
গভীর রাত। টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হারিকেনটা নিভিয়ে দিয়ে আফসার আলি শুয়ে পড়ল, বাইরের ঝড় বৃষ্টি বেশ আগেই থেমে গেছে। টিনের ঘরের মাঝ-বরাবর মুলিবাঁশের একটা বেড়া দিয়ে ঘরটাকে দুই ভাগ করা হয়েছে, অপর পাশে শুয়ে আছে তার কলেজপড়ুয়া মেয়ে পরি। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, রাতের নিস্তব্ধতায় তার নিঃশ্বাসের শব্দও পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি শুরু হলেই মেয়েটা কেমন যেন চুপ হয়ে যায়, হয়তো ভয় পায়! অথচ মেয়েটা জানেই না তার চাইতেও ঝড়-বৃষ্টিকে বেশি ভয় পায় তার বাবা।
সেই শেষ বিকেলে আফসার আলি যখন বাড়ি ফিরে আসছিল তখন হঠাৎ করেই লু-হাওয়া বইতে শুরু করে। ফাঁকা মাঠের উপর বাতাসের ঘূর্ণিতে শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ, খড় আর ধুলোবালি মিলেমিশে একাকার হয়ে একসাথে পাক খেতে শুরু করে। সন্ধ্যা ঘনাবার আগে আগে পুরো আকাশ ছেয়ে যায় সুরমা রঙের মেঘে, আর চরাচরে নেমে আসে থমথমে ভাব। সুরমা রঙ একসময় কালো হয়ে উঠে, সেই কালো ছায়া পড়ে নদীর ওপর। তারপর হুট করেই শুরু হয় ঝড়ো বাতাস। গাছের উদ্যত ফণাগুলোকে মনে হচ্ছিল কেউ যেন জোর করে কুর্নিশ করাতে চাচ্ছে, আর তার প্রতিবাদে গাছগুলো গোঁ গোঁ শব্দ করছে। তাদেরকে ভয় দেখাতেই যেন শুরু হলো বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানি আর মেঘের গুরুগম্ভীর ডাক। বিজলির আলোতে মুহূর্তের জন্য চরাচর আলোকিত হলেও পর-মুহূর্তেই অন্ধকার যেন দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। প্রতিরোধের বাঁধ ভেঙ্গে কিছু গাছ আত্মসমর্পণ করে প্রকৃতির হাতে আর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে দিয়ে যায় মড়মড় শব্দের মরণ চিৎকার। ততক্ষণে নদীও ঘুম থেকে জেগে উঠে শুরু করেছে উদ্দাম নাচ। বাতাসের তীব্র শো শো শব্দের সাথে সঙ্গতি রেখেই নদীর ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ছে প্রচণ্ড শব্দে। কিন্তু সে ঝড় থেমে গেছে বেশ আগেই। নদী এখন শান্ত, বিধ্বস্ত গাছগুলো ক্লান্ত আর প্রকৃতি নীরব―কিন্তু আফসার আলির চোখে ঘুম আসছে না। একে একে স্মৃতির পাতায় উঠে আসছে চাচা-চাচি, পরির মা-র মুখ। শৈশবেই বাবা-মা হারানো আফসার আলি বড় হয় নিঃসন্তান চাচা-চাচির কাছে। সন্তানের মতো আদরে, ভালোবাসায় তাকে বড় করে তুলতে থাকে, কিন্তু সেই তারাও একদিন কিছু না বলেই চলে গেল। জায়গাজমি নিয়ে একটা মামলার জন্য শহরে যেতে হয়েছিল, কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধে ঘনিয়ে আসে। সেদিনও প্রকৃতি এমন বিরূপ ছিল, মাঝনদীতে নৌকাডুবি হলে চাচা-চাচিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। দাম্পত্য জীবনের সুখও বেশিদিন ছিল না, বিয়ের বছরখানেক পরেই পরির জন্ম, কিন্তু তাকে জন্ম দিতে গিয়েই পরির মা চলে যায় না-ফেরার দেশে। সে রাতেও এমন ঝড়-বৃষ্টি ছিল। ঝড়-বৃষ্টিকে তাই আফসার আলির খুব ভয়।
