আর্কাইভকবিতা

অনূদিত কবিতা : আব্বাস কিয়ারুস্তামির একগুচ্ছ কবিতা : ইসলাম মাজহার

আব্বাস কিয়ারুস্তামির অনেক পরিচয় আছে। তিনি একাধারে সফল চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সম্পাদক, ফটোগ্রাফার, প্রযোজক, গ্রাফিক ডিজাইনার, লেখক ও চিত্রশিল্পী। শিল্পের প্রায় সব শাখায় পদচারণা থাকলেও তাঁর যে পরিচয়টি তাঁকে দুনিয়াব্যাপী খ্যাতি এনে দিয়েছে তা হলো তাঁর সিনেমা নির্মাণ। তাঁর নান্দনিক সিনেমা শৈলী তাঁকে তাঁর মাতৃভূমি ইরানের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব সিনেমায় একজন প্রভাব বিস্তারকারী নির্মাতা হিসেবে স্থান দিয়েছে। কিয়ারুস্তামি ঠিক শিল্পের কোন শাখায় নাম করতে চেয়েছিলেন ‘ইরনা’-র সাংবাদিক প্রশ্ন করলে, তাঁর সরস উত্তর ছিল যে তিনি একজন চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিয়তির টানে তিনি প্রস্ফুটিত হন সিনেমার ক্যানভাসে।

কিয়ারুস্তামি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চলচিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখ্য যে তিনি ১৯৯৩, ২০০২, ২০০৫, ও ২০১৪ সালে কান চলচিত্র উৎসবে বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন। ইরানি চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে অধিক এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

কিয়ারুস্তামি ১৯৭০ সালে সিনেমায় সম্পৃক্ত হন। তিনি দীর্ঘ, শর্টফিল্ম ও ডকুমেন্টারি মিলিয়ে চল্লিশটি সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তাঁর সিনেমাকর্মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কোকার ট্রিলোজি, ক্লোজ আপ (১৯৯০), তা’মে গিলা’স ‘চেরির স্বাদ’ (১৯৯৭), বা’দ মা’রা’ খা’হাদ বুরদ ‘বাতাস আমাদের নিয়ে যাবে’ (১৯৯৯) ইত্যাদি। অসাধারণ সব সিনেমা নির্মাণের ফলে তিনি পাঁচবার কান চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণ পাম পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং সবিশেষ ১৯৯৭ সালে চেরির স্বাদ বা তা’মে গিলাস এর জন্য পদকটি লাভ করেন।

কিয়ারুস্তামি ক্যামেরার ক্যানভাসে আঁকেন দৃশ্যপট। সেই দৃশ্যপটের উদ্যোগ তিনি নেন ঠিকই, তবে নিয়ন্ত্রণের বদলে অনুসরণেই তিনি শ্রেষ্ঠ কর্মটি বের করে নিয়ে আসেন। এ যেন সৃষ্টির খেলায় মেতে উঠা। এই যে সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠা, এই প্রেরণাও তিনি পান কবিতায়।―কবিতায় ? কার কবিতায় ? একান্ত সাক্ষাৎকারে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলে কিয়ারুস্তামি সহাস্যে কালো চশমা জোড়া চোখের সাথে ভালো করে সেঁটে আবৃত্তি করতে শুরু করেন রুমির কবিতা,

‘গুয়ি মানি ভা মিদাভি দার চুগা’নে হুকমে মান

দার পেইয়ে তো’ হামি দাভাম গারচে মান মি দাভানামেত’

অর্থাৎ, ‘পলো বল ছুটছো তুমি আমার লাঠির জোরেই!

আবার দ্যাখো তোমার পেছনে আমিই ছুটছি, যদিও তুমি ছুটেছো আমি হতেই।’

কিয়ারুস্তামি পলোর লাঠির স্থলে ক্যামেরা বসিয়েছেন আর অনুসরণ করেছেন নিজের ভেতরের শিল্পী সত্তাকে। সেই প্রচেষ্টায় সৃষ্টি করেছেন অমর সব সিনেমা। অনেকে কিয়ারুস্তামিকে সিনেমার কবি বলেন। কারণ তাঁর সিনেমা কাব্যিক। সিনেমা কাব্যিক হলেও যে কিয়ারুস্তামি খোদ কবিতা থেকে দূরে ছিলেন এমন নয়। তাঁর অনেক সাহিত্যকর্মের মধ্যে দুটি কবিতার বইও রয়েছে। বইগুলোর নাম যথাক্রমে, ‘বা’দ ভা বারগ’ অর্থাৎ, বাতাস ও পাতা  ‘গোরগি দার কামিন’ অর্থাৎ, ওঁত পেতে থাকা নেকড়ে। ‘বা’দ ও বারগ’ কবিতা সংকলনটি তিনি জাপানি সাহিত্যে প্রচলিত ‘হাইকু’ কাব্যরীতিকে অনুসরণ করে লিখেছেন। মূল বইয়ে হাইকুগুলোর সাথে চিত্র সংযুক্ত হয়েছে। এবং চিত্রাঙ্কনের মতো শৈল্পিক কাজটিও কিয়ারুস্তামি নিজেই করেছেন। ছোট ছোট এই কবিতাগুলোতে কিয়ারুস্তামির প্রকৃতির প্রতি প্রেম ও সত্যান্বেষণ বোধ দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর অপর গ্রন্থ গোরগি দার কামিন ২০০৪ সালে ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলোতে কিয়ারুস্তামির গভীর জীবনবোধ প্রকাশ পায়। এই পর্বে আব্বাস কিয়ারুস্তামির নির্বাচিত কিছু কবিতার বাংলা অনুবাদ উল্লেখ করছি।

*

সূর্যমুখী ফুলগুলো,

চুপি চুপি নুয়ে পড়ে,

পঞ্চম মেঘাচ্ছন্ন দিনে।

*

ভালোমন্দ যাই হোক,

আকাশ নীল

নীল

*

সময়ের অত্যাচারে,

কবিতায় আশ্রয়।

প্রিয় বিলোপে,

কবিতায় আশ্রয়

সুস্পষ্ট অত্যাচারে,

কবিতায় আশ্রয়।

*

দরজার ছিদ্র দিয়ে

তাপ আসে

চাঁদের আলোও

*

চল্লিশটি লাইট আলোকিত হতেই

চল্লিশটি ছায়া

মাটিতে ঘুমিয়ে পড়ল।

*

মেঘের ভাঁজে ভাঁজে হাবুডুবু খাওয়া চাঁদটার

উদ্দেশ্য

আত্মপ্রকাশ।

*

চাঁদের সাথে

রহস্যের কথা বলেছি

সূর্য উঠতেই রহস্য ফাঁস হয়ে গেল।

*

আমার ও চাঁদের মাঝে

কথা হয়

না চাঁদ শুনতে পায়,

না আমি।

*

চাঁদের আলোর নিচে

পেয়ালা খালি পড়েছিল,

মনও।

*

চাঁদের সাথে সূর্যের দেখা

ততক্ষণে সকাল।

*

শুধু পাথুরে ঘোড়া

সওয়ারিকে মাটিতে ফেলে না।

*

ফিরে আসেনি আর

যে নদী গিয়েছে সমুদ্রে

যে সৈন্য গিয়েছে রণে

যে বন্ধু গিয়েছে অচিন দেশে।

*

চারটি গাছ

চার রকমের

ছায়াগুলো একরকম

চারজন ক্লান্ত পথচারীর জন্য।

*

এই ছোট্ট শিশুটি

শহরের সবচেয়ে বড় সাহিত্যিকের সাথে

কথা বলে

অথচ ব্যাকরণের বালাই নাই।

*

ছোট্ট শিশুটি

মাছগুলোকে প্রশ্ন করে

কেন তারা সবাই এত গোসল করতে

পছন্দ করে ?

*

এখনও

আমার বিশ্বাস হয় না যে

এটা পৃথিবী

এবং এটা ঘোরে।

*

দুটি সমান্তরাল রেখাও

মিলিত হয়েছিল

অসাবধানতায়।

*

ভীমরুল

ফুলে বসতেই প্রজাপতি

উড়ে চলে যায়।

*

বসন্তকে প্রশংসা করার কি আছে

কিংবা গ্রীষ্মকে ঘৃণার ?

একটা যায়, আরেকটা আসে।

*

শিশু জিজ্ঞাসা করে,

আচ্ছা শজারুর পিঠও কি চুলকায় ?

*

আমার উড্ডীনের অভিযাত্রায় অভিজ্ঞতা ছিল

ভূপাতিত হওয়া।

*

পুরোনো গাছগুলো

চারাগাছগুলোর দিকে

কীভাবে তাকায় ?

*

ভালো ও মন্দের মাঝে

ভালোটি বেছেছি

আজব রাস্তা ছিল

মন্দে ভরা

*

একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ শোকসভায়

নীরবতা পালন করার সময়

একজন হেসে দিয়েছিল

আমি দেখেছি।

*

মাথাহীন পুতুলটা ঘুমিয়ে আছে

একটি শিশুর কোলে,

শিশুটি মায়ের কোলে

মা পথের কোলে।

*

ঝোপঝাড়ের ভাঁটফুল,

না কেউ ঘ্রাণ নেয়,

না কেউ তুলে,

না কেউ বেচে,

না কেউ কেনে।

*

রাত সময়মতো আসে,

ভোরের আলোও,

মোরগও যথাসময়ে ডাকে।

আমিই অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।

*

ভাষায় বিরক্ত হয়ে আছি।

তিক্ত ভাষা,

ঝাল ভাষা,

ব্যাকরণ ভাষা,

রূপক ভাষা, উপমার ভাষা ইত্যাদি ইত্যাদি

তুমি বরং ইশারায় কথা বলো!

*

হাজারো উলঙ্গ শিশু

বরফে,

একটা শীতকালীন দুঃস্বপ্ন।

*

কে বোঝে

কলির কষ্ট

যখন সে ফুটে উঠে ফুলে।

*

সবসময় অসমাপ্ত থাকে

আমার কথা

আমার সাথে

*

বলেছে,

‘আমার হাতে একটা কাজও ঠিকমতো হয় না।’

আফসোস!

যদি বলতো,

‘আমার মন থেকেও।’

*

একাকীত্ব ;

নিজের সাথে শর্তহীন ঐকমত্য।

*

প্রিয়রা জ্বালিয়েছে অব্যাহতভাবে

শত্রুদের থেকে কিছু মনে নেই।

*

না বলতে পারে

না লিখতে

কিন্তু কিছু একটা বলছিল

না পড়তে পেরেছি

না কেউ লিখে রেখেছে।

*

কালো মেঘখণ্ডটা

অবশেষে

পূর্ণ চাঁদটাকে

কোলে তুলে নিল।

*

শুরু থেকে লক্ষ্য পর্যন্ত

শত হাজার কিলোমিটার

শত হাজার মানুষ

কারো সাথে কোনও কাজ নাই।

*

বাগান বিক্রি করে দিয়েছি

আজ।

আচ্ছা, গাছ কি জানে ?

……

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button