আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : বিটলসের সঙ্গে

মূল : হারুকি মুরাকামি

জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ : ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল

ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ :  মিলটন রহমান

[হারুকি মুরাকামির জন্ম ১৯৪৯ সালে। সে হিসেবে বয়স এখন পঁচাত্তর। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা সম্ভবত চৌদ্দটি। আর ছোটগল্প গ্রন্থ ছিল মাত্র পাঁচটি। তবে ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল প্রকাশিত হয় তাঁর ষষ্ঠ গল্পগ্রন্থ দি ফার্স্ট পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার (মূল জাপানি ভাষায় গ্রন্থের শিরোনাম-ইছিবানসু তানসু)। এক মলাটে আটটি গল্প। গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিশ্বের তাবৎ পত্রিকা আলোচনায় মেতে আছে। মূল জাপানি ভাষা থেকে সব ক‘টি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। বিশ্বসাহিত্যে মুরাকামির গল্পগ্রন্থটি বিস্তর আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সব সাহিত্য পত্রিকা গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। দি নিউ ইয়র্কার, গার্ডিয়ান, দি টাইমস থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় এ গ্রন্থ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সঙ্গীত, স্মৃতি এবং স্ফীত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসিক দর্শন গল্পগুলোর অবকাঠামো তৈরি করেছে। এ গ্রন্থের চতুর্থ গল্প ‘বিটলসের সঙ্গে’। ইংরেজি থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মূলের ভাব এবং চিন্তার রেখা ঠিক রাখতে।]  

বয়স বেড়ে যাওয়ার  বিষয়ে আমার অদ্ভুত ধারণা এমন নয় যে আমি কেন বৃদ্ধ হয়েছি। এমন নয় যে যৌবন আমাকে বুঝতে না দিয়েই প্রৌঢ়তার দিকে পা বাড়িয়েছে। বরং এই ভেবে আমি সান্ত্বনা পাই, আমার প্রজন্মের অন্যরা কীভাবে প্রৌঢ় হয়ে উঠেছে এবং যেসব সুন্দরী এবং প্রাণবন্ত নারীদের আমি চিনতাম, এখন তাদের এক একজনের কয়েকটি নাতি-নাতনি রয়েছে। তবে এ দৃশ্য বিরক্তিকর এবং কষ্টেরও। আমি দুঃখবোধ করি না এই ভেবে তাদের মতো আমি একইভাবে প্রৌঢ় হয়ে উঠিনি।

আমি মনে করি, আমাকে বিস্মিত করে তোলে, যখন ভাবি কীভাবে আমার সময়ের মেয়েগুলো প্রৌঢ় হয়ে উঠেছে। যা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে, তাদের বুড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার যৌবনের স্বপ্নগুলোও চিরতরে হারিয়ে গেছে। স্বপ্নের মৃত্যু অনেক সময় একটি প্রাণের মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ হয়ে ওঠে।

একটা মেয়ে ছিল―একটা মহিলা। তার কথা আমার খুব ভালো মনে আছে। যদিও তার নাম জানি না আমি। জানি না এখন সে কোথায় থাকে, করে। আমি যে স্কুলে পড়তাম, সে স্কুলে মেয়েটিও পড়ত, সেভাবে তাকে আমি চিনি। আমরা পড়তামও একই ক্লাসে (তার শার্টের উপরের ব্যাচটা আমারটার মতো একই রঙের ছিল), আর সে বিটলসের গান খুব পছন্দ করত।

১৯৬৪ সাল, বিটলসের জনপ্রিয়তার তুঙ্গ সময়। সময় ছিল শরতের শুরুর দিকে। নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছিল এবং সবকিছু একটি রুটিনে পড়তে শুরু করেছিল আবার। মেয়েটি তাড়াহুড়ো করে পুরোনো স্কুল বিল্ডিং এর দীর্ঘ আবছা হলপথ দিয়ে নিচে নামছিল, উড়ছিল তার স্কার্ট। সেখানে কেবল আমি ছিলাম। সে দীর্ঘ গানের ক্যাসেটটি বুকের মধ্যে এমনভাবে চেপে ধরে রেখেছিল, যেন অনেক মূল্যবান কিছু। দীর্ঘ গানের ক্যাসেট ‘উইথ দি বিটলস’-এর গায়ে অর্ধ ছায়ার মতো চার বিটলসের ছবি ছাপা। আমি জানি না, যে কোন কারণে, আমার পরিষ্কার মনে আছে সেটি ছিল মূল অ্যালবাম। অ্যালবামের ব্রিটিশ সংস্করণ। আমেরিকান কিংবা জাপানি সংস্করণ নয়।

সে ছিল অত্যন্ত সুন্দরী। আমার কাছে সে ছিল অন্তত আকর্ষণীয়। সে লম্বা ছিল না, তবে মাথার চুল ছিল বেশ লম্বা, পা ছিল সরু, গা থেকে চমৎকার সুবাস ভেসে আসত। (আমি জানি না, এটা হয়তো আমার ভুল স্মৃতি হতে পারে। সম্ভবত সে কোনও ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করত না। কিন্তু আমার মনে আছে, যখন সে পাশ দিয়ে চলে যেত, একটা সুগন্ধ আমার দিকে ধেয়ে আসত।) সেই সুন্দরী, নামহীন মেয়েটি, যে বুকে চেপে রেখেছিল ‘উইথ দ্য বিটলস’ অ্যালবামটিÑসে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল।

আমার হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করতে শুরু করে, দীর্ঘশ্বাস নিলাম, সব শব্দ যেন থেমে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল আমি যেন পুকুরের তলায় ডুবে গেছি। কেবল কানের গভীরে একটি ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনতে পাই। যেন কেউ একজন আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কোন বার্তা পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই পুরো ঘটনাটা দশ থেকে পনের সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। আমি বুঝে ওঠার আগেই ফুরিয়ে গেল এবং সেখানে থাকা বার্তাটি স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেল।

স্কুলের আবছা আলোকিত হলপথ, একটি সুন্দরী মেয়ে, যার স্কার্টের পাড় নাচছে ‘উইথ দ্য বিটলসে’র সাথে।

একমাত্র সেই সময় আমি মেয়েটিকে দেখেছিলাম। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার দুই বছরের মধ্যে আমাদের আর দেখা হয়নি। ভাবলে এটা আবাক হওয়ার মতোই একটি বিষয়। আমি যে হাই স্কুলে পড়তাম তা ছিল কুবে শহরের পাহাড়ের ওপরে একটি বৃহৎ পাবলিক স্কুল। এক একটি ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী ছিল প্রায় সাড়ে ছয় শ। (আমরা ছিলাম অতি জন্মহারের প্রজন্ম) এমন ছিল না যে একই ক্লাসে পড়লেও আমরা সবাই একে অপরকে চিনতাম। আমি স্কুলের বেশির ভাগ বাচ্চাদের চিনতাম না, জানতাম না নাম। আমি প্রায় প্রতিদিনই স্কুলে যেতাম এবং সেই হলপথ ব্যবহার করতাম। সেই পথ আমাকে অনেকটা আটকে রেখে মনে করিয়ে দিত যে, মেয়েটির সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আমি সেই হলপথ ব্যবহার করি এবং মেয়েটিকে খুঁজি।

মেয়েটি কি ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেছে ? নাকি প্রারম্ভিক শরতের সেই বিকেলে আমি মানুষ নয়, অন্য কিছু দেখেছিলাম ? আমরা একে অপরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সম্ভবত মেয়েটিকে মনে গেঁথে রেখেছিলাম। আবার যদি কখনও দেখা হয়, তাহলে আমি কি মেয়েটিকে চিনতে পারব না ? (আমার মনে হয় চিনতে না পারার আশংকাই বেশি)।

পরে, কয়েকটি মহিলার সাথে আমার পরিচয় হয় এবং তাদের সাথে বাইরে যেতাম। যখনি নতুন কোনও মহিলার সাথে দেখা হতো, আমি নিজের অজান্তেই ১৯৬৪ সালের সেই উজ্জ্বল মুহূর্তটিকে পুনরুজ্জীবিত করার আকাক্সক্ষা পোষণ করতাম। শরতের যে মুহূর্তটি আমি হলপথে অনুভব করেছিলাম। আমার হৃদয়ে সেই নীরব, অদম্য রোমাঞ্চ, বুকে নিঃশ্বাসহীন অনুভূতি, আর সেই ঘণ্টা কানের মধ্যে ক্ষীণ বাজে।

কখনও কখনও আমি সেই অনুভূতি পুনরায় অনুভব করতে পারি, তবে সব সময় নয়।  এবং অন্য সময় আমি একে ধরে রাখতে পারি, শুধু আমার আঙ্গুল ছুঁয়ে গড়িয়ে যেতে দিই। সে যাই হোক, তখন যে আবেগ উছলে উঠেছিল, তা এক ধরণের পরিমাপক হিসেবে কাজ করেছে। যা দিয়ে আমি নিজের আকাক্সক্ষা পরিমাপ করতাম। বাস্তবে যখন আমি সেই অনুভূতির অনুরণন পেতাম না, তখন নিজের ভেতরে সেই অনুভূতির স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে তুলতাম। এভাবে স্মৃতি আমার সবেচেয়ে মূল্যবান মানসিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে, যা আমার বেঁচে থাকার উপায় হয়ে ওঠে। অনেকটা উষ্ণ বিড়ালছানার মতো, একটি কোটের বড় পকেটের ভেতর তুলতুলে নরম এবং কোচকানো ঘুমের মতোন।

বিটলসের সাথে।

এক বছর আগে, যখন বিটলস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তখন মেয়েটির সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তখন বিটলসের লক্ষ্য ছিল ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে আমেরিকার একক তালিকায় শীর্ষ পাঁচটি গান যেন স্থান করে নেয়। পপ সঙ্গীতের ইতিহাসে এমন আগে দেখা যায়নি। যে পাঁচটি গান শীর্ষস্থান দখল করেছিল, সেগুলো হলো―১. কান্ট বাই মি লাভ (আমাকে ভালোবাসা কিনে দিতে পারবে না), ২. টুইস্ট অ্যান্ড শাট (নাচো এবং উল্লাস করো), ৩. শি লাভস ইউ (মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে), ৪. আই ওয়ান্ট টু হোল্ড ইউর হ্যান্ড (আমি তোমার হাত ধরতে চাই), ৫. প্লিজ প্লিজ মি (দয়া, দয়া করো আমাকে)। কেবল ‘কান্ট বাই মি’- এর জন্য প্রি অর্ডার ছিল দুই মিলিয়নের বেশি। রেকর্ডটি বিক্রির আগেই ডাবল প্লাটিনাম করেছিল।