পরির মা মারা যাবার পর আফসার আলি আর বিয়ে করেনি। পোস্ট অফিসে চাকরি করে আর প্রতিদিন ভোরে ছেলে-মেয়েদের আরবি শিখিয়ে বাবা-মেয়ের সংসার দিব্যি চলে যায়। তিনকূলে এই মেয়েটি ছাড়া তার এখন আর কেউ নেই; কাজের জন্য যতক্ষণ বাইরে থাকে সারাক্ষণ তার মন পড়ে থাকে বাড়িতে মেয়েটার কাছে। পোস্ট অফিসের কাজ শেষ করেই তাই বাড়িতে ছুটে আসে। এই তো কয়েক দিন আগেই সুশান্তের মেয়ের বিয়েতে তার দাওয়াত ছিল। মধ্যরাতে বিয়ের লগ্ন ছিল বলে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতে দেরি হচ্ছিল, কিন্তু আফসার আলি এত সময় পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারেনি, বিয়ে হবার আগেই বাড়ি চলে এসেছিল। আসার আগে সুশান্ত জোর করে তাকে খাইয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল সে যেন না খেয়েই আছে। বাড়িতে এসে ঘুমন্ত পরিকে ডেকে তুলে ভাত তরকারি রান্না করে বাবা মেয়েতে মিলে আবার খেতে বসলো। বাবা ছিল না বলে একা একা পরি কিছু খেতে পারেনি আবার বাবা খেয়ে আসবে চিন্তা করে কিছু রান্নাও করেনি। বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই একসময় মেয়েটা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল।
বাবার এই ভালোবাসাটা পরিও বুঝতে পারে, বাবার জন্য তার ভালোবাসাও অসীম। ছোট এই জীবনে আদর, স্নেহ, ভালোবাসা বা শাসন যা কিছু পরি পেয়েছে সব তো এই বাবার কাছ থেকেই। বাবাকে বেশিক্ষণ চোখের আড়ালে রাখতে তারও কেমন যেন অস্বস্তি লাগে; বিকেলে তার বাড়ি ফেরার সময় হলেই ঘরের দাওয়ায় এসে বসে থাকে, উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে দুচাকায় চড়ে বাবার ফিরে আসার পথের দিকে। তার সাইকেল দেখা মাত্র পরি ঘরের ভেতরে চলে যায় আর বাড়ির কাছাকাছি এসে আফসার আলি যেন জানান দিতেই টুং টাং করে সাইকেলের বেল বাজাতে শুরু করে। আফসার আলি কখনই জানতে পারেনি পথের বাঁক ঘোরার সাথে সাথে পরি জেনে গিয়েছে বাবা আসছে, বেল বাজিয়ে তাকে জানান দেবার কোন প্রয়োজন নেই।
মাঝে মাঝে আফসার আলি রেগে গিয়ে যখন কিছু বলে পরি বুঝতে পারে এই বলার পেছনে যতটা না রাগ আছে তার চাইতে বেশি আছে স্নেহ। তবে মাঝে মাঝে পরিও যে রেগে উঠে না তা নয়; প্রতিদিন সন্ধ্যার পর পরি যখন পড়তে বসে তখন ইচ্ছা করেই যেন আফসার আলি এটা সেটা জিজ্ঞেস করে পরিকে বিরক্ত করার জন্য। পরি তখন রেগে উঠে কিছু বললে তার কথা বলার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। পরি তাই এখন আর রাগ করে না, বুঝে গিয়েছে বাবার সাথে কিছুক্ষণ তাল মিলিয়ে গেলেই সে চুপ হয়ে যাবে। ছোটবেলার মতো এখনও রাতে পরি আগে না ঘুমালে সে ঘুমায় না, ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে বলেই মাঝে মাঝে ঘুম না আসলেও পরি ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। আজকে অবশ্য সে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ফজরের নামাজ পড়ে আফসার আলি দাওয়ায় এসে বসে। গত রাতে ঝড় হওয়াতেই আজকে আর কেউ পড়তে আসেনি, গ্রামের অনেক ঘর-বাড়ি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, উঠান জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙ্গা ডাল, মরা