তাতেই ভুগছি…।
আপনার কথা মানছি। কিন্তু আমাদের যেটা দুর্ভাগ্য, এই যে বাজারে আক্রা, খাদ্যপণ্যের অসহনীয় দাম, মানুষ দুটো ভাত কোনওমতে জোটাতে পারলেও মাছ-মাংস পাতে তুলতেই পারছে না―আমাদের কিন্তু এই কথাটা বলারও স্বাধীনতা নেই। দেখছেন তো, দেশে কথা বললেই…।
শ্রীদামদা বলল―‘আলিম, থামো, থামো, জিহ্বা সামলাও। কথা অন্যদিকে যেতেছে। বিপদ হতে পারে…।’
বিপদ! আমজনতার চারদিকেই বিপদ…।
বাউল সাগর সরকার এতক্ষণে মুখ খুলল। সে দীর্ঘ সময় ধরে গুনগুন করছিল―‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়…’―সে বলল―আমি একটা কথা কই, শ্রীদামদা। দেহেন, এটার মধ্যেও আবার বিপজ্জনক কিছু আছে কিনা… ?
কও দেহি, কী কবা…।
দ্যাশে নাকি বড় বুদ্ধিজীবী আর ছোট বুদ্ধিজীবীর মধ্যে কাইজা লাগছে… ?
ও, এই কথা! শ্রীদামদা বলল―‘নাট্যজন মামুনুর রশীদ সাহেব বলেছিলেন―দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ লেগেছে। এই দুর্ভিক্ষের সুযোগ নিয়া হিরো আলমদের উত্থান ঘটেছে…। আর কোথায় যাবা! দুই দল মাঠে নাইমা পড়ছে। একদল মামুনুর রশীদের পক্ষে, একদল হিরো আলমের পক্ষে। হিরোব্যাটার পক্ষেও মানুষ থাকে ? সব খবিশ…।’
অধ্যাপক গোপাল দাস বললেন―‘দুর্ভিক্ষ লাগেনি কোথায়, দাদা ? শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতি, ধর্ম-নৈতিকতা, বিবেক-বোধ ―সবখানে, সবকিছুতে দুর্ভিক্ষ লেগেছে। না-হলে মানুষ এত অধঃপতিত হয় কীভাবে… ?’
ব্যাংকার কাকা রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুন করছিলেন―‘পড়বে না মোর চিহ্ন এই বাটে’―তিনি বললেন―‘ডাক্তার, রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে, এবার তুমি কিছু শোনাও। আমরা তো অনেকক্ষণ বকবক করলাম। তোমার কথা শুনে আজকের মতো নিষ্ক্রান্ত হই…।’
আমি আর কী বলব ? আমি সামান্য একজন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের বলার মতো কথা আর কী থাকতে পারে। এমনিতেই, শুনি তো, কানে আসে; লোকে আড়ালে-আবডালে আমাকে নাস্তিক বলে গালাগালি করে। তবে আমি হলপ করে বলতে পারি―নাস্তিক হওয়ার মতো সাহসী মানুষ আমি নই। কিছু প্রশ্ন হয়তো আছে আমার মনে। আমি প্রশ্নগুলোর মীমাংসা খুঁজি। প্রশ্ন আরজ আলী মাতুব্বরের মনেও ছিল। তাঁর প্রশ্ন আর আমার প্রশ্ন মিলে যায়। মাতুব্বর সাহেব বুদ্ধিমান দার্শনিক ছিলেন, তাই তো তার প্রশ্নগুলোকে পুস্তকে লিখে রেখে গেছেন। তাঁর মতো আমার কিংবা অন্য কারও মনে, এই ধরনের প্রশ্ন জাগরিত হলে, আমরা আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধান’-এর আশ্রয় নিতে পারি। আমি মাতুব্বরের প্রশ্নগুলো নিয়েই আড্ডায় সবার সঙ্গে আলোচনা করি মাত্র…।
ব্যাংকার কাকাকে উদ্দেশ্য করে বললাম―কাকা শুনুন তাহলে―আরজ আলী মাতুব্বর প্রশ্ন তুলেছিলেন―‘জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যে-সব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলে না। আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই। যেখানে একই কালে দুইটি মত সত্য হতে পারে না, সেখানে শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হবে কীভাবে ? যদি বলা হয় যে, সত্য হবে একটি; তখন প্রশ্ন উঠবে কোনটি এবং কেন ? অর্থৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি কী ? সত্যতা প্রমাণের উপায় কী ? এবং সত্যের রূপ কী… ?’
