অনুবাদ গল্প : দেহেইশা ক্যাম্পের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে

মূল : মোহামেদ আলি তাহা
বাংলা অনুবাদ : ছন্দা মাহবুব
[মোহামেদ আলি তাহা (জন্ম : ১৯৪১ সালে, আক্রের মিয়ার-এ) একজন ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার, শিশুসাহিত্যিক এবং ব্যঙ্গ রচনা লেখক। তিনি গালিলি অঞ্চলের একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও পরিচিত। ১৯৭০-এর শেষের দিকে তিনি ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট ফর পিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি―ডিএফপিই নামক সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। ডিএফপিই আরব এবং ইহুদিদের বাম সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি ফিলিস্তিনে আরব জনগণের জন্য ‘ন্যাশনাল আকর্ড’ কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। একাধিকবার তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৯৮৩ সালে, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁর গল্পসংগ্রহ ‘আ রোজ ফর মাই আইজ, হাফিজা’(A Rose for My Eyes, Hafiza) বাজেয়াপ্ত করে এবং তাকে গ্রেফতার করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে―For the Sun Rise (1964), A Bridge Over Sad River (1974), To be in the coming Era (1989)]
প্রাচীন এক জলপাই গাছের গুঁড়িতে বসেছিলাম। বাড়ির সকলের সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ। কাপ, প্লেট আর চামচগুলো ঘষে ঘষে ধোয়া শুরু করলাম। বাড়ির পিছনের উঠানে এভাবে বসে থাকা এখন আমার প্রতিদিনের কাজের একটা অংশ। আকাশে জ্বলজ্বলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। শরতের মিষ্টি রোদ শরীরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল আমার। আলতো হাতে প্লেটে তাল দিয়ে আমি গুনগুন করে গাইছিলাম মার্সেল খালিফের গান।১ ভেজা হাত বুলিয়ে নিলাম বুকের জোড়া কবুতরের উপর আর একবার মাথা তুলে দেখে নিলাম শরতের জ্বলজ্বলে সূর্য। তার কাছে বোতলটা দেওয়ার সময় সে আমাকে বলেছিল, ‘আমি সূর্যটা তুলে এনে তোমার ফুলদানিতে রেখে দিব।’
সবকিছুই এই ছেলের কথা শোনে, কিন্তু সব থেকে বেশি কথা শুনে তার জিভ। সুন্দর সুন্দর কবিতার ভাষায় সে আমাকে কঠিন দুনিয়া থেকে বাঁচিয়ে তোলে আর খুব গভীরে জীবনের প্রতি এক নতুন ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে। সে কি জানে? আমাদের বাসায় যে একটিমাত্র ফুলদানি আছে সেটা খুবই সাধারণ, স্কুলের আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস ক্লাসে আমি বানিয়েছিলাম, আর যে ফুলদানি কি না নার্সিসাস, অ্যানিমোনির মতো কিছু বুনোফুল ছাড়া অন্য কোনও ফুল দেখেনি, চেনে না।
ক্যাম্পের মানুষেরা ফুল কেনে না। কোনও বিবাহবার্ষিকী কিংবা জন্মদিনেও তারা ফুল উপহার দেয় না। আমার বাবা-মা হয়তো ভুলেই গেছেন কবে তাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল। আর আমার জন্মদিন কখনও উদযাপন করা হয়নি। জন্মদিন আমাদের মতো ক্যাম্পের ছেলেমেয়েদের জন্য একটা বিলাসিতা, যা পূরণ করার সামর্থ্য আমাদের নেই।
কবে আমাদের একটা বাড়ি হবে? যেমন বাড়ি সকলের থাকে, যেমন বাড়ি আমি শহরে দেখি, যেমন বাড়ির কথা আমি বইয়ে পড়ি। কেন আমার নিজের একটা ঘর নেই―বিছানা, বালিশ আর পর্দা টানানো জানালাসহ? সন্ধ্যার সময় যে জানালার পর্দা সরিয়ে আমি রুপালি চাঁদের সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলব। কেন একটা বাড়ি হবে না আমাদের, নিজেদের একটা রান্নাঘরসহ, গরম পানির ট্যাপ আর একটা মার্বেলের সিংক যেখানে আমি কাপ-প্লেট ধুয়ে সুন্দর সাজিয়ে রাখতে পারব? সে আমাকে বলেছিল, ‘আমি সূর্যকে তুলে এনে তোমার ফুলদানিতে রেখে দিব!’
সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোমার বাবা কী করে?’
‘তিনি বাড়ি বানান তাদের জন্য।’
‘কেফার সাভাতে২ নাকি তেল আবিবে?’
‘দু জায়গাতেই। কিরিয়াত আরবাতেও।৩’
সে আমার দিকে তাকাল। আমার খুব লজ্জা করছিল। কেন, বাবা, তোমাকে তাদের জন্য বাসা বানাতে হবে? ওরা আমার বন্ধু নাজওয়ার বাসা গুড়িয়ে দিয়েছে, আর রুটির দোকানি হাসান আল-ফারানের বাসাও। কিন্তু সে আমাকে আমার লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার বাবা তাদের জন্য সবজি লাগায়, দেখভাল করে। ফসল তোলার কাজও তিনি করেন।’
স্কুলে ক্লাস শেষ হয়ে গেলে আমরা সকলে মিলে খেলতাম, এই যেমন ছেলের দল আর মেয়েদের দল, আরও অনেক রকমের মজার মজার খেলা।
ছেলেটি খুব ভালো করেই জানত সে কী করছে। সে জানত কীভাবে আমাদের নেতৃত্ব দিতে হবে । আর জানত কীভাবে আমাদের আস্থা আর ভালোবাসা জিতে নিতে হবে।
সে বলেছিল, “চলো ‘সেনাবাহিনী আর দেশপ্রেমিক’ খেলা খেলি।”
নতুন খেলা ছিল সেটা। আমরা কিছুই জানতাম না, কখনও শুনিওনি এই খেলা সম্পর্কে। কিন্তু কেউই আপত্তি করল না।
সে আমাদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলল। এক দল দখলদার সেনাবাহিনী আরেক দল দেশপ্রেমিক। সে ছিল দেশপ্রেমিক দলের নেতা আর আমি সেনাবাহিনী দলের নেতা।
গলার স্বর সর্বোচ্চ উঁচুতে তোলে, ভারী গলায় আমি চিৎকার করে উঠলাম, ‘রাস্তা ফাঁকা করো!’ তারপরে আমি মিলিটারি গাড়ির মতো গর্জন করতে শুরু করলাম। আসলে, ঠিক করে বলতে গেলে, আমি ষড়ভুজাকৃতি তারা৪ চিহ্নিত গাড়ির মতো হিসহিস শব্দ করছিলাম।
আমি হাঁটছিলাম, আমার দল আমাকে অনুসরণ করছিল। আমি শব্দ করছিলাম আর কাল্পনিক বন্দুক থেকে গুলি করছিলাম। তারপর আমি হিব্রু ভাষায় চিৎকার করে উঠলাম,
‘জেরুজালেম?
―আমাদের,
বেথেলহেম?
―আমাদের,
হেব্রন?
―আমাদের,
জেরিকো?
―আমাদের,
আরবদের জন্য?
―শুধু মরুভূমি।’
বৃষ্টির মতো পাথর উড়ে এল আমাদের দিকে। আমরা, আমার দল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলাম। আমি কাছের একটা বাসার বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। তাকিয়ে দেখলাম আমাদের বন্ধু সামি একটা বাসার দেয়ালের পিছনে আশ্রয় নিয়েছে। ‘সাবধান বন্ধু, পাথর কিন্তু চোখে দেখে না।’ কিছুটা মজা করে ওকে খোঁচা দিয়েই কথাটা বললাম।
‘আমাকে বললে? আমি মোটেই ভয় পাইনি।’ সে উত্তর দিল।
ভীতু সামি দেখতে দেখতে এই খেলার মাস্টার হয়ে উঠছিল। হঠাৎ সে ব্যথায় চিৎকার করে উঠল, ‘আমার মাথা, আমার মাথা!’