পাতা, খড়। ছেলে-মেয়েরা কেউ না আসলেও প্রতিদিনকার মতো আফসার আলি দাওয়ায় এসে বসে সুললিত কণ্ঠে কোরআন পড়তে শুরু করল। পরি ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গুনগুন করতে করতে উঠোন ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। সকালের মিষ্টি রোদ খেলা করে বেড়াচ্ছে পরির কপালে, চিবুকে, হাতের চুড়িতে, কানের দুলে। তার দিকে নজর পড়তেই কিছুক্ষণ চুপ করে মেয়েকে দেখতে থাকে। সম্মোহিত আফসার আলির রোদের এই খেলা দেখতে ভালো লাগে; রোদ সরাসরি আসতে পারছে না, উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ডালিম, পেয়ারা, বড়ই আর ছাতিম গাছের ছড়ানো পাতার মধ্য দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে পরির গায়ে নেমে আসছে। প্লাবনের মতো নয়, কিন্তু অতি সূক্ষ¥ সংবেদনশীলতা নিয়েই যেন রোদের এই লুকোচুরি খেলা চলছে। সে একটু আনমনা হয়ে যায়, এই বয়সেই পরির মা-কে বিয়ে করে এনেছিল, সারাদিন ঘর উঠানে ছুটাছুটি করে বেড়াতে বেড়াতে পরির মা-ও এমন গুনগুন করত। মধুময় অতীত আর প্রশান্ত বর্তমানকে এক পাশে সরিয়ে রেখে কপট বিরক্তি নিয়ে সে মেয়ের উদ্দেশে বলে উঠে―‘পরি! মুই কোরান পরংচো, আর তুই গান কওছিস ?’ বাবার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটার মতো একটা হাসি দিয়ে পরি ঘরের ভেতরে চলে যায়, তখনও সে গুনগুন করে যাচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে পরি বেরিয়ে আসে; সামনে দিয়ে যেতে যেতে বলতে থাকে, ‘মুই কলেজত গেনু, বাবা৷ আন্দন করা আচে, খায়া নেন।’ পরির যাবার পথের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আফসার আলি ভাবতে থাকে, মেয়েকে বিদায় দেবার সময় ঘনিয়ে আসছে। তার চোখে টলমলে পানি, কিন্তু সে তখনও জানতো না পরিকে বিদায় জানাবার খুব বেশি দেরি নেই।
মেয়ে বেরিয়ে যাবার পর আফসার আলি বের হয়, ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে গ্রামের বাজারে। বাজারের মুখেই একটা বিশাল শিমুল গাছের নিচে পোস্টঅফিস, পোস্টঅফিসের পর থেকেই বাজার শুরু হয়েছে। ছোট গ্রাম হওয়ায় এবং চিঠিপত্র খুব কম আসে বলে সে নিজেই পোস্টমাস্টার, নিজেই ডাক বাহক। প্রায় পঁচিশ বছর ধরে এই পোস্ট অফিসে চাকরি করলেও সবচাইতে বড় আফসোস আজ পর্যন্ত তার কাছে কোনও চিঠি আসেনি। এতগুলো বছর ধরে সে শুধু অন্যের চিঠি বিলি করে যাচ্ছে, কিন্তু নিজের বাড়িতে কোনও চিঠি নিয়ে যেতে পারেনি। একটা সময় সে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করত একদিন হয়তো তার কাছেও একটা চিঠি আসবে, কেউ হয়তো তাকেও একটা চিঠি লিখবে। এমনকি মাঝেমাঝে বন্ধুদেরকে ঠাট্টা করে বলত, তোরাও তো আমার কাছে চিঠি পাঠাতে পারিস। চিঠি পাবার সেই তীব্র আকুলতা এখন অবশ্য কমে গেছে, আর নিজ বাড়িতে একেবারেই যে চিঠি নিয়ে যায়নি তা-ও নয়। কোনও কারণে শহরে গেলে সেখান থেকে সে পরির মা-কে চিঠি লিখতো, তারপর নিজেই সেই চিঠি নিয়ে গিয়ে বলত, ‘কোনঠে রে তুই! দেখ তোর নামোত চিঠি আচছে’―পুকুর পাড়ে বা ঘরের দাওয়ায় বসে নিজেই সেই চিঠি পরির মা-কে পড়ে শোনাত আর পরির মা আঁচলে মুখ ঢেকে ফিকফিক করে হাসতো। পরির মার কাছে এখন আর কোনও চিঠি আসে না।