প্রশ্ন তো গুরুতর, ডাক্তার! এভাবে তো কোনওদিন ভেবে দেখিনি। আমরা শুধু আমাদের ধর্ম, মানে ইসলাম কী বলছে, ইসলামের বিধান কী―এসবই বিবেচনার মধ্যে রাখি এবং মানি…।
আরও জটিল, কঠিন ও সূক্ষ্ম প্রশ্ন আছে কাকা। আরজ আলী মাতুব্বর আল্লাহর স্বরূপ নিয়েও প্রশ্ন রেখে গেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমিও মাঝে-মাঝে ভাবি। কিন্তু কোনও কূলকিনারা করতে পারি না। আমি সামান্য মানুষ, ভেদবুদ্ধি ও জ্ঞানও সামান্য, আমার মনে তো এ ধরনের চিন্তাভাবনা আসার কথা না, এসব প্রশ্নও ওঠার কথা না―কিন্তু, কাকা, প্রশ্ন উঠে যে! আমি তো মনের ভেতর অতল পানিতে শুশুকের মতো জেগে ওঠা প্রশ্নগুলোকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে পারি না। প্রশ্নগুলো আমার করোটির ভেতর কলরব করে। আল্লাহর স্বরূপ-সম্পর্কিত মাতুব্বরের প্রশ্ন শুনুন, দেখুন, কীসব ভয়ানক প্রশ্ন―‘জগতের প্রায় সকল ধর্মই একথা স্বীকার করে যে, ঈশ্বর অদ্বিতীয়, নিরাকার ও সর্বব্যাপী।… কিন্তু হিন্দুদের মুখে শোনা যায় যে, সৃষ্টিপালনের উদ্দেশ্যে ভগবান মাঝে-মাঝে সাকারও হয়ে থাকেন এবং যুগে যুগে ‘অবতার’রূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে তাঁর লীলা প্রকাশ করেন এবং যখন খ্রিস্টানদের নিকট শোনা যায় যে, পরম সত্তা―‘ভগবান, মশিহ, পরমাত্মা’―এই ত্রিত্বে প্রকাশ পাচ্ছে; আবার যখন মুসলিম ধর্মযাজকদের নিকট শোনা যায় যে, আল্লাহতায়ালা আরশে ‘কুরছি’র ওপর বসে রিজওয়ান নামক ফেরেস্তার সাহায্যে বেহেস্ত, মালেক নামে ফেরেস্তার সাহায্যে দোজখ, জিবরাইলের সাহায্যে সংবাদ প্রেরণ, আজরাইলের মাধ্যমে জান কবচ এবং মিকাইলকে দিয়ে খাদ্যবণ্টন ও আবহাওয়া দপ্তর পরিচালনা করেন―তখনই মন ধাঁধায় পড়ে, বুদ্ধি বিগড়িয়ে যায়। মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে―নিরাকার সর্বশক্তিমান ভগবানের সৃষ্টিপালনে সাকার হতে হবে কেন ? অদ্বিতীয় ঈশ্বরের মহত্ত্ব প্রকাশে ত্রিত্বের অবশ্যক কী ? সর্বব্যাপী আল্লাহতায়ালার স্থায়ী আসনে অবস্থান কীরূপ ? এবং বিশ্বজগতের কার্যপরিচালনার জন্য ফেরেস্তার সাহায্যের আবশ্যক কী… ?’
