
ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষদের রক্ষা করো, মাবুদ! ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষদের রক্ষা করো! তোমার আবাবিল পাখি পাঠাও। খুনিদের ধ্বংস করে দাও। মাবুদ, তোমার এই অধম ক্রীতদাসের দোয়া কবুল করো।
জায়নামাজে বসে দুই হাত তুলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছেন কফিল উদ্দিন মুনশি। ঝুর ঝুর করে চোখের পানি পড়ছে। জায়নামাজ ভিজে একাকার। মানুষের চোখের পানিতে জায়নামাজ এমনভাবে ভিজতে পারে! এটা চোখে না দেখলে কারও বিশ্বাস হবে না। খোকা মাঝি এটাই মনে করেন।
খোকা মাঝির তুলতুলে নরম মনটার ভিতরে আইঢাই করে উঠল। ভাবনা হচ্ছে, ফিলিস্তিনের আল্লাহ কোথায় থাকেন ? হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ মেরে ফেলছে ইহুদিরা। মাসুম বাচ্চা ও নারীদের গণহত্যা করছে। এটা কি আল্লাহ দেখেন না! মানুষ হয়ে মানুষকে এভাবে হত্যা, এরা কি দানব না হিংস্র জানোয়ার! আমরা নিজেরাই কেন মরে যাই না! গাজার ২২ লাখ মানুষের কী করুণ দশা! হায় ভগবান! তুমি ওদের রক্ষা করো। কফিল উদ্দিন মুনশির কাছে গিয়ে বলেন―এমন হত্যা সহ্য করা যায় না, মুনশি বিয়াই।
মুনশি জায়নামাজে বসেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মনের আগুন ঝেড়ে শব্দ করেন-পেপার হাতে নিলেই ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গণহত্যা ও ভয়াবহ ধ্বংসের ছবি। ধ্বংসস্তূপের নিচে শত শত মৃত মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা জীবিতরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। আহতদের একটু একটু করে দম শেষ হচ্ছে। মানুষ রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। শিশুদের-নারীদের পচা-গলা দেহ। শত্রুরা মরদেহ গাজায় দাফন করতে দেয় না। দখলদার সেনারা মানুষকে বাইরে বের হতে দিচ্ছে না। মানুষ জানতেই পারে না, তাদের প্রিয়জন মারা গেছে। তাদের মৃতদেহ পচে-গলে গেছে। একটি পা, একটি হাত, একটি মাথা―এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে থাকতে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ইয়া আল্লাহ! ইয়া রহমানের রাহিম! তুমি কোথায় ?
খোকা মাঝি ক্লেশ-মাখানো কণ্ঠে মুনশি বিয়াইকে গাজার আল্লাহ কোথায় থাকেন তা জিজ্ঞেস করেন ? বলতে পারবেন, বিয়াই ? কোথায় তিনি ? তাঁর কি কিছুই করার নেই ? এভাবে আর কতদিন ? গাজা এখন একটি লাশঘর। বিপন্ন ফিলিস্তিন। বিপন্ন বিশ্ববিবেক। এভাবেই কি আমাদের বেঁচে থাকতে হবে ? গাজার আর্তকণ্ঠ সহ্য করতে পারছি না, ভাই।
মুসলমানের সঙ্গে রয়েছে খোকা মাঝির গভীর আত্মীয়তার বন্ধন। মেজো মেয়ের কফিল উদ্দিন মুনশির ভাতিজার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তাতে মুনশি কোনও আপত্তি করেননি। তার বড় ছেলে যখন আটিগ্রামের মোঃ হাবিবুরের মেয়েকে কোর্ট ম্যারেজ করল, তখন এলাকায় বড় গণ্ডগোল হতে পারতো। তিনি অনেক বড় বিপদে পড়তে পারতেন। দু-চারজন কানাঘুষো শুরু করেছিল। কফিল মুনশি মুহূর্তে সেই কানাঘুষো ট্যাকেল দিয়েছেন। বিয়াইকে সঙ্গে নিয়ে এলাকায় ঘুরেছেন। কেউ আর কথা চালাচালির সাহস পায়নি।
কফিল উদ্দিন মাস্টারকে এলাকার সবাই কফিল মুনশি বলে ডাকে। এটি মানুষের মহব্বতের ডাক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন সাঁইত্রিশ বছর। খোকা মাঝিকে তিনি প্রাণখোলা মনে বিয়াই বলে ডাকেন। দারুণ আত্মীয়তার রসায়ন দুজনের মধ্যে। জীবনভর দেশ-বিদেশের খবর রেখেছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ধর্মীয় সব কর্ম সম্পাদন করেন। সবসময় সুন্দর পথে চলেন, সত্য বলেন। সাচ্চা মুসলমান। বড়ো উদার মনের মানুষ। বাপকালীন তিনশত বিঘা জমির মালিক। এক ছেলে ও এক মেয়ের পিতা তিনি। ছেলে সরকারি মেডিকেলের এমবিবিএস ডাক্তার। মেয়ে সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। সব দিক মিলিয়ে বলা চলে, রামকৃষ্ণপুরের জমিদারি এখনও তাঁর হাতেই রয়েছে। অত্র এলাকার সবাই তাঁকে ভালোবাসে ও ভক্তি করে। চাকরি থেকে অবসরে এলেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য অনেকেই পীড়াপীড়ি করে। তিনি এলাকাবাসীদের সাফ জানিয়ে দেন―এসব তাঁর পছন্দ হয় না। ইচ্ছে ও সামর্থ্য থাকলে এমনিতেই মানুষের সেবা করা যায়। বহু বছর আগে তিনি হজ পালন করেছেন। তবে কেউ তাঁকে কখনও হাজি বলে ডাকেন না। এটা তাঁর কিঞ্চিৎ দুঃখ।
ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত গেরিলা মহামতি ইয়াসির আরাফাত। তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। কফিল মুনশির প্রিয় ব্যক্তিত্ব তিনি। এখনও মনেপ্রাণে ভালোবাসেন তাঁকে। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তিনি। কথায় কথায় ইয়াসির আরাফাতের শ্রেষ্ঠ উক্তি ব্যবহার করে এলাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের উপদেশ দেন―শুনো তোমরা, ‘ঈযড়ড়ংব ুড়ঁৎ ভৎরবহফং পধৎবভঁষষু. ণড়ঁৎ বহবসরবং রিষষ পযড়ড়ংব ুড়ঁ. (সঠিক বন্ধুকে বেছে নাও। শত্রুকে বেছে নেওয়ার কিছু নেই, ও নিজে থেকেই তোমাকে খুঁজে নেবে।)’
তিনি ছেলে-মেয়েদের উদ্দেশ্যে আরও উত্থাপন করেন―সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুসলিম বিজয়ের সময় ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করে। তখন উমর ইবনে আল খাত্তাবের নেতৃত্বে রাশিদুন খিলাফত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কাছ থেকে শাম অঞ্চল জয় করে। খলিফা উমরের কাছে জেরুজালেমের অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণে রাজি হন। চূড়ান্তভাবে ৬৩৬ সালের নভেম্বর মাসে মুসলিম সেনাবাহিনী বাইজেন্টাইন রোমানদের দখলে থাকা জেরুজালেম জয় করে। এই জেরুজালেমের পুরোনো শহরে বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা অবস্থিত। কাবা ঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর মসজিদুল আকসা নির্মাণ করা হয়। সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনার পর জেরুজালেম ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম শহর। সে দিনের মুসলিমদের হিম্মত ছিল অন্যরকম। এসব কথা তোমাদের ভালো লাগতেও পারে আবার নাও লাগতে পারে।
উপস্থিত সবাই খুব আগ্রহ দেখায়। একজন দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে ষোলো আনা বুঝিয়ে দেয়―মুসলমানের ইতিহাস এগুলো। অবশ্যই আমাদের জানা দরকার।
কফিল মুনশি সজোরে ‘তা সত্যি বটে’ বলেই শুরু করেন, ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকেই এই অঞ্চলে সংঘাত চলতে থাকে। প্রায় ৮০ বছর চলছে এই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত। ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইনের মোট জনসংখ্যা ৫২ লক্ষ ৫ হাজার। প্রধান ধর্ম ইসলাম (সুন্নি)। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ২২ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। এখানে ৯৯% মুসলিম। দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী বহুদিন ধরে এই অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনে নির্বিচার মুসলিম গণহত্যা কোনওদিন বন্ধ হবে কি না জানি না।
একজন জানতে চায়―স্যার ইসরায়েলের জনসংখ্যা কত ?
অন্য একজন বলে দেয়―প্রায় ৯৮ লক্ষ।
গ্রামের চায়ের দোকানে ছুটির দিনেগুলোতে মানুষ গিজগিজ করে। সেখানে দৈনিক খবরের কাগজ থাকে। দেশ-বিদেশের নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। ফিলিস্তিনের গাজায় দীর্ঘদিন ধরে দখলদারদের গণহত্যা চলছে। এটা নিয়েও গ্রামের মানুষ কথা বলে। সেখানে শাকিল মোল্লা উপস্থিত ছিল। এলাকার সবাই ফিলিস্তিনের পক্ষে কিছু একটা করার কথা কফিল উদ্দিন মুনশিকে বলেছে। মুনশি সেই মোতাবেক ইউনিয়নের মানুষজন একত্র করেছে। মূলত সবাই তাঁর ডাকেই এখানে এসেছে। উদামের মা, মহিলা মেম্বর ছদরা ফকিন্নিও এসেছে। ফকিন্নি গ্রামের মাটি মেশানো ভাষায় কথা বলে। সত্য বলার ক্ষেত্রে কাউকে ভয় পায় না। এজন্য প্রতিবার মানুষ তাকে ভোট দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার বানায়। কফিল মুনশি তাকে আদর করে সর্বদা বোন বলে ডাকে। মুনশির পাশেই সে বসেছে। ইউনিয়নের গণ্যমান্য বহু মানুষ একত্র হয়েছে। ফকিন্নি কোনও রাখঢাক ছাড়া হঠাৎ মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে ঠাস ঠাস করে বলতে থাকে―
মিয়া ভাই, তুমি ফেলেছতনরে এত্তো মহব্বত করো। ফেলেছতনের গজার সব মানুষ মারবার নইছে শত্রুরা। কিছু একটা করবা না ? আমরা সবাই তোমার মুকে চাইয়্যা আছি। ফকিন্নি মহব্বত করে কফিল উদ্দিন মুনশিকে মিয়া ভাই নামে ডাকে।
করা তো দরকার, বোন। এজন্যই তো তোমাদের ডেকেছি। প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ি। কান্নাকাটিসহ আল্লাহর কাছে মোনাজাত করি। রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে মোনাজাত করছি। মসজিদে মসজিদে মোনাজাত চলছে। আশা করি, শীঘ্রই ভালো কিছু একটা খবর পাব।
মরিচের ব্যাপারি কিয়ামত বলে―কিছু ফল কি পাইব্যার নইছো, মুনশি ?
ফল আল্লাহ দিবেন, অবশ্যই দিবেন।
টাম্পে দামি দামি অস্ত দিছে। ঐ অস্তের হমকে তোমার নমজ আর মুনাজত কিছু করবার পারব বইল্যা বিশ্ব্যাস অয় না।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, ব্যাপারি। ধৈর্য ধরো।
ছদরা ফকিন্নি বলে―মিয়া ভাই, জনম ভইর্যাই তো দ্যাকপার নইছি। কত্তো আগে থনে ঐ দ্যাশের মানুষগুলারে এহুদির্যা মারবার নইছে। খালি মুনাজত আর দোয়া ছাড়া সারা বিশ্বের মুছলমান কিচ্ছু করবার পারতাছে না। নও সবাই যুদ্ধে নও। আমিও যামু তোমাগো নগে। যার যা আছে, তাই নিয়্যা বাইর হও। এহুদিগো হাড়গিলা চাবিয়্যা খামু।
পিছনে নজিমুদ্দির পোলা বিড়ি ছুরত খিক খিক করে হাসে।
ফকিন্নি চরম রেগে ওঠে। ছুরতকে গালি দেয়, ঐ নেড়িকুত্ত্যার বাচ্চা, খ্যাক খ্যাক কইর্যা হাসছ ক্যারে ? য্যানে যাছ, হ্যানেই কেঁউ কেঁউ করছ। প্যাঁ প্যাঁ করছ। সবকিছু নিয়্যা ইয়্যার্কি শুরু করছত। আমার পিছে লাগছত ক্যারে ? পারা দিয়া তোরে আলু খ্যাতে গাইর্যা থুমু। মিটিং ছ্যাড়াব্যাড়া করবার চাছ। সবাই চুপ করে থাকে। একটু পর ফকিন্নি আবার কথা বলে―কিছু করবার না পারলেও জীবনডা দিয়্যা আহি, নও। নবীসাবরে বলবার তো পারুম, তোমার ফেলেছতনের গজার উম্মদগো নিগ্যা জীবন দিছি। নবীসাবের নাম নিয়্যা বাইর হমু। সবাই নাজি আছো ?
দুষ্টু টাইপের কয়েকজন চিল্লিয়ে বলে―সবাই নাজি। আমরা যামু ফকিন্নি। চায়ের দোকানদার বলে―আমিও যামু।
তোর বউ পোলাপান ক্যারা দেকপো ? ব্যাপারি দোকানদারকে বলে।
আল্লায় দেকপো। নবীসাবে দেকপো।
দোকানদারের বউ সেখানে উপস্থিত। বয়স অল্প। সে অবুঝের মতো কাঁদে আর বলে―
মুনশি মামু, আমাগো উনারে যাইব্যার দিমু না। আমার কোলে দ্যাড় বছরের এই গেন্দি ম্যায়াডারে ক্যারা দেকপো ?
এইবার আবাল-বৃদ্ধবনিতার অনেকেই খিল খিল করে হেসে দেয়। অনেকেই নড়াচড়া দিয়ে বসে। বিড়ি ছুড়তের পেটে গুড়গুড় করে ওঠে। ঝট করে উৎকট দুর্গন্ধ এঁটে ধরে সবাইকে। মরিচের ব্যাপারী বলে―মরাগরু খাইছত নাকি, হারামজাদা ? বেজম্মা-খবিশ কোথাকার! বিটল্যামি করছ! একজন বলে, ওরে এ্যান থনে বাইর কইর্যা দ্যাও।
কিছুক্ষণ ফিসফিস-বিড়বিড় আওয়াজের পর কফিল মুনশি মুখ খুলেন, বাবারে, মনে হয় মানিকগঞ্জের পদ্মা নদী পার হলেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে পৌঁছে যাবে সবাই!
মরিচের ব্যাপারি একটু কাশি দেয়। তারপর দরাজ গলা ফোটায়―মাস্টর বাংলাদেশ থনে ফেলিস্তান কতোদূর ?
দাদুরে, বাংলাদেশ থেকে ফিলিস্তিনের দূরত্ব ৫৪৮৯ মাইল। কেউ ইচ্ছে করলেই ওখানে যেতে পারবে নাকি!