জাপানেও বিটলস অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। রেডিও অন করলেই তাদের গা শোনা যেতো। আমি বিটলসের গান ভালোবাসি, এমনকি তাদের সব হিট গানের তালিকা আমার জানা। তুমি আমাকে সেসব গান গাইতে বলো, আমি গাইতে পারব। বাড়িতে আমি পড়াশুনো করার সময় (কিংবা পড়ার ভান করার সময়) রেডিও আমার কাছ থেকে দূরে থাকত। সত্য কথা বলতে কি, আমি কখনও বিটলসের গানের অনুরাগী ছিলাম না। আমি কখনই সক্রিয়ভাবে তাদের অ্যালবাম খুঁজিনি। আমার জন্য সেই গান শোনা তেমন আগ্রহের কিছু ছিল না। আমার প্যানাসনিক ট্রানজিস্টর রেডিওর ক্ষুদ্র স্পিকার থেকে পপ সঙ্গীত শোনা যাচ্ছে এক কানে, অন্য কান তা আমলেই নিচ্ছে না। আমার কৈশোরে তা ছিল সূচনা সঙ্গীতের মতো।

হাইস্কুল এবং কলেজে পড়ার সময় আমি বিটলসের একটা অ্যালবামও কিনিনি। আমার প্রিয় ছিল জ্যাজ এবং ক্লাসিক্যাল। যখনই আমি গানের দিকে মনোনিবেশ করতাম তখনই জ্যাজ এবং ক্লাসিক্যাল শুনতাম। জ্যাজ রেকর্ড কেনার জন্য আমি পয়সা জমাতাম। জ্যাজ বারে মাইলস ডেভিস এবং থেলোনিয়াস মঙ্কের করা সুরের রেকর্ড আনার অনুরোধ করতাম এবং জমানো পয়সা দিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে যেতাম। শুনলে বিস্ময় লাগবে, আমার মধ্য ত্রিশের পরে, এক বসাতে ‘উইথ দ্য বিটলস’, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনতাম। আমাদের হাইস্কুলের হলপথে ওই মেয়েটির দীর্ঘ রেকর্ডটি বহন করার দৃশ্য কখনও আমার কাছে মলিন হয়নি। তবে দীর্ঘ সময় এই রেকর্ড শোনার ইচ্ছে জাগেনি আমার। আমি কখনও জানতেও আগ্রহী হইনি যে ভিনাইল ডিস্কের খাঁজে কোন রেকর্ডটি মেয়েটি বুকে ঠেসে ধরেছিল।

শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে আমি যখন মধ্য ত্রিশে দাঁড়ালাম, তখন আমার মনে হলো অ্যালবামটি তেমন দুর্দান্ত কিছু নয়, কিংবা দম বন্ধ করা কোনও সঙ্গীত নয়। অ্যালবামের চৌদ্দটি গানের মধ্যে ছয়টি ছিল অন্য শিল্পীদের করা। ‘মার্ভোলেটস’, ‘প্লিজ মি. পোস্টম্যান’ এবং সাক ব্যরির ‘রোল ওভার বেথুবেন’ ছিল অত্যন্ত চিত্ত জাগানিয়া। আমাকে এ কটি গান এতই মুগ্ধ করেছে যে, এখনও শুনতে ভালো লাগে, যদিও সেগুলো অন্যদের করা ছিল। অন্য আটটি মূল গান, পলের করা ‘অল মাই লার্ভিং’সহ কোনওটিই বিস্ময় জাগানিয়া নয়। সেখানে একটি গানও হিট ছিল না। বিটলসের প্রথম অ্যালবাম ‘প্লিজ প্লিজ মি’ যা এক টেকে রেকর্ড করা ছিল, তা আমার কাছে অনেক বেশি প্রাণবন্ত এবং আকর্ষক ছিল। তবু বিটলসের ভক্তদের ধন্যবাদ জানাতে হয়, নতুন গানের জন্য অদম্য ইচ্ছে প্রকাশ করায়। দ্বিতীয় অ্যালবামটি ব্রিটেনে আত্মপ্রকাশ করার পর শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখে, যা একুশ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয় (তবে আমেরিকাতে অ্যালবামটি প্রকাশিত হয় ‘মিট দ্য বিটলস’ নামে, সেখানে কয়েকটি গানও পরিবর্তন করা হয়, তবে রেকর্ডটির প্রচ্ছদ প্রায় একই রকম ছিল)। 

মেয়েটির বুকে অ্যালবামটি চেপে ধরার দৃশ্য আমার কাছে অমূল্য ছিল। অ্যালবামটির প্রচ্ছদ সরিয়ে ফেললে, দৃশ্যটি আমাকে বিমোহিত নাও করতে পারে, তখন যেভাবে করেছিল। অ্যালবামে গান ছিল নিশ্চিত। কিন্তু সেখানে আরও কিছু ছিল, যা এর চেয়েও বেশি মোহনীয়। সেই মুহূর্তটি আমার বুকে গেঁথে গেল। নির্দিষ্ট বয়সে, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট স্থানে একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতি সেখানে ছিল।

আমার জন্য পরের বছর, ১৯৬৫ সালের প্রধান ঘটনা ছিল প্রেসিডেন্ট জনসনের উত্তর ভিয়েতনামে বোমা মারার নির্দেশ না দেয়া। এবং যুদ্ধ শিথিল করা কিংবা ইরিওমোট দ্বীপে নতুন প্রজাতির একটি বন্য বিড়াল আবিষ্কার করা। তবে আমার জন্য বড় ঘটনা হলো একটি মেয়ের সাথে প্রেমে জড়ানো। সেও আমার মতো ক্লাসে নতুন। 

কোনও ধরনের ভুল বোঝাবুঝি যাতে তৈরি না হয়, সেজন্যে বলে রাখতে চাই যে, আমি দেখতে সুদর্শন ছিলাম না, এমনকি ছিলাম না তারকা দৌড়বিদ। স্কুলে আমার ফলাফলও ছিল অন্যদের চেয়ে খারাপ। আমার গান গাওয়াও আকাঙক্ষার চেয়ে অনেক পেছনে ছিল, তা যে বাদ দেব তেমন উপায়ও ছিল না। যখন আমি স্কুলে পড়তাম, এবং পরের বছরগুলোতেও, আমার চারপাশে কখনও দেখিনি কোনও মেয়ের দল। এই অনিশ্চিত জীবনে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমন কয়েকটি ঘটনার মধ্যে এটি একটি। তবু সব সময় মনে হতো আমার পাশে একটি মেয়ে আছে। যে কি না কোনও না কোনও কারণে আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। আমার কোনও ধারণা নেই। তবে তাদের সাথে আমার বেশ অন্তরঙ্গ সময় কেটেছে। তাদের কয়েকজনের সাথে আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। মাঝে মাঝে এ সম্পর্ককে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতাম। আমি যে মেয়েটির কথা বলছি, সে এই দলেরই একজন। সেই প্রথম কোনও মেয়ের সাথে আমি অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম।

আমার প্রথম প্রেমিকা ছিল ছোটখাটো গড়নের এবং কমনীয়। সেই গ্রীষ্মে, প্রতি সপ্তাহে একবার তার সাথে আমি ডেটিং-এ যেতাম। একদিন বিকেলে, তার পুরো ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলাম এবং ব্রার ফাঁক গলে তার স্তন স্পর্শ করেছিলাম। ওর পরনে ছিল হাতাকাটা সাদা জামা। তার চুল থেকে ভেসে আসছিল শ্যাম্পুর সুগন্ধ।

বিটলস সম্পর্কে তার কোনওই আগ্রহ ছিল না। জ্যাজ শুনতেও সে আগ্রহী ছিল না। সে শস্তা জনপ্রিয় সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করত, যাকে বলা যেতে পারে মধ্যম মানের গান, যেমন মেন্টোভানি অর্কেস্ট্রা, পার্সি ফেইথ, রজার, রজার উইলিয়ামস, এন্ডি উইলিয়ামস, নাইট কিং কোল ইত্যাদি। (অবশ্য সে সময় মধ্যম মান বা মধ্যবিত্ত শব্দটি অবমাননাকর ছিল না)। তার বাড়িতে এসব শিল্পীর রেকর্ডেও স্তূপ ছিল, যা সহজে শ্রবণযোগ্য বলে এখন বিবেচিত হয়।

এক বিকেলে, তার বসার ঘরের টেবিলে রাখা একটি টেপ রেকর্ডার। তাদের একটি বৃহৎ স্টেরিও সিস্টেম রেকর্ডার ছিল। আমরা আরামদায়ক সোফায় বসে একে অপরকে চুমু খাচ্ছিলাম। সে সময় ঘরে আমি আর ও ছাড়া কেউ ছিল না। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, এমন উত্তেজনাকর সময়ে রেকর্ডারে কী বাজছিল তা খেয়াল করার ফুরসৎ পাইনি।

১৯৬৫ সালের সামারের যে স্মৃতি আমার মনে আছে তা হলো, তার পরনে ছিল সাদা জামা, চুল থেকে ছড়াচ্ছিলো শ্যাম্পুর সুগন্ধ এবং ফিতাযুক্ত চমৎকার ব্রা-এর ছোঁয়া (ব্রাটি ছিল আন্ডারওয়ারের মতো গভীর খাদযুক্ত দুর্গের মতো)। আর ম্যাক্স স্টেইনারের পরিবেশনা পার্সি ফেইথ অর্কেস্ট্রার ‘থিম ফ্রম এ সামার প্লেস’। এখনও ‘থিম ফ্রম এ সামার প্লেস’ শোনার সময় আমার চোখে ভেসে ওঠে সেই আরামদায়ক সোফাটি, যেটিতে আমরা বসে একে অপরকে চুমু খেয়েছিলাম।

ঘটনাক্রমে, কয়েক বছর পর ১৯৬৮ সালে―আমার মনে পড়ে, একই সময়ে রবার্ট কেনেডি আত্মহত্যা করেছিলেন। আমরা একই ক্লাসে পড়ার সময় তিনি আমাদের হলরুম শিক্ষক ছিলেন। সে সময় নিজের ঘরে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রবার্ট। তিনি আমাদের সোশ্যাল স্টাডিজ পড়াতেন। একটি আদর্শিক অচলাবস্থার কারণেই না কি তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। 

আদর্শিক অচলাবস্থা ?

