আর্কাইভগল্প

গল্প : হাসনাহেনার সৌরভ : সুজন বড়ুয়া

হাফিজউদ্দিন সাহেব বাসায় এসে দেখেন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। ছোট মেয়ে হেনার বাসায় থাকবার কথা। তিনি ডোরবেল চাপলেন।

হাফিজউদ্দিন সাহেব গিয়েছিলেন পল্টনের দিকে। বেরিয়ে ছিলেন তিনটার সময়। সাধারণত বিকেলে বের হলে এত সহসা ফেরেন না। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর খানেক আগে। একসময় সারাদিনই বাইরে থাকা মানুষ, বাসায় আর কতক্ষণ ভালো লাগে! তাই পল্টনের দিকে গেলে বন্ধুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান। আজ বন্ধু শাফায়াতকে পাওয়া যায়নি তার অফিসে। ফিরতে দেরি হবে শুনে আজ আর বসেননি সেখানে। এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসেছেন বাসায়।

মালিবাগে বাসা। সাত তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় থাকেন তারা। লিফট নেই। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হাফিজ সাহেব। বাসায় ঢোকার একটাই দরজা। ঢুকেই ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। তারপর তিন দিকে সব ঘর ছড়ানো। ড্রইং-ডাইনিংয়ের ওপাশে বড় রাস্তার দিকে জানালা। সেই জানালা দিয়ে সারাদিন অবাধে আলো আসে ঘরে।

দরজা খুলতে সচরাচর এতক্ষণ দেরি হয় না। ওয়াশ রুমে গেল নাকি ? কিন্তু ভেতরে দরজার কাছেই লোক চলাচলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যেন। মনে হচ্ছে ব্যস্তভাবে কেউ নড়াচড়া করছে। চাপাস্বরে কথা বলার শব্দও ভেসে আসছে কি ?    

হাফিজ সাহেব আবার ডোরবেল চাপলেন। ব্যগ্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে। সময় গড়াচ্ছে। দরজা খুলছে না তবু। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। বেল চাপলেন আবার। এবার বেশ লম্বা করে।

অবশেষে দরজা খুলল। হেনা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। স্বাভাবিক তার চাহনি। কিন্তু হাফিজ সাহেব খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলেন, কোথায় যেন একটু সমস্যা। মেয়ের চেহারায় ভয়মাখা এক অপ্রতিভ ভাব স্পষ্ট। ঘরে অস্বাভাবিক কিছু কি ঘটেছে ? মেয়ে কি কিছু লুকাচ্ছে ? ঘরে কি অবাঞ্ছিত কেউ আছে ? বাইরের কেউ কি এসেছে ? কই, দরজার বাইরে কারও জুতা স্যান্ডেল তো ছিল না।

হাফিজ সাহেব নিজেকে সামলে নিলেন। ভেতরের উত্তেজনা চাপা দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। মুখে শুধু বললেন, দরজা খুলতে এতক্ষণ সময় লাগল!

হ্যাঁ, একটু… বলতে বলতেই নিজের ঘরে চলে গেল হেনা। মুখ জুড়ে যেন কেমন অস্থির আলো-আঁধারি।

মেয়েদের এমন অস্পষ্ট আচরণে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন হাফিজ সাহেব। দুই কন্যাসন্তানের জনক তিনি। স্ত্রী রুবিনাকে নিয়ে চারজনের সংসার। বাসায় নিজেকে সংখ্যালঘুই ভাবেন তিনি। সব সময় সংযত থাকেন যেন মেয়েদের স্বাধীন জীবন-যাপনে কোনও বাধা না পড়ে। ঘরের মধ্যে চলাচলেও সব সময় পা ফেলেন রয়েসয়ে, বুঝেশুনে। সর্বত্র অগ্রাধিকার মেয়েদের।

বড় মেয়ে হাসনা। ছোট মেয়ের জন্মের পর বড় বোনের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রেখেছিলেন হেনা। হাফিজ সাহেব সেদিন বলেছিলেন, হাসনার ছোট বোন হবে হেনা। দুই বোন মিলে এক ফুল―হাসনাহেনা। আমাদের বাগানকে প্রতিদিন সৌরভে ভরিয়ে দেবে দুজন।

দুই মেয়েকে সেভাবেই তৈরি করেছিলেন হাফিজ সাহেব আর স্ত্রী রুবিনা মিলে। সাদাসিধে সরল মানুষ হাফিজ সাহেব। কোনও অসৎ অন্যায় ধান্দা-ফিকির তিনি জানেন না। সংসারের সচ্ছলতার জন্য চাকরি করেছেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই। হাফিজ সাহেব ছিলেন সরকারি ব্যাংকের সহকারী ম্যানেজার। রুবিনা মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষিকা। মেয়েদের পড়িয়ে ছিলেন শহরের সেরা স্কুল-কলেজে। সেই সঙ্গে শিখিয়েছিলেন ছবি আঁকা, নাচ ও গান। শৈশব-কৈশোরেই সব আলোর দুয়ার চিনিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের। বড় মেয়ে হাসনা এখন ঢাকা মেডিকেলে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে হেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমেস্ট্রি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। দুই মেয়েকে নিয়েই হাফিজ সাহেবের যত স্বপ্ন-আশা। তার একান্ত কামনা―মেয়েরা সাফল্যের শীর্ষ শিখর স্পর্শ করুক। তারা যখন যা চায় সাধ্যমতো চাহিদা মেটাতে চেষ্টার ত্রুটি করেন না কখনও।

কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে মাঝে মাঝে কেমন ধন্দ লাগে হাফিজ সাহেবের। মেয়েদের কি সত্যিকারের স্বপ্নের পথে নিতে পারছেন ? নাকি এত অবাধ সুযোগ-স্বাধীনতা মেয়েদের বিপথে ঠেলে দিচ্ছে ? তা না হলে এমন হবে কেন ? মেয়েদের গতিবিধি দেখে থমকে যান তিনি। মনে মনে প্রমাদ গোনেন। এ কী দেখছি! এমন দিন আসবে কোনওদিন তো কল্পনাও করিনি।

অথচ হাসনা যেদিন সরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে গেল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির চূড়ান্ত সুযোগ পেল সেদিন হাফিজ সাহেবের পরিবারে যেন আনন্দের বান ডেকেছিল। তিনি ভেবেছিলেন জীবনটা বুঝি সার্থক হতে চলেছে। আহা, এত আনন্দ কোথায় রাখি ? আল্লাহ, তুমিই সবকিছুর মালিক। তুমিই ভালো জানো।

হাসনা যেদিন প্রথম মেডিকেল কলেজের ক্লাসে যাচ্ছিল, তখন হাফিজ সাহেব বলেছিলেন, মাগো, দোয়া করি অনেক বড় হও। এতদিন তুমি নদীতে ছিলে, এখন সাগরে যাচ্ছ। আমরা চাই তোমরা সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বজয়ী হও। তবে সব ক্ষেত্রে নিজের স্বকীয়তা ও শালীনতা বজায় রেখো।

কিন্তু ক্লাস শুরুর ছয় মাসের মধ্যেই হাসনার চালচলন, ভাবভঙ্গি সব কেমন পাল্টে যেতে লাগল দ্রুত। ব্যস্ত, চুপচাপ, যেন স্ট্রেসে থাকে খুব। এক বছর গড়াতে গড়াতে একটু যেন আত্মকেন্দ্রিক, একরোখা হয়ে উঠল আরও।

একদিন সকালে স্ত্রী রুবিনা আচমকা বললেন, তোমার বড় মেয়ে হাসনা তো মনে হয় প্রেমে পড়েছে।

হাফিজ সাহেব কিঞ্চিৎ অবাক, কী বলো ? মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছি ডাক্তার হতে। এসব কী করছে! ভালো করে খোঁজ-খবর নাও তো।

এক সপ্তাহ পর রুবিনা আবার বললেন, হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিক, মেয়ে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

তুমি এতটা নিশ্চিত হলে কী করে ?―হাফিজ সাহেবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।

হাসনার ফোনে যখন-তখন একটা রিং আসে। নামটা কেমন যেন বাংলা বাংলা নাম―সুবীর।

হাফিজ সাহেব এবার আরও উৎসুক হয়ে তাকান―তারপর ?

রুবিনা বলতে থাকেন, হাসনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সুবীর কে রে ? হাসনা বলেছে, ওর ক্লাসমেট। ভালো ছাত্র। কিছুদিন আগে যে ওদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলো, সেই অনুষ্ঠানে একসঙ্গে ওরা গান করেছে, আর নাট্যাংশে একসঙ্গে অভিনয়ও করেছে। ছেলেটার পুরো নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল, সুবীর বৈদ্য। তার মানে হিন্দু ছেলে।

হাফিজ সাহেব বিমর্ষ-নির্বাক। মনে মনে এটারই ভয় পেয়েছিলেন তিনি। মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়েছে, ছেলেদের সংস্পর্শে তেমন যায়নি। মেডিকেল কলেজে যাওয়ার প্রথম দিনেই মেয়েকে বলেছিলেন ‘স্বকীয়তা-শালীনতা বজায় রেখো’। এর কিছুই মনে রাখেনি মেয়েটা! একসঙ্গে এতগুলো ছেলে দেখে কি মাথা বিগড়ে গেল ? আসলে এসব কি সত্যি ? হাফিজ সাহেব বিচলিত হয়ে বললেন, ব্যাপারটা এতদূর গড়িয়েছে তুমি কীভাবে বুঝলে ?

দেখো না, মেয়ে কেমন আনমনা হয়ে গুটিয়ে গুটিয়ে থাকে। ছুটির দিনেও ল্যাবের কথা বলে বাইরে চলে যায়। সন্ধ্যার পরও বাসায় ফিরতে চায় না। ফোন করলে অনেক সময় ফোন ধরে না, রিং-ব্যাকও করে না। তোমাকে আমি বারবার বলেছিলাম, মেয়েদের বেশি পড়াশোনার দরকার নাই।―রুবিনার বুক ফেটে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে এতদিনের চাপা হাহাকার।

হাফিজ সাহেব কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, মেয়েকে বোঝাও, পড়াশোনায় জোর দিতে বলো। একটু থেমে আবার বলেন, মেডিকেলে ভর্তি হয়ে যদি ও এসবই করবে, তাহলে বিয়ে করেই পড়তে থাকুক। আমি ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ দেখছি। তুমি ভেবো না।

এক সপ্তাহের মধ্যেই মেয়ে হাসনার জন্য উপযুক্ত একটি পাত্রের সন্ধান পেয়ে গিয়েছিলেন হাফিজ সাহেব। পাত্র পিজি হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করছে। হবু ডাক্তার-পাত্রীর জন্য ডাক্তার-পাত্র―এরচেয়ে ভালো আর কী হয় ? কিন্তু বেঁকে বসল হাসনা। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, বিয়ে! কীসের বিয়ে ? এখন আমি ওসব ভাবছি না। আমার বিয়ের জন্য তোমাদের এত ব্যস্ত হতে হবে না। সে আমি সময়মতো দেখব।

ব্যস, বাবা-মায়ের মনের চাপা আগুন এবার জ¦লে উঠল আরও দাউ দাউ করে। মেয়ে কত বদলে গেছে! কীসের জোরে এসব কথা বলে ও ? ক্রোধান্ধ হয়ে পড়েন হাফিজ সাহেব। কিন্তু পরক্ষণেই আবার পিতৃমূর্তি জেগে ওঠে তার। কাঁচা বয়েস। ভুল যদি সে করেই থাকে, শুধরে ওঠার সময় তো দেওয়া উচিত। তাছাড়া এমন গুরুতর কিছু কি হয়েছে ? সহপাঠীদের মধ্যে এরকম হালকা ভাব ভালোলাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রুবিনার অনুমান মিথ্যাও হতে পারে! মেয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করছে, সন্ধ্যায় দেরিতে হলেও বাসায় ফিরে আসছে, এসে খাওয়া-দাওয়া করছে, ঘুমাচ্ছে। দেখা যাক কী হয়। নিজেই ভেতরের উত্তেজনার রাশ টানেন হাফিজ সাহেব।

কিন্তু স্ত্রী রুবিনার কোনও ভাবান্তর নেই। তার মস্তিষ্ক যেন উত্তপ্ত কড়াই, অবয়ব যেন দুশ্চিন্তার জটিল মানচিত্র। মেয়েদের সামনে কিছুটা সামলে চললেও স্বামীর সামনে ফেটে পড়েন যখন-তখন।―এইচএসসির পর মেয়ের জন্য কত ভালো ভালো সম্বন্ধ আসল, তুমি বিয়ে দিলে না। মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করবে, ডাক্তার বানাবে। বানাও, মজা বোঝো এবার।

এদিকে ছোট মেয়ে হেনা এরই মধ্যে এইচএসসি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি হচ্ছে। ভর্তির পরীক্ষা দিচ্ছে এদিক-ওদিক। তারও আশা বড় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে।

কিন্তু একদিন রুবিনা চরম এক দাবি তুলে ধরলেন হঠাৎ। স্বামীকে তিনি বললেন, দেখো, একই ভুল আমি বারবার করতে চাই না। হেনা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, হবে। কিন্তু তার আগে তুমি ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো। বিয়ে করেই ও ভার্সিটিতে ভর্তি হবে।

হাফিজ সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন, বড় মেয়েকে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে দেব ? এসব কী আজগুবি কথা! পরে বড় মেয়ের জন্য আর পাত্র আসবে ? নানা খুঁত ধরবে তখন।

রুবিনা তার দাবিতে অনড়। শেষে ছোট মেয়ে হেনার কানেও উঠল কথাটি। হেনা বলল, আপু কি বিয়ে করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে ? আমার বেলায় কেন এই নিয়ম ? কেন আমাকে ভর্তির আগে বিয়ে করতে হবে ?

হাফিজ সাহেবের নীরবতায় হেনারই জয় হলো। ঢাকা ভার্সিটির কেমেস্ট্রি বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল সে। অবশ্য ক্লাস শুরুর দিনে ছোট মেয়ের উদ্দেশ্যে এবার আর কোনও বাণী দিলেন না হাফিজ সাহেব। বড় মেয়ের কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে বড় মর্মাহত তিনি। দেখি, ছোট মেয়ে কী করে ?

প্রথম দিকে কিছুদিন ভালোই চলল। হাফিজ সাহেব ছোট মেয়ের চলনধারা দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ খুশি। কিন্তু ছয় মাস যেতে না যেতে বদলের ছোঁয়া লাগল তার মধ্যেও। সাজ-পোশাক, চলন-বলন, মেলামেশা সবকিছু বদলে যেতে লাগল দ্রুত। হাফিজ সাহেব চুপচাপ দেখেন, মুখে কিছু বলতে পারেন না। চোখ তুলে দেখতেও কেমন সংকোচ হয় তার। আগে মেয়ে ওড়না পরত বক্ষ আবৃত করে। এখন ওড়না পরে নামমাত্র, গলা থেকে ভাঁজ করে পেছন দিকে দু পাশে ঝুলিয়ে। আগে ছেলেদের সঙ্গে মিশত সসংকোচে, দূরত্ব রেখে। এখন ক্লাসরুম ছাড়াও অবলীলায় আড্ডা দিয়ে বেড়ায় ক্যান্টিনে হোটেলে। দল বেঁধে খেতে চলে যায় এদিকে-ওদিকে।

হাফিজ সাহেব নীরবে দেখেন শোনেন আর মর্মে দগ্ধ হন। ভেতরে ভেতরে হতাশায় মুষড়ে পড়েন। কেন এমন হচ্ছে ? এমন জীবন-যাপন, চলাফেরা তো পরিবার থেকে মেয়েদের কখনও শেখানো হয়নি। শহরের সেরা গার্লস স্কুল-কলেজে মেয়েদের পড়ানো হয়েছে সারা জীবনের জন্য নারী-প্রগতির সঙ্গে সামাজিক নৈতিকতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও শালীনতা বোধে উদ্বুদ্ধ হবে বলে। স্কুল-কলেজে তো এগুলোই শেখানো হয়েছে―সংযত সাজ-পোশাক, নম্র জীবন-যাপন  সব। কিন্তু এখন কী চালচলন তাদের! স্কুল-কলেজের সব শিক্ষা ভুলে গেল! ওসব কি ভালো ছিল না ? নাকি নতুন যুগের ধর্ম এই ? নাকি আমি অতিমাত্রায় রক্ষণশীল, এ যুগে অচল ? মনে মনে নিজেকে সামাজিক মূল্যবোধের তুলাদণ্ডে বিচারের মুখোমুখি করেন হাফিজ সাহেব। না, বিপক্ষে কোনও রায় পান না তিনি। কিন্তু পিতা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণী কন্যাকে শাসনের বেড়াজালে আটকে তার স্বপ্নযাত্রার গতি রোধ করার সায়ও পান না তিনি ভেতর থেকে। তবু নিজের সন্তান চোখের সামনে অশোভন পথে পা বাড়াবে এ কি মানা যায় ? রুচিজ্ঞানে বাধা পেলেও তিনি মৃদু উষ্মা প্রকাশ করেন আকারে-ইঙ্গিতে। কিন্তু ফল হয় না। নিরুপায় হয়ে শরণাপন্ন হন স্ত্রীর, আরে, ছোট মেয়েটাও তো দেখি বড়টার পথ ধরছে। এভাবে চলাফেরা তো ঠিক না। সাজ-পোশাকে একটু দৃষ্টি দিতে বলো। 

স্ত্রী রুবিনা এমনিতেই ভেতরে ভেতরে অগ্নিকুণ্ড। এবার সাপের মতো ফোঁস করে উগড়ে দিলেন জমানো বিষ-জ¦ালা, আমি কী বলব ? তোমার মেয়ে তুমি বলো। আমার কথা তুমি শুনেছ ? উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছ, উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। দেখতে থাকো, চোখের সুখ মেটাও।

এ কী কথা! মেয়েদের এসব কি বাপ দেখে ? মেয়েরা স্লিভলেস টাইট উগ্র জামা-কাপড় পরলে সেটা মা দেখবে না ? মায়েরাই এসব শাসন বারণ করে জানি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তুমিও পড়েছ ? তোমার মেয়ে তোমার মতো হবে না ? ―হাফিজ সাহেবের কণ্ঠে অনুযোগের সুর।

এখন সেই আগের যুগ নাই। মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে লাউডগার মতো নুয়ে থাকবে ? এ জন্যই আগে বিয়ের কথা বলেছিলাম।― গজগজ করতে করতে রুবিনা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

হাফিজ সাহেব আবার নিজের মধ্যে ফিরে এলেন। এ তর্ক অবান্তর। কিন্তু স্ত্রীর এমন অসহযোগিতার কোনও কারণ খুঁজে পান না তিনি। জ্ঞাতে অজ্ঞাতে তার কোনও অন্যায় কি হয়েছে ? স্ত্রী দুই কন্যা―কারও প্রতি ? পতি ও পিতা হিসেবে একনজরে নিজের কর্মকাণ্ডের জরিপ নিলেন তিনি। হ্যাঁ, কন্যাদের স্বপ্নের পথে এগিয়ে দিতে গিয়ে তিনি স্ত্রীকে উপেক্ষা করেছেন। কন্যারা সুশিক্ষিত হলেও তাদের জীবনমান উন্নত হলে আদতে মায়েরই বেশি সুখী হওয়ার কথা। বয়স ও জীবনের অনভিজ্ঞতায় কন্যারা ভুল করতে পারে, কিন্তু রুবিনা কেন এমন অবুঝ হবে ?

হাফিজ সাহেব কী করবেন কিছু ভেবে পান না। নিজেকে মনে হয় অথই সাগরে দিগ্ভ্রান্ত নাবিক। তার আশেপাশে কেউ নেই। তাকে উত্তাল ঢেউয়ের বুকে ছেড়ে দিয়ে যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সবাই। কখনও  মনে হয় মেয়েরা যেন মানিপ্লান্ট, পর্যাপ্ত আলো-হাওয়ায় পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য তাদের রেখেছিলেন জানালার কাছে, তাতে তারা এমন বহির্মুখী হয়ে গেল যে, আর ঘরে ফেরানো যাচ্ছে না! 

ক্রমেই চারজনের সংসারে একঘরে হয়ে গেলেন হাফিজউদ্দিন। সবার সঙ্গে তার কেমন এক দূরত্ব। সবাই আছে যে যার মতো। একান্ত দৈনন্দিন প্রয়োজন ছাড়া কারও সঙ্গে কারও কথা হয় না তেমন। অবশ্য সারাদিন ঘরে প্রায় একাই থাকেন তিনি। দুই মেয়ে সকালে চলে যায় ভার্সিটিতে। হাসনার ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা-ছয়টা। হেনা ফেরে দুপুরের দিকে। স্ত্রী রুবিনার ডে শিফটের স্কুল। আসতে আসতে তাও ছয়টা গড়ায়।

আজও হেনা ফিরেছিল দুপুরের দিকে। হাফিজ সাহেব তখন বিশ্রামে ছিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর একটু শোয়ার অভ্যেস তার। তবে হেনা ফেরার পর আজ বিছানায় শুতে যাননি আর। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন পল্টনের দিকে। কিন্তু প্রতিদিন যে মানুষ বাসায় ফেরেন সন্ধ্যার পর ঘটনাক্রমে আজ তিনি ফিরেছেন একঘণ্টা পরেই। তাই বলে বাসায় এমন কী হলো যে হেনা সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলতে পারল না ?  দেরি হতেই পারে, কিন্তু আজকের দেরি হওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হয়নি হাফিজ সাহেবের। বিশেষত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে কারও ব্যস্ত নড়াচড়ার আভাস আর চাপাস্বরে কথা বলার শব্দ শুনতে পেয়েছেন তিনি। সম্ভত ভেতরে অবাঞ্ছিত কেউ একজন আছে। হেনার ভাবগতিকও স্বাভাবিক লাগছে না। কেমন অস্থির অস্থির ভাব তার। ডাইনিংয়ের পাশটায় হাসনার ঘরের দরজা বরাবর সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে ও-ঘরে কেউ যেতে না পারে।

তাহলে ও-ঘরেই কি কেউ আছে ? হাফিজ সাহেব ভেতরে ভেতরে দৃঢ় হলেন। যা-ই ঘটুক, মেয়েকে এখন না ঘাঁটানোই ভালো। দেখা যাক। ভেতর থেকে প্রধান দরজার দুটো ছিটকিনিই লাগিয়ে দিলেন তিনি। চুপচাপ বাইরের জামা-কাপড় ছাড়লেন। ওয়াশ রুমে গেলেন, কিন্তু দরজা পুরোপুরি বন্ধ করলেন না। গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে ফিরে এলেন নিজের রুমে। খবরের কাগজটা টেনে নিলেন হাতে। তারপর প্রধান দরজার দিকে মুখ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। যে-কেউ দেখলে বুঝবে খবরের কাগজ পড়ার চেয়েও দরজা পাহারা দেওয়াই তার মুখ্য উদ্দেশ্য।

হেনা ডাইনিং থেকে সরে ধীর পায়ে তার ঘরে ফিরে গেল। তার হাতে সেলফোন।

হাফিজ সাহেব ভাবলেন, এবার গিয়ে হাসনার ঘরটা একবার দেখে আসা যায়। আবার মনে হলো, না, এটা হীনতার প্রকাশ হবে। এমন দুর্বল পিতা তিনি হতে পারেন না। ঘটনা আপন নিয়মেই ঘটুক। কিন্তু বাসায় এভাবে কে আসতে পারে ? হেনার এমন কে আছে ? বিল্ডিংয়ের ছেলেরা―যাদের সঙ্গে হেনা ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভেজে, কিংবা নিচে গিয়ে রাস্তার কুকুরদের খাবার দেয়, তারা ? কিন্তু তারা তো সব বয়সে হেনার ছোট―নিচু ক্লাসে পড়ে। তাছাড়া তারা সবার চেনা, তাদের লুকিয়ে থাকতে হবে কেন ?

হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠল। হাফিজ সাহেব ঘড়ি দেখলেন―পৌনে পাঁচটা বাজে। দরজা খুলতে উঠতে যাবেন, তার আগেই হেনা এসে দরজা খুলে দিল। হাসনা ঘরে ঢুকল। ডাইনিং পেরিয়ে ঘরে যেতে যেতে হেনাও তার সঙ্গী হলো। হাফিজ সাহেব পেপারের আড়ালে মুখ ঢেকে খেয়াল করছিলেন দুই বোনের গতিবিধি। মিনিট দুই পরই দুজন আবার ফিরে এলো হেনার ঘরে।

তারপর আরো কিছুক্ষণ কেটে গেল। হাফিজ সাহেব ভাবছিলেন, কী করা উচিত ? কীভাবে ঘটনার জের টানবেন ? একটা বিষয় কেবল তার মাথায় ঘুরছিল, মেয়েদের ব্যাপার, এখানে পিতার বেশি চোটপাট চ্যাঁচামেচি করার সুযোগ নেই। কাজ করতে হবে নিঃশব্দে, কাক-পক্ষীরও জানাশোনার অন্তরালে।

হাফিজ সাহেব যখন এমন সাত-পাঁচ ভাবনার ঘূর্ণিতে থইহীন, তখন মনে হলো তার সামনে থেকে খবরের কাগজটা সরে যাচ্ছে, তার স্থলে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে একটি হাতে লেখা ফুলস্কেপ কাগজ। তাতে শুরুতে লেখা আছে―তড়িৎ রসায়ন সূত্র। আর কাগজটা ধরে আছে বড় মেয়ে হাসনা।―বাবা, এটা কিন্তু হেনার লেখা নয়।

এটা কী, কার লেখা ?―হাফিজ সাহেবের সকৌতূহল দৃষ্টি।

এটা হেনার ক্লাসমেটের লেখা।

তাতে কী হয়েছে ?

হেনা এটা পড়ার জন্য এনেছিল। কালকে এ বিষয়ে ওদের টিউটোরিয়াল এক্সাম। তাই ছেলেটা এটা নিতে এসেছে। ওরা এটা নিয়ে ডিসকাস করছিল। 

হাফিজ সাহেব প্রাণপণ চেষ্টায় সামলে নিয়েছেন নিজেকে। শান্ত কণ্ঠে জানতে চান, তারপর ?

তুমি হঠাৎ করে চলে আসায় হেনা ভয় পেয়ে ছেলেটাকে সরিয়ে রেখেছে আমার ঘরে।―গম্ভীর মুখে কথা শেষ করে হাসনা।

ঘটনাটা যদিও অনেকটা পূর্ব অনুমিত, তবু এতটা চমকপ্রদ হবে ভাবতে পারেননি হাফিজউদ্দিন। তিনি একইসঙ্গে বিস্মিত এবং হতাশ। বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন, তুমিই বলো, এটা কি ঠিক হলো ?  

হাসনার মুখে কাচুমাচু ভাব, না বাবা, ঠিক হয় নাই। ওরা সামনের ঘরে বসে থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু তোমার ভয়ে―

হাসনাকে থামিয়ে দিয়ে হাফিজ সাহেব বললেন, হেনাকে ডাকো।

হেনা ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাঁদোকাঁদো ভাব।

হাফিজ সাহেবের বিষাদমাখা দৃষ্টি, এসব কী হেনা ? তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে কি আমরা অপরাধ করেছি ? আমাদের তো দেখি মুখ লুকাবার জায়গাও থাকবে না।

হেনা হাফিজ সাহেবের বুকের কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়, বাবা, আমি ভুল করেছি। তোমার ভয়ে আমার তখন হুঁশজ্ঞান ছিল না।

স্নেহবৎসল পিতা হাফিজউদ্দিন। মেয়েদের সামান্যতম কষ্ট-কুণ্ঠাবোধ তার বুকে বাজে অনেক বড় হয়ে। ক্ষমা আর বিশ্বাসই তার কাছে পিতৃত্ব। তিনি বিগলিত কণ্ঠে বলেন, ভালো কাজে ভয় পাবে কেন মা। তোমাদের কতবার বলেছি, এমন কাজ করবে না যা মানুষের সামনে বলা যায় না, দেখানো যায় না। আজকের এই ঘটনা যদি তোমার মা জানতে পারে, তাহলে কাল থেকেই তোমাদের ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তোমরা কি তা-ই চাও ?

এরই মধ্যে হাসনাও হাফিজ সাহেবের বুকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার হাসনা হেনা দুই বোন একসঙ্গে বলে ওঠে, বাবা, আমরা তোমার মেয়ে, তোমার অমর্যাদা হোক এমন কাজ কোনওদিন করব না।

হাফিজ সাহেবের ভেতরে আবেগের পুকুরটা যেন ছলকে উঠল এবার। দু মেয়েকে তিনি বুকে টেনে নেন দু হাতে। তারপর স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বলেন, মাগো, তোমাদের কাছে আমাদের চাওয়া খুবই সামান্য। আমরা শুধু চাই, আমাদের ঘর ভরে থাকুক হাসনাহেনার সৌরভে।―একটু থেমে হাফিজ সাহেব আবার বলেন, তোমাদের মা আসার সময় হয়ে গেছে, ছেলেটাকে এখনই যেতে বলো।  

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button