রাজিবপুর কলেজের অধ্যক্ষ মজিদ মাহবুব মোল্লা। তাঁর ছেলে শাকিল মোল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস পড়ে। কঠিন এক চিৎকার দেয় সে। একটানে শরীরের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলে। মুখে বলে―সবাই চলো। দশ হাজার মাইল দূরে হলেও আমরা হেঁটেই ফিলিস্তিন যাব। মুসলমানদের রক্ষা করতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষ―সর্বকালের স্বীকৃত মুসলিম বীর যোদ্ধাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। হযরত আলী (রা.), আল্লাহর তলোয়ার খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.), মুহাম্মদ বিন কাশেম, তাইমুরসহ ইসলামের এই বীরদের চেতনা মনে ধারণ করেই এ যুদ্ধে মুসলমান বিজয়ী হতে পারে। মুসলিম জাতি দুর্বল নয়। তাঁদের চমৎকার অহংকার করার মতো ইতিহাস রয়েছে। যে নবীর দোয়ায় আসমানি ফেরেশতা নেমে আসে। আবাবিল পাখি শত্রুর উপর পাথর নিক্ষেপ করে! মুসলমানদের আত্মার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এঁদের শক্তি লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের সেই শক্তিকে জাগাতে হবে।
কথাগুলো শুনে মুসলিম মিয়ার মুখ কালো মেঘের মতো হয়ে যায়। দরদর করে চোখ বেয়ে পানি পড়ে। আরও অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তাদের চোখ থেকেও বড় বড় বৃষ্টিফোঁটার মতো পড়তে থাকে। একজন অদ্ভুত রকমের চিঁ চিঁ শব্দ করে কাঁদেন। পাশে থাকা মুরুব্বিগণ গভীর ভাবনায় পড়ে যান। সবার ভাবনা একটাই ফিলিস্তিনের মানুষের জন্য কী করা যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা স্লোগান দেয়―
ফিলিস্তিন, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ;
অন্যায় যুদ্ধ, বন্ধ করো বন্ধ করো;
গাজায় গণহত্যা, এই মুহূর্তে বন্ধ করো বন্ধ করো;
গাজা মুক্তি পাক মুক্তি পাক;
যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, শান্তি চাই, শান্তি চাই।
স্লোগান শেষ হওয়ার আগেই গাঁট্টাগোট্টা গোছের এক ছেলে জোরে বুলি ছাড়ে―আদির্যা তোর টুলে এতো ছারপোকা কিয়্যারে ?
এক মুরুব্বি গালে থাপ্পড় দিয়ে তাকে থামায় এবং তীব্র আওয়াজে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে―এরদোয়ান কি করতাছে ? হুনি, তার অনেক শক্তি। হেই শক্তি অহনে কামে নাগায় না কিয়্যারে ? ইর্যান কি করবার নইছে ? সবাই ঝাঁপিয়্যা পড়ে না কিয়্যারে ? মুনশি, তুমি কিছু কও না কিয়্যারে ?
কফিল মুনশি আড়চোখে চেয়ে থাকেন। তিনি ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য করণীয় কোনও উপায় খুঁজে পান না। কিছুক্ষণ ভেবে লোকটিকে সান্ত্বনা দেন―ভাইরে ধৈর্য ধরো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালো কিছু করবেন।
ফকফকা ফর্সা এক মুরুব্বি মুখের লম্বা পাকা দাড়ি টানতে টানতে মুখে খই ফোটায়―হুনতাছি ফিলিস্তিনের মানুষ সব মাইর্যা ফালিব্যার নইছে। এ্যানে ধৈর্য ধইর্যা কি পামু ? জীবনভর তো ধৈর্যই ধরতাছি। শুক্করবারে জুম্ব্যার দিনে মজ্জিদে যাই, হুজুরে কান্দে, দোয়া করে। আমরাও কান্দি। দোয়া করি। কই, কিছু তো অয় না। জনম ভইর্যা একই কথা।
গলা খাঁকারি দিয়ে অন্য একজন বলে উঠল―শুয়োরের বাচ্চাগো সব নতুন নতুন মেশিন, বমা। অস্তের নগে ক্যামতে কী পাইব্যা, কী পারবা ? এক লক্ষ মানু যাইবো, ওরা একটা বমা মারবো। এগ বমায় সব মইর্যা যাইবো। নাভ কি অইবো, কও ?
আরেকজন বলে ওঠে―হুনি, ইরান সব অস্ত্র দিয়্যা রাশিয়্যার যুদ্ধ কইর্যা দিল। এ্যানে ইরান আহে না কিয়্যারে ? মুনশি, কিছু করো। তোমার তো সব আছে। আল্লায় তোমার ধন-সম্পদের অভাব দেয় নাই। তুমি ওগোরে পাটিয়্যা দ্যাও।
এখানে একজনের পক্ষে কতটুকু করা সম্ভব হবে, বলো ? মুনশি এ কথা বলতে বলতেই উত্তর দিক থেকে স্লোগান দিতে দিতে তরুণদের বড় একটি দল এসে চা দোকানের সামনে জড়ো হয়। সঙ্গে কয়েকটি মেয়েও দেখা যায়। মেয়েরা রাজিবপুর কলেজের ভিপি নার্গিসের সঙ্গে এসেছে। তারা ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি জানাতে এসেছে। একটি মেয়ে কটমট করছে। সে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতেই বলে―জালিমরা মুসলমানের পবিত্র আল আকসা মসজিদ ভাঙলো!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নুশরাত জেবিন। নুশরাত জেবিন সত্য তুলে ধরে―মসজিদুল আকসা বা আল আকসা মসজিদ ভাঙেনি। এটা নিয়ে ব্লগাররা লাইক পেতে বিভ্রান্তি ছড়ায়। আল আকসা মসজিদ ঠিক আছে। তবে না ভাঙলেও ভাঙতে কতক্ষণ লাগবে। শুধু একটি শক্তিশালী বোমা। ওদের কাছে তো বোমার অভাব নেই।
শাকিল মোল্লা নার্গিসকে ধন্যবাদ দিয়ে ফিলিস্তিনে যাওয়ার জন্য আনসার বাহিনী গঠনের প্রস্তাব পেশ করে এবং কে কে যেতে আগ্রহী তা জানতে চায়।
যাবেন কীভাবে ? নুশরাত জিজ্ঞেস করে।
আমি ঢাকায় গিয়ে সে ব্যবস্থা করব।
ভাইয়া সেদিন খবরের কাগজে একটি করুণ বিষয় পড়লাম।
কী বিষয় ?