গ্রামের পরিচিত মুখ বলে বাজারে যাবার সময় প্রায় সবাই একবার করে পোস্ট অফিসে উঁকি দিয়ে বলে যায়, ‘কী খবর বাহে ? ক্যাংকা আচেন ?’ অবশ্য করিম শেখ, রহমত আলি, ইব্রাহীম খাঁ, সুশান্ত বসাকদের কথা আলাদা। প্রায় সমবয়সী হওয়ায় ওরা যখন আসে তখন গল্প গুজব করে মাতিয়ে রাখার জন্যই আসে। এভাবে লোকজনের সাথে গল্পগুজব করে আর গতানুগতিক কাজের মধ্য দিয়েই আফসার আলি দিন পার করে, এভাবেই একটা একটা করে দিন চলে যায়।
এভাবে চলতে চলতেই ধান কাটার মৌসুম চলে আসে। ফাঁকা হতে থাকে মাঠ, ধানে আর খড়ে ভরে উঠে গৃহস্থের ঘর-বাড়ি-উঠান-গোলা। ধান কাটার জন্য উত্তর থেকে আসা কামলাদের সাথে নিয়ে গ্রামের পুরুষরা দিনে ধান কাটে, ভারে করে আঁটি-বাঁধা ধান নিয়ে আসে খলায়, সেখানে পালা সাজায় আর মহিলারা ধান শুকায় গোবর লেপা আঙ্গিনায়, ছড়ানো ধানে পায়ের পাতা ডুবিয়ে ঘুরে ঘুরে আঙ্গিনায় ছড়িয়ে দেয়। রাত নামলে বড় বড় পিতলের ডেকচিতে ধান সিদ্ধ করে পাঁচমুখো চুলায় আর পুরুষরা শূন্য ড্রাম আর কাঠের তক্তা বিছিয়ে ধানের আঁটি পেটায় অথবা গরু মহিষের পেছনে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে ধান মাড়াই করে। অবস্থাপন্নরা নিজেরা মাঠে নেমে কাজ না করলেও কাজের তদারকির জন্য সারাক্ষণ তাদের কামলাদের সাথেই থাকতে হয়। ধান কাটার এই সময়টায় গ্রামে যখন খুশির আমেজ বয়ে যায়, তখন একমাত্র আফসার আলির মন খারাপ থাকে। গল্প করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া এ সময় কঠিন, সারাদিন তাই তাকে একা একাই কাটাতে হয়। নিজের যাপিত জীবন আর অতীতের সুখ দুঃখের স্মৃতি এই সময়টাতেই তাকে বেশি করে তাড়িয়ে বেড়ায়। একা থাকার মুহূর্তগুলো মাঝে মাঝেই সে পার করে বেওয়ারিশ চিঠিগুলো পড়ে―নিজের কাছে চিঠি না আসার দুঃখ সে এই চিঠিগুলো বার বার পড়েই কিছুটা কমানোর চেষ্টা করে। কোনও বেওয়ারিশ চিঠিই ফেলে দেয়নি। অবশ্য এই গ্রামে চিঠি এমনিতেই কম আসে, বেওয়ারিশ চিঠির সংখ্যাও তাই খুব একটা বেশি নয়। আলাদা একটা ড্রয়ারে এই চিঠিগুলোকে জমিয়ে রেখেছে।
কর্মহীন এমন একটা দিন পার করে সাইকেল চালিয়ে মেঠো পথ দিয়ে আফসার আলি বাড়ির দিকে আসতে থাকে। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে বলে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ঢুকেই সে চলে যায় কলপাড়ে ওজু করতে। ওজু করে ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে পরি ঘরে নেই, সন্ধ্যাবাতিও জ্বালানো হয়নি। একটু অবাক হলেও পরিকে ডাকাডাকি না করে তাড়াতাড়ি নামাজে দাঁড়িয়ে যায়; পরি হয়তো আছে আশেপাশেই। নামাজ শেষ করার পরেও যখন পরি ফিরে আসে না তখন সে উঠানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মেয়ের নাম ধরে ডাকাডাকি করে। মেয়ের কোনও সাড়া না পেয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে, ‘মোর বেটিক কেউ দেকচেন ?’ উন্মাদের মতো সারা গ্রাম চষে ফেলে আফসার আলি কিন্তু পরির খোঁজ কেউ দিতে পারে না―পরি কোথাও নেই!
