মুক্তগদ্য : উঠানে ছিল চাঁদের আলো : আনজীর লিটন

একটা সময় ছিল প্রায় প্রতিটি বাড়িতে থাকত এক টুকরো খোলা উঠান। সেই উঠানে গল্প হতো। আনন্দের আড্ডা হতো। সূর্যের আলো এসে উঠানের বুকে মেলে দিত রৌদ্রতাপের চিহ্ন। আবার রাত হলে, চাঁদের জ্যোৎস্না থেকে নেমে আসত নরম আলোর পালকি। এখন ঘর আছে, কিন্তু উঠান নেই। আকাশে চাঁদ আছে কিন্তু নেই চাঁদের আলো ছড়ানো সেই উঠান। কোথায় হারিয়ে গেল উঠান ?
একদিন এই উঠানজুড়ে ছিল নরম কাদামাটি। পায়ের ছাপ পড়ে থাকত সারাদিন। সন্ধ্যায় উঠানজুড়ে জোনাকির আলোয় ভরে উঠত অন্ধকার কোণ। উঠানের বুকজুড়ে ভেসে বেড়াত বাতাসের গান।
এখন উঠান নেই। উঠানের গল্প নেই। উঠানজুড়ে হুল্লোড় নেই। চেনা মাটির গন্ধ নেই। নেই মুখর করা পারিবারিক আড্ডা। অথচ এই উঠান শুধু মাটির টুকরো নয়। এটা ছিল মনের প্রশান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার জায়গা।
কিন্তু আজকের জীবন বাস্তবতায় চোখ থেকে সরে গেল উঠানের ছবি। এসেছে নতুন দিন। নতুন সময়। নতুন পৃথিবীতে প্রবেশ করেছি আমরা। নতুনের হাতছানিতে বদলে গেছে চারপাশের দৃশ্যপট। বদলে গেছে জীবনধারা। জেগেছে নতুন স্বপ্ন। খুলেছে নতুন পথ। আর এই পথ চলায় হারিয়ে যেতে দেখছি উঠানকে। গ্রামেও এখন অনেক জায়গায় উচু দালান উঠেছে। উঠানের জায়গায় পাকা ফ্লোর বা টাইলস করেছে। চিরচেনা সেই উঠানের ছবি সত্যি কি হারিয়ে গেল ? পেছনে ফেলে আসা সেই সব দিনের নরম রোদ কাঁঠাল পাতার ছায়া আর মাটির গন্ধÑকোথায় পাব তারে। শহরের খোলা ছাদ, আবদ্ধ অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনি কি কখনও সেই হারানো উঠানের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে ? আধুনিক স্থাপত্যের নকশায় উঠান থাকে না। কিন্তু উঠানের সারমর্ম দারুণ মমতায় জড়িয়ে রাখে। আমাদের উঠান হারিয়ে গেল মানে শিকড় ছিঁড়ে গেল। আর শেকড়হীন মানুষ কেবলই যান্ত্রিক নির্বাসিত এক অস্তিত্ব। তাই হৃদয়ের গহিনে হারানো উঠানের জন্য হাহাকার শুনি :
তোমাদের উঠোনে কি বৃষ্টি নামে ? রেলগাড়ি থামে ?
মন-গড়া বৃষ্টি নিয়ে মন-গড়া ট্রেন
মন-গড়া রেললাইন ছেড়ে দিয়ে ঝিকঝিক ধোঁয়ার বহর নিয়ে থামে এসে
তোমার ঘুমের মশারির কাছে ? বালিশের পাহাড়ের কছে ?
Ñআবিদ আজাদ
যাদের শেকড় গ্রামে, তারা হয়তো উঠান বলতে বোঝে ফেলে আসা এক খোলা জায়গা। যার চারপাশ ঘিরে রেখেছে শোবার ঘর, রান্নাঘর, কাচারিঘর, গোয়ালঘর, কুয়া, কলপাড়। লেবু বাগান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে সৌরভ। ঝিরিঝিরি বাতাসে দুলে উঠছে উঠানের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ডালিম গাছের ফুলগুলো।
আহা! সেই সে উঠানÑযার কোনায় বসে তেঁতুলগাছের ওপর ছড়িয়ে থাকা আকাশ দেখতে দেখতে কথা হতো তারাদের সাথে, চাঁদের সাথে। তাই কবি জীবনানন্দ দাশ অপার মুগ্ধতায় কবিতায় তুলে আনেন দৃশ্যপট :
আকাশে চাঁদের আলোÑউঠানে চাঁদের আলোÑনীলাভ চাঁদের আলোÑএমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাকÑঅশথে ঘুঘুর ডাকÑহৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকেÑনরম ঘুঘুর ডাক আজ
তুমি যে রয়েছ কাছেÑঘাসে যে তোমার ছায়াÑতোমার হাতের ছায়াÑতোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলোÑউঠানে চাঁদের আলোÑনীলাভ চাঁদের আলোÑএমন চাঁদের আলো আজ
Ñজীবনানন্দ দাশ
উঠানের শূন্যতা মানে অতীতের গল্পগুলো এসে ভিড় জমায়। আজকালকার শহরের মানুষেরা জানে না কী হারিয়েছে। উঠানের অস্তিত্ব তারা অনুভব করতে পারে না। কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠার জীবন সংস্কৃতি বারবার মনে করিয়ে দেয়, শোনো, তুমি যত দূরে যাও, তুমি যতই বদলে যাও, মনে রেখো তোমাদের একটা উঠান ছিল।
কী ছিল সেই উঠানে ? ছিল প্রকৃতির সান্নিধ্য। ছিল মানুষে-মানুষে সম্মিলন কেন্দ্র। এখানে রচিত হতো সম্পর্ক তৈরির নিবিড় ব্যাকরণ। উঠানকে ঘিরে যত উচ্ছ্বাস, যত আনন্দমাখা অনুভূতি কবি আল মাহমুদের কবিতায় এভাবেই খুঁজে পাই :
একটু ছিল বয়েস যখন ছোট্ট ছিলাম আমি
আমার কাছে খেলাই ছিল কাজের চেয়ে দামি
উঠোন জুড়ে ফুল ফুটেছে আকাশ ভরা তারা
তারার দেশে উড়তো আমার পরান আত্মহারা।
Ñআল মাহমুদ
‘উঠান’ শব্দটা শুনলেই গ্রামীণ দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। পাখি ডাকা ভোর, শিশির ভেজা কাচা মাটির গন্ধ। উঠান মানেই স্মৃতির আঁচড়। উঠান মানেই যেন কবি জসীমউদ্দীনের সেই সব বুনো ফুলের হাসির ছন্দ :
গড়াই নদীর তীরে,
কুটিরখানিরে লতা-পাতা-ফুল মায়ায় রয়েছে ঘিরে।
বাতাসে হেলিয়া, আলোতে খেলিয়া সন্ধ্যা সকালে ফুটি
উঠানের কোণে বুনো ফুলগুলি হেসে হয় কুটি কুটি।
Ñজসীম উদ্দীন
আজ উঠান নিজেই বিবর্ণ রূপ ছড়িয়ে দিয়েছে। উঠান ছিল, এখন নেইÑএ যেন নতুন সময়ের অনুভূতি তৈরি করছে। ইট-কংক্রিটের নিচে চাপা পড়েছে শৈশবে দেখা উঠান।
আধুনিকতার ঢেউ এসে উঠানকে গ্রাস করেছে।
উঠানে বিষণ্ন দুপুরের রূপ নেই, জোনাকীর আলো নেই, ঝিঁঝি পোকার ডাক নেই।
এখন ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার হয়ে উঠছে এক একটি উঠান। এই ডিজিটাল উঠানগুলোতে মানুষ জড়ো হয়, কথা বলে, হাসে, ঝগড়া করে, অভিমান করে, আবার মিলেও যায়। খোলা আকাশের নিচে জেগে থাকা আগেকার দিনের উঠানে ছিল হাত ধরে বসে থাকার গন্ধ, আর এখনকার ডিজিটাল উঠানে ইমোজি, মিম, ভিডিও, রিলস, স্টোরি ঘুরে বেড়ায়। আগের দিনের উঠানে আকাশের নিচে বসে গল্প হতো এখন অ্যানড্রোয়েড ফোনের স্ক্রিনের আলোয় মুখ বুজে কথা হয়। দুই উঠানের দুটি ধরন হলেও কিন্তু উঠানকে ঘিরে মূল চাহিদা একইÑ সংযোগ, বন্ধুত্ব, ভাব-আবেগ এবং অনুভূতির আদান-প্রদান।
তবে ডিজিটাল উঠানগুলো আগের দিনের খোলা উঠানের মতো উষ্ণ নয়। অনেকটাই ক্ষণস্থায়ী, যান্ত্রিক। চাঁদের আলোয় উঠানে বসে যে অনুভূতি তৈরি হয়, সেই অনুভূতির বিশালতা ছিল সীমাহীন। প্রকৃতির সান্নিধ্য, মুক্ত বাতাস, কাদামাটির গন্ধÑসব মিলিয়ে সেটা ছিল এক প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা। কিন্তু ডিজিটাল উঠানে আকাশটা কৃত্রিম, বাতাসটা ভার্চুয়াল, অনুভূতিগুলো অতিমাত্রায় যান্ত্রিকতার স্পর্শ নিয়ে আসে।
মানুষের জীবনধারা ও নগরায়নের ধরন বদলে গেছে। আগের দিনে খোলা জায়গার গুরুত্ব ছিল বেশি। কিন্তু বর্তমান যুগে জমির মূল্য, প্রয়োজন এবং স্থাপত্যশৈলীর পরিবর্তনের কারণে উঠান হারিয়ে গেছে। খোলা উঠান এখন বহুতল ভবনের নিচে চাপা পড়েছে। শহরের মানুষদের কাছে বসবাসের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট বাসিন্দারা খোলা ছাদকে উঠানের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছে। উঠানের কোণায় যেমন প্রকৃতির নিসর্গের ছোঁয়া থাকে, তেমনই ছাদবাগানে সব্জি আর টবে ফোটা ফুল কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দেয় মনের ভেতর।
অনেকের মতো, আমাদেরও একটা উঠান ছিল। আমাদের উঠানের কোনায় একটা বরই গাছ ছিল। মনে পড়ে শীত সকালের কুয়াশার জাল ভেদ করে আম্মা আমাকে নিয়ে যেত বরই গাছের তলায় বরই কুড়াতে। মাটিতে পড়ে থাকা কাচা পাকা বরইগুলো টুকটুক করে তুলতাম, আর রেখে দিতাম আম্মার আঁচলে। গ্রামের বাড়িতে গেলে উঠানে ছড়িয়ে থাকা বরইগুলো আমার শৈশব রাঙিয়ে দিত। সেই সঙ্গে আম্মার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিত স্বর্গরাজ্য থেকে তুলে আনা তৃপ্তিমাখা আনন্দ। সুখকর সেই মুহূর্তগুলো জমা রেখেছি উঠানের কাছে। কারণ যে যাই বলুক, ছোটদের কৌতূহল মেটানোর জায়গা ছিল এই উঠান। বড়দের কাছে গল্প শোনা, পিঠাপুলি বানানোর আনন্দ, কাঁথা সেলাই করতে করতে এবাড়ি-ওবাড়ির মুখরোচক গল্পগুলো ডালপালা ছড়াত উঠানে বসেই। উঠানের কাছে থাকত একটা ঢেঁকিঘর। ধান সেদ্ধ করার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত উঠান জুড়ে। শীতকালে সকাল-সন্ধ্যায় খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো আর আগুনের উত্তাপ নিতে নিতে গল্পগুজব প্রাণবন্ত হয়ে উঠত এই উঠানে বসেই। আর তাই এটা প্রমাণিত যে, উঠান শুধু বাড়ির অংশ নয়, এটা প্রতিবেশীদের মিলনস্থলও বটে।
গ্রামের বাড়িতে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন করা হতো উঠানে। ঈদ এলে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যাওয়া―এর প্রধান নান্দনিক মাধুর্য রচিত হতো উঠানকে ঘিরে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ছোট-বড় সবাই উল্লসিত হৃদয় মেলে ধরত উঠানের কাছে। সুখের আয়োজন হলে যেমন উঠানÑতেমনই বিপরীত চিত্র দুঃখের গল্পও ভেসে বেড়ায় উঠানের কোণে। উঠান আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উঠানের কথা ছড়িয়ে আছে কবির কবিতায়, গানের সুরে। ঝাঁঝালো গল্পের প্রতীকী উপমায় উঠান আলাদা ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে দিয়েছে আমাদের হৃদয়ে :
এই যে খোলা উঠোন জুড়ে
চলছে নৃত্য, গানের সুরে দুলছে সত্যি
গেরস্তদের বসতবাড়ি। নাচ জমেছে
ডানে বামে। কাছের, দূরের সবার প্রাণে।
Ñশামসুর রাহমান
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন আর স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে কথাশিল্পী আমজাদ হোসেন তাঁর উঠান উপন্যাসে তুলে এনেছেন উঠানকে ভিন্নমাত্রার উপমা দিয়ে। যেখানে রুস্তম সরকার নামে এক চরিত্রের কাছে উঠান এমন এক বৃত্ত তৈরি করে যা আবদ্ধ করে রাখে সংসার-পরিজন। কারণ রুস্তম সরকারের উঠানে দয়া-মায়া, প্রেম-ভালোবাসার জায়গা নেই। ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, তাদের নাতি-নাতনি মিলে এক উঠানকে ঘিরে বিরাট সংসার সাজায় রুস্তম সরকার। ব্রিটিশরা চলে যায়। তার প্রতীকী দৃশ্যরূপ রুস্তম সরকারের মৃত্যু। আর সেই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রুস্তম সরকারের কাছে অবরুদ্ধ থাকা উঠান মুক্তি পায়।
নগরায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে আজকাল উঠান হারিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির স্পর্শে তথ্যপ্রবাহের এই যুগে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের কারণে জায়গা নিয়েছে ভার্চুয়াল দুনিয়া। সামাজিক প্রেক্ষাপটে চিরচেনা উঠান রূপ নিয়েছে উঠান বৈঠক নামে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি আর ক্ষুদ্রঋণের বার্তা জানতে উঠান বৈঠকে উপস্থিত হচ্ছেন গ্রামীণ নারী-পুরুষ।
কিন্তু যে উঠান আমাদের স্মৃতির অংশ, শৈশবের প্রতিচ্ছবি-সেই উঠান কি আর খুঁজে পাব না ?
শৈশবের সেই উঠান কি সত্যি হারিয়ে গেছে ? নাকি আমার ভেতরেই কোথাও রয়ে গেছে।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