বুঝতে পারলাম আঘাত পেয়েছে। দৌড়ে গেলাম তার দিকে। রক্তের লাল ধারা মুখের উপর দিয়ে চিকন বাঁকা রেখায় নামছিল। আমাকে দেখার সাথে সাথে বলে উঠল, ‘আমাদের বলল এটা একটা খেলা, সাবিত তো একে সত্যি বানিয়ে ফেলল।’
এরপর যখনই সামির সাথে আমার দেখা হতো, আমি কথা শুরুই করতাম, ‘আমাদের বলল এটা একটা খেলা, সাবিত তো একে সত্যি বানিয়ে ফেলল!’ এই বলে। এই কথায় খুব ক্ষেপে যেত সামি, আর আমিও হাসতে হাসতে বলতাম, ‘ঠিক কাজই হয়েছে, তুমি তো দখলদার বাহিনী।’ সামি আরও ক্ষেপে গিয়ে আমাকে মারতে আসত, আমি দৌড়াতাম, সামিও তাড়া করত পিছন পিছন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘কখন?’
সে বলেছিল, ‘যখন চালাক আল-শাতির হাসান ভয়ংকর রাক্ষসগুলোকে হত্যা করবে।৫’
আমি বাসায় ফিরে মনে মনে ভাবছিলাম তার চুল, তার চোখ, তার নাক। আর ছবি আঁকলাম চালাক আল-শাতির হাসান এক রাক্ষসের বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে! ছবির এক কোনায় বসিয়ে দিলাম জ্বলজ্বলে একটা সূর্য আর একটা বাড়ি… আর… থাক আমি না-হয় নাই বলি। ভেবে নাও কী?
‘যদি তোমার পা শিকলে বেঁধে ফেলে?’
‘আমি স্বীকার করব না।’
‘যদি তোমাকে বরফ ঠান্ডা পানির নীচে চেপে ধরে?’
‘আমি স্বীকার করব না।’
‘যদি ইলেক্ট্রিকের শক দেয়?’
‘আমি স্বীকার করব না।’
‘যদি তোমার চোখের পাপড়ি একটা একটা করে টেনে ছিঁড়ে ফেলে?’
‘উহ! আমি স্বীকার করব না।’
‘যদি তোমার আঙ্গুলের নখ টেনে তুলে ফেলে?’
‘উহ! উহ! আমি স্বীকার করব না।’
‘যদি তোমার পিছন দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে দেয়?’
‘না, না, আমি কক্ষনো স্বীকার করব না।’
‘যদি তারা তোমার উপরে সব ধরনের সাভাক পদ্ধতি৬ ব্যবহার করে?’
‘আমি স্বীকার করব না।’
‘আর কী বাকি রইল? আমি ভুলে গেছি। কিছু কি আর বাকি আছে?’
সে হেসে বলেছিল, ‘আর সিআইএ?’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর সিআইএ?’
সে শান্তভাবে উত্তর দিল, ‘আমি স্বীকার করব না।’
আমি তার চিবুকের দিকে তাকালাম। কল্পনা করলাম তার চিবুকে দাড়ি, ঠিক চে গুয়েভারার মতো। আমার ইচ্ছে করছিল তাকে চুমু দিতে। মনের ভিতরে কিছু একটা নাচছিল।
সাবিত পুরুষ।
সাবিত স্বীকার করবে না।
আর এই খেলা, আমার ভালো লাগে না, এই খেলা মন খারাপ করা, বিষণ্ন।
খুব ধীরস্থিরভাবে সে বলেছিল, ‘আবলা, জোন-১ এর খেয়াল রাখবে, আমি মসজিদ থেকে ফালাফেলওয়ালা৭ পর্যন্ত খেয়াল রাখব। সামিহা বাজার এলাকায় থাকবে। সামি আল-সায়াগ রাস্তা খেয়াল রাখবে। সবকিছু খুব দ্রুত করতে হবে। কোনওভাবেই কারও সাথে তর্ক বা ঝগড়া করা ঠিক হবে না। আমরা ঠিক দশটায় আল-ফুকা গলির চৌরাস্তায় এক হব। আর সামি তুমি তোমার বলটা নিয়ে আসবে!’
আমরা দ্রুত সরে পড়লাম।
আমার মনে হচ্ছিল হঠাৎ করেই আমি যেন বড় হয়ে গেছি। আমি, সামিহা, আদেলের কন্যা, একজন সংগ্রামী ফেদায়ি, যে কিনা দখলদার সেনাবাহিনী―তাদের অফিসার, সৈনিক, ট্যাংক, বিমান, রকেট সবকিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, একটা নতুন ভোর আনার জন্য। যদি এইসব নির্দেশনা এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার দরকার না হতো, তাহলে হয়তো আমি রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে লাফাতে লাফাতে বলতাম―‘দখলদারী নিপাত যাক!’ আমি মনে মনে দেখতে পাচ্ছিলাম, পোস্ট অফিসের চূড়া থেকে চার রঙের পতাকা পতপত করে উড়ছে… আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম আমার ক্লাসের বন্ধুরা স্কুলের উঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে, ‘আমার মাতৃভূমি! ও আমার মাতৃভূমি!’
আমি প্রথম দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনজন কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে। দোকানদার প্রায় আমার বাবার বয়সী। (আমার বাবা আমাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য তাদের বাড়িঘর বানিয়ে দেয়।) দোকানদারের ফর্সা মুখ লালচে দেখাচ্ছে, কপালের উপর সাদা চুল গুছিয়ে আঁচড়ানো। তার পোশাক বেশ মার্জিত, পায়ের জুতা মাথার চুলের মতো চকচক করছে।
প্রথম ক্রেতা চলে গেল। ‘নারী আর পুরুষের জন্য রেশমি এবং পশমি উলের পোশাক। আমরা শুধু আল্লাহর উপরই আস্থা রাখি। অভিযোগ এবং কিস্তিতে পরিশোধ বাঞ্ছনীয় নয়। সততাই আমাদের নীতি।’ আমি হাসলাম; নিশ্চয়ই বিশাল লাভ করে সে এখান থেকে। ক্রেতারা কেউ দর কষাকষি করছে না, দাম সব নির্ধারিত। দ্বিতীয় ক্রেতাও বেরিয়ে গেল। দোকানি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, যেন মাত্রই আমাকে খেয়াল করেছে। আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছিল আমি এই দামি পোশাকগুলো কিনব? কেন এই পোশাকগুলো আমার কেনা হবে না? এই যে হালকা মিষ্টি মেরুন রঙের ভেলভেট জামাটা, এই জামাটা তো আমাকে দারুণ মানাতো। সাবিত! আহ, সাবিত। কেন আমি এই জামা কিনতে পারব না? কিনব? আমি… ঠিক আছে, ঠিক আছে, কেন এই জামা কেনার সামর্থ্য আমার হবে না?
‘এই যে বালিকা, তোমার কোনটা পছন্দ?’
দিবাস্বপ্ন ভেঙে আমি জেগে উঠলাম। তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে আমাদের কথা জানালাম। তিনি আমাকে দেখলেন, তারপর খুব শংকিতভাবে আমার দিকে তাকালেন অথবা খুশির চোখে। তারপর তিনি বললেন, ‘দেশের জন্য, বিপ্লবের জন্য, আমরা আমাদের জীবন বাজি রাখতেই পারি!’
আমি দোকান থেকে বের হয়ে দ্রুত পাশেরটায় চলে গেলাম। অপেক্ষা না করেই ফিসফিস করে দোকানির কানে কানে কথাগুলো বলে উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই চলে গেলাম। পরেরটায় ঢুকলাম, বের হলাম; ঢুকলাম, বের হলাম।
লোহার দরজাগুলোতে আবার তালা লাগানো হয়েছে।
আমার মনে হলো আমার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে।
স্কুল গেটের সামনে আমরা তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সে এল ব্যাগভর্তি পিঁয়াজ নিয়ে। সকলের জন্য একটা করে পিঁয়াজ, আর এইটা তোমার জন্য সামিহা। নিজের বাসায় লাগানো পিঁয়াজ। টায়ারগুলো সব রেডি, সামি এগুলোকে পোড়াবে। আর বুলেট? সেজন্য আছে আমাদের এই উপত্যকা। মসৃণ আর নিরেট পাথরে ভরা।
‘ভালো করে নিশানা করো ছেলেরা।’ সব থেকে নাজুক অঙ্গ হচ্ছে চোখ আর কানের আশেপাশের অংশ। আর নাক, সেটা? আমি একবার এক সৈনিকের নাকে আঘাত করেছিলাম, লাটিমের মতো ঘুরে গিয়েছিল সে। সেই সময় আমার মনে পড়েছিল আমাদের জ্যোতির্বিদ্যার শিক্ষক তাহসিনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন পৃথিবী কেন তার নিজের চারপাশে ঘোরে? তাহসিন উত্তর দিয়েছিল, ‘কারণ সে বোকা।’
সামরিক দখলদারিত্ব বোকামি। নিজের চারপাশেই ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় অজ্ঞান হয়ে যাবে। পড়ে যাবে। বৃষ্টি পড়বে তারপর, রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারপর সূর্য উঠবে আর সাবিত সূর্য তুলে এনে আমার ফুলদানিতে রাখবে। আর আমরা একটা বাড়ি বানাবো, মার্বেলের সিংক থাকবে, জানালা আর বিছানাসহ একটা ঘর থাকবে, জানালায় পর্দা থাকবে, আর রূপালি চাঁদ।
সে তার শার্ট খুলে ফেলল।
কী এক ছেলে সে! দুর্দান্ত ছেলে এক। নিজের শরীরে চার-রঙা পতাকা জড়িয়ে নিল। যেন এটাই তার পোশাক। শার্ট পরে নিল এর উপরে। তারপর মাথা উঁচু করে হেঁটে গেল। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল উপরে। স্কুল বিল্ডিং-এর উপরে পতাকা উড়ল পতপত করে।
তোমার উপর শান্তি নেমে আসুক!
আমাদের হৃদয় তোমার সাথে।
পাঁচ সৈনিকসহ একটা গাড়ি এগিয়ে এল।
…সামিহার মতে, সাবিতের মতে, দেহেইশা ক্যাম্পের প্রাথমিক স্কুলের ইতিহাস শিক্ষকের মতে, যিনি বলেছিলেন, ‘জেনে রাখো, আইন জালুতেই হালাকু খানের সমাপ্তি হয়েছিল…৮’
জ্বলন্ত টায়ার দিয়ে ব্যারিকেড বানানো হয়েছিল।
আমি একবার আমার বাসার উঠোনে একটা চকরাবকরা সাপ দেখেছিলাম। ভয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম। আমার বাবা এসে সারা উঠোন খুঁজেও আর সাপটাকে পায়নি, পরে তিনি কিছু রাবারের টায়ার পুড়িয়েছিলেন। জ্বলন্ত টায়ার সাপদের দূরে রাখে।
মিলিটারির গাড়িটা থেমে গেল। দুজন সৈনিক বের হয়ে এল রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য। পাথর পড়া শুরু হলো চারপাশ থেকে।
পাথরের বৃষ্টি হোক। ওহ দুনিয়া, চারপাশ থেকে পাথর পড়ুক।
বুলেট গর্জে উঠল।
দেয়াল ভেঙে ফেলল।
গ্যাস স্প্রে করল।
আমার পকেটে বাড়িতে লাগানো পিয়াজটা আমি ছুঁয়ে দেখলাম।
তারা স্কুল বন্ধ করে দিল আর একটা জেলখানা খুললো।
প্রিয়, আমার প্রিয় ফিলিস্তিন। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমার জন্যই বাঁচি। আমি রাবার টায়ার জ্বালিয়েছিলাম আর সৈনিকদের দিকে পাথর ছুড়ে মেরেছিলাম, যেন তুমি আমার হতে পারো, শুধু আমার, আমার। আমি তোমার ফিলিস্তিন, আর তুমি আমার। আমি তোমাকে সবকিছুর মধ্যে দেখি। সাদা বাদাম ফুলে যখন গাছ ঢেকে যায়, লাল বুনো ফুলে, সকালের শিশিরে ভেজা ঘাসে, মেষপালকের গাঢ় চেহারায়… আর ভোরের নক্ষত্রে।
‘সামিহা, তুমিই তো মাতৃভূমি!’
‘আমি, হায় খোদা! তুমি জানো আমি কে? আমার বাবা কিরিয়াত আরবাতে তাদের জন্য বাড়ি বানায়, হেব্রনের জমিতে, ঈশ্বরের প্রিয় আল-খলিল।৯’ এই কি সত্যি ইব্রাহিম, ও মেহেরবানদের প্রিয়, এ কি সত্যি যে তুমি আমাদের আদিপিতা আর তাদেরও?
আর আমি একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখি, কংক্রিটের ছাদ, একটা সিংক, পানির ট্যাপ, বিছানা, জানালা আর পর্দাসহ একটা ঘর… আর একটা চাঁদ।
আমার প্রেমিকের মুখ, ও চাঁদ, তোমার থেকেও সুন্দর। আমার প্রেমিক উজ্জ্বল আর তুমি নিষ্প্রভ।
আমার প্রেমিক সাহসী আর তুমি ভীতু।
আমার প্রেমিক সেনা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়ছে আর তুমি একই রকম আলো দিচ্ছো সবসময়।
আমার প্রেমিক পতাকা উড়িয়েছে, টায়ার পুড়িয়েছে, সৈনিকদের উপর পাথর ছুড়ে মেরেছে, বাসায় লাগান পিঁয়াজ দিয়েছে যেন টিয়ার গ্যাসে আমাদের চোখ জ্বলে না যায়।
আমার প্রেমিক আজ রাতে মাসিয়াহু১০ কারাগারে ঘুমাবে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি, ও ফিলিস্তিন, আর সাবিত আমি তোমাকেও ভালোবাসি। আমি তোমাকে দেখেছি, প্রিয় আমার, আমি দেখেছি তোমার বিশাল হৃদয়, আল-মাতালা থেকে আল-নাকাব১১ পর্যন্ত বিস্তৃত; আর এর ভিতরে আছে দুটো নাম, সাবিত।
সাবিত তোমার জন্য আমাদের ভালোবাসা, অবিচল।
সাবিত শহরের কেন্দ্রস্থলে পতাকা তুলছে। আমার মার মুখ দিয়ে বের হয়ে আসছে জাঘারিত১২। ছেলে মেয়েরা গান গাইছে।
তোমার জন্যই আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়। তোমার জন্যই আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়।
ধ অক্ষর ধ্বংসের জন্য।
ব অক্ষর বাড়ির জন্য।
ক অক্ষর ক্যাম্পের জন্য।
দ অক্ষর দেহেইশার জন্য
এসবের বিরুদ্ধে তুমি কী করেছিলে? বলো কী করেছিলে, মোনা, আর তুমি সামিরা, আর তুমি খাদিজা, আর তুমু আলেফ? কী করেছিলে আহমেদ, আর তুমি সামেহ, আর তুমু হান্না, আর তুমি আলি?
তোমাদের আর আমার বাবা তাদের জন্য বাড়ি বানায় যখন তারা আমাদের ঘর ভেঙে ফেলে।
আমরা ফুল ফোটাই, যখন তারা গুলি করে।
সাবিত সাহসী আর সে কখনও স্বীকার করবে না।
আর আমরা তোমাদের ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি।
অভিশপ্ত তোমাদের মায়েরা।
আমি এখন জানি কীভাবে একটা কাচের বোতলকে মলোটোভ ককটেলে পরিণত করতে হয়।
বুলেটের সাথে ফুলের কখনও দেখা হয় না।
ট্যাংকের সাথে লিলি ফুলেরও মোলাকাত হয় না।
প্রাচীন একটা অলিভ গাছের গুঁড়িতে বসে আমি কাপ, প্লেট, চামচ ঘষতে শুরু করি।
পাখি কিচিরমিচির করছে আর রোদ আমার ঘাড়ে আদরমাখা হাত বুলাচ্ছে।
সে আমাকে বলেছিল, ‘আমি সূর্যকে তুলে এনে তোমার ফুলদানিতে রেখে দিব।’
একটা মিলিটারি গাড়ি এসে দাঁড়াল। একজন সৈনিক আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, হাতের মুঠোয় আমার চুল জড়িয়ে ধরে টান দিল গাড়িটার দিকে। ধ্বংসকারী।
ফাতাহ১৩।
বেশ্যা।
তোমার এত সাহস, তুমি গাড়িতে মলোটোভ ককটেল ছুড়ে মারো?
ভয়ংকর এক আলো ঘরে জ্বলে উঠল। কিছুটা অচেতন ভঙ্গিতে সামিহার মা তার চোখ হাত দিয়ে ঢাকলেন। তিনি দেখতে পেলেন হলুদ কমলার মতো সূর্য তার মেয়ের ফুলদানিতে পড়ছে আর তার দরজার কাছে অস্ত যাচ্ছে।
তথ্যসূত্র :
১. লেবাননের গায়ক, বাদক ও গীতিকার
২. ইসরায়েলের একটা শহর
৩. পশ্চিম তীরে হেব্রনের উপকণ্ঠে ইসরায়েল অধিকৃত একটি বসতি।
৪. ইসরায়েলের স্টার অভ ডেভিড
৫. লেবানিজ রূপকথার চরিত্র
৬. ঝঅঠঅক ছিল ইরানের শাহ সরকারের গোপন পুলিশ এবং নিরাপত্তা সংস্থা, যারা ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। সাভাক রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর সকল ধরনের নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাত এবং অত্যাচার, গুপ্তচরবৃত্তি, এবং হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমন করত। অনেক বিরোধীকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিচার বহির্ভূত হত্যা করা হতো এবং অনেকেই নিখোঁজ হয়ে যেত।
৭. ফালাফেল ফুচকাজাতীয় খাবার
৮. ফিলিস্তিনের উত্তর অংশে অবস্থিত আইন জালুত নামক স্থানে হালাকু খানের মঙ্গোল বাহিনী মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। মঙ্গোলদের পতনের সূচনা সেখান থেকেই।
৯. হেব্রন আল-খলিল নামেও পরিচিত
১০. ইস্রায়েলের রামাল্লাতে অবস্থিত জেলখানা
১১. আল-মাতালা উত্তর ইসরায়েলের শহর আর আল-নাকাব (হিব্রুতে নেগেভ) দক্ষিণ ইসরায়েলের শহর।
১২. আনন্দ, বেদনা কিংবা কারও সম্মানে আরব নারীরা মুখ দিয়ে ধ্বনি বের করেন। অনেকটা এই অঞ্চলের উলুধ্বনির মতো।
১৩. আল ফাতাহ―প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট (পিএনএলএম)
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