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুরের উত্থাপন করা এই বিষয়টি―
‘যে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, গল্পটা সেই বলবে। আমরা যতটুকু পেরেছি, করেছি। আমাদের কথা মনে রেখো।’
হৃদয়স্পর্শী এই কথাগুলো গাজার আল আওদা হাসপাতালের সাদা একটি বোর্ডে লিখেছিলেন চিকিৎসক মাহমুদ আবু নুজাইলা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালান ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরা। এ সময় ইসরায়েলের ১ হাজার ১৩৯ জনকে হত্যা করে এবং ২০০ জনকে জিম্মি করে। এরপর থেকে গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের অবিরাম হত্যাযজ্ঞে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে গাজা। ইসরায়েল ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর আল আওদা হাসপাতালে বিমান হামলা চালায়। ওই হামলায় নিহত হন চিকিৎসক মাহমুদ আবু নুজাইলা। মাহমুদ আবু নুজাইলার কথাগুলো ২০২৫ সালের ৩ জানুয়ারি শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাঁদতে কাঁদতে পড়ে শোনান জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুর (তথ্যসূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, রোববার, ৫ জানুয়ারি ২০২৫)। কথাগুলো পড়ে আমি অনেক কেঁদেছি।
এখানে তুমি কেঁদে কী করতে পারবে ?
ভাইয়া, যুদ্ধে আমাদের নেওয়া যাবে ?
শাকিল মোল্লা ঢকঢক শব্দে বড় এক মগ পানি পান করে। এরপর হাসতে হাসতে বলে―তোমার গোল-গাল নাদুস-নুদুস চেহারাটা নষ্ট করতে যেও না।
এগুলো কী বলেন, ভাইয়া! আপনার চেহারাটাও তো পাকা আমের মতন টসটসা!
সবাই একটু হেসে দেয়।
এবার মেয়েটির চোখে চোখ রেখে কোমল সুরে সে বলে―তোমরা সেখানে গিয়ে শুধু বিপদে পড়বে। আমরা ছেলেরা যাওয়ার চেষ্টা করছি, আপুমণি। শুনো, মূল কথা হলো―মুসলমানদের প্রযুক্তিজ্ঞানে অনেক সমৃদ্ধ হতে হবে। প্রযুক্তিতে খুবই পারদর্শী হতে হবে। শত্রুকে পরাজিত করতে তার অস্ত্রের চেয়ে তীক্ষè ও শক্তিশালী অস্ত্র দরকার হয়। এখন সব অস্ত্রই প্রযুক্তিনির্ভর। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুকে পরাজিত করার কথা মুসলমানের ভাবাই ঠিক হবে না।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মানুষের কথা ভাবতে ভাবতে কফিল মুনশির মাথা ঝিনঝিন করছে। তবে শাকিলের কথায় তিনি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের বিজয় নিশান দেখতে পাচ্ছেন। তিনি ইরাকের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ শুরু হলো এই কথা উল্লেখ করে সামনে যেতে থাকেন―
সারা পৃথিবীর মুসলমানরা নামাজ পড়ে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের জন্য কতো দোয়া করেছিল। আমিও বাদ ছিলাম না। পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান নামাজ পড়ে মোনাজাত করে কেঁদেছিল। তাতে কিছুই হলো না। ইরাকের যুদ্ধ নিয়ে একটি ছোট্ট কাহিনি বলি। সবাই শোনো।
স্যার, বলেন।
একজন জোরে আওয়াজ তোলে―সবাই মন দিয়ে স্যারের কথাগুলো শুনো।
মুনশি আবার শুরু করেন―আমি তখন ঢাকায় শিক্ষকতা করতাম। স্কুল ছিল ওয়াপদার পাশে।
বয়রা বুছাই বলে―কী কও কাক্কু ?
ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত বিদ্যুৎ অফিসের কথা কই।
বুছাই হা করে থাকে।
পোড়ারমুখো ঐরকম হা করে আছিস কেন ? মুনশি রাগ করেন।
মাথায় ধপধপে সাদা রেশমের পাগড়ি পরা এক ছেলে বলে―স্যার, ওর কথা বাদ দেন। ও কানে শোনে না। আপনি বলেন। আমরা শুনি।
হ্যাঁ, বলি। তখন মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ চলছে। আমাদের স্কুলের দপ্তরি তোফাজ্জল মিয়া। ইয়া আদমি! অনেক বড়সড় মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। প্রতিদিন স্কুলে জোহরের নামাজ পড়তেন। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিজয়ের জন্য দোয়া করতেন। দুই হাত আসমানের দিকে উঠিয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলতেন।
একদিন আমাদের এক স্যার বললেন―তোফাজ্জল মিয়া, আপনার দোয়া দিয়ে বুশের বোমা ফেরাতে পারবেন না। বুশের বোমার বিপরীতে আরও শক্তিশালী বোমা লাগবে। তাহলে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এ যুদ্ধে জিততে পারবেন। অন্যথায় দোয়া বিফলে যাবে। এক কথায়, দুই কথায় তোফাজ্জল মিয়া ঐ শিক্ষককে উলটাপালটা বলে মারতে যায়।
আমরা সবাই মিলে পরিস্থিতি সামাল দেই। তার কয়েক দিন পর ইরাকের অবস্থা শোচনীয় হয়। ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে মার্কিন সেনারা বন্দি করে। ৩ বছর বহু নাটকীয়তার পর ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাদ্দাম হোসেনকে মার্কিনিরা নির্মমভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। তার মাত্র তিন দিন পর তোফাজ্জল স্ট্রোক করে মারা যায়। আমি তখন ঢাকা থেকে বদলি হয়ে চলে এসেছি। বাস্তব চিত্র হলো এই। মুসলমানদের জ্ঞানবুদ্ধি বাড়াতে হবে। বিজ্ঞানে অনেক উন্নতি করতে হবে। অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত হতে হবে। তাছাড়া শুধু দোয়া করে এ যুদ্ধে জয় আসবে না। আমি সবসময় আগ্নেয়াস্ত্র বিরোধী। তারপরও বলি, এখন তো হজরত আলী (রা.) ও আল্লাহর তলোয়ার খালিদ বিন ওয়ালিদের মতো সাচ্চা মুসলমান নেই। মানুষের শক্তি নামাজ রোজায় থাকে না। মানুষের শক্তি থাকে সত্যের মধ্যে। আল্লাহ পাক সত্য পছন্দ করেন। সত্যই তো ধর্ম। শত শত মিথ্যা বলে নামাজে হাত তুললে হবে না। ঐ হাত আল্লাহ ফিরিয়ে দেন।
এইড্যা বুঝে কয়জন ? এই যে ছদরা ফকিন্নি। দিনে এক হাজার মিছ্যা কতা কয়! মরিচের ব্যাপারি কথাগুলো বলে ঠোঁট টিপে হাসে।
ফকিন্নি ধমকের স্বরে প্রতিবাদ করে―ফাজিল মানুষ কনকার! দিন ভইর্যা কি তুই আমার নগে থাকছ ?
তা থাকুম ক্যা ? হুনি তো ?
কার কাছে হুনো ? ভদ্দরনোকের মতন কতা কও। ব্যাহায়া কতা কও ক্যা ? দুই দিন পরে মরবা। তাও ফালতু কতা ছাড়ো না! নিশ্যা কইর্যা আইছো ?
নিশ্যা করুম কিয়্যারে ? যা সত্য তাই কইছি। প্যাঁচামুখী, সাবধান!
ভয় দ্যাহাছ! আরে আমার দ্যাবদূতরে! মুকভরা পাকা দাড়ি নিয়্যা বদমাসি কতা কছ। মনে করছত তোর ভাইয়ে চেয়ারম্যান, তাই তোরে আমি ডরামু ? কেছ কইর্যা দিমু। জেলের ভাত খাবি, দুরমুইশ্যা। বাইর হইব্যার পারবি ন্যা।
তুই একেবারে দুধে ধোয়া তুলসির মালা!
আমরা কাঁসি বাজাই, ভাত খাই। দিন ভইর্যা কাম করি। গরিবের চাইল চুরি করি ন্যা। তোগো ধার ধারি না, বুছছত ? ভাইয়ে চেয়ারম্যান। ডর দ্যাহাছ! তোগো চেয়ারম্যানি নিয়্যা তোরা থাগ গা।
কফিল মুনশি দুজনকেই চুপ করতে অনুরোধ করেন। দুজনেই চুপ হয়ে যায়।
মুনশির হাতে একটি বই। পাতা নাড়তে নাড়তে বলেন―প্রকৃতির শাসন মতে মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মানুষকে ঠকানো মহাপাপের কাজ। এখনকার মানুষ এটা বুঝতে চায় না। এসব মানুষের রোজা-নামাজ হয় না। মুসলমানদের চরিত্র নষ্ট হচ্ছে লোভ-লালসায়। আল্লাহ মুসলমানের কথা শোনেন না। কলির জামানা। অতি উন্নত অস্ত্র যাদের আছে, যুদ্ধে তারা জিততে পারবে―এই কথাটা কেমন হয়, আল্লাহ জানেন। আমার মনে হয়, মুসলমানরাও স্বল্প সময়ের মধ্যে বড় বড় অস্ত্রের মালিক হবে। তখন পৃথিবীর রূপ কেমন হবে, জানি না।
শাকিল মোল্লা পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে সবার দোয়া প্রার্থনা করে এবং আগামীর প্রত্যাশা ব্যক্ত করে―স্যার, সেদিন আমরাও দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব, ইসলাম কাকে বলে। ইসলামি খেলাফত কাকে বলে। শেষ নবির উম্মত মুসলমান কী করতে পারে।
কফিল মুনশি আয়েশি ভাব নিয়ে মনের একটি সুখ প্রকাশ করেন―আল্লাহর অশেষ রহমতে, ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ফিলিস্তিনে গিয়েছিলাম। মানুষ আশরাফুল মখলুকাত। আমি চাই জগতের সকল মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক। বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজ আদায় করি। মহান আল্লাহর দরবারে জগতের সকল মানুষের সুখ-শান্তি কামনা করে বহু কেঁদেছি। জগতে বহু ধর্ম আছে। ধার্মিক মানুষ একেবারে কমে গেছে। তাই পৃথিবীতে আজকের এই অবস্থা। ধর্ম যার যেটা হোক, সবাই তো মানুষ। এই মানুষদের আমি ভালোবাসি। প্রতিটি মানুষের মৃত্যু আমাকে কঠিন কষ্ট দেয়।
মুনশি সব মানুষ তো আল্লায় বানাইছে। এতো ধর্ম কিয়্যারে দিছে ? দুনিয়্যাডায় কী শুরু হইছে। খালি যুদ্ধ আর যুদ্ধ! ইসরাইল গাজাডা শেষ কইর্যা দিব্যার নইছে। হাসপাতালে বম দেয়। কোনও জিনিসপত্তর যাইব্যার দেয় না, হুনি ? মরিচের ব্যাপারি কিয়ামতের কথা এগুলো।
ফিলিস্তিনের গাজায় জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েল। হামাস―হিজবুল্লাহ কতো তুখোড় তুখোড় নাম শুনি। ইসরায়েলকে তো কেউ পরাজিত করতে পারে না ? মুনশি দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বলেন।
চিন্তা করতে করতে মোহাম্মদ আলীর মাথা টাড়স টাড়স করছে। সে মুনশি স্যারকে নিবেদন করে―স্যার, কীভাবে পারবে ? ইসরায়েলের পক্ষে তো রয়েছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন একদিকে হামাসকে যুদ্ধবিরতির চাপ দিত, অন্যদিকে ইসরায়েলকে অস্ত্র দিত। এখন ট্রাম্প এসে গাজা দখল এবং গাজার বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত করে জর্ডান ও মিশরে সরিয়ে দিতে বলেছে। গাজায় ২২ লাখের বেশি মানুষ বাস করে। তাঁদের প্রায় সবাই ত্রাণনির্ভর। ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়েছে। কীভাবে এই মানুষগুলো বেঁচে থাকবে!
রাজিবপুর কলেজের ভিপি নার্গিস ২০২৫-এর মার্চ মাসের একটি ঘটনা তুলে ধরে―মুসলমানের পবিত্র রমজান মাসের এক রাত। মানুষ গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সেহরি খাওয়ার জন্য উঠেছে। হঠাৎ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ফিলিস্তিনের গাজায় একের পর এক বোমা হামলা করে ইসরায়েল। নিষ্পাপ ৪০৪ জন মানুষ নিহত হয়েছে। কতো মানুষ আহত হয়েছে। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস কী করেন ? কেন তিনি বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে পারেন না!
রাজিবপুর কলেজের এক শিক্ষক মনে টানটান উত্তেজনা অনুভব করছেন। তিনি নিম্নোক্ত কথাগুলো সবাইকে শুনতে অনুরোধ করেন―২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বড়দিন উদ্যাপনেও বোমা হামলা করে ৮ জন মানুষ হত্যা করেছে ইসরায়েল। ২০২৪ সালে ইসরায়েলের বোমা হামলায় ইয়েমেনে ৯ জন মানুষ নিহত হয়েছে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও গাজায় চরম নৃশংসতা চালাচ্ছে। মৃত্যু-ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা। গাজায় প্রায় ১০০% ঘরবাড়ি ধ্বংস করে ফেলেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মানুষ না। ও একটা হারামি। পত্রিকায় দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন দিয়ে হামলা চালাবে। এই ড্রোন ১৫ হাজার ২৪০ মিটার উঁচুতে ২৪ ঘণ্টা উড়তে পারে। এখন গাজার চারদিকে শুধু মৃত্যুর মিছিল। এটি ফিলিস্তিনের মৃত্যু উপত্যকা! গাজায় মানবিক ত্রাণসহায়তা প্রবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ইরায়েলের প্রতি জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েল তাও মানছে না। হাসপাতালে হামলা করে অবাধে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন তারা গাজায় হামলা থামাবেন না।
এক লোক ইসরায়েলকে বেইমানের দেশ বলে মনের খেদ ঢালেন―হিটলার ওদের শেষ করে দিলে আজ মুসলমানের এতো কষ্ট হতো না। যে কোনও মূল্যে ওদের শেষ করতেই হবে।
রাজিবপুর কলেজের এক শিক্ষক প্রত্যুত্তর করেন―কান ঝালাপালা হয়ে গেল এই কথা শুনতে শুনতে! আপনি চাইলেই ওদের শেষ করতে পারবেন না। মুসলমানকে ধর্মীয় গোঁড়ামি বাদ দিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হতে হবে। আমেরিকা-রাশিয়ার মতো দামি দামি আগ্নেয়াস্ত্র বানাতে হবে।
রাজিবপুর কলেজের ভিপি নার্গিস সুন্দর আলাপচারিতার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে―স্যার, তাহলে মানুষ কি মানবকল্যাণ বাদ দিয়ে শুধু যুদ্ধের দামামা বাজাবে ?
এসব বলে কিছু হবে না, নার্গিস। বেঁচে থাকতে হলে মুসলমানদের জন্য এর বিকল্প কোনও রাস্তা নেই।
কফিল উদ্দিন মুনশি ইরানের অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কথা তুলে ধরেন।
স্যার শোনেন, যতো নিষেধাজ্ঞাই দিক, তবু ইরানের সব উন্নত-উন্নত ড্রোন, বোমা, পরমাণু বোমা, যুদ্ধের আধুনিক হাল-হাতিয়ার বানাতেই হবে। এছাড়া পৃথিবীতে মুসলমান মাথা উঁচু করে টিকতে পারবে না। আর দরকার মুসলমানের ঐক্য। তা না হলে দিনের নবি মুহাম্মদের মুসলিম রাজ্যের শাসনভার একের পর এক খ্রিস্টানদের দখলে চলে যাবে।
মুনশি দুনিয়ার সকল মানুষকে আগ্নেয়াস্ত্র থেকে সরে আসার অনুরোধ করেন। এগুলোকে তিনি মানুষের বদ অহংকার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি আশা করেন, সৃষ্টিকর্তার শক্তির সামনে কিছুই টিকতে পারবে না।
স্যার, তবু মুসলমানকে টিকে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা করতেই হবে।
অতি আগ্রহ সহকারে হাজিনগর মসজিদের ইমাম সাহেব বলেন―
‘ইয়া-আইয়ুহাললাযীনা আমানুছবিরূ ওয়াছাবিরূ ওয়ারা-বিতু ওয়াত্তাকুল্লাহা লায়াল্লাকুম তুফলিহুন।’
‘অর্থ―হে ইমানদারগণ, তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, সুদৃঢ় থাকো এবং তৎপর হও, তোমরা সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করো, অবশ্যই তোমরা সফলকাম হতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন―মহান আল্লাহ আমাদের দৃঢ় এবং তৎপরও হতে বলেছেন। তার মানে বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব করতে হবে।
ভিপি নার্গিস খবরের কাগজের উদ্ধৃতি দেয়―স্যার, আজকেও খবরের কাগজে পড়লাম। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচারে হামলা করছে ইসরায়েল। ২০২৫-এর জানুয়ারি মাস থেকে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি থাকলেও গত ১৮ মার্চ তা লঙ্ঘন করে আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এই সময়টাতে সেখানে মোট ৫২ হাজার ৬১৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৫২ জন। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ। গাজায় কোনও ত্রাণসহায়তা ঢুকতে পারছে না। হাজার হাজার শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারী চিকিৎসাবিহীন ভয়াবহ জীবন পার করছে। খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সংকট চলছে।
কফিল উদ্দিন মুনশি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে উল্লেখ করেন―দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সংহতি জানিয়ে র্যালি করলো। সভা-সমাবেশ করলো। তারপরও কিছুই হচ্ছে না। হায়, আল্লাহ তুমি গাজাকে রক্ষা করো।
শাকিল মোল্লা র্যালি আয়োজন করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবাই ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য স্লোগান দিতে দিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের দুই পাশে গিয়ে পোস্টার-ব্যানারসহ দাঁড়ায়। মুখে সবাই স্লোগান ধরে―
ফিলিস্তিন, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ;
অন্যায় যুদ্ধ, বন্ধ করোবন্ধ করো;
গাজায় গণহত্যা, এই মুহূর্তে বন্ধ করো বন্ধ করো;
গাজা মুক্তি পাক মুক্তি পাক;
যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, শান্তি চাই, শান্তি চাই।
এই শত শত মানুষের সামনে কফিল উদ্দিন মুনশি আসমানের দিকে দুই হাত তুলে জোর গলায় বলেন―হে মাবুদ, হে আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা―তুমি ‘ফিলিস্তিনের মৃত্যু উপত্যকা’য় রহমত নাজিল করো। আর একটি গাজাবাসীর লাশ যেন আমরা না দেখি, আল্লাহ। খোকা মাঝি মুনশির পাশে দাঁড়ানো। তিনি চিৎকার দিয়ে বলেন― হে ভগবান, এই কথা কবুল করো।
রাজিবপুর কলেজের শিক্ষক মাইকের স্পিকার হাতে নিয়ে ফিলিস্তিনের মানুষের জয়ের নিশ্চয়তা দেন―আপনারা শুনুন, রাশিয়ার এক সেনা কমান্ডার বলেছেন―
‘ফিলিস্তিনি মুসলমানদের কখনও পরাজিত করা সম্ভব নয়, কারণ তাঁরা বন্দুকের নলে জান্নাত দেখে আর আমরা দেখি মৃত্যু।’ কাজেই অবশেষে জয় ফিলিস্তিনের মানুষেরই হবে। তিনি আরও একটি খুশির খবর যোগ করেন― ৫.০৪.২০২৫ তারিখে ইসরায়েলের ৩৫০ জন লেখক-সম্পাদক এই অমানবিক যুদ্ধ বন্ধ করার আবেদন দিয়েছে।
সমাবেশের শেষ ভাষণে কফিল উদ্দিন মুনশি স্পিকার হাতে ধরে গভীর আশাবাদ ব্যক্ত করেন―
ইসলাম শান্তির ধর্ম। মুসলিমরা শান্তির পক্ষে। অবশ্যই আল্লাহ ফিলিস্তিনিদের রক্ষা করবেন। হে বিশ্ববাসী, ‘শোনো, একদিন না একদিন ফিলিস্তিনের জয় হবেই হবে। আজকের ‘ফিলিস্তিনের মৃত্যু উপত্যকা’ রচনাকারী শত্রুরা দুনিয়া থেকে অচিরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
সচিত্রকরণ : রজত