তবে এটা ঠিক যে, ষাটের দশকের শেষের দিকে আদর্শগত কারণে এভাবে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। তবে তা ছিল সংখ্যায় অল্প। 

আমি খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ি যখন মনে হয়, যে সময়ে পার্সি ফেইথের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে আমি আর আমার প্রেমিকা সোফায় বসে একে অপরকে উপভোগ করছিলাম, ঠিক তখন আমাদের সোশ্যাল স্টাডিজের শিক্ষক রবার্ট ধীরে ধীরে আদর্শিক আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যান। ধীরে ঠিক করে নেন ফাঁসির দড়ির গিঁট। মনে হলেই আমি বিমর্ষ হয়ে উঠি। আমি সব শিক্ষককেই চিনতাম, তবে রবার্ট ছিলেন সেরা। তিনি কতটুকু সফল ছিলেন সে অন্য প্রশ্ন, তবে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি সমদৃষ্টিতে দেখতেন। ক্লাসের বাইরে তার সাথে আমি কখনও কথা বলিনি। তাকে আমার এভাবেই মনে আছে।

১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সাল ছিল বিটলসের বছর। তারা ‘এইট ডেজ এ উইক’ প্রকাশ করে ফেব্রুয়ারিতে, এপ্রিলে ‘টিকেট টু রাইড’, জুলাইয়ে ‘হেল্প’ এবং ‘ইয়েস্টার্ডে’ প্রকাশ করে সেপ্টেম্বরে। এই গানগুলোর সবই মার্কিন জনপ্রিয়তার তালিকায় ছিল শীর্ষে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মনে হতো আমরা সারক্ষণ বিটলসের গান শুনি। আমাদের চারপাশে, সবখানে এমন ছিল, যেন একটি ওয়াল পেপারের সাথে আরেকটি ওয়াল পেপার সাঁটার মতোই। একটার পর একটা গান শুনতাম আমরা, কোনও বিরতি ছাড়া।

যখন বিটলসের গান বাজতো না তখন ছিল অন্যদের সময়। যেমন―রোলিং স্টোনসের ‘(আই কেন নট নো) সেটিসফেকশন’ অথবা ‘দি বায়ার্ড’স’ কিংবা ‘মি. টেম্বুরিন ম্যান’। অথবা টেম্পটেশনের ‘মাই গার্ল’ কিংবা দি রাইসেস ব্রাদার্সের ‘ইউ হেভ লস্ট দেট লাভিন ফিলিন’ বা বিচ বয়েসের, ‘হেল্প মি রোনডা’ এসব গান ছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এছাড়া ডায়ানা রস এবং দি সুপ্রিম-এর গান একের পর এক জনপ্রিয়তায় শীর্ষে ছিল। আমার ছোট্ট ট্রানজিস্টর রেডিওতে এসব গান একের পর এক বাজতে থাকত। ওই সময় ছিল পপ সঙ্গীতের স্বর্গরাজ্য।

আমি এমনও বলতে শুনেছি যে, সে সময় ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে উত্তম সময়, যখন পপ সঙ্গীত সত্যিকার অর্থে আমাদের কাছে অর্থবোধক হয়ে উঠত, সহায়তা করত নিজেকে খুঁজে পেতে। সম্ভবত এটাই সত্য কিংবা সত্য নয়। হয়তো কিছুই না, তারপরও সবকিছুর পরে পপ সঙ্গীতই ছিল আমাদের। আমাদের জীবনটা তো আলংকারিক, ক্ষয়িষ্ণু এবং রঙের বিস্ফোরণ ছাড়া আর বেশি কিছু নয়।

আমার প্রেমিকার বাড়ি ছিল কোবে রেডিও স্টেশনের পাশে, যে রেডিও আমি সব সময় শুনি। মনে হয় তার বাবা মেডিকেল যন্ত্রপাতি আমদানি কিংবা রপ্তানি বাণিজ্য করে। আমি পুরোপুরি জানি না। সে যাই হোক, তিনি নিজেই কোম্পানি পরিচালনা করতেন এবং বেশ ভালো বাণিজ্য করতেন। সমুদ্রের কাছে পাইন বনের মধ্যে ছিল তাদের বাড়ি। শুনেছি বাড়িটি নাকি ব্যবসায়ীদের অবকাশ যাপনের বাংলো ছিল। সেটি কিনে নিয়ে তারা নতুন করে কাজ করিয়েছে। সামুদ্রিক হাওয়ায় পাইন গাছগুলোয় মরিচা ধরেছে। এটা ‘থিম ফ্রম এ সামার প্লেস’ শোনার উপযুক্ত জায়গা ছিল।

কয়েক বছর পর, শেষ রাতে আমাকে দেখতে হয়েছিল, ১৯৫৯ সালের টেলিভিশন চলচ্চিত্র ‘এ সামার প্লেস’। হলিউডের চলচ্চিত্রটি ছিল সাধারণ প্রেমের গল্প, তবু ভালো লেগেছে। চলচ্চিত্রটিতে দেখেছি, সমুদ্রের কোল ঘেঁষে পাইন বন, যাতে গ্রীষ্ম দোল খাচ্ছে পার্সি ফেইথ অর্কেস্ট্রার হর্ন পর্ব। বাতাসে পাইন গাছের দোল খাওয়ার দৃশ্য আমার কাছে তরুণদের উগ্র যৌন আকাক্সক্ষার রূপক হিসেবে ধরা দিয়েছিল। আমি ওই দৃশ্যকে এভাবে গ্রহণ করেছি, একে আমার পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও বলা যেতে পারে।

ওই সিনেমাতে ট্রয় ডোনাহু ও সান্দ্রা ডি এমন দুর্মর যৌন হাওয়ায় ভেসেছিল যে, এর কারণে বাস্তব বিশ্বের যাবতীয় সংকট তাদের মুখোমুখি হয়। এক সময় সব ভুল বোঝাবুঝি কুয়াশা সরানোর মতো মুছে দুজনে কাছাকাছি আসে এবং বিয়ে করে। পঞ্চাশের দশকে প্রায় সব চলচ্চিত্রের সমাপ্তি টানা হতো নায়ক-নায়িকার মিলন বা বিয়ের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাতে করে প্রেমিক-প্রেমিকা বৈধভাবে যৌনমিলন করতে পারে। আমি আর আমার প্রেমিকা বিয়ে করিনি। আমরা তখন হাই স্কুলে পড়ি। আমরা নেপথ্যে থিম ফ্রম এ সামার প্লেস বাজিয়ে, সোফায় আনাড়িভাবে একটি পরিবেশ তৈরি করতাম।

তুমি কি জানো ? সোফার উপরে ফিসফিস করে প্রেমিকা আমাকে বলল, যেন সে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে, ‘আমি সত্যি ঈর্ষাপরায়ণ চরিত্রের’।

‘সত্যি ?’ আমি বললাম।

‘আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, তুমি বিষয়টি জানো’।

‘আচ্ছা।’

‘মাঝে মাঝে এতো ঈর্ষাকাতর হতে কষ্ট হয়।’

আমি আলতো আঙ্গুলে তার চুলে বিলি কাটতে থাকি। সে সময় ঈর্ষান্বিত মানুষ কেমন অনুভব করে, এরং তাতে করে তার ভেতর কী ঘটে তা অনুভব করা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আমি তখন নিজের আবেগে আচ্ছন্ন ছিলাম।

ফুটনোটের মতো একটু বলতে চাই, সেই সুদর্শন তরুণ নায়ক ট্রয় ডোনাহু, পরে মদ এবং মাদকদ্রব্যসহ ধরা পড়ে। এরপরে ছবিতে কাজ করা বন্ধ করে দেয়, এমনকি হয়ে পড়ে গৃহহীন। সান্দ্রা ডিও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। ডোনাহু জনপ্রিয় নায়িকা সোজানা প্লাসেটকে বিয়ে করে, যদিও সে বিয়ে ভেঙে যায় আট মাস পড়ে। ডি ১৯৯৬ সালে সঙ্গীতশিল্পী ববি ডারিনকে বিয়ে করে। তাদেরও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ১৯৬৭ সালে। ‘এ সামার প্লেস’-এর সাথে এই ঘটনাগুলোর কোনও সম্পর্ক নেই। আমি এবং আমার প্রেমিকার জীবন কিংবা ভাগ্যের সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই।

আমার প্রেমিকার এক বড় ভাই এবং এক ছোট বোন ছিল। ছোট বোনটি জুনিয়র হাই স্কুলে পড়ত। তবে সে বড় বোনের অর্থাৎ আমার প্রেমিকার চেয়ে দুই ইঞ্চি লম্বা ছিল। সে অর্থে মেয়েটি খুব একটা সুন্দরী ছিল না, মোটা পুরু কাচের চশমা পরত। আমার প্রেমিকা তার বাচ্চা বোনটিকে খুব পছন্দ করত। বোনটি আমাকে বলেছিল, তার স্কুলের ফলাফল ভালো। মানে সে ভালো ছাত্রী। আমার প্রেমিকা মাঝামাঝি গ্রেডের যোগ্য ছিল। সম্ভবত আমার মতোই।

এক সময় আমরা তার ছোট বোনকে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিশেষ কারণে তাকে নিতেই হলো। ছবিটির নাম ছিল ‘দি সাউন্ড অব মিউজিক’। পুরো প্রেক্ষাগৃহ ছিল পূর্ণ। আমরা বসেছিলাম একেবারে সামনের দিকে। সিনেমার পর্দা ছিল ৭০ এমএম। বৃহৎ পর্দায় একেবারে কাছ দেখে দেখায় শেষ দিকে আমার চোখে ব্যথা করে। আমার প্রেমিকা ছবির গানগুলোর প্রতি বেশ আসক্তি দেখায়। সে গানগুলোর একটা দীর্ঘ ক্যাসেট কিনে বিরামহীন শুনতে থাকে। আমি ভক্ত ছিলাম জন কোলট্রেনসের জাদুকরী সংস্করণ ‘মাই ফ্যাভরিট থিংস’-এর। তবে, তার জন্য রেকর্ডটি কেনা আমার মনে হয়েছে অর্থহীন, তাই আমি কখনও কিনিনি।

তার ছোট বোন আমাকে খুব একটা পছন্দ করত না। দেখা হলে সে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকত―সে তাকিয়ে থাকা ছিল অত্যন্ত রুক্ষ। যেন ফ্রিজের একেবারে পিছনে পড়ে থাকা পুরোনো মাছ খাওয়া যাবে কি না তা প্রত্যক্ষ করছে। তার সে চাওয়ায়, আমার নিজেকে সব সময় অপরাধী মনে হতো। যখন সে আমার দিকে তাকাতো তখন মনে হতো সে পরিপার্শ্ব বাতিল করে দিয়ে আমার ভেতরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা  করত। আমার মধ্যে লজ্জা এবং অপরাধবোধ ছিল বলেই সম্ভবত এমন মনে হতো।

আমার প্রেমিকার ভাই ছিল ওর চেয়ে চার বছরের বড়। সে হিসেবে তখন ওর বয়স ছিল বিশ বছর। ভাইয়ের সাথে কখনও সে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। এমনকি তার ভাইকে আমার সম্পর্কে কখনও বলেওনি। যদি তার ভাই কখনেও আমার সাথে কথা বলতে চাইতো, তৎক্ষণাৎ সে আলোচনার বিষয় পাল্টে ফেলত। এখন বুঝতে পারি, তার মনোভাব কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল। এমন না যে, আমি এ বিষয়ে খুব ভাবতাম। তাদের পরিবার সম্পর্কেও আমি খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম না। তার আবেগ আমাকে খুব বেশি আকৃষ্ট করেছিল।

১৯৬৫ সালের শরতের শেষ দিকে তার ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা এবং কথা হয়েছিল।

এক রবিবারে আমার প্রেমিকার বাড়িতে গিয়েছিলাম তাকে নিয়ে আসার জন্য। দরজায় বারবার কলিং বেল টিপেও কারও সাড়া পাওয়া গেল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, আবার টানা বেল বাজাতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম কেউ একজন ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি ছিলেন আমার প্রেমিকার বড় ভাই। তিনি আমার চেয়ে লম্বা এবং মোটা। তেমন রঙচটে নয়, দেখতে অনেকটা ক্রীড়াবিদের মতো। যে কোনও কারণে ব্যায়াম করতে পারতেন না। ফলে শরীরে কিছু চর্বি জমেছিল। তার ছিল চওড়া কাঁধ। চুল থাকত এলোমেলো। মনে হতো যেন এইমাত্র ঘুম থেকে জেগেছেন। চুলগুলো কেমন শক্ত এবং মোটা। মনে হতো তার চুল অন্তত আরও দুই সপ্তাহ আগে কাটা উচিত ছিল। তার একটা গোল গলার নীল সোয়েটার ছিল, গলার দিকটা আঁটোসাঁটো। তাকানোর ভঙ্গি ছিল একেবারে আমার প্রেমিকার বিপরীত। আমার প্রেমিকা সব সময় ঝরঝরে পরিষ্কার এবং সুসজ্জিত থাকত।

প্রেমিকার ভাই আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, অনেকটা অপ্রস্তুত প্রাণির মতো―দীর্ঘ শীত যাপন শেষে, সূর্য ওঠার মতো।

আমি কোনও কথা বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার মনে হয় তুমি…সায়োকোর বন্ধু।’ বলেই খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। কণ্ঠস্বর ছিল ঘুম জড়ানো, কিন্তু তার কথায় আমি কিছুটা স্ফুলিঙ্গ অনুভব করি।

‘ঠিক বলেছেন’―আমি বললাম। নিজের পরিচয় দিলাম। আমার এখানে এগারোটায় আসার কথা ছিল।

‘সায়োকো এখন বাড়িতে নেই।’

তার কথার প্রতি উত্তরে বললাম―‘নেই ?’

‘সে বাড়িতে নেই, অন্য কোথাও গেছে।’

‘কিন্তু এখানে আমার এগারোটায় আসার কথা ছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।’

‘তাই নাকি ?’ সায়োকোর ভাই বললেন। তিনি পাশের দেয়ালের দিকে তাকালেন, যেন দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখছেন। কিন্তু দেয়ালে কোনও ঘড়ি ছিল না, কেবল শূন্য সাদা দেয়াল। অনেকটা অনিচ্ছায় তিনি আবার আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘হয়তো তোমার সাথে তেমন কথা ছিল। কিন্তু সে তো এখন বাড়িতে নেই।’

আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। সায়োকোর ভাই এতক্ষণ যা করল তা নিয়েও মনে প্রশ্ন। দেখলাম ধীরে হাত দিয়ে মাথার পিছনে চুলকাচ্ছে। তিনি যা করছেন, তা অত্যন্ত ধীরে এবং মেপে মেপে করছেন।

‘এখন বাড়িতে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না’ তিনি বললেন। ‘কতক্ষণ আগে আমি যখন ঘুম থেকে জেগেছি তখন কেউ ছিল না। তারা সবাই বাইরে বেরিয়েছে। তবে কোথায় গেছে আমি জানি না।’

আমি কিছুই বলিনি।

‘আমার বাবা সম্ভবত গলফ খেলতে গেছেন। আমার বোনও হয়তো কোথাও ঘুরতে বেরিয়েছে। তবে আমার মার বাইরে যাওয়াটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। কারণ তিনি খুব কমই বাইরে যান।’

এই বাড়িতে আমি আসিনি, এমন ভাবনা থেকে আমি নিজেকে বিরত রাখলাম।

‘তবে সায়োকো যদি তোমাকে বাড়িতে থাকবে বলে কথা দিয়ে থাকে, তাহলে আমি নিশ্চিত সে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে আসবে।’ সায়োকোর ভাই বললেন। ‘তুমি কেন ভেতরে আসছো না, আসো ভেতরে অপেক্ষা করো।’

‘আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। আমি আশেপাশে একটু ঘোরাঘুরি করে আবার ফেরত আসব।’ আমি বললাম।

তিনি অত্যন্ত কোমল স্বরে বললেন, ‘না বিরক্তির কিছু নেই। বরং তুমি আবার ফেরত আসলে যখন দরজায় বেল বাজাবে সেটাই হবে বিরক্তিকর। আবার এসে তোমাকে দরজা খুলে দিতে হবে। বরং তুমি ভেতরে বসো।’

আর কোনও উপায় ছিল না। আমি ঘরে প্রবেশ করলাম। আমাকে তিনি লিভিং রুমে বসতে দিলেন। লিভিং রুমে সেই সোফা যেটিতে গত গ্রীষ্মকালে আমি আর সায়োকো মিলিত হয়েছিলাম। আমি সে সোফায় বসলাম। আর তার ভাই একটি চেয়ার নিয়ে আমার মুখোমুখি বসলেন। আর একটা হাই দিলেন।

‘তুমি সায়োকোর বন্ধু, ঠিক ?’ তিনি যেন দ্বিতীয়বার বিষয়টি নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন।

‘জি’―আমি বললাম

‘ইয়কো’র বন্ধু না ?’

আমি মাথা নাড়লাম। ইয়কো, সায়াকোর লম্বা মতন ছোট বোনটি।

‘সায়োকোর সাথে বাইরে যাওয়া কি খুব মজার ?’ কৌতূহলী চোখে তার ভাই জানতে চাইলেন।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। চুপ করে বসে রইলাম। তিনিও আমার উত্তরের অপেক্ষায় বসে রইলেন।

‘জি আনন্দের’ মনে হলো উত্তরের জন্য এটাই সঠিক শব্দ।

‘কেবলই আনন্দের ? লোভনীয় নয় ?’

‘না―আমি তা বুঝাতে চাচ্ছি না।’ মুখ থেকে গড়িয়ে বেরিয়ে গেল শব্দ কটি।

‘কোনও ব্যাপার না’ সায়োকোর ভাই বললেন, ‘আনন্দ কিংবা লোভনীয় শব্দ দুটির অর্থে তেমন কোন তফাৎ নেই বলেই আমি ধরে নিলাম। আচ্ছা, তুমি কি সকালের নাস্তা করেছো ?’

‘জি করেছি।’

‘আমি নিজের জন্য কিছু টোস্ট করতে যাচ্ছি। তুমি কি নিশ্চিত যে  খেতে চাও না ?’

‘না, আমি ঠিক আছি’ বললাম।

‘অন্তত একটা কফি তো পান করবে ?’

‘না, ঠিক আছি।’

আমি একটু কফি পান করতে পারতাম। কিন্তু আমার প্রেমিকার ভাইয়ের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাই না। যেহেতু সায়োকোও বাসায় নেই।

তিনি কোনও কথা না বলে উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কাপ-প্লেটের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি হাঁটুর উপরে হাত রেখে একেবারে সুবোধ বালকের মতো সোফায় বসে আছি। কখন আমার প্রেমিকা ফিরে আসে সে অপেক্ষায়। এখন ঘড়িতে সোয়া এগারোটা বাজে।

আমি আবারও স্মরণ করার চেষ্টা করছিলাম যে, আমার এগারোটায় আসার কথা ছিল কি না। তবে আমি যতই ভাবি না কেন, তারিখ এবং সময় যে ঠিক আছে আমি নিশ্চিত। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা গতকাল রাতেও কথা বলেছি। সায়োকো ভুলো মনের নয়, এমনও নয় যে সে কথার বরখেলাপ করে। তবে এটাও আশ্চর্যের, সে এবং পরিবারের সব সদস্য কেন তার ভাইকে একা রেখে রবিবারে বাইরে বেরিয়েছে।

আমি বিভ্রান্ত হয়ে ধৈর্য ধরে বসে আছি সেখানে। সময় যেন খুব ধীর গতিতে এগুচ্ছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নিত্য শব্দ। কল ছাড়ার শব্দ ভেসে আসছে কানে। চামচ দিয়ে কিছু মেশানো হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে রান্নাঘরের কাপবোর্ড খোলা-বাঁধার শব্দ। সায়োকোর ভাইটি এমন, যেন তিনি যাই করছেন তাতেই একটা শোরগোল করার প্রবণতা থাকতেই হবে। বাইরে কোনও বাতাস নেই। এমনকি কোনও কুকুরের ডাকও শোনা যাচ্ছে না। যেন অদৃশ্য কাদার মতো নীরবতা আমার কানে ঢুকে পড়ে কানের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। 

অসাধারণ কিছু গান ছিল তখন। ‘থিম ফ্রম এ সামার প্লেস’, ‘এডেল্যুইস’ কিংবা ‘মুন রিভার’ এরকম কিছু গান। আমি বাছাই করিনি। কারও বাড়িতে গেলে অনুমতি ছাড়া আমি রেকর্ডার চালু করতে পারতাম না। এমতাবস্থায় আশেপাশে কিছু খুঁজছিলাম, কিন্তু কোনও সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিন চোখে পড়ল না। আমার ব্যাগে কিছু আছে কি না খুঁজে দেখলাম। সাধারণত ব্যাগে একটি পত্রিকা রাখি, কিন্তু সেদিন নিতে ভুলে গিয়েছিলাম।

আমি আর আমার প্রেমিকা যখন অভিসারে যেতাম তখন, আমরা এমন ভান করতাম, যেন লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতে যাচ্ছি। বিষয়টিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ব্যাগে স্কুলসংক্রান্ত জিনিসপত্র ভরে নিতাম। অনেকটা অপেশাদার অপরাধীর ক্ষীণ অজুহাত তৈরি করার মতো। তো সেদিন আমার ব্যাগে ছিল স্কুলের ঐচ্ছিক পাঠ্য বই ‘জাপানি ভাষা ও সাহিত্য’। অনেকটা অনিশ্চয়তায় বইটি টেনে বের করে পড়তে থাকি। আমি তেমন পাঠক ছিলাম না, যেমন একজন মনোযোগী পাঠক প্রতিটি পৃষ্ঠায় মনোযোগ প্রয়োগ করে। আমি চেষ্টা করি, কঠিন কিছু পাঠ করা ছাড়া কীভাবে সময় পার করা যায়। আমি কখনই একাকী চুপচাপ বসে থাকতে পারতাম না। সব সময় বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো কিংবা গান শুনতে পছন্দ করি। যখন আশেপাশে কোনও বই দেখতে পেতাম না, তখন ছাপার অক্ষরে যা পাশে পেতাম তা-ই তুলে নিতাম হাতে। ফোনে আমি বাষ্পীয় আয়রণ ব্যবহারের একটি নির্দেশিকা পাঠ করতাম। তবে এ ধরনের পাঠের চেয়ে ঐচ্ছিক পাঠ্যবই ‘জাপানি ভাষা ও সাহিত্য’ অনেক ভালো ছিল।

আমি এলোমেলোভাবে বইয়ের গল্প-উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধগুলো উল্টেপাল্টে দেখতাম। কয়েকটি লেখা থাকত বিদেশি লেখকদের। বেশির ভাগ লেখা থাকত জাপানের বিখ্যাত ও আধুনিক লেখকদের রচনা, যেমন―রিনুসুগে আকোটাগুয়া, জুনিচিরো তানিজাকি, কুবু আবে এবং এমন আরও বেশ কয়েকজনের নাম বলা যায়। প্রতিটি রচনার সাথে যুক্ত থাকত কিছু উদ্ধৃতি কিংবা প্রশ্ন। তবে বেশির ভাগ প্রশ্নই ছিল অর্থহীন। অর্থহীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা কঠিন। বের করলেও তা আদৌ সঠিক কি না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এমনকি যারা প্রশ্ন নিয়ে আসে তারাও এর উত্তর জানে কিনা সন্দেহ। এভাবে চিন্তা করা যায়, ‘যুদ্ধের প্রতি লেখকের অবস্থান কী ?’ কিংবা লেখক যখন মোমের মতো ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের সৌন্দর্য এবং আড়াল হওয়ার বর্ণনা দেন, ‘তখন কীভাবে প্রতীকী আবহ তৈরি করেন ?’ আপনি এর যে কোনও উত্তর দিতে পারেন। বলতে পারেন মোমের মতো সুন্দর চাঁদের বর্ণনা তো বর্ণনাই। সেখানে কোনও প্রতীকী আবহ তৈরি করার প্রয়োজন নেই। কেউ বলবে না আপনার উত্তর ঠিক হয়নি। তবে আমি মনে করি অবশ্যই এর চেয়ে আরও যুক্তিসঙ্গত উত্তর রয়েছে। তবে সত্যিকার অর্থে আমি মনে করি না যে, যুক্তিসঙ্গত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই সাহিত্য পাঠ।

সে যাই হোক না কেন, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে আমি অনেক সময় নষ্ট করেছি। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, অধিকাংশ সময় আমার মনে এবং চিন্তায় এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করত। যেখানে কোনও কোনও প্রশ্নের উত্তর যুক্তিসঙ্গত না হলেও ভুল ছিল না। হয়তো এই প্রবণতাই ছিল স্কুলে আমার ফলাফলে বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটার অন্যতম কারণ।

আমার এসব সাত-পাঁচ চিন্তার মধ্যে আবার বসার ঘরে ফিরে এলেন আমার প্রেমিকার বড় ভাই। তার চুলগুলো তখনও লেপ্টে আছে মাথায়। সম্ভব সকালের নাস্তা করার কারণেই তার চোখে আগের মতো ঘুম ঘুম ভাব নেই। তার হাতে ধরা সাদা বড় মগ, যার গায়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি জার্মান প্লেনের ছবি, ককপিটে দেখা যাচ্ছে দুটি মেশিনগানের ছবি। এটা উনার বিশেষ মগ। আমার প্রেমিকা এমন একটি মগে পান করছে, তেমন কোনও ছবি তুলতে পারিনি।

‘তুমি কোনও কফি পান করতে চাও না ?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা নেড়ে বললাম, ‘না, আমি ঠিক আছি।’

তার সোয়েটারটি ছিল ব্রেড ক্রাম্বসে ভরা। সোয়েটারের কনুইও ছিল একই রকম। তিনি সম্ভবত ক্ষুধার্ত ছিলেন। টোস্ট খাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করেছেন, ফলে ব্রেড ক্রাম্বসগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমি বুঝতেই পারছি এমন পরিস্থিতি আমার প্রেমিকাকে বিরক্ত করে, কারণ সে সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। আমিও সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করি। আমাদের দুজনের এ বিষয়ে একই গুনো ছিল বলে আমি মনে করি।

তার ভাই দেয়ালের দিকে তাকালেন। দেয়ালে ঝুলছে একটি ঘড়ি। ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা বাজে।

‘সে তো এখনও ফেরেনি, ফিরেছে কি ? সে কোথায় যেতে পারে ?’

আমি উত্তর করি না।

‘তুমি কি পাঠ করছো ?’

‘আমাদের ঐচ্ছিক জাপানি পাঠ্য বই।’

‘হুম’ তিনি বললেন। ঈষৎ মাথা ঝুঁকে বললেন, ‘বইটি কি কৌতূহলোদ্দীপক ?’

‘ঠিক তেমন নয়, এ মুহূর্তে আমার কাছে পাঠের আর কিছু নেই।’

‘আমি একটু দেখতে পারি ?’

আমি বইটি তার নিচু টেবিলে দিলাম। তার বাম হাতে কফি কাপ, ডান হাতে বইটি নিলেন। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম বইয়ের উপর তিনি কফি ফেলেন কি না। কিন্তু না তেমন কিছু ঘটেনি। সশব্দে কাপটি রাখলেন টেবিলের ওপর। দুহাতে বইটি নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলেন।

‘তো, তুমি কোন অংশটি পাঠ করছিলে ?’

আকোটাগুয়ার গল্প ‘স্পাইনিং গিয়ার্স’ পাঠ করছিলাম। এখানে গল্পটির একটি মাত্র অংশ আছে, পুরোটা নেই।

একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন “আমি কখনো স্পাইনিং গিয়ার্স পাঠ করিনি। তবে আমি অনেক দিন আগে পাঠ করেছিলাম তাঁর গল্প ‘কাপা’। ‘স্পাইনিং গিয়ার্স’ গল্পটি কি বিমর্ষতায় পূর্ণ ?”

‘হুম ঠিক তাই। গল্পটি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে লিখেছিলেন আকোটাগুয়া।’ সে সময় তাঁর বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ। আমার পাঠের ঐচ্ছিক নোট মতে, ‘স্পাইনিং গিয়ার্স’ প্রকাশিত হয়েছিল আকোটাগুয়ার মৃত্যুর পর ১৯২৭ সালে। গল্পটি ছিল অনেটাই তাঁর শেষ জীবনের ইচ্ছেপত্র।

‘হুম’ আমার প্রেমিকার ভাই বললেন। ‘তুমি কি আমাকে গল্পটি পড়ে শোনাতে পারবে বলে মনে করো ?’

আমি তার দিকে বিস্ময়ে তাকালাম। ‘মানে আপনার জন্য উচ্চস্বরে পাঠ করতে বলছেন ?’

‘হুম। আমি সব সময় চাই কেউ যেন আমাকে পাঠ করে শোনায়। আমি ভালো পাঠক নই।’

‘আমিও উচ্চস্বরে পাঠ করাতে খুব একটা ভালো নই।’

‘তুমি খুব ভালো পাঠ করতে না পারলেও অসুবিধা নেই। তাতে আমি কিছু মনে করব না। শুধু ঠিকঠাক মতো ক্রমানুসারে পাঠ করলেই হবে। মানে, এমন নয় যে আমাদের অন্য কিছু করতে হবে।’

‘এটা কিছুটা স্নায়ুবিক ও হতাশার গল্প’ আমি বললাম।

‘কখনও কখনও আমি এমন গল্প শুনতে পছন্দ করি। অনেকটা, শয়তানের সাথে শয়তানের যুদ্ধ করার মতো।’

তিনি সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিমানখচিত কফির মগটি হাতে তুলে নিয়ে, এক চুমুক দিলেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন পাঠ শোনার জন্য।

সেই ছিল আমার প্রেমিকার উন্মাদ বড় ভাইয়ের জন্য আকোটাগুয়ার গল্প ‘স্পাইনিং গিয়ার্স’ পাঠ করে পার করা রবিবার। আমি প্রথমে তেমন আগ্রহবোধ করিনি। তবে পরে পাঠ করতে করতে কিছুটা আগ্রহী হয়ে উঠলাম। ঐচ্ছিক পাঠকদের জন্য গল্পের দুটো পর্ব ছিল―‘লাল বাতি’ ও ‘উড়োজাহাজ’―আমি শুধু ‘উড়োজাহাজ’ পর্ব পাঠ করেছি। পর্বটি ছিল আট পাতা দীর্ঘ। এর শেষ লাইনটি ছিল―‘এমন কেউ কি নেই, আমি ঘুমানোর সময় যে আমার শ্বাস রোধ করার চেষ্টা করবে ?’ এই লাইনটি লেখার পরেই নাকি আকোটাগুয়া আত্মহত্যা করেছিলেন।

আমি পাঠ শেষ করেছি, কিন্তু তখনও পরিবারের কোনও সদস্য বাড়িতে ফেরত আসেনি। একবারের জন্যও ফোন বেজে ওঠেনি, বাইরে কোনও কাক ডাকার শব্দও শোনা যায়নি। চতুর্দিকে সুনসান নীরবতা। শরতের সূর্যের আলো জানালায় ঝুলে থাকা জরির পর্দা ভেদ করে আছড়ে পড়ছে ঘরে। ধীর-স্থির সময় তার মতো এগিয়ে যাচ্ছে। আমার প্রেমিকার ভাই হাত ভাঁজ করে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন, আমি যেন পাঠ করছি চূড়ান্ত সেই লাইন―‘লেখালেখি করার কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই আমার। আমি যখন এমন অনুভব করি, তখন মনে হয় বেঁচে থাকা বড় বেদনাদায়ক। এমন কেউ কি নেই, আমি ঘুমানোর সময় যে আমার শ্বাস রোধ করার চেষ্টা করবে ?’

তুমি গল্পটি পছন্দ করো বা না করো, তবে একটি বিষয় পরিষ্কার ছিল যে, এমন উজ্জ্বল একটি রবিবার গল্পটি পাঠের জন্য উপযুক্ত ছিল না। বই বন্ধ করে আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। তখন ঘড়ির কাঁটা মাত্র দুপুর বারোটার ঘর পেরিয়েছে।

‘নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে’ আমি বললাম। ‘আমার চলে যাওয়া উচিত।’ আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে শুরু করলাম। ছোটবেলা থেকে আমার মা অনেকটা ঢোল পিটিয়ে আমাকে বলতেন, কারও বাসায় খাওয়ার সময় থেকে যেন বিরক্ত না করি। যে জন্যেই হোক আমার মার কথা ভালো লেগেছিল এবং আমি তা পালন করেছি, যা অনেকটা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। 

‘সেই দূর পথে তুমি এসেছ। কী হয় আর আধ ঘণ্ঠা অপেক্ষা করলে ?’ আমার প্রেমিকার ভাই জিজ্ঞেস করলেন। ‘এ সময়ের মধ্যে যদি সে না আসে তাহলে তুমি চলে যেতে পারো।’ তার কথাগুলোর মধ্যে কেমন একটা আবেদন ছিল। আমি কোলে হাত রেখে আবার সোফায় বসে পড়লাম।

‘তুমি উচ্চস্বরে খুব ভালো পাঠ করতে পারো’―তিনি বললেন। ওনার কথা বেশ ভালো লাগলো। ‘তোমাকে কি এ কথা আর কেউ বলেছে ?’

আমি মৃদু মাথা ঝাঁকালাম।

‘রচনার বিষয়বস্তু মন থেকে উপলব্ধি করতে না পারলে ভালো পাঠ করা সম্ভব নয়। শেষ অংশটা আসলেই খুব ভালো ছিল।’

‘ওহ’ আমি অস্ফুটস্বরে উত্তর দিলাম। মনে হচ্ছিল আমার চোয়ালজোড়া লাল হয়ে উঠছে। তার প্রশংসা একটু বেশিই মনে হচ্ছিল আমার। ফলে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলাম। তার মধ্যেও আরও আধঘণ্ঠা তার সাথে আমার কথা বলতে হয়েছিল। বিষয়টি এমন ছিল, কথা বলার জন্য তার কাউকে প্রয়োজন। আমাকে পেয়ে তাই ছাড়তে চাইছিলেন না। হঠাৎ প্রার্থনার ভঙ্গিতে তিনি হাত জোড় করে বলতে শুরু করলেন, ‘আমার এ প্রশ্নটি তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে। কখনও কি তোমার স্মৃতিশক্তি রোধ হয়েছিল ?’

‘রোধ ?’

‘আমি যা বলতে চাইছি তা হলো এমন যে, একটা সময় থেকে আরেকটা সময় পর্যন্ত তুমি কোথায় ছিলে কিংবা কী করেছিলে কিছুই মনে করতে পারছো না।’

মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘এমন আমার জীবনে কখনও হয়নি।’

‘তার মানে তুমি বলতে চাইছো ওই সময়ের মধ্যে একের পর এক কি করেছো সব তুমি মনে করতে পারো ?’

‘যদি সাম্প্রতিক সময়ের কোনও ঘটনা বা স্মৃতি শুনতে চান, তাহলে বলব আমার মনে আছে।’

‘হুম’ বলেই মাথার পিছনে হাত নিয়ে কিছুক্ষণ চুলকালেন। তারপর বললেন, ‘আমি মনে করি এটা স্বাভাবিক।’

আমি তার পরবর্তী কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। 

‘আসলে স্মৃতি হারানোর মতো ঘটনা আমার বেশ কয়েকবার হয়েছে। যেমন, বিকেল তিনটায় আমার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়। আবার যখন ফেরে তখন বুঝতে পারি সময় সন্ধ্যা সাতটা। আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না ওই মধ্যবর্তী চার ঘণ্ঠা সময় আমি কোথায় ছিলাম এবং কী করেছিলাম। এটা এমন নয় যে বিশেষ কিছু ঘটেছে। যেন আমি মাথায় আঘাত পেয়েছি কিংবা মতাল হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার কাজ করছি কিন্তু কোনও রকম উপসর্গ ছাড়াই স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছিল। আমি আগে অনুমান করতে পারি না, কখন এমন ঘটবে। এমনকি আমার কোনও ধারণা নেই যে এমন কতদিন, সপ্তাহ বা মাস চলবে। এমনও হতে পারে চিরতরে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারি।’

‘তাই’ বিড়বিড় করে বললাম, আমি তার কথা শুনছিলাম।

‘মনে করো, তুমি একটি টেপ রেকর্ডারে মোজার্টের একটি সিম্ফনি রেকর্ড করেছো। সেটি যখন আবার বাজাতে গেলে শুনলে লাফ দিয়ে দ্বিতীয় সিম্পনি থেকে বাজছে এবং তা লাফ দিয়ে আবার তৃতীয় সিম্ফনি থেকে বাজতে শুরু করল। এর মাঝখানে যা ছিল তা হারিয়ে গেছে। বিষয়টি এমনই ছিল। হারিয়ে গেছে বলতে আমি এমন বুঝাইনি যে, রেকর্ডারে শূন্য কোনও স্থান ছিল। যা ছিল তা মিলিয়ে গেছে। আমি কী বলছি বুঝতে পেরেছো ?’

আমি অনিশ্চিত স্বরে বললাম, ‘জি বুঝতে পেরেছি।’

‘যদি সঙ্গীত হয়, তাহলে তা কিছুটা অসুবিধাজনক। কিন্তু সে অর্থে খুব বেশি ক্ষতিকারক নয়। তবে এমন ঘটনা যদি তোমার বাস্তব জীবনে ঘটে, তাহলে অবশ্যই যন্ত্রণাদায়ক। বিশ্বাস করো তুমি বুঝতেই পারছো আমি কি বলতে চাইছি।’

আমি মাথা নাড়লাম।

‘তুমি চাঁদের অন্ধকার দিকটায় যাও, আবার ফিরে আসো খালি হাতে।’

আমি আবারও মাথা নাড়লাম। যদিও তিনি যে উপমা দিলেন তা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি কি না নিশ্চিত ছিলাম না।

‘এটা একটা বংশগত রোগ। কিন্তু আমার মতো এমন ঘটনা বিরল। কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে এক জনের এমন রোগ আছে। তারপরও সেখানে রোগের ভিন্নতা থাকতে পারে। জুনিয়র হাইস্কুলের শেষ বছরে মা আমাকে একজন নিউরোলজিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন।’

একটু বিরতি দিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, ‘অন্য কথায় রোগটি এমন যে, পুরো স্মৃতিশক্তি এলোমেলো হয়ে যায়। তোমার স্মৃতিশক্তি একটি ভুল খোপে লুকিয়ে আছে। যা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বা এমন যে তা কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এভাবেই চিকিৎসক আমাকে বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন। এটি তেমন মারাত্মক রোগ নয় যে আপনার জীবন সংহার হতে পারে, কেবল ধীরে ধীরে স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। যা প্রতিদিনের জীবন যাপনে সংকট তৈরি করতে পারে। চিকিৎসক আমাকে রোগের নাম বলেছেন এবং কিছু ট্যাবলেট দিয়েছিলেন। কিন্তু ঔষধে কোনও কাজ হয়নি। যা ছিল কেবল সান্ত্বনার ঔষধ।’

কিছুক্ষণের জন্য আমার প্রেমিকার বড় ভাই চুপ করে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন, তার কথা আমি বুঝেছি কি না। যদিও মনে হয়েছিল তিনি জানালা দিয়ে বাড়ির বাইরে তাকিয়ে আছেন।

বললেন, ‘আমি প্রতি বছর এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হই এক থেকে দুবার।’

‘সব সময় নয়। কতটুকু পর পর হয় তা কোনও বিষয় নয়। ঘটনা হলো তা যখন ঘটে তখন আমি প্রকৃত সংকট অনুভব করি। এমনকি তা যদি কম সময়ের জন্যও হয়। এভাবে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া এবং তা কখন ঘটবে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকা। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো বিষয়টি ?’

‘জি হ্যাঁ’ মৃদু স্বরে আমি বললাম। আমি তার এই অদ্ভুত ঘটনার বর্ণনা শুনছিলাম। প্রচণ্ড অগ্নিতপ্ত গল্প।

‘যেমন বলা যায়, হঠাৎ করে আমার স্মৃতি কেটে যায়। সেই স্মৃতিশূন্য সময়ে, পছন্দ করি না এমন কাউকে বিশাল হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করি। তুমি বলে এমন ঘটনা শেষ করতে পারবে না। এটা এতটাই বাজে, আমি ঠিক বলেছি ?’

‘আমি তা-ই বলতাম।’

‘আমি এই ঘটনা বললে বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসায় লেগে যাবে। বিষয়টা হলো আমার স্মৃতি কোথায় যেন উড়ে যায়। এ স্মৃতিশূন্যতা কি তারা নেবে আমার কাছ থেকে ?’

আমি মাথা নাড়ালাম।

‘সত্যি বলতে কি, কিছু মানুষ আছে যাদের আমি পছন্দ করি না। যারা আমাকে ছোটবেলায় প্রস্রাব করতে সহায়তা করেছে। তাদের মধ্যে আমার পিতা একজন। কিন্তু আমি আমার বাবার মাথায় কখনও আঘাত করব না, করব কি ? আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে স্মৃতিশক্তি লোপ পেলে কি করি তা হুশ থাকে না।’

কোনও মতামত জানানো ছাড়া আমি কেবল মাথা ঝাঁকাই।

‘ডাক্তার বলেছেন হঠাৎ স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া তেমন বিপজ্জনক কিছু না। এটা এমন না যে যখন আমার স্মৃতি লোপ পায় তখন কেউ আমার ব্যক্তিত্ব ছিনতাই করে। ডক্টর জ্যাকেল এবং মিস্টার হাইড-এর মতো। আমি সব সময় নিজেকে নিজে চালাই। এটা এমন যে, রেকর্ড করা বিষয়টি দি¦তীয় অংশ থেকে লাফ দিয়ে তৃতীয় অংশে চলে যায়। আমি সব সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম যে আমি কে, এবং বেশির ভাগ সময় আমি স্বাভাবিকভাবে কাজ করি। মোজার্ট কিন্তু হঠাৎ করে স্ট্রেভিনস্কিতে রূপ নেয় না। মোজার্ট সব সময় মোজার্টই থাকে। এটা ঠিক যে কোনও একটি অংশ কোথাও হারিয়ে গেছে।’

তিনি উঠে পড়েন এবং বাইপ্লেন কফি কাপে চুমুক দেন। আমিও একটি কফি পান করার ইচ্ছে পোষণ করি।

‘অন্তত ডাক্তার আমাকে যা বলেছেন। ডাক্তাররা যা বলেছেন দানাদার লবণের মতো তাই নিতে হবে। আমি যখন হাই স্কুলে পড়তাম তখন ভয় পেয়েছিলাম, আমি ভাবছিলাম, যখন জানতাম না আমি কী করছি, হাতুড়ি দিয়ে আমার এক সহপাঠীর মাথায় আঘাত করি। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, তুমি যখন হাই স্কুলে পড়তে তখন তুমি বুঝতে পারতে না তুমি কে, ঠিক আছে ? তার সাথে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার বিষয়টি যুক্ত করো, দেখবে তুমি সইতে পারবে না।’

আমি মৃদু মাথা নাড়ালাম, সম্ভবত তিনিই ঠিক। 

এসব কথা শোনার পর আমি স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকলাম। আমার প্রেমিকার ভাই চলে গেছেন। আমি বিষয়টি যতবার ভেবেছি ততবার ভয় পেয়েছি। নিজেকে টেনে কিছুতেই স্কুলে নিতে পারলাম না। মা শিক্ষককে আমার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করেন। যদিও তখনও আমার স্কুলে অনুপস্থিত থাকার তালিকা ভারী ছিল। শিক্ষকগণ আমাকে তারপরও পাস করিয়ে দিলেন, যা ছিল ব্যতিক্রম। সম্ভবত এমনও হতে পারে যে, স্কুল চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপদ বিদায় করতে। কিন্তু আমি কলেজে যাইনি। আমার রেজাল্ট একেবারে খারাপ ছিল না, তারপরও কোনও না কোনও কলেজে ভর্তি হতে পারতাম। কিন্তু বাইরে যাওয়ার মতো আত্মবিশ্বাস আমার ছিল না। তারপর থেকে আমি কেবল বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করতাম। কুকুরকে হাঁটাতে নিয়ে যেতাম। এছাড়া খুব কমই বাড়ি থেকে বের হতাম। আজকাল আমি আর আতংকিত হই না। এমন বোধ করলে, মনে করতাম আমি এখন কলেজে যেতে পারি।

তিনি নীরব বসে আছেন, আমিও। বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। এখন বুঝতে পারছি কেন আমার প্রেমিকা তার ভাই সম্পর্কে কিছু বলতে চায় না।

‘ধন্যবাদ আমার গল্প শোনার জন্য’―তিনি বললেন। ‘রিয়ানাসোকে আকোটাগুয়ার ‘স্পাইনিং গিয়ার্স’ চমৎকার গ্রন্থ। খুবই ঘোরলাগা গল্প, কোনও কোনও সময় এমন গল্পই আমার ভালো লাগে। তুমি কি আসলেই কফি পান করতে চাও না ? বেশি সময় লাগবে না, এক মিনিটেই করে দিতে পারি।’

‘না আমি ঠিক আছি। বরং আমার চলে যাওয়া উচিত।’

তিনি আবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন। ‘তুমি কেন একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাও না, যদি তারপরও কেউ না আসে তাহলে তুমি যেতে পারো। আমি উপরে নিজের রুমে আছি, ততক্ষণ তুমি নিজেই নিজের সাথে সময় কাটাও। আমাকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।’

আমি মাথা নাড়লাম।

‘সায়োকোর সাথে বাইরে যাওয়া কি খুব আনন্দের ?’ আমার প্রেমিকার ভাই আমাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা নেড়ে বললাম, ‘হুম আনন্দের।’

‘ওর সাথে কোন সময়টি তোমার ভালো লাগে ?’

‘সে অনেক মুহূর্ত আছে তার সাথে ভালো লাগার। এ মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলতে পারবো না।’ আমি সত্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম।

‘হুম’ একটু চিন্তিত স্বরে বললেন। ‘এখন তুমি যা বলেছো তা আমি দেখতে পাচ্ছি। সে আমার রক্ত সম্পর্কের ছোট বোন। আমরা একই ছাদের নিচে বসবাস করি তার জন্মের পর থেকেই। কিন্তু এখনও অজস্র বিষয় আছে তার, যা আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমি তাকে বুঝতে পারি না। জানি না কীভাবে তাকে বুঝবো। তাই তোমার কাছে অনুরোধ, চেষ্টা করো আমার হয়ে এ বিষয়গুলো কতটুকু বুঝতে পারো। যদিও কিছু বিষয় থাকে যা বের করার চেষ্টা না করা ভালো। ’

কফির কাপ হাতে নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

‘সে যাই হোক, তোমার কাছে অনুরোধ বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।’

তিনি আমার দিকে হাত ঝাঁকিয়ে বের হয়ে গেলেন।

‘ধন্যবাদ’ আমি বললাম।

তখনও কারও ফেরার লক্ষণ দেখা গেল না। আমি একা সম্মুখের দরজার দিকে গেলাম। জুতা পরে হাঁটতে শুরু করলাম। পাইন বনের ভেতর দিয়ে দ্রুত পা চালাই স্টেশনের দিকে। ট্রেনে চেপে বাড়ি পৌঁছাই। সেদিন অদ্ভুত শান্ত শরতের রবিবার বিকেল ছিল।

দুপুর দুইটার পর আমার প্রেমিকা ফোন করে। ‘কথা ছিল তুমি আগামী রোববার আমাদের বাসায় আসবে’―সে বলল। যদিও আমি তার কথায় সায় দিলাম না। তবে সে একেবারে নিশ্চিত ছিল যে তার কথা সত্যি। এক সপ্তাহ আগে তার বাড়িতে ভুলে চলে যাওয়ার জন্য নম্রভাবে ক্ষমা চাইলাম।

আমি তাকে বলিনি যে যতক্ষণ আমি ওর বাসায় ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছি, ততক্ষণ তার ভাইয়ের সাথে আলাপ করছিলাম। তবে আলাপ করছিলাম না বলে, শুনছিলাম বললেই সঠিক হবে। মূলত যাওয়ার পর থেকে আমি তার ভাইয়ের কথাই শুনেছিলাম। বুঝতে পারলাম, আমি যে রিওনোসুকে আকোটাগুয়ার ‘স্পাইনিং গিয়ার’ পাঠ করছি।

আঠারো বছর পর আবার দেখা আমার প্রেমিকার ভাইয়ের সাথে। সময়টি ছিল অক্টোবরের মাঝামাঝি। তখন আমার বয়স ছিল পঁয়ত্রিশ বছর। স্ত্রীকে নিয়ে টোকিও থাকি। কাজ আমাকে এত ব্যস্ত রাখে যে কোবে যাওয়ার সময়ই হয় না আমার।

পড়ন্ত বিকেল, আমি শিবাইয়া পাহাড়ের দিকে হাঁটছিলাম, মেরামত করতে দেয়া ঘড়ি আনতে। কিছুটা চিন্তামগ্ন আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। এ সময় কেউ একজন আমাকে ডাক দিলেন।

লোকটি বললেন, ‘মাফ করবেন’। অস্পষ্ট স্বরে তিনি বললেন। আমি দাঁড়ালাম। তার দিকে তাকালাম, কিন্তু চিনতে পারলাম না। লোকটি দেখতে আমার চেয়ে একটু বেশি বয়সী এবং লম্বা। তার গায়ে ছিল ধূসর রঙের মোটা জ্যাকেট ও গোল গলার গৌর বর্ণের কাশমিরি সোয়েটার ও বাদামি রঙের প্যান্ট। মাথার চুল ছিল ছোট করে ছাটা। দেখতে দৌড়বিদের মতই মনে হচ্ছিল। তার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য এলোমেলো মনে হলেও আকর্ষণীয়ই দেখাচ্ছিল। তাকে আমার সে মুহূর্তে সুদর্শনই মনে হয়েছিল। মনে হলো, উনি এমন একজন ব্যক্তি, যার জীবন নিয়ে কোনও অসন্তুষ্টি নেই। আমার অনুমান, তিনি অভিজাত বংশীয় একজন মানুষ হবেন।

‘আমি তোমার নাম মনে করতে পারছি না। তুমি এক সময় আমার ছোট বোনের প্রেমিক ছিলে না ?’ তিনি বললেন।

আমি তাকে ভালো করে দেখে চিনতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না।

‘আপনার ছোট বোন ?’

‘সায়োকো’ তিনি বললেন। ‘সম্ভবত হাইস্কুলে তোমরা একই ক্লাসে পড়তে।’

আমার চোখ আটকে গেল তার সোয়েটারের উপর টমেটো ক্যাচাপের ছোট্ট একটি দাগের ওপর। তিনি পোশাকে পরিপাটি ছিলেন, কিন্তু তার সোয়েটারের ছোট্ট সেই দাগ আমাকে কিছুটা বিচলিত করে তুললো। তখন আমার মনে পড়ল―ঘুমে ঢুলোঢুলো চোখ, ঢিলেঢালা গলার আকাশি-নীল শোয়েটারে ব্রেড ক্রাম্বস ছড়িয়ে থাকা সেই ভাই!

বললাম ‘এখন চিনতে পেরেছি। আপনি সায়োকার বড় ভাই। আপনাদের বাড়িতে একবার আমাদের দেখা হয়েছিল। ঠিক বলিনি ?’

‘ঠিক বলেছো। তুমি আমাকে আকোটাগুয়ার ‘স্পাইনিং গিয়ার’ পড়ে শুনিয়েছিলে।

আমি হাসলাম। ‘আমি বিস্মিত হচ্ছি মানুষের এই ভিড়ে আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন! বহুদিন আগে, তাও মাত্র একবারের জন্য আমাদের দেখা হয়েছিল।’

‘জানি না কীভাবে হলো। তবে আমি তোমার চেহারা ভুলিনি। তাছাড়া তুমি সেই আগের মতোই আছো। একটুও বদলাওনি।’

আমি বললাম, ‘আপনি কিন্তু অনেক বদলে গেছেন। আপনাকে দেখতে একেবারে আলাদা মনে হচ্ছে। আগের চেহারার সাথে কোনও মিল নেই।’

‘ঠিক―ব্রিজের তল দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।’ বলেই হাসলেন তিনি।

‘সায়োকো কেমন আছে ?’ জিজ্ঞেস করলাম।

হঠাৎ তিনি অস্থির দৃষ্টি হানলেন। ধীরে ধীরে শ্বাস নিলেন, আবার শ্বাস ছাড়লেন। যেন তার চারপাশে বিরাজমান বাতাসের ঘনত্ব মাপছেন।

‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে আমরা কোথাও গিয়ে বসে কথা বলতে পারি, যদি তোমার তেমন কোনও ব্যস্ততা না থাকে।’ তিনি বললেন।

বললাম, ‘আমার তেমন কোনও ব্যস্ততা নেই।’

‘সায়োকো মারা গেছে।’ তিনি শান্ত গলায় বললেন। আমরা একটা কফি দোকানের কাছেই ছিলাম। সেখানে গিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লাম।

‘মারা গেছে ?’

‘সায়োকো তিন বছর আগে মারা গেছে।’

আমি নির্বাক বসে থাকি। মনে হলো জিভটা মুখের মধ্যে ফুলে উঠছে। তাতে মুখের মধ্যে যে লালা জমে ওঠে তাও গিলতে চেষ্টা করে পারিনি।

সর্বশেষ আমার সাথে সায়োকোর যখন দেখা হয় তখন তার বয়স ছিল বিশের কোটায়। তখন সে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছিল। তার বাবার সাদা টয়োটা কার চালিয়ে আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল কোবের রোক্কো পাহাড়ে। তার গাড়ি চালানোর হাত তেমন ভালো ছিল না। তারপরও গাড়ি চালানোর সময় সে খুব উচ্ছ্বসিত থাকত। সম্ভবত সে সময় রেডিওতে বিটলসের একটি গান বাজছিল। গানটির কথা আমার বেশ মনে আছে। হ্যালো গুডবাই ইউ সে গুডবাই অ্যান্ড আই সে হ্যালো। সর্বত্রই তখন বিটলসের গানের ছড়াছড়ি ছিল।

আমি কিছুতেই মানতে পারছি না যে সায়োকো মারা গেছে এবং এই পৃথিবীতে নেই। আমি কীভাবে তা মেনে নেবো বুঝতে পারছিলাম না। পুরো ঘটনাটা পরাবাস্তব মনে হয়েছিল।

আমি শুকনো খটখটে কণ্ঠে  জিজ্ঞেস করলাম, ‘সায়োকো কীভাবে মারা গিয়েছিল ?’

খুব সাবধানে কথা বলার ঢঙে বললেন, ‘সে আত্মহত্যা করেছিল।’ ছাব্বিশ বছর বয়েসে সে যে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করত সেখানেরই এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছিল সায়োকো। তাদের দুটো সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে আত্মহত্যা করে বসে। তখন তার বয়স ছিল বত্রিশ।

‘বাচ্চাগুলোকে রেখে সে আত্মহত্যা করল ?’

আবার প্রাক্তন প্রেমিকার ভাই মাথা নাড়লেন। ‘বড়টি ছেলে আর ছোট মেয়ে। তার স্বামী সন্তানদের দেখাশোনা করে। আমি মাঝে মাঝে তাদের দেখতে যাই। বাচ্চা দুটো অত্যন্ত ভালো ও মায়াবী।’

এ ঘটনা যে বাস্তব তা মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। ছোট ছোট দুটো বাচ্চা রেখে আমার প্রাক্তন প্রেমিকা আত্মহত্যা করেছে ?

‘কেন সে এমন করল ?’

সায়োকোর ভাই মাথা ঝাঁকালেন। ‘কেউ জানে না কেন সে এ কাজ করল। সে কোনও সংকটে কিংবা মানসিক যন্ত্রণায় আছে তেমন কিছু কোনওদিন বুঝতে দেয়নি। তার শারীরিক, মানসিক অবস্থাও ভালো ছিল। স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল। সন্তানদের সে খুব আদর করত। আত্মহত্যা করার সময় সে কোনও নোটও রেখে যায়নি। চিকিৎসক তাকে ঘুমের বড়ি সেবন করতে বলেছিলেন। বড়িগুলো কিনে জমিয়ে একসাথে সব খেয়ে ফেলেছিল। তাতে করে বুঝা যায় সে আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিয়েছিল একটু একটু করে। ছয় মাস ধরে সে বড়িগুলো জমায় এবং একসাথে খেয়ে ফেলে। এটা আকস্মিক কোনও আবেগ ছিল না।’

কিছু সময়ের জন্য আমরা দুজন চুপচাপ বসেছিলাম। আমরা দু’জনই চিন্তারহিত হয়ে পড়ি। 

একদিন, রোক্কো পাহাড়ের উপরে একটি ক্যাফেতে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি যাচ্ছি টোকিওতে একটি কলেজে পড়তে। সেখানে একটি মেয়ের সাথেও আমার সম্পর্ক হয়েছে। আমি তাকে সব বলেছিলাম। সে কোনও কথা বলেনি। ব্যাগটি হাতে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। একটি বারের জন্যও আর পিছনে ফিরে তাকায়নি।

আমি ক্যাবল কারে করে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নেমে আসি একা। সে নিশ্চয়ই সেই সাদা টয়োটা কার নিয়ে বাড়ি ফিরবে।

সে দিনটি ছিল অত্যন্ত রৌদ্রোজ্জ্বল। আমার মনে আছে গন্ডোলার জানালা দিয়ে আমি পরিষ্কার পুরো কোবে শহর দেখলাম। তা ছিল অবিশ্বাস্যরকম সুন্দর দৃশ্য।

সায়োকো কলেজে গেল, চাকরি পেলো বড় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। এক সহকর্মীকে বিয়ে করেছিল। দুটো সন্তানও হলো। কিন্তু জমিয়ে ঘুমের বড়ি সেবন করে আত্মহত্যা করল।

তার সাথে আগে পরে আমার সম্পর্ক ছিন্ন করতেই হতো। এখনও তার সাথে কাটানো অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে আমার। সে আমার প্রথম প্রেমিকা ছিল। তাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। সে-ই আমাকে মেয়েদের শরীর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করেছিল। আমরা একসাথে নতুন সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। অনেক অসম্ভব রকম সুন্দর ও উপভোগ্য সময় অতিবাহিত করেছি আমরা। যা কেবল টিনেজ বয়েসেই করা সম্ভব।  

তবে বলতে কষ্ট হয় যে, সে আমার কানে কখনও আবেদনের ঘণ্টা বাজাতে পারেনি। আমি খুব চেষ্টা করতাম শুনতে, কিন্তু  সে আবেদন তৈরি করতে পারেনি। দুঃখজনক। টোকিওতে আমি একটি মেয়েকে চিনতাম, সে আমার মধ্যে সেই আবেদন তৈরি করতে পেরেছিল। বিষয়টি এমন নয় যে যুক্তি কিংবা নৈতিকতা অনুসারে তুমি বেছে নিতে পারবে। হয়তো এমনটি হতেও পারে, নাও হতে পারে। যদি হয়, তোমার চেতনা বা আত্মার গভীরে তা নিজের ইচ্ছেয় হয়।

‘জানো’, আমার সাবেক প্রেমিকার ভাই বললেন, ‘আমার মনে একবারও আসেনি যে সায়োকো আত্মহত্যা করতে পারে। এমনকি সারা পৃথিবীর মানুষ যদি নিজেকে খুন করে, আমি ভেবেছিলাম ভুল করে যে, সে বেঁচে থাকবে এবং ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি তাকে মোহভঙ্গের কষ্টে কাতর কিংবা মনের মধ্যে কষ্ট লুকিয়ে রাখার মতো চেহারায় দেখিনি। সত্যি বলতে কি আমি ভাবতাম সে খুব চিন্তামগ্ন গভীরতার মেয়ে নয়। আমি কখনই তার প্রতি মনোযোগী ছিলাম না। হয়তো আমরা দু’জন একই অনুভূতিপ্রবণ ছিলাম না। আমি কিন্তু আমার অন্য বোনের সাথে খুব স্বচ্ছন্দ ছিলাম। তবে, এখন মনে হয়, আমি সায়োকোর সাথে ভীষণ অন্যায় করেছি। সম্ভবত আমি তাকে কখনই বুঝতে পারিনি। তার সম্পর্কে কখনও কিছুই বুঝতে পারিনি। হয়তো আমি নিজের জীবন নিয়েই খুব ব্যস্ত ছিলাম। হয়তো আমার মতো কারও তাকে বাঁচানোর মতো ক্ষমতা ছিল না। আমার উচিত ছিল তার সম্পর্কে কিছু বোঝা, তা খুব বেশি কঠিন ছিল না। এখন এ যন্ত্রণা বহন করা খুব কষ্টের। আমি অত্যন্ত অহংকারী এবং আত্মকেন্দ্রিক ছিলাম।’

আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমিও সম্ভবত তাকে বুঝতে পারিনি। ওর ভাইয়ের মতো আমিও নিজের জীবন নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলাম।

আমার সাবেক প্রেমিকা সায়োকোর ভাই বললেন, “আকোতাগুয়ার ‘স্পাইনিং গিয়ার’র যে গল্প তখন তুমি আমাকে পাঠ করে শোনাচ্ছিলে সেখানে একটি অংশ আছে এমন যে, কীভাবে একজন পাইলট আকাশে-বাতাসে ভাসতে ভাসতে শ্বাস নেয়, কিন্তু এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আর শ্বাস নিতে পারে না…এরা একে বলে ‘বিমানের রোগ’। আমি জানি না এটি সত্যিকারের রোগ কি না, তবে লাইনগুলো আমার এখনও মনে আছে।”

‘আপনি কি সেই পরিস্থিতি অতিক্রম করেছেন ? মানে মাঝে মাঝে আপনার যে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যেত ?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমার মনে হচ্ছে, আমি সায়োকোবিষয়ক আলোচনা থেকে সরে যেতে চাচ্ছি।

‘ও হ্যাঁ।’ বলেই তিনি বাঁকা চোখে তাকালেন। এটা অদ্ভুত একটি ব্যাপার, সেই রোগটি সেরে গেছে। এটি ছিল বংশগত রোগ। ডাক্তার বলতেন ক্রমান্বয়ে এ রোগ আরও বাড়বে। কিন্তু না, রোগটি নিজে থেকেই মিলিয়ে গেল, যেন কখনই আমার সে ধরনের কোনও রোগ ছিল না। যেন কোনও অশুভ শক্তিকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।

‘শুনে খুব খুশি হলাম’ আমি বললাম।

‘তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর আমার সেই সমস্যা আর ছিল না। তারপর থেকে আমার স্মৃতি হারানোর মতো কোনও ঘটনা আর ঘটেনি, এমন কি একবারের জন্যও না। আমি অত্যন্ত প্রশান্ত মনে মাঝ পথেই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে আমার বাবার ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব নিই। তা নিয়ে কিছু সময় ব্যস্ত ছিলাম। এখন আমি একেবারে সাধারণ জীবন যাপন করি।’

‘শুনে খুব ভালো লাগলো’ আমি বললাম, ‘তো আপনি হাতুড়ি দিয়ে আপনার বাবার মাথায় আঘাত করেননি ?’

‘তুমি বাজে একটি ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছো, তাই নয় কি ?’ তিনি বললেন। বলেই উচ্চ স্বরে হাসতে লাগলেন। ‘তুমি নিশ্চয়ই জানো, ব্যবসার কাজে টোকিওতে সাধারণত খুব বেশি আসা হয় না আমার। বিশাল এই শহরে তোমার সাথে আমার ধাক্কা খাওয়ার বিষয়টি অদ্ভুত মনে হচ্ছে। তবে এটা অনুভব করতে পারি যে, কিছু একটা আমাদের এখানে একত্র করেছে।’

‘নিশ্চয়ই’ আমি বললাম।

‘তো তোমার সম্পর্কে বলো ? তুমি কি সব সময় টোকিওতেই ছিলে ?’

‘গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরপরই আমি বিয়ে করি’ তাকে বললাম। ‘তখন থেকেই আমি টোকিওতে বসবাস করে আসছি। আমি এখন একজন লেখক হিসেবে কাজ করছি।’

‘লেখক ?’

‘জি’।

‘ভালো। তুমি উচ্চ স্বরে বই পাঠে খুব ভালো ছিলে।’ তিনি বললেন, এ কথা বললে তোমার কাছে বোঝা মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য কথা বলতে কি সায়োকো তোমাকে খুব ভালোবাসতো।

আমি কোনও উত্তর দিইনি। আমার সাবেক প্রেমিকার বড় ভাইও আর কোনও কথা বললেন না।

আমরা বিদায় নিলাম। আমি ঠিক করতে দেওয়া ঘড়ি নিতে গেলাম। আর আমার সাবেক প্রেমিকার বড় ভাই পাহাড় বেয়ে সিবাইয়া স্টেশনের দিকে হেঁটে গেলেন। ভিড়ের মধ্যে তার পশমি জ্যাকেটে আঁকা ছবিটি যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল।     

তার সাথে আমার আর কখনও দেখা হয়নি। ভাগ্য আমাদের দ্বিতীয়বার এক জায়গায় করেছিল। প্রায় বিশ বছর পর, তিনশ মাইল দূরের শহরে, একটি কফি শপে মাঝখানে টেবিল রেখে, দুজন, দুই পাশে বসে কফি পান করতে করতে কিছু বিষয়ে কথা বললাম। তবে কফি পানরত আমরা যেসব কথা বলেছিলাম তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু সেখানে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল যা আমাদের জীবন যাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। তবে, তা  নিছক ইঙ্গিতে বলা হয়েছিল। সেখানে জৈব কিংবা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আমাদের সংযোগ করার কিছুই ছিল না।

(প্রশ্ন : এই দুই ব্যক্তির জীবনের কোন বিষয়গুলি প্রতীকীরূপে তাদের দুটি সভা এবং কথোপকথনে উপস্থাপিত হয়েছিল ?)

আমি সেই মায়াবী মেয়েটিকে আর দেখিনি। যে ‘উইথ দি বিটলস’-এর লং প্লে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মাঝে মাঝে আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি―মেয়েটি কি এখনও সেই ১৯৬৪ সালের স্কুলের আবছায়া হলওয়েতে তাড়াহুড়ো করে নেমে যাচ্ছে ? নেমে যাওয়ার সময় তার স্কার্টের পাড় দোলা দিয়ে যাচ্ছে ? এখনও জন, পল, জর্জ এবং রিঙ্গোর অর্ধ আলোকিত ছবির সাথে অ্যালবামের সেই দুর্দান্ত কভারটি আঁকড়ে ধরে রেখেছে, যেন এর উপরই নির্ভর করছে তার জীবন! 

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button