আমার চেম্বারে সিলিং ফ্যান ঘুরছিল। এবং তা বেশ জোরেশোরেই। আমি এ-ব্যাপারে সবসময়ই খুব সজাগ। গরমের দিন। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম। আমি খেয়াল রাখি―কেউ যেন আমার চেম্বারে আড্ডা দিতে এসে বিরক্ত না হন। কিন্তু আমার চোখে পড়ল―ব্যাংকার কাকা অস্বস্তি অনুভব করছেন। দু চোখের মণি কেমন ডিমের উপরিভাগের মতো ঘোলাটে সাদা দেখাচ্ছে। বুড়া মানুষটি অসুস্থবোধ করছেন নাকি ? গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে যে! আমি কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম―‘কাকা, আপনার কি খারাপ লাগছে ? ভেতরে শোওয়ার ব্যবস্থা আছে। একটু শোবেন ? প্রেসারটা মেপে দেখি…।’
ব্যাংকার কাকা বললেন―‘না ডাক্তার, শুতে হবে না। আজ থাক। তোমার কথা আমি আর নিতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এখন একটু উয়াশ পাচ্ছি। লোকমান, মানুষের মনে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে এ ধরনের প্রশ্ন, অবান্তর ও উদ্ভট বলব কিনা বুঝতে পারছি না, থাকতে পারে, তা আমার কল্পনার মধ্যেও ছিল না। আরজ আলী মাতুব্বর লোকটা প্রশ্ন যা তুলেছে, আশ্চর্য! চলো, আজ বাড়ি যাই…।’
দ্রব্যগুণে শ্রীদামদার কিছুটা তন্দ্রার মতো এসেছিল। সে হঠাৎ লাফিলে উঠল। ‘কী ব্যাপার ? কী ব্যাপার ? আমাকে রাইখাই তোমরা সবাই বাড়ি যেতেছ… ?’
আজিজুল বোধহয় এখন স্লুইস গেটের কাছাকাছি মাইক মারছে। স্লুইস গেটের কাছে ভ্যান কি অটো দাঁড় করিয়ে মাইকের হর্ন পশ্চিমপাড়া, উত্তরপাড়া―দুদিকেই ঘুরিয়ে মাইকিং করা যায়। এতে মাইকিং-এর বার্তা পৌঁছে যায় দুপাড়ার মানুষের কাছেই। আমাদের বাড়ি থেকে স্লুইস গেট ভালোই দূরে। তবু মাইকিং-এর শব্দ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি। আজিজুলের গলার স্বর, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি―সবই খুব স্পষ্ট ও পরিষ্কার; দূর থেকে মাইকিং-এর শব্দ ভেসে এলেও বোঝা যায়, এটা তারই গলা। তাছাড়া আজিজুল শোক সংবাদ প্রচার করে খুব দরদ সহকারে―কোনও মানুষের শেষযাত্রার খবর প্রচার বলে কথা! কিন্তু আজ আজিজুলের গলা খুব ভারী মনে হচ্ছে। বেশ খানিকটা দূরে নিজের বাড়িতে কফিনের ভেতর শুয়ে থেকেও টের পাচ্ছি―যখন সে উচ্চারণ করছে―শোক সংবাদ, শোক সংবাদ; রসুলপুরনিবাসী ডা. লোকমান বাশার আজ দুপুর…, তখন ওর গলা কাঁপছে। তা হবে কেন ? আজিজুল অভিজ্ঞ-মাইকম্যান, শোক সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে ওর গলা কাঁপে―এরকমটা তো কখনও দেখিনি। আমি লোকটি কে যে, বিখ্যাত কোনও লোক নই, তেমন অর্থবিত্তের মালিক নই, সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনও প্রভাব ছিল না, সামান্য হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিলাম, আর টুকটাক লেখালেখি করেছি―এতেই আমার শোক সংবাদ প্রচারের সময় আজিজুলের গলা ভারী হয়ে উঠবে কেন, কাঁপবে কেন―আমার বুঝে আসে না। আমি স্মৃতি হাতড়াই, মনে করার চেষ্টা করি―আদৌ কোনওদিন মাইকিং করার সময় ওর গলার কাঁপন দেখেছি কি দেখিনি। হ্যাঁ, মনে পড়ে, একদিন আজিজুলের গলার কাঁপন দেখেছি, সেদিন ওর গলা শুধু কাঁপছিল তাই না, আজিজুল কাঁদছিল, দরদর করে পানি পড়ছিল ওর চোখ থেকে। হ্যাঁ কাঁদবেই তো, কাঁদতে যে হবেই, এরকম পরিস্থিতির শিকার হলে যে কোনও মানুষই কাঁদবে, কাঁদতে বাধ্য; কারণ―আজিজুল সেদিন ওর নিজের বড় ছেলেসহ দুজনের শোক সংবাদ প্রচার করছিল…।
দেখুন, আল্লাহর কী বিচার! ২৩ বছর বয়সী তরতাজা যুবক আসাদুল, ক’দিন পর বিয়ে, শহরে বিয়ের বাজার করতে গেছিল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে ফিরছিল বাড়িতে, তখন মধ্যদুপুর, রাবনা বাইপাসে রোদ যেন ডাঙ্গুলি খেলছিল কংক্রিটের রাস্তায়, আসাদুলকে বহনকারী অটো ওভার ব্রিজের নিচ দিয়ে বাইপাস সড়ক অতিক্রম করছিল, হঠাৎ চোখের পলকে, অটোর চালক রহিম, জোয়ান-ছেলে, ওর বাড়িও রসুলপুর, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দক্ষিণ দিক থেকে দৈত্যের মতো ছুটে এল উত্তরবঙ্গগামী একটি লালরঙের বাস, বাসের মাথায় যেন রক্তবর্ণের সুচালো শিং, রহিমের অটোকে সজোরে গুঁতো মেরে চূর্ণবিচূর্ণ করে চলে গেল বাসটি। এও তো সৃষ্টিকর্তারই লীলা…!
আজিজুল সেদিন একই সঙ্গে নিজের ছেলে আসাদুল এবং অটোচালক রহিমের শোক সংবাদ প্রচার করছিল। এরকম দুঃখের দিনে না-কাঁদলে মানুষ কাঁদবে আর কবে ? আজিজুল সেদিন কেঁদেছিল। কিন্তু আজ আমার শোক সংবাদ প্রচার করতে গিয়েও কি কাঁদছে আজিজুল। ওর গলাটা ভারী লাগছে কেন… ?
শোক সংবাদ, শোক সংবাদ! আপনারা ধৈর্য সহকারে মনোযোগ দিয়ে শুনুন―রসুলপুরনিবাসী…।
আজিজুল সম্ভবত মাইকিং শেষ করে এখন বাড়ির দিকে আসছে। মাইকের শব্দ এখন খুব কাছাকাছি। আজিজুলের গলাও খুব ভারী। সে-যে মাইকিং করতে করতেই কেঁদেছে, তা স্পষ্ট…।
আমি কফিনের ভেতর শুয়ে আছি। কফিনটা এতক্ষণ দক্ষিণদুয়ারি ঘরের বারান্দায় ছিল। এখন আবার উঠানে নামানো হয়েছে। আমার পবিত্র গোসল তখন শেষ, লাশ সাদা সুগন্ধি কাফনে মুড়িয়ে কফিনে তোলা হবে; তখনই হঠাৎ ঢল বৃষ্টি নামল। আকাশে মেঘের ডাকাডাকি নেই, বিদ্যুচ্চমক নাই―এই চৈত্রের দুপুরবেলা বৃষ্টি―অবাক কাণ্ড! কফিনটিকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে ঘরের বারান্দায় তোলা হয়েছিল। দক্ষিণদুয়ারি এই ঘরে থাকত মা। মা ওপারবাড়ি চলে গেল―তাও তো অনেক দিন। ১১ বছর। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর, সেদিন ছিল আশুরা, পবিত্র দিন; সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে, পশ্চিম আকাশ তখন কারবালা প্রান্তরের মতোই রক্তাভ, মা ওপারবাড়ি চলে গেল। লোকজন বলাবলি করছিল―বাদশার মায়ের কী ভাগ্য, আমার বড় ভাইয়ের নাম বাদশা, বয়োজ্যেষ্ঠরা মাকে বাদশার মা বলেই ডাকত, সে পবিত্র দিনে মারা গেল, নিশ্চয়ই বেহেস্তবাসী হবে…।
মা সত্যি-সত্যি বেহেস্তে গেছে কিনা, জানি না। জানার কোনও উপায়ও নেই। প্রকৃত অর্থেই বেহেস্ত-দোজখ আছে কি নেই, তাও তো দেখছি প্রশ্নসাপেক্ষ। স্টিফেন হকিং পরকাল কিংবা বেহেস্ত-দোজখের অস্তিত্ব নাকচ করে দিয়েছেন। আরজ আলী মাতুব্বরও প্রশ্ন রেখে গেছেন―বেহেস্ত-দোজখ আসলে কোথায় ? এই দুধাম আসলে মানুষের কল্পনার ফসল কিনা ? এক কবির কবিতা পড়েছি―‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর/ মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেই সুরাসুর।’ তাহলে ? আমি নিজে প্রশ্নদগ্ধ মানুষ। সুতরাং এ-প্রসঙ্গ থাক। মা বেহেস্তে গেছে, এই বিশ্বাস ধারণ করে বেঁচে থাকাই বোধকরি উত্তম। কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি―মা একবুক কষ্ট নিয়ে পরলোকে গেছে। কারণ, এই বাড়িতে যে আমি একা, নিঃসঙ্গ। আমি ছিলাম মায়ের অবাধ্য সন্তান। মা বেঁচে থাকতে কতভাবে কত চেষ্টাই না করেছে আমাকে সংসারী করার, কাজ হয়নি, ব্যর্থ হয়েছে মা; আমি মার কথামতো সংসারী হইনি। মা বোধহয় এখনও তার নিঃসঙ্গ লোকমানের জন্য হাহুতাশ করে। বেহেস্তে বসবাস করেও হয়তো তার ঘুম হয় না ঠিকমতো। মার কথা ভেবেই, তার মৃত্যুর পর একটি কবিতা লিখেছিলাম। তার কিয়দংশ আপনাদের শোনাই―
‘আমার জন্য উদ্বেগাকুল হওয়ার দরকার নেই মা; আমিও
তো আসছি! পাসপোর্ট প্রস্তুত। ভিসার জন্য আবেদন করেছি
স্বর্গীয় দূতাবাসে; সিলটা পড়লেই চলে আসব তোমার কাছে।
মাত্র তো এক সেকেন্ডের পথ! ভালো থেকো মা…।’
বৃষ্টির জন্য গোর-কাটা বন্ধ ছিল। বৃষ্টি ধরে যাওয়ার পর আবার গোর-কাটা শুরু হয়েছে। জুলফিকার কাকা, শ্রীদামদা, অধ্যাপক গোপাল দাস, বাউলশিল্পী সগির সরকার―ওরা সবাই, আরও কেউ-কেউ, যারা কদাচিৎ আমার চেম্বারে বসে―তারা, অনেক আগেই এসেছে। জুলফিকার কাকা নিজে গোর-কাটার তদারকি করছেন। বাড়ির পূর্ব-উত্তর কোণে বকুল গাছটার নিচে মায়ের গোরের পাশেই আমার গোর হবে। এটাই আমার ইচ্ছে ছিল। মাকে ওখানে গোর দেওয়ার পরদিন বকুলের চারাটি আমি রোপণ করেছিলাম…।
বৃষ্টি ছুট দিতেই লোকজন আসতে শুরু করেছে। বৃষ্টি দেখে যারা চলে গেছিল তারাও আসছে। এখন উঠান-ভরা লোকজন। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। শ্রীদামদা বুদ্ধি করে মোকাদ্দেসের ডেকোরেটর থেকে চেয়ার আনিয়েছে। দাদা সাংসারিক কি সামাজিক―সব কাজই নিখুঁতভাবে গুছিয়ে করতে পারে। কখন, কোথায় কী দরকার হবে এটা দাদা খুব ভালো বোঝে। মড়াবাড়িতেও যে ডেকোরেশনের চেয়ার লাগবে, লোকজনকে বসতে দিতে হবে―এটা তাকে কারও বলে দেওয়ার দরকার পড়েনি। নিজের বুদ্ধিমতোই আনিয়েছে। আমি শ্রীদামদার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করি। অধ্যাপক গোপাল দাস আর বাউল সগির সরকার দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছে। দুজনেরই থমথমে মুখ। সম্ভবত দুজনেই সৃষ্টিকর্তার বিবেচনাবোধের ময়নাতদন্ত করছে―লোকমান বাশারের কী এমন বয়স হয়েছিল যে তাকে এখনই তুলে নিয়ে যেতে হবে…!
তাই তো! কফিনের ভেতর শুয়ে-শুয়ে বিষয়টি নিয়ে আমিও ভেবেছি কিছুক্ষণ। কতই বা বয়স হয়েছে আমার ? ৫৫ কি ৫৬। চোখে পড়ে এমন কোনও রোগ-ব্যাধিতেও আক্রান্ত ছিলাম না। বেলা ১২টার দিকে চেম্বার থেকে এসে আলাউদ্দিন আল আজাদের নির্বাচিত গল্পগ্রন্থ থেকে ‘বৃষ্টি’ গল্পটি পড়ছিলাম, পুরোপুরি ঘোরগ্রস্ত ও আচ্ছন্ন হয়ে। এমনও হয় ছোটগল্প! বলতে পারি―একেবারে বন্য, হিংস্র, প্রথাবিরোধী। পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম―আমাদের ছোটগল্পের বিষয়, ভাষা আর বুননশৈলী নিয়ে। দেখুন গল্পটির বিষয়বস্তু―দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না, খরায় পুড়ে যাচ্ছে ফসলের জমি, কিন্তু কেন বৃষ্টি হচ্ছে না―একদিন জুম্মা নামাজের পর মৌলানা মহিউদ্দিন বয়ান করলেন―‘কিতাবে আছে, খোদার গজব নামে তখনি―যখন দুনিয়া গুনাগারিতে ভরে যায়।’ হাজি কলিমুল্লাহ বললেন―‘এই অনাবৃষ্টি কেন হলো, আপনারা ভেবেছেন কি ? নিশ্চয়ই কোনও মেয়ে অবৈধভাবে গর্ভবতী হয়েছে…।’ অর্থাৎ মানুষের, বিশেষ করে কোনও মেয়ে-মানুষের পাপের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। মেয়ে-মানুষটির খোঁজ শুরু হলো। কে হতে পারে এই ভ্রষ্টা-পাপিষ্ঠা নারী ? হাজিবাড়ির কাজের মহিলা জৈগুন খোঁজ এনে দিল―বাতাসির পেটে পাঁচ মাসের বাচ্চা―অথচ আট মাস আগে ওর স্বামী ইহলোক ত্যাগ করেছে। খবর পেয়ে হাজি কলিমুল্লাহ বেজায় খুশি। এই মেয়েটাকে শাস্তি দিতে পারলেই বৃষ্টি নামবে। শান্তির বৃষ্টি। মৌলানা মহিউদ্দিনের বাড়িতে বিচার বসল, বাতাসির বিচার হলো―পঞ্চাশ ঘা জুতার বাড়ি, গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে; বিচার যখন হচ্ছিল তখন চারদিক আঁধার করে বৃষ্টি নামতে শুরু করল আর তখন হাজি কলিমুল্লাহর নতুন বউ যুবতী জোহরার ঘরে সৎ-ছেলে খালেদ; তখন বৃষ্টি নামছিল তাদের ঘরে, ঘরের চালে, উঠানে; গল্পটি পড়ে আমি কেমন যেন হয়ে গেছিলাম, বাকরুদ্ধ হওয়ার জো, গল্পের বিষয়-প্রকরণ নিয়ে আর ভাবতেও পারছিলাম না, তখনই মনে হলো―পাথরের চাঁইয়ের মতো ভারী ও ওজনদার কেউ যেন আমার বুকের ওপর চেপে বসল, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না; আর নিঃশ্বাস নিতে না-পারাই তো মৃত্যু…।
উঠানে গিজগিজে লোক। তারা লোকমান বাশারের আত্মার শান্তি কামনা করতে এসেছে। গোর খোঁড়া শেষ হলেই জানাজা হবে। তারপর দাফন। বাড়ির আবহ শোকগ্রস্ত। লোকটা অল্পব য়সেই চলে গেল! এই শোকগ্রস্ত পরিবেশেও আমার মনে হলো―আমি মৃত, কিছুক্ষণের মধ্যেই গোর দেওয়া হবে, তারপরও আমি বুঝতে পারছি, হয়তো এটা অলৌকিক ব্যাপার, আমার পঞ্চেন্দ্রিয়ের একটা ইন্দ্রিয়―কর্ণ―জেগে আছে, আমি শুনতে পাচ্ছি―কিছু লোক বলাবলি করছে―এই লোকটার কী গতি হবে… ?
কী গতি হবে, মানে… ?
মানে, ডা. লোকমান বাশার নাকি নাস্তিক ছিল। আল্লাহ-রসুল, কোরআন-হাদিসে তার বিশ্বাস ছিল না। নাস্তিক লোকের জায়গা তো দোজখেই…।
কে বলল ডাক্তার নাস্তিক ছিল… ?
বাজারে চাউর ছিল। মসজিদের ইমাম সাহেব বলত…।
আমি মনোযোগ দিয়ে লোকগুলোর কথা শুনছি। দেখি, লোকমান বাশার সম্পর্কে ওরা আর কী বলে… ?
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