গভীর রাতে যখন ঘরের দাওয়ায় বসে বিড়বিড় করতে করতে গামারি কাঠের খুঁটিতে হেলান দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, পরি তখন তার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে নির্ঘুম জেগে আছে। আফসার আলি তখনও জানে না, পরির সাথে তার আর কোনওদিন দেখা হবে না। পরি তখনও জানে না, ভালোবাসার টানে কাঞ্চন ভেবে পরম নির্ভরতায় আর প্রেমের প্রমত্ততায় যার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বাবাকে ত্যাগ করে এসেছে সে নিতান্তই একটা কাচের টুকরো। যার হাত ধরে সে বিক্ষুব্ধ সংসারে ঝাঁপ দিতে চেয়েছে সেই তাকে একদিন ছুড়ে ফেলবে এক গণ্ডূষ জলের মতো।
পরির পালিয়ে যাওয়া গ্রামের লোকজনের গাল-গল্পের বিষয়বস্তু হলেও সরাসরি আফসার আলিকে তারা কিছু বলে না, সেও চেষ্টা করে যতটা সম্ভব গ্রামের লোকজনদের এড়িয়ে চলার। তারপর ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে পোস্ট অফিসের গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ানো শিমুল গাছটা যখন মাতাল সাঁওতালদের চোখের মতো শতসহস্র টকটকে লাল ফুল নিয়ে ঝকমক করে উঠল, তখন তার কাছে একটা চিঠি এলো। খামের উপর লেখা তার নামের দিকে তাকিয়েই আফসার আলি চমকে উঠে, এ যে পরির হাতের লেখা! বেদনার একটা চোরাস্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও কোনওরকমে খামটা খুলে চিঠি পড়তে শুরু করে। মাত্র কয়েকটা শব্দের ছোট চিঠি―
বাবা,
এই চিঠি তুমি যখন পাবে তখন আমি আর বেঁচে নেই। আমি ভুল করেছিলাম বাবা, যদি পারো তবে ক্ষমা করে দিও।
তোমার আদরের পরি
আফসার আলি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, মনে হয় যেন পাথরের মতো স্থাণু হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সে যখন আটকে রাখা নিঃশ্বাস সশব্দে ত্যাগ করে তখন বাহির থেকে তাকে দেখে শান্ত মনে হলেও ভেতরে তার ভয়াল তাণ্ডব বয়ে চলেছে―যে তাণ্ডব হয়েছিল চাচা-চাচিকে হারানোর দিনে, যে তাণ্ডব চলেছিল পরির মা-র চলে যাবার দিনে।
আকাশে তখন মেঘ জমতে শুরু করেছে, চরাচরে নেমে এসেছে ঝুঝকো আঁধার। ঘোলা হয়ে যাওয়া চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে আফসার আলি চিঠিটা সযত্নে তার বুক পকেটে তুলে রাখে। তার কাছে আসা প্রথম চিঠি!
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ



