
শেষ বিকেলের অল্প বৃষ্টির পর মেঘ সরে গিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর উঠেছে। মে মাসের তপ্ত গরমে অনেক দিন পর একপশলা বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি হলে রুভা তাদের দোতলা ঘরের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। বৃষ্টির জল নিয়ে সে খেলা করতে থাকে, বৃষ্টির গতি যত বাড়ে তত সে মজা পায়, খিলখিল করে হাসে। আজ বৃষ্টি হলো, তাও অনেক দিন পর, কিন্তু কিশোরী রুভার মনটা ভিজল না।
সন্ধ্যার একটু আগে আগে প্রতিদিন বাবা ঘরে ফেরেন। বাবা ঘরে ঢুকলেই রুভার মনটা ঝলমল করে ওঠে। পড়তে বসার আগে বাবার সঙ্গে তার কিছুক্ষণ গল্প করা চাই-ই চাই।
জানালার বাইরে লালমরিচের মতো আলো আর হালকা হাওয়া খেলা করছিল। বাতাসে সোঁদা গন্ধ। এখনও বাবা এল না! আজ সেই ভোরবেলায়, যখন শহর জেগে ওঠে না ঠিক, আবার ঘুমিয়েও থাকে না, তখনই রুভার ঘুম ভাঙে। এত সকালে ঘুম ভাঙার বিশেষ একটা কারণ ছিল বটে। আজ তাদের যাওয়ার কথা ছিল দূরদেশে এক পুরোনো সভ্যতার শহরে। বাবা বলেছিলেন, ‘সেইখানে ইতিহাস ঘুমিয়ে থাকে। আমরা সেই ইতিহাসের অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াব।’
রুভা খুব এক্সাইটেড হয়ে ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আজ বাতিল। কারণ, যুদ্ধ…।
রুভা জানালা দিয়ে দেখতে পেল, বাবা গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকছেন। রুভা বুঝতে পারছে না, মানুষ কেন মানুষ মারে ? মারলে বুঝি ব্যথা লাগে না!
বাবা ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হতে পারেনি, অধৈর্য রুভা গাল ফুলিয়ে জানতে চাইল, ‘বাবাই, আমরা কি যাচ্ছি না ?’
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তার মুখে গভীর ক্লান্তি। ইতিহাসের শিক্ষক তিনি, অথচ আজ যেন ইতিহাস তাঁর বুক চেপে বসেছে।
‘না রে মা। এয়ারপোর্ট বন্ধ। যুদ্ধ চলছে।’
‘কবে শেষ হবে যুদ্ধ ?’
এ উত্তর রুভার বাবার জানা নেই। রুভা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। সে যুদ্ধ দেখেনি, তবে যুদ্ধ শব্দটা তার অদ্ভুত লাগে। স্কুলে পড়েছে, কিন্তু বইয়ের পাতায় যা থাকে, তা তো রক্ত নয়। কিন্তু যুদ্ধে অনেক রক্ত ঝরে।
বাবার স্কুলে প্রতি বছর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে ম্যাগাজিন ছাপা হয়। বেশ পুরোনো কয়েকটা ম্যাগাজিন রুভার খুব পছন্দ। সেখানে তার বাবা একটা অণুগল্প লিখেছিলেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। বাবা গল্পটার নাম দিয়েছিলেন ‘শুনতে কি পাও তুমি ?’
ভোর হতে না হতেই সাগরের ঢেউ গর্জন তুলে ফিরে আসছিল। সৈকতের নির্জনতায় সেই শব্দটা কেমন যেন কান্নার মতো লাগছিল আজ। তুরস্কের বোদরুম শহরের এক কোনায়, সমুদ্রতীরের বালুকাবেলায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক শিশুর নিথর দেহ। তার গায়ে ছোট্ট লাল শার্ট, নীল প্যান্ট, পায়ে নেই কোনও জুতো। মনে হয় যেন ঘুমিয়ে আছে। তার নাম আইলান কুর্দি। সে যেন কান পেতে শুনছে কিছু একটা। কী শুনছে আইলান ?
মাত্র তিন বছর বয়স তার। পৃথিবীর কিছুই সে বোঝে না। যুদ্ধের মানে সে জানে না, সীমান্ত মানে জানে না, পাসপোর্ট বা ভিসার কোনও ভাষা তার জানা নেই। সে কেবল জানে―সে তার বাবার হাত নিশ্চিন্তে ধরে এক নতুন জায়গায় যাচ্ছে, যেখানে আর গোলাগুলি নেই, আর লুকিয়ে থাকতে হবে না।
আগের রাতে আইলান তার মা, ভাই এবং বাবার সঙ্গে একটি ছোট নৌকায় উঠেছিল। গন্তব্য ছিল গ্রিস―আরও ভালো, আরও নিরাপদ একটা জীবন। কিন্তু সমুদ্র শান্ত ছিল না। সমুদ্র তো জানে না, তার বুকে এক নিষ্পাপ ছোট্ট শিশু ছোট্ট নৌকায় লাল জামা পরে নতুন দেশে যাচ্ছে। ঢেউ একে একে সব স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে গেল। তার ছোট্ট হাতগুলো কিছুই ধরতে পারল না―না ভাইয়ের হাত, না বাবার হাত, না জীবনের আশার ছোট্ট খড়কুটো। আইলানের ছোট্ট শরীরটা ভেসে গেল ঢেউয়ে।
সকালবেলা এক তুর্কি পুলিশ তাকে তুলে নেন কোলে―সযত্নে, যেন এখনও বেঁচে আছে আইলান। ক্যামেরা ক্লিক করে চলে―আর সেই মুহূর্তটাতেই বিশ্ব বিবেকের আয়নায় গেঁথে যায় আইলান।
প্রিয় আইলান, তুমি তো চঞ্চল দেবশিশু, চঞ্চলপনা বাদ দিয়ে এত শান্ত মনে চুপচাপ তুমি কী শুনছ সমুদ্রের বালুকাবেলায় ?
যদি আইলান কথা বলতে পারত, হয়তো বলত, ‘তোমরা বলেছিলে, নতুন দেশে গিয়ে আমার জন্য খেলনা কিনবে। এখন দেখি, চারপাশে শুধু জল… আর নীরবতা। আমি তো কিছুই করিনি।’
লাল শার্টের সেই ঘুমন্ত শিশুটি আজও জেগে আছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। সে যেন বলছে―‘আমি কান পেতে শুনছি, প্রতিটি ঢেউ আমায় বলছে―এ পৃথিবী মানবের তরে, দানবের তরে নয়।’
গল্পটা পড়তে পড়তে রুভা কেঁদে ফেলেছিল। তার পরের বছর ২০১৬ সালে তার বাবা আরও মর্মান্তিক একটি অণুগল্প লেখেন। সেটাও যুদ্ধের এবং ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে।
রুভা এখনও খুব একটা ভালো করে জানে না―যুদ্ধ মানে কী, কিন্তু বুঝতে পারে―এটা আনন্দের উল্টো।
বাবা জামাকাপড় ছেড়ে সোফায় বসেছেন। মা এক কাপ চা দিয়ে গেলেন। রুভা গুটিশুটি মেরে বাবার কোলের কাছে এসে বসল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘মানুষ কেন যুদ্ধ করে, বাবাই ?’
বাবা চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে যান। একটি দীর্ঘ নীরবতা। তারপর বাবা ধীরে ধীরে বললেন, ‘মানুষ যুদ্ধ করে, কারণ তারা ভয় পায়। কখনও নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে চায়, কখনও অন্যের ওপর দখল চায়।
‘আরও সহজ করে যদি বলি, তাহলে যুদ্ধ মানে মানুষের এক গোপন ভয় আর দুর্বলতা। সেই ভয় থেকেই তার হাতে অস্ত্র ওঠে।’
রুভা একটু ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষ কি আদিকাল থেকেই যুদ্ধ করছে বাবাই ? জন্ম থেকে যুদ্ধ করতে চায় ?’
বাবা এবার চায়ের কাপে ছোট্ট করে চুমুক দিলেন। বললেন, ‘না মা, মানুষ জন্মায় কাঁদতে কাঁদতে, হাতে অস্ত্র নিয়ে নয়। একসময় মানুষ শুধু আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, ফসল ফলাতে শিখেছিল। যুদ্ধ তার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যখন একদল মানুষ জমি চাইল, আরও সম্পদ চাইল, আর দেখল সেগুলো অন্যের কাছেও আছে―তখন শুরু হলো সংঘাত।’
‘তাহলে প্রথম যুদ্ধটা কখন হয়েছিল, বাবাই ?’
‘প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়, আজকের ইরাক অঞ্চলে, কিরকুক শহরের কাছে প্রায় ৪৫০০ বছর আগের একটা যুদ্ধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। লাগাশ আর উম্মা নামক দুই শহররাষ্ট্রের মধ্যে সেই যুদ্ধ হয়েছিল। তবে যুদ্ধের চিহ্ন আরও পুরোনো। সুদানে এক গণকবরে ১৩ হাজার বছরের পুরোনো মানুষের কঙ্কালে তীরের আঘাতের দাগ পাওয়া গেছে। মনে করা হয়, সেটাই ইতিহাসের প্রথম সংঘর্ষের প্রমাণ।’
রুভার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। সে যেন ভাবছে, মানুষ এত আগে থেকেই লড়াই করছে!
‘তাহলে যুদ্ধ কখনও বন্ধ হয়নি ?’
‘তেমনই বলা যায়,’ বাবা বলেন, ‘মানুষ সভ্য হয়েছে, কিন্তু হিংসা তার মস্তিষ্কে রয়ে গেছে। সভ্যতা যত বেড়েছে, যুদ্ধ হয়েছে আরও জটিল, আরও প্রযুক্তিনির্ভর। আগে লড়াই হতো হাতাহাতি করে, পরে এসেছিল ধাতব অস্ত্র, বন্দুক, কামান, তারপর ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক বোমা… এখন তো মানুষ দূর থেকে ড্রোন দিয়ে মানুষ মারছে।’
‘সংখ্যায় যারা বেশি, যুদ্ধ কি সবসময় তারাই জেতে ?’
‘না মা,’ বাবা বললেন, ‘সবসময় না। অনেক সময় দেখা গেছে, সংখ্যা কম হলেও বুদ্ধি, কৌশল আর উন্নত অস্ত্র থাকলে, ছোটরাও বড়কে হারাতে পেরেছে। যেমন ধরো, ব্রিটিশরা সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, কিন্তু তারা সংখ্যায় কম ছিল। শত শত বছর ধরে তারা পৃথিবীর নানা জায়গায় উপনিবেশ গড়ে তুলতে পেরেছিল। কারণ তাদের ছিল উন্নত নৌবাহিনী, অস্ত্র এবং এক অদ্ভুত শৃঙ্খলা। আবার ধরো আমেরিকা যখন ভিয়েতনামে যুদ্ধ করল, তখন তারা অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, কিন্তু গেরিলা কৌশলের কাছে তারা হেরে গেল। আফগানিস্তানে তালিবান বা মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে লড়েও সোভিয়েত ইউনিয়ন সফল হতে পারেনি। আবার, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্র ও সংগঠিত বাহিনীর বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় কম, অস্ত্রে দুর্বল কিন্তু কৌশল, সাহস ও জনগণের সমর্থনে জয়ী হয়েছিল। তাই শুধু শক্তি নয়, কৌশল আর মানসিক দৃঢ়তাও জয় নির্ধারণ করে।’
রুভা একটু চুপ করে থাকল। যেন বুঝতে চেষ্টা করছে যুদ্ধের জয়-পরাজয়। তারপর বলল, ‘বাবা, এখন কোথায় কোথায় যুদ্ধ চলছে ?’
‘আহা মা, সেটা যদি বলি, তাহলে তোমার আর ঘুম পাবে না। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশে সংঘাত চলছে। গাজা, ইউক্রেন, ইয়েমেন, সুদান, কঙ্গো, মিয়ানমার… লম্বা তালিকা।
‘ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। আফ্রিকার বহু দেশে গৃহযুদ্ধ লেগেই আছে। সম্প্রতি শুরু হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা।’
রুভা একটু চুপ করে। তারপর বলে, ‘কিন্তু আমরা তো ঘুরতে যাচ্ছিলাম। আমরা তো কারও কিছু নিইনি।’
বাবা হাসলেন না। তাঁর চোখে জলের রেখা। ‘সেই নিরীহ মানুষেরই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, মা। যারা কিছু চায় না, তারাই সব হারায়।’
‘বাবাই, যুদ্ধ কি কখনও শেষ হবে না ? আমি চাই, শেষ হোক।’
‘অবশ্যই মা, যুদ্ধ কোনও সমাধান নয়। আলোচনাই সমাধান। মানুষ এত জানে, এত ভালোবাসে, এত কিছু তৈরি করে, তারপরও যদি সে বার বার একই ভুল করে। সে যুদ্ধ করে।’
‘তাহলে আমরা কী করব ?’
‘আমরা চেষ্টা করব আমাদের চারপাশটুকু সুন্দর রাখতে। তুমি যখন কারও সঙ্গে রাগ না করে কথা বলো, সেটা এক ধরনের শান্তি। তুমি যখন কাউকে ভালোবাসো, তখন তুমি যুদ্ধের বিপরীত পথ বেছে নিচ্ছ।’
রুভা একটু হেসে বলল, ‘তাহলে আমি এখনই যুদ্ধ থামাতে পারি ?’
‘পারো না ? পারো! একদিন তুমি বড় হবে, মানুষকে বোঝাবে―যুদ্ধ দিয়ে কিছু হয় না। তোমার মতো মানুষ বাড়লেই একদিন যুদ্ধ সত্যিই থেমে যাবে।’
রুভা জানে না ভবিষ্যতে তার মতো কোটি কোটি শিশুর জীবনটা কেমন হবে। তার বুকের ভিতরে এক আশ্চর্য শূন্যতা তৈরি হয়।
তবু সন্ধ্যায় সে নিজের খাতায় ছবি আঁকে―একটা পাখি, যে যুদ্ধের শহর পেরিয়ে উড়ছে। সেই পাখির চোখে তার নিজের চোখ।
বাইরে সূর্য ডুবছে। টেলিভিশনে বোমার শব্দ, সাইরেনের শব্দ। জানালার ওপারে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। রুভা জানে, সূর্য এখন ডুবছে বটে, সকালে আবার নতুন এক সূর্য জেগে উঠবে। সেই নতুন সূর্য এখনই জেগে ওঠে―রুভার চোখে। সে জানে না সে কী করবে, কিন্তু সে জানে, সে যুদ্ধ চায় না। সে ভালোবাসা চায়। তার মনে হয়, ইতিহাস যদি বার বার ফিরে আসে, তাহলে ভবিষ্যৎও বদলানো যায় বার বার।
রুভা আবার প্রশ্ন করে, ‘বাবাই, তাহলে কি যুদ্ধ কমবে না ?’
‘কমবে মা। একদিন ঠিক কমবে। একেবারে থেমেও যাবে। বিশ্বজুড়ে যারা শান্তির কথা বলে, তারা আজ অনেক শক্তিশালী।’
রুভা চুপ করে সন্ধ্যার ছায়া ঘনানো অন্ধকার দেখতে থাকে। তারপর ফিসফিস করে বলে, ‘বাবাই, আমি বড় হয়ে কী করব জানো ?’
‘কী করবি মা ?’
‘আমি একটা স্কুল খুলব যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের জন্য। তাদের গান শেখাব, আঁকতে শেখাব, যুদ্ধ নয়―শান্তির গল্প শোনাব।’
বাবা হেসে বললেন, ‘এটাই তো আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হবে মা। যদি তোমার মতো হাজার হাজার রুভা বড় হয়ে এই পৃথিবীকে ভালোবাসতে শেখে, তাহলে যুদ্ধ একদিন জাদুঘরে থাকবে―ইতিহাস বইয়ে, আর কোথাও নয়।’
রুভার মনে হলো, এই অস্থির পৃথিবীতে সবারই যেন একটা যুদ্ধজীবন রয়েছে। যুদ্ধের মধ্যে থাকলেও রয়েছে, না-থাকলেও পরোক্ষভাবে রয়েছে। এই যুদ্ধজীবন রুভার আর ভালো লাগছে না।
কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ে বাবার কোলে। তার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি খেলে বেড়ায়। তার বুকের ভেতরে যুদ্ধের কষ্ট, কিন্তু সে বিশ্বাস করে―একদিন সব যুদ্ধ শেষ হবে, শিশুর হাসি দিয়ে ভরে উঠবে পৃথিবী।
সে ঘুমের মধ্যে স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা বাবার অণুগল্পটার দৃশ্য দেখতে পায়। স্বপ্নের মধ্যে সিরিয়ার আকাশটাকে তার মনে হচ্ছিল লাল রঙের কাপড়ের মতো―ছিঁড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। চারদিকে ধুলো, ধ্বংস আর কান্নার শব্দ। সিরিয়ার আলেপ্পোর ছোট্ট এক পাড়ায়, একটি ভাঙা দেয়ালের পাশে শুয়ে ছিল ছয় বছরের ইউসুফ। তার গায়ে ধুলো আর রক্তের ছোপ। ডান হাতটা নড়ছিল না, চোখের কোণে জমে ছিল এক ফোঁটা জল।
ইউসুফ তার মায়ের খোঁজ করছিল। মাকে আগেই আহত অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু ইউসুফ জানত না সে কথা। চারপাশে কেউ বাঁচানোর নেই, কেবল একজন স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে এসে তাকে কোলে তুলে নেয়।
‘বাবা, ব্যথা লাগছে ?’ মানুষটি জিজ্ঞাসা করলো ইউসুফকে।
ইউসুফ কান্নাজড়িত গলায় বলল, ‘আমি আল্লাহকে সব বলে দেব…’
‘কী বলবি, বাবা ?’ মানুষটি কেঁপে উঠল।
ইউসুফ চোখ মেলে ফিসফিস করে বলল―‘আমি আল্লাহকে সব বলব… ওরা আমাকে ব্যথা দিয়েছে।’
ছোট্ট ইউসুফ মারা যায়। তার কথা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের কোণে কোণে―‘ও ধস মড়রহম ঃড় ঃবষষ অষষধয বাবৎুঃযরহম.’ ইউসুফ বিশ্বাস করে, আল্লাহ নিশ্চয়ই শিশুদের এসব অত্যাচারের কথা জানে না। জানলে, যারা শিশুদের ওপর অত্যাচার করছে, তাদের অবশ্য উচিত শিক্ষা দেবেন।
রুভা স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পায়, তার সামনে ইউসুফ। খুব সুন্দর একটা ফুলবাগানে খেলে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ইউসুফ। হাসছে, আনন্দ করছে।
রুভা ভাবল, ইউসুফ নিশ্চয়ই আল্লাহকে গিয়ে সব বলে দিয়েছে। আর কোনও চিন্তা নেই। পৃথিবীতে শিশুদের আর কেউ কিছু করতে পারবে না।
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